বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৩
ঘরের ঘেরাটোপ সবার কাছেই খুব আপন । তবুও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে পড়ি আমরা । আসলে সারাদিনের থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় এর বাইরের ডাক যারা শুনতে চায় , তাদের কখনও আকাশ ডাকে , কখনও পাহাড় ডাকে ... ডাক দেওয়ার দলে দল ভারি করতে প্রকৃতির নানান বিভাগ আছে । কিন্তু সকলে সে ডাক শুনতে পায় না । তা দোষের মোটেই না , এক এক জনের জীবনের গান এক এক রকম ।
গত বছরের বসন্তের শেষ থেকেই বাইরের ডাকাডাকিতে অনন্ত কালের তালা পড়ার উপক্রম হল , আমরা কিছুদিন ভয়ে কাটিয়ে সাবধানতার কবজ পরে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। কোন সাবধানতাই full proof নয় , তাই ভয় রইল সাথে সাথে ।
কিছুদিন ভাইরাসের প্রকোপ কমল , একটু হাঁফ ছাড়িয়ে , সমুদ্র সৈকতে ঘুরে,ঘরে ফিরলাম...তারপরেই ২য় ঢেউ এর, ফেউ হাজির আবার ঘরের বাইরে নেই কেউ ( প্রায় )। হাঁফ ছাড়তে ছাদই সম্বল । আর আমার কর্তা মশাই যেহেতু মেডিক্যাল প্রোফেশনে আছেন , তার ভাণ্ডারে ভয় পাওয়ানোর মেলাই রসদ মজুত, অগত্যা ঘরের মধ্যেই বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম । কি করি বলো !!! কদিন বেড়ু যাওয়ার আবদার করতে না করতেই লকডাউনের জন্য যে রোজগার কমতি , সেই এক বছরের পুরাতন কুমীর ছানা বেরিয়ে পড়ল ... আমিও রণে ভঙ্গ দিলাম। জানি তো !! আমার থেকেও তেনার হাঁফ ধরছে বেশি । আমি বললেই নানা পাটেকর হয়ে যান তিনি ।
যথা সময়ে আমার শিখণ্ডী, অর্থাৎ আমাদের কন্যার দিকে চেয়ে তার বাবার মন ঘুরল আর আমরাও দুই পরিবার বাপসোহাগী কন্যার লেজ ধরে গঙ্গার ধারে ডায়মন্ড হারবারের অভিমুখে রওনা দিলাম। কলকাতার কাছেই , যেতে ঠিক দু ঘন্টা সময় লাগল । ওখানকার সবচেয়ে বড় মৎস ব্যবসায়ীর জামাই এর রিসর্ট পুণ্যলক্ষ্মী । কলকাতা থেকেই বুকিং সম্পন্ন করা ছিল । হাজরার মোড় ও ল্যাণ্ডসডাউন ক্রসিং এর মাঝেই ওদের বুকিং অফিস ।
জলখাবার খেয়ে ও টুকটাক খাবার ( দরকার হয় না ) সাথে নিয়ে , মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নদীর ধারের সাময়িক বাসস্থানে।
ঘরে ব্যাগ পত্তর রেখে আকুল হয়ে সবাই বাগানে নেমে এলাম । বিস্তৃত বাগানে আণ্ডা বাচ্চার হুটোপুটিতে আমার কন্যাও যোগ দিল , তার নিজের মতন করে। অন্য সময় হলে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে তার আর তার মায়ের জুড়ি মেলা ভার , তবে এখন দুরের নিয়ম বলবৎ .... অগত্যা , সে একাই একশো পন্থা নিল ।
দুই গাছের গুঁড়িতে বাঁধা হ্যামকে এবারও এদের উৎপাতে উঠতেই হলো !! নেহাত আজকাল পরিচিত মহলে ছবি দেওয়া একটা অবশ্য পালনীয় অলিখিত বিধি ও🤣 বটে । কন্যা আমার বীরাঙ্গনা টাইপ হলেও স্লীপে স্লীপ্ করে যাওয়ার ভয়ে যখন আকুল , ঠিক তখন বছর ৪/৫ এর দুই খুদে এগিয়ে এল দিদির দিকে , প্রেসটিজে গ্যামাক্সিন পুরো !! যাক , এরপরে স্লীপের ব্যপারটা আর জমলো না , তাতে কি ?? অন্য উপায় আছে তো !!! ঝোলার ও দোলার দুরকম ব্যবস্থা রয়েছে তো !!! হ্যামক দুটি আর দোলনাও দুই , সাথে আরো কিছু । তবে সরকারি নির্দেশ মেনে সাঁতার মানা হ্যায় । আমাদের কমল মিত্র সম বাবা যদিও পুলে নামতে দিতও না , কন্যার পা ডোবানোর ইচ্ছাপূরণও বাতিল হল , কারণ পুলের পানে নজর দিলেই বাবার দৃষ্টি কুল (cool) ,আমার আবার জলের থেকে স্থলেই স্বচ্ছন্দ বিচরণ । তাই ওসবে আমার অবস্থা হেলদোলহীন।
দুপুরে জমজমাট ভোজন হল , পুরো টিম ইলিশের ভাজা আর ভাঁপায় ডুব দিলাম। কন্যার ভাজা মাছের কাঁটা বাঁছতে গিয়ে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেলেও, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে ভাঁপা মাছ বাবার পাতে বাঁছতে দিতেই আমার মেজাজ পুরো ওদিকে ট্রান্সফার হয়ে গেল । সমান সমান ভাগযোগ ... কারো বলার নেই কিচ্ছুটি । মাছের স্বাদ দুরকমের । ভাজা ছিল তাজা ,অন্য ভাঁপার স্বাদ খানিক চাপা । ফেরার দিন কাঁচা মাছের খোঁজ লাগিয়ে পেলাম না ভালো । কাছেই নগেন্দ্র বাজারে গেলে হয়তো বা দেখা মিলত ...কিন্তু!!! অনলাইন আমাদের হ্যাবিটে বারোটা নয় তেরোটা বাজিয়েছে !!! খেয়ে ঢেকুর তুলে আপামর বাঙালি অল্প ঘুরেই ঘরে ঘুমের দেশে .... । বাজারে কে যাবে ?
সন্ধ্যার সময় আলোর মালায় বাগানে যেন স্বপ্ন পুরী !! নদীর হাওয়া ... সত্যিই মনকে ঝরঝরে করার ওষুধ। তবে নদীর জলে কচুরীপানা মনকে বিষন্ন করেছে , একটু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা সব দিক দিয়েই কাম্য । পরের দিনের ভোরের আমার একার ঘোরাঘুরির পর ঘরে ফিরলাম তখনই, যখন আকাশ ভেঙে ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিন শুরু হলো । বাগানের মধ্যেও ছাদ ঘেরা অংশে এক ভ্রমণ পিপাসু ভদ্রমহিলার নাচ দেখলাম দুর থেকেই । মুগ্ধ হলাম। ঘরের রোজকার নাচন তো এ নয় , এ হল মনের খুশির প্রকাশ । বাইরের পৃথিবী , প্রকৃতি আমাদের গানে, নাচে উদ্বুদ্ধ করে ....
ঘরে ফিরে সকালের বদলে ফেরার সময়টা আর একটু বাড়ানো হল , অনেক কাঠ খড় পুড়িয়েই সই ... হলো তো !! কাজেই বেড়ানোর মধ্যে মন কষাকষি , মেঘ জমা জমি সবই হয়ে গেল । জলখাবারের পর্ব যেটা কিনা কমপ্লিমেন্টারি তা মিটিয়ে , সবাই ঘরেই ফিরলাম. .. কারণ বাগানে একটু ভিড় তাতে আমার কর্তার ফতোয়া জারি, তো কোই বাত নেহি , ঘরের জানলা দিয়েই নৌকো , জাহাজ , স্টীমার সবার যাতায়াত নজরে ধরা দিচ্ছিল আর গল্পের সাথে বিশ্রাম সবই চলছিল , একটু ঝিমন্ত , ঘুমন্ত ভাব স্নানের পর হলো .... এরপরে খাওয়া আর ভাতঘুমের পাট চুকিয়ে পৌনে ছয়টায় ফিরতি পথ জমে উঠল সত্যি ভুতের গল্পে , কিছু পরে দেখি আমার ফুলন দেবীর হাল , বেহাল ... গাড়ির বাইরে কিছুটা পথ হাল্কা অন্ধকারে ঢাকা ... ওতপাতা ভুতের খাসমহল ... আর কি !! কিন্তু সামান্য পরে পরেই আলো ঝলমলে দোকান , সত্যিই ভুতেদের ভারি মুশকিল!! যাক শেষমেষ ওসব গল্প বাদ ছাদ দিয়ে অন্য রকম গল্প আর খেলা খেলতে খেলতে ঘরে ফিরলাম পৌনে আটটায়...
No comments:
Post a Comment