বেড়াতে গিয়ে মজারু ১৮
পরীক্ষার শেষ প্রহরের দেখা এবারও মিলল , হোক না সে অনলাইনের পরীক্ষা । আপাতত করোনা জন্য ট্রেন অথবা প্লেনের বুকিং আমাদের শিকেয় তোলা , যদিও পরিষেবা চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে কপাল ঠুকে যাচ্ছেন বটে , তবে আমরা এখনও ও পথ ধরিনি। তবে আগামী দিনে যে ধরব না , এমনও বলিনি । just দেখছি, ভাবছি ....অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছি। গতবছর আমরা যখন ভালোয় ভালোয় ঘুরে ঘরে ফিরলাম, তারপর করোনা ডালপালা বিস্তার করল , সব যাতায়াত বন্ধ হলো । পরে আস্তে ধীরে আবার আমরা বন্দী দশার বাইরে এদিক ওদিক দেখে , সাবধান হয়ে কাজে কর্মে , মনের টানাপোড়েন কাটিয়ে মনের ডাকে ভয়ের থেকে ছুটি নিলাম... বেরিয়ে পড়লাম।
এমন ধারার বেড়ুর মার নেই , এ যেমন ঠিক , আবার সাবধান হয়েও সব বিপদ যে এড়ানোর নয় , তাও ভুল নয়। এবারের আলাপ, বিলাপ , জোগাড় সব শেষ করে আমাদের জয়যাত্রা শুরু হলো মন্দারমণির দিকে । মেয়ে তো শুরুতেই সুরুৎ করে অন্য গাড়িতে আর দুই খুদের সঙ্গী হোলো আর আমি ঝাড়া হাতপায়ে বাকিদের সঙ্গ দিলাম। পুরোপুরি বিঘ্ন শূন্য যাত্রা যে হবে না , তা জানতামই । আরে বুঝলে না ?? চিরকালীন বাবা যে আমাদের সাথেই ছিল মেয়ের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে !!!
আমরা জমজমাট গল্পের আসর বসিয়ে এগিয়ে পড়লাম, পুপে দিদি আর তার খুদে সঙ্গী পথে খাওয়ার পালা শেষ করে , পথে কিছু দানও করল !! এবারও আমাদের সাথে সবার জন্যই ছিল হরেক রকম ঘরে তৈরি করা খাবার। দলের চার গৃহিনীর রান্না ঘরে তৈরি দুধ চা, আলুর দম, রুটি , দু রকম কেক , মিষ্টান্ন ( এটা দোকানের বটে ) ও আমিষ আর নিরামিষ স্যাণ্ডউইচ। খাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি ও চলল গড়গড়িয়ে , আমরাও গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পথের শোভা ও রাজনৈতিক নানা দলের নানা ফুলের মেলা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। সামনেই যেমন বসন্তের দোল উৎসব , তেমনি আবার কাছেই ভোট উৎসব .... কাজে কাজেই সব ধরনের ফুলের মেলা দেখতে দেখতেই এক সময় পথের শেষে আমাদের মন্দারমণির বাসস্থানে পৌঁছলাম।
এবারের এই বেড়ুর উত্তেজনা একটু উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল , কারণ নতুন দুই খুদে , যারা নাকি পুপে দিদি বলতে অজ্ঞান, তারা সজ্ঞানে সাথে ছিল । কদিন আগে থেকেই বেড়ু সিদ্ধ জ্ঞানদা দিদির ভূমিকায় পুপে , তাদের বাণী বিতরণ করছিল । আর ওদের উত্তেজনা যে আমাদের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল তা আর বলতে ?? আমাদের পোষাক , জুতো , সাজন , গোজন দেখে দুষ্টু লোক কি কি বলতে পারে , সে সব আগাম আমরাই বলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আরে ভাই !!! মন্দারমণি কিসে কমতি ? শুধু পাটায়া হলেই সাজের বাহার হবে ????
পৌঁছে, খানিক ধাতস্ত হয়ে , সকলে সমুদ্রের সাথে ধস্তাধস্তি করতে বেরিয়ে পড়লাম। বেলা তখন মন্দ হয়নি । তবে আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সকলের লটবহরে কড়া নজর রাখলাম। পরে শরতদার জিম্মায় সব রেখে অল্প জলে পা , হাঁটু ভিজিয়ে সবাই হোটেলে ফিরে ভোজন পর্বে ডুব দিলাম। সকলের পেটে তখন খাই খাই রব । সব রকমের খাবারে ভুরিভোজ হলো , যদিও শেষ পাতে কিছু কম পড়েছিল , কিন্তু ততক্ষণে সব ফুরুৎ 🤫 । পরে অল্প বিরতি নেওয়া হল। যদিও খুদে বাহিনীর তাতে খুব সমর্থন ছিল না । কিন্তু আমার কন্যা আগের দিন রাত থেকেই যাওয়ার উত্তেজনায় প্রায় জাগন্তই ছিল .... কাজেই তাকে না শোয়ালেই নয়। কিন্তু ঘন্টা দেড়েক পরেই সে হ্যাচড় পাচড় করে উঠে মেতে উঠল ,অপর দুই খুদেকে নিয়ে । চায়ের সাথে ভালো রকমটা খেয়ে আমরা সকলে ঘর বন্ধ করে হোটেলের বীচ সংলগ্ন বাগানে জমজমাট আসর বসালাম।
আকাশে আসন্ন পূর্ণিমার চাঁদ , সামনে সাগরের ঢেউ এর উথাল পাথালের মাঝে বেমানান শুধুই বাগানের হাল্কা বৈদ্যুতিক বাতির সারি । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁধন প্রয়োজন আছে বৈকি !!! এমন মন মাতানো পরিবেশ , প্রকৃতিতে গান আপনিই এসে যায় .... আমার কর্তা মশাই আর মৌ এর উৎসাহে গান চালু হলো , বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ হলাম শরতদার গানে , মৌয়ের কাছে আগেই জেনেছিলাম, এবার শুনলাম, অপূর্ব। গান চলতে থাকল আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে। আমার কর্তা মশাই এর কিছু পেটেন্ট গান আছে ... যা এমনতর আসরে আমাকে পরিবেশন করতেই হয় , এবারও হোলো । রাতের খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে ঘরে এসে শুতেই গভীর ঘুমে সবাই ডুবে গেলাম...সারাদিনের ক্লান্তি , ধকল তখন দিনের শেষে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল ।
ঘুম ভেঙে উঠে পেলাম কুয়াশার চাদরে মোড়া সমুদ্র। বারান্দা থেকে মনে মনে শুনতে পেলাম ... সাগর ডাকে আয় , আয় .. যে কোন বেড়ানোর জায়গাতেই ভোরে ঘুম ছুটে যায় জলদি আর জায়গা বুঝে কোথাও কোথাও আমি একাকি ঘোরাঘুরি করি ,এ সময় তাজা বাতাস ফুসফুসে ভরে নিতে দারুন লাগে। তবে খুব বেশি ভোরে নয় অবশ্যই আর সর্বত্র নয়ও । বাবা ও মেয়ের তখনও ঘুমের ঘনঘটা জারি রয়েছে , কর্তা মশাইকে জানান দিয়ে ক্যামেরা আর মোবাইল নিয়ে সাগর দার ডাকে সাড়া দিলাম। এমন ডাকে সাড়া দিতে বয়ৈ গেছে কি বলা যায় ??
নিজের মনে কিছু বিরল মুহুর্তকে মন-বন্দী , ক্যামেরা -বন্দী করার পর হাঁটতে হাঁটতে জলের ধারে চলে গেলাম , কতজন যে নিজের খেয়ালে হাঁটছেন, ঝিনুক কুড়াচ্ছেন...এরপর আস্তে ধীরে ঘরে ফিরলাম। পরের পর্ব খুব সংক্ষিপ্ত। চা আর জলখাবারের পাঠ মিটিয়ে আবার সাগরে সমর্পন । এ দিন দুই ছানাকে সামলে, জলের ধারেই বসেছিলাম নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে । তা কি কারো সহ্য হয় ?? সমুদ্রের ঢেউ যেখানে তার শক্তি হারিয়ে ম্রিয়মান হয়ে যায় , সেখানে থাকতেই আমার ভালো লাগে । ঢেউ এর সাথে পাগলামী করতে কি ওদের মানা করেছি ?? তা তো নয় , কিন্তু এক এক বার এক এক জন আয় আয় , আরেকটু আয় বলে কোন সুদূরে নিয়ে হাজির করল !!! কয়েকবার আমার কর্তা মশাই এর পিছনে লুকিয়ে পড়ে ঢেউ আটকেছি , কিন্তু জলে নামলে কি ওভাবে জলীয় বিপদ এড়ানো যায় ?? নুন জলও খেতে হলো , নাকের জলে , চোখের জলে অবস্থা । আমার ক্ষেত্রে রেকর্ড ব্রেকিং বুক সমান জল ...ভাবা যায় ?? এর মধ্যে দুই দম্পতি আবার জলের মধ্যেই কোলে পিঠে ও চড়ে ভাসতে শুরু করল , একজনের অবশ্যি কাঁধ জানান দিচ্ছে , এমন কানাঘুসো শুনতে পেলাম পরে !!! যদিও সে মানতে নারাজ । ওদিকে জলের মধ্যে একজন তার কর্তা কে ধরে , একটু রোমান্টিক হতে গেল তো সেই দাদা লজ্জিত হয়ে ... আমাকে ধরছো কেন ?? বলে পগার পারের মতন সাগর পার হয়ে গেল প্রায় প্রায় । দাদার ঘরনীও ফোলা গাল আরো ফুলিয়ে দূরে দূরেই সাঁতরে ফিরল । এদিকে আমাকে তোলা মুশকিল, ওজন নেহাৎ ফেলনা নয় মোটেই। না হলে এমন রোমান্টিক সুযোগ হারাতে দিতাম নাকি ?? বয়স হয়েছে তো কি ?? দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি !!! তবে ???
বেলা শেষে ফিরে পরিষ্কার জলে স্নান পর্ব মিটিয়ে আবার হামলে পড়ে খাওয়া হলো । এবারে সবাই সাবধানী , আগাম বেশি করেই খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। খাওয়ার পর আমার কন্যা ছলোছলো চোখে নাটকীয় পরিবেশের অবতারণা করে ছোট্ট সাথি আদির সাথে রিমিদের ঘরে ঘুমাতে গেল । পুরানো দিনের বাংলা ছায়াছবির কড়া মেজাজের বাবার বদলে মোলায়েম মেজাজ বজায় রেখে বেড়ানোর সঙ্গে তাল রাখার উপদেশ দিয়ে এ দিকের বাবাকে ঠাণ্ডা করে ঘুমানোর উপদেশ দিলাম। সে ঘুমানোর আগে আমিই ঘুমিয়ে কাদা । ঘুম ভাঙল দরজার পেটাপেটিতে , খুলে দেখি জন মানিষ্যি নেই....এ কাদের কারবার !!! বুঝতে কি আর বাকি থাকে ???
এই দিন ছিল সপ্তাহের শনিবার, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই খুদে বাহিনী হোটেলের বাগানে খেলতে গেল আর কজন গেল সমুদ্রের বীচ মুখী গার্ডেন চেয়ারের দখল নিতে ।কেন ?? সপ্তাহান্তের ভিড় তো এ চত্বর জুড়ে ছড়ানো । না হলে পরে আসর বসাবো কি করে ???
সেদিন ছিল মাঘী পূর্ণিমা। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ মামাকে দেখে আকুল হয়ে সব ভাগ্নে ভাগ্নি নীচে নেমে এলাম। এসেই ছন্দ পতন !!! এক তো হোটেলের বাগানময় আলোর আলপনায় চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর দফা রফা তাতে আবার গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত চটুল হিন্দী গানের আলাপন !!!! মেজাজটা একটু পানসে হয়ে গেল , সেদিনে কি কি গাইব সেসব গানের লিস্টি সেই থেকে মনে নিয়েই ঘুরছি 🤫 । সুযোগ পেলেই গেয়ে শোনাবো কিন্তু । অগত্যা মনের ব্যাথা মনে রেখেই বীচে নামলাম... মন ভরে গেল , বুঝলাম কেন চাঁদ নিয়ে এত রচনা । সাগরকে কি অপূর্ব যে দেখাচ্ছিল চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মেখে , ব্যাখ্যার ভাষা নেই আমার ভাঁড়াড়ে । এক সময় ফিরলাম, ফিরতেই হলো । সাথে ছিল সত্যদা আর মঞ্জুশ্রী , জল বাড়ছিল , বাড়ছিল তীব্রতা । ফিরে এসে জমাটি আড্ডা চালু হল চা ও টা সহযোগে , কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়ার উৎপাতে আমরা মহিলা মহল আর একটু পরে এণ্ডী গেণ্ডী সহ ঘরে এসে চিৎপাত হলাম আর ওরা থাকল ওধারে ।ওদেরও একটু পিএনপিসির সুযোগ দেওয়ার দায়িত্ব তো আমাদেরই, তাই না ?? রাতের খাওয়ার শেষে যে যার ঘরে উপুড় হলাম। রবিবার সকালেই আমাদের ঘরে ফেরার পালা ....মনে তখন মন খারাপের দিস্তা । তার মধ্যেও চা ,জলখাবারের পাঠ মিটিয়ে অঞ্জন,মৌ আর শরৎদা আরো একবার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে এল। ছোটদের ইচ্ছেকে আপাতত চাবি দিয়ে রাখা হল। তারপর সাগরের ডাকাডাকি উপেক্ষা করে , তাকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। এবারও পুপে দিদি অন্যত্র থাকল। যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি, শয়ন এসবের মাঝেই বাড়ি এসে পড়ল । অনেক অনেক আনন্দে ঝাঁপি বোঝাই করে , আগামী বেশ কিছুদিনের মনের খোরাক জমিয়ে নিত্য দিনের কাজে নিজেদের জুড়ে নিলাম। ফেরার পর আমাদের খুদে সদস্য আদিবাবু ঘোষণা করেছে মহিলা মহলকে বাদ দিয়ে বাবা, দাদা আর কাকুদের সাথে সে শিগগিরই সমুদ্রে বেড়ু যাবেই যাবে ।
" আজ তবে এই টুকু থাক .... 🥰🥰🥰🥰🥰
#শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment