Monday, 11 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২১


ভোর রাতে মুম্বাই পৌঁছলাম আমরা । আগেই লিখেছি , যার ডেরায় আমাদের মুম্বাই এর দিন গুলো কাটাবো বলে স্থির  করা ,  সে হল আমার কর্তা মশাই এর  পাড়াতুত বন্ধু , সে আমার থেকে বছর দেড়েকের বড় মোটে । আমাদের কোর্টসিপ পর্বেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল । তখন থেকেই সে  আমারও বন্ধু । পাড়াতুত বন্ধুত্ব তো বয়স মেনে হয় না , কাজেই আমার কর্তার থেকে সে বছর তিনেক ছোটই । এখন যদিও দুজনের পাড়া  ভিন্ন কিন্তু বন্ধুত্ব অভিন্ন হৃদয়ের  । সাগ্নিকের তখন বিয়ে হয়নি , ও কর্মসূত্রে ওখানে থাকত কমলকে নিয়ে । সে একাধারে সাগ্নিকের বাজার সরকার,  রাঁধুনি , সবকিছু । ওদের পূর্ব পরিচিত , বিশ্বাসী কলকাতার ছেলে । কাকিমা , মানে সাগ্নিকের মা , তার ছেলেকে একা একা অচেনা শহরে পাঠাতে নারাজ , তাই এই ব্যবস্থাপনা । কমলের যেমন সুন্দর ব্যবহার,  তেমন  রান্নার হাত । সেদিন সপ্তাহের শুরুয়াত , কাজেই সাগ্নিকের সাথে আগের বলা কথা অনুযায়ী ঠিক হল যে , সারা সপ্তাহে ওর ব্যবস্হাপনায় আমরা সব ঘুরবো , দেখবো দুজনায় । রাতে ওর সাথে দেখা হবে ঘরে ফিরে , সপ্তাহান্তে এক সাথে সবাই খেতে যাব ওর পরিচিত কোন রেস্তোরাঁতে । অতএব মেঘনাদের ভূমিকায় সাগ্নিক অবতীর্ণ হল আর আমাদের বোম্বাই ওরফে মুম্বাই দর্শন শুরু হল সেদিন একটু পর থেকেই। 

মুম্বাইতে আমার ছোটবেলার দুই বান্ধবীর বসবাস , বৈবাহিক সূত্রে । তাদের সাথেও এই সুযোগে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেবার ভাবনা মনে রয়েছে । সেই মতনই প্রথম দিন সাগ্নিকের দেখানো পথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম,  অফিস যাওয়ার পথে ভাসি (Vashi )স্টেশনে আমাদের নামিয়ে , ও চলে গেল । ওখান থেকে ট্রেনে ভি.টি , ওখান থেকে সমুদ্র তট ,তারপর খানিক সমুদ্র বিহারে এলিফ্যান্টা কেভস্ দর্শন,  ফিরতি পথে এক বান্ধবীর সাথে মোলাকাত ... বেড়ু পুরো জমে ক্ষীর । কিন্তু .... পরন্তু বলেও একটা ব্যাপার আছে তো ;  সেদিন সবই হল বটে তবে ... "কিন্তু যুক্ত" হয়ে ভরপুর ভাবে। ভাসি থেকেই যে ট্রেন সরাসরা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস (ভি.টি ) যায় , তাতে ওঠার  সাগ্নিকের নির্দেশ না বুঝে একটা দূরের স্টেশন থেকে আগত ও ভরন্ত , ভাসি হয়ে যাওয়ার ট্রেনের দেখা পেতেই কিছুই ছানবিন না করে তাতে দুজন উঠে পড়ে , দেখি বসার কোনো জায়গা নেই।  ভালো ভিড় , তবে সে ভিড় সহ্য করার মতন । আমরা দুজন ভিড়ে আর ভিতরে ভিড়লাম না , দরজার কাছেই দাঁড়ালাম। পরবর্তী স্টেশন থেকে পুরো চলমান ভিড় যখন ট্রেনে এন্ট্রি নিল , আমরা ভয়ানক ভড়কে গেলাম। দুজন মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী দুপাশে ভিড় চাপে অনিবার !!! দুর্নিবার 😳 দুজন চাপের গুঁতোয় ওমন যুক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েও ঘেমে আকুল , পরের স্টেশন ছিল বিপরীত দিকে , সেখান থেকেও আরো ভিড় ট্রেনের অন্দরে প্রবিষ্ট হল আর আমার কর্তা কানে কানে বলল( একদমই কানাকানি করার মতন কাছেই ছিল সে ) ... " পরের স্টেশনে নেমে যেতেই হবে , এ ভাবে সকলের সাথে গা ঘষাঘষি করতে পারছি না ।" ভিড় আমাদের এমন পাবলিক প্লেসে ভয়ানক রকম কাছে নিয়ে এসেছে , ওই দিনের পর ওমন মুখোমুখি আর হলাম কই ?? কিন্তু ও ছিল একদমই চাপে পড়ে দম আটকে মুখিয়ে মুখোমুখি , ওতে করে রোমান্টিক হওয়ার উপায়ের থেকে আনরোমান্টিক বেদনা আর ভয় লাগছিল । কানে মন্তর দেওয়ার পর মাথা হেলিয়ে সমর্থন জানালেও (ওই ভিড়েও জনতা মুখরিত কিনা !!),  এবারের নতুন ভাবনা গজিয়ে উঠল , নামব কি করে ?? দুজন নামতে পারবো তো ?? এর মধ্যেই খানিকটা অংশের পথ, ট্রেন সমুদ্রের ওপর দিয়ে যায় নাকি !!! নাকি এ জন্যই বললাম কারণ জনসমুদ্র ছাড়া , দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়েও আর কিছুই চোখে পড়েনি , কর্তা মশাই পরে বলেছিলেন... " দেখোনি ?? সমুদ্র? " আর সমুদ্র !!! তখন বাহুবলীর বাহু আর শার্ট ছাড়া নজরে ধরা দিয়েছে জনতার মাথা !!!! পরের স্টেশন এল , টানাটানি , ধস্তাধস্তির যুদ্ধ শেষে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে আমরা নামতে সক্ষম হলাম।  অতদিন আগে হলেও পরিষ্কার মনে আছে সেই স্টশনের নাম আর উক্ত ঘটনা .... গোয়াণ্ডি(Govandi) । এবার ???? নেমে দুজন চাপহীন জড়াজড়ি মুক্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে ভেবলে দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে ধাতস্ত হয়ে প্রথমেই দুজনে বললাম...বাপ রে বাপ  ! আস্তে ধীরে স্টেশনের বাইরে এলাম , একে ওকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর না পেয়ে একটু এগিয়েই একটা বাস ডিপো নজরে এল , আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে তিনি এগিয়ে ওখান থেকে সদ্য ছাড়া বাসে উঠে পড়লেন । আমার সামনে এলে আমিও উঠে পড়ব ... কিন্তু একি ?? বাস যে না থেমে গতি বাড়িয়ে এগিয়েই চলেছে , বিপদে মাথা কেমন যেন শূন্য হয়ে যেতেই দেখি হিরো , বাস থেকে গালি বর্ষণ করতে করতে ঝাঁপ... মাটিতে । পাশেই দাঁতের দোকান খুলে কজন অটো চালক মজা দেখছিল । তাদের কাছে যেতেই তাদের দাঁতের বিকশিত চেহারা আপাতত ঢাকা পড়ল , জানা গেল একটা অঞ্চল পর্যন্ত অটো করে যাওয়া যেতে পারে , সেখান থেকে বাহন বদল করে ভি.টি , তারপর আরব সাগরের তীরে .... । এবার  দুজন শক্ত করে দুজনার  হাত চেপে  ধরে , অটোতে চেপে বসলাম। যথাস্থানে নেমে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত এক উত্তরপ্রদেশীয় ট্যাক্সিচালকের ট্যাক্সিতে গদিওমান হয়ে অবশেষে সাগর তীরে এলাম । এতক্ষণ পর সাগরের পারে এসে মন যেন একটু মুক্তি পেলো । একদিকে "গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া " , অপর দিকে বিখ্যাত হোটেল তাজ । তখনো সেখানে আতঙ্কবাদীর ছায়া পড়েনি । ও বছরের শেষ দিকে সে সব ঘটেছিল । আমরা গিয়েছিলাম বছরের প্রথম দিকে । 

আমরা চারদিকে অনেক পায়রা আর লোকজনের চলা ফেরা দেখতে দেখতে এগোলাম , সামনেই এলিফ্যান্টা যাওয়ার ফেরি চলাচলের  টিকিট কাউন্টার।  কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন টিকিট কাটতে , আমি আস্তে আস্তে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে লাগলাম,  আমাদের বঙ্গোপসাগরের মতন জোরালো ঢেউ নয় , তবে ভাল লাগছিল।  হঠাৎই সামনে থেকে আসা দুই অচেনা ব্যাক্তির একজন আচমকা আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে টান মারতেই , চীৎকারটা মাতৃভাষাতেই বেরল ... একি !! হচ্ছেটা কি ? কর্তা মশাই টিকিট  নিয়ে সেদিক পানেই আসছিলেন , আমার গলা শুনে এক ছুটে কাছে আসতেই ,  ছুটকারা মিলল !!! আর সে আপদ রঙীন হওয়ার এক্টো করল আর আমার জীবনের  নায়ক অপরিচিত জায়গায় হিরো গিরি স্থগিত রাখল , কলকাতা হলে .... । পরে সমুদ্র যাত্রা কালে আমার আতঙ্কিত অবস্থার উন্নতিকল্পে মননিবেশ করল সে , বলল ... ওমন গরু খেদানোর শান্তনিকেতনী ঢঙে দুষ্টু লোকের মোকাবিলা হয় না । অ-মাইক গলার প্রয়োগ করা জরুরী। কি বাজে কথা যে বলে না !! আর হেঁসোরাম হয়ে যাই আমি ... অগত্যা ।

এরপর জল যাত্রা শেষে , নামলাম ডাঙায় , সেখান থেকে আবার টিকিট , এবার , টয়ট্রেন ... সব অধ্যায় পেরিয়ে কেভস পৌঁছলাম ১৫০ সিঁড়ি বেয়ে , সিঁড়ির সংখ্যা আগের ( ঔরঙ্গাবাদ ও মহাবালেশ্বর) থেকে অনেক কম হলেও,  সকাল থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনার ঘনঘটায় কিনা জানি না , এখানে  সিঁড়ি আরোহনে বেশ কাহিল হয়েছিলাম দুজনেই। সব দেখার মাঝে মুম্বাই এর ওই কেভস্ নিবাসী এক বাঁদর একবার আমার কাছে ধেয়ে আসতে আত্মরক্ষার জন্য সাথের পেপসির বোতল ( যদিও প্রায় খালি ) দিতে হল ... চিতা ভী পিতা হ্যায় জানতাম sprite এর বিজ্ঞাপনের কল্যাণে ,সেদিন থেকে জানলাম বান্দর ভী পিতা হ্যাঁয় , but Pepsi । 

ওখানকার সব কিছু দেখার পর , দুপুরের খাবার খেয়ে আবার এক প্রস্থ টয়ট্রেন ও ফেরি যাত্রা করে আমরা মূল ভূখণ্ডে ফিরলাম।  তখন ঘোর দুপুর । মালাড নিবাসী প্রিয় বান্ধবীর সাথে দেখা করার কথা বিকেলে , কাজেই হাতে তখন  অনেকটা সময় , হারা উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরলাম , সময় কাটালাম পথে পথেই । এভাবেই নাকি যে কোন নতুন জায়গার গন্ধ নেতে ঽয় । গন্ধ কতটা ভিতরে পৌঁছল , জানা নেই  , তবে ৪টে নাগাদ বন্ধুর কর্তা মশাই কে কল করে , আমরা অটো করে চলে এলাম চার্চ গেট স্টেশনের সামনে । ওখানেই ওরা আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে।  তারপর একসাথে আমরা সন্ধ্যা কাটিয়ে ফিরে যাব নিজের নিজের ডেরায় । কিন্তু ওরা বেশ দেরিতে এল , অপেক্ষার শেষ হল । 

এবার চারমূর্তির অভিযান শুরু হল । আমাদের লক্ষ্য ছিল মেরিন ড্রাইভ , সেই মতোই এগিয়ে পড়ে সেখানে হাজির হলাম । সত্যিই খুব ভাল লাগছিল , এক পাশে বান্ধবী , অন্য পাশে প্রিয় বান্ধব ... । বেড়ানোর ব্যাপারটা সব সময়ই এতো ভাল যে জঙ্গলে গেলেও কখনও ভয়ঙ্কর লাগে না , কিন্তু এই শহরে , ঘরে যখন বান্ধবগড়ের আগমন ঘটে , তখন খুবই গোলমাল লাগে । গল্পে গল্পে জানলাম,  ওরা সেদিন বাড়ি ফিরবে না , আমাদের সাথেই নবী মুম্বাই ফিরবে , তবে রাত্রি যাপন করবে ওই খারগারেই আমার বান্ধবীর মেজমাসির বাড়িতে । বাড়ি ফিরবে পরের দিন । টুকটুক মুখ চালানোর মতন ড্রাই খাবার যা ছিল , তার সদ্ব্যবহার করা হল । সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে । মেরিন ড্রাইভ এর আলোয় দৃশ্যমান হল কুইনস নেকলেস । তবে ওপর থেকে দেখার অভিজ্ঞতা কখনও সামনে থেকে হয় না , তা বলিউডের সিনেমার দৌলতে হয়ে গেছে এই যা । তবে সে যাই হোক খুবই ভাল লাগছিল । একটা সময় আমরা এবং ওরা দুই দল হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা দুই বান্ধবী আর ওরা দুই কর্তা মশাই।  পরিচয় আগে একবার হলেও,  এবার ভাল করে হওয়ার সুযোগ ঘটছে । আসলে আমার বান্ধবীর বিয়ে ঠিক হবার পর পরই , (ওর শ্বশুরবাড়ি চূঁচূড়াতে ), আমি আমার জনা তিনেক আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলাম ও দিক পানে ,  তখন যোগাযোগ করে দেখাও করেছিলাম সমুদার সাথে । ফিরতি পথে আবার বন্ধুনীকে মতামত ( আমাদের দুজনার ) জানিয়েছিল ইতিবাচক দিকেই ।

যাক গল্পের শেষ নেই ,  কিন্তু এক সময় উঠতেই হল , ভি.টি থেকে ট্রেনে উঠতে হবে । সকালের বিভীষিকার ছবি মনের ক্যানভাসে ভেসে ভেসে উঠলেও একসময় ওরা দুই জন অভ্যস্থ কায়দায় আমাকে নিয়ে ট্রেনে সিধিয়ে গেল এবং সমুদা আমাদের দুই বন্ধুর বসার বন্দোবস্ত করেও দিল । আমার কর্তা মশাই শুরুতে না পেলেও পরে বসার জায়গা পেলো । সমুদা আগেই পেয়েছিল । গুছিয়ে বসে আমাকে বলল ... " এখানে ভিড়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে , আপনিই ট্রেনে উঠে যাবে , চেষ্টার দরকারও হবে না ।" শুনলাম,  বুঝলাম কিনা জানি না , কারণ ভিড় তো জল নয় , যে ভাসবো !!! কেমন করে ভাসবো ? আর সব চেয়ে মুশকিল কি জানো ?? জলে আমার বড় ভয় !! সাঁতার জানি না যে ??

যাক এসবের মধ্যেই এক সময় ভিড় ফাঁকা হল , রাত তখন ১১ টার আশপাশে । জানলার হাওয়ার প্রভাবে আমার বান্ধবীর চোখে তখন নিদ্রা দেবী আসব আসব করছেন । এক সময় গন্তব্যও এসে পড়ল ।আমাদের নামার  পর আবার চমক .... এর মধ্যেই কখন আমার কর্তা মশাই তার বন্ধুকে ফোন করে সবার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছে । আর কমল তো আছেই হাতা খুন্তি আর উপকরণ নিয়ে ।  একেই বলে ডবল মজা । মজার ওপর মজা । অতএব একসাথে সাগ্নিকের ডেরায় ফিরে আলাপ , বিলাপ ( আমাদের সকালের ঘটনা ) , গালি , তালি সব মিটিয়ে পেট পুরে বাঙালি খাবার খেয়ে , ওরা মাসির বাড়ি চলে গেল , এখানে পৌঁছে রাস্তার থেকেই আমার বান্ধবী তার মাসির বাড়ি চিহ্নিত করেছিল , একদমই পাশে । 

সেদিনের পর্ব মিটিয়ে , অনেক ধরনের অভিজ্ঞতায় ঝোলা ভরিয়ে আমরা ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম । আগের ভোর রাতে পৌঁছানোর পর থেকে অনেক ধরনের হুটোপুটির দরুণ দারুণ ঘুমে ডুব দিলাম । পরের দিনের আরো অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে হবে তো !! তাই না ??? 

@ শুচিস্মিতাভদ্র

No comments:

Post a Comment