Sunday, 10 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ১৬


বেড়ানোর মজার ঘটনার কথা লেখার শুরু করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আস্তে ধীরে। হঠাৎ আমার এক বান্ধবী কাম পাঠিকার অনুরোধে আবার কলম ধরতেই হোলো। যে ঘটনার ঘনোঘটা নিয়ে লেখার অনুরোধ , তা কতোটা মজার , তাতে সন্দেহ আছে যথেষ্ট । বলার মতন ঘটনা অবশ্যই, কিন্তু মজার বোধহয় নয়। 

যে কোনো বিষয় লিখতে গেলে গোড়া থেকে শুরু করাই আমার স্বভাব । to the point answer লেখা , একদা আয়ত্তে ছিল , এখনও ছাত্রছাত্রীদের ওমন গাল ভরা জ্ঞানের বাণী দিয়ে থাকি ... বিষয় অনুযায়ী দরকারি সব লেখার আর অদরকারি বিষয় বাদ দেওয়ার নির্দেশ... এই সব আরকি !!! কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে ... কিছু কথা বিস্তারে শুরু করলেই আমার কর্তামশাই কথার মাঝখানে কেটে ছেঁটে  বিষয়কে পয়েন্টে এনে ফেলেন। তবে কিছু কিছু আমার নিজস্ব এলাকায় একদমই আমি হাত গলাতে বা নাক গলাতে দিই না । সেখানে আমি আমার মতন‌ই চলি । 

তো কথা হলো গিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ইতিবৃত্তের উপস্থাপনা । তো ছোট্ট পুপের যখন ১০/১১ মাসের বয়ঃক্রম, তখন দুজন মিলে ঠিক করলাম ওর বেড়ানোর হাতেখড়িটা দিয়ে দেওয়া উচিত। অনেকেই আঁতকে উঠলেও , এই সব বিষয়ে আমার আবার বলতে নেই সাহস ভালোই। আসলে ভয়কে আমরা জোরকদমে জয় করি , যেখানে আমাদের পছন্দ , ভালোলাগা, ভালোবাসা জড়াজড়ি করে থাকে।আর নিজের পছন্দের অনুকূল মতদানকারী যদি কিছু পেয়ে যাই, তবে তো সোনায় সোহাগা । আমার ছোটবেলার বান্ধবী এষা প্রবল ভাবে উৎসাহিত করলো , একেবারে আমার মতন‌ই বিস্তারিত গতে , with check list , যেহেতু সাথে হাতেখড়ির নতুন সাথি। হোক একটুকুন !!! তার জিনিসের কোণায় একটু খানি নিজেদের জিনিস ঠুসে একরাতের জন্য চললাম ঘন্টা দেড়েকের গন্তব্য দেউলটিতে। এখন অবশ্য সবার সব রকম জিনিস বোঝাইয়ের পদ্ধতি এতোদিনের অভ্যাসে করায়ত্ব। সত্যদা ও মঞ্জুশ্রীদের গাড়ি চড়ে সকালে বেরিয়ে পড়লাম। বেড়ানো যে ছোটজনের মজ্জাগত, বুঝতে অসুবিধা হলো না। যাওয়া, আসা, থাকা , খাওয়া,কথা শিল্পীর  বাড়িতে বেড়ু, গ্রামের নাটমন্দিরে একটু বিশ্রাম, নদীর দর্শন সব মিলিয়ে হাতে খড়ি ভালোয় ভালোয় মিটেও গেল। 

খুশি মনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম পরের পর্বের আর একটু বেশি দিনের বেড়ানোর। কোথায় হতে পারে , কোনো আন্দাজ ??? পুরী ছাড়া আর  কোথায় বা হতে পারে , তোমরাই বলো ?? শুরুর ঘটনা যখন পুরী কেন্দ্রিক । 

পূজোর পরেই যাত্রা। পূজার আসে পাশে প্রতিবার‌ই নিম্নচাপ  হানা দেয় উপকূল বরাবর, সেবারও পিলিন এলো । পিলিন কিলিন মানে clean হতে , আমরাও সব গুছু করে বেড়ু অন মোডে নিজেদের ফিট করে নিলাম। এবার‌ও টিম দেউলটি অন। শুরুতে ই হারালো আমাদের টিমের দুখান ছাতা। গরিবের কথা বাসি না হলে কেউ কি কান দেয় ? যখন তাতে  মান যুক্ত হয়, তখন পুরো ব্যপারটা দাড়ায় ... It's just a fun । দুই ছত্রপতি আমাদের কথা অগ্রাহ্য করে হ‌ওড়া অভিমূখী ট্যাক্সির সীটের পিছনে ছাতা দ্বয়কে শুইয়ে রেখে , পরে বাহন চালককেই বোধহয় তা আসন্ন বৃষ্টি উপলক্ষে উপহার স্বরূপ দিয়ে থাকবে !!! কি জানি , কি কারণ !!! যখন খেয়াল হোলো , তখন আমরা লটবহরসহ হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে । তখনো জানি না ভবিষ্যতে ছাতা খোয়া গিয়ে কি দূর্গতিতে পড়বো !! তবে ওই দূর্যোগে ছাতা থাকা , না থাকারই সামিল।

জনশতাব্দী এক্সপ্রেস শেষ দুপুরে ছেড়ে , পুরোপুরি পুরী পৌঁছবে রাতের দিকে। আর আমরা ট্রেনে রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে , যখন পুরী পৌঁছে যাবো, হোটেলে পৌঁছেই দে ঘুম .... এমন ভাবনায় ডুব দিতে দিতেই র‌ওনা দিলাম। কল্পনায় পরের দিনের সমুদ্র থেকেই সূর্যের টুপ করে উদয় হ‌ওয়ার দৃশ্যও দেখে ফেললাম। এবার পুপে ট্রেনে প্রথমবার ... কিন্তু বলতে নেই , আচরণ বেশ ভালোর দিকেই। যদিও ছোটদের গ্রহণযোগ্যতা আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি। আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী পুরী গিয়েছিল তার ছয়মাসের ছেলেকে নিয়ে। সেদিক থেকে পুপে আরো কমাস এগিয়ে তবেই শহরের বাইরে পা রাখলো। 

গল্প পড়া, গল্প করা, গান শোনা, পুপেকে কোলে নিয়ে ঘোরাফেরা, তাকে খাওয়ানো, নিজেদের খাওয়া ... এসবের মাঝে সময় কখন এগিয়ে ঘড়ির কাঁটা দশটায় পৌঁছেছে, খেয়াল নেই। বাইরে তোড়ে বৃষ্টি হচ্ছিল, শব্দে জানান দিচ্ছিল। সময়ের খেয়াল হলো তখন , যখন দশটা নাগাদ ট্রেন অচল হলো । ঘন্টা খানেক পর সকলের চেষ্টায় খবর সংগ্রহ হলো যে, তুমুল বৃষ্টির জন্য দেরি হচ্ছে। একঘন্টা পর সচল ট্রেন থেমে থেমে এগিয়ে সাক্ষী গোপাল স্টেশনে পৌঁছে সেই যে হেঁচকি তুলে থামল .... তারপর চালু হয়ে যখন আমরা অবশেষে পুরী পৌঁছলাম , তখন রাত দুটো ছুঁই ছুঁই ।তার মধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে, পুপে ঘমন্ত, আমি চিন্তত অথচ ঝিমন্ত, বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে আসা জলে অর্ধেক ভিজন্ত😝। সরে বসার উপায় উধাও... কেন ? কেন আবার ? কোলে বিচিত্র মুদ্রায় নিদ্রায় মগ্ন আমার কন্যা। একটু নড়লেই বিপদ আর জাগন্ত হলে আরেক  ধরনের বিপদ যদি আমার মধ্যে সিধোয় , সেই ভয়ে আমি মূর্তিবৎ ... নট নড়ন চড়ন । ওই আবহাওয়ার গোলোযোগ  নাকি ছিল পিলিনের চলে যাওয়ার আগের বাঁধন ছাড়া কাঁদন। তার জেরেই একটা ছাড়া পুরী স্টেশনের বাকি সব লাইন আইন মোতাবেক ছিল না আর তাতেই এ হেন দূর্গতি । 

প্ল্যাটফর্মে নেমে জনসমুদ্রে ভাসলাম, ওপর থেকে বরুনদেবের কৃপা বর্ষন চালু ছিল। সাথে one and only একখান ছাতা । ঠিকই ধরেছ, আমার সবসময়ের সাথি, আমার প্রিয় ছাতি ( ছাতা ) । কোলের ছানা তখন জাগন্ত হয়ে , বেশ ঘাবড়ে গেছে। কোলে কাঁখে ছানা,খান দুয়েক হালকা ব্যাগ আর মাথায় ছাতা নিয়ে অনেকটা জনতার ঠেলায় গা ভাসিয়ে অটোতে চাপলাম। আমার ওজনদার কর্তা মশাই সামনে আর আমরা বাকি সবাই পিছনে । ছোট জনের চোখে ভয় আর বিস্ময়ের মেলানো মেশানো অভিব্যক্তি , তবে মুখ বন্ধ। তখনো তার কথা ফোটে নি বটে , কিন্তু মুখ বন্ধ থাকতো না খুব একটা । পথে নেমেই বুঝলাম বরুণদেবের সাথে যোগ্য সঙ্গত করছে পবনদেব !!! শুনশান পথ (কেন বুঝলাম না , কারণ স্টেশনে তিলধারণের জায়গা ছিল না )... বৃষ্টির তোড়... হাওয়ার শব্দের মাঝে আমরা সমুদ্রের সামনের পথে এসে পড়লাম .... হাওয়ার তীব্রতায় অটো চালক , অটো ঘুরিয়ে ঢুকে গেল পুরী হোটেলের পাশের অপরিসর গলিতে। কারণ সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা বাধাহীন হাওয়ায় অটো উল্টে যেতো না হলে !!! আটোর দুধারে বসে আমি আর সত্যদা ভিজে তখন হালুয়া হয়ে গেছি। আমার কর্তা মশাই এর পায়ের ওপর দিয়ে জলের প্রবাহ চলছে, মাঝখানে বসে ছোটখাটো চেহারার মঞ্জুশ্রীও প্রায় হালুয়া অবস্থায়। এর মধ্যে একটা কার্লভাট পেরতে গিয়ে , পেরতে না পেরে উল্টে যাওয়ার উপক্রম হতেই  আমার কর্তা মশাই লাফিয়ে নেমে কিছুটা হলেও পবনপুত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। পবন দেব খানিক তুষ্ট হলেন কিনা জানিনা, তবে এর খানিক পরে সমুদ্রের সামনের পথে ফিরে, নির্বিঘ্নে আমরা হোটেলে পৌঁছে হাপ ছাড়লাম। ঘড়ি দেখলাম রাত ২.৩৫। হাঁপিয়ে, কাঁপিয়ে সব হালকা গুছিয়ে, ছড়িয়ে ঘুমাতে গেলাম রাত ৩.৩০ এ । সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সূজ্জি মামার উদয় দেখা হোলো না। ঘুম ভাঙলো যখন মেঘ কেটে , সূর্য হাসছে। যদিও ওটা ট্রেলার ছিল। তখন সকাল ৭ টা। 

সে বার পুরী পুরোপুরি বৃষ্টির ঘেরাটোপে বন্দী ছিল। কখনো কম, কখনো বেশি। মেঘ পুরোপুরি কাটল পাঁচদিনের দিন সকাল থেকে, যেদিন সন্ধ্যায় আমাদের ফেরার ট্রেন।

সব দিনই বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি চলল। পূজো দিতে গিয়ে জানলাম পুরীর মন্দিরে ছাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা। অগত্যা ভিগি ভিগি সকালে উপোসী কর্তা গিন্নি , পুপেকে মঞ্জুশ্রীর জিম্মায় রেখে ধর্মে মন দিতে গেলাম। একদম আপাদমস্তক ভিজে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর দর্শন, পূজন সব সম্পন্ন হোলো । কিন্তু .... হোটেলে ফিরে জ্বরে বিছানায় কাত হলাম। পুরো হিসাব বরাবর । 

মেঘ কাটলো , জ্বরও তল্পি গোটালো আর আমরাও টুইটম্বুর নতুন রকম অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ঝুলিয়ে ফিরতি ট্রেনে উঠে বসলাম । সব রকমের না হলেও , এও এক নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা .... ভালো নয়, বেশ গোলমেলে। তবে এর আগাম নোটিশ থাকলে সত্যিই হয়তো যাওয়ার আগে দুবার ভাবতাম। অথবা বাতিল করতাম। বেড়ু বাতিল করার অভিজ্ঞতা আমাদের ভরপুর !!! কষ্ট হলেও অনেক সময় বেড়াতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে বৈকি । 


@ শুচিস্মিতা ভদ্র

No comments:

Post a Comment