Sunday, 10 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু 

            ১৭ 

বেড়ানো নিয়ে যাদের বাড়াবাড়ির অন্ত নেই , তারা যে করোনা পরিস্থিতির বন্দী দশায় ঝিমিয়ে পড়বে এ তো নতুন কিছু নয় !!! তা হবারই ছিল । কিন্তু নিউ নরমাল নামক পরিস্থিতির আগমনে তারা যে এক ঝটকায় ,  ঝটপট ঝিমুনি কাটিয়ে উঠে জোগাড় যন্ত্রে সামিল হবে এ কথাও সবারই জানা। তবে উঠল বাই , কটক যাই বলার উপায় সত্যিই আর নেই।  কোনো কালেই যদিও আমাদের এমন ধারা ছিল না ,  এখন তো ওমন হওয়ার সম্ভাবনাও নেই ধারেকাছে। চারটে পরিবারের যাওয়ার কথা দিয়ে আলোচনা শুরু হলেও, শেষমেষ তা দাড়ালো ৫০% এ। অর্থাৎ দুই পরিবার হাত ধরাধরি করে , চার চাকায় চেপে একদিন বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। আমাদের তিনজনের বোঁচকার সংখ্যা এবারও বেশির দিকে , করোনাজন্য , চেক লিস্টিতে আরো ক'জনা যে জায়গা করে নিয়েছিল বলাই বাহুল্য। গুছু করতে করতেই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া বাদ সাধলো , ঘন্টা খানেক দেরিতে এগিয়ে পড়লাম। খানিক চুপি চুপি , কারণ বিরুপ মন্তব্য শুনে মন ভারি করা মানা ছিল , এমনিতেই ঝোলার ভার বেশ বেশিই ছিল ... মন হাল্কা না রাখলে সে সব বইব কেমনে তোমরাই বলো !!! অল্পসল্প সম মনস্ক কিছু প্রিয়জনকে জানিয়ে ও তাদের উৎসাহ মনে ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।  ভোর না থাকলে কি হবে , ভোর ভোর পরিবেশেই রওনা দিলাম । বুঝলে না তো ??? সেদিন কুয়াশার প্রকোপে ভোর না থেকেও ভোরের রেশ রয়ে গিয়েছিল প্রায় বেলা ১১.৩০ পর্যন্ত। সাথে মুখ চালানো ও পেট ভরানোর জন্য হরেক রকম ঘরে তৈরি খাবার,  শুকনো খাবার , মায় এক ফ্লাস্ক ভর্তি চাও নেওয়া হলো । না , এবার চলতি পথে কোথাও খাবার খাওয়ার অলিখিত বিধিনিষেধ নিজেদের ওপর আগেই চাপিয়ে নিয়েছিলাম ।

বেরিয়ে পড়ে বাহির পানে চোখ মেলে দেখি কুয়াশার চাদরে শহর ডাকা পড়েছে , অগত্যা নিজেরা নিজেদের মতন হল্লাহাটি চালু করে মল্লার রাজার দেশের পানে ধেয়ে চললাম। হ্যাঁ , একদম ঠিকই ধরেছ , আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর,  সাথে মুকুটমণিপুর । রাজা মহারাজাদের দেশ বলে কথা !!! মুকুট না থেকে পারে ?? তবে সত্যিই এই নামের মূলে যে ইতিহাসের অবদান তা জানা হয়ে ওঠেনি । তবে এক বাক্যে বলতেই হবে google দেব জিন্দাবাদ,  একদম পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিল আর পথ একদম ঝাঁ চকচকে .... এমন পথের জন্যই হয়তো লেখা হয়েছিল বিখ্যাত গান ... " এই পথ যদি না শেষ হয় ??? " 

কিন্তু পথ শেষ হলো  আর সাথের বাহন চালক সত্যদা ও তার সহধর্মিনী যারা পারতপক্ষে বেশি খাবার  খায় না , আমাদের পাল্লায় পড়ে যোগ্য সঙ্গত করলো ... অতএব বানানো খাবারের ( একটা গোটা কেক বাদে ) সদ্ব্যবহার হলো পথেই ।

পরের দিন দর্শনীয় স্থানে ঘুরপাক খেতে খেতে যেমন মুগ্ধ হলাম,  তেমনই নিশ্চিত হলাম মল্লার রাজপরিবারের মন্দির প্রীতি দেখে । নিঃসন্দেহে টেরাকোটা শিল্প অনবদ্য,  অমূল্য,  কিন্তু কোথাও রাজবাড়ির দেখা পেলাম না , মন্দিরের প্রতি যত্নবান হয়ে , প্রাসাদ চলে গেল কালের গর্ভে , এই বিষয়টা একটু যেন কেমন কেমন ঠেকল !! যাই  হোক , আমার প্রশ্নের উত্তরে আমাদের টোটো চালক ( গাড়ি নিয়ে গেলেও ওখানকার ঘোরাঘুরি টোটোতেই হয়েছিল ) পথের পাশের এক বিস্তৃত অঞ্চল জোড়া ভগ্নস্তুপকে চিহ্নিত করলেন রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলে । মনটা একটু ভার হলো । 

ওদিককার কনকনে ঠাণ্ডার লেশমাত্রর দেখা মিলল না , হাল্কা ঠাণ্ডা ভুস্ করে গনগনে রোদে ডুব দিল বেলা বাড়ার সাথে সাথে । কাছাকাছি দর্শনীয় সব দেখার ফাঁকে টেরাকোটার মৃৎশিল্পের পসরা সাজানো কিছু ছোট ছোট দোকানের দেখা মেলার সাথে সাথেই আতঙ্কিত আমার কর্তা মশাই এর চলনে টগবগে গতির সঞ্চার হলো আর আমার  বাঁকুড়ার বিখ্যাত ঘোড়া ঘাড়ে করার সুযোগ ঘটলো না । এরপর আমি এক জায়গাতে খানিকটা কর্তা মশাইকে অনুসরণ করলাম না , কোনোদিকে না তাকিয়ে মঞ্জুশ্রীর হাত ধরে , গতি বাড়িয়ে সামনের দোকানে ঢুকে পড়লাম। দেখা হলো পশুকূল , পাখি কূলের টেরাকোটার মূর্তি , বিকনা গ্রামের বিখ্যাত ডোকরার মূর্তি ও গহনা । গ্রামের নাম শুনেই বুঝলাম,  আমার লোকাল গার্জেনের এলেম আছে !!!! কারণ শুরু থেকেই আমাদের চিকনা গ্রামের ডোকরা শিল্প তৈরীর কাজ দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিল যে !!! কোথায় বিকনা , আর কোথায় চিকনা !!!!  দোকানে দাঁড়িয়ে দিল দরিয়া মেজাজে হঠাৎই সত্য দার style এ .... "কি নেবে বলো ??? ".... বলেই ফেলেছিল । আমি out of syllabus এ আজ ওবধি স্বচ্ছন্দ নই , এক্কেরে ভেবলে গেলাম... আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুনর মুসিকো ভবোঃ !!! শেষ পর্যন্ত idea বাতিল করতেই হলো , কারণ আর কিছুই না , বিকনার কারিগরের হাতের তৈরী করা শিল্পকে চিকনা , ডোকরা যে নামেই ডাকি না কেন , তা যে মূল্যের দিক থেকে বেশ ওজনদার , সে তথ্য দোকানদারের কাছে শুনেই , ও পথ আর কেউ মাড়ায় ??? সাথে যে ওতপাতা বিপদ !!! অন্ধকে শাকের ক্ষেত না দেখানোর কি যেন একটা প্রবাদ আছে না ??? একটা দিকে তো পকেটকে বাঁচানো গেল !! এই বা কম কি ??? বিষ্ণুপুরের শাড়ির সাথে আড়ি করানো গেলে ভালই হোতো , কিন্তু ও ব্যাপারে কোনও  আশার আলো দেখতে পাবে কিনা তাতে প্রবল সন্দেহ ছিল তো !! 

এরপর গনগনে রোদ পড়ার পর আমরা হাজির হলাম,  ৩২ কিলোমিটার দূরের গনগনিতে । পথ হারিয়ে,  গুলিয়ে , পুরোটাই গ্রামের মধ্যের মাটির বাড়ির উঠোন পেরিয়ে , ছোট্ট নদীর কাঠের পুল পেরিয়ে, পুরোপুরিই অ্যাডভেঞ্চারে মত্ত হয়ে গনগনি পৌঁছে গেলাম এক সময়ে ,  সাথের দুই সঙ্গীর অ্যাডভেঞ্চার তখন উচ্চগ্রামে বাঁধা পড়েছে !!! চড়াই উতরাই পেরিয়ে চড়াও হলো বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর এক টীলায় । একজন খুব গম্ভীর,  অন্যজন যথারীতি হাস্য মুখর , তবে হাবেভাবে ও অভিব্যাক্তিতে দুজনের মুখেই তখন বহু বছরের পুরাতন জীবন সঙ্গিনীকে আরো একবার impressed করার বিজয়ী হাসি .... এদিকে আমরা হাত ধরাধরি করে ভেবেই আকুল ... পড়লে সেই  ম্যাও সামলানোর চিন্তায়। যাক্ , দুই হিরো ( আমাদের) গোটা অবস্থায় টিলা থেকে নামল , একজন একটু নেচে নিয়ে আরো ভয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল , নামার সময় । বুঝতেই পারছ নাচন কোদন কে করেছে ??? 

ঘোরাঘুরির পর গোল বাঁধল শাড়ির দোকানে , আমি কিনতে চেয়ে বকুনি খাই সব সময় , আর মঞ্জুশ্রীরও বকুনি জোটে ভিন্ন কারণে , ও কিনতে নারাজ । কি বৈপরীত্য !!! শেষমেষ দুজনেই ভয়ে ভয়ে শাড়ি বাগিয়ে ফিরলাম।  আমার ভয় এক রকম , মঞ্জুশ্রীর ভয় অন্য রকম । ঘরে ফিরে এ তরফে মঞ্জুর তুলনা টেনে , আমি বকুনি খেলাম আর ওদিকের রাগ, বকুনির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ছিল কিনা জানা নেই,  তবে পরের দিন মুকুটমণিপুর থেকে ফিরতি পথে ভয়ে ভয়ে মঞ্জুশ্রী , বাধ্য আর কাঁচুমাচু মুখে তিন খানা শাড়ি কিনে ফেরার পথে এই ভেবে আকুল হলো , আগের দিন রাজি হলে একটা শাড়িতেই সত্য দা খান্ত দিতো , দাদা আমার ভয়ানক রেগে বেশি বেশি কেনার কথা ভাবতোই না !!! 

এবারের বেড়ু বেড়ু খাসা হলো , মুকুটমণিপুরের ঘুরু ঘুরুতে সাথের খাবারের ভাগিদার স্বরূপ তিনটে সারমেয়ও জুটে গিয়েছিল,  দুষ্টু লোকজন টেরিয়ে টেরিয়ে তাদের চিলিচিকেন আর চাউমিন খাওয়া নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করলেও,  ওসবে কান , মন কোনোটাই দিইনি আমি । মোটের ওপর বিষ্ণুপুরের হোটেল থেকে আনা পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের এমন সদ্ব্যবহার আমিও আশা করিনি । ফেরার পথে মুকুটে পালকসম খেজুরের ঝোলা গুড়ও ঝোলায় পোরা হলো । আমার কর্তা মশাই আর মঞ্জুশ্রী গেল টাটকা রস আর গুড় চাটাচাটি আর বাছাবাছি করতে , আমরা বাকি তিনজনা গাড়িতেই রইলাম, পরে শুনলাম সকালে নামানো সারি সারি হাঁড়ি সূর্যাস্তের পর বিলকূল converted to তাড়ি !!! সেই শুনে ওরা তাড়াতাড়ি খেঁজুর গুড় নিয়েই পাত্তাড়ি গুটিয়েছিল । তা সব দিক দিয়েই এবারের নতুন পরিস্থিতির নিউ নর্মাল বেড়ু একদম ফাস্টক্লাস । তাই না বলো ????

@ শুচিস্মিতা ভদ্র

No comments:

Post a Comment