Monday, 11 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৫


পুরীতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাঙালির কোনো উপলক্ষ্য লাগে না ।" উঠল বাই কটক যাই " এই প্রবচনের থেকে অনেক বেশি মনগ্রাহী অবশ্যই যদি বলা হয় " উঠল বাই পুরী যাই " । আমাদের এবারের যাওয়ার অবশ্য উপলক্ষ্য ছিলই।  তবে পূজো দেওয়ার সাথে সাথে আনুষঙ্গিক সবটাই উহ্য ছিল । কিন্তু ভিড়ের বহর দেখে একটা বিষয়ে দলের সবাই সহমত ছিলাম,  যে বেশি ঘোরাঘুরি নৈব নৈব চ।  

তো ভোর ভোর আগাম সময়ে  হোটেলে হাজির হলেও ঘরের দখল পেতে প্রায় সকাল সাড়ে আটটার কাছাকাছি হয়ে গেল । চেক ইন আর আউটের মাঝে ঘন্টা খানিকের ব্যবধান হলেও একটু এদিক ওদিক ধরতে নেই । আমরাও ধরিনি । দোতলার পাশাপাশি তিনটে ঘর সিঁড়ির একদিকে আর অন্য দিকে আর এক পরিবারের থাকার বন্দোবস্ত হল । সব থেকে জুনিয়র দম্পতির জন্য,  একটু আলাদা ব্যবস্থা এই আর কি !! আমাদেরও ওমন দিন ছিল রে ভাই !!!  এখন তো পুরোটাই গদ্য আর অম্ল-মধুর কলহ মুখর দিনগত পাপক্ষয় 🤫 

 দু দলের দু রকমের পছন্দসই( লাল চা & দুধ চা ) চা পান করার পর বুদ্ধি খুলল  , ঠিক হল সবাই হোটেলের নীচের রেস্টুরেন্টে জলখাবার খেয়ে সমুদ্রে সমর্পন পর্বে মন দেবো । সেই মতন ভরপুর জলযোগ করে সকলে একে একে সমুদ্র বিহারে এগিয়ে পড়লাম। তবে পুরী আর দীঘার ঢেউ যে আকাশ আর পাতাল , সে তথ্য আমার অবগত ছিল , তাই আমি সবার সম্পত্তির পাহারাদার / চৌকিদার নিযুক্ত হলাম স্বেচ্ছাকৃত ভাবে। খান তিনেক চেয়ার ভাড়া করে মাল পত্তর সহ আমি থাকলাম এধারে আর ওরা গেল ওধারে । সমুদ্রের ধারের স্নানরত জনতাকে দেখে মনে নানা ভাবের উদয় হল , প্রশ্ন জাগল ... অতিমারি কারে কয় ? সেটা দিয়ে কি করা হয় ? সেটা কোথায় হয়েছে ? .... তবে তাও একটা কথা বলতে হবেই অধিকাংশ মানুষই সাবধানী ( অন্তত আমার চোখে যা পড়েছে সেদিন  ) এবং মাস্ক-বাদী । এদের মধ্যে ভাগাভাগি করলে কারোর কারোর মাস্ক পরার ধরনে থুঁতনি বিলাস প্রকট । তবুও বলা যায় মানুষের অভ্যাস হয়েছে , হচ্ছে , হয়ে চলছে । সাবধানতার বর্ম আর যাই করুক বিপদে ফেলে না বা কম ফেলে বিপদে । ওই জন্যই  তো গুরুজনে বলেছেন .. সাবধানের মার নেই  । তবে কথা হল গিয়ে জলের একটা আকর্ষক শক্তি আছেই , কাছে গেলে টের পাওয়া যায় ঠিক । বসে থাকতে থাকতে মনে ইচ্ছে উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করল ... পাশের চেয়ারে আসীন এক মাসিমাকে আমাদের সমুদ্রগামী ব্যাগের দায়িত্ব ট্রান্সফার করে গুটি গুটি এগিয়ে গেলাম । অজানা -অচেনা মাসিমাকে ব্যাগ দিলে  ?? ওসব বললে একদম খেলব না ... দুনিয়া শুদ্ধু সকলকে অবিশ্বাস করতে আমি অপারগ আর সামনেই আমারই মতন পায়ের পাতা ডোবানো জলে মাসিমার মেয়ে-জামাই সাঁতার দেওয়ার যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করছিল না , তা বাপু আগে ভাগেই দেখে নিয়েছি , সর্বোপরি যার থেকে চেয়ার ভাড়া করেছিলাম আমরা , তিনি " কিছু হইবো নি " বলে অভয় দান করেছিলেন । বিশ্বাস,  সতর্কতা , আশ্বাস সবের ফলাফল আমার সাগরের ডাকে সাড়া দেওয়া ... তবে বলা ভাল দীঘা , মন্দারমণির সাগরের ডাকে যতটা সাড়া দিয়েছিলাম,  পুরীর সাগর দাদার ডাকে ওমন ভাবে সাড়া দেওয়ার মতন মনের জোর বাপু আমার নেই কো । বালি সরে সরে কচি বেলার মতন টলোমলো করতে করতে শেষমেষ ধপাস্ করে জলের মধ্যে বসেই পড়লাম ... কিন্তু সাধে কি বলে পুরীর ঢেউ জোরালো !!! আমার এমন ওজনদার বপুকেও মাঝে মাঝে টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গো !!! এদিকে আমাদের দলের ম্যানেজার মানে আমার কর্তা মশাই একদম লাগাম ছাড়া আর নাগাল ছাড়া । অন্যবার তাকে চেপে ধরে আর এগোতে দিই না , আর খানিক লবনজল সেবন করে থাকি ... এবার তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে কন্যা ও অন্যান্য জলচর সাথিদের সাথে মহানন্দে স্নান করলেন । আমি পাড়ে থাবা গেড়ে বসে খালি  বালি মাখলাম । ওরা এবারও আয় আয় , এসো এসো শুরু করেছিল , আমি সোজা জল থেকে উঠে চেয়ারে ... এরা হাঁপিয়ে একটু জিরোয় , আবার এগিয়ে যায় ... সব থেকে ছোট্ট আদি বাবুও তাই , সে আবার ঢেউ এর ঘায়ে এদিক ওদিক হলেই সামনে যাকে পাচ্ছে গাছ বাওয়ার  মতন গা বেয়ে উঠে পড়ছে ... সত্যদাকে বেয়েও উঠছে , কিন্তু থামছে না সে কোন মতেই। এ ভাবেই বেলা গড়িয়ে গেল অনেকখানি ... একে একে জলচররা উভচর হলেন ... সমুদ্দুরের ধারে ওখানকার ফেরি করা ছানার জিলিপি , নতুন নাম ধারী(মনে পড়ছে না) এক ভয়ানক মিষ্টান্ন দিয়ে নোনতা মুখ মিষ্টি করে সবাই ঘরে ফিরলাম ... একদম বিপরীত দিকেই আমাদের হোটেল । ফিরে সকলে আরেক প্রস্থ স্নান করে ... খাওয়ার ঘরের পানে জড়ো হলাম । যারা স্নান করেছে , তারা তো বটেই সাথে আমারও ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছিল ... মিষ্টি খেয়েছি তো কি , অতোক্ষণ ছিলুম তো ... সমুদ্দুরের হাওয়ার গুণ বলো আর বেড়ানোর গুণ বলো ক্ষিদে পেতেই পারে তাই না ??? 

সন্ধ্যার দিকে আমরা চললাম নতুন বীচ্ বা সমুদ্র সৈকতে । কিছুকাল হল বি .এন .আর এর দিকে গড়ে উঠেছে Blue flag beach । সাজানো গোজানো বীচ  , পরিচ্ছন্ন,  বসার ছাউনি ... নেই স্নানের অনুমতি । দিনের আলো থাকতে ওখানে গেলে ,  যে বেশ ভাল লাগত , তা বলাই বাহুল্য।  টিকিট কেটে সাজানো বীচে কিছুক্ষণ কাটানোর পর , আমরা চলে গেলাম আমার কন্যার জন্য তার জেঠুর তরফ থেকে  অর্গানাইজ করা surprise party তে । আসলে হয়েছিল কি , জেঠু তার আহ্লাদী দিয়া ওরফে পুপের জন্মদিনের জন্য তার এক অফিস কর্মীর (ওখানকার শাখার ) মারফত সমস্ত ব্যবস্থাপনা করে রেখেছিলেন । সেই মতন সব পর পর হলো সেই ভদ্রলোকের বাসস্থানের নীচের তলার হল ঘরে , সাথে ভুরিভোজ।  ভোজন , নাচন সব মিটিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত করে । পরের দিনের প্ল্যান আগেই ছকে নেওয়া হয়েছিল । পরের দিন উপলক্ষ্য পূরণ অর্থাৎ পূজো দেওয়ার কথা আমাদের।  

মন্দিরে যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম অতিমারি জনিত কড়াকড়ির কথা , সে মতন সব কাগজপত্র সাথে ছিলই,  তাছাড়াও আমাদের একজনের ডবল ভ্যাকসিন না থাকার দরুন সদ্য করা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট ধারী কাগজ ছিল মজুত । তার মনে সংশয় থাকলেও সে আমাদের সাথে চলল , আমরাও কপাল ঠুকে জয় জগন্নাথ  বলে আণ্ডা বাচ্চাদের তাদের  মৌ আন্টির জিম্মা করে বেরিয়ে পড়লাম।  মৌয়ের এবার মন্দির দর্শনে রয়েছে পারিবারিক বাধা । গতবছর মাসিমা অর্থাৎ মা চলে গেছেন । 

দাদার পরিচিত পাণ্ডার সহায়তায় সব লাইন পেরিয়ে আইন মোতাবেক সকলে মন্দিরে পৌঁছলাম নির্বিঘ্নে এবং জলদি । দূর থেকে দর্শনও হল দিব্যি ... সবেমাত্র  ভাব বিহ্বল হয়ে ছলো ছলো চোখে  মনের প্রার্থনা জগন্নাথ দেবের কাছে নিবেদন করেছি কি না করেছি ... পিছন থেকে কর্তা মশাই এর আর্তি শুনে থমকে গেলাম।  আসলে হয়েছিল কি , লাইনের ভি.আই.পি বিভাগ আমাদের সহজে উতরে দিলেও সব লাইন মিলে মন্দিরের ভিতরে ভক্ত বৃন্দের খিঁচুড়ি আর এ সময়ের দর্শনে  পুণ্য অর্জনের আধিক্যে , দেশোয়ালি জনতার ভিড় ও তাদের জয় ধ্বনিতে কর্তা মশাই যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন !! আমার কর্তা মশাই এর বদ্ধতার ব্যরাম আছে , যার গালভরা নাম claustrophobia।  তাকিয়ে দেখি তিনি ঘেমে নেয়ে একসা আর চোখে মুখে আতঙ্ক । এমতাবস্থায় সাহস দিয়ে বিশেষ লাভ হয় না , তাও চেষ্টা করলাম , হাত ধরে , অনেক চেষ্টায় কাঁধ বেড় দিয়ে ধরে ভরসা জোগানোর চেষ্টাও বৃথা গেল ... দেখলাম দলের সবাই আগুয়ান হলেও আমার প্রাণনাথ ভরসা দানেও কেমন যেন ফরসা হয়ে আসছেন ... হাত মুঠো করে চেপে অন্য সাথিদের জানান দিয়ে দুজনে লাইন থেকে বেরিয়ে এলাম  একপাশে । অল্প বয়সী এক পুরোহিত বৈদ্যুতিক পাখার দিকে দিক নির্দেশ করে দিলেন । দাঁড়ালাম দুজনে । একবার বলার চেষ্টা করলেন ... " তুমি ওদের সাথে যেতে পারতে , আমি না হয় , দাঁড়াতাম । " আচ্ছা এক যাত্রায় পৃথক ফল কি হয় ? তোমরাই বলো ?? এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর , মন্দিরের সিকিউরিটি গার্ড ও আরও কজনার সহায়তায় ভিন্ন পথে বাইরে বেরিয়ে এলাম । বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ার (তখনও অরুণদেব তেজ দেখাতে শুরু করেননি)মধ্যে এসে সত্যিই যেন ধড়ে প্রাণ এল । কর্তা মশাই সুস্থ বোধ করলেন , মুখে হাসি ফুটল । সত্যি বলতে কি , আমার claustrophobia না থাকলেও,  ভিড় ভাল লাগে না কোনদিনই , আর এই অতিমারির আবহে ভিড় দেখলে আতঙ্ক জাগে মনে ।  গৌহাটির কামাখ্যাতে একই সমস্যা হলেও ভরসা কাজে লেগেছিল , একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম স্বর্ণমন্দিরের মধ্যে । তবে প্রতি ক্ষেত্রেই  সকলের সহযোগিতা পেয়েছি ।

দর্শন , পূজন , ঘুর্নন ( ঘোরাঘুরি ) সব মিটিয়ে হোটেল ফিরলাম। ঠিক হল জলখাবার সেরে আবার সমুদ্র মন্থন(?) শুরু হবে । আমি জাজ্বল্যমান অরুণদেবের তেজ দেখে ক্ষান্ত দিলাম , জলখাবার খেয়ে ঘরে ফিরলাম,  আমার কর্মক্ষেত্রে অনলাইন এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল , তার প্রতিযোগীদের বিভাগ অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করার কাজ আমার দায়িত্বে ছিল । হোটেলের ঘরে বসে শান্তিপূর্ণ ভাবে সাথের মোবাইল থেকে সে সব তৈরি করতে লেগে গেলাম... এক সময় তা শেষ হল , তেনারাও ফিরলেন , এরমধ্যে আমার কন্যা একবার বিশেষ কারণজন্য ঘরে ফিরে , কিছু পরে আবার সমুদ্রগামী হলেন তার মামীর সাথে । তারপর সব মিটিয়ে খেয়ে ঘুম .... । 

বিকেলে থুড়ি সন্ধ্যার দিকে দল বেরলো আশেপাশে ঘুরতে আর কিছু খরিদারির ইচ্ছাপূরণ করতে । এবার নিজের জন্য কিছু নেব না বলতেই দেখলাম ম্যানেজার কেমন ঝিমিয়ে গেলেন , আমি কিনব বললে , দেব না দেব না বলে  যেমন উৎসাহে কোমর বেঁধে (?)😒 ঝগড়া করে , এবার কেমন মিইয়ে গেলেন , কিছু পরে আমতা আমতা করে নাটকীয় ভাবে শুরু করলেন ... " তোমাকে একটা সুতোও দেবো না , তা কি হয় ?? " মনে মনে হেসে নিলাম।  গম্ভীর হয়ে একখান দোকানে গিয়ে সুতোয় বোনা পুরীর গামছা বাছতে শুরু করলাম।  এবার তো ম্যানেজার হতচকিত 🙄  ম্যানেজ করতে চলে এলেন ... অতঃপর আর খেলিয়ে লাভ নেই বুঝলাম,  সবটাই মাটি হবার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি না করে , মুখ বুজে শাড়ি পছন্দ করে ফেললাম।  নিজের থেকে কিনতে যেতেই আবার সেন্টিমেন্টাল সীন .... । পরবর্তী গল্প খুব সাধারণ। আরো দোকানপাট,  পশরা , ভিড় সব পাশ কাটিয়ে ভিন্ন পথে হেঁটে হোটেল ফিরলাম...অনেক রাত ওবধি আমাদের ঘরেই জমজমাট আড্ডার সাথে ঠিক হলো পরের দিনের কর্মসূচি ।

বেড়ানোও অবশ্যই আমার মতে একখান কাজের মতন কাজ ।মহান কাজ । সংসারের জাতাকলে ভাজা ভাজা হয়ে যাওয়া শরীর ও মনকে তাজা করা কি , যে সে কাজ না সাধারণ কাজ ??  পরেরদিনের একটু ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে শিগগির আসছি । কেমন ??? 

@শুচিস্মিতাভদ্র

No comments:

Post a Comment