বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩১
পরেরদিন যথা নিয়মে ভোরের মনোরম আরামে হোটেলের ঘরের বাইরের চত্বরে চা পান অপেক্ষায় জড়ো হলাম। যদিও সকাল ৭টার আগে রান্নাঘর ঘুমন্ত, কিন্তু কিছু অপেক্ষার একটা অপেক্ষাকৃত অন্য রকম ব্যাপার আছে । অপেক্ষার রকমফের অবশ্যই আছে । সবই যে চিন্তামুক্ত হবে , তা তো নয় !!! তবে এই অপেক্ষার মধ্যেই আমাদের গল্প গাছা চলতে থাকল , পরবর্তি বেড়ানোর গল্পের গাছে তোলার মই নিয়ে আমার কর্তা রীতিমত প্রস্তুত হয়ে গেলেন । কলকাতায় ফিরেই যে , সে মই নাড়াতে শুরু করবেন এবং আমিও যে মই থেকে মাটিতে নেমে পড়ব , এ তো বলাই বাহুল্য।
এসবের মাঝেই চা এসে পড়ল, তারপর গোছগাছ , স্নান , জলখাবারের পর্ব চুকিয়ে বাক্স প্যাটরাসহ বেরিয়ে পড়লাম। ওই দিন দারিংবাড়ির পাহাড় থেকে নেমে আসব , আরো কিছু স্পট দেখতে দেখতে । বিকেল নাগাদ পৌঁছব গোপালপুরে । সেখানে আমরা থাকব সত্য দার অফিসের গেস্ট হাউসে ।
পথের দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চললাম। প্রতিটা গাছের আকার , পাতার রঙ একে অপরের থেকে পৃথক । সবই যেন মনে হচ্ছে ছবি তুলে রাখি । যা অবাস্তব ও অসম্ভব। কিছু বিষয় মনের ক্যামেরাতেও রাখতে হয় । তাই রাখছিলাম । এবারে আমি একা পিছনে লাগেজ নিয়ে নিশ্চিন্তে প্রকৃতি দেখতে দেখতে আর জোয়ান খেতে খেতে চলেছি । মেয়ে প্রথমেই ফতোয়া জারি করে আমাকে দূরে রেখেছে !!! পথেই পড়ল এক জলপ্রপাত যাওয়ার পথ , যেখানে ১৫০সিঁড়ির কথা শুনেই তেনারা ঘচাং ফু করেছিলেন লিস্টি করার সময়ে । কি মনে করে , এবার !!! আমাদের বাহনচালক টিটোর কথায় আমরা জলপ্রপাতের পথ ধরলাম, ঠিক হল যদি পারি নামব , না পারি তো ফিরে আসব ... চেষ্টার শেষ রাখি কেন ?? সেই মতন সূর্য চশমা চোখে পরে এবং সেটাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়েই পড়লাম সিঁড়ির দিকে , খোঁজাখুঁজির খবরে অবাক হয়ে কন্যার মামী আমার দিকে তাকিয়ে কইল ... রোদ চশমা যদি গাড়িতে , তো তোমার চোখে ওখান কি বটে ?? 😁🤪 ..... বাকিদের মনের ভাব অনেকটা এমন তখন ... তুমি কি জামা জুতো মিলিয়ে মিলিয়ে রোদ চম্মাও এনেছ নাকি ?? আমি চুপ 😷। পিছনে আগত অন্য দলের এক মাসীমা হেসেই খুন । আসলে রোদের এমন জোরদার আলো , রোদচশমা নাকি শুধু চশমা নাকে এঁটেছি তা বোঝাই দায় !! এমন হয়েই থাকে , পার্থক্য কেবল নিজের হলে এক , অপরের হলে মনে হয় ভারি মজাদার ঘটনা তো 😁😊!!!! যেমন ধরো আমাদের কলেজের মালাদি , একদিন চশমা হারিয়ে কলেজে এলেন , মন ভার , মুখে মেঘ ... কোথায় রেখেছিলে গো ? প্রশ্নের উত্তরে আমরা ঘায়েল ... কোথায় আবার রাখব !! চোখেই ছিল !!!! 🙄 আসলে ভিড় ঠেলে নামতে গিয়ে চশমা gone , এদিকে ভিড়ের বাস থেকে নামার পর ভড়কে যাওয়া ভাবটা অনেকক্ষণ থাকে বটে ... ভড়কানি কমার পর জগত সংসারের উপলব্ধি ফেরৎ আসে । চিন্তা করলে এমন কম বেশি অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই।
নামলাম ধীরে অতি ধীরে .... জলের কূল কূল শব্দ ঘন হল , জলের ধারার সামনে এসে মনে হল ... এই কষ্ট স্বার্থক । যদিও নামার কষ্ট পায়ে , ওঠার কষ্ট দমে .... ছড়ানো ছিটনো পাথরের এক পাশে ঝরনা নেমে আসছে , গাছের ছায়ায় এত রোদের মাঝেও মন সতেজ করা ঠাণ্ডা হাওয়া । এখানে ওই উতরায় বেয়ে নেমে এসেছে একপাল গাভী । বেশ মজায় তারা আমাদের আসেপাশে পাথরের খাঁজে বেড়ে ওঠা ঘাস দিয়ে প্রাতরাশ সারছিল । আমরাও পাথরের ওপর দিয়ে টলোমলো করে এর ওর হাত ধরে ঝর্ণা কে পিছনে রেখে খান কতক একা ও দোকা ছবি তুলে ফেললাম। গো সন্তানদেরও ক্যামেরা বন্দী করে .... এবার উতরাই পথে এগিয়ে চললাম। নীচ থেকে উপরের পানে চেয়ে মনে মনে ভাবলাম ... জলদি জলদি অদেখা পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে ফেলতে হবে লিস্টি মিলিয়ে ... এক দিকে পা , আরেক দিকে শ্বাস দুয়েরই হাঁসফাঁস প্রাণান্তকর অবস্থা থেকে ফুলস্টপে পৌঁছনোর আগে ভাগে । যদিও ভাবনা আর কাজের ফারাক মেটানো বড়ই গোলমেলে কাজ , ওই গোলাকার চক্র , নেহাতই বক্র ... মেলানো যায় না , মানুষ ভাবে এক , হয় আরেক ।
তো যাইহোক ধীরে ধীরে উঠে এলাম...সিঁড়ির মুখেই চায়ের দোকান ... সেখানে পৌঁছে ই চেয়ারে ধপাস !!! এরা দুজন চা খেল । গরমে আমরা দুই বান্ধবী চা না খেয়ে গাছের ঠাণ্ডা হাওয়া খেয়ে আবার রওনা দিলাম। এবার অনেকক্ষণের যাত্রা । আসল খেলা শুরু হল এবার ... কন্যার motion sickness, যা বিগত কয়েক বার এক হোমিও ম্যাডিসিনের হাতযশে বন্ধ ছিল । এবারে সেই ওষুধ সাথে ছিল না , ফলাফল হাতে নাতে ... এদিকে কন্যার কিছু হলেই তার বাবা একদম মন কেমনের দেশে । বার বার পাঁচ বার ... কন্যার হাল বেহাল। এদিকে আমারও জোয়ানের শিশি প্রায় খালি !!! ধূ ধূ প্রান্তর , ঝক ঝকে পথ আর কট্ কটে রোদ ... ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগের এমন সুযোগ সচরাচর ঘটে না । পরবর্তি গন্তব্য তিব্বতি মঠ জিরাং হয়ে আরেক খাসা জলপ্রপাত খাসাদা । তারপরেও কিছু আছে লিস্ট মোতাবেক , কিন্তু সবটাই সময় আর শরীর বুঝে । কোন সুদূর অতীতে একদল তিব্বতী এখানে এসেছিলেন , আপন করতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার , তারা রয়ে গেলেন ... ছোট্ট বসতি গড়ে তুললেন । তৈরি হল জিরাং মনাস্ট্রি ... প্রকৃতির মাঝে তার রূপ অনবদ্য। মাখনের মতন রাস্তার দুপাশের প্রাকৃতিক শোভার মাঝে অনেক দূর থেকে আমাদের বাহন চালক টিটো দেখালো সোনালি রঙের ঝিলিক দেওয়া মঠের চূড়ো । এক সময় হাইওয়ের পাশে রাস্তার এক শাখার মধ্য দিয়ে যেন এক মিনি তিব্বতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে মনাস্ট্রির চৌহিদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। এক পাশে এক বিশাল সরোবরকে পাশ কাটিয়ে এক প্রশস্ত চত্বরে গাড়ি থামল , আমরা নামলাম। ছবি তোলার সাথে সাথে , সব ঘুরে দেখে , এরপরেই কাছে অবস্থিত খাসাদা জলপ্রপাতে চলে এলাম। বেশ ছড়ানো ছিটনো প্রসারিত অঞ্চল জুড়ে জলের ধারার বয়ে চলা অবিরাম। পিকনিক হয় শীতে । বেশ অনেক পর্যটক থাকলেও ফাঁকা ফাঁকা সবাই ঘুরছে , ছবি তুলছে , সর্বোপরি স্নানরত উচ্ছ্বসিত জনতার দর্শনও পেলাম। আমাদের সাথের জলচররা হাহুতাসে সামিল হল , স্নানের সাজ সজ্জা নিয়ে না আসার জন্য। ছোট্ট জলের ধারায় পা ডুবিয়ে তিনজন বিপরীত দিকে চলে গেল , আমার কারণ জন্য, অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও কর্তামশাই এ ধারেই রইলেন ।
ফিরতি পথে পড়বে তপ্তপানি , hot spring ... কিন্তু আমরাও তখন যারপরনাই তপ্ত !! এদিকে পেটেও ছুঁচোর দল ছুটোছুটি করছে , বেলা গড়িয়ে কোথায় গেছে ঠিক নাই আর কন্যার পেটে তো যা ছিল সবই রাস্তায় ছড়াতে ছড়াতে এসেছেন তিনি ... কাজে কাজেই এবারে গাড়ি চালু হতেই সর্ব সম্মতি ক্রমে ঠিক হল আগে পেট পূজো ও তারপরে সোজা গোপালপুর। তপ্তপানি আর ডিয়ার পার্ক আপাতত সবার ইচ্ছে অনুযায়ী বাদ পড়ল । খাওয়ার পর যাত্রা করে আমরা বিকেলে পৌঁছলাম গোপালপুরে ।
গোপালপুর গেস্ট হাউসে পৌঁছে মন উদাস হয়ে গেল !! এ মন ব্যাকুল যখন তখন ... কারণ জানি এক্ষেত্রে , তবে বলি শোনো ... গেস্ট হাউসের রান্নাঘর থেকে মন কাড়া খাবারের গন্ধই এর কারণ 🤫 আসলে দারিংবাড়িতে আগের কয়দিন ঘরোয়া খাবারের রান্না ভাল করে উতরে গেলেও কেতাবি খাবারে খানিক খানিক খাবি খেতে হয়েছে । তাতে অবশ্যি পরোয়া করিনি তেমন । ওমন হতেই পারে । আমার জন্মদিনে কর্তামশাই চাইনিজ এগ ফ্রায়েড রাইস ও চিলি চিকেন ওর্ডার করার পর ... কড়াইশুটি যুক্ত চিলি চিকেন ও ডিম সহযোগে ঘি ভাত আমরা কিন্তু সোনামুখ করে খেয়ে ফেলেছিলাম। মনটা একটু দমে গিয়েছিল বটে । তবে এখানকার রান্নাঘরের আকুল করা গন্ধে মনটা সজীব হয়ে উঠল আবার ।
দ্বিতল যুক্ত বাড়ির পুরোটাই গেস্ট হাউস আর তা তখন আমাদের আপাত দখলে । নিচে বসার ও খাওয়ার জায়গাটা লম্বাটে আকারের , একপাশে রান্নাঘর আর ওপরে পাশাপাশি দুখান ঘর , বাথরুম ও বারান্দা সংলগ্ন। একটু জিরিয়ে চা ও পাকোড়া খেয়ে বীচমুখী হলাম । একটু ঘুরপথে লাইট-হাউস পেরিয়ে গোপালপুরের ছোট্ট সমুদ্র সৈকতে পৌঁছলাম। খানিক বসা , গল্প, জলে পা ডোবানোর পর ফিরলাম...গেস্ট হাউসের পাশে এসে সত্য দার কথায় , তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অবাক চোখে চেয়ে এক অনবদ্য দৃশ্য দেখতে পেলাম...পথের পাশের গাছে গাছে দিনের শেষে ঘরে ফিরেছে অগুন্তি বক । গাছ পুরো সাদা হয়ে আছে । ঘাড় গুঁজে তারা বসেছে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে .... অসাধারণ দৃশ্য। নতুন ধরণের ভাল লাগা নিয়ে ফিরলাম ঘরে । পরেরদিন ফেরার পালা .... তবে সে সন্ধ্যা নাগাৎ । ভোরে গাছের অতিথিদের একে একে উড়ে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখলাম একাকী বারান্দায় বসে ... বাকি রা তখনও ঘুমের দেশে । জলখাবারের পর্ব ও গল্প মিটিয়ে দল আবার দশটা নাগাদ বীচমুখী হল , এবার আর ঘুর পথে না , পুরোনো এক ভাঙা কেল্লার মধ্য দিয়ে , যা নাকি রাতের বেলায় ভৌতিক (?) , শর্টকাট করা হল , চড়াই উতরাই পথে তপ্ত বালির মধ্য দিয়ে জেলে ডিঙির পাশ কাটিয়ে বীচে নেমে এলাম। তেনারা বরাবরই জলচর , জলে নেমে গেলেন , আমি জেলেদের বানানো এক ছাউনিতে বসে নির্জন বীচের রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম । জলের স্বচ্ছতা , জলের রঙ মনে ভাল লাগা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। সকলের অনুরোধে এখানেও এগিয়ে জলে পা ডোবালাম । স্নানের মতন প্রস্তুতি আমার ছিল না । সকাল হারালো দুপুরের ভুরিভোজে , বিকেলে মন খারাপের দিস্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে ... এরপরের ঘটনা একদমই সংক্ষিপ্ত ও পরিচিত । তাই আর দীর্ঘায়িত না করে এবার আসি কেমন ??
@শুচিস্মিতাভদ্র