বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৮
স্মৃতির মাঝে ফিরে গিয়ে , আমাদের উত্তর বঙ্গের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখতে শুরু করেছিলাম। বেশ কিছুটা এগিয়েও গেলাম আগের দিন । আমাদের দার্জিলিং যাপন যথা নিয়মে দ্বিতীয় দিনে পড়ল। আমরাও কিছু অসুবিধার কারণে হলিডেহোমের মায়া কাটিয়ে ম্যালের এক হোটেলে হাজির হলাম । সব গুছিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম, একে একে জলখাবারের পাট মিটল ম্যালের বিখ্যাত খাবারের দোকানে । এরপর নিয়ম মাফিক দর্শনীয় স্থানের দর্শন চলতে থাকল । মিউজিয়াম থেকে শুরু হল সেদিনের পথ চলা । এরপর রক গার্ডেন আর গঙ্গা মায়া লেক ও পার্কের খাড়াই পথের উতরাইতে নামার সময় হাল বেশ বেহাল হয়েছিল । পাহাড়ী সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একের পর এক ঘোরাঘুরি চলতে লাগল । চিড়িয়াখানা , মাউন্টেনিয়ারীং ইনস্টিটিউট এর সংগ্রহশালা , পাশের এক পার্কে লোকনৃত্য দেখতে দেখতে সূর্য পাটে নামতেই ঠাণ্ডার কামড় বাড়তে লাগল । এদিকে হয়েছে কি !!! বেড়ুতে অনভিজ্ঞ আমি আবার সেদিন এক কাণ্ড করে বসেছিলাম। আমি আমার পছন্দের পরিধেয় শাড়ি পরে ছিলাম , আর তাতে ঠাণ্ডার কামড়ে সব থেকে বেশি কাহিল তখন আমি । যতই গরম পোষাক চাপাই !!! শাড়ি নিয়ে সমস্যা তখন বেশ ভারি । সেই থেকে শিক্ষিত হয়ে , পাহাড়ী বেড়ুতে শাড়ির সাথে করেছি পুরো আড়ি । অত ঠাণ্ডা কি সইতে পারি ??? আমার আবার শীত , গরম সবেই কষ্ট , সবই বেশি লাগে যথা সময়ে , তাই কর্তা মশাই দেগে দিয়েছেন উগ্র পন্থি বলে। চুপি চুপি বলি গরমে যদিও আমার কষ্ট ওঠে চরমে । ঠাণ্ডার ওপর খুব বেশি রাগ আমার নেই । ঝাণ্ডা নিয়ে ঠাণ্ডার ক্যাম্পেন করতে আমার খুব একটা আপত্তিও তাই নেই । ঠাণ্ডাকালে ঘোরা , খাওয়া , কাজ কোনোটাই অসুবিধাজনক লাগে না । তবে এ কথাও সত্য যাদের দম নিয়ে দমসম কাণ্ড ঘটে , স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কাছে বছরের এ সময় উপভোগ্য হয় না । আর একদল আছেন যারা খুবই শীতকাতুরে টাইপ , তা শীত তাদের ভীত করে ভিত নাড়িয়ে দেয় । আরেক দলের আবার শীত ও গ্রীষ্ম ক্যালেন্ডার মেনে আসে যায় 😃🙃। তো সে যাই হোক , শীত আমাদের কাছে এখনও খুবই উপভোগ্য। বয়সের সাথে সাথে ভোগান্তির বাড়বাড়ন্ত হলে তখন অবশ্যি আলাদা কথা । আমার মাকে দেখে তাই বুঝেছি ।
সেদিনের বৈকালিক আড্ডায় আমরা ম্যালের এক কপিসপে বসেছিলাম, পরে ঘোরাঘুরির পর ঘরে ফিরে ক্লান্তির প্রাবল্যে খেয়ে চটপট ঘুম দিলাম। পরদিন রাত থাকতে উঠে টাইগার হিলে যাওয়ার পরিকল্পনা । সে মতন গাড়িও বলা ছিল । যথা সময়ে ওঠার পর পরই আমাদের বাকি সাথিরা না যাওয়ার বার্তা জানিয়ে ঘুমের দেশে ফেরত গেল । কিন্তু ঘুম আমার বেড়ানোর অন্তরায় নয় কখনোই আর তাছাড়া সকলের এই অভিজ্ঞতা নতুন নয় আমার মতন , কাজেই আমার উৎসাহ স্বাভাবিক ভাবেই বেশ বেশি ছিল । সেই মতন ধড়া চুড়ো পরেও কাঁপতে কাঁপতে রওনা দিলাম অন্ধকারের মধ্যেই। পোশাক সমেত কোন কাব্য তো দূর অস্ত , এক সময় শুনলাম আমাকে অনেকটা সেই রহস্যজনক ইয়েতির মতন লাগছে । এ যাবৎ ওই একবারই কর্তা মশাই তুলনা টেনেছিল 🙏🏻 । সময়ে পৌঁছলাম, কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের সেই গানের কলি সত্য হল ... টাইগার হিল থেকে সূর্য ওঠা দেখা হল না সেবার 🎶🎶 , অনেক উৎসাহ নিমেষে ঝিমিয়ে গেলেও , টাইগার হিলেই দিনের আলো ফুটতে দেখে , আমরা ফিরে চললাম। পথে নামলাম বাতাসীয়া লুপ সংলগ্ন বাগান ও ঘুম মনাস্ট্রিতে । ফিরে গিয়ে , বেরিয়ে পড়ব সবাই। সেই মতোই গোছানোর সময় খেয়াল হল আমার একখান চাদর মিসিং। একটু বকুনি জুটল , তারপরই কর্তা মশাই ছুটল আগের দিনের সন্ধ্যার আড্ডার আসর সেই কফি শপে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই চাদর খানা পাওয়াও গেল । এরপর আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম কালিমপঙের উদ্দেশ্যে । প্রথমেই এক জায়গায় জলখাবার খেয়ে নেওয়া হল , তারপর নতুন উৎসাহে চললাম আরেক শৈল শহরের দিকে ।
আমাদের তিন ঘরণীর আলাপ তখন আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে । গান , গল্পের মধ্যেই দুপুরের দিকে কালিমপঙে নেমে এলাম । অনেকটা নিচের শৈল শহর , তাই ঠাণ্ডার প্রকোপ কম আগের থেকে । কালিমপঙে আমাদের কোন বুকিং ছিল না , স্পট বুকিং মেলা ভার হয়ে দাঁড়াল । অগত্যা খোঁজাখুঁজির পর্ব চালু হল । এক সময় পুরনো পরিচয়ের সূত্র ধরে কালিমপঙের স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছে পাওয়া গেল পূর্ব পরিচিত মি.অজয় করকে । উনি তখন ওখানকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।
এ ক্ষেত্রে আগের বিষয় একটু না বললেই নয় , আমাদের বিবাহ উত্তর কালে কসবাতে বাড়ি তৈরির জন্য হাউস বিল্ডিং লোন নেওয়ার সময় পরিচয় হয় স্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মি.করের সাথে । খুবই সাহায্য করেছিলেন ঢাকুরিয়া নিবাসী কর বাবু । পরে কালিমপঙে বদলি হয়ে যান । সে তথ্য একবার ওনার সাথে পথের দেখায় আমাদের ব্যক্ত করেছিলেন পূজোর সময় ( বিয়ের পর প্রথম পূজোতে ) । তখনই মৌখিক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কালিমপঙে । কিন্তু হ্যাঁ বাচক সম্মতি ছাড়া কার্যত কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বরের লেনদেন হয় নাই 🙄।
এবার খড়কুটোর মতন শেষ সম্বল রূপে মি.করের নাম আর স্টেট ব্যাঙ্কের নাম আমার কর্তা মশাই এর মানসপটে ভুস করে ভেসে উঠল ... এবার পুরো সিরিয়ালী কায়দায় ব্যাঙ্কের খোঁজ ও সেই সাথেই ভাগ্যক্রমে দেখা মিলল মি. করের । 😊 ভদ্রলোকে আকাশ থেকে পড়লেন !! তবে আকাশ ,বাতাস যাই হোক এদিক ওদিক খোঁজ লাগিয়ে বাজারের জন বহুল এলাকাতে একখান ভাল হোটেলের ব্যবস্থাও করে দিলেন । হোটেল ক্রাউন । ডিউটি আওয়ারসে বেরিয়ে ছিলেন আমাদের সাথে , তাই ব্যবস্থা করে দিয়েই ফিরে গেলেন , সন্ধ্যার সময় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ।
বাঙালি যতই মোমো আর চাউ হাউ মাউ করে খাক না কেন , বেশি দিন ওই মেনু টানতে পারে না , টানলেই গেনু গেনু ( গেলুম গেলুম ) রব ওঠে । সে যে একশো শতাংশ সত্য, তার প্রমাণ মিলল কালিমপঙের হোটেলের খাবার টেবিলে । হোটেলে ঘরে পৌঁছে সবাই ফ্রেস হয়ে (বেলা চারটে নাগাদ) এক্সটেন্ডেড মধ্যাহ্ন ভোজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম পড়ন্ত বেলায় । বেলা চারটেতেও ধুমায়িত ভাত , ডাল , আলুভাজা , পাঁপড় , স্যালাড আর মাছ সহযোগে ক্ষিদে মিটল সবার । কদিন পর কালিমপঙের সহনশীল ঠাণ্ডার মাঝে আমাদের পুচকু সোনা বৃষ্টি রাণীর মুখে হাসি ফুটল । ছোটদের সব কিছুর গ্রহনযোগ্যতা সব থেকে বেশি হলেও দার্জিলিঙের ঠাণ্ডায় ছোটজন একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল ।
পরেরদিন কর বাবুর ঠিক করা গাড়ি চড়ে পাড়ি দিলাম লাভা ও ললেগাও । কর বাবু লাভাতে ভেজ মোমো খাওয়ার পরামর্শ দিলেও, ভয়ানক আমিষাসী আমরা নন-ভেজেই স্থির হয়ে রইলাম। লাভাতে পৌঁছে ঠাণ্ডার ধরনে আবার কেঁপে গেলাম । এখানকার উচ্চতা বেশ বেশি আর সেদিন মেঘলা থাকার জন্য, পুরো অঞ্চলের আবহাওয়া ছিল ভিজে ভিজে । ওখানকার মনাস্ট্রি ঘুরে দেখার পর আমরা ওখান থেকে গেলাম লেলেগাও তে । সেখানে পাহাড়ী গাছের সারির মধ্যে রয়েছে দড়ি ও কাঠের তৈরি সেতু । সেতুর ওপর ওঠা , ছবি পর্ব সব মিটিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। পাহাড়ী পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে একখান ছবিও তোলা হল সকলের । সব মিটিয়ে সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরে আড্ডার আসর বসল । পরের দিন গেলাম কালিমপঙের সর্বোচ্চ স্থান ডেলো পাহাড়ে । ফেরার পথে কালিমপঙের আরেক মনাস্ট্রি ও পাইন ভিউ নার্সারি দেখে নিলাম। সেদিনকার সান্ধ্য আড্ডায় আমাদের সাথে যোগ দিলেন কর বাবু । গান , গল্প ও আবৃত্তির মাঝে ঝড়ের গতিতে সময় বয়ে গেল । ঝুমার অপূর্ব আবৃত্তি শুনে আমরা মুগ্ধ হলাম। ও তখন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী । এখন নানা অনুষ্ঠান, রেকর্ডিং , দূরদর্শনে ও বেশ পরিচিত মুখ । কর বাবু আমাদের দুজনকেই দু ধরনের বিষয়ের চর্চার উপদেশ দিয়েছিলেন, ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমার ক্ষেত্রে গান নিয়ে ওভাবে এগোনো সম্ভব ছিল না সংসার সামলে । আসলে সকলে সবটা সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করতে পারে না । ঝুমাকে সাধুবাদ দিতেই হয় , ও পেরেছে । একটা বিষয় ওই প্রসঙ্গে মনে আছে , আমি গান শোনানোর পর ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে গুটি গুটি হাটি হাটি করে বৃষ্টি এসে গম্ভীর হয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিল বেশ গম্ভীর ভাবে .." বালো (ভালো) হয়েছে ।" ওর বলার ধরনে সবাই হেসে আকুল হলেও, এ অতি অবশ্যই এক স্বীকৃতি তো বটেই !!
কর বাবুর সাথে যোগাযোগ আবার ক্ষীণ হলেও, ওনার দারস্থ হয়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে এক ভিন্ন কারণে । বলা ভাল খুব দরকারি কারণে । এবারেও অনেক সাহায্য পেয়েছিলাম ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত বিষয়ে । রিটায়ার করে গিয়েছেন , কিন্তু তবুও সব রকমেই সাহায্য করেছিলেন। মানুষ মানুষের জন্য আমার এই বিশ্বাসের ভিত আরো দৃঢ় হয়েছিল ওনাকে দেখে ।
পরের দিন ছিল আমাদের মন খারাপের দিস্তা ভরা ফেরার দিন । ফেরার পথে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট ঘুরে ট্রেন ধরেছিলাম। মনে আছে স্টেশনে শেষ বিকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমার কর্তা মশাই আমাদের তিন মহিলাকে নিয়ে হংকং মার্কেট গিয়েছিলেন । কেনাকাটি কিছু করিনি , ঘুরে দেখে আবার ফিরে গিয়েছিলাম। এরপরের অধ্যায় খুবই সংক্ষিপ্ত। এক রাত ট্রেনে কাটিয়ে, পরের সকালে হাওড়া আর তারপর বাড়ি ।।
@শুচিস্মিতাভদ্র
2018, December , উপরের স্মৃতিচারণের অনেক ভছর পরে দেখেছিলাম কঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব শোভা ...
No comments:
Post a Comment