বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৪
পুরী , জগন্নাথ ধাম , আমাদের বঙ্গ জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। অনেকদিন পুরী যাওয়া হয়নি । কথিত আছে , জগন্নাথ দেব না ডাকলে নাকি আগাম ঠিক করে রাখা যাত্রাও বাতিল হয়ে যায় । আমরা আবার অন্য জায়গার যাওয়া বাতিল করে জগন্নাথ দেবের ডাকে সাড়া দিয়ে পুরী গিয়েছিলাম বিয়ে-বৌভাত পর্ব মিটিয়ে। সে গল্প আগেও করেছি । আমাদের প্রথম কোর্টসিপের দিন ছিল রথের দিন , তাই আমাদের কর্তা গিন্নির জীবনে পুরী ও জগন্নাথ দেবের আসন বেশ পাকাপোক্ত।
লকডাউন ইস্তক টুকটাক যা ঘুরু বেড়ু করেছি , সবই কাছাকাছির মধ্যেই আর চারচাকায় আসীন হয়ে । কু ঝিক ঝিককে খুবই miss করছিলাম। পূজোর আগে অসুস্থ হলেন আমার শ্বশুর মশাই ...খুব চিন্তার মাঝে দিন কাটার পর , যখন আমরা চিকিৎসকের কথায় আশা ছেড়ে দিয়েছি , সেই সময় বাবা বাড়ি ফিরলেন । পুরোপুরি সুস্থ না হলেও কিছুটা বিপদ কাটিয়ে আমাদের খানিক নিশ্চিন্ত করলেন । পূজো দেওয়ার ভাবনা আমার কর্তার মাথায় ছিলই, আরো তিন পরিবারের সাথে পরামর্শ মতন পুরীর টিকিট, হ্যাঁ ট্রেনের টিকিট কাটা হল পূজোর আগেই।
এরপরও একরাশ সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে নির্ধারিত দিনে লটবহর নিয়ে হাওড়া স্টেশনের হট্টমালায় হাজির হয়ে জন স্রোত দেখে দুশ্চিন্তায় কুল কুল করে ঘামতে ঘামতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মুখের মাস্ক খোলার সাহস নেই । ওভাবেই যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই চোখের সামনের সব কিছুই ফসফসিয়ে স্প্রে করে নিল আমার সাথের জনেরা , আমি আর সত্যদা আগাম বসে পড়েছিলাম তাই আমাদেরও স্যানিটাইজ করা হল 🙄 । ডিয়ো আর পারফিউম ছাড়া নতুন ধারার স্প্রে মেখে , বসেই পড়লাম ... মনে তখন " পড়েছ যবনের হাতে , খানা খেতে হবে সাথে " টাইপ ফিলিং হল । তো খাবার কথা যখন উঠেই পড়ল বলেই ফেলি , রাতের খাবার বাড়ি থেকে এক প্রস্থ খেয়েই সবাই বেরিয়েছিলাম , ট্রেন তো ১০.৪০ এর পুরী স্পেশাল। টুকটাক খাবার বেরিয়ে পড়ল আমাদের সঙ্গী মৌ এর ঝুলি থেকে , আগেই প্রতিশ্রুতি আদায় করা ছিল .. ত্রিকোণ পার্কের উল্টোদিকে city mart এর পাশের গলির বিখ্যাত শঙ্করের ফ্রাই আর এক বাক্স সন্দেশ ( দোকানের খেয়াল রাখি নাই , সব খেয়াল তখন ফ্রাইতে ন্যাস্ত, খেতে ব্যস্ত ) । আমরা আণ্ডা বাচ্চা সহ মোট ১১ জন । কাজেই একসাথে সবাই সীট পাই নাই । আছি কাছাকাছি । পরের দিন আবার আমাদের কন্যার জন্ম দিন । খাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই ঘড়ির পানে চেয়ে সময় গুনছি । বাড়ি থেকেই কন্যা বলে দিয়েছে ট্রেনের মধ্যেই তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর আবদার ...
শোয়ার ব্যবস্থাও ততক্ষণে করে ফেলা হয়েছে , এই প্রথম পুপে একা মাঝের বার্তে শোবে , ওখানে ওর বাবাও থাকবে । আমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা দেওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা । সবাই নিজের নিজের বালিশ , চাদর আদর করে সাথে নিয়েছি । এখন আর ওসব রেল কর্তৃপক্ষ দেন না অতিমারির কারণজন্য । কর্তা মশাই অতি সাবধানী, পাতলা ব্ল্যাঙ্কেট কিনেই ফেলছিলেন , কারণ ওনার কাছে খবর ছিল ট্রেনের ভয়ানক ঠাণ্ডা নাকি তলা থেকে ওঠে !! একতলা বাড়ির মাটিতে শুলে তলা থেকে ঠাণ্ডা ওঠে এ তথ্য জানি কিন্তু ট্রেনের ক্ষেত্রে সেটা কি করে সম্ভব জানি না বাবা । বললুম ... ট্রেন সাপের মতন চলে বটে , কিন্তু চাকার ওপর থাকে তো !! আর এসি এর দৌলতে আপার বার্তে ঠাণ্ডার প্রকোপটা বেশি এমনটাই আমার জ্ঞানের ভাণ্ডারে মজুত। তো যাইহোক এসব চাপানউতোর চলতেই থাকে সব ঘরেই। আর কন্যার পিতাশ্রী ওমনই হয়ে থাকে ।
মধ্যরাতে পুপে দেবীকে জন্মদিনের শুভ কামনা জানিয়ে যে যার মতন শুতে গেলাম। ট্রেনটা শুরু থেকেই কেমন হেঁচকি তুলে তুলে , সবাইকে তটস্থ করতে করতে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে । আমাদের পাশের একসহযাত্রীকেও বলতে শুনলাম যে এই ঝাকুনির বার্তা তিনিও কারোর থেকে শুনে এসেছেন আগাম । হয়তো অতিমারি জনিত কারণে দীর্ঘ অচলাবস্থাই এর মূলে ।
ভোরের দিকে একবার উঠে ওদিক পানে নজরদারি করতে গিয়েই কর্তা মশাইকে চোখে পড়ল। না , তিনি ঘুমাননি , নিদ্রামগ্ন কন্যাকে সাথে নিয়ে বসে আছেন । বোঝো কাণ্ড !! ট্রেন এর ওই হেঁচকি বা ঝাঁকুনীতে বেচারী ছিটকে পড়ার ভয়ে মাঝের বার্ত থেকে নেমে বাবার বার্তোস্হ হয়েছে আর বাবাও ঘুমে তালা চাবি দিয়ে উঠে বসেছেন । কি আর করা সহধর্মিনী বলে কথা , তাকে আমার বার্তের দিকে রওনা করিয়ে , আমি নিদ্রা দেবীকে বিদায় জানিয়ে ওখানে বসলাম । সময়মত আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটি ফুটি করে ফুটল , সবাই চোখ মেলল , চায়ে গরম হাজির ... সে সব পাট মিটিয়ে সঠিক সময়ের অনেক আগেই পুরী পৌঁছল আমাদের ট্রেন । তখন ৬.৩৫ মি.
ট্রেন থেকে নেমেই শুনলাম , একটু অপেক্ষার পর রেলওয়ের গাড়ি চড়েই মালপত্র সহ স্টেশনের বাইরে যাব ... ভাবলাম... কি দারুণ ব্যাপার স্যাপার । কিন্তু... স্টেশন চত্বর এক সময় প্রায় ফাঁকা হয়ে এল , হেনকালে একখান গাড়ির দেখা পাওয়া গেলেও ... সে গাড়ির চালক দুজন আর দুটির বেশি লাগেজ নেবে না বলে হুঁস করে বেরিয়ে গেল আমাদের মায় ম্যানেজারের চোখের সামনে দিয়ে । নাহ্ , ম্যানেজ করতে পারল না গো !!! আমরা দলের ম্যানেজারের দিকে নজর করে দেখি , তিনি হাঁটা দিয়েছেন দ্রুত নিজের বাক্স প্যাটরাসহ ... তাকে ধরতে যার যার লট বহর সে , সে নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। ছোটা শেষ হল এক সময় , তার মধ্যে আমার ট্রলি ব্যাগের দুই চাকার মাপ ভিন্ন, সে বার দুয়েক প্ল্যাটফর্মে ফ্ল্যাট হল , শেষমেষ আমাদের দলের ছোট বাপ্পা তার দায়িত্ব নিয়ে আমায় রেহাই দিল । বদলে তার পাকাপোক্ত চাকাযুক্ত ট্রলি নির্দ্বিধায় টেনে নিয়ে পথের শেষে স্টেশনের বাইরে এলাম। দুটো গাড়ি ভাড়া করা হল , ম্যানেজারের দেখা পেলুম । কথা বলার সুযোগ হয়নি । ভাগ্যিস। চললাম আমাদের পুরীর আপাত ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
ক্রমশ
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment