বেড়াতে গিয়ে মজারু ১৯
আমাদের বিয়ের বছর চারেক পর আমরা মুম্বাই গিয়েছিলাম। যাওয়ার মাস চারেক আগে থেকেই চাপানউতোর চলছিল জায়গার বাছাই নিয়ে । মুম্বাই যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার মত ছিল অজন্তা , ইলোরা হয়ে মুম্বাই গমন । ওদিকের মতামত ছিল ভিন্ন ... খাজুরাহো হলে কথা ছিল অন্য, বৌদ্ধ, জৈন আর হিন্দুদের গুহা স্থাপত্য দেখার কোন মানে নাকি নেই !!! কিন্তু মুম্বাই ঘুরে গোয়া যাওয়ার মানে আমি বিনা চশমাতেও পষ্টাপষ্টি বুঝেছিলাম । মন ভার , মুখ ভার ... মন খারাপের দিস্তা নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে স্কুলের বান্ধবীর অজন্তার বর্ণনা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম .... অতঃপর ভাগ্য সুপ্রশন্ন হল বলতে হবে ... কর্তা মশাই রাজি হলেন অবশেষে । আহা !! মোটেও গিন্নির মুখ চেয়ে ... এমন ভাবার কারণ নেইকো । ওই চাপানউতোর কালে বলা ভালো হেনকালে মুক্তি পেল সন্দীপ রায়ের পরিচালিত " কৈলাশে কেলেঙ্কারি " । আমরা দেবাদেবী দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়া প্রেক্ষাগৃহে দেখতে গেলাম ... দেখলাম...মন জয় করলো কিনা সিনেমার ইলোরার গুহা মন্দির !! ভাবা যায় ?? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে , বাড়ি ফেরার পথেই বলতে শুনলাম... " এবার অজন্তা ইলোরাটা ঘুরে আসি , কি বলো ? পরের বার গোয়া যাবক্ষণ ।" 😆 কিন্তু লকডাউন আর করোনার প্রবাহিত ঢেউ এ ওটা গয়া ভ্রমণে না শেষ হয় 😒 এই চিন্তায় চিন্তিত। যাক্ ওসব , তো যা বলছিলাম... মনের উচ্ছ্বাস মনে চেপে , মনে মনেই বললাম... তা আর বলতে ?? মত বদলালো , সেই মতো পথও বদল হলো ।
এক বাঁধা দূর করলেন সন্দীপ রায় , টিকিট কাটা ও অন্যান্য কাজ যখন একটু একটু এগিয়ে পড়েছে , আবারও বাঁধা । এবারের বাধা বাসা বাঁধল আমার কোমরে । দুঃখের কথা কাকে বলি ,বালতি তুলতে গিয়ে ফিক লেগে ব্যাথা একদম পিকে ( peak )। তাকে ঠিক করতে নানা দাওয়াই , সাথে বিশ্রাম চলতে থাকল । আরাম হারাম হ্যায় বলে যেই কাজে যোগ দিই ব্যারাম আবার কোমরের দখল নেয় । আমাদের মন খারাপ... সময় বেশি নেই, মেরে কেটে বেরিয়ে পড়তে বাকি মাস দেড়েক । আমার মায়ের অনুরোধে গেলাম শেষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডেরায় ... কর্তা নিমরাজি , নিজে গেলেন না , বিশ্বাস নেই, এদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কথা ফেলা সব দিকে থেকেই বিপদের !! এলোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথির বিবাদটা কিসের কে জানে ? তবে শেষরক্ষা করলেন হোমিওবাবুই । অনেকদিনের পরিচিত ডাক্তার একদমই রোমিও সুলভ যুবক নন ... সব শুনেই , যাওয়ার দিনক্ষণ জেনে বললেন .. চিন্তার কিছু নেই, তুমি ঘুরতে যেতে পারবে । আর সত্যিই পারলাম আর দৌলতাবাগ ফোর্টের ৩৫০ সিঁড়ি আর প্রতামগড় ফোর্টের ৪০০ সিঁড়ি নিজে হেঁটেই উঠেছিলাম ... মোটেই কোলে কাঁখে চাপিনি । কর্তা মশাই মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার জেঠুর মহিমা মেনে নিলেন তখনকার মতো , কলকাতার জল হাওয়াতে ফিরে আবার স্বমহিমায় ফিরে ওনাদের এলোপ্যাথির গুণ কীর্তন করে চলেছেন সেই ইস্তক।
শেষমেষ দূগ্গা দূগ্গা করে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস করে রওনা দিলাম। স্লীপারের টিকিট ছিল ... বয়সের সাথে সাথে বায়নাক্কার দোহাই দিয়ে দুজনেই স্লীপার থেকে আপার মুখী হয়েছি ... দুজনেই সহমত তাই নেই চাপ । আর তখন না থাকলেও এখন আমারও সাথে পুপে নামক শিখণ্ডী আছে । সে কিছু বললে ( অবশ্যই বেড়ানোর সময় ) তার বাবা কেমন যেন নরম পাকের মাখা সন্দেশের মতন মোলায়েম হয়ে যায় । কিন্তুক !!! অন্য সময় কড়া পাকের হালুম হালুমে আমরা মা মেয়ে গেলুম হয়ে যাই বাড়িতে । তবে সত্যিই বলছি ... বেড়ানোর সময় কর্তা মেয়ের কাছে নরম পাক আর আমার কাছে একদম উত্তমকুমার 😄 কি রোমান্টিক !!! বাপ রে !!! এই জন্যই তো কবে থেকে বেড়াতে যেতে চাইছি ।
ট্রেনে এক রাত কাটিয়ে তারপরের দুপুরে ভুসওয়ালে নামলাম, এদিকের অনেকের বাণী শিরোধার্য করে ভুসওয়ালের বিখ্যাত কলা কেনার উপায় না থাকায় , আমরা ওখান থেকে সরাসরি ওমনি (মারুতি ভ্যান) ভাড়া করে ফরদাপুর সরকারি হোটেলে হাজির হলাম। হাইওয়ের পাশে ছড়ানো ছিটানো বিশাল এলাকা জুড়ে হোটেল । এখানেও বেশ কিছু হনু সপরিবারে থাকে । দূরে অজন্তার পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে , মনে একেবারে ফূর্তির বাণ ডাকল । তবে সন্ধ্যার দিকে বিজ্লি গন্ হওয়ার কিছু পরেই হোটেলের এক কর্মী এসে দুইখান মোমবাতি ধরিয়ে জেনারেটরের গোলযোগের তথ্য পরিবেশন করে গেল , অপরিচিত জায়গায় আলো আঁধারির মধ্যে দুজন ভুতের মতন বসে বসে হঠাৎই হৈ চৈ শুনে ঘাবড়ে গেলাম ... কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝলমলে আলোর ঝিলিকে সন্ত্রস্ত ভাব খানিক কেটে যেতেই ঘরের সামনের টানা বারান্দায় প্রথমে উকি , তারপর টুকি করতে করতে কর্তা মশাই গুটি গুটি এগিয়ে খবর সংগ্রহ করে ফিরে এল ... কৌতুহল নিবারণ হল , শুনলাম কোন সান্ত্রি বা মন্ত্রীর ছেলে ( এখন তিনি মন্ত্রী 🤫 ) গামলা গামলা আমলা সহ পায়ের ধুলো দিতে এসেছিলেন ...
এমারজেন্সির জন্য রাখা জেনারেটর চালু করতেই আলোয় ভুবন ভরা হলো । আর ওই আলো বন্ধ করলে বিপদ হতেও তো পারে , তাই আলো স্থায়ী হল , এক সময় বিজ্লিও হাজির হল। আমরা পরের দিনের ইতিহাস দেখার ভাবনায় মত্ত হয়ে ঘুম দিলাম নৈশ আহারের পরে পরেই ।
পরের দিন সকালেই খেয়ালে ধরা দিল , বাঙালি ছাড়া অন্য প্রদেশের এক দুইটি পরিবার হোটেলে থাকলেও বিদেশী বোর্ডারের ভিড় অনেক বেশি , যাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যে এগিয়ে চীনা ও জাপানি বোর্ডার । আমাদের বাঁ পাশের ঘরেই ছিল ভারি মিষ্টি এক জাপানি যুবতী । অজন্তা কেভস্ দেখতে যাওয়ার পথে আলাপও হয়েছিল তার সাথে , পেশায় সে নার্স ( সেবিকা )। তা শুনে যথারীতি আমার কর্তা ভারি খুশি হয়ে গিয়েছিল , পেশাগত নৈকট্যের কারণেই হয়তো । কি জানি 🤔 ?
এরপর অটোর যাত্রার পর ব্যাটারি চালিত বাসে করে অজন্তার পাহাড়ের পাদদেশে অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই গাইড না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন , আমি পিছু নিলাম ... প্রথম গুহায় ঢুকেই সিদ্ধান্ত কেমন যেন ঝিমিয়ে গেল , আমি এসব ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে ওদিকের রকম দেখি ... সেই যে ঠোক্কর খেলো...আজ ওবধি ওই ঠেকে শেখা বিস্তর কাজে এসে চলেছে ঐতিহাসিক স্থান দেখতে গিয়ে । আসলে কি হয়েছিল জানো ? পাড়াতুত এক কাকু গাইডের জন্য খরচ যে বেকার এই মন্ত্র কানে দিয়েছিলেন আর আমার কর্তা মশাই বেড়াতে গিয়ে যথেচ্ছ খরচ করলেও , এমনিতে বুঝে খরচের মানুষ , যদিও আমার ক্ষেত্রে হাল পুরো না হলেও খানিক ছেড়ে দিয়েছে , তবে লাগাম এখনও ওদিকেই । কিছু বিশেষণ যুক্ত বাক্যবাণ শুনলেই বলে ... উঁহু ওমন বলতে নেই , বলো আমি মিতব্যায়ী । এই ওবধি ঠিক ছিল , পরে যোগ করে ... "না হলে হাতি পুষবো কি করে ?? " ... দেখলে তোমরা কেমন আমাকে হাতি বলে দিলো ?? তাও ভুল বাংলায় ?? হস্তিনী হবে তো !!! যাই বলুক ওর সাথে পথে বেরলে একটা মানানসই চেহারা না হলে কি ভালো দেখায় ? তোমরাই বলো !!!
তো যা বলছিলাম, শেষ ওবধি সব দেখাদেখি হলো গাইডের দেখানো পথেই, ফিরে হোটেলে দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়ে অজন্তাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি করে আমরা চলে গেলাম ঔরঙ্গাবাদ। সেখানকার সরকারী হোটেলে গিয়ে জানলাম, আমাদের জন্য যে ঘর নির্ধারিত, তাতে নাকি সন্দীপ রায় ছিলেন ..." কৈলাশে কেলেঙ্কারি " সিনেমার শুটিং এর সময় । সত্য মিথ্যার বিচার কে করবে জানি না , আমরা সত্য ধরে বিগলিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম । সন্ধ্যার সময় ওদিকের বিখ্যাত শাড়ির খোঁজে দুজন , দু রকম মেজাজ নিয়ে অটো ধরে প্রথমে দোকান, পরে শাড়ির কারখানা ঘুরে , গায়ে শাড়ি ফেলে এদিক ওদিক দেখে একখান বগলদাবা করে ফিরলাম ... যদিও , যে শাড়ির খোঁজে গেলাম, তাকে তখনও পাওয়া হল না । আপন করতে আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আমার এক মুম্বাই নিবাসী বান্ধবী নিয়ে এসেছিল তাকে । সেই তাক লাগানো অরিজিনাল পৈঠানির মূল্য অতদিন আগেও বেশ বেশি ছিল , আমার বান্ধবী নিয়ে এসেছিল সেমি পৈঠানি । অরিজিনালের আঁচলের পাখির মোটিফে নাকি সোনার জরির কাজ একে অমূল্য করেছে । প্রধানত দুরকমের পাখি ... টিয়া ও ময়ূর । কোনটার মূল্য বেশি বুঝতেই পারছ !!! আমার ছোটদির ছেলে সব শুনে বলেছিল... " কাকের মোটিফ কিনলে ভাল করতে .. মেসোর পকেট ফ্রেন্ডলি হোতো !!!!" 😡👿
পরের দিন one day package এ গাইড সহ আমাদের বাস ছাড়ল হোটেলের অফিসের সামনে থেকেই। কজন বাঙালি সহযাত্রী সহ বেরিয়ে পড়লাম। গাইডের বলার ধরণ একটু নাটকীয় , তাতে ক্ষতি ছিল না , তবে গলার উত্থান, পতন ছিল মারাত্মক !! পতনের দিকের বর্ণনা কিছুই কর্ণগোচর হয়নি সেবার । তো খানিক খানিক গোচরিভূত তথ্য নিয়েই একে একে দৌলতাবাগ ফোর্ট , ইলোরার গুহা মন্দির, পানি চক্কি , বিবি কা মকবরা , ঔরঙ্গজেবের সমাধি সব দেখা হল । এর মধ্যেই খাওয়ার বিরতি ছিল , ইলোরা দেখার মাঝে । ইলোরাতে ভাগাভাগি করে দুই দিকে
স্থাপত্য...একদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ গুহা , যেখানেই সেই বিখ্যাত কৈলাশ মন্দির, যার জন্য আমার ইচ্ছাপূরণ হল , আর অন্য দিকে জৈন গুহা মন্দির। জৈন গুহা মন্দিরের সিঁড়ি দেখে আক্কেল গুড়ুম, প্রায় ছোটবেলার style এ ( মনে নেই ছোটকালের কথা ) হামা দিয়ে হ্যাঁচোর প্যাচোড় করে উঠলাম শেষমেষ। কর্তা ছিলেন পিছে , তাই টেনে তোলার উপায় নেই। এদিকে ইলোরাতে আরেক কাণ্ড ধরা পড়ল ... কর্তা মশাই এর সদ্য উপহার স্বরূপ পাওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা আর আগেকার আমার কোডাক k20 এই দুইখান নিয়েই বেড়ু বেড়ু করতে গিয়েছিলাম... ভাগ্যিস !!! কর্তা মশাই এর বিবেচনার কথা বলতেই হবে । ইলোরা চত্বরে নজরে এল এ যাবৎকালের সব ছবির কিছুই নতুন ক্যামেরা আর দেখাচ্ছে না । কি হবে ?? কত কায়দার ছবি তুলে দিয়েছিল কর্তা মশাই !!! 🤔😥
নাহ্ সে সব গেলোই , ভাগ্যিস ভাগযোগ করে দুই যন্ত্রেই ধরে রেখেছিলাম ছবি .... । খুব মন ভার হয়েছিল। তাজমহলের আদলে তৈরি বিবি কা মকবরাতে এই মিঞা বিবি পুরাতন পদ্ধতির সহায়তায় ছবিও তুলেছিলাম, যা আজও অক্ষত।
এই ঘোরাঘুরির মধ্যেও শাড়ির কারখানা পরিদর্শন ছিল । সেখানে বাসের সকল মহিলা হাসি মুখে আর কর্তারা বিরস বদনে হাজিরা দিলেন। মায়ের জন্য একখান শাড়ি কিনেছিলাম, নিজেই । জামাইকে আর দুঃখের ভাগিদার করিনি । তাতেও মুখ ভার !!! বিয়ের পর থেকেই বুঝিয়ে আসছি ... তোমার টাকা আমার টাকা এবং আমার টাকা আমার টাকা !!! তা শুনলেও মানলে তবে না ? আচ্ছা তোমরাই বলো দেখি , বিয়ের মন্তর কে বলে পুরোহিত মশাই এর সাথে ? আমরা তো বসে বসে ভাবি এরপর কি কি হবে ??? হতে চলেছে ??? তবে ?? ওখানে যদিদং .... ইত্যাদির ইতিবৃত্ত অনুযায়ী তোমার সবই আমার... সে যাই বলো না বলো .... ।
যাক সেদিন হা ক্লান্ত হয়ে ফিরে , খেয়ে দেয়ে ঘুম , পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে পুনে হয়ে আমরা রওনা দেবো পাহাড়ী গন্তব্য মহাবালেশ্বর । তার গল্প আবার হবে কেমন ??
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment