Monday, 11 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৬ 


পুরীর এবারের অধ্যায়ে প্রথম দুদিনে যথাক্রমে পূজা আর খরিদারির পর্ব মিটল নিয়ম মতন । সেদিন রাতে কন্যা তার মৌ আন্টির ঘরে নিদ্রা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই , তার পিতাশ্রীর মুখ ভার হল । নানা পাটেকরের না-বাচক রাগ রাগিনী খানিক চেষ্টার পর হ্যাঁ-বাচকে পরিণত করার পরিণতি পুপের ভিন্ন ঘরে নিদ্রামগ্ন হওয়া । পরের দিন আমি ভোরে উঠে হাঁটা দিলাম সমুদ্রের পারে । ইতি উতি জনতার জমায়েত সেথায় , সবার নজর সুজ্জি মামার আগমনের দিকে । আমিও খানেক অপেক্ষার পর সূর্যোদয় দেখে ফেললাম , কিছু  ছবি তোলার পর বালি পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাথে উঠে এলাম ... না , হোটেলের দিকে না গিয়ে সোজা লাইট-হাউস মুখী হয়ে ওদিক পানে আরো একটু এগিয়ে পড়লাম।  বেশ লাগছিল । পথে মানুষজন  আছে , কাজেই অসুবিধাও নেই । আমাদের সাথীরা সকলেই নিদ্রামগ্ন, আমি ডাকাডাকি করি নাই  । কাজেই সময়টাকে নিজের মতন উপভোগ করতে করতে সামনে এগোলাম। আগে , এক সময় , সকালে হাঁটা শুরু করেছিলাম ,  পরে কন্যার পিছনের নাচন শুরুয়াতের পর হন্টনের  বন্টন হয়ে গেল অন্য  রকম কাজে !!! অগত্যা .... অনেকদিন পর সমুদ্রের ধারে ধারে হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল।  পথের পাশেই ফণী বিদ্ধস্ত দুই হোটেল দেখলাম।  একটার ওপর তলা পরিত্যক্ত,  অন্যটি পুরোটাই ধ্বংসাবশেষ। খারাপ লাগল দেখে , আরো কিছুটা হেঁটে , এবার আবার ফেরার পথ ধরলাম, ঘরে ফিরে মঞ্জুশ্রীর বানানো চা খেতে খেতেই আগেরদিনের ঠিক করা সেদিনের কার্যসূচীর আলাপ আলোচনা শুরু হল । 

পুরীর আশেপাশে অনেক কিছুই যাওয়া যায় দেখতে , তার মধ্যে যাওয়া ঠিক হল দুই শিল্প গ্রামে , যেখানে যাওয়ার বাই এখন মোটামুটি পুরীতে আগত সব ভ্রমণ পিপাসুর তালিকার শীর্ষে । আমি নিজেও আসার আগে দুজনের কাছে শুনেছি । ফেসবুকের কল্যাণে এই শিল্প গ্রামের কথা একদা পড়েও ছিলাম , ভুলেও ছিলাম 😔,  মনে করালো এক বান্ধবী আর আমার ভাসুর ঠাকুর ।

 জলখাবারের পাট চুকিয়ে , হোটেলের বাগানে ছবিছাবা তুলে আমরা সবাই রওনা দিলাম।  শিল্প গ্রামের সাথে আরো কিছু জায়গা লিস্টি মোতাবেক যাওয়ার কথা হলেও,  আমাদের অলিখিত ও অকথিত চুক্তি মতন সবটাই সবার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল।  

শিল্প গ্রাম রঘুরাজপুর , বিখ্যাত তার পট চিত্রের জন্য। অরিজিনাল পটের দাম যে বেশ বেশি , সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেও।  সে ধারণা শুধুমাত্র  বেশির ধারণা  , কত বেশী , কি মূল্য তার ধারণা না ছিল  আমার , না ছিল তেনার  , কাজেই বেরনোর সময় তিনি ওখানকার শিল্প কর্ম খরিদ করার অভয় বাণী দিতে , বেশ অবাক হলেও,  মন খুশ হয়ে গেল। কিন্তু পটের মাঝে পড়েই ঝটপট ওসব অভয় বাণী ভুলে প্রথমেই ... নিতে পারি , কিন্তু কেন নেব টাইপ ভাব নিয়ে , গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরপাক খেতে লাগলাম । সত্যি বলতে কি অসাধারণ শিল্প কর্ম !!!  পট তৈরি হয় ছেড়া শাড়ি অথবা কাপড়ের সাথে কেমিক্যাল মিশিয়ে , তারপর তার উপর আঁকা হয় পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র। পট ছাড়াও নানা রকম পাত্র , শিশি , বালতি , নারকেলের গায়ে চিত্র অঙ্কন ।দীর্ঘ সময়ের শিল্প কর্ম । দেখা সার্থক , আসা সার্থক । কথার খেলাপ নিয়ে কর্তার গিন্নির চাপানউতোরের ভিতরেই আমরা গাড়ি চেপে বসলাম। দুজনেই তখন হাড়ি মুখো । কর্তার বক্তব্য ... কিনে দিলাম শাড়ি , তার পরেও মুখ কেন হাঁড়ি ?? গিন্নির বক্তব্য যদি দিতে নাহি পারি তবে কেন কথা  ভারি ভারি ??? 😬

আড়াআড়ি করতে করতে মুখে কুলুপ এঁটে , পরবর্তী শিল্প গ্রাম পিপলি / পিপিলিতে পৌঁছলাম।  এটি ঠিক গ্রাম নয় , আধা শহর । আর রঘুরাজপুরে আমরা শিল্পীদের বাড়িতেই গিয়েছিলাম,  এখানে আমাদের বাহন চালক পশরা সাজানো এক দোকানে হাজির করলেন । পিপলির শিল্প ভিন্ন।  এখানে বিখ্যাত  এপ্লিকের কাজ । নানা রকমের ব্যাগ , ছাতা , ওয়াল হ্যাঙিং , ঘাগরা ইত্যাদি সহ অন্যান্য আরো অনেক ধরনের অনেক স্হানের শিল্প পশরা ঘুরে দেখলাম। 

এখানে আমি কিছুই কেনার মুডে ছিলাম না । কিন্তু আমি যেদিকে হাঁটব তিনি ভিন্ন দিকে যাবেনই । তো তিনি এবার কেনার বায়না জুড়লেন 🙄। আমি ছোট কিছু টোকেন কিনলাম,  হঠাৎই নজর কাড়ল কাঠের তৈরি পুতুল , যার পেটের ভিতর আরেকজন,  তার পেটে আরও একজনা ... এ ভাবে কোথাও ৫ ,কোথাও বা ৭ ।কেউ মহিলা,  কেউ বা পুরুষ। এমন পুতুল আমাকে আমার ছোটবেলায় নিয়ে গিয়েছিল আগের দিনই।  আবদার করতেই তখন  নানা পাটেকর বলে উঠে ছিলেন ... নেহী নেহী আভি নেহি । তবে ওটা আসলে  কভি নেহীই ছিল । আর এখানে সাধ আর সাধ্য সমানে সমানে , তাই বাছতে শুরু করলাম,  সাথে আমাদের রিমিও যোগ দিল , কিন্তু ওর ঘরেও ছোট নানা পাটেকর মজুত,  তিনি আবার , এমা পুতুল !! এ ধারার   মুখের এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেন যে রিমি বেচারীর মনটা ঝিমিয়ে গেল একেবারে । এ সব অদরকারী জিনিসের কদরকারী আমাদের দলে আমরা মহিলা মহল বাদে একজন‌ই।  ঠিকই ধরেছ তিনি আমাদের সত্য দা।  দাদাভাই এসে হাল ধরলেন ... " কিনবি ?? তো কিনে দিচ্ছি।" রিমি একটু ঘেঁটে গেল ... সত্যিই নাকি মজা ?? ... দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেষ দুজনে কাঠের পুতুল নিয়ে পিপলিকে বিদায় জানালাম। 

পেটে পিলপিলিয়ে  ছুঁচোর দল তখন কনসার্ট বলো , কীর্তন বলো শুরু করে দিয়েছে । প্রখর তপন তাপে মাস্কবাদী প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত প্রায় । বাদবাকি দর্শনীয় স্থানের তালিকায় ঢ্যারা দিয়ে সবাই এক বাক্যে পেট পূজোর মন্দির অন্বেষণ শুরু করলাম। অচিরেই মিলল ভোজনালয় । সকলের পছন্দসই থালি অর্ডার করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।  গরমাগরম  থালির আগমনও হল যথা সময়ে । খিদের মুখে সবই অমৃত। খেয়ে ঢেকুর তুলে গাড়ি চড়ে , এবার ফেরার পথ ধরলাম।  

ফেরার পথে হোটেলের কাছাকাছি এসে হঠাৎই আমাদের ম্যানেজারের নির্দেশ মেনে আমরা হোটেল ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম ... লাইট-হাউস পেরিয়ে আরো এগিয়ে গেলাম,  এক সময় হোটেলের সংখ্যা কমে , শেষ হল , আরো একটু এগিয়ে গাড়ি থামিয়ে আমরা নেমে পড়লাম ... আর একটু এগিয়েই নাকি মোহনা , এদিকটা বেশ ফাঁকা , বালি পেরিয়ে দলের কজনা হাঁটা দিল , আমার কন্যাও এগিয়ে গেল , আমরা কজন বয়ঃজেষ্ঠ ও জেষ্ঠারা , রাস্তার ধারের বাঁধানো অংশে বসে ও দাঁড়িয়ে দেখলাম অসংখ্য গাঙচিলের মৎস শিকার । ভারি ভাল লাগছিল । সারা দিনের ঘোরার পরের পরিশ্রান্ত শরীর ও মন যেন একটু আরাম পেলো । বেশ গরম আবহাওয়া জন্যই আমরা সকলেই বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।  এরপর হোটেলের ঘরে ফেরার পালা । ফিরে একটু গুছু করতে হলো , পরেরদিন আমাদের নিজ নিকেতনে ফেরার পালা । একটু গুছু ও বিশ্রাম নেওয়ার সময় আগের দিনের খরিদ করা সামগ্রী আবার অবলোকন করতে মেলে বসতেই নজরে এল যে , দোকানদার ভুল বশত একখান চুড়িদার পিস দাম না নিয়েই সাথে দিয়েছেন । কি কাণ্ড  !!! 

পূজোর আগে আগেই এক অনলাইন কেনাকাটির বিভ্রাটে পড়ে অনেক গুলি অন্যের জিনিসের আমার ঠিকানায় আর আমার জিনিসের ভিন্ন রাজ্যের ঠিকানায় যাতায়াত নিয়ে ভারি গোলযোগের মধ্যেই পড়েছিলাম,  কিন্তু এ তো অনলাইন নয় , এখানেও এক ভুল ?? সাথের শরৎ দা শুনেই বলে ফেলল যে , দেশের সব প্রদেশের বিক্রেতাই তোমার মতন ক্রেতা পেয়ে আহ্লাদে আটের জায়গায় ষোলখান হয়ে নানা কিছু উপহার স্বরূপ দিয়ে খুশি করছে । ভেবে আর কি করবে ? নিয়ে নাও। সাথের জনা দুই চেপে যেতে বললেও,  ওসবে আমার বিস্তর সমস্যা , তাই আবার দোকানে চললাম,  সমস্যা মিটল নগদে ,  ঘরে ফিরে এই বারের মতন আড্ডার হাট বসল আমাদের ঘরে । রাতে খেয়ে উঠে , মন যেন অবসন্নতায় ছেয়ে গেল । মন বলল ... আবার বেড়ু হলেও অদ্যই শেষ রজনী এবারের।

পরের দিন ভোরে উঠে সমুদ্রের পাড়ে গেলাম , সাথে মঞ্জুশ্রী । না , সেদিন দুজনে হাঁটাহাঁটির মধ্যে না গিয়ে , অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ও পরিষ্কার দেখে বালির ওপর বসে দেখলাম সূর্যোদয় । গল্পের ফাঁকে হঠাৎই দেখি সত্যদাও হাজির । একসময় ওখান থেকে উঠে একটু এগিয়ে চা বিস্কুট খেয়ে ফিরলাম হোটেলে । আরেক প্রস্থ চা খেয়ে , জলখাবারের পর দলের সকলে আমাদের কাছে ছোট্ট আদিকে রেখে সমুদ্দুরে স্নান আর সেই সাথে তাকে ,যাই যাই বলে বিদায় জানাতে গেল । আমরা গেলাম না কন্যার জন্য,  তেনার অল্প গলা খুশ খুশ ,আমি  অথবা তার বাবা স্নানে গেলে তার সাথে যুক্ত হতো পুপের  উসখুশ । অগত্যা বাবা ত্যাগ স্বীকার করলেন । আমি জলের থেকে স্থলেই বেশি স্বচ্ছন্দ,  কাজেই আমার ক্ষেত্রে নো মনকষ্ট । এরপরে গল্প একদমই অপ্প অপ্প । দুপুর গড়িয়ে বিকেল , তারপর সন্ধ্যা ... আমরাও তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্টেশনে এবং ট্রেনে হাজির । এবার পাশাপাশি আর কাছাকাছি সকলে । সাথে হোটেল থেকে আনা রাতের বন্দোবস্ত ... অবশ্যই খাবারের । যাওয়ার উত্তেজনার সিকি ভাগও তখন নেই,  কাজেই খাওয়ার পর ঘুমের ব্যবস্থার পর সবাই মোটামুটি ঘুমের দেশে , দিনের শেষে।এবারের ট্রেন হেঁচকিহীন তাই নিদ্রাহীন হওয়ার সম্ভাবনা মুক্ত।  ঘুম একবার অল্প ভাঙলেও , পুরোপুরি ভাঙল হাওড়া হাজির হওয়ার কিঞ্চিত আগেই । সব গুছু করতে করতেই  হাওড়া হাজির । আমরাও একে একে সব গুছিয়ে নেমে পড়লাম...দাদা মানে আমার ভাসুর ঠাকুরের পাঠানো গাড়ি করে ভোর ভোর ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে এলাম।  অনেক অনেক তাজা বাতাস নিয়ে আরো অনেক কাজ করার প্রতিশ্রুতির সাথে সাথে মনে মনে বললাম ... আবার যাব বেড়ু , কেমন ???

@শুচিস্মিতাভদ্র

No comments:

Post a Comment