বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৭
একটু পিছনে ফিরে দেখতে গিয়ে নজর আটকে গেল , আমাদের ফেলে আসা শুরুর দিনের পানে । বিয়ের পর এদিক ওদিক শুধুই তুমি-আমি ভ্রমণ ফেজ কাটিয়ে বছর খানেক পর ঠিক হলো , আরো কিছু সাথি নিয়ে দল ভারি করে ঘুরতে যাওয়া হবে । সেই মতন আমার কর্তা মশাই তার স্কুল জীবনের তিন বন্ধুর সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করে দিলেন । কিন্তু শুরুতেই এক পরিবার বাদ চলে গেল , কারণ তাদের একজন সম্ভাব্য যাওয়ার আগেই নতুন চাকরি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছিলেন। দুজনে তখনই না গেলেও, কর্তার বিহনে গিন্নি আর কি করে বিরহ কাটিয়ে বেড়ু যাবেন ?? অগত্যা বাকি দুজনার ( দুই পরিবার ) সাথে আলোচনা এগিয়ে গেল , সেই মতন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমরা তিন পরিবার দার্জিলিং মেইল ধরতে মেলাই বাক্স প্যাটরাসহ শিয়ালদহ স্টেশনে হাজির হলাম। এক পরিবারের কর্তা পড়ুয়া টাইপ , তার ছয় খান ব্যাগ বাক্সের অনেকখানিই নাকি ছিল বই এর দখলে , যা পরে শুনেছিলাম। তার ব্যাগের সংখ্যা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে হাসি ঠাট্টা হল বিস্তর। আমি তখন ও দলে সদ্য যুক্ত সদস্যা। কাজে সবেতেই মন্তব্য, বক্তব্য পেশ না করে শুধু হাসিই🙃🙂আমার সম্বল । সেই টিমের একজনের পরিবার বেড়ে তিনজনের হয়েছে অল্প কিছু আগে আর বাকি আরেক পরিবার তখনও হাম-তুম আর বই এ বন্দী। আমাদের ট্রেন ছিল বাতানুকূলমুক্ত শয়নের সুবিধাজনক স্লীপার। সময়ের হাত ধরে এখন বায়নাক্কার অনেক বাড় বৃদ্ধি হলেও, তখন আমরা ওসব থেকে অনেক দূরে ছিলাম।
সকলের পাশাপাশি বসার বন্দোবস্ত না থাকায় , আমরা তিন ঘরনী ও পুচকু বৃষ্টি রাণী এধারে আর ওপর তিন বন্ধু থাকল ওধারে । রাতে ও তরফের সকলেই একবার করে অর্ধাঙ্গিনী দর্শন করে গেলেন শোয়ার আগে । তখনও আমরা একে অপরের খুব পরিচিত না হলেও পরিচিতি বৃদ্ধির ভিত স্হাপন হয়ে গেল সে রাতেই । ভ্রমণ শেষে জিনিয়া হল জিনু , ঝুমা হল ঝুমস্ আর এই অধম হয়ে গেল শিলু । আমার ডাক খোঁজের নাম শিল্পী কিনা !!!
পরেরদিন ট্রেন থেকে নেমেই শুনলাম কি এক কারণ জন্য দার্জিলিং যাওয়ার দীর্ঘায়িত পথ ছাড়া , বাকি সব কটা পথই বন্ধ ... কাজে কাজেই সময় ও খরচ দুইই যে একটু বেশির দিকে পড়বে তা জানিয়ে দিলেন ওখানকার স্ট্যান্ডের ভাড়া গাড়ির মালিক ও ড্রাইভারকূল ।
পথের দৈর্ঘ যেখানে সকলের বিরক্তি উদ্রেক করল , সেখানে তখন .... আমার চোখে তো সকলই মধুর , সকলই নবীন , সকলই বিমল 🎶🎶🎶🎶🎶 অবস্থা । আমার কর্তা মশাই ওই সময় ঠিক কি ভাবছিলেন , বলতে পারব না , আমি তখন জীবনে প্রথম হিমালয় যাত্রার আনন্দে বিভোর । সারা দিন পথে থাকলেও no আপত্তি ... পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি । সব আলাপ বিলাপের শেষে আমরা সবাই যাত্রা শুরু করলাম ঘুর পথে দার্জিলিং । তখন মধ্য সকাল । জানা নাম আর অজানা পথ বেঁধে দিল আমাদের তিন পরিবারকে । পথে এক জায়গায় চা-জলখাবারের পাট মিটলো ধুমায়িত মোমো দিয়ে । আমাদের দার্জিলিং যাপন কাল ছিল দু রাত , তৃতীয় দিনে কথা মতন আমরা নেমে আসব কালিম্পং । সেখানেও দু রাত থেকে পুরোপুরি নেমে যাব সমতলে , তারপর ফিরতি ট্রেন এন.জে.পি থেকে । কালিম্পং এ জিনিয়ার ছোটবেলা কেটেছে । কর্মসূত্রে কাকু অর্থাৎ জিনিয়ার বাবা ওখানে কিছু বছর ছিলেন । আমাদের আলোচনার শুরুতেই জিনিয়ার অনুরোধ ছিল , একটু ছোটবেলার অঞ্চল ভ্রমণ ... সেই মতন সব ব্যবস্থাপনা ।
পথে সাথের খুদে সদস্যের জন্য এক জায়গাতে গাড়ি থামিয়ে সকলে নামলাম। পাকদণ্ডীর মাঝে আমরা , একদিকে খাদ , একদিকে পাহাড় , পাইন গাছের সারি , ঠাণ্ডার কাঁপুনির মাঝে শুধুই আমরা । কি যে অপূর্ব লাগছিল !!! কিন্তু বাহন চালকের তাড়নায় প্রকৃতির মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা হল না , সবাই গাড়িতে চড়েই প্রকৃতি অবগাহনে মগ্ন হলাম । গল্পও চালু ছিল প্রকৃতি দেখার ফাঁকে ফাঁকে , বেশ খানিক পথ পেরনোর পর ড্রাইভার দাদা , আমাদের জলদি জলদি গাড়িতে ওঠার জন্য দেওয়া তাড়নার কারণ ব্যক্ত করলেন । শুনে তো সবাই খানিক বাক রহিত হলাম । হয়েছিল কি !!! এ পথে ওনার নিত্য যাতায়াত, কখনও যাত্রী নিয়ে পাহাড়ে উঠছেন , তো কখনও বা নামছেন সমতলে ... দিন পাঁচেক আগে ওখানেই এক চিতার সাথে মোলাকাত হয়েছিল । যদিও পাহাড়ে এ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা , কিন্তু আমাদের গাড়ির বাইরে অবস্থান যথেষ্ট বিপদজনক এমন পরিস্থিতিতে । সেই চিতা ওখানে আছে না নেই তার পুরোটাই unseen । আমাদের নামার সময় বিষয়টা বলে যেমন ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে চাননি , আবার আমরা নামার পরও দুশ্চিন্তার থেকে অব্যহতিও পাননি । আমরা চলেছিলাম ঘুরপথে মংপু হয়ে। ওখানে কবিগুরু যেখানে থাকতেন , তার পাশ দিয়েই আমাদের যাওয়ার পথ , কিন্তু সেবারও নয় , এখনও ওবধি ওখানে যাওয়া তোলা রয়েছে । আমার একার ইচ্ছা ভোটে হেরে গেল , সবাই তখন গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য রীতিমত অধীর হয়ে উঠেছিল ।
এক সময় পথ শেষ হল আমরা দার্জিলিং পৌঁছলাম । আমাদের বাসস্থান ঠিক করা ছিল এক হলিডে হোমে , যেটার মালিকের নাম এখনও মনে আছে , পাহাড়ী এক মহিলা বেণুদি । হলিডে হোমটি ছিল আমার ভাসুরের অফিসের পরিচিত একজনের মাধ্যমেই বুকিং করেছিলেন দাদা । খানিক খোঁজাখুঁজির পর ম্যালের থেকে খানিকটা নীচে গভর্নর হাউসের দিকের রাস্তায় দেখা মিলল হলিডে হোমের । তিনতলা বাড়ির দুই আর তিন তলা মিলিয়ে থাকার বন্দোবস্ত। ঘরের সামনের টানা বারান্দার এক পাশ দিয়েই ওপরে ওঠার সিঁড়ি । দোতলার পাশাপাশি দুখান ঘর আর তিন তলায় আরও একখান ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল । দলের মধ্যে আমাদের বিবাহিত জীবনের বয়স যেহেতু সব থেকে কম (১ বছর ৩ মাস ) সকলেই আমাদের তিন তলার নিভৃত কোণে পাঠিয়ে দিল দুষ্টু মিষ্টি হাসি হেসে ।
ঘরে ঢুকে সব খানিক বুঝে নিয়ে আর ওখানকার ঠাণ্ডার সাথে আলাপ চারিতার মধ্যেই একে একে নিজেরা একটু ফ্রেস হলাম । জল গরম করে নিতে হল ঘরের লাগোয়া রান্নার জায়গায় । আপাতত ঘুরপথে ঘোরার দরুণ ভালোই ক্ষিদে পাওয়ার কথা , কিন্তু সে সবের আন্দাজ করে আমরা ভারী জলখাবার ও সাথের মুখ চালানোর মতন শুকনো খাবারের চালান পেটে দিতে দিতেই পথ ধরেছিলাম , কাজেই ফ্রেস হয়ে সবাই নিজেদের মেলে ধরলাম ম্যালের পথে । মেলা চড়াই পথ , কিছুক্ষণের মধ্যেই হেঁপো রুগীর মতন হাঁপিয়ে পড়লাম সবাই । গলা পুরো শুকিয়ে শুষ্কং কাষ্ঠং । তো যাই হোক শেষমেষ ম্যালে পৌঁছলাম। আমার কর্তা মশাই আগে অনেক বেড়িয়েছেন, পাহাড়ও তার কাছে নতুন কিছু নয় , কাজেই তিনি আমার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস যারপরনাই উপভোগ করছিলেন। ওখানে অনেক ঘোরাঘুরির পরও কাঞ্চন দা মানে কঞ্চনজঙ্ঘার দেখা দিলেন না । মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে রইলেন । আসলে পরে অভিজ্ঞতা আর বয়সের উচ্চাসনে বসে বুঝেছি যে বছরের কিছু বিশেষ সময়ই তিনি দর্শন দেন এবং সে মতন অল্প কিছু বছর আগে মন ভরিয়ে দিয়েছিলেন দর্শন দিয়ে । অন্য সময় দেখা দিতেও পারি , আবার কেন দেবো এই ভাবনার মধ্যেই টুরিস্ট কূল মন বেদনায় আকূল হয়ে সমতলে নেমে আসেন । কারো করো ভাগ্যে যে শিকে ছেঁড়ে না , তা নয় । তবে সবটাই সম্ভাবনার ঝুলিতে । একবার নির্ধারিত সময়ে এন.জে.পি স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন থেকে নামার আগেই কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দেখেছিলাম স্লিপিং বুদ্ধাকে । তো যা বলছিলাম....
সেদিন আমরা ম্যালে বসেই ঠিক করলাম, রাতের রান্না নিজেরাই করব হলিডে হোমের রান্না ঘরে । প্রতিটা ঘরেই লাগোয়া রান্নাঘর । মেনু ঠিক হল বাঙালি মুগ ডালের খিঁচুড়ি ,বেগুনী , ডিম ভাজা আর পাঁপড় ভাজা । ঠাণ্ডায় বেড়ু পুরো জমে উঠল । আমরা দুজন সেই মতন ম্যাল থেকে একটু নীচে নেমে স্থানীয় বাজারে চললাম রেশনীং এর জন্য। সব ঘুরে ঘুরে কিনে ফেরার পথে লাল টুকটুকে একখান টুপিও পরিয়ে দিলেন🤫 কর্তা মশাই, যাতে আবার পাহাড়ের ছবি মজুত।
ফিরে আমরা জমা হলাম দোতলার একজনার ঘরে । উজ্জ্বল দা আর ঝুমার ঘরের লাগোয়া রান্নাঘরেই সে রাতের খাবার তৈরির স্থান নির্বাচন করা হল । আস্তে ধীরে অন্ধকার আর ঠাণ্ডা দুই পড়ল জাকিয়ে , কমন বারান্দার দিকের দরজা বন্ধ করে আমরা গল্প শুরু করলাম। এক দুবার তিন ধূমপানকারী বাইরে বেরলেও ঠাণ্ডার দরুণ জলদি ঘরে ঢুকে পড়ল। আমিও একবার বাইরে আলোর জোনাকি জ্বলা পাহাড়ী শহরকে দেখতে গেলাম। তবে একই রকম ভাবে , ঠাণ্ডা রোমান্টিক হওয়ার সুযোগ দিল না আমাকে । প্রকৃতির নানান রূপে আমি বার বার মুগ্ধ হই , সেই রূপে অবগাহন করতে আমার দারুণ লাগে চিরকাল। সেখানে একা না দোকা সেটা পুরোই গৌন।
চায়ের সাথেটা দিয়ে গল্পও চলতে থাকল , খানিক পরে তিন ঘরণী রান্নাঘরে লেগে পড়লাম রন্ধনে । একসময় গল্পও জমে উঠল , সাথে খিঁচুড়ির সুবাসে সবার ক্ষিদে চাগিয়ে উঠতেই সকলে থালা বাগিয়ে ধরল । বেগুনী ,ডিম ভাজা ও পাঁপড় ভাজা সহযোগে খিঁচুড়ি দিয়ে জমাটি ভোজ সাঙ্গ করে , প্রায় ১১টা পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে খোলা সিড়ি বেয়ে ওপরের ঘরে হাজির হলাম। মনে আছে স্পষ্ট ... ঘরে ঢুকেও অনেকক্ষণ কাঁপুনি মোডে ছিলাম ।
পরের দিন প্রথমেই সর্ব সম্মতিক্রমে হলিডেহোম বদল করে চলে আসা হল ম্যালের এক হোটেলে । হলিডে হোমের কিছু অব্যবস্থা ছাড়াও ম্যালের থেকে দূরত্বের জন্যই এই অদলবদল সাব্যস্ত হয়েছিল।
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment