Sunday, 10 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ১৫


বাঙালির বেড়ানোর একাল সেকাল নিয়ে কাটাছেঁড়া করলে বেশ রকম ফেরের দেখা মেলে। আগেকার বেড়ানো দীপুদা অর্থাৎ কিনা দীঘা , পুরী ও দার্জিলিং এর মধ্যে প্রধানত  ঘোরাফেরা করলেও  তখনো স্বাস্থ্যকর গন্তব্য ছিল পশ্চিম , যেখানে মূলতঃ যাওয়ার কারণ ছিল স্বাস্থ্য উদ্ধার। আর ছিল কাশি । কাশিতে যে বাঙালির কতটা চারিয়ে যাওয়া শিকড় , তার অনেক প্রমাণের ছড়াছড়ি আমাদের বাঙলা সাহিত্যের আঙিনায় উঁকি মারলেই পষ্ট দেখা যায়। এখন বিশ্বায়নের বাতাসে আমরা দেশ , বিদেশ সবেতেই বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি । আমি আপাতত পকেট বুঝে দেশেই আছি ... বাহির( বিদেশ ) পানে চোখ মেলিনি , সাথির হিয়ার হাল বেহাল করার কোন ইচ্ছে নেই। 

তো যা বলতে চাইছি , তা হলো বেড়ানোর নানা রকমের ধরনের মধ্যে  এক রকম হলো আয়েস করে , আরামে বেড়ানো ।এর বিপরীতের দেখাও মেলে । মূলতঃ ছাত্র জীবনের পকেটমানী নির্ভর বেড়ানোয়।

 তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে বেড়ানো, অনেকটা রাজাকীয় মেজাজে , কিন্তু পকেট সামলে নিয়ে অবশ্যই। বেড়াতে গেলে আমাদের কলকাতার , কসবার ছাপোষা আপাদ মস্তক সংসারী ভদ্রবাবুর ভাবটা অনেকটাই দাড়ায় এমন .... যার নেপথ্যে মান্না দের কন্ঠের বিখ্যাত  " মেজাজটা তো আসল রাজা , আমি রাজা ন‌ই " গানটা বাজানো যেতেই পারে। তো এমন ভাবনার আগমন আকাশে , বাতাসে বেড়াতে যাওয়ার দিন দুয়েক আগে থেকেই শুনতে পাই । তো গতবছরও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আমার কর্তা মশাই এর একটা ইচ্ছা প্রকাশ পেল , যাওয়ার কদিন আগে । সেটা কি ? না , বেনারস গিয়ে মগন-লাল মেঘ-রাজের মতো বজরায় চড়ে গঙ্গা ভ্রমণ হবে। বহুত্ খুব !!!! 

সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই আপামর বাঙালির প্রথম বেনারস দর্শন। অপরাজিতর অপু নিশ্চিন্দীপুর ছেড়ে , বাবা ও মায়ের সাথে কাশি বাসি হয়েছিল জীবনের কিছু  সময়ে । অপুকে চেনে না এমন বাঙালি কি আছে ? এরপর ফেলুদার সাথেও আবার যাওয়া বেনারসের মছলি বাবার ডেরায় । এখানেই আলাপ মুকুলের ভাষায় দুষ্টু লোক মগন-লাল মেঘ-রাজের সাথে, যার আছে নিজস্ব বজরা। 

মেজাজটা ধরে থাকলেও , গঙ্গার ধারে বজরার রেট শুনে আমার রাজা মশাই ফেন্ট্ হতে হতে সামলে নিলেন । পকেট বুঝে আমরা পাঁচ জন দাঁড় টানা নৌকায় উঠলাম। বলা ভালো এক ছুটে নৌকায় উঠে ছুটকারা দিলাম নিজেদেরই।রেট শুনলাম পাঁচ হাজারের মতো । ওর নেট রেজাল্ট গঙ্গা বক্ষে নৌ-বিহার। উপভোগ্যও বটে , বাজেটের মধ্যেও বটে। নৌকায় নড়েচড়ে নিজেকে ফিট করে নেওয়ার পর , একটু ধাতস্ত হয়ে , বেশ ভালোই লাগলো... মৃদু হাওয়া ... একদম সাঙ্গিতীক পরিবেশ। নদী নিয়ে জানা শোনা বাংলা , হিন্দি সব রকমের গান হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো , আমরা দিদি - বোন ... না সাধিলেও গাইবো বলে শুরু করে দিলাম(কে আর সাধবে , দিনকাল বড়ই খারাপ )। মেয়ে ধারে পাশে নদীর গান না পেয়ে রোদের গান ধরলো .... মেঘের কোলে রোদ হেসেছে .... বিকেলের হালকা নরম রোদ তখন বেশ ভালোই লাগছিলো । 

বেনারসে এখনো বহু বাঙালির বসবাস। ওখানে বাঙালি টোলা তো একটা বাঙালি পাড়াই বটে।

বেনারসের পর এলাহাবাদ আমাদের গন্তব্য। ত্রিবেণী যে তিনটি নদীর জটলা , তা কে না জানে ? আগের বার(সেবার আসা বাতিল হয়েছিল ) সম্ভাব্য আসার আগে আমার সহকর্মী সঞ্চিতাদি বলেছিলো যে , নৌকায় করে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বলবে ... ইয়ে হ্যায় ত্রিবেণী । ওরা জলের যে দুরকম রঙ দেখাবে , নিজে কতটা দেখবে সন্দেহ আছে !! কথার চাক্ষুষ প্রমাণ এবার পেলাম । কি যে গঙ্গা , যমুনার দুরকম রঙ দেখালো মাঝি ও পুরোহিত পষ্ট বুঝিনি । সাথের লোক জন বুঝলোও , ভেদাভেদ দেখলোও । কি জানি ??? আমি বাপু দেখেছি না দেখিনি / বুঝেছি  না বুঝিনি সেই ধন্দ্বের মাঝেই দুলছি বা ঝুলছি যাই বলো !!! 

হ্যাঁ, এবার বলি সাথে পুরোহিত কেন ? পূজো দেওয়ার জন্য ??? মোটেই নয় । আমরা দেখতে এসেছি -- এ তথ্য প্রথমেই পরিবেশন করেছিলাম । বিশ্বাসই করেনি। এ একেবারেই অনাহুত পুরোহিত। যাওয়ার পথে যতো টা উৎসাহে সংসারের কল্যাণ জন্য পূজো দেওয়াতে রাজি করানোর বৃথা চেষ্টা করলেন। ফেরার সময় ওই বোঝানো বৃথা যাওয়ায় ততোধিক নেতিয়ে পড়েছিলেন। তবে নেতিয়ে পড়ার ঠিক আগের মূহূর্তে শেষ চেষ্টা স্বরূপ নৌকা থেকে হাত বাড়িয়ে জল তুলে মন্ত্রোচ্চারণ করে সবার মাথায় ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

এরপর আমরা নবাবী শহরে পৌঁছে গেলাম। টোটো আর অটো আমাদের গতবারের বেড়ুতে মূখ্য চরিত্রে অবতীর্ণ। প্রথমে বেনারসে পরে লক্ষ্ণৌতে। প্রথম দিন চালকের পাশে আসীন হয়েই ওজন জনিত কারণে বাঁধা পেয়ে একজন মুখ ভার করে আমাদের সাথেই বসলেন । আমরা এই সুযোগে একটু হেসেও নিলাম। পাচ্ছে হাসি , হাসছি তাই ... এই গোছের হাসি । খারাপ হাসিও না , ব্যাঙ্গাত্মক তো নয়ই। সত্যি সত্যি সত্যি।

লক্ষ্ণৌতে একটা বিষয় বাদে সবই বেশ মন পসন্দ। দেখার জায়গা , ইতিহাস , খাবার আর চিকনের কাজ। খাবার তো যেমন স্বাদের , তেমন পকেটের ওপরও চাপ পড়ে বেশ কম। আর নবাবী খানাপিনার কথা আর কি বা বলি !!! ওমন খাবার এখানে তো আর পাবো না !!! এই ভেবে মনটা ডুকরে কেঁদে কেঁদে উঠছে!!!!ওরা থাক ওধারেই । ওদের নিয়ে আলোচনা বাদই দিলাম। যারা ওদিক পানে যাওনি এখনো , পারলে যেও কিন্তু। আর যারা গিয়েছো , খেয়েছো , তাদের কাছে আর মাসির গল্প কি করবো ? নিশ্চয়ই তারা সব আবার যাবেই , যদি খাদ্য রসিক হ‌ও। 

এদের চিকন্-কারি আর চিকেন কারির উচ্চারণ আলাদা হলে কি হবে ? দুটো কেমন যেন একরকম শোনায়। ওতে গোলও বাধে বিস্তর । আমার কর্তার সিনিয়র এক দাদা এই গোলমেলে উচ্চরণ জনিত কারণে আর একটু হলেই স্ত্রীর জন্য উপহার স্বরূপ পাওয়া শাড়ি রিফিউজ করেই ফেলেছিলেন। নেহাৎ বৌদি র কপাল আর সেমিনারের কর্মকর্তা দের নাছোড়বান্দা মনোভাব। সেমিনারে আমন্ত্রণে

 এসে উপহার স্বরূপ মুরগি( চিকন্) কি করে নিয়ে কলকাতা ফিরবেন ... এমন ভাবনায় আকুল হয়ে , ম্যাডামের জন্য কোনো উপহার লাগবে না ... এমনটা বলেই দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মকর্তারা শুনলে তবে না ? ভাগ্যিস !!! তারা কুরিয়ার করে দিলেন। রাতে কাঁচুমাচু দাদা , স্ত্রীকে জানাতেই .... ফোনের ওপার থেকে বৌদির উচ্ছসিত জবাব এলো ... " কবে গো , কবে পাবো ?" দাদা অবাক.... পরে রহস্য উদঘাটন হলো ।

তো লক্ষ্ণৌ ভ্রমণের একদিন টোটো চালক চিকন কারি দেখাতে নিয়ে যাবে শুনে , আমার অভিব্যক্তি ছিল ... " শুধুই দেখবো ?? তো খাবে কে ?? " 

গোল যে করেছি , একটু পরেই বুঝেছি । তাই মনের ভাব মনে চেপে রেখেছিলাম। আজ বলেই ফেললাম !!! 

তো একটা বিষয় বাদ দিয়ে বাকি সব ভালো যখন , তখন বলতে হবেই কি সেই এক মাত্র বিষয় ? 

বিষয় হলো , ঘুরতে বেরিয়ে টোটো চালক, অটো চালক , রিক্সা চালক সবাই ওই গোলমেলে শব্দের চিকন্ এর দোকানে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। বলা ভালো ব্যস্ত বাগিস। যখন‌ই বেরিয়েছি হোটেল থেকে একঝাঁক মানুষ ( টোটো/ অটো/রিক্সা চালক)এগিয়ে এসেছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মার্কেটিং করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এতে আমার খুশি হ‌ওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু হতে পারিনি , কারণ এই কারণে তিতিবিরক্ত হয়ে আমার কর্তা মশাই যদি পুরো চিকন্ কারি বাগে আনতে না দেয় , তখন ????তো শেষমেশ স্বয়ং আমরাই আমিনাবাগে গিয়ে চিকন্ বাগিয়ে নিলাম। আর নবাবী খানার খাসমহলে মাটন্ , চিকেন পেট পুরে খেয়ে দিব্যি হজম করে ফিরে এসেছি। 

ফিরে এসেছি স্ব মহিমায়..... যেখানে হালকা ঝোলে ডুব দিয়েও অম্বলই আমাদের সম্বল। কিছু করার নেই । এই পৈটিক ও পৈত্রিক পেট নিয়ে জীবনের ৫০% তো পাড়ি দিয়েই ফেললাম। বাকিটা সে ভি দেখে নেবো ।।।


@ শুচিস্মিতা ভদ্র

No comments:

Post a Comment