বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩০
অতঃপর দারিংবাড়ি পৌঁছলাম। হাইওয়ের পাশের এক হোটেলে মৌখিক কথা বলে রেখেছিলেন আমাদের পরিচিত একজন , কিন্তু সামনাসামনি সেই হোটেল আমাদের মনের মতন হল না , তার উপস্থিতি সাইন করল না , এজন্যই হয়তো বলে পহলে দর্শনধারী .... ঘর ছোট কি বড় সেটা ঘুরতে বেরিয়ে প্রাধান্য পায় না বটে , তবে পরিবেশ অবশ্যই একখান বড়সড় ব্যাপার। দুই গিন্নি ও আমার কন্যাকে রিসেপসনে রেখে দুই বন্ধু ঘর দেখতে গেলেন ... রঙিন জলের বোতল ও কিছু রঙিন মানুষ দেখে আমরা সদলবলে ওখান থেকে দে ছুট । হোটেল সাইনের অনেক কিছুই আইনমোতাবেক মনে হল না ।কর্মসূত্রে পরিচিত এক ভ্রমণ পাগল দাদাকে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করলাম এবং সুকান্ত দার পরামর্শে অসাধারণ এক বাসস্থানের সন্ধান পেলাম , পাহাড়ের ওপরে ইকো ডিয়ার হোম .. বাজার পেরিয়ে একটু যেতেই ডানদিকে বেঁকে আরও একটু .... আবার ডান দিক...লাল মাটির পথ এঁকে বেঁকে নিয়ে এল মন ভরানোর আবাসে .... নীল নির্জনে নাকি লাল নির্জনে নাকি রামধনু নির্জনে .কতরকম রঙের মেলা !!! ... শান্ত পাহাড়ি পরিবেশ একবারেই সবার মন ভরিয়ে দিল । পাশাপাশি দুখান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরের আপাত বাসিন্দা হলাম । দুখান ঘরের একখান একেবারেই সিঁড়ির মুখোমুখি তাই একটু পৃথক করতে মন্দিরের দরজা সদৃশ দরজা লাগিয়ে একটু যেন আলাদা ।
একটু গুছু করে নিয়ে ঘরের বাইরের প্রশস্ত জায়গাতেই বসলাম, সে দিন বেরনোর কিছু নেই । সূর্য ডুবছে আর হাল্কা ঠাণ্ডা তার দখল নিচ্ছে ... ভারি ভাল লাগছিল পাশের ঘর গুলো কয়েকটি বঙ্গ পরিবারের দখলে । বেড়াতে যাব আর দেশোয়ালি ভাই , বোনের দেখা পাব না , তা কি হয় ?? তবে একদুজনের সাথে পথের দেখার ছোট্ট আলাপ হলেও, বাকিদের সাথে আলাপ বিলাপের সুযোগ ঘটেনি ।
আমার এবারের বেড়ানোর আকর্ষণ ছিল অল্প অল্প টাকা জমিয়ে কেনা শখের ক্যামেরা , যাতে almost পরীক্ষামূলক ছবি তোলা হচ্ছিল, কারণ তার সব নিয়ম কানুন এখন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে , মাথার ভিতর প্রবেশ করা সময় সাপেক্ষ, অন্তত আমার কাছে তো বটেই । পাশের সত্যদা খানিক খানিক বুঝিয়ে দিচ্ছিল , এই যা সুবিধা !! একটা ছবি দেখে মন খুশ হল কি না হল পরের ছবি পুরো মনের ওজন বাড়িয়ে একশা !! একখান ছবি দেখে সত্য দা উবাচ ... একি !!! বরফের এফেক্ট আনলি কি করে ?? দেখি ফটোর সাবজেক্ট দম্পতির পিছনের ব্যাকগ্রাউন্ড পুরো সাদা হয়ে গেছে । 😔
সন্ধ্যার সময় থেকেই সত্যদা তার ভাগ্নির পিছনে লাগতে শুরু করল ... কথিত আছে কোন এক দারিং নামধারী সাহেবের কর্মক্ষেত্র ছিল এই আদিবাসী সম্বলিত অঞ্চল। পরবর্তী কালে এখানকার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান সেই সাহেব । নিজের দেশে নাকি আর ফেরা হয়নি । কাজেই দারিং সাহেবের অশরীরি আত্মার উপস্থিতির গল্পের গুঁতোয় আমার কন্যা শেষমেষ বাইরে বসার সাহস হুস করে উড়ে গেল , সে ঘরেই নিজের মতন রইল আর আমরা ঠাণ্ডার আমেজে বসে চা ও টা খেলাম গল্পের সাথে জমিয়ে । তবে টায়ের ভাগিদার ঘর থেকে কড়া নজর রেখে তার, ভাগের টা ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল টাটা করে । রাতের খাবার খেয়ে জলদি শুয়ে পড়লাম সকলে , পরের দিন চারদিকে একটু ঘুরু বেড়ু করতে হবে , সর্বোপরি সেদিন আবার আমার জন্মদিনও বটে । কর্তামশাই বলেছেন ডেস্টিনেশন বার্থডে (?) করে দিলাম , একখান কুর্তিও দিয়েছি আর গিফ্ট চাইতে নেই ... অগত্যা !!! 🤫
ইদানীং কালের ট্রেণ্ড অনুযায়ী মধ্য রাতে অর্থাৎ কিনা রাত বারোটার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো ভীষণ রকম ইন । সে মত কেউ কেউ রাতেই জানায় , গত কয়েক বছর কর্তা মশাইও এ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী হয়েছেন । কিন্তু এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন, সারাদিনের ক্লান্তির দখলে সকলে , কাজেই ভোর বেলায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা পেলাম একে একে । ফোনের বার্তা কিছু পেলাম সকালে , বাকি পেলাম ওই দিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাসস্থানে ফিরে । যোগাযোগ ব্যবস্থার এদিক ওদিক চলতেই থাকে বেড়াতে গেলে । যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবার আমি পিছিয়ে থাকি বেড়ুর সময় , এবার দেখলাম চিত্র ভিন্ন। শুনলাম এখানে বি.এস.এন.এল আর জিও র পাল্লা ভারি । আমি প্রথম দলে পড়েছি , তাই মোটামুটি ভাবে এবারের বেড়ুতে যুক্ত ছিলাম সকলের সাথে । ফোন ছাড়া আজকাল আমরা একদমই মন কেমনের ডুব জলে , কাজেই এও এবারে এক প্রাপ্তি বলা যায় , ধরে নিলাম জন্মদিনের এও এক উপহার 😊।
সকালে ঘরের সামনের মিঠে রোদ , তেতে উঠতে শুরু করল , আমরাও জলখাবারের পাট মিটিয়ে ঘোরাঘুরির দিকে মন দিলাম। আগের দিন দলের দুই সম মনস্ক সদস্য ফোন ঘেঁটে ঘোরার তালিকা করছিল , আর রোদের তেজের ভয়ে অনেক কিছুর পাশেই ঢ্যারা দিয়ে ঘচাং ফু করছিল ... কি ভাগ্যি , আমার চোখে পড়েছিল ঘটনা খান !!! কয়েকটা স্পট বেমালুম বাদ দিয়ে দিচ্ছিল !!! সে ঢ্যারা গুলোর ওপর 2nd ঢ্যারা apply করে লিস্টিতে রেখেছিলাম। সেই মতন বেরিয়ে একে একে দেখলাম ওয়াচ টাওয়ার সম্বলিত মান্দাসুরু পার্ক ,লাভার্স পয়েন্ট ,হিল ভিউ পার্ক ইত্যাদি ইত্যাদি । পাহাড়ী ঢালে অবস্থিত পার্কে অনেক ধরণের গাছে তৈরি করেছে অপূর্ব আলো ছায়ার আলপনা । ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় মান্দাসুরু ভ্যালি । একখান জলপ্রপাত আছে শুনলাম, যা এখন শুকনো । লাভার্স পয়েন্টে জলের ধারায় পা মেলে ধরে বসে যারপরনাই আরাম পেলাম । তবে ওখানে দেখলাম, না লাভারদের দেখা মেলেনি । মেলাই গরু ,বাছুর । কার্য কারণ সন্ধানে একখান যুতসই কারণ খুঁজে পেলাম .... প্রেমের অন্যতম প্রতীক শ্রীকৃষ্ণ। আর রাধাকৃষ্ণের যুগল ছবির পাশে আমরা অনেক সময়েই দেখে থাকি গোকূলের অন্যতম এই পশুকে । একদমই শান্ত, নির্বিরোধী । চোখ দুখান ভীরুতায় মাখানো যেন ।
মাঝে দুপুরের খাবারের বিরতি ছিল । তখন ক্ষিদের সাথে সূজ্জি মামার তেজের যুগলবন্দীতে আমরা একদম মিইয়ে গেছি । পথের পাশের এক ধাবাতে থাবা গেড়ে বসে খাবারের ওর্ডার দেওয়ার পর , তীর্থের কাকের মতন হোটেলের রান্নাঘরের পানে চেয়ে বসেছিলাম সবাই , খাবার সার্ভ করার পর ... একখান্ ঝোড়ো ইনিংস খেললাম সকলে , যেখানে কথা কম , কাজ থুড়ি খাওয়া বেশি হল । ভুড়ি ঠাণ্ডা হল , সাথে মুড়ি অর্থাৎ মাথা খানিক ঠাণ্ডা হল । পুরো ঠাণ্ডা হতে গেলে দিবাকর মহাশয়ের অস্ত যাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে । এরপরের পর্বে আমরা গেলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনস্থ পাইন বনে আর তারপরেই কফি অ্যান্ড ব্ল্যাক পেপার গার্ডেনে । যেখানে এই দুই প্রজাতি ছাড়াও আরো অনেক গাছের সমারোহ । পাইন বনে আইন মোতাবেক গাছের গুড়িতে হেলে , জড়িয়ে , টুকি করে অনেক রকম ছবিছাবা হল । আমার বান্ধবী কাম কন্যার মামীর একবার মনে পড়ে গেল আমাদের ছোটকালের সেই মুভির গল্প, যেখানে নায়ক নায়িকা পরিস্থিতির শিকার হয়ে পাইন বনে পথ হারিয়ে রাত কাটালো ভয়ে ভয়ে , সকালে নায়কের পথ খোঁজাখুঁজিতে বাগড়া দিতে ব্যস্ত নায়িকা গান ধরল ... " গজব কা হ্যায় দিন , সোচো জারা ... 🎶🎶। আমাদের দিনটাও সেদিন ছিল গজব কা দিন , যদি গরমের আধিক্যকে ভুল করে ভুলে যাই । এর পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাগানে গেলাম, সেখানে কিছু গাছ অচেনা গাছ চেনা হল , চেনা বামুনের পৈতে লাগেনা , কাজেই চেনাদের আবার দেখলাম। আমাদের এবারের ঘুরু বেড়ুর এক নম্বর আকর্ষণ যদি আমার কেনা ক্যামেরা হয় , তো দু নম্বর অবশ্যই নিজস্বী ডাণ্ডা বা selfie stick , যেটি আমি কর্তা মশাই কে আসার আগে উপহার দিয়েছিলাম, তার শখের কথা মাথায় রেখেই। সেদিনের ভ্রমণে মাঝে মাঝেই তাকে নিজস্বী-দণ্ড ধরে দণ্ডায়মাণ দেখা গেছে । তা নিয়ে নিজস্বী ছাড়া বাকি ছবিই সে বেশি তুলেছে , ভ্রমণরত এক কলেজ স্টুডেন্ট তাকে আঙ্কেল সম্বোধন করে দিশা দেখাতে গিয়েছিল , একদম কানে তোলেনি , এমন পরিবেশে , এত সাজনগোজনের পর কিনা আঙ্কেল !!! রাগ হবে না !!!! তারপরে তা শুনে আন্টিসহ সাথের বিশ্বাস ভাজন সকলের কান এঁটো করা হাসি !!!! একদম ভাল নয় । very bad ।
এরপর দিনের শেষে সূর্য ডোবার পালা দেখতে আমরা পাড়ি জমালাম sunset point এ , কিন্তু রোদের তেজী রূপে বেশিক্ষণ অপেক্ষার ইচ্ছে কেমন ঝিমিয়ে গেল , আমরা ফিরে চললাম, আমাদের আপাত আবাসে । ফিরতি পথে ওখানকার কিছু অর্গানিক মশলাপাতি কিনে , সর্বোপরি আমার জন্য একখানা কেক নিয়ে ঘরে ফেরা হল । ফিরেই বারান্দার কৌনিক বিন্দুতে ডুবন্ত সূর্যের দেখা মিলল , ক্যামেরা বাগিয়ে আমি আর সত্য দা সেই মুহুর্ত লেন্স বন্দী করলাম।
আসতে ধীরে হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ হাজির হল , আর আমরা দিনের শেষের ক্লান্তি ভুলে , আবার তরতাজা হয়ে সান্ধ্যকালীন আসর জমালাম । যা সম্পন্ন হল ছোট্ট করে কেক কাটা ও খাওয়ার পর 🎂 , সাথে আরো কিছু জলযোগ যুক্ত করে । কন্যা সেদিনও আগের দিনের মতন কিছু সময় বাইরে কাটিয়ে , দারিং দাদুর ভয়ে ঘরেই কাটাল । ওখানেই পরের দিনের দিনপঞ্জী ঠিক করে নেওয়া হল আমাদের বাহন চালক টিটোর সাথে । রাতের খাবার খেয়ে যাবতীয় ব্যাটারী মায় নিজেদের চার্জ দিতে আমরা শুতে গেলাম।
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment