বেড়াতে গিয়ে মজারু (১১)
বেড়াতে যাওয়ার ঘটনার ঘনঘটায় রাজধানী ভ্রমণও সাথে আছে। দিল্লি চলো বললেই তো আর যাওয়া যায় না !! রাজধানী বলে কথা । বেশ কয়েকবার টালবাহানা পেরিয়ে দিল্লি, আগ্রা ও ভরতপুর যাওয়া ঠিক হলো। পুপে (আমার কন্যা) তখন হাঁটতে শিখেছে। ওখানে পৌঁছে ঘোরাঘুরি শুরু হলো। চারিদিকে ইতিহাস ওতপেতে বসে আছে। যেখানে , যেদিকে যাই আমার কন্যা বিপরীত দিকে হাঁটা দেয় ।এ যে ভবিষ্যতের forecast ছিল .... এখন বুঝতে অসুবিধা নেই। তখনো সে নিয়ে বিস্তর ঝামেলা বেধেছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু সে ঝামেলার সমাধান পরদিন বিনা প্রয়াসেই হয়ে গেল। কারণ বিশেষ কিছু নয় .... প্রথম দিনের হন্টনে আমার কন্যার বুদ্ধি খুলে গেল বলতে পারো .... দ্বিতীয় দিন আমাদের দিল্লির আপাত আবাস বঙ্গভবনের নিচে নেমেই সে ঘোষণা করল .... " বাবা কোলে "। ব্যাস সারা ভ্রমনে বাবার কোলে চেপে মজায় ঘুরতে লাগলো সে। আর আমার কর্তার মাজা ব্যাথার প্রকাশ পেতে লাগল তার বাছাই করা শব্দ চয়নে। সে সব শব্দ প্রকাশিত হওয়ার মতন নয়কো । আর তেনার সব রাগ গিয়ে পড়ল মুঘল শাসনকর্তাদের ওপর। কেন ?? আহা বুঝলে না !! তাঁদের স্থাপত্য কীর্তি দেখতে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছেও দেখা মিলেছে কোন না কোন প্রবেশ দ্বারের, তারও বহু পরে দৃশ্যমান হয়েছে মূল দর্শনীয় স্থান। কোনো কোনো জায়গায় আমি কিছু কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে সিন্ধুতে বিন্দুই বলো বা কোটিকে গুটিক যাই বলো একদমই তাই। আর আমার শিখণ্ডী ক্যামেরা তো আছেই... তবে বেড়াতে গিয়ে মেয়েকে বাবাই সামলে নেয় হোটেলের বাইরে আর আমি হামলে পড়ি দর্শনীয় বিষয়কে লেন্স বন্দী করতে।
এভাবেই ঘোরাঘুরি চলতে থাকে।
বেড়াতে গিয়ে marketing করার বদ অভ্যাস আমার আছে। সে নিয়ে চাপান উতোর নতুন কিছু নয়। তবে কিছু তো নতুন থাকবে.... থাকতেই হবে। আসলে ব্যাপারটা পুরোই বুমেরাং হয়েছে আমার কর্তার ক্ষেত্রে। তাহলে ঘটনাটা গোড়া থেকেই শুরু করি .... আমাদের বিয়ের আগেও আমার কর্তা মশাই অনেক বেড়িয়েছেন.... সবই স্কুল বা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে। এমন বেড়ানোর সময় অন্যান্য বন্ধুদের অর্ধাঙ্গিনীদের সাথে করে shopping করানোর দায়িত্ব স্বেচ্ছায় বরণ করেছিলেন তিনি । অবশ্যই অর্থ দিয়ে নয় বরং তাদের উৎসাহ দিয়ে। এখন তার অবস্থা ঠিক সেসময়ের ওই অসহায় বন্ধুদের মতোই । কারণ আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহ দিতে খুব একটা হয় না , আমি কাউকে না পেলে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিই আর ওর কোন না কোন বন্ধু আমাদের সহযাত্রী হলে এ দায়িত্ব সে নিয়ে নেয়.... কাজেই বুঝলে তো কার্যকারণ পরম্পরা !!!
তো হঠাৎ বেশ কিছু দিন যাবৎ notice করলাম আমার কর্তা মশাই কেনাকাটার সম্ভাবনা দূর করতে উঠে পড়ে লেগেছে.... যেখানে কিছু কেনার বাসনা জাগছে ... সেখানে অকারণ ঝগড়া করে দুমদাম করে দোকান বাজার ছেড়ে প্রায় ছুটে এগিয়ে যাচ্ছে!!! প্রথম প্রথম বুঝিনি .... এই করে লালকেল্লার মীণাবাজার আর ফতেহপুর সিক্রির মার্কেট কমপ্লেক্স এর এক দুটো জিনিস মাঠে মারা গেল মানে ব্যাগস্থ করা হোলো না !!!! কিন্তু এখন আমিও সব বুঝে গেছি ..... যতই রাগাও আমি রাগবই না।
তো দিল্লি আগ্রা পেরিয়ে আমরা গেলাম, রাজস্থানের ভরতপুর পাখিরালয়। সেখানে পাখি দেখার সাথে সাথেই শীতের ওই সময়ে ( ফেব্রুয়ারি/ মার্চ ) ময়াল সাপ দেখা যায়। সেই অ - অজগর আসছে তেড়ে এর বিখ্যাত চরিত্র। চরিত্রই বটে। ওরা সজারুকে তাড়িয়ে তার বাসার দখল নেয় , আর শীতের রোদ পোহায় ওই বাসার ছাদে , মানে সজারুর গর্তের ওপরে। গাইড বললেন যে ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে দেখা মিললেও মিলতে পারে। আমরা সাড়ে চারজন চলেছি গাইডের গাইডলাইন ধরে.... যথারীতি পুপে তার পাপার কোলে। সব থেকে শঙ্কিত মেয়ে কোলে মেয়ের বাবা .... এমন ভাবে আসে পাশে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে অজগরের তেড়ে আসার আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে । হঠাৎ গাইডের ইশারায় দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই, তার নির্দেশিত দিকে দেখা পেলাম..... সবাই দূর থেকেই দেখলাম। সবথেকে দূরে কে বলো তো ? হ্যাঁ ঠিক ধরেছ মেয়ে কোলে এক বাবা । গাইডকে ক্যামেরা দিলাম। প্রায় সামনে বসে ছবি তুললেন। না আমার সাহসও কমের দিকেই। কিন্তু এখানে সবার পিছনে একজনই .... । বাবা বোধহয় এমনই হয় । আমাদের সঙ্গী সত্যদা বলেই ফেলল ঠাট্টা ছলে .... " খেলে I mean গিললে তোমাকেই ধরবে .... অনেকদিনের ক্ষিদেরর নিবারণ হবে "
এখানেও কটমটে দৃষ্টি পড়ল সত্যদার ওপর। তবে ওই বক্তব্যের জন্য একটু , সামান্য অগ্রগতি ও হলো আমার কর্তার। কিন্তু এর মাঝে এতো জনের নড়াচড়ায় , মাটির কম্পনে বোধহয় কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে তিনি পাতালপ্রবেশ করলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ..... কে বলো দেখি ????
আমার তো নানা রকমের ভয়। তাই নিয়েই অর্ধেক জীবন যাপন হয়ে গেল বাকিটাও ওমন ভাবেই কাটবে। বেড়াতে যাওয়ার পথে ট্রেনে ওঠা থেকেই নানা রকম ভয় নিয়েই চলতে শুরু করি। তাতে কষ্টকল্পনা , শুধু মাত্র মনে হওয়া থেকে শুরু করে সবই জায়গা করে নেয়। একবার middle bunk থেকে খুব মন দিয়ে কোনাকুনি উল্টো দিকের দুই সহযাত্রীর আচার আচরণে খুব নিবিষ্ট মনে দেখছি আর মনে মনে দানা বাঁধছে সন্দেহ !!! হঠাৎ খেয়াল হলো আমার সাথি আমার দিকে তাকিয়ে উল্টো দিকের middle bunk থেকে মিটি মিটি হাসছে । আমি তাকাতেই মাথা নাড়িয়ে মৃদু গলায় বলল .... যা ভাবছো, তেমন কিছু নয় ... ঘুমিয়ে পড়ো । ওমন হাসি দেখলে ভয়ানক রাগ হয় , তাই গাল ফুলিয়ে ঘুমিয়েই পড়লাম।
কিন্তু কথা হচ্ছে কি আমার মতো এমন জঙ্গির ভয় যে আমার সঙ্গী একদমই ট্রেন যাত্রায় পায়নি কোনদিন.... তা কিন্তু হলফ করে বলতেই পারবে না।
মাঝে পর পর কিছু জঙ্গি ঘটিত ট্রেন দূর্ঘটনা হয়েছিল। কোথা থেকে ফিরছিলাম সঠিক মনে নেই .... যথারীতি আমি আমার bunk এ ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেছে.... কি দেখলাম জানো ? আমার কর্তা যে ট্রেনে ভালো না ঘুমালেও bunk এ চোখবুজে শুয়ে থাকে .... সে একটা ছোট টর্চ হাতে নিয়ে চুপ করে আতঙ্কিত মুখে বসে আছে .... আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওমন ভাবে বসার কারণ কি ? গম্ভীর গলায় উত্তর এলো .... " এখন জঙ্গল মহল পার হচ্ছে গাড়ি..... আমি অবাক .... " তো হচ্ছে । তোমার কি হয়েছে? একরাশ বিরক্তি মাখা উত্তর এলো ... " কি আবার হবে ? এটা মাওবাদী এলাকা । তুমি ঘুমাও । পেরিয়ে গেলেই শুয়ে পড়বো । " বোঝো কাণ্ড...মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল... কোনো মতেই আটকাতে পারলাম না .... " তা তুমি কি টর্চ দিয়ে মাওবাদী টর্চার আটকাবে ?" ..... এবার লাগাম দিলাম মুখে... ওদিক থেকে দাঁত কিড়মিড় শুনলাম কিনা ঠিক মনে নেই।
পাশ ফিরে ঘুমের চেষ্টা করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর বুঝলাম টর্চের জন্যই হোক বা না হোক আমরা সব গোটাই আছি আর আমার কর্তা train এ জীবনে প্রথম হাসপাতাল ছাড়া night duty দিয়ে খুবই ক্লান্ত। সে তখনও ঘুমের দেশে , স্বপ্ন দেখছে কিনা কে জানে ?????
@ শুচিস্মিতা ভদ্র
No comments:
Post a Comment