Monday, 11 April 2022



বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩১


পরেরদিন যথা নিয়মে ভোরের মনোরম আরামে হোটেলের ঘরের বাইরের চত্বরে চা পান অপেক্ষায় জড়ো হলাম।  যদিও সকাল ৭টার আগে রান্নাঘর ঘুমন্ত,  কিন্তু কিছু অপেক্ষার একটা অপেক্ষাকৃত অন্য রকম ব্যাপার আছে । অপেক্ষার রকমফের অবশ্যই আছে । সবই যে চিন্তামুক্ত হবে , তা তো নয় !!! তবে এই অপেক্ষার মধ্যেই আমাদের গল্প গাছা চলতে থাকল  , পরবর্তি বেড়ানোর গল্পের গাছে তোলার মই নিয়ে আমার কর্তা রীতিমত প্রস্তুত হয়ে গেলেন । কলকাতায় ফিরেই যে , সে মই নাড়াতে শুরু করবেন এবং আমিও যে মই থেকে মাটিতে নেমে পড়ব , এ তো বলাই বাহুল্য। 

এসবের মাঝেই চা এসে পড়ল,  তারপর গোছগাছ , স্নান , জলখাবারের পর্ব চুকিয়ে বাক্স প্যাটরাসহ বেরিয়ে পড়লাম।  ওই দিন দারিংবাড়ির পাহাড় থেকে নেমে আসব , আরো কিছু স্পট দেখতে দেখতে । বিকেল নাগাদ পৌঁছব গোপালপুরে । সেখানে আমরা থাকব সত্য দার অফিসের গেস্ট হাউসে ।

পথের দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চললাম। প্রতিটা গাছের আকার , পাতার রঙ একে অপরের থেকে পৃথক । সবই যেন মনে হচ্ছে ছবি তুলে রাখি । যা অবাস্তব ও অসম্ভব।  কিছু বিষয় মনের ক্যামেরাতেও রাখতে হয় । তাই রাখছিলাম । এবারে আমি একা পিছনে লাগেজ নিয়ে নিশ্চিন্তে প্রকৃতি দেখতে দেখতে আর জোয়ান খেতে খেতে চলেছি । মেয়ে প্রথমেই ফতোয়া জারি করে আমাকে দূরে রেখেছে !!! পথেই পড়ল এক জলপ্রপাত যাওয়ার পথ , যেখানে ১৫০সিঁড়ির কথা শুনেই তেনারা ঘচাং ফু করেছিলেন লিস্টি করার সময়ে । কি মনে করে , এবার  !!! আমাদের বাহনচালক টিটোর কথায় আমরা জলপ্রপাতের পথ ধরলাম,  ঠিক হল যদি পারি নামব , না পারি তো ফিরে আসব ... চেষ্টার শেষ রাখি কেন ?? সেই মতন সূর্য চশমা চোখে পরে এবং সেটাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়েই পড়লাম সিঁড়ির দিকে , খোঁজাখুঁজির খবরে অবাক হয়ে কন্যার মামী আমার দিকে তাকিয়ে কইল ... রোদ চশমা যদি গাড়িতে , তো তোমার চোখে ওখান কি বটে ?? 😁🤪      .....     বাকিদের মনের ভাব অনেকটা এমন তখন ...  তুমি কি জামা জুতো মিলিয়ে মিলিয়ে রোদ চম্মাও এনেছ নাকি ?? আমি চুপ 😷। পিছনে আগত অন্য দলের এক মাসীমা হেসেই খুন । আসলে রোদের এমন জোরদার আলো , রোদচশমা নাকি শুধু চশমা নাকে এঁটেছি তা বোঝাই দায় !! এমন হয়েই থাকে , পার্থক্য কেবল নিজের হলে এক , অপরের হলে মনে হয় ভারি মজাদার ঘটনা তো 😁😊!!!!  যেমন ধরো আমাদের কলেজের মালাদি , একদিন চশমা হারিয়ে কলেজে এলেন , মন ভার , মুখে মেঘ ... কোথায় রেখেছিলে গো ? প্রশ্নের উত্তরে আমরা ঘায়েল ... কোথায় আবার রাখব !! চোখেই ছিল !!!! 🙄 আসলে ভিড় ঠেলে নামতে গিয়ে চশমা gone , এদিকে ভিড়ের বাস থেকে নামার পর ভড়কে যাওয়া ভাবটা অনেকক্ষণ থাকে বটে ... ভড়কানি কমার পর জগত সংসারের উপলব্ধি ফেরৎ আসে । চিন্তা করলে এমন কম বেশি অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই। 

নামলাম ধীরে অতি ধীরে .... জলের কূল কূল শব্দ ঘন হল , জলের ধারার সামনে এসে মনে হল ... এই কষ্ট স্বার্থক । যদিও নামার কষ্ট পায়ে , ওঠার কষ্ট দমে .... ছড়ানো ছিটনো পাথরের এক পাশে ঝরনা নেমে আসছে , গাছের ছায়ায় এত রোদের মাঝেও মন সতেজ করা ঠাণ্ডা হাওয়া । এখানে ওই উতরায় বেয়ে নেমে এসেছে একপাল গাভী । বেশ মজায় তারা আমাদের আসেপাশে পাথরের খাঁজে বেড়ে ওঠা ঘাস দিয়ে প্রাতরাশ সারছিল । আমরাও পাথরের ওপর দিয়ে টলোমলো করে এর ওর হাত ধরে ঝর্ণা কে পিছনে রেখে খান কতক একা ও দোকা ছবি তুলে ফেললাম। গো সন্তানদেরও ক্যামেরা বন্দী করে .... এবার উতরাই পথে এগিয়ে চললাম। নীচ থেকে উপরের পানে চেয়ে মনে মনে ভাবলাম  ... জলদি জলদি অদেখা  পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করে ফেলতে হবে লিস্টি মিলিয়ে ... এক দিকে পা , আরেক দিকে শ্বাস দুয়েরই হাঁসফাঁস প্রাণান্তকর অবস্থা থেকে ফুলস্টপে পৌঁছনোর আগে ভাগে । যদিও ভাবনা আর কাজের ফারাক মেটানো বড়ই গোলমেলে কাজ , ওই গোলাকার চক্র , নেহাতই  বক্র ... মেলানো যায় না , মানুষ ভাবে এক , হয় আরেক ।

 তো যাইহোক ধীরে ধীরে উঠে এলাম...সিঁড়ির মুখেই চায়ের দোকান ... সেখানে পৌঁছে ই চেয়ারে ধপাস !!! এরা দুজন চা খেল । গরমে আমরা দুই বান্ধবী চা না খেয়ে গাছের ঠাণ্ডা হাওয়া খেয়ে আবার রওনা দিলাম।  এবার অনেকক্ষণের যাত্রা । আসল খেলা শুরু হল এবার ... কন্যার motion sickness,  যা বিগত কয়েক বার এক হোমিও ম্যাডিসিনের হাতযশে বন্ধ ছিল । এবারে সেই ওষুধ সাথে ছিল না , ফলাফল হাতে নাতে ... এদিকে কন্যার কিছু হলেই তার বাবা একদম মন কেমনের দেশে । বার বার পাঁচ বার ... কন্যার হাল বেহাল। এদিকে আমারও জোয়ানের শিশি প্রায় খালি !!! ধূ ধূ প্রান্তর , ঝক ঝকে পথ আর কট্ কটে রোদ ... ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগের এমন সুযোগ সচরাচর ঘটে না । পরবর্তি গন্তব্য তিব্বতি মঠ জিরাং হয়ে আরেক খাসা জলপ্রপাত খাসাদা । তারপরেও কিছু আছে লিস্ট মোতাবেক , কিন্তু সবটাই সময় আর শরীর বুঝে । কোন সুদূর অতীতে একদল তিব্বতী এখানে এসেছিলেন , আপন করতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার , তারা রয়ে গেলেন ... ছোট্ট বসতি গড়ে তুললেন । তৈরি হল জিরাং মনাস্ট্রি ... প্রকৃতির মাঝে তার রূপ অনবদ্য। মাখনের মতন রাস্তার দুপাশের প্রাকৃতিক শোভার মাঝে অনেক দূর থেকে আমাদের বাহন চালক টিটো দেখালো সোনালি রঙের ঝিলিক দেওয়া মঠের চূড়ো । এক সময় হাইওয়ের পাশে রাস্তার এক শাখার মধ্য দিয়ে যেন এক মিনি তিব্বতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে মনাস্ট্রির চৌহিদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লাম।  এক পাশে এক বিশাল সরোবরকে পাশ কাটিয়ে এক প্রশস্ত চত্বরে গাড়ি থামল , আমরা নামলাম। ছবি তোলার সাথে সাথে , সব ঘুরে দেখে , এরপরেই কাছে অবস্থিত খাসাদা জলপ্রপাতে চলে এলাম।  বেশ ছড়ানো ছিটনো প্রসারিত অঞ্চল জুড়ে জলের ধারার বয়ে চলা অবিরাম।  পিকনিক হয় শীতে । বেশ অনেক পর্যটক থাকলেও ফাঁকা ফাঁকা সবাই ঘুরছে , ছবি তুলছে , সর্বোপরি স্নানরত উচ্ছ্বসিত জনতার দর্শনও পেলাম।  আমাদের সাথের জলচররা হাহুতাসে সামিল হল , স্নানের সাজ সজ্জা নিয়ে না আসার জন্য। ছোট্ট জলের ধারায় পা ডুবিয়ে তিনজন বিপরীত দিকে চলে গেল , আমার কারণ জন্য,  অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও কর্তামশাই এ ধারেই রইলেন । 

ফিরতি পথে পড়বে তপ্তপানি , hot spring ... কিন্তু আমরাও তখন যারপরনাই তপ্ত !! এদিকে পেটেও ছুঁচোর দল ছুটোছুটি করছে , বেলা গড়িয়ে কোথায় গেছে ঠিক নাই আর কন্যার পেটে তো যা ছিল সবই রাস্তায় ছড়াতে ছড়াতে এসেছেন তিনি ... কাজে কাজেই এবারে গাড়ি চালু হতেই সর্ব সম্মতি ক্রমে ঠিক হল আগে পেট পূজো ও তারপরে সোজা গোপালপুর। তপ্তপানি আর ডিয়ার পার্ক আপাতত সবার ইচ্ছে অনুযায়ী বাদ পড়ল । খাওয়ার পর যাত্রা করে আমরা বিকেলে পৌঁছলাম গোপালপুরে ।

গোপালপুর গেস্ট হাউসে পৌঁছে মন উদাস হয়ে গেল !! এ মন ব্যাকুল যখন তখন ...  কারণ জানি এক্ষেত্রে , তবে বলি শোনো ... গেস্ট হাউসের রান্নাঘর থেকে মন কাড়া খাবারের গন্ধই এর কারণ 🤫 আসলে দারিংবাড়িতে আগের কয়দিন ঘরোয়া খাবারের রান্না ভাল করে উতরে গেলেও কেতাবি খাবারে খানিক খানিক খাবি খেতে হয়েছে । তাতে অবশ্যি পরোয়া করিনি তেমন । ওমন হতেই পারে । আমার জন্মদিনে কর্তামশাই চাইনিজ এগ ফ্রায়েড রাইস ও চিলি চিকেন ওর্ডার করার পর ... কড়াইশুটি যুক্ত চিলি চিকেন ও ডিম সহযোগে ঘি ভাত আমরা কিন্তু সোনামুখ করে খেয়ে ফেলেছিলাম। মনটা একটু দমে গিয়েছিল বটে । তবে এখানকার রান্নাঘরের আকুল করা গন্ধে মনটা সজীব হয়ে উঠল আবার । 

দ্বিতল যুক্ত বাড়ির পুরোটাই গেস্ট হাউস আর তা তখন আমাদের আপাত দখলে । নিচে বসার ও খাওয়ার জায়গাটা লম্বাটে আকারের , একপাশে রান্নাঘর আর ওপরে পাশাপাশি দুখান ঘর , বাথরুম ও বারান্দা সংলগ্ন। একটু জিরিয়ে চা ও পাকোড়া খেয়ে বীচমুখী হলাম । একটু ঘুরপথে লাইট-হাউস পেরিয়ে গোপালপুরের ছোট্ট সমুদ্র সৈকতে পৌঁছলাম। খানিক বসা , গল্প,  জলে পা ডোবানোর পর ফিরলাম...গেস্ট হাউসের পাশে এসে সত্য দার কথায় , তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অবাক চোখে চেয়ে এক অনবদ্য দৃশ্য দেখতে পেলাম...পথের পাশের গাছে গাছে দিনের শেষে ঘরে ফিরেছে অগুন্তি বক । গাছ পুরো সাদা হয়ে আছে । ঘাড় গুঁজে তারা বসেছে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে .... অসাধারণ দৃশ্য। নতুন ধরণের ভাল লাগা নিয়ে ফিরলাম ঘরে । পরেরদিন ফেরার পালা .... তবে সে সন্ধ্যা নাগাৎ । ভোরে গাছের অতিথিদের একে একে উড়ে কাজে যোগ দিতে যাওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখলাম একাকী বারান্দায় বসে ... বাকি রা তখনও ঘুমের দেশে । জলখাবারের পর্ব ও গল্প মিটিয়ে দল আবার দশটা নাগাদ বীচমুখী হল , এবার আর ঘুর পথে না , পুরোনো এক ভাঙা কেল্লার মধ্য দিয়ে , যা নাকি রাতের বেলায় ভৌতিক (?) , শর্টকাট করা হল , চড়াই উতরাই পথে তপ্ত বালির মধ্য দিয়ে জেলে ডিঙির পাশ কাটিয়ে বীচে নেমে এলাম।  তেনারা বরাবরই জলচর , জলে নেমে গেলেন , আমি জেলেদের বানানো এক ছাউনিতে বসে নির্জন বীচের রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম । জলের স্বচ্ছতা , জলের রঙ মনে ভাল লাগা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।  সকলের অনুরোধে এখানেও এগিয়ে জলে পা ডোবালাম । স্নানের মতন প্রস্তুতি আমার ছিল না । সকাল হারালো দুপুরের ভুরিভোজে , বিকেলে মন খারাপের দিস্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে ... এরপরের ঘটনা একদমই সংক্ষিপ্ত ও পরিচিত । তাই আর দীর্ঘায়িত না করে এবার আসি কেমন ?? 

@শুচিস্মিতাভদ্র

 



বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩০


   অতঃপর দারিংবাড়ি পৌঁছলাম। হাইওয়ের পাশের এক হোটেলে মৌখিক কথা বলে রেখেছিলেন আমাদের পরিচিত একজন , কিন্তু সামনাসামনি সেই হোটেল আমাদের মনের মতন হল না  , তার উপস্থিতি সাইন করল না , এজন্যই হয়তো বলে পহলে দর্শনধারী .... ঘর ছোট কি বড় সেটা ঘুরতে বেরিয়ে প্রাধান্য পায় না বটে , তবে পরিবেশ অবশ্যই একখান বড়সড় ব্যাপার। দুই গিন্নি ও আমার কন্যাকে রিসেপসনে রেখে দুই বন্ধু ঘর দেখতে গেলেন ...  রঙিন জলের বোতল ও কিছু রঙিন মানুষ দেখে আমরা সদলবলে ওখান থেকে দে ছুট ।  হোটেল সাইনের অনেক কিছুই আইনমোতাবেক মনে হল না ।কর্মসূত্রে পরিচিত এক ভ্রমণ পাগল দাদাকে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করলাম এবং সুকান্ত দার পরামর্শে অসাধারণ এক বাসস্থানের সন্ধান পেলাম , পাহাড়ের ওপরে ইকো ডিয়ার হোম .. বাজার পেরিয়ে একটু যেতেই ডানদিকে বেঁকে আরও একটু .... আবার ডান দিক...লাল মাটির পথ এঁকে বেঁকে নিয়ে এল মন ভরানোর আবাসে .... নীল নির্জনে নাকি লাল নির্জনে নাকি রামধনু নির্জনে .কতরকম রঙের মেলা !!!  ... শান্ত পাহাড়ি পরিবেশ একবারেই সবার মন ভরিয়ে দিল । পাশাপাশি দুখান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরের আপাত বাসিন্দা হলাম ।  দুখান ঘরের একখান একেবারেই সিঁড়ির মুখোমুখি তাই একটু পৃথক করতে মন্দিরের দরজা সদৃশ দরজা লাগিয়ে একটু যেন আলাদা ।

একটু গুছু করে নিয়ে ঘরের বাইরের প্রশস্ত জায়গাতেই বসলাম,  সে দিন বেরনোর কিছু নেই । সূর্য ডুবছে আর হাল্কা ঠাণ্ডা তার দখল নিচ্ছে ... ভারি ভাল লাগছিল   পাশের ঘর গুলো কয়েকটি বঙ্গ পরিবারের দখলে । বেড়াতে যাব আর দেশোয়ালি ভাই , বোনের দেখা পাব না , তা কি হয় ?? তবে একদুজনের সাথে পথের দেখার ছোট্ট আলাপ হলেও,  বাকিদের সাথে আলাপ বিলাপের সুযোগ ঘটেনি । 

আমার এবারের বেড়ানোর আকর্ষণ ছিল অল্প অল্প টাকা জমিয়ে কেনা শখের ক্যামেরা , যাতে almost পরীক্ষামূলক ছবি তোলা হচ্ছিল,  কারণ তার সব নিয়ম কানুন এখন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে , মাথার ভিতর প্রবেশ করা সময় সাপেক্ষ,  অন্তত আমার কাছে তো বটেই । পাশের সত্যদা খানিক খানিক বুঝিয়ে দিচ্ছিল , এই যা সুবিধা !! একটা ছবি দেখে মন খুশ হল কি না হল পরের ছবি পুরো মনের ওজন বাড়িয়ে একশা !! একখান ছবি দেখে সত্য দা উবাচ ... একি !!!  বরফের এফেক্ট আনলি কি করে ?? দেখি ফটোর সাবজেক্ট দম্পতির পিছনের ব্যাকগ্রাউন্ড পুরো সাদা হয়ে গেছে । 😔

সন্ধ্যার সময় থেকেই সত্যদা তার ভাগ্নির পিছনে লাগতে শুরু করল ... কথিত আছে কোন এক দারিং নামধারী সাহেবের কর্মক্ষেত্র ছিল এই আদিবাসী সম্বলিত অঞ্চল। পরবর্তী কালে এখানকার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান সেই সাহেব । নিজের দেশে নাকি আর ফেরা হয়নি । কাজেই দারিং সাহেবের অশরীরি আত্মার উপস্থিতির গল্পের গুঁতোয় আমার কন্যা শেষমেষ বাইরে বসার সাহস হুস করে উড়ে গেল , সে ঘরেই নিজের মতন রইল আর আমরা ঠাণ্ডার আমেজে বসে চা ও টা খেলাম গল্পের সাথে জমিয়ে । তবে টায়ের ভাগিদার  ঘর থেকে কড়া নজর রেখে তার, ভাগের টা ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল টাটা করে । রাতের খাবার খেয়ে জলদি শুয়ে পড়লাম সকলে , পরের দিন চারদিকে একটু ঘুরু বেড়ু করতে হবে , সর্বোপরি সেদিন আবার আমার জন্মদিনও বটে । কর্তামশাই বলেছেন ডেস্টিনেশন বার্থডে (?) করে দিলাম , একখান কুর্তিও দিয়েছি আর গিফ্ট চাইতে নেই ... অগত্যা !!! 🤫

ইদানীং কালের ট্রেণ্ড অনুযায়ী মধ্য রাতে অর্থাৎ কিনা রাত  বারোটার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো ভীষণ রকম ইন । সে মত কেউ কেউ রাতেই জানায় , গত কয়েক বছর কর্তা মশাইও এ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী হয়েছেন । কিন্তু এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন,  সারাদিনের ক্লান্তির দখলে সকলে , কাজেই ভোর বেলায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা পেলাম একে একে । ফোনের বার্তা কিছু পেলাম সকালে  ,  বাকি পেলাম ওই দিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাসস্থানে ফিরে । যোগাযোগ ব্যবস্থার এদিক ওদিক চলতেই থাকে বেড়াতে গেলে । যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবার আমি পিছিয়ে থাকি বেড়ুর সময় , এবার দেখলাম চিত্র ভিন্ন।  শুনলাম এখানে বি.এস.এন.এল আর জিও র পাল্লা ভারি । আমি প্রথম দলে পড়েছি , তাই মোটামুটি ভাবে এবারের বেড়ুতে যুক্ত ছিলাম সকলের সাথে । ফোন ছাড়া আজকাল আমরা একদমই মন কেমনের ডুব জলে , কাজেই এও এবারে এক প্রাপ্তি বলা যায় , ধরে নিলাম জন্মদিনের এও এক উপহার 😊।

সকালে ঘরের সামনের মিঠে রোদ , তেতে উঠতে শুরু করল , আমরাও জলখাবারের পাট মিটিয়ে ঘোরাঘুরির দিকে মন দিলাম।  আগের দিন দলের দুই সম মনস্ক সদস্য ফোন ঘেঁটে ঘোরার তালিকা করছিল , আর রোদের তেজের ভয়ে অনেক কিছুর পাশেই ঢ্যারা দিয়ে ঘচাং ফু করছিল ... কি ভাগ্যি , আমার চোখে পড়েছিল ঘটনা খান !!! কয়েকটা স্পট বেমালুম বাদ দিয়ে দিচ্ছিল !!! সে ঢ্যারা গুলোর ওপর 2nd ঢ্যারা apply করে লিস্টিতে রেখেছিলাম। সেই মতন বেরিয়ে একে একে দেখলাম ওয়াচ টাওয়ার সম্বলিত  মান্দাসুরু পার্ক ,লাভার্স পয়েন্ট ,হিল ভিউ পার্ক ইত্যাদি ইত্যাদি । পাহাড়ী ঢালে অবস্থিত পার্কে অনেক ধরণের গাছে তৈরি করেছে অপূর্ব আলো ছায়ার আলপনা । ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় মান্দাসুরু ভ্যালি । একখান জলপ্রপাত আছে শুনলাম,  যা এখন শুকনো । লাভার্স পয়েন্টে জলের ধারায় পা মেলে ধরে বসে যারপরনাই আরাম পেলাম । তবে ওখানে দেখলাম,  না লাভারদের দেখা মেলেনি । মেলাই গরু ,বাছুর । কার্য কারণ সন্ধানে একখান যুতসই কারণ খুঁজে পেলাম .... প্রেমের অন্যতম প্রতীক শ্রীকৃষ্ণ। আর রাধাকৃষ্ণের যুগল ছবির পাশে আমরা অনেক সময়েই দেখে থাকি গোকূলের অন্যতম এই পশুকে । একদমই শান্ত,  নির্বিরোধী । চোখ দুখান ভীরুতায় মাখানো যেন ।

 মাঝে দুপুরের খাবারের বিরতি ছিল । তখন ক্ষিদের সাথে সূজ্জি মামার তেজের যুগলবন্দীতে আমরা একদম মিইয়ে গেছি । পথের পাশের এক ধাবাতে থাবা গেড়ে বসে খাবারের ওর্ডার দেওয়ার পর , তীর্থের কাকের মতন হোটেলের রান্নাঘরের পানে চেয়ে বসেছিলাম সবাই  , খাবার সার্ভ করার পর ... একখান্ ঝোড়ো ইনিংস খেললাম সকলে , যেখানে কথা কম , কাজ থুড়ি খাওয়া বেশি হল । ভুড়ি ঠাণ্ডা হল , সাথে মুড়ি অর্থাৎ মাথা খানিক ঠাণ্ডা হল । পুরো ঠাণ্ডা হতে গেলে দিবাকর মহাশয়ের অস্ত যাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে । এরপরের পর্বে আমরা গেলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনস্থ পাইন বনে আর তারপরেই কফি অ্যান্ড ব্ল্যাক পেপার গার্ডেনে । যেখানে এই দুই প্রজাতি ছাড়াও আরো অনেক গাছের সমারোহ । পাইন বনে আইন মোতাবেক গাছের গুড়িতে হেলে , জড়িয়ে , টুকি করে অনেক রকম ছবিছাবা হল । আমার বান্ধবী কাম কন্যার মামীর একবার মনে পড়ে গেল আমাদের ছোটকালের সেই মুভির গল্প,  যেখানে নায়ক নায়িকা পরিস্থিতির শিকার হয়ে পাইন বনে পথ হারিয়ে রাত কাটালো ভয়ে ভয়ে , সকালে নায়কের  পথ খোঁজাখুঁজিতে বাগড়া দিতে ব্যস্ত নায়িকা গান ধরল ... " গজব কা হ্যায় দিন , সোচো জারা ... 🎶🎶। আমাদের দিনটাও সেদিন ছিল গজব কা দিন , যদি গরমের আধিক্যকে ভুল করে ভুলে যাই । এর পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাগানে গেলাম,  সেখানে কিছু গাছ অচেনা গাছ চেনা হল , চেনা বামুনের পৈতে লাগেনা , কাজেই চেনাদের আবার দেখলাম।  আমাদের এবারের ঘুরু বেড়ুর এক নম্বর আকর্ষণ যদি আমার কেনা ক্যামেরা হয় , তো দু নম্বর অবশ্যই নিজস্বী ডাণ্ডা বা selfie stick ,  যেটি আমি কর্তা মশাই কে আসার আগে উপহার দিয়েছিলাম, তার শখের কথা মাথায় রেখেই। সেদিনের ভ্রমণে মাঝে মাঝেই তাকে নিজস্বী-দণ্ড ধরে দণ্ডায়মাণ দেখা গেছে । তা নিয়ে নিজস্বী ছাড়া বাকি ছবিই সে বেশি তুলেছে , ভ্রমণরত এক কলেজ স্টুডেন্ট তাকে আঙ্কেল সম্বোধন করে দিশা দেখাতে গিয়েছিল , একদম কানে তোলেনি , এমন পরিবেশে , এত সাজনগোজনের পর কিনা আঙ্কেল !!! রাগ হবে না !!!! তারপরে তা শুনে আন্টিসহ সাথের বিশ্বাস ভাজন সকলের কান এঁটো করা হাসি !!!! একদম ভাল নয় । very bad ।

এরপর দিনের শেষে সূর্য ডোবার পালা দেখতে আমরা পাড়ি জমালাম sunset point এ , কিন্তু রোদের তেজী রূপে বেশিক্ষণ অপেক্ষার ইচ্ছে কেমন ঝিমিয়ে গেল , আমরা ফিরে চললাম,  আমাদের আপাত আবাসে । ফিরতি পথে ওখানকার কিছু অর্গানিক মশলাপাতি কিনে , সর্বোপরি আমার জন্য একখানা কেক নিয়ে ঘরে ফেরা হল । ফিরেই বারান্দার কৌনিক বিন্দুতে ডুবন্ত সূর্যের দেখা মিলল , ক্যামেরা বাগিয়ে আমি আর সত্য দা সেই  মুহুর্ত লেন্স বন্দী করলাম।  

আসতে ধীরে হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ হাজির হল , আর আমরা দিনের শেষের ক্লান্তি ভুলে , আবার তরতাজা হয়ে সান্ধ্যকালীন আসর জমালাম । যা সম্পন্ন হল ছোট্ট করে কেক কাটা ও খাওয়ার পর 🎂 , সাথে আরো কিছু জলযোগ যুক্ত করে । কন্যা সেদিনও আগের দিনের মতন কিছু সময় বাইরে কাটিয়ে , দারিং দাদুর ভয়ে ঘরেই কাটাল । ওখানেই পরের দিনের দিনপঞ্জী ঠিক করে নেওয়া হল আমাদের বাহন চালক টিটোর সাথে । রাতের খাবার খেয়ে যাবতীয় ব্যাটারী মায় নিজেদের চার্জ দিতে আমরা শুতে গেলাম। 

                          @শুচিস্মিতাভদ্র 

                                                         





বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৯ 


এ বছরের বেরিয়ে পড়া , অনেকটা যেন দীর্ঘায়িত বন্দী দশা কাটিয়ে ঘরে ফেরার মতন । যদিও ইতি উতি চেয়ে বিপদ আপদ বাঁচিয়ে আমরা টুকটাক ধারে কাছে ঘুরেছি । অতিমারির প্রতিটি ধাক্কার পর একটু করে ঘুরতে বেরিয়েছি । বলতে নেই ভয় থাকলেও,  সৌভাগ্য বশত ভয়ের কারণ ঘটেনি । এ বছরের শুরুতেই ওমিক্রণে কাত হলাম সপরিবারে । তারপর কন্যার পরীক্ষা ঢেউ আঁছড়ে পড়ল সংসার সমুদ্রের ওপর । খাবি খেতে খেতে কূলের দিকে এবং বেড়াতে যাওয়ার নানা জায়গার ওপর নজর দিলাম।  লক্ষ স্থির করতে পারছিলাম না । কারণ আমাদের দেশের অনেক কিছুই দেখা বাকি,  কাকে ছাড়ি আর কাকে রাখি !!!! মহা বিপদ ... এর মধ্যেই কর্তা মশাই ঘোষণা করলেন,  বিপদ এখনও সব পরিষ্কার হয়নি বটে , রাজ্যের বাইরে এখনই নয় । 🙄 

নানা উদাহরণ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি এক কথার মানুষ ... অগত্যা হাতের কাছের অদেখা অজানার দিকে চোখ ফেরাতেই হলো । সেই মতন উত্তরবঙ্গের শুলুক সন্ধান চালু হল , নেট ঘেটে , ট্রাভেল ব্লগ দেখে , উত্তরবঙ্গের পরিচিত মানুষ জনের সাথে কথা বলে । ভিডিও র আধিক্যে এক দিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু ... স্বপ্নে হাজির বাঘ মামা । কিন্তু .... এসব পড়াশোনার চক্করে ট্রেন টিকিটের টিকি ধরা গেল না । বক্সা - জয়ন্তী এবারের মতন বাক্স বন্দী হল ।আপামর জনতা দু বছরের পর কি আনন্দ আকাশে বাতাসে বলে বেরিয়ে পড়েছেন , যেটা খুবই স্বাভাবিক। অনেকে সত্যিই ঘরের বাইরে ঘুরতে যাননি গত দু বছরে । আবার নতুন জায়গার সন্ধান ... নেট... ব্লগ...এই করতে করতে আবার নির্ধারিত ডেটের টিকিট টুক করে শেষ ... প্রায় যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি , মনে বাজছে দুঃখের সুর ... শেষমেষ পরবর্তি নির্বাচিত জায়গার টিকিট পাওয়া গেল একটু ঘুরপথে । আর আমরাও নিজ রাজ্যের বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। 

উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী জনপদ দারিংবাড়ি ও ফিরতি পথে গোপালপুর অন সী । একাধারে খানিক উত্তরবঙ্গ ও খানিক দক্ষিণবঙ্গের পাহাড় ও সমুদ্রের touch ....।  মন্দ নয় , কি বলো ? তবে কথা হলো ,  ট্রেনের টিকিটে সকলের যাত্রার সময় অবস্থান পৃথক পৃথক । কন্যার সহ আমি একদিকে , কন্যার মামা-মামী আরেক দিকে আর আমার কর্তা মশাই ঝাড়া হাত পা হয়ে অন্যত্র। রাতের ট্রেন যথা সময়ে যাত্রা করল ... আমরাও নিজেদের ট্রেনের সংসার সাজিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম,  তবে এবার একটু সজাগ হয়ে ঘুম দিলাম , কারণ ট্রেনের আমাদের দুই জাগন্ত পরিজন অন্য দিকে শয়ন করেছেন।  আমার পাশের দুই সহযাত্রী পত্রপাট নিদ্রামগ্ন হলেন , তা বুঝলাম তাদের নাসিকা বহনকারী বার্তা মারফত। ঘুম - জাগরণের মাঝেই সকাল হল , সময় মতন আমাদের গন্তব্য বেহরমপুর ওরফে ব্রক্ষ্মপুরে নেমে পড়লাম। নামার আগের আলাপ চারিতায় জানলাম যে উড়িষ্যা রাজ্যের শেষ স্টেশন হল এই ব্রক্ষ্মপুর । এর পরের স্টেশন ইচ্ছাপূরম অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে । মোটের উপর আমাদের বেড়ুর ইচ্ছাপূরণ হল ওই স্টেশনের খানিক আগেই । 

গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা তাই , যোগাযোগ করে আমরা বাহন চালক টিটোর গাড়িতে আসীন হয়ে , প্রথমেই কাছেই একটা হোটেলে হাজির হলাম তরতাজা হতে । ব্যবস্থাপনায় আমার ভাসুর ঠাকুর। কর্মসূত্রে তিনি নানা দিকে যান । খেয়ে , স্নান করে ১১ টা নাগাদ  বেরিয়ে পড়লাম দাড়িংবাড়ির উদ্দেশ্যে । বেরিয়েই বুঝলাম আমাদের তাজা ভাবটা বেশিক্ষণ ধরে রাখা মুশকিল,  শিগগিরই তা ভাজা ভাজা হবে , এমনই রোদের তেজ । যেটা আমাদের সকলেরই জানা ছিল , মোটেও সিলেভাসের বাইরে ছিল না । শহরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললাম।  পথে সুরুডা ড্যাম , কন্টেশ্বরী মন্দির দেখে , দুপুরের পেট পূজোর পর দারিংবাড়ি পৌঁছলাম বিকেলে । 

                                     

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু  ২৮

স্মৃতির মাঝে ফিরে গিয়ে , আমাদের উত্তর বঙ্গের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখতে শুরু করেছিলাম। বেশ কিছুটা এগিয়েও গেলাম আগের দিন । আমাদের দার্জিলিং যাপন যথা নিয়মে দ্বিতীয় দিনে পড়ল।  আমরাও কিছু অসুবিধার কারণে হলিডেহোমের মায়া কাটিয়ে ম্যালের এক হোটেলে হাজির হলাম । সব গুছিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম, একে একে জলখাবারের পাট মিটল ম্যালের বিখ্যাত খাবারের দোকানে । এরপর নিয়ম মাফিক দর্শনীয় স্থানের দর্শন চলতে থাকল । মিউজিয়াম থেকে শুরু হল সেদিনের পথ চলা । এরপর রক গার্ডেন আর গঙ্গা মায়া লেক ও পার্কের খাড়াই পথের উতরাইতে নামার সময় হাল বেশ বেহাল হয়েছিল । পাহাড়ী সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একের পর এক ঘোরাঘুরি চলতে লাগল । চিড়িয়াখানা , মাউন্টেনিয়ারীং ইনস্টিটিউট এর সংগ্রহশালা , পাশের এক পার্কে লোকনৃত্য দেখতে দেখতে সূর্য পাটে নামতেই ঠাণ্ডার কামড় বাড়তে লাগল । এদিকে হয়েছে কি !!! বেড়ুতে অনভিজ্ঞ আমি আবার সেদিন এক কাণ্ড করে বসেছিলাম।  আমি আমার পছন্দের পরিধেয় শাড়ি পরে ছিলাম , আর তাতে ঠাণ্ডার কামড়ে সব থেকে বেশি কাহিল তখন আমি । যতই গরম পোষাক চাপাই !!! শাড়ি নিয়ে সমস্যা তখন বেশ ভারি । সেই  থেকে শিক্ষিত হয়ে , পাহাড়ী বেড়ুতে শাড়ির সাথে করেছি পুরো আড়ি । অত ঠাণ্ডা কি সইতে পারি ??? আমার আবার শীত , গরম সবেই কষ্ট , সবই বেশি লাগে যথা সময়ে , তাই কর্তা মশাই দেগে দিয়েছেন উগ্র পন্থি বলে। চুপি চুপি বলি গরমে যদিও আমার কষ্ট ওঠে চরমে । ঠাণ্ডার ওপর খুব বেশি রাগ আমার নেই । ঝাণ্ডা নিয়ে ঠাণ্ডার ক্যাম্পেন করতে আমার খুব একটা আপত্তিও তাই নেই । ঠাণ্ডাকালে ঘোরা , খাওয়া , কাজ কোনোটাই অসুবিধাজনক লাগে না । তবে এ কথাও সত্য যাদের দম নিয়ে দমসম কাণ্ড ঘটে , স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কাছে বছরের এ সময় উপভোগ্য হয় না । আর একদল আছেন যারা খুবই শীতকাতুরে টাইপ , তা শীত তাদের ভীত করে ভিত নাড়িয়ে দেয় । আরেক দলের আবার শীত ও গ্রীষ্ম ক্যালেন্ডার মেনে আসে যায় 😃🙃। তো সে যাই হোক , শীত আমাদের কাছে এখনও খুবই উপভোগ্য। বয়সের সাথে সাথে ভোগান্তির বাড়বাড়ন্ত হলে তখন অবশ্যি আলাদা কথা । আমার মাকে দেখে তাই বুঝেছি ।

সেদিনের বৈকালিক আড্ডায় আমরা ম্যালের এক কপিসপে বসেছিলাম,  পরে ঘোরাঘুরির পর ঘরে ফিরে ক্লান্তির প্রাবল্যে খেয়ে চটপট ঘুম দিলাম।  পরদিন রাত থাকতে উঠে টাইগার হিলে যাওয়ার পরিকল্পনা । সে মতন গাড়িও বলা ছিল । যথা সময়ে ওঠার পর পরই আমাদের বাকি সাথিরা না যাওয়ার বার্তা জানিয়ে ঘুমের দেশে ফেরত গেল । কিন্তু ঘুম আমার বেড়ানোর অন্তরায় নয় কখনোই আর তাছাড়া সকলের এই অভিজ্ঞতা নতুন নয় আমার মতন , কাজেই আমার উৎসাহ স্বাভাবিক ভাবেই বেশ বেশি ছিল । সেই মতন ধড়া চুড়ো পরেও কাঁপতে কাঁপতে রওনা দিলাম অন্ধকারের মধ্যেই। পোশাক সমেত কোন কাব্য তো দূর অস্ত , এক সময় শুনলাম আমাকে অনেকটা সেই রহস্যজনক ইয়েতির মতন লাগছে । এ যাবৎ ওই একবারই  কর্তা মশাই তুলনা টেনেছিল 🙏🏻 । সময়ে পৌঁছলাম,  কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের সেই গানের কলি সত্য হল ... টাইগার হিল থেকে সূর্য ওঠা দেখা হল না সেবার 🎶🎶 , অনেক উৎসাহ নিমেষে ঝিমিয়ে গেলেও , টাইগার হিলেই দিনের আলো ফুটতে দেখে , আমরা ফিরে চললাম। পথে নামলাম বাতাসীয়া লুপ সংলগ্ন বাগান ও ঘুম মনাস্ট্রিতে । ফিরে গিয়ে , বেরিয়ে পড়ব সবাই। সেই মতোই গোছানোর সময় খেয়াল হল আমার একখান চাদর মিসিং। একটু বকুনি জুটল , তারপরই কর্তা মশাই ছুটল আগের দিনের সন্ধ্যার আড্ডার আসর সেই কফি শপে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই চাদর খানা পাওয়াও গেল । এরপর আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম কালিমপঙের উদ্দেশ্যে । প্রথমেই এক জায়গায় জলখাবার খেয়ে নেওয়া হল , তারপর নতুন উৎসাহে চললাম আরেক শৈল শহরের দিকে ।

আমাদের তিন ঘরণীর আলাপ তখন আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে । গান , গল্পের মধ্যেই দুপুরের দিকে কালিমপঙে নেমে এলাম । অনেকটা নিচের শৈল শহর , তাই ঠাণ্ডার প্রকোপ কম আগের থেকে । কালিমপঙে আমাদের কোন বুকিং ছিল না , স্পট বুকিং মেলা ভার হয়ে দাঁড়াল । অগত্যা খোঁজাখুঁজির পর্ব চালু হল । এক সময় পুরনো পরিচয়ের সূত্র ধরে কালিমপঙের স্টেট ব্যাঙ্কে পৌঁছে পাওয়া গেল পূর্ব পরিচিত মি.অজয় করকে । উনি তখন  ওখানকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।  

এ ক্ষেত্রে আগের বিষয় একটু না বললেই নয় , আমাদের বিবাহ উত্তর কালে কসবাতে বাড়ি তৈরির জন্য হাউস বিল্ডিং লোন নেওয়ার সময় পরিচয় হয় স্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মি.করের সাথে । খুবই সাহায্য করেছিলেন ঢাকুরিয়া নিবাসী কর বাবু । পরে কালিমপঙে বদলি হয়ে যান । সে তথ্য একবার ওনার সাথে পথের দেখায় আমাদের ব্যক্ত করেছিলেন  পূজোর সময়  ( বিয়ের পর প্রথম পূজোতে ) । তখনই মৌখিক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কালিমপঙে । কিন্তু হ্যাঁ বাচক সম্মতি ছাড়া কার্যত কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বরের লেনদেন হয় নাই 🙄। 

এবার খড়কুটোর মতন শেষ সম্বল রূপে মি.করের নাম আর স্টেট ব্যাঙ্কের নাম আমার কর্তা মশাই এর মানসপটে ভুস করে ভেসে উঠল ... এবার পুরো সিরিয়ালী কায়দায় ব্যাঙ্কের খোঁজ ও সেই  সাথেই ভাগ্যক্রমে দেখা মিলল মি. করের । 😊 ভদ্রলোকে আকাশ থেকে পড়লেন !! তবে আকাশ ,বাতাস যাই হোক এদিক ওদিক খোঁজ লাগিয়ে বাজারের জন বহুল এলাকাতে একখান ভাল হোটেলের ব্যবস্থাও করে দিলেন । হোটেল ক্রাউন । ডিউটি আওয়ারসে বেরিয়ে ছিলেন আমাদের সাথে , তাই ব্যবস্থা করে দিয়েই ফিরে গেলেন , সন্ধ্যার সময় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ।

বাঙালি যতই মোমো আর চাউ হাউ মাউ করে খাক না কেন , বেশি দিন ওই মেনু টানতে পারে না , টানলেই গেনু গেনু ( গেলুম গেলুম ) রব ওঠে । সে যে একশো শতাংশ সত্য,  তার প্রমাণ মিলল কালিমপঙের হোটেলের খাবার টেবিলে । হোটেলে ঘরে পৌঁছে সবাই ফ্রেস হয়ে (বেলা চারটে নাগাদ) এক্সটেন্ডেড মধ্যাহ্ন ভোজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম পড়ন্ত বেলায় । বেলা চারটেতেও ধুমায়িত ভাত , ডাল , আলুভাজা , পাঁপড় , স্যালাড আর মাছ সহযোগে ক্ষিদে মিটল সবার । কদিন পর কালিমপঙের সহনশীল ঠাণ্ডার মাঝে আমাদের পুচকু সোনা বৃষ্টি রাণীর মুখে হাসি ফুটল । ছোটদের সব কিছুর গ্রহনযোগ্যতা সব থেকে বেশি হলেও দার্জিলিঙের ঠাণ্ডায় ছোটজন একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল । 

পরেরদিন কর বাবুর ঠিক করা গাড়ি চড়ে পাড়ি দিলাম লাভা ও ললেগাও । কর বাবু লাভাতে ভেজ মোমো খাওয়ার পরামর্শ দিলেও,  ভয়ানক আমিষাসী আমরা নন-ভেজেই স্থির হয়ে রইলাম। লাভাতে পৌঁছে ঠাণ্ডার ধরনে আবার কেঁপে গেলাম । এখানকার উচ্চতা বেশ বেশি আর সেদিন মেঘলা থাকার জন্য,  পুরো অঞ্চলের আবহাওয়া ছিল ভিজে ভিজে । ওখানকার মনাস্ট্রি ঘুরে দেখার পর আমরা ওখান থেকে গেলাম লেলেগাও তে । সেখানে পাহাড়ী গাছের সারির মধ্যে রয়েছে দড়ি ও কাঠের তৈরি সেতু । সেতুর ওপর ওঠা , ছবি পর্ব সব মিটিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম।  পাহাড়ী পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে একখান ছবিও তোলা হল সকলের । সব মিটিয়ে সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরে আড্ডার আসর বসল । পরের দিন গেলাম কালিমপঙের সর্বোচ্চ স্থান ডেলো পাহাড়ে । ফেরার পথে কালিমপঙের আরেক মনাস্ট্রি ও পাইন ভিউ নার্সারি দেখে নিলাম। সেদিনকার সান্ধ্য আড্ডায় আমাদের সাথে যোগ দিলেন কর বাবু । গান , গল্প ও আবৃত্তির মাঝে ঝড়ের গতিতে সময় বয়ে গেল । ঝুমার অপূর্ব আবৃত্তি শুনে আমরা মুগ্ধ হলাম।  ও তখন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী । এখন নানা অনুষ্ঠান,  রেকর্ডিং , দূরদর্শনে ও বেশ পরিচিত মুখ । কর বাবু আমাদের দুজনকেই দু ধরনের বিষয়ের চর্চার উপদেশ দিয়েছিলেন,  ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমার ক্ষেত্রে গান নিয়ে ওভাবে এগোনো সম্ভব ছিল না সংসার সামলে । আসলে সকলে সবটা সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করতে পারে না । ঝুমাকে সাধুবাদ দিতেই হয় , ও পেরেছে । একটা বিষয় ওই প্রসঙ্গে মনে আছে , আমি গান শোনানোর পর ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে গুটি গুটি হাটি হাটি করে বৃষ্টি এসে গম্ভীর হয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিল বেশ গম্ভীর ভাবে .." বালো (ভালো) হয়েছে ।" ওর বলার ধরনে সবাই হেসে আকুল হলেও,  এ অতি অবশ্যই এক স্বীকৃতি তো বটেই !!

কর বাবুর সাথে যোগাযোগ  আবার ক্ষীণ হলেও, ওনার দারস্থ হয়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে এক ভিন্ন কারণে । বলা ভাল খুব দরকারি কারণে । এবারেও অনেক সাহায্য পেয়েছিলাম ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত বিষয়ে । রিটায়ার করে গিয়েছেন , কিন্তু তবুও সব রকমেই সাহায্য করেছিলেন। মানুষ মানুষের জন্য আমার এই বিশ্বাসের ভিত আরো দৃঢ় হয়েছিল ওনাকে দেখে ।

পরের দিন ছিল আমাদের মন খারাপের দিস্তা ভরা ফেরার দিন । ফেরার পথে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট ঘুরে ট্রেন ধরেছিলাম।  মনে আছে স্টেশনে শেষ বিকেলে  পৌঁছে গিয়েছিলাম।  আমার কর্তা মশাই আমাদের তিন মহিলাকে নিয়ে হংকং মার্কেট গিয়েছিলেন । কেনাকাটি কিছু করিনি , ঘুরে দেখে আবার ফিরে গিয়েছিলাম। এরপরের অধ্যায় খুবই সংক্ষিপ্ত।  এক রাত ট্রেনে কাটিয়ে,  পরের সকালে হাওড়া আর তারপর বাড়ি ।। 

@শুচিস্মিতাভদ্র 


2018, December , উপরের স্মৃতিচারণের অনেক ভছর  পরে দেখেছিলাম কঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব শোভা ...

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৭


একটু পিছনে ফিরে দেখতে গিয়ে নজর আটকে গেল , আমাদের ফেলে আসা শুরুর দিনের পানে । বিয়ের পর এদিক ওদিক শুধুই তুমি-আমি ভ্রমণ ফেজ কাটিয়ে বছর খানেক পর ঠিক হলো ,  আরো কিছু সাথি নিয়ে দল ভারি করে ঘুরতে যাওয়া হবে । সেই মতন আমার কর্তা মশাই তার স্কুল জীবনের তিন বন্ধুর সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করে দিলেন । কিন্তু শুরুতেই এক পরিবার বাদ চলে গেল , কারণ তাদের একজন সম্ভাব্য যাওয়ার আগেই নতুন চাকরি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছিলেন। দুজনে তখনই না গেলেও,  কর্তার বিহনে গিন্নি আর কি করে বিরহ কাটিয়ে বেড়ু যাবেন ?? অগত্যা বাকি দুজনার ( দুই পরিবার ) সাথে আলোচনা এগিয়ে গেল , সেই মতন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমরা তিন পরিবার দার্জিলিং মেইল ধরতে মেলাই বাক্স প্যাটরাসহ শিয়ালদহ স্টেশনে হাজির হলাম। এক পরিবারের কর্তা পড়ুয়া টাইপ , তার ছয় খান ব্যাগ বাক্সের অনেকখানিই নাকি ছিল বই এর দখলে , যা পরে শুনেছিলাম।  তার ব্যাগের সংখ্যা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে  হাসি ঠাট্টা হল বিস্তর। আমি তখন ও দলে সদ্য যুক্ত সদস্যা। কাজে সবেতেই মন্তব্য,  বক্তব্য পেশ না করে শুধু হাসিই🙃🙂আমার সম্বল ।  সেই টিমের একজনের পরিবার বেড়ে তিনজনের হয়েছে  অল্প কিছু আগে আর বাকি আরেক পরিবার তখনও হাম-তুম আর বই এ বন্দী। আমাদের ট্রেন  ছিল বাতানুকূলমুক্ত শয়নের সুবিধাজনক স্লীপার। সময়ের হাত ধরে এখন বায়নাক্কার অনেক বাড় বৃদ্ধি হলেও,  তখন আমরা ওসব থেকে অনেক দূরে ছিলাম। 

সকলের পাশাপাশি বসার বন্দোবস্ত না থাকায় , আমরা তিন ঘরনী ও পুচকু বৃষ্টি রাণী এধারে আর ওপর তিন বন্ধু থাকল ওধারে । রাতে ও তরফের সকলেই  একবার করে অর্ধাঙ্গিনী দর্শন করে গেলেন শোয়ার আগে । তখনও আমরা একে অপরের খুব পরিচিত  না হলেও পরিচিতি বৃদ্ধির ভিত স্হাপন হয়ে গেল সে রাতেই । ভ্রমণ শেষে জিনিয়া হল জিনু , ঝুমা হল ঝুমস্ আর এই অধম হয়ে গেল শিলু । আমার  ডাক খোঁজের নাম শিল্পী কিনা !!!

পরেরদিন ট্রেন থেকে নেমেই শুনলাম কি এক কারণ জন্য দার্জিলিং যাওয়ার দীর্ঘায়িত পথ ছাড়া , বাকি সব কটা পথই বন্ধ ... কাজে কাজেই সময় ও খরচ দুইই যে একটু বেশির দিকে পড়বে তা জানিয়ে দিলেন ওখানকার স্ট্যান্ডের ভাড়া  গাড়ির মালিক ও ড্রাইভারকূল ।

পথের দৈর্ঘ যেখানে সকলের বিরক্তি উদ্রেক  করল , সেখানে তখন .... আমার চোখে তো সকলই মধুর , সকলই নবীন , সকলই বিমল 🎶🎶🎶🎶🎶  অবস্থা । আমার কর্তা মশাই ওই সময় ঠিক কি ভাবছিলেন , বলতে পারব না , আমি তখন জীবনে প্রথম হিমালয় যাত্রার আনন্দে বিভোর । সারা দিন পথে থাকলেও no আপত্তি ... পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি । সব আলাপ বিলাপের শেষে আমরা সবাই যাত্রা শুরু করলাম ঘুর পথে দার্জিলিং । তখন মধ্য সকাল । জানা নাম আর অজানা পথ বেঁধে দিল আমাদের তিন পরিবারকে । পথে এক জায়গায় চা-জলখাবারের পাট মিটলো ধুমায়িত মোমো দিয়ে । আমাদের দার্জিলিং যাপন কাল ছিল দু রাত , তৃতীয় দিনে কথা মতন আমরা নেমে আসব কালিম্পং । সেখানেও দু রাত থেকে পুরোপুরি নেমে যাব সমতলে , তারপর ফিরতি ট্রেন এন.জে.পি থেকে । কালিম্পং এ জিনিয়ার ছোটবেলা কেটেছে । কর্মসূত্রে কাকু অর্থাৎ জিনিয়ার বাবা ওখানে কিছু বছর ছিলেন । আমাদের আলোচনার শুরুতেই জিনিয়ার অনুরোধ ছিল , একটু ছোটবেলার অঞ্চল ভ্রমণ ... সেই মতন সব ব্যবস্থাপনা ।

পথে সাথের খুদে সদস্যের জন্য এক জায়গাতে গাড়ি থামিয়ে সকলে নামলাম।  পাকদণ্ডীর মাঝে আমরা , একদিকে খাদ , একদিকে পাহাড় , পাইন গাছের সারি , ঠাণ্ডার কাঁপুনির মাঝে শুধুই আমরা । কি যে অপূর্ব লাগছিল !!! কিন্তু বাহন চালকের তাড়নায় প্রকৃতির মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা হল না , সবাই গাড়িতে চড়েই প্রকৃতি অবগাহনে মগ্ন হলাম । গল্পও চালু ছিল প্রকৃতি দেখার ফাঁকে ফাঁকে , বেশ খানিক পথ পেরনোর পর ড্রাইভার দাদা , আমাদের জলদি জলদি গাড়িতে ওঠার জন্য দেওয়া তাড়নার কারণ ব্যক্ত করলেন । শুনে তো সবাই খানিক বাক রহিত হলাম । হয়েছিল কি !!! এ পথে ওনার নিত্য যাতায়াত,  কখনও যাত্রী নিয়ে পাহাড়ে উঠছেন , তো কখনও বা নামছেন সমতলে ... দিন পাঁচেক আগে ওখানেই এক চিতার সাথে মোলাকাত হয়েছিল । যদিও পাহাড়ে এ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা , কিন্তু আমাদের গাড়ির  বাইরে অবস্থান যথেষ্ট বিপদজনক এমন পরিস্থিতিতে । সেই চিতা ওখানে আছে না নেই তার পুরোটাই unseen । আমাদের নামার সময় বিষয়টা বলে যেমন ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করতে চাননি , আবার আমরা  নামার পরও দুশ্চিন্তার থেকে অব্যহতিও পাননি । আমরা চলেছিলাম ঘুরপথে মংপু হয়ে। ওখানে কবিগুরু যেখানে থাকতেন , তার পাশ দিয়েই আমাদের যাওয়ার পথ , কিন্তু সেবারও নয় , এখনও ওবধি ওখানে যাওয়া তোলা রয়েছে । আমার একার ইচ্ছা ভোটে হেরে গেল , সবাই তখন গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য রীতিমত অধীর হয়ে উঠেছিল । 

এক সময় পথ শেষ হল আমরা দার্জিলিং পৌঁছলাম । আমাদের বাসস্থান ঠিক করা ছিল এক হলিডে হোমে , যেটার মালিকের নাম এখনও মনে আছে , পাহাড়ী এক মহিলা বেণুদি । হলিডে হোমটি ছিল আমার ভাসুরের অফিসের পরিচিত একজনের   মাধ্যমেই বুকিং করেছিলেন দাদা । খানিক খোঁজাখুঁজির পর ম্যালের থেকে খানিকটা নীচে গভর্নর হাউসের দিকের রাস্তায় দেখা মিলল হলিডে হোমের । তিনতলা বাড়ির দুই আর তিন তলা মিলিয়ে থাকার বন্দোবস্ত। ঘরের সামনের টানা বারান্দার এক পাশ দিয়েই ওপরে ওঠার সিঁড়ি । দোতলার পাশাপাশি দুখান ঘর আর তিন তলায় আরও একখান ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল । দলের মধ্যে আমাদের বিবাহিত জীবনের বয়স যেহেতু সব থেকে কম (১ বছর ৩ মাস ) সকলেই আমাদের তিন তলার নিভৃত কোণে পাঠিয়ে দিল দুষ্টু মিষ্টি হাসি হেসে । 

ঘরে ঢুকে সব খানিক বুঝে নিয়ে আর ওখানকার ঠাণ্ডার সাথে আলাপ চারিতার মধ্যেই একে একে নিজেরা একটু ফ্রেস হলাম । জল গরম করে নিতে হল ঘরের লাগোয়া রান্নার জায়গায় । আপাতত ঘুরপথে ঘোরার দরুণ ভালোই ক্ষিদে পাওয়ার কথা , কিন্তু সে সবের আন্দাজ করে আমরা ভারী জলখাবার ও সাথের মুখ চালানোর মতন শুকনো খাবারের চালান পেটে  দিতে দিতেই পথ ধরেছিলাম , কাজেই ফ্রেস হয়ে সবাই নিজেদের মেলে ধরলাম ম্যালের পথে । মেলা চড়াই পথ , কিছুক্ষণের মধ্যেই হেঁপো রুগীর মতন হাঁপিয়ে পড়লাম সবাই । গলা পুরো শুকিয়ে শুষ্কং কাষ্ঠং । তো যাই হোক শেষমেষ ম্যালে পৌঁছলাম। আমার কর্তা মশাই আগে অনেক বেড়িয়েছেন,  পাহাড়ও তার কাছে নতুন কিছু নয় , কাজেই তিনি আমার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস যারপরনাই উপভোগ করছিলেন। ওখানে অনেক ঘোরাঘুরির পরও কাঞ্চন দা মানে কঞ্চনজঙ্ঘার দেখা দিলেন না । মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে রইলেন । আসলে পরে অভিজ্ঞতা আর বয়সের উচ্চাসনে বসে বুঝেছি যে বছরের কিছু বিশেষ সময়ই তিনি দর্শন দেন এবং সে মতন অল্প কিছু বছর আগে মন ভরিয়ে দিয়েছিলেন দর্শন দিয়ে । অন্য সময় দেখা দিতেও পারি , আবার কেন দেবো এই ভাবনার মধ্যেই টুরিস্ট কূল মন বেদনায় আকূল হয়ে সমতলে নেমে আসেন । কারো করো ভাগ্যে যে শিকে ছেঁড়ে না , তা নয় । তবে সবটাই সম্ভাবনার ঝুলিতে । একবার নির্ধারিত সময়ে এন.জে.পি স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন থেকে নামার আগেই কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দেখেছিলাম স্লিপিং বুদ্ধাকে । তো যা বলছিলাম....

সেদিন আমরা ম্যালে বসেই ঠিক করলাম,  রাতের রান্না নিজেরাই করব হলিডে হোমের রান্না ঘরে । প্রতিটা ঘরেই লাগোয়া রান্নাঘর । মেনু ঠিক হল বাঙালি মুগ ডালের খিঁচুড়ি ,বেগুনী , ডিম ভাজা আর পাঁপড় ভাজা । ঠাণ্ডায় বেড়ু পুরো জমে উঠল । আমরা দুজন সেই মতন ম্যাল থেকে একটু  নীচে নেমে স্থানীয় বাজারে চললাম রেশনীং এর জন্য।  সব ঘুরে ঘুরে কিনে ফেরার পথে লাল টুকটুকে একখান টুপিও পরিয়ে দিলেন🤫 কর্তা মশাই, যাতে আবার পাহাড়ের ছবি মজুত।  

 ফিরে আমরা জমা হলাম দোতলার একজনার ঘরে । উজ্জ্বল দা আর ঝুমার ঘরের লাগোয়া রান্নাঘরেই   সে রাতের খাবার তৈরির স্থান নির্বাচন করা হল । আস্তে ধীরে অন্ধকার আর ঠাণ্ডা দুই পড়ল জাকিয়ে , কমন বারান্দার দিকের দরজা বন্ধ করে আমরা গল্প শুরু করলাম। এক দুবার তিন ধূমপানকারী বাইরে বেরলেও ঠাণ্ডার দরুণ জলদি ঘরে ঢুকে পড়ল।  আমিও একবার বাইরে আলোর জোনাকি জ্বলা পাহাড়ী শহরকে দেখতে গেলাম। তবে একই রকম ভাবে , ঠাণ্ডা রোমান্টিক হওয়ার সুযোগ দিল না আমাকে । প্রকৃতির নানান রূপে  আমি বার বার মুগ্ধ হই , সেই রূপে অবগাহন করতে আমার দারুণ লাগে চিরকাল। সেখানে একা না দোকা সেটা পুরোই গৌন।

চায়ের সাথেটা দিয়ে গল্পও চলতে থাকল , খানিক পরে তিন ঘরণী রান্নাঘরে লেগে পড়লাম রন্ধনে । একসময় গল্পও জমে উঠল , সাথে খিঁচুড়ির সুবাসে সবার ক্ষিদে চাগিয়ে উঠতেই সকলে থালা বাগিয়ে ধরল । বেগুনী ,ডিম ভাজা ও পাঁপড় ভাজা সহযোগে খিঁচুড়ি দিয়ে জমাটি ভোজ  সাঙ্গ করে , প্রায় ১১টা পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে খোলা সিড়ি বেয়ে ওপরের  ঘরে হাজির হলাম।  মনে আছে স্পষ্ট ... ঘরে ঢুকেও অনেকক্ষণ কাঁপুনি মোডে ছিলাম । 

পরের দিন প্রথমেই সর্ব সম্মতিক্রমে হলিডেহোম বদল করে চলে আসা হল ম্যালের এক হোটেলে । হলিডে হোমের কিছু অব্যবস্থা ছাড়াও ম্যালের থেকে দূরত্বের জন্যই এই অদলবদল সাব্যস্ত হয়েছিল।


@শুচিস্মিতাভদ্র



 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৬ 


পুরীর এবারের অধ্যায়ে প্রথম দুদিনে যথাক্রমে পূজা আর খরিদারির পর্ব মিটল নিয়ম মতন । সেদিন রাতে কন্যা তার মৌ আন্টির ঘরে নিদ্রা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই , তার পিতাশ্রীর মুখ ভার হল । নানা পাটেকরের না-বাচক রাগ রাগিনী খানিক চেষ্টার পর হ্যাঁ-বাচকে পরিণত করার পরিণতি পুপের ভিন্ন ঘরে নিদ্রামগ্ন হওয়া । পরের দিন আমি ভোরে উঠে হাঁটা দিলাম সমুদ্রের পারে । ইতি উতি জনতার জমায়েত সেথায় , সবার নজর সুজ্জি মামার আগমনের দিকে । আমিও খানেক অপেক্ষার পর সূর্যোদয় দেখে ফেললাম , কিছু  ছবি তোলার পর বালি পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাথে উঠে এলাম ... না , হোটেলের দিকে না গিয়ে সোজা লাইট-হাউস মুখী হয়ে ওদিক পানে আরো একটু এগিয়ে পড়লাম।  বেশ লাগছিল । পথে মানুষজন  আছে , কাজেই অসুবিধাও নেই । আমাদের সাথীরা সকলেই নিদ্রামগ্ন, আমি ডাকাডাকি করি নাই  । কাজেই সময়টাকে নিজের মতন উপভোগ করতে করতে সামনে এগোলাম। আগে , এক সময় , সকালে হাঁটা শুরু করেছিলাম ,  পরে কন্যার পিছনের নাচন শুরুয়াতের পর হন্টনের  বন্টন হয়ে গেল অন্য  রকম কাজে !!! অগত্যা .... অনেকদিন পর সমুদ্রের ধারে ধারে হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল।  পথের পাশেই ফণী বিদ্ধস্ত দুই হোটেল দেখলাম।  একটার ওপর তলা পরিত্যক্ত,  অন্যটি পুরোটাই ধ্বংসাবশেষ। খারাপ লাগল দেখে , আরো কিছুটা হেঁটে , এবার আবার ফেরার পথ ধরলাম, ঘরে ফিরে মঞ্জুশ্রীর বানানো চা খেতে খেতেই আগেরদিনের ঠিক করা সেদিনের কার্যসূচীর আলাপ আলোচনা শুরু হল । 

পুরীর আশেপাশে অনেক কিছুই যাওয়া যায় দেখতে , তার মধ্যে যাওয়া ঠিক হল দুই শিল্প গ্রামে , যেখানে যাওয়ার বাই এখন মোটামুটি পুরীতে আগত সব ভ্রমণ পিপাসুর তালিকার শীর্ষে । আমি নিজেও আসার আগে দুজনের কাছে শুনেছি । ফেসবুকের কল্যাণে এই শিল্প গ্রামের কথা একদা পড়েও ছিলাম , ভুলেও ছিলাম 😔,  মনে করালো এক বান্ধবী আর আমার ভাসুর ঠাকুর ।

 জলখাবারের পাট চুকিয়ে , হোটেলের বাগানে ছবিছাবা তুলে আমরা সবাই রওনা দিলাম।  শিল্প গ্রামের সাথে আরো কিছু জায়গা লিস্টি মোতাবেক যাওয়ার কথা হলেও,  আমাদের অলিখিত ও অকথিত চুক্তি মতন সবটাই সবার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল।  

শিল্প গ্রাম রঘুরাজপুর , বিখ্যাত তার পট চিত্রের জন্য। অরিজিনাল পটের দাম যে বেশ বেশি , সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেও।  সে ধারণা শুধুমাত্র  বেশির ধারণা  , কত বেশী , কি মূল্য তার ধারণা না ছিল  আমার , না ছিল তেনার  , কাজেই বেরনোর সময় তিনি ওখানকার শিল্প কর্ম খরিদ করার অভয় বাণী দিতে , বেশ অবাক হলেও,  মন খুশ হয়ে গেল। কিন্তু পটের মাঝে পড়েই ঝটপট ওসব অভয় বাণী ভুলে প্রথমেই ... নিতে পারি , কিন্তু কেন নেব টাইপ ভাব নিয়ে , গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরপাক খেতে লাগলাম । সত্যি বলতে কি অসাধারণ শিল্প কর্ম !!!  পট তৈরি হয় ছেড়া শাড়ি অথবা কাপড়ের সাথে কেমিক্যাল মিশিয়ে , তারপর তার উপর আঁকা হয় পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র। পট ছাড়াও নানা রকম পাত্র , শিশি , বালতি , নারকেলের গায়ে চিত্র অঙ্কন ।দীর্ঘ সময়ের শিল্প কর্ম । দেখা সার্থক , আসা সার্থক । কথার খেলাপ নিয়ে কর্তার গিন্নির চাপানউতোরের ভিতরেই আমরা গাড়ি চেপে বসলাম। দুজনেই তখন হাড়ি মুখো । কর্তার বক্তব্য ... কিনে দিলাম শাড়ি , তার পরেও মুখ কেন হাঁড়ি ?? গিন্নির বক্তব্য যদি দিতে নাহি পারি তবে কেন কথা  ভারি ভারি ??? 😬

আড়াআড়ি করতে করতে মুখে কুলুপ এঁটে , পরবর্তী শিল্প গ্রাম পিপলি / পিপিলিতে পৌঁছলাম।  এটি ঠিক গ্রাম নয় , আধা শহর । আর রঘুরাজপুরে আমরা শিল্পীদের বাড়িতেই গিয়েছিলাম,  এখানে আমাদের বাহন চালক পশরা সাজানো এক দোকানে হাজির করলেন । পিপলির শিল্প ভিন্ন।  এখানে বিখ্যাত  এপ্লিকের কাজ । নানা রকমের ব্যাগ , ছাতা , ওয়াল হ্যাঙিং , ঘাগরা ইত্যাদি সহ অন্যান্য আরো অনেক ধরনের অনেক স্হানের শিল্প পশরা ঘুরে দেখলাম। 

এখানে আমি কিছুই কেনার মুডে ছিলাম না । কিন্তু আমি যেদিকে হাঁটব তিনি ভিন্ন দিকে যাবেনই । তো তিনি এবার কেনার বায়না জুড়লেন 🙄। আমি ছোট কিছু টোকেন কিনলাম,  হঠাৎই নজর কাড়ল কাঠের তৈরি পুতুল , যার পেটের ভিতর আরেকজন,  তার পেটে আরও একজনা ... এ ভাবে কোথাও ৫ ,কোথাও বা ৭ ।কেউ মহিলা,  কেউ বা পুরুষ। এমন পুতুল আমাকে আমার ছোটবেলায় নিয়ে গিয়েছিল আগের দিনই।  আবদার করতেই তখন  নানা পাটেকর বলে উঠে ছিলেন ... নেহী নেহী আভি নেহি । তবে ওটা আসলে  কভি নেহীই ছিল । আর এখানে সাধ আর সাধ্য সমানে সমানে , তাই বাছতে শুরু করলাম,  সাথে আমাদের রিমিও যোগ দিল , কিন্তু ওর ঘরেও ছোট নানা পাটেকর মজুত,  তিনি আবার , এমা পুতুল !! এ ধারার   মুখের এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেন যে রিমি বেচারীর মনটা ঝিমিয়ে গেল একেবারে । এ সব অদরকারী জিনিসের কদরকারী আমাদের দলে আমরা মহিলা মহল বাদে একজন‌ই।  ঠিকই ধরেছ তিনি আমাদের সত্য দা।  দাদাভাই এসে হাল ধরলেন ... " কিনবি ?? তো কিনে দিচ্ছি।" রিমি একটু ঘেঁটে গেল ... সত্যিই নাকি মজা ?? ... দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেষ দুজনে কাঠের পুতুল নিয়ে পিপলিকে বিদায় জানালাম। 

পেটে পিলপিলিয়ে  ছুঁচোর দল তখন কনসার্ট বলো , কীর্তন বলো শুরু করে দিয়েছে । প্রখর তপন তাপে মাস্কবাদী প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত প্রায় । বাদবাকি দর্শনীয় স্থানের তালিকায় ঢ্যারা দিয়ে সবাই এক বাক্যে পেট পূজোর মন্দির অন্বেষণ শুরু করলাম। অচিরেই মিলল ভোজনালয় । সকলের পছন্দসই থালি অর্ডার করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।  গরমাগরম  থালির আগমনও হল যথা সময়ে । খিদের মুখে সবই অমৃত। খেয়ে ঢেকুর তুলে গাড়ি চড়ে , এবার ফেরার পথ ধরলাম।  

ফেরার পথে হোটেলের কাছাকাছি এসে হঠাৎই আমাদের ম্যানেজারের নির্দেশ মেনে আমরা হোটেল ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম ... লাইট-হাউস পেরিয়ে আরো এগিয়ে গেলাম,  এক সময় হোটেলের সংখ্যা কমে , শেষ হল , আরো একটু এগিয়ে গাড়ি থামিয়ে আমরা নেমে পড়লাম ... আর একটু এগিয়েই নাকি মোহনা , এদিকটা বেশ ফাঁকা , বালি পেরিয়ে দলের কজনা হাঁটা দিল , আমার কন্যাও এগিয়ে গেল , আমরা কজন বয়ঃজেষ্ঠ ও জেষ্ঠারা , রাস্তার ধারের বাঁধানো অংশে বসে ও দাঁড়িয়ে দেখলাম অসংখ্য গাঙচিলের মৎস শিকার । ভারি ভাল লাগছিল । সারা দিনের ঘোরার পরের পরিশ্রান্ত শরীর ও মন যেন একটু আরাম পেলো । বেশ গরম আবহাওয়া জন্যই আমরা সকলেই বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।  এরপর হোটেলের ঘরে ফেরার পালা । ফিরে একটু গুছু করতে হলো , পরেরদিন আমাদের নিজ নিকেতনে ফেরার পালা । একটু গুছু ও বিশ্রাম নেওয়ার সময় আগের দিনের খরিদ করা সামগ্রী আবার অবলোকন করতে মেলে বসতেই নজরে এল যে , দোকানদার ভুল বশত একখান চুড়িদার পিস দাম না নিয়েই সাথে দিয়েছেন । কি কাণ্ড  !!! 

পূজোর আগে আগেই এক অনলাইন কেনাকাটির বিভ্রাটে পড়ে অনেক গুলি অন্যের জিনিসের আমার ঠিকানায় আর আমার জিনিসের ভিন্ন রাজ্যের ঠিকানায় যাতায়াত নিয়ে ভারি গোলযোগের মধ্যেই পড়েছিলাম,  কিন্তু এ তো অনলাইন নয় , এখানেও এক ভুল ?? সাথের শরৎ দা শুনেই বলে ফেলল যে , দেশের সব প্রদেশের বিক্রেতাই তোমার মতন ক্রেতা পেয়ে আহ্লাদে আটের জায়গায় ষোলখান হয়ে নানা কিছু উপহার স্বরূপ দিয়ে খুশি করছে । ভেবে আর কি করবে ? নিয়ে নাও। সাথের জনা দুই চেপে যেতে বললেও,  ওসবে আমার বিস্তর সমস্যা , তাই আবার দোকানে চললাম,  সমস্যা মিটল নগদে ,  ঘরে ফিরে এই বারের মতন আড্ডার হাট বসল আমাদের ঘরে । রাতে খেয়ে উঠে , মন যেন অবসন্নতায় ছেয়ে গেল । মন বলল ... আবার বেড়ু হলেও অদ্যই শেষ রজনী এবারের।

পরের দিন ভোরে উঠে সমুদ্রের পাড়ে গেলাম , সাথে মঞ্জুশ্রী । না , সেদিন দুজনে হাঁটাহাঁটির মধ্যে না গিয়ে , অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ও পরিষ্কার দেখে বালির ওপর বসে দেখলাম সূর্যোদয় । গল্পের ফাঁকে হঠাৎই দেখি সত্যদাও হাজির । একসময় ওখান থেকে উঠে একটু এগিয়ে চা বিস্কুট খেয়ে ফিরলাম হোটেলে । আরেক প্রস্থ চা খেয়ে , জলখাবারের পর দলের সকলে আমাদের কাছে ছোট্ট আদিকে রেখে সমুদ্দুরে স্নান আর সেই সাথে তাকে ,যাই যাই বলে বিদায় জানাতে গেল । আমরা গেলাম না কন্যার জন্য,  তেনার অল্প গলা খুশ খুশ ,আমি  অথবা তার বাবা স্নানে গেলে তার সাথে যুক্ত হতো পুপের  উসখুশ । অগত্যা বাবা ত্যাগ স্বীকার করলেন । আমি জলের থেকে স্থলেই বেশি স্বচ্ছন্দ,  কাজেই আমার ক্ষেত্রে নো মনকষ্ট । এরপরে গল্প একদমই অপ্প অপ্প । দুপুর গড়িয়ে বিকেল , তারপর সন্ধ্যা ... আমরাও তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্টেশনে এবং ট্রেনে হাজির । এবার পাশাপাশি আর কাছাকাছি সকলে । সাথে হোটেল থেকে আনা রাতের বন্দোবস্ত ... অবশ্যই খাবারের । যাওয়ার উত্তেজনার সিকি ভাগও তখন নেই,  কাজেই খাওয়ার পর ঘুমের ব্যবস্থার পর সবাই মোটামুটি ঘুমের দেশে , দিনের শেষে।এবারের ট্রেন হেঁচকিহীন তাই নিদ্রাহীন হওয়ার সম্ভাবনা মুক্ত।  ঘুম একবার অল্প ভাঙলেও , পুরোপুরি ভাঙল হাওড়া হাজির হওয়ার কিঞ্চিত আগেই । সব গুছু করতে করতেই  হাওড়া হাজির । আমরাও একে একে সব গুছিয়ে নেমে পড়লাম...দাদা মানে আমার ভাসুর ঠাকুরের পাঠানো গাড়ি করে ভোর ভোর ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে এলাম।  অনেক অনেক তাজা বাতাস নিয়ে আরো অনেক কাজ করার প্রতিশ্রুতির সাথে সাথে মনে মনে বললাম ... আবার যাব বেড়ু , কেমন ???

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৫


পুরীতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাঙালির কোনো উপলক্ষ্য লাগে না ।" উঠল বাই কটক যাই " এই প্রবচনের থেকে অনেক বেশি মনগ্রাহী অবশ্যই যদি বলা হয় " উঠল বাই পুরী যাই " । আমাদের এবারের যাওয়ার অবশ্য উপলক্ষ্য ছিলই।  তবে পূজো দেওয়ার সাথে সাথে আনুষঙ্গিক সবটাই উহ্য ছিল । কিন্তু ভিড়ের বহর দেখে একটা বিষয়ে দলের সবাই সহমত ছিলাম,  যে বেশি ঘোরাঘুরি নৈব নৈব চ।  

তো ভোর ভোর আগাম সময়ে  হোটেলে হাজির হলেও ঘরের দখল পেতে প্রায় সকাল সাড়ে আটটার কাছাকাছি হয়ে গেল । চেক ইন আর আউটের মাঝে ঘন্টা খানিকের ব্যবধান হলেও একটু এদিক ওদিক ধরতে নেই । আমরাও ধরিনি । দোতলার পাশাপাশি তিনটে ঘর সিঁড়ির একদিকে আর অন্য দিকে আর এক পরিবারের থাকার বন্দোবস্ত হল । সব থেকে জুনিয়র দম্পতির জন্য,  একটু আলাদা ব্যবস্থা এই আর কি !! আমাদেরও ওমন দিন ছিল রে ভাই !!!  এখন তো পুরোটাই গদ্য আর অম্ল-মধুর কলহ মুখর দিনগত পাপক্ষয় 🤫 

 দু দলের দু রকমের পছন্দসই( লাল চা & দুধ চা ) চা পান করার পর বুদ্ধি খুলল  , ঠিক হল সবাই হোটেলের নীচের রেস্টুরেন্টে জলখাবার খেয়ে সমুদ্রে সমর্পন পর্বে মন দেবো । সেই মতন ভরপুর জলযোগ করে সকলে একে একে সমুদ্র বিহারে এগিয়ে পড়লাম। তবে পুরী আর দীঘার ঢেউ যে আকাশ আর পাতাল , সে তথ্য আমার অবগত ছিল , তাই আমি সবার সম্পত্তির পাহারাদার / চৌকিদার নিযুক্ত হলাম স্বেচ্ছাকৃত ভাবে। খান তিনেক চেয়ার ভাড়া করে মাল পত্তর সহ আমি থাকলাম এধারে আর ওরা গেল ওধারে । সমুদ্রের ধারের স্নানরত জনতাকে দেখে মনে নানা ভাবের উদয় হল , প্রশ্ন জাগল ... অতিমারি কারে কয় ? সেটা দিয়ে কি করা হয় ? সেটা কোথায় হয়েছে ? .... তবে তাও একটা কথা বলতে হবেই অধিকাংশ মানুষই সাবধানী ( অন্তত আমার চোখে যা পড়েছে সেদিন  ) এবং মাস্ক-বাদী । এদের মধ্যে ভাগাভাগি করলে কারোর কারোর মাস্ক পরার ধরনে থুঁতনি বিলাস প্রকট । তবুও বলা যায় মানুষের অভ্যাস হয়েছে , হচ্ছে , হয়ে চলছে । সাবধানতার বর্ম আর যাই করুক বিপদে ফেলে না বা কম ফেলে বিপদে । ওই জন্যই  তো গুরুজনে বলেছেন .. সাবধানের মার নেই  । তবে কথা হল গিয়ে জলের একটা আকর্ষক শক্তি আছেই , কাছে গেলে টের পাওয়া যায় ঠিক । বসে থাকতে থাকতে মনে ইচ্ছে উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করল ... পাশের চেয়ারে আসীন এক মাসিমাকে আমাদের সমুদ্রগামী ব্যাগের দায়িত্ব ট্রান্সফার করে গুটি গুটি এগিয়ে গেলাম । অজানা -অচেনা মাসিমাকে ব্যাগ দিলে  ?? ওসব বললে একদম খেলব না ... দুনিয়া শুদ্ধু সকলকে অবিশ্বাস করতে আমি অপারগ আর সামনেই আমারই মতন পায়ের পাতা ডোবানো জলে মাসিমার মেয়ে-জামাই সাঁতার দেওয়ার যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করছিল না , তা বাপু আগে ভাগেই দেখে নিয়েছি , সর্বোপরি যার থেকে চেয়ার ভাড়া করেছিলাম আমরা , তিনি " কিছু হইবো নি " বলে অভয় দান করেছিলেন । বিশ্বাস,  সতর্কতা , আশ্বাস সবের ফলাফল আমার সাগরের ডাকে সাড়া দেওয়া ... তবে বলা ভাল দীঘা , মন্দারমণির সাগরের ডাকে যতটা সাড়া দিয়েছিলাম,  পুরীর সাগর দাদার ডাকে ওমন ভাবে সাড়া দেওয়ার মতন মনের জোর বাপু আমার নেই কো । বালি সরে সরে কচি বেলার মতন টলোমলো করতে করতে শেষমেষ ধপাস্ করে জলের মধ্যে বসেই পড়লাম ... কিন্তু সাধে কি বলে পুরীর ঢেউ জোরালো !!! আমার এমন ওজনদার বপুকেও মাঝে মাঝে টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গো !!! এদিকে আমাদের দলের ম্যানেজার মানে আমার কর্তা মশাই একদম লাগাম ছাড়া আর নাগাল ছাড়া । অন্যবার তাকে চেপে ধরে আর এগোতে দিই না , আর খানিক লবনজল সেবন করে থাকি ... এবার তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে কন্যা ও অন্যান্য জলচর সাথিদের সাথে মহানন্দে স্নান করলেন । আমি পাড়ে থাবা গেড়ে বসে খালি  বালি মাখলাম । ওরা এবারও আয় আয় , এসো এসো শুরু করেছিল , আমি সোজা জল থেকে উঠে চেয়ারে ... এরা হাঁপিয়ে একটু জিরোয় , আবার এগিয়ে যায় ... সব থেকে ছোট্ট আদি বাবুও তাই , সে আবার ঢেউ এর ঘায়ে এদিক ওদিক হলেই সামনে যাকে পাচ্ছে গাছ বাওয়ার  মতন গা বেয়ে উঠে পড়ছে ... সত্যদাকে বেয়েও উঠছে , কিন্তু থামছে না সে কোন মতেই। এ ভাবেই বেলা গড়িয়ে গেল অনেকখানি ... একে একে জলচররা উভচর হলেন ... সমুদ্দুরের ধারে ওখানকার ফেরি করা ছানার জিলিপি , নতুন নাম ধারী(মনে পড়ছে না) এক ভয়ানক মিষ্টান্ন দিয়ে নোনতা মুখ মিষ্টি করে সবাই ঘরে ফিরলাম ... একদম বিপরীত দিকেই আমাদের হোটেল । ফিরে সকলে আরেক প্রস্থ স্নান করে ... খাওয়ার ঘরের পানে জড়ো হলাম । যারা স্নান করেছে , তারা তো বটেই সাথে আমারও ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছিল ... মিষ্টি খেয়েছি তো কি , অতোক্ষণ ছিলুম তো ... সমুদ্দুরের হাওয়ার গুণ বলো আর বেড়ানোর গুণ বলো ক্ষিদে পেতেই পারে তাই না ??? 

সন্ধ্যার দিকে আমরা চললাম নতুন বীচ্ বা সমুদ্র সৈকতে । কিছুকাল হল বি .এন .আর এর দিকে গড়ে উঠেছে Blue flag beach । সাজানো গোজানো বীচ  , পরিচ্ছন্ন,  বসার ছাউনি ... নেই স্নানের অনুমতি । দিনের আলো থাকতে ওখানে গেলে ,  যে বেশ ভাল লাগত , তা বলাই বাহুল্য।  টিকিট কেটে সাজানো বীচে কিছুক্ষণ কাটানোর পর , আমরা চলে গেলাম আমার কন্যার জন্য তার জেঠুর তরফ থেকে  অর্গানাইজ করা surprise party তে । আসলে হয়েছিল কি , জেঠু তার আহ্লাদী দিয়া ওরফে পুপের জন্মদিনের জন্য তার এক অফিস কর্মীর (ওখানকার শাখার ) মারফত সমস্ত ব্যবস্থাপনা করে রেখেছিলেন । সেই মতন সব পর পর হলো সেই ভদ্রলোকের বাসস্থানের নীচের তলার হল ঘরে , সাথে ভুরিভোজ।  ভোজন , নাচন সব মিটিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত করে । পরের দিনের প্ল্যান আগেই ছকে নেওয়া হয়েছিল । পরের দিন উপলক্ষ্য পূরণ অর্থাৎ পূজো দেওয়ার কথা আমাদের।  

মন্দিরে যাওয়ার আগেই শুনেছিলাম অতিমারি জনিত কড়াকড়ির কথা , সে মতন সব কাগজপত্র সাথে ছিলই,  তাছাড়াও আমাদের একজনের ডবল ভ্যাকসিন না থাকার দরুন সদ্য করা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট ধারী কাগজ ছিল মজুত । তার মনে সংশয় থাকলেও সে আমাদের সাথে চলল , আমরাও কপাল ঠুকে জয় জগন্নাথ  বলে আণ্ডা বাচ্চাদের তাদের  মৌ আন্টির জিম্মা করে বেরিয়ে পড়লাম।  মৌয়ের এবার মন্দির দর্শনে রয়েছে পারিবারিক বাধা । গতবছর মাসিমা অর্থাৎ মা চলে গেছেন । 

দাদার পরিচিত পাণ্ডার সহায়তায় সব লাইন পেরিয়ে আইন মোতাবেক সকলে মন্দিরে পৌঁছলাম নির্বিঘ্নে এবং জলদি । দূর থেকে দর্শনও হল দিব্যি ... সবেমাত্র  ভাব বিহ্বল হয়ে ছলো ছলো চোখে  মনের প্রার্থনা জগন্নাথ দেবের কাছে নিবেদন করেছি কি না করেছি ... পিছন থেকে কর্তা মশাই এর আর্তি শুনে থমকে গেলাম।  আসলে হয়েছিল কি , লাইনের ভি.আই.পি বিভাগ আমাদের সহজে উতরে দিলেও সব লাইন মিলে মন্দিরের ভিতরে ভক্ত বৃন্দের খিঁচুড়ি আর এ সময়ের দর্শনে  পুণ্য অর্জনের আধিক্যে , দেশোয়ালি জনতার ভিড় ও তাদের জয় ধ্বনিতে কর্তা মশাই যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন !! আমার কর্তা মশাই এর বদ্ধতার ব্যরাম আছে , যার গালভরা নাম claustrophobia।  তাকিয়ে দেখি তিনি ঘেমে নেয়ে একসা আর চোখে মুখে আতঙ্ক । এমতাবস্থায় সাহস দিয়ে বিশেষ লাভ হয় না , তাও চেষ্টা করলাম , হাত ধরে , অনেক চেষ্টায় কাঁধ বেড় দিয়ে ধরে ভরসা জোগানোর চেষ্টাও বৃথা গেল ... দেখলাম দলের সবাই আগুয়ান হলেও আমার প্রাণনাথ ভরসা দানেও কেমন যেন ফরসা হয়ে আসছেন ... হাত মুঠো করে চেপে অন্য সাথিদের জানান দিয়ে দুজনে লাইন থেকে বেরিয়ে এলাম  একপাশে । অল্প বয়সী এক পুরোহিত বৈদ্যুতিক পাখার দিকে দিক নির্দেশ করে দিলেন । দাঁড়ালাম দুজনে । একবার বলার চেষ্টা করলেন ... " তুমি ওদের সাথে যেতে পারতে , আমি না হয় , দাঁড়াতাম । " আচ্ছা এক যাত্রায় পৃথক ফল কি হয় ? তোমরাই বলো ?? এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর , মন্দিরের সিকিউরিটি গার্ড ও আরও কজনার সহায়তায় ভিন্ন পথে বাইরে বেরিয়ে এলাম । বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ার (তখনও অরুণদেব তেজ দেখাতে শুরু করেননি)মধ্যে এসে সত্যিই যেন ধড়ে প্রাণ এল । কর্তা মশাই সুস্থ বোধ করলেন , মুখে হাসি ফুটল । সত্যি বলতে কি , আমার claustrophobia না থাকলেও,  ভিড় ভাল লাগে না কোনদিনই , আর এই অতিমারির আবহে ভিড় দেখলে আতঙ্ক জাগে মনে ।  গৌহাটির কামাখ্যাতে একই সমস্যা হলেও ভরসা কাজে লেগেছিল , একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম স্বর্ণমন্দিরের মধ্যে । তবে প্রতি ক্ষেত্রেই  সকলের সহযোগিতা পেয়েছি ।

দর্শন , পূজন , ঘুর্নন ( ঘোরাঘুরি ) সব মিটিয়ে হোটেল ফিরলাম। ঠিক হল জলখাবার সেরে আবার সমুদ্র মন্থন(?) শুরু হবে । আমি জাজ্বল্যমান অরুণদেবের তেজ দেখে ক্ষান্ত দিলাম , জলখাবার খেয়ে ঘরে ফিরলাম,  আমার কর্মক্ষেত্রে অনলাইন এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল , তার প্রতিযোগীদের বিভাগ অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করার কাজ আমার দায়িত্বে ছিল । হোটেলের ঘরে বসে শান্তিপূর্ণ ভাবে সাথের মোবাইল থেকে সে সব তৈরি করতে লেগে গেলাম... এক সময় তা শেষ হল , তেনারাও ফিরলেন , এরমধ্যে আমার কন্যা একবার বিশেষ কারণজন্য ঘরে ফিরে , কিছু পরে আবার সমুদ্রগামী হলেন তার মামীর সাথে । তারপর সব মিটিয়ে খেয়ে ঘুম .... । 

বিকেলে থুড়ি সন্ধ্যার দিকে দল বেরলো আশেপাশে ঘুরতে আর কিছু খরিদারির ইচ্ছাপূরণ করতে । এবার নিজের জন্য কিছু নেব না বলতেই দেখলাম ম্যানেজার কেমন ঝিমিয়ে গেলেন , আমি কিনব বললে , দেব না দেব না বলে  যেমন উৎসাহে কোমর বেঁধে (?)😒 ঝগড়া করে , এবার কেমন মিইয়ে গেলেন , কিছু পরে আমতা আমতা করে নাটকীয় ভাবে শুরু করলেন ... " তোমাকে একটা সুতোও দেবো না , তা কি হয় ?? " মনে মনে হেসে নিলাম।  গম্ভীর হয়ে একখান দোকানে গিয়ে সুতোয় বোনা পুরীর গামছা বাছতে শুরু করলাম।  এবার তো ম্যানেজার হতচকিত 🙄  ম্যানেজ করতে চলে এলেন ... অতঃপর আর খেলিয়ে লাভ নেই বুঝলাম,  সবটাই মাটি হবার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি না করে , মুখ বুজে শাড়ি পছন্দ করে ফেললাম।  নিজের থেকে কিনতে যেতেই আবার সেন্টিমেন্টাল সীন .... । পরবর্তী গল্প খুব সাধারণ। আরো দোকানপাট,  পশরা , ভিড় সব পাশ কাটিয়ে ভিন্ন পথে হেঁটে হোটেল ফিরলাম...অনেক রাত ওবধি আমাদের ঘরেই জমজমাট আড্ডার সাথে ঠিক হলো পরের দিনের কর্মসূচি ।

বেড়ানোও অবশ্যই আমার মতে একখান কাজের মতন কাজ ।মহান কাজ । সংসারের জাতাকলে ভাজা ভাজা হয়ে যাওয়া শরীর ও মনকে তাজা করা কি , যে সে কাজ না সাধারণ কাজ ??  পরেরদিনের একটু ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে শিগগির আসছি । কেমন ??? 

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৪ 


পুরী , জগন্নাথ ধাম , আমাদের বঙ্গ জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।  অনেকদিন পুরী যাওয়া হয়নি । কথিত আছে , জগন্নাথ দেব না ডাকলে নাকি আগাম ঠিক করে রাখা  যাত্রাও বাতিল হয়ে যায় ।  আমরা আবার অন্য জায়গার যাওয়া বাতিল করে জগন্নাথ দেবের ডাকে সাড়া দিয়ে পুরী গিয়েছিলাম বিয়ে-বৌভাত পর্ব মিটিয়ে।  সে গল্প আগেও করেছি । আমাদের প্রথম কোর্টসিপের  দিন ছিল রথের দিন , তাই আমাদের কর্তা গিন্নির জীবনে পুরী ও জগন্নাথ দেবের আসন বেশ পাকাপোক্ত। 

লকডাউন ইস্তক টুকটাক যা ঘুরু বেড়ু করেছি , সবই কাছাকাছির মধ্যেই আর চারচাকায় আসীন হয়ে । কু ঝিক ঝিককে খুবই miss করছিলাম।  পূজোর আগে অসুস্থ হলেন আমার শ্বশুর মশাই ...খুব চিন্তার মাঝে দিন কাটার পর , যখন আমরা চিকিৎসকের কথায় আশা ছেড়ে দিয়েছি , সেই সময় বাবা বাড়ি ফিরলেন । পুরোপুরি সুস্থ না  হলেও কিছুটা বিপদ কাটিয়ে  আমাদের খানিক নিশ্চিন্ত করলেন ।  পূজো দেওয়ার ভাবনা আমার কর্তার মাথায় ছিলই, আরো তিন পরিবারের সাথে পরামর্শ মতন পুরীর টিকিট,  হ্যাঁ ট্রেনের টিকিট কাটা হল পূজোর আগেই। 

এরপরও একরাশ সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে নির্ধারিত দিনে লটবহর নিয়ে হাওড়া স্টেশনের হট্টমালায় হাজির হয়ে জন স্রোত দেখে দুশ্চিন্তায় কুল কুল করে ঘামতে ঘামতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মুখের মাস্ক খোলার সাহস নেই । ওভাবেই যাত্রা শুরু করলাম।  প্রথমেই চোখের সামনের সব কিছুই ফসফসিয়ে স্প্রে করে নিল আমার সাথের জনেরা , আমি আর সত্যদা আগাম বসে পড়েছিলাম তাই আমাদেরও স্যানিটাইজ করা হল  🙄 । ডিয়ো আর পারফিউম ছাড়া নতুন ধারার স্প্রে মেখে , বসেই পড়লাম ... মনে তখন  " পড়েছ যবনের হাতে , খানা খেতে হবে সাথে " টাইপ ফিলিং হল । তো খাবার কথা যখন উঠেই পড়ল বলেই ফেলি , রাতের খাবার বাড়ি থেকে এক প্রস্থ খেয়েই সবাই বেরিয়েছিলাম , ট্রেন তো ১০.৪০ এর পুরী স্পেশাল।  টুকটাক খাবার বেরিয়ে পড়ল আমাদের সঙ্গী মৌ এর ঝুলি থেকে , আগেই প্রতিশ্রুতি আদায় করা ছিল .. ত্রিকোণ পার্কের উল্টোদিকে city mart এর পাশের গলির বিখ্যাত শঙ্করের ফ্রাই আর এক বাক্স সন্দেশ ( দোকানের খেয়াল রাখি নাই , সব খেয়াল তখন ফ্রাইতে ন্যাস্ত, খেতে ব্যস্ত ) । আমরা আণ্ডা বাচ্চা সহ মোট ১১ জন । কাজেই একসাথে সবাই সীট পাই নাই । আছি কাছাকাছি । পরের দিন আবার আমাদের কন্যার জন্ম দিন । খাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই ঘড়ির পানে চেয়ে সময় গুনছি । বাড়ি থেকেই কন্যা বলে দিয়েছে ট্রেনের মধ্যেই তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর আবদার  ...

 শোয়ার ব্যবস্থাও ততক্ষণে করে ফেলা হয়েছে , এই প্রথম পুপে একা মাঝের বার্তে শোবে , ওখানে ওর বাবাও থাকবে । আমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা দেওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা । সবাই নিজের নিজের বালিশ , চাদর আদর করে সাথে নিয়েছি । এখন আর ওসব রেল কর্তৃপক্ষ দেন না অতিমারির কারণজন্য । কর্তা মশাই অতি সাবধানী, পাতলা ব্ল্যাঙ্কেট কিনেই ফেলছিলেন , কারণ ওনার কাছে  খবর ছিল ট্রেনের ভয়ানক ঠাণ্ডা নাকি  তলা থেকে  ওঠে !! একতলা বাড়ির মাটিতে শুলে তলা থেকে ঠাণ্ডা ওঠে এ তথ্য জানি কিন্তু ট্রেনের ক্ষেত্রে সেটা কি করে সম্ভব জানি না বাবা । বললুম ... ট্রেন সাপের মতন চলে বটে , কিন্তু চাকার ওপর থাকে তো !! আর এসি এর দৌলতে আপার বার্তে ঠাণ্ডার প্রকোপটা বেশি এমনটাই আমার জ্ঞানের ভাণ্ডারে মজুত। তো যাইহোক এসব চাপানউতোর চলতেই থাকে সব ঘরেই। আর কন্যার পিতাশ্রী ওমনই হয়ে থাকে । 

মধ্যরাতে পুপে দেবীকে জন্মদিনের শুভ কামনা জানিয়ে যে যার মতন শুতে গেলাম। ট্রেনটা শুরু থেকেই কেমন হেঁচকি তুলে তুলে , সবাইকে তটস্থ করতে করতে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে । আমাদের পাশের একসহযাত্রীকেও বলতে শুনলাম যে এই ঝাকুনির বার্তা তিনিও কারোর থেকে শুনে এসেছেন আগাম । হয়তো  অতিমারি জনিত কারণে দীর্ঘ  অচলাবস্থাই এর মূলে । 

ভোরের দিকে একবার উঠে ওদিক পানে নজরদারি করতে গিয়েই কর্তা মশাইকে চোখে পড়ল।  না , তিনি ঘুমাননি , নিদ্রামগ্ন কন্যাকে সাথে নিয়ে বসে আছেন । বোঝো কাণ্ড  !! ট্রেন এর ওই হেঁচকি বা ঝাঁকুনীতে বেচারী ছিটকে পড়ার ভয়ে মাঝের বার্ত থেকে নেমে বাবার বার্তোস্হ হয়েছে আর বাবাও ঘুমে তালা চাবি দিয়ে উঠে বসেছেন । কি আর করা সহধর্মিনী বলে কথা , তাকে আমার বার্তের দিকে রওনা করিয়ে  , আমি নিদ্রা দেবীকে বিদায় জানিয়ে ওখানে বসলাম । সময়মত  আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটি ফুটি করে ফুটল , সবাই চোখ মেলল , চায়ে গরম হাজির ... সে সব পাট মিটিয়ে সঠিক সময়ের অনেক আগেই পুরী পৌঁছল আমাদের ট্রেন । তখন ৬.৩৫ মি. 

ট্রেন থেকে নেমেই শুনলাম , একটু অপেক্ষার পর রেলওয়ের গাড়ি চড়েই মালপত্র সহ স্টেশনের বাইরে যাব ... ভাবলাম... কি দারুণ ব্যাপার স্যাপার । কিন্তু... স্টেশন চত্বর এক সময় প্রায় ফাঁকা হয়ে এল , হেনকালে  একখান গাড়ির দেখা পাওয়া গেলেও ...  সে গাড়ির চালক দুজন আর দুটির বেশি লাগেজ নেবে না বলে হুঁস করে বেরিয়ে গেল আমাদের মায় ম্যানেজারের চোখের সামনে দিয়ে । নাহ্ , ম্যানেজ করতে পারল না গো !!!  আমরা দলের ম্যানেজারের দিকে নজর করে দেখি , তিনি হাঁটা দিয়েছেন দ্রুত নিজের বাক্স প্যাটরাসহ ... তাকে ধরতে যার যার লট বহর সে , সে নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম।  ছোটা শেষ হল এক সময় , তার মধ্যে আমার ট্রলি ব্যাগের দুই চাকার মাপ ভিন্ন,  সে বার দুয়েক প্ল্যাটফর্মে ফ্ল্যাট হল , শেষমেষ আমাদের দলের ছোট বাপ্পা তার দায়িত্ব নিয়ে আমায় রেহাই দিল । বদলে তার পাকাপোক্ত চাকাযুক্ত ট্রলি নির্দ্বিধায় টেনে নিয়ে পথের শেষে স্টেশনের বাইরে এলাম।  দুটো গাড়ি ভাড়া করা হল , ম্যানেজারের দেখা পেলুম । কথা বলার সুযোগ হয়নি । ভাগ্যিস। চললাম আমাদের পুরীর আপাত ঠিকানার উদ্দেশ্যে।

ক্রমশ 

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২৩


ঘরের ঘেরাটোপ সবার কাছেই খুব আপন । তবুও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে পড়ি আমরা । আসলে সারাদিনের থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় এর বাইরের ডাক যারা শুনতে চায় , তাদের কখনও আকাশ ডাকে , কখনও পাহাড় ডাকে ... ডাক দেওয়ার দলে দল ভারি করতে প্রকৃতির নানান বিভাগ আছে । কিন্তু সকলে সে ডাক শুনতে পায় না । তা দোষের মোটেই না , এক এক জনের জীবনের গান এক এক রকম । 

গত বছরের বসন্তের শেষ থেকেই বাইরের ডাকাডাকিতে অনন্ত কালের তালা পড়ার উপক্রম হল , আমরা কিছুদিন ভয়ে কাটিয়ে সাবধানতার কবজ পরে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।  কোন সাবধানতাই full proof নয় , তাই ভয় রইল সাথে সাথে ।

 কিছুদিন ভাইরাসের প্রকোপ কমল , একটু হাঁফ ছাড়িয়ে , সমুদ্র সৈকতে ঘুরে,ঘরে ফিরলাম...তারপরেই ২য় ঢেউ এর, ফেউ হাজির আবার ঘরের বাইরে নেই কেউ ( প্রায় )। হাঁফ ছাড়তে ছাদই সম্বল । আর আমার কর্তা মশাই যেহেতু মেডিক্যাল প্রোফেশনে আছেন , তার ভাণ্ডারে ভয় পাওয়ানোর মেলাই রসদ মজুত,  অগত্যা ঘরের মধ্যেই বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম । কি করি বলো !!! কদিন বেড়ু যাওয়ার আবদার করতে না করতেই লকডাউনের জন্য যে রোজগার কমতি , সেই এক বছরের পুরাতন কুমীর ছানা বেরিয়ে পড়ল ... আমিও রণে ভঙ্গ দিলাম।  জানি তো !! আমার থেকেও তেনার হাঁফ ধরছে বেশি । আমি বললেই নানা পাটেকর হয়ে যান তিনি ।

যথা সময়ে আমার শিখণ্ডী,  অর্থাৎ আমাদের কন্যার দিকে চেয়ে তার বাবার মন ঘুরল  আর আমরাও দুই পরিবার বাপসোহাগী কন্যার লেজ ধরে গঙ্গার ধারে ডায়মন্ড হারবারের অভিমুখে রওনা দিলাম। কলকাতার কাছেই , যেতে ঠিক দু ঘন্টা সময় লাগল । ওখানকার সবচেয়ে বড় মৎস ব্যবসায়ীর জামাই এর রিসর্ট পুণ্যলক্ষ্মী । কলকাতা থেকেই বুকিং সম্পন্ন করা ছিল । হাজরার মোড় ও ল্যাণ্ডসডাউন ক্রসিং এর মাঝেই ওদের বুকিং অফিস । 

জলখাবার খেয়ে ও টুকটাক খাবার ( দরকার হয় না ) সাথে নিয়ে , মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নদীর ধারের সাময়িক বাসস্থানে। 

ঘরে ব্যাগ পত্তর রেখে আকুল হয়ে সবাই বাগানে নেমে এলাম । বিস্তৃত বাগানে আণ্ডা বাচ্চার হুটোপুটিতে আমার কন্যাও যোগ দিল , তার নিজের মতন করে। অন্য সময় হলে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে তার আর তার মায়ের জুড়ি মেলা ভার , তবে এখন দুরের নিয়ম বলবৎ .... অগত্যা , সে একাই একশো পন্থা নিল । 

দুই গাছের গুঁড়িতে বাঁধা হ্যামকে এবারও এদের উৎপাতে উঠতেই হলো !! নেহাত আজকাল পরিচিত মহলে ছবি দেওয়া একটা অবশ্য পালনীয় অলিখিত বিধি ও🤣 বটে । কন্যা আমার বীরাঙ্গনা টাইপ হলেও স্লীপে স্লীপ্ করে যাওয়ার ভয়ে যখন আকুল , ঠিক তখন বছর ৪/৫ এর দুই খুদে এগিয়ে এল দিদির দিকে , প্রেসটিজে গ্যামাক্সিন পুরো !! যাক , এরপরে স্লীপের ব্যপারটা আর জমলো না , তাতে কি ?? অন্য উপায় আছে তো !!! ঝোলার ও দোলার দুরকম ব্যবস্থা রয়েছে তো !!!  হ্যামক দুটি আর দোলনাও দুই , সাথে আরো কিছু । তবে সরকারি নির্দেশ মেনে সাঁতার মানা হ্যায় । আমাদের কমল মিত্র সম বাবা যদিও পুলে নামতে দিতও না , কন্যার পা ডোবানোর ইচ্ছাপূরণও বাতিল হল , কারণ পুলের পানে নজর দিলেই বাবার দৃষ্টি কুল (cool) ,আমার আবার জলের থেকে স্থলেই স্বচ্ছন্দ বিচরণ । তাই ওসবে আমার অবস্থা হেলদোলহীন। 

দুপুরে জমজমাট ভোজন হল , পুরো টিম ইলিশের ভাজা আর ভাঁপায় ডুব দিলাম। কন্যার ভাজা মাছের কাঁটা বাঁছতে গিয়ে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেলেও, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে  ভাঁপা মাছ বাবার পাতে বাঁছতে দিতেই আমার মেজাজ পুরো ওদিকে ট্রান্সফার হয়ে গেল । সমান সমান ভাগযোগ ... কারো বলার নেই কিচ্ছুটি । মাছের স্বাদ দুরকমের । ভাজা ছিল তাজা ,অন্য ভাঁপার স্বাদ খানিক চাপা । ফেরার দিন কাঁচা মাছের খোঁজ লাগিয়ে পেলাম না ভালো । কাছেই নগেন্দ্র বাজারে গেলে হয়তো বা দেখা মিলত ...কিন্তু!!! অনলাইন আমাদের হ্যাবিটে বারোটা নয় তেরোটা বাজিয়েছে !!! খেয়ে ঢেকুর তুলে আপামর বাঙালি অল্প ঘুরেই ঘরে ঘুমের দেশে .... । বাজারে কে যাবে ?

সন্ধ্যার সময় আলোর মালায় বাগানে যেন স্বপ্ন পুরী !! নদীর হাওয়া ... সত্যিই মনকে ঝরঝরে করার ওষুধ। তবে নদীর জলে কচুরীপানা মনকে বিষন্ন করেছে , একটু পরিষ্কার,  পরিচ্ছন্নতা সব দিক দিয়েই কাম্য । পরের দিনের ভোরের আমার একার ঘোরাঘুরির পর ঘরে ফিরলাম তখনই,  যখন আকাশ ভেঙে ঝরো ঝরো মুখর  বাদল দিন শুরু হলো । বাগানের মধ্যেও ছাদ ঘেরা অংশে এক ভ্রমণ পিপাসু ভদ্রমহিলার নাচ দেখলাম দুর থেকেই । মুগ্ধ হলাম।  ঘরের রোজকার নাচন তো এ নয় , এ হল মনের খুশির প্রকাশ । বাইরের পৃথিবী , প্রকৃতি আমাদের গানে, নাচে উদ্বুদ্ধ করে .... 

ঘরে ফিরে সকালের বদলে ফেরার সময়টা আর একটু বাড়ানো হল , অনেক কাঠ খড় পুড়িয়েই সই ... হলো তো !! কাজেই বেড়ানোর মধ্যে মন কষাকষি , মেঘ জমা জমি সবই হয়ে গেল । জলখাবারের পর্ব যেটা কিনা কমপ্লিমেন্টারি তা মিটিয়ে , সবাই ঘরেই ফিরলাম. .. কারণ বাগানে একটু ভিড় তাতে আমার কর্তার ফতোয়া জারি,  তো কোই বাত নেহি , ঘরের জানলা দিয়েই নৌকো , জাহাজ , স্টীমার সবার যাতায়াত নজরে ধরা দিচ্ছিল আর গল্পের সাথে বিশ্রাম সবই চলছিল , একটু ঝিমন্ত , ঘুমন্ত ভাব স্নানের পর হলো .... এরপরে খাওয়া আর ভাতঘুমের পাট চুকিয়ে পৌনে ছয়টায় ফিরতি পথ জমে উঠল সত্যি ভুতের গল্পে , কিছু পরে দেখি আমার ফুলন দেবীর হাল , বেহাল ... গাড়ির বাইরে কিছুটা পথ হাল্কা অন্ধকারে ঢাকা ... ওতপাতা ভুতের খাসমহল ... আর কি !! কিন্তু সামান্য পরে পরেই আলো ঝলমলে দোকান , সত্যিই ভুতেদের ভারি মুশকিল!! যাক শেষমেষ ওসব গল্প বাদ ছাদ দিয়ে অন্য রকম গল্প আর খেলা খেলতে খেলতে ঘরে ফিরলাম পৌনে আটটায়...

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২২ 


 প্রথম দিনের ঘটনার ঘনঘটা পেরিয়ে আমাদের মুম্বাই বেড়ু পরের দিনে পড়ল । আগের দিনের ঘটনার দরুণ আমরা এ দিন অতি সচেতন হয়ে রওনা দিলাম।  কোথায় ?? আরে !!! বলিনি বুঝি ??? হ্যাঁ , তাই তো ;  আগেই বলেছিলাম যে ওই চত্বরে দুই বান্ধবী বাসা বেঁধেছে বৈবাহিক সূত্র ধরে । এক বন্ধুর সাথে মোলাকাত তো ভালোই হলো , এবার পালা অন্যজনের । সে তখন থাকত , একটু দূরে থানেতে । মুম্বাই পৌঁছে আগের সকালে ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা প্রথমে ব্যর্থ হতেই , ঘরের উক্ত দুই বন্ধু যুক্তি করে , যুক্ত হয়ে  আমাকে উত্যক্ত করতে লাগল .... " বন্ধু ফোন ধরছে না , তোমায় চায় না "... ইত্যাদি প্রভৃতি বলে । কি করি ?? এ সব ভেবে আকুল হয়ে বান্ধবীর দেওয়া অন্য একটা নম্বরে ফোন করতেই ঘরের বন্ধুদের মুখে আপাতত তালা পড়ল । কারণ আমার বান্ধবী  ফোন ধরল তো বটেই,  সাথে সাথে তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বরে আমার সব আশঙ্কার অবসান হল । কর্তা মশাইকে ডেকে , ফোনেই সে জানালো সাদর আমন্ত্রণ।  তার কন্যা তখন ছোট্ট, নিজের নানা রকম শারীরিক অসুস্থতার জন্য দেখা করতে আসা সম্ভব যে নয় , সে কথা সে আমার কর্তার কাছে পেশ করল। তারপরের গল্প খুবই জলবৎ তরলং । আগেই বলেছি যে এবার আমরা খুব সাবধানী। প্রথমে বাসে করে স্টেশন,  তারপর নির্ধারিত ট্রেনের টিকিট কেটে দুবার ট্রেন বদল করে আর তারপর ট্যাক্সি চেপে বান্ধবীর অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হলাম।  সারাদিন চলল , খাই দাই , গল্পের মজলিস , আর পুকচুটাকে অনেক আদর করার পালা। কাকিমা , মানে বান্ধবীর মা তখন ওখানেই ছিলেন , ওনার হাতের অনবদ্য মেথি চিকেন পেট পুরে খেয়ে , রেসিপি শিখে এবার ফেরার পালা । ফিরতি পথে ওর কর্তা মশাই আমাদের স্টেশনে নামিয়ে দিতেই , তার কথা মত আমরা ফিরতি ট্রেনের টিকিট কাটলাম ফার্স্ট ক্লাসের । হ্যাঁ , ওখানে ট্রেনের ক্লাসের ভিন্নতা বজায় আছে । দুই ক্লাসের দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক , তা ভিড় মুক্ত রেখেছে প্রথম ক্লাসকে। এই তথ্য জানা থাকলে প্রথম দিনের বিভীষিকার হাত থেকে রেহাই মিলত । তবে সেদিন থানে যাওয়ার সময় স্রোতের ভিন্ন  দিকে যাওয়ার দরুণ , ভিড়ের ভীতি চাপেনি আমাদের ওপর । তাই  দিনটা ভালোভাবেই কাটিয়ে ফিরলাম । 

পরের দিন সাগ্নিকের ঠিক করা ভাড়া গাড়িতেই আমাদের মুম্বাই দর্শনের পালা চলল। একে একে কমলা নেহেরু পার্ক , আরো একখানি পার্ক ( নাম মনে নেই ) সমুদ্রের ভিতর হাজি আলি , চৌপাট্টি বীচ্ , মার্কেট প্লেস পেরিয়ে ঘুরপাক খেলাম । সাথে সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির এবং সমুদ্রের ধারে অবস্থিত মহালক্ষ্মী মন্দিরও বাদ গেলো না । সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরের সিকিউরিটি ব্যবস্থার কড়াকড়িতে ক্যামেরা , মোবাইল সবই ড্রাইভার দাদার কাছে গচ্ছিত রেখেই গিয়েছিলাম । 

মুম্বাই ঘুরতে যাচ্ছি ... সে কথা শুনে এখানে অনেকেই বলেছিল  শাহরুখকে দেখতে পাবি .... বলে কি ?? পরে বুঝলাম, দেখলামও। অবাক হবার কিছুই নেই,  সারা দেশেই এনাদের পথে পথে দেখতে পাওয়া যায় পোস্টারের দৌলতে । সে সব আলাদা করে বলার কি আছে বলো দেখি !!! যত্তোসব !!! 

ঔরঙ্গাবাদের আমাদের one day trip এ আলাপ হওয়া এক দিদিভাই সেমি পৈঠানি শাড়ির খবর দিয়েছিলেন , দোকানের নাম সহ , দাদর্ ক্রস করার সময় চোখের সার্চ লাইট জ্বালিয়ে এক গোলপানা চৌরাস্তার মাথায় সেই দোকানের দর্শন মেলার পর , সেখানেও হানা দিয়ে আর একখান অন্য শাড়ি বাগিয়ে ঘরে ফিরলাম  সন্ধ্যার দিকে , সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজন পথেই  হয়েছিল । দর্শনীয় স্থান কিছু কিছু দেখা না হলেও,  সব মিলিয়ে এই বেড়ুতে এতোটাই মজা হয়েছিল , যা যা দেখা হয়নি , তার জন্য কোন খারাপ লাগা মনে দানা বাঁধেনি । 

ঘোরার শেষ দিকে এক অভিনব ট্রিপের ব্যবস্থা করে দিল সাগ্নিক । সেই ট্রিপ আরো জমে উঠল আমাদের প্রথম দিনের চারমূর্তির একত্রিত হবার পর। এর মধ্যেই একদিন রাতে ঠিক করা হল কাছেই গোয়াগামী পথে আলিবাগ পেরিয়ে , মুরুদ জঞ্জিরা ফোর্ট  ও আলিবাগের মাঝামাঝি সমুদ্রের ধারে পড়বে তুলনামূলক ফাঁকা কাশিদ বীচ্ । সমুদ্রের হাতছানি সহ একটা দিন যাপনের মনোরম ঠিকানা । সকালে রওনা দিয়ে দিন শেষে ফেরা । ওখানে এক বেলার / একদিনের থাকা খাবার উপযুক্ত ব্যবস্থাও মজুত।  

ফোনাফোনি করেই বার্তা এদিক ওদিক ছুটল , সেই মত যাওয়ার আগের রাতে বান্ধবীরা চলে এল সাগ্নিকের ডেরায় । একসাথে খাওয়া , গল্পের পর আবার আমরা ওরা দুই দল দুই ঘরে অনেক অনেক আড্ডার পাট মিটিয়ে ঘুম দিলাম, সকালে চটজলদি তৈরি হয়ে চারজন রওনা দিলাম সাগ্নিকের ঠিক করা গাড়িতে ।সেদিনও সাগ্নিকের অফিস । তবে সেদিন যেহেতু ছিল আমার জন্ম নেওয়ার তারিখ , সেই মত কথা হল ফিরে আমাদের সকলকে নিয়ে সাগ্নিক বেরবে । একেবারে ঠাসা কার্যাবলী ।

গান চলল , গাড়ি চলল , কিছু পরেই শহরের কংক্রিটের জঙ্গলের অদল বদল চোখে পড়তে শুরু করল , প্রকৃতি তার দরজা খুলতে শুরু করল । হাইওয়ের ধারে এক জায়গায় ডান হাতের কাজ ভালোই  হল । ড্রাইভার দাদা কলার উঁচিয়ে ঘোষণা করলেন  , এ পথের থেকেও গোয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেক গুণ এগিয়ে । সত্যিই তাই , নানাজনের বর্ণনা আর ছবি দেখে তেমনই ধারনা হয়েছে ।  কবে যে যেতে পারব আর ধারনার বাস্তবায়িত রূপ  দেখব ... কে জানে ?? আমাদের এই করোনাজনিত লক অ্যান্ড কি এর চক্করে সব বেড়ানোর দোর গোড়ায় সংশয় আর ভয়ের তালা পড়েছে । তাও আমরা নিজের মতন সাবধানতার কবজ এঁটে যাচ্ছি বটে , কিন্তু সেই আগের সতস্ফূর্ততা যে কবে ফিরবে ?? 

আগের কথায় ফিরি ... এক সময় আমাদের সাথি হল  আরবীয় সমুদ্র । নিজেদের মধ্যে গল্পের থেকেও প্রকৃতি দর্শন হচ্ছিল বেশি । সাথে  গাড়িতে চলছিল মন পসন্দ গানা । এক সময় পথ ফুরালো , আমরা আমাদের সেদিনকার দিনযাপনের ঠিক করা ঠিকানায় পৌঁছলাম। বাগান ঘেরা ছোট্ট দোতলার একতলায় অবস্থিত হোমস্টে । দুটোই ঘর , ঘর সংলগ্ন বাথরুম আর একখান বড় হল ঘর । আপাত দৃষ্টিতে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।  খুঁটিয়ে দেখার সময় আর তখন কার হাতে ?? সমুদ্র যে ডাক দিয়েছে কোন সকালে !!! সাথের ছোট ব্যাগ পত্তর ও মোবাইল ঘরে রেখে ( আমার অতি সাবধানী কর্তা মশাই মোবাইল সাথেই রাখলেন প্লাস্টিকের মোড়কে ) আমরা এবার চললাম। কোথায় বলো তো ?? ঠিক ধরেছ সাগর দার ডাকে সাড়া দিয়ে আমার গানে জীবন আনতে চললাম। সাগরের ডাক উপেক্ষা করে , তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়ৈ গেছে কি বলা যায় কখনো ?? 

এমন জনমানবহীন রোমান্টিক বীচ্ আমি বাপু আর দেখলাম না এখনও। দিনটা সপ্তাহের শেষ দিকে হলেও শেষ দিন ছিল না । কারণ যাই হোক , বীচে পৌঁছেই নজরে এল ওখানে শুধুই আমরা ৪ মূর্তি। আর সমুদা উদাত্ত ঢেউ এর দিকে একদম দামাল ভঙ্গিতে ছুট তারপরই এপাং ওপাং ঝপাং 🙃🙂 কিন্তু একি !!! সমুদা পাচন খাওয়া মুখ নিয়ে ঝপাং থেকে উঠে আসছে কেনো ?? সমুদ্দুরে কি কোনও ওত পাতা বিপদ বসে ? মুম্বাই পৌঁছে ইস্তক সময় গতিক বড়ই বেগতিক দিকে ঝুঁকে আছে । 

আমরা কাছে যেতেই রহস্য উন্মোচিত হল ... আসলে সমুদা যখন ঝপাং হল , উত্তেজনার বসে টাকার ব্যাগ সহ ডাইভ দিয়েছিল !! টাকার ভিগি ভিগি চেহারা একদমই দর্শনধারী নয় , আর তার গুণ তো বিচার করা যাবেই না যতক্ষণ না শুখা নোটের দেখা মিলছে । কিন্তু সমুদাকে আমরা একটু ক্ষণের মধ্যেই সাগরদার জিম্মা করে দিলাম তার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে ,টাকার শোক তখন ঢেউ এর ঝোঁকে উধাও । ওদের বিয়ের পর ওটাই প্রথম outing ছিল , কাজেই ওরা ভেসে গেল প্রেমের জোয়ারে , ভাসাবো দোহারে style এ , আমরা কর্তা গিন্নি একটু পুরাতন বিবাহিত ( তখন বছর ৪) তাই বিজ্ঞের মতন একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে হাসলাম।  আমাদের মুশকিল হলো ... আমি পা ডোবার বেশি জলে যাই না , আমি কুমির ডাঙা খেলতে সেই ছোট্ট থেকেই ভালবাসি ঠিকই  তবে কুমির হিসেবে নয় , তাই ডাঙা ডিঙোতে ভয় পাই বটে !!! এদিকে তিনি জলের ধারে গেলে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না , জলের মাঝে বেচারা (?) আমাকে পায় না । কিছুক্ষণ বাদে আমার বান্ধবী মর্তে মানে সাগরপারে আমাদের দিকে নজর ফিরিয়ে , কিঞ্চিত লাজুক লাজুক মুখে ফেরত এলেন , ওদিকের দাদার ডাকাডাকি উপেক্ষা করে । আমরা ওকে আশ্বস্ত করলেও তিনি সেন্টু মিশিয়ে যা বললেন,  তাতে  আমার সেন্টুও সেন্টপার্সেন্ট অন হয়ে গেল .... " ওর সাথে আরো বেড়াবো , তোকে কি আর এ ভাবে পাবো ?? " 

ব্যাস্ , ক্লোজআপ নেওয়ার কেউ নেই কো সেথা , তবে আমার কর্তার মুখ ক্লোজ করা এসব ক্ষেত্রে অসম্ভব !!! যাক্ , মোটের ওপর এরপরের অঙ্কে ( mathematics নয় 🙏🏻) আমার কর্তা সমুদ্দুরে নোনতা জল খেতে ঝপাং হল আর কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল ওরা আর আমরা আলাদা টিম , যতই টিমটিম করুক । কিছু সময় পর আমার যা হয় আর কি , রোমান্টিক পরিবেশে গান পায় , আমার বান্ধবী আবার নাচের দিকের কেরামতি , কাজেই সাগর তীরে পুরো সাংস্কৃতিক মধ্যাহ্ন যাপন শুরু হল ....  হঠাৎই নাচা গানার মাঝে বিভোর  দুই কুশীলব দেখি ওই টিমের দুই শ্রোতা এবং দর্শকও স্রোত ঠেলে হাজির , পলিপ্যাক থেকে গামছা , তোয়ালের বন্ধন মুক্ত  হয়ে ক্যামেরাও বেরিয়ে পড়েছে !!! দূরে দেখা যাচ্ছে মুরুদ জনজিরা ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ ....সবটাই ভারি  অপূর্ব । নাচ গান শেষে চারজন এগিয়ে পড়লাম... না রে ভাই , ফোর্ট অনেক দূরে ওদিক পানে পাড় ধরে হাঁটা শুরু করিনি , ওখানে এক দুদিন থাকলে হাল্কা চেষ্টা করা যেতো  হয়তো বা , যেমন , একবার নিউ দীঘা থেকে সমুদ্রের পাড় ধরে আর হাতে হাত ধরে  পাড়ি দিয়ে সামান্য দূরে পুরাতন দীঘায় হাজিরা দিয়েছিলাম .... এবার না হয় আর একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হতো !! কারণ এ ধরণের পুরাতন ফোর্ট দেখলেই কেমন দুব্বল হয়ে পড়ি আমি আর আমার মনে পড়ে যায় চিত্রহারে দেখা এক পুরাতন হিন্দী ছায়াছবির দৃশ্যায়ন,  সাথে আমাদের কিশোর কুমারের বিখ্যাত গানের কলি .. " রাত কাল ই (?)  এক্ খোয়াবো মে আই অউর গলে কা হার হুই ... 🎼 " 

তো যা বলছিলাম দীঘা , পুরীর সমুদ্রে হুটোপুটির পর আপামর বাঙালি যা খোঁজে,  আমরা সে পথই ধরলাম । এবং বলতে নেই খানিক এগিয়ে একটা ঝুপড়ি গোছের দোকানে ডাবের দর্শনও মিলল , ঝুপড়ির পাশে আবার দুই  গাছে বাঁধা হ্যামকের দেখা মিলল । ফেলো কড়ি .... ধরো দড়ি ... মানে হ্যামকে দোল খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে বটে । আমার এসব ইচ্ছে একদমই নেগেটিভ দিকে , কারণ পড়ে গেলে , একেই কোমরে চোট , যদি আবার পাকায় ঘোট ... তখন ? কিন্তু , বান্ধবীর ইচ্ছা মতন , সে একখান দোলায় দুলে বা ঝুলে যখন পাশে হাঁটু মুড়ে বসা সমুদার ছবি আমাদের ফটোগ্রাফার তুলেই ফেলল , আমার কর্তার ইচ্ছাপূরণ করতে আমাকেও এক পথে হাঁটতেই হল , কর্তা মশাই এর হাত খাঁমচে ধরে , অনেক কসরত করে ঝুলে পড়লাম । বাপ্ রে !! সে এক খান ছবি বটে , মুখে ভয়ার্ত হাসি প্রকাশিত । যাক এসব মিটিয়ে হোম স্টের দিকে ফিরতে গিয়ে আর এক কাণ্ড !! বেলা যত গড়িয়েছে রোদ তত ভাজা ভাজা করেছে পথ ঘাট , এদিকে যাওয়ার সময় একজন বাদে কেউই চটি পরে যাইনি । ফেরার পথে এবার কুমির ডাঙার বদলে কিতকিত খেলা কাজে লাগালাম দুই বান্ধবী। তা দেখে একজন ছুটে এসে জুতো খুলে দিল , আমরাও ওমন হিংসুটে নই , ভাগ যোগ করে দুজন এক এক পাটি চপ্পল পায়ে গলিয়ে , এক পা বাঁচিয়ে,  দে ছুট্ । বাকি দুজনও আমাদের কোমল চরণে রোদ্দুর সয় না এ সব টিপ্পনী কাটতে কাটতে জোরে জোরে পা চালিয়ে ফিরল , কারণ চুপিচুপি বলি ওনাদের পদ যুগলেও তাপ এবার চাপ দিতে শুরু করেছিল ।

ফিরে এসে জলদি জলদি স্নানের পাঠ মিটিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেলাম , ওখানকার বাগানে চেয়ার টেবিল পেতে । গরম ভাত ,স্যালাড,  ডাল আর হাল্কা দেশী মুরগীর ঝোল । আহা !! খিদের মুখে যেন অমৃত।  এসব মিটতে মিটতে বিকেল হয়ে গেল , আর কিছু পরেই  আমরা ফেরার পথ ধরলাম । 

যথা সময় আমরা ফিরলাম,  ফিরে একটু পরেই গাড়িতে আমাদের নিয়ে সাগ্নিক কথা রাখতে চলল । নিয়ে গেল চেম্বুরে ওর পরিচিত এক তারকা খচিত রেস্টুরেন্টে । সেখানে খ্যাঁটন মিটিয়ে ফিরলাম বেশ রাত করেই । ফেরার পথে তখন সবারই মন ভার , কারণ আমাদের বেড়ুর সে দিনই  শেষ রজনী । পরের দিনের ফিরতি ট্রেন জ্ঞানেশ্বরী । 

এরপরের অধ্যায় একদমই সংক্ষিপ্ত , পরের দিন এক প্রস্থ বান্ধবীর সাথে তার মাসির বাড়ি ঘুরে , বিকেলে বান্ধবীর সারপ্রাইজ গিফ্ট সহ সারপ্রাইজ আগমনের পালা মিটিয়ে , সময় মতন সাগ্নিকের বাহনে চেপে ফেরার পথ ধরলাম । অনেক গুলো দিন বাইরে কাটিয়ে মন তখন নিজের নিকেতন পানেই ফিরতে চাইছিল । অতএব মন চলো নিজ নিকেতনে গাইতে গাইতে ট্রেনে উঠে পড়লাম ...  আবার পরের ঘোরার স্বপ্ন নিয়েই  ফিরে এলাম । 

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২১


ভোর রাতে মুম্বাই পৌঁছলাম আমরা । আগেই লিখেছি , যার ডেরায় আমাদের মুম্বাই এর দিন গুলো কাটাবো বলে স্থির  করা ,  সে হল আমার কর্তা মশাই এর  পাড়াতুত বন্ধু , সে আমার থেকে বছর দেড়েকের বড় মোটে । আমাদের কোর্টসিপ পর্বেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল । তখন থেকেই সে  আমারও বন্ধু । পাড়াতুত বন্ধুত্ব তো বয়স মেনে হয় না , কাজেই আমার কর্তার থেকে সে বছর তিনেক ছোটই । এখন যদিও দুজনের পাড়া  ভিন্ন কিন্তু বন্ধুত্ব অভিন্ন হৃদয়ের  । সাগ্নিকের তখন বিয়ে হয়নি , ও কর্মসূত্রে ওখানে থাকত কমলকে নিয়ে । সে একাধারে সাগ্নিকের বাজার সরকার,  রাঁধুনি , সবকিছু । ওদের পূর্ব পরিচিত , বিশ্বাসী কলকাতার ছেলে । কাকিমা , মানে সাগ্নিকের মা , তার ছেলেকে একা একা অচেনা শহরে পাঠাতে নারাজ , তাই এই ব্যবস্থাপনা । কমলের যেমন সুন্দর ব্যবহার,  তেমন  রান্নার হাত । সেদিন সপ্তাহের শুরুয়াত , কাজেই সাগ্নিকের সাথে আগের বলা কথা অনুযায়ী ঠিক হল যে , সারা সপ্তাহে ওর ব্যবস্হাপনায় আমরা সব ঘুরবো , দেখবো দুজনায় । রাতে ওর সাথে দেখা হবে ঘরে ফিরে , সপ্তাহান্তে এক সাথে সবাই খেতে যাব ওর পরিচিত কোন রেস্তোরাঁতে । অতএব মেঘনাদের ভূমিকায় সাগ্নিক অবতীর্ণ হল আর আমাদের বোম্বাই ওরফে মুম্বাই দর্শন শুরু হল সেদিন একটু পর থেকেই। 

মুম্বাইতে আমার ছোটবেলার দুই বান্ধবীর বসবাস , বৈবাহিক সূত্রে । তাদের সাথেও এই সুযোগে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেবার ভাবনা মনে রয়েছে । সেই মতনই প্রথম দিন সাগ্নিকের দেখানো পথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম,  অফিস যাওয়ার পথে ভাসি (Vashi )স্টেশনে আমাদের নামিয়ে , ও চলে গেল । ওখান থেকে ট্রেনে ভি.টি , ওখান থেকে সমুদ্র তট ,তারপর খানিক সমুদ্র বিহারে এলিফ্যান্টা কেভস্ দর্শন,  ফিরতি পথে এক বান্ধবীর সাথে মোলাকাত ... বেড়ু পুরো জমে ক্ষীর । কিন্তু .... পরন্তু বলেও একটা ব্যাপার আছে তো ;  সেদিন সবই হল বটে তবে ... "কিন্তু যুক্ত" হয়ে ভরপুর ভাবে। ভাসি থেকেই যে ট্রেন সরাসরা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস (ভি.টি ) যায় , তাতে ওঠার  সাগ্নিকের নির্দেশ না বুঝে একটা দূরের স্টেশন থেকে আগত ও ভরন্ত , ভাসি হয়ে যাওয়ার ট্রেনের দেখা পেতেই কিছুই ছানবিন না করে তাতে দুজন উঠে পড়ে , দেখি বসার কোনো জায়গা নেই।  ভালো ভিড় , তবে সে ভিড় সহ্য করার মতন । আমরা দুজন ভিড়ে আর ভিতরে ভিড়লাম না , দরজার কাছেই দাঁড়ালাম। পরবর্তী স্টেশন থেকে পুরো চলমান ভিড় যখন ট্রেনে এন্ট্রি নিল , আমরা ভয়ানক ভড়কে গেলাম। দুজন মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী দুপাশে ভিড় চাপে অনিবার !!! দুর্নিবার 😳 দুজন চাপের গুঁতোয় ওমন যুক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েও ঘেমে আকুল , পরের স্টেশন ছিল বিপরীত দিকে , সেখান থেকেও আরো ভিড় ট্রেনের অন্দরে প্রবিষ্ট হল আর আমার কর্তা কানে কানে বলল( একদমই কানাকানি করার মতন কাছেই ছিল সে ) ... " পরের স্টেশনে নেমে যেতেই হবে , এ ভাবে সকলের সাথে গা ঘষাঘষি করতে পারছি না ।" ভিড় আমাদের এমন পাবলিক প্লেসে ভয়ানক রকম কাছে নিয়ে এসেছে , ওই দিনের পর ওমন মুখোমুখি আর হলাম কই ?? কিন্তু ও ছিল একদমই চাপে পড়ে দম আটকে মুখিয়ে মুখোমুখি , ওতে করে রোমান্টিক হওয়ার উপায়ের থেকে আনরোমান্টিক বেদনা আর ভয় লাগছিল । কানে মন্তর দেওয়ার পর মাথা হেলিয়ে সমর্থন জানালেও (ওই ভিড়েও জনতা মুখরিত কিনা !!),  এবারের নতুন ভাবনা গজিয়ে উঠল , নামব কি করে ?? দুজন নামতে পারবো তো ?? এর মধ্যেই খানিকটা অংশের পথ, ট্রেন সমুদ্রের ওপর দিয়ে যায় নাকি !!! নাকি এ জন্যই বললাম কারণ জনসমুদ্র ছাড়া , দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়েও আর কিছুই চোখে পড়েনি , কর্তা মশাই পরে বলেছিলেন... " দেখোনি ?? সমুদ্র? " আর সমুদ্র !!! তখন বাহুবলীর বাহু আর শার্ট ছাড়া নজরে ধরা দিয়েছে জনতার মাথা !!!! পরের স্টেশন এল , টানাটানি , ধস্তাধস্তির যুদ্ধ শেষে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে আমরা নামতে সক্ষম হলাম।  অতদিন আগে হলেও পরিষ্কার মনে আছে সেই স্টশনের নাম আর উক্ত ঘটনা .... গোয়াণ্ডি(Govandi) । এবার ???? নেমে দুজন চাপহীন জড়াজড়ি মুক্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে ভেবলে দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে ধাতস্ত হয়ে প্রথমেই দুজনে বললাম...বাপ রে বাপ  ! আস্তে ধীরে স্টেশনের বাইরে এলাম , একে ওকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর না পেয়ে একটু এগিয়েই একটা বাস ডিপো নজরে এল , আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে তিনি এগিয়ে ওখান থেকে সদ্য ছাড়া বাসে উঠে পড়লেন । আমার সামনে এলে আমিও উঠে পড়ব ... কিন্তু একি ?? বাস যে না থেমে গতি বাড়িয়ে এগিয়েই চলেছে , বিপদে মাথা কেমন যেন শূন্য হয়ে যেতেই দেখি হিরো , বাস থেকে গালি বর্ষণ করতে করতে ঝাঁপ... মাটিতে । পাশেই দাঁতের দোকান খুলে কজন অটো চালক মজা দেখছিল । তাদের কাছে যেতেই তাদের দাঁতের বিকশিত চেহারা আপাতত ঢাকা পড়ল , জানা গেল একটা অঞ্চল পর্যন্ত অটো করে যাওয়া যেতে পারে , সেখান থেকে বাহন বদল করে ভি.টি , তারপর আরব সাগরের তীরে .... । এবার  দুজন শক্ত করে দুজনার  হাত চেপে  ধরে , অটোতে চেপে বসলাম। যথাস্থানে নেমে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত এক উত্তরপ্রদেশীয় ট্যাক্সিচালকের ট্যাক্সিতে গদিওমান হয়ে অবশেষে সাগর তীরে এলাম । এতক্ষণ পর সাগরের পারে এসে মন যেন একটু মুক্তি পেলো । একদিকে "গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া " , অপর দিকে বিখ্যাত হোটেল তাজ । তখনো সেখানে আতঙ্কবাদীর ছায়া পড়েনি । ও বছরের শেষ দিকে সে সব ঘটেছিল । আমরা গিয়েছিলাম বছরের প্রথম দিকে । 

আমরা চারদিকে অনেক পায়রা আর লোকজনের চলা ফেরা দেখতে দেখতে এগোলাম , সামনেই এলিফ্যান্টা যাওয়ার ফেরি চলাচলের  টিকিট কাউন্টার।  কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন টিকিট কাটতে , আমি আস্তে আস্তে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে লাগলাম,  আমাদের বঙ্গোপসাগরের মতন জোরালো ঢেউ নয় , তবে ভাল লাগছিল।  হঠাৎই সামনে থেকে আসা দুই অচেনা ব্যাক্তির একজন আচমকা আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে টান মারতেই , চীৎকারটা মাতৃভাষাতেই বেরল ... একি !! হচ্ছেটা কি ? কর্তা মশাই টিকিট  নিয়ে সেদিক পানেই আসছিলেন , আমার গলা শুনে এক ছুটে কাছে আসতেই ,  ছুটকারা মিলল !!! আর সে আপদ রঙীন হওয়ার এক্টো করল আর আমার জীবনের  নায়ক অপরিচিত জায়গায় হিরো গিরি স্থগিত রাখল , কলকাতা হলে .... । পরে সমুদ্র যাত্রা কালে আমার আতঙ্কিত অবস্থার উন্নতিকল্পে মননিবেশ করল সে , বলল ... ওমন গরু খেদানোর শান্তনিকেতনী ঢঙে দুষ্টু লোকের মোকাবিলা হয় না । অ-মাইক গলার প্রয়োগ করা জরুরী। কি বাজে কথা যে বলে না !! আর হেঁসোরাম হয়ে যাই আমি ... অগত্যা ।

এরপর জল যাত্রা শেষে , নামলাম ডাঙায় , সেখান থেকে আবার টিকিট , এবার , টয়ট্রেন ... সব অধ্যায় পেরিয়ে কেভস পৌঁছলাম ১৫০ সিঁড়ি বেয়ে , সিঁড়ির সংখ্যা আগের ( ঔরঙ্গাবাদ ও মহাবালেশ্বর) থেকে অনেক কম হলেও,  সকাল থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনার ঘনঘটায় কিনা জানি না , এখানে  সিঁড়ি আরোহনে বেশ কাহিল হয়েছিলাম দুজনেই। সব দেখার মাঝে মুম্বাই এর ওই কেভস্ নিবাসী এক বাঁদর একবার আমার কাছে ধেয়ে আসতে আত্মরক্ষার জন্য সাথের পেপসির বোতল ( যদিও প্রায় খালি ) দিতে হল ... চিতা ভী পিতা হ্যায় জানতাম sprite এর বিজ্ঞাপনের কল্যাণে ,সেদিন থেকে জানলাম বান্দর ভী পিতা হ্যাঁয় , but Pepsi । 

ওখানকার সব কিছু দেখার পর , দুপুরের খাবার খেয়ে আবার এক প্রস্থ টয়ট্রেন ও ফেরি যাত্রা করে আমরা মূল ভূখণ্ডে ফিরলাম।  তখন ঘোর দুপুর । মালাড নিবাসী প্রিয় বান্ধবীর সাথে দেখা করার কথা বিকেলে , কাজেই হাতে তখন  অনেকটা সময় , হারা উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরলাম , সময় কাটালাম পথে পথেই । এভাবেই নাকি যে কোন নতুন জায়গার গন্ধ নেতে ঽয় । গন্ধ কতটা ভিতরে পৌঁছল , জানা নেই  , তবে ৪টে নাগাদ বন্ধুর কর্তা মশাই কে কল করে , আমরা অটো করে চলে এলাম চার্চ গেট স্টেশনের সামনে । ওখানেই ওরা আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে।  তারপর একসাথে আমরা সন্ধ্যা কাটিয়ে ফিরে যাব নিজের নিজের ডেরায় । কিন্তু ওরা বেশ দেরিতে এল , অপেক্ষার শেষ হল । 

এবার চারমূর্তির অভিযান শুরু হল । আমাদের লক্ষ্য ছিল মেরিন ড্রাইভ , সেই মতোই এগিয়ে পড়ে সেখানে হাজির হলাম । সত্যিই খুব ভাল লাগছিল , এক পাশে বান্ধবী , অন্য পাশে প্রিয় বান্ধব ... । বেড়ানোর ব্যাপারটা সব সময়ই এতো ভাল যে জঙ্গলে গেলেও কখনও ভয়ঙ্কর লাগে না , কিন্তু এই শহরে , ঘরে যখন বান্ধবগড়ের আগমন ঘটে , তখন খুবই গোলমাল লাগে । গল্পে গল্পে জানলাম,  ওরা সেদিন বাড়ি ফিরবে না , আমাদের সাথেই নবী মুম্বাই ফিরবে , তবে রাত্রি যাপন করবে ওই খারগারেই আমার বান্ধবীর মেজমাসির বাড়িতে । বাড়ি ফিরবে পরের দিন । টুকটুক মুখ চালানোর মতন ড্রাই খাবার যা ছিল , তার সদ্ব্যবহার করা হল । সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে । মেরিন ড্রাইভ এর আলোয় দৃশ্যমান হল কুইনস নেকলেস । তবে ওপর থেকে দেখার অভিজ্ঞতা কখনও সামনে থেকে হয় না , তা বলিউডের সিনেমার দৌলতে হয়ে গেছে এই যা । তবে সে যাই হোক খুবই ভাল লাগছিল । একটা সময় আমরা এবং ওরা দুই দল হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা দুই বান্ধবী আর ওরা দুই কর্তা মশাই।  পরিচয় আগে একবার হলেও,  এবার ভাল করে হওয়ার সুযোগ ঘটছে । আসলে আমার বান্ধবীর বিয়ে ঠিক হবার পর পরই , (ওর শ্বশুরবাড়ি চূঁচূড়াতে ), আমি আমার জনা তিনেক আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলাম ও দিক পানে ,  তখন যোগাযোগ করে দেখাও করেছিলাম সমুদার সাথে । ফিরতি পথে আবার বন্ধুনীকে মতামত ( আমাদের দুজনার ) জানিয়েছিল ইতিবাচক দিকেই ।

যাক গল্পের শেষ নেই ,  কিন্তু এক সময় উঠতেই হল , ভি.টি থেকে ট্রেনে উঠতে হবে । সকালের বিভীষিকার ছবি মনের ক্যানভাসে ভেসে ভেসে উঠলেও একসময় ওরা দুই জন অভ্যস্থ কায়দায় আমাকে নিয়ে ট্রেনে সিধিয়ে গেল এবং সমুদা আমাদের দুই বন্ধুর বসার বন্দোবস্ত করেও দিল । আমার কর্তা মশাই শুরুতে না পেলেও পরে বসার জায়গা পেলো । সমুদা আগেই পেয়েছিল । গুছিয়ে বসে আমাকে বলল ... " এখানে ভিড়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে , আপনিই ট্রেনে উঠে যাবে , চেষ্টার দরকারও হবে না ।" শুনলাম,  বুঝলাম কিনা জানি না , কারণ ভিড় তো জল নয় , যে ভাসবো !!! কেমন করে ভাসবো ? আর সব চেয়ে মুশকিল কি জানো ?? জলে আমার বড় ভয় !! সাঁতার জানি না যে ??

যাক এসবের মধ্যেই এক সময় ভিড় ফাঁকা হল , রাত তখন ১১ টার আশপাশে । জানলার হাওয়ার প্রভাবে আমার বান্ধবীর চোখে তখন নিদ্রা দেবী আসব আসব করছেন । এক সময় গন্তব্যও এসে পড়ল ।আমাদের নামার  পর আবার চমক .... এর মধ্যেই কখন আমার কর্তা মশাই তার বন্ধুকে ফোন করে সবার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছে । আর কমল তো আছেই হাতা খুন্তি আর উপকরণ নিয়ে ।  একেই বলে ডবল মজা । মজার ওপর মজা । অতএব একসাথে সাগ্নিকের ডেরায় ফিরে আলাপ , বিলাপ ( আমাদের সকালের ঘটনা ) , গালি , তালি সব মিটিয়ে পেট পুরে বাঙালি খাবার খেয়ে , ওরা মাসির বাড়ি চলে গেল , এখানে পৌঁছে রাস্তার থেকেই আমার বান্ধবী তার মাসির বাড়ি চিহ্নিত করেছিল , একদমই পাশে । 

সেদিনের পর্ব মিটিয়ে , অনেক ধরনের অভিজ্ঞতায় ঝোলা ভরিয়ে আমরা ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম । আগের ভোর রাতে পৌঁছানোর পর থেকে অনেক ধরনের হুটোপুটির দরুণ দারুণ ঘুমে ডুব দিলাম । পরের দিনের আরো অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে হবে তো !! তাই না ??? 

@ শুচিস্মিতাভদ্র

Sunday, 10 April 2022

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ২০ 

অজন্তা , ইলোরার ঘোরার পাট চুকিয়ে , পরের ভোরে ঔরঙ্গাবাদ থেকে পুনে গামী বাসে রওনা দিলাম। তখন পুনা আর পুনে এই দুই নামের মাঝে ওই স্থান ঝুলছে বা দুলছে । পুরাতন নাম তল্পি গোটায়নি আর নতুন নামও শিকড় গাড়েনি । রওনা দিলাম ।  কাচ ফিক্সড করা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস , সাথে সিনেমা দেখার সুব্যবস্থা যুক্ত । কিন্তু ওই ব্যবস্থা আমার ক্ষেত্রে সু থাকল না , কু এ পর্যবসিত হল । সেই থেকেই জানলাম চলমান বাস বা গাড়িতে আমার এসব দেখা চলবে না । এখনও ট্রেন ছাড়া অন্যত্র ( যানবাহন) মোবাইল দর্শন মানা হ্যায় । যদি সিগন্যাল দেখে ফোনে মন দিয়ে ফেলি , তৎক্ষণাৎ লোকাল গার্জেন গর্জন করেন । আমিও সমঝে যাই । 

তো এক ভয়ানক সিনেমা চলছিল,  ওয়েলকাম । বাপ রে ওয়েলকামের ধরণেই কিনা জানি না , খানিক দেখেই শরীর গোলমাল ( ওই সিনেমা হজম  করা সহজ নয় ), ফলে চোখ বুজেই পুনে ওবধি কাটিয়ে দিলাম।

কিন্তু আমার কর্তা মশাই এর এক কথা জীবনের হাজারো ঝামেলা , তাই সাধ করে জীবন মুখী সিনেমার গভীর বিষয় কেন দেখব ??? তাই তার মন পসন্দ সিনেমা সে মন দিয়ে মজা নিয়েই  দেখা শেষ করল । এ দিকে পুনেও গুনে গুনে সময় মতন চলে এল । আমার গা গোলানো তখন অনেকটাই কমের দিকে । সম্ভবত বেলা ১১ টার একটু পরেই পুনেতে নামলাম।  লটবহর আমার জিম্মা করে তিনি গেলেন মহাবালেশ্বরের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে আর মুম্বাই নিবসী তার এক বন্ধুকে কল করতে ।কারণ মুম্বাই পৌঁছে নবী মুম্বাইতে তারই ডেরায় আমাদের ওখানকার  সাকিন নির্দিষ্ট, আগে থেকেই। সেদিন শনিবারের বারবেলা , আমাদের সাথে কথা বলেই সে বাজারের পথ ধরবে । আমরা যাবো কিনা !!!  আর গিয়ে কতো ঘুরবো ... তার জন্য ভাল করে বাঙালি খাবার খেয়ে দেয়ে নিজেদের শক্ত পোক্ত করতে হবে তো !!!  বাইরে এ কদিন বাঙালি খাবার তো মেলেনি , উল্টে ঔরঙ্গাবাদে হোটেলে অদ্ভুত স্বাদের একটা কেমন কেমন চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস খেয়েছিলাম । আসলে বাঙালি চাইনিজ খেয়ে অভ্যস্ত জিভ , মারাঠি চাইনিজ সহ্য কেন করবে , সেটা নয় উহ্যই থাক । 

গাড়ি ঠিক করা নিয়ে গোল বাঁধলেও,  শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ এর মতন গাড়ি আমাদের নিয়ে গতি বাড়িয়ে গড়গড়িয়ে মহাবালেশ্বরের পথে রওনা দিল । গাড়িতে উঠে খোলা জানলার নির্মল বাতাসে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । আগের বাস জার্নির সময় তেমন কিছুই খাওয়ার সুযোগ হয়নি , শরীর গোলমালের দরুন। বিস্কুট খেয়েছিলাম বোধহয় তেনার তাড়নায় । এবার খিদে খিদে ভাব জেগে উঠল , আমরাও ড্রাইভার দাদার recommendation এ এক জায়গায় পাত পেড়ে খেয়ে নিলাম।  আর খিদের মুখে কি বাঙালি কি মারাঠি সবই অমৃত । কাজে কাজেই খাবার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা তোলা থাকল তখনকার মতন । আবার চলতে চলতে... বরং বলা যায় ভাত ঘুম দিতে দিতে দুজনেই পাহাড়ি পথ ধরে ফেললাম। হ্যাঁ তো , মহাবালেশ্বর তো পাহাড়েই । আর পাহাড়ের প্রতি আমাদের দুজনেরই আকর্ষণ আর প্রেম ভয়ানক রকম বেশি । এক সময় ঘুম ভাঙার পর "ও সাথি চল তু...."  গানের কলি মনে আনা গোনা করতে লাগল ... এ পথেই তো এক সময়ের অসংখ্য বলিউডের তারকাদের নাচা গানার আদর্শ স্থান ছিল বলে শুনেছি । এক সময় পাহাড়ি পথের বাঁকে গন্তব্য দৃশ্যমান হল , আরো কিছু পথ পেরিয়ে একটা চার্চের পাশ কাটিয়ে M.T.D.C এর হোটেলে পৌঁছলাম।  তখন সন্ধ্যার আঁধার নামছে । এখানেও গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কটেজ আর ডাইনিং হল অন্য পাশে । পাশাপাশি আলাদা আলাদা ছোট্ট কটেজের একটাতে আমাদের স্হান হল । এখানেও আগাম মোমবাতি ধরিয়ে দিল হোটেলের রুম সার্ভিসের মধ্য বয়স্ক কর্মীটি । হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজে মন মেজাজ তখন বেজায় খুশ্ । মোমবাতি , খাবার জলের ব্যবস্থা  সব সম্পন্ন করে যাওয়ার আগে ওই কর্মী ঘরের সামনের লাগোয়া বারান্দায় কিছু না রাখার কথা বলে গেলেন । কিছু বলতে কাপড় জামা , জুতো ইত্যাদি । বাঙালি ঘরনী আর ধোপানীর খুব পার্থক্য নেই কো !!! আমি ট্রেনেও ছোটখাট তোয়ালে , গামছা শুকতে দিতে দেখেছি আর তা থেকে শিক্ষিত হয়েছি , এক দুবার .... । মোদ্দা কথা হল যে এখানেও বাঁদর । পরের দিন সক্কাল সক্কাল আমরা দুই মক্কেল নিজেদের বারান্দার চেয়ারে ফিট করে সকালের তাজা ভাবটা নিজেদের ভিতর ভর্তি করতে করতে এক খুদে বাঁদরের বাঁদরামি দেখছিলাম। মজাও লাগছিল। 

তো সেদিন সন্ধ্যার দিকে হাঁটি হাঁটি করে একটু আশে পাশের সাথে পরিচিত হতে গেলাম।  প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে আমি চনমনে আর সে মিনমিনে হয়ে গেল । কেন বলো তো ? ঠিক ধরেছ মার্কেট প্লেসে হাজির হয়েছিলাম  যে !!! কোন দিকের বিপদ কে জানে ? আমার পরিচিত মহলের জন্য টুকটুক কিছু কিনে থাকি প্রতিবারই  , সেই টোকেন খোঁজাখুঁজির ফাঁকে ফ্রুট জুস খাওয়া হল , স্ট্রবেরী জুস । ওদিককারই ফল , পরের দিন স্ট্রবেরী ফার্মেও গিয়েছিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর , পরের দিনের ঘুরপাক খাওয়ার গাড়ি ঠিক করতে ওখানকার অনেক ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে একটা অফিসে কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লাম। পর পর অনেক এজেন্সি থাকলে , অপরিচিত শহরে কে আর সঠিক পথের দিশা দেবে ? তবে টুরিস্ট স্পট গুলোতে সাধারণত এলোমেলো ঘটনা কম ঘটে । তিনি দস্তুর মতন সব যাচাই করতে শুরু করলেন । আমি এদিক ওদিক দেখে , ওখানকার এক স্লীপার কোচের ছবি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম।  পথে এমন বিজ্ঞাপিত ছবি আরো কটি এজেন্সির সামনে দেখলেও মরমে পশেনি , এবার আমার এক নতুন ইচ্ছে মনে ডানা মেলল .... আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী দুই রাত মহাবালেশ্বরে কাটিয়ে , তৃতীয় দিনের দিন ভোরে বা সকালে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে পাড়ি  দেবো ,আর সাগ্নিকের বাড়ি দুপুর দুপুর পৌঁছে যাব । কিন্তু ... কর্তা মশাই কে একটু অন্যরকম ভাবে বোঝাতে হবে , তো যে পথ সোজা সেটাই পাকড়াও করলাম...ভাড়া গাড়ি আর বাসের (তা সে হোক না শীততাপ নিয়ন্ত্রিত) ভাড়ার বিস্তর ফারাক । তবে ?? আর একটা রাত হোটেলের বদলে নয় , স্লীপার কোচেই কাটুক। ভোর ভোর বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে । চিড়ে ভিজল এক কথায় , পরের  দিন ও রাতের দু ধরনের বাহনের আগাম বুকিং করে , বুক ভরা খুশি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু মুশকিল কি জানো ? ও পক্ষও আমাকে হাঁড়ে হাঁড়ে চেনে 🤔। ফেরার পরে একগাল হেসে বললে ... " আমার টাকা save করলে , নাকি ওই বাসে চড়ার শখ চাগাড় দিয়েছে ?"  .... যাহ্ পুরো জল ঢেলে দিল । এই করে জানো তো ; যা ভাবি ঠিক ধরে ফেলে !! আর কি ; ধরা পড়ে , ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ইতি টেনে আমিও হেসেই দিলাম... কি আর করি !!! রাতে খেতে গিয়ে শুনি ওখানকার রান্না ঘরে একজন বাঙালি কুক আছে , বাঙালি টুরিস্টের কৌলিন্যই আলাদা , তাই সে কথা মাথায় রেখে পশ্চিম বাংলার রতন , পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে , ওখানকার রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে । তাকে ডাকা হলো , ফরমায়েশ মতন যখন খাবার  পরিবেশিত হল , বুঝলাম এ রতন আর সে রতন নেই । পরোটা ও মাংসের ঝোলের বদলে কুলচা আর এক চিড়বিড়ে ঝাল চিকেন খেয়ে তখন দুজনেই বুঝতেই পারছিলাম ... নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে ? কিন্তু গাওয়ার অবস্হায় ছিলাম না কেউই । আমার কর্তার গানের দৌড়োদৌড়ি মেঘের কোলে ওবধি । তবে গান শুনতে ভালবাসে আর কোন জমায়েতে গেলেই লজ্জিত মুখে বলে ফেলেন ...  জানো তো/ জানিস তো শিল্পী( আমি ) গান জানে । এবার তাদের শুনতে হয়ই , না চাইলেও 🤫 কারণ অনিচ্ছুক বুঝে যদি চেপে যাই , সে চেপে ধরবেই ... কই শুরু করো !!! বোঝো একবার ; আমি আগাপাসতলা বুঝেও এই শ্রোতার উৎসাহের স্রোত থামাতে অপারগ 🙄

তো যাইহোক পরের দিন জলদি সাজুগুজু করে জলদি বেরিয়ে পড়লাম। রোদে ভাজা হবার আগে আগেই ।যা যা দেখার দেখতে দেখতে চললাম। পাহাড়ের কয়েকটা কমন ভিউ পয়েন্ট দেখার সাথে সাথে , মন্দির ( পঞ্চগঙ্গা মন্দির  ) , লেক , বোটিং আর না না ধরনের মার্জিত রোমান্টিক ছবিও তোলা হলো ড্রাইভার দাদার সৌজন্যে । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে,  বসে , পদপ্রান্তে বসে ( আমি) ছবি তোলার পর , খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে স্ট্রবেরী ফার্ম দর্শন করে , ঐতিহাসিক প্রতাপগড় ফোর্টের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলাম। ফোর্টের চূড়ান্ত উঁচু স্হানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ঘোড়ায় বসা একখান চির পরিচিত মূর্তি দেখে , এবার ফেরার পথ ধরলাম। মন্দিরের একটা বিষয় মনে আছে , বেশ কয়েকটি নদীর জল সরাসরি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে দুটি পৃথক জলাধারে মিশেছে ।প্রতিটা নদীর নাম লেখা নল , যা পাথরের তৈরি গো-মুখের সাদৃশ্য যুক্ত , তা দিয়েই পঞ্চ নদীর জলের জলাধারে প্রবেশ । বেশ অভিনব লেগেছিল বিষয়টা । পাঁচটি নদী সম্ভবত কৃষ্ণা , কোয়েনা , ভেন্না , গায়েত্রী ও সাবিত্রী আর ধর্মীয় মতে ওই জল আমাদের গঙ্গা জলের মতনই পবিত্র বলে বিবেচ্য। ওদিকে তো গঙ্গা নেই । সম্ভবত দুই জলাধারের একটির জল পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয় আর অন্যটি মন্দিরের দর্শনার্থীদের হাত , পা ধোয়া জন্য ব্যবহৃত হয় ।

সব দেখা দেখির পর ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল , ফিরে বিশ্রাম,  নৈশ আহারের পরেই ইচ্ছাপূরণ ট্রিপ । সে বাস ছাড়ল রাত ৯ টার সময় । খানিক আগেই সেখানে পৌঁছে , মাল পত্তর বাসের পেটে ভরে বাসে উঠে পড়লাম।  উঠেই আমি মুগ্ধ !!! করিডোরের দুপাশে জোড়া বার্থ আপার আর লোয়ার । সমস্ত বার্থে দুখান বালিস , দুখান  ব্ল্যাঙ্কেট , আলোর ব্যবস্থা , চার্জ দেওয়ার পয়েন্ট আর  সবটাই হাল্কা ঘিয়ে রঙের পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী । আহা !! কি রোমান্টিক পরিবেশ । ভাগ্যিস ইচ্ছে জেগেছিল  ; নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে নিলাম মনে মনে । কিন্তু এ কি আমার এমন রোমান্টিক কর্তা মশাই এমন চিন্তিত কেন ? মুখে তার হাসি নাই দেখলাম । কি হলো ??? আমাদের রাজ্যের পাহাড়ি পথে রাতে গাড়ি চলাচলের বিধিনিষেধ ( কম চলে ) থাকলেও ওদিকের বন্দোবস্ত ভিন্ন আর তাতেই আমার চিন্তামণি চিন্তিত হয়েছেন , সে পরে বুঝেছিলাম। নাহ্ ওমন রোমান্টিক অ্যামবিয়েন্স মাঠে থুড়ি পাহাড়ি পথেই মারা পড়ল । আমি আবার মনের দুঃখ আর চিন্তা সইতে পারিনা , ঘুমিয়ে পড়ে মনকে রেহাই দিই , অগত্যা ঘুম দিলাম। তিনিও জাগন্ত হয়ে পাশে শুলেন , পরে যে ঘুমালেন তা বুঝলাম নামার আগের কন্ডাক্টারের জায়গার নামের অ্যানাউন্সমেন্টে !!! আসলে হয়েছিল কি ... আমাদের নামতে হবে নবী মুম্বাই এর খারগারে , সেই মত কথা ছিল কন্ডাক্টর আমাদের একটু আগে পানভেলে ঘুম থেকে তুলে দিলেই , কর্তা মশাই বন্ধুকে ফোন করে দেবে আর আমরা যথাস্থানে নামার পর , সে তার বাহন চালিয়ে এসে তার ডেরায় নিয়ে যাবে । কিন্তু .... পানভেলে আমরা সবাই ঘুমন্ত মায় কন্ডাক্টরও , ঘুম ভেঙে দু স্টপ পেরিয়ে খারগার আসতে দেখে সে হৈ চৈ রবে খারগারের  নাম ঘোষণা করল ... ধড়মড়িয়ে দুজন উঠে পড়ে নামার তাড়নায় , সে বাছাধনকে আর আগে না ডাকার জন্য বকুনি দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। খারগার বাসস্টপ পেরিয়ে গিয়ে একটু অন্ধকার রাস্তার ওপর রাত ৩টে ৩০ মিনেটে আমাদের লটবহর সহ নামিয়ে শূনশান পথে বাস হুস্ করে বেরিয়ে গেল । 

কর্তা মশাই চটপট রাস্তার আরো ধারে আমাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধুকে ফোন লাগাল , ওই অন্ধকার ভাল লাগছিল না , আলোর দিকে আসলেই বকুনি দিয়ে আঁধারে মশার জিম্মায় থাকতে বলছিল । বললাম... মশা তো তুলে নিয়ে যাবে এবার ?? রাগত উত্তর এলো ... "তুলুক , অন্য কেউ না তুললেই হলো ।" এবার আলো আঁধারির কার্যকারণ ধরতে পারলাম , কেঁপে উঠলাম... সত্যিই তো , এ তো ভাবিনি !! ওই সময়টা তো বিপদজনক  আর মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে দিয়ে চার চাকার ছোট বড় গাড়ি তো বেরিয়ে যাচ্ছে অনবরত । বয়স কম , সাথে জাঁদরেল সাথি , বেড়ানোর রোমাঞ্চকর আনন্দে বাস্তবকে ভুলে মেরে দিয়েছি যে , দিনকালের হালচাল তো ভাল নয় । ভয় ভয় করতে লাগল । এমন পরিস্থিতিতে সময় যেন কাটতেই চায় না । ওর বন্ধু দুই রিঙেই ফোন ধরে , নেমে গেছি শুনেই আর দেরি করেনি , ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে এল ... মনের ঝাল মেটানোর আগেই লটবহর আর আমাদের তুলে নিয়ে রওনা দিল ওর বাসস্থানের দিকে । প্রথমেই আমাদের বেআক্কেলে সময়ে আসার জন্য বেছে বেছে শব্দ প্রয়োগ শুরু হলো ...আর তারপরেই কটাক্ষ লটবহরের সংখ্যাধিক্যের জন্য,   কিন্তু তোমরাই বলো কন্ডাক্টর যদি আমাদের আগাম না ডাকে আমরাই বা কি করব ??? যাক ... চিন্তার কারণেই বাক্যবাণ,  যা ভালবাসার আরেক নাম ... সোহাগ করে যে , সে তো শাসন করতেই পারে , তাই না ??? 

এবার ভোরের অপেক্ষা আর মুম্বাই বেড়ু ....  

@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু  ১৯ 

 আমাদের বিয়ের বছর চারেক পর আমরা মুম্বাই গিয়েছিলাম।  যাওয়ার মাস চারেক আগে থেকেই চাপানউতোর চলছিল জায়গার বাছাই নিয়ে । মুম্বাই যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার মত ছিল অজন্তা , ইলোরা হয়ে মুম্বাই গমন । ওদিকের মতামত ছিল ভিন্ন ... খাজুরাহো হলে কথা ছিল অন্য,  বৌদ্ধ, জৈন আর হিন্দুদের গুহা স্থাপত্য দেখার কোন মানে নাকি নেই  !!! কিন্তু মুম্বাই ঘুরে গোয়া যাওয়ার মানে আমি বিনা চশমাতেও পষ্টাপষ্টি বুঝেছিলাম । মন ভার , মুখ ভার ... মন খারাপের দিস্তা নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে স্কুলের বান্ধবীর অজন্তার বর্ণনা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম ....  অতঃপর ভাগ্য সুপ্রশন্ন হল বলতে হবে ... কর্তা মশাই রাজি হলেন অবশেষে । আহা !! মোটেও গিন্নির মুখ চেয়ে ... এমন ভাবার কারণ নেইকো । ওই চাপানউতোর কালে বলা ভালো হেনকালে মুক্তি পেল সন্দীপ রায়ের পরিচালিত " কৈলাশে কেলেঙ্কারি " । আমরা দেবাদেবী দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়া প্রেক্ষাগৃহে দেখতে গেলাম ... দেখলাম...মন জয় করলো কিনা সিনেমার ইলোরার গুহা মন্দির !! ভাবা যায় ??  সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে , বাড়ি ফেরার  পথেই বলতে শুনলাম... " এবার অজন্তা ইলোরাটা ঘুরে আসি , কি বলো ? পরের বার গোয়া যাবক্ষণ ।" 😆 কিন্তু লকডাউন আর করোনার প্রবাহিত ঢেউ এ ওটা গয়া ভ্রমণে না শেষ হয় 😒 এই চিন্তায় চিন্তিত। যাক্ ওসব , তো যা বলছিলাম... মনের উচ্ছ্বাস মনে চেপে , মনে মনেই বললাম... তা আর বলতে ?? মত বদলালো , সেই মতো পথও বদল হলো । 

এক বাঁধা দূর করলেন সন্দীপ রায় , টিকিট কাটা ও অন্যান্য কাজ যখন একটু একটু এগিয়ে পড়েছে , আবারও বাঁধা । এবারের বাধা বাসা বাঁধল আমার কোমরে । দুঃখের কথা কাকে বলি ,বালতি তুলতে গিয়ে ফিক লেগে ব্যাথা একদম পিকে ( peak )। তাকে ঠিক করতে নানা দাওয়াই , সাথে বিশ্রাম চলতে থাকল । আরাম হারাম হ্যায় বলে যেই কাজে যোগ দিই ব্যারাম আবার কোমরের দখল নেয় । আমাদের মন খারাপ... সময় বেশি নেই,  মেরে কেটে বেরিয়ে পড়তে বাকি মাস দেড়েক । আমার মায়ের অনুরোধে গেলাম শেষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডেরায় ... কর্তা নিমরাজি , নিজে গেলেন না , বিশ্বাস নেই,  এদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কথা ফেলা সব দিকে থেকেই বিপদের !! এলোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথির বিবাদটা কিসের কে জানে ? তবে শেষরক্ষা করলেন হোমিওবাবুই । অনেকদিনের পরিচিত ডাক্তার একদমই রোমিও সুলভ যুবক নন ... সব শুনেই , যাওয়ার দিনক্ষণ জেনে বললেন .. চিন্তার কিছু নেই,  তুমি ঘুরতে যেতে পারবে । আর সত্যিই পারলাম আর দৌলতাবাগ ফোর্টের ৩৫০ সিঁড়ি আর প্রতামগড় ফোর্টের ৪০০ সিঁড়ি নিজে হেঁটেই উঠেছিলাম ... মোটেই কোলে কাঁখে চাপিনি । কর্তা মশাই  মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার জেঠুর মহিমা মেনে নিলেন তখনকার মতো , কলকাতার জল হাওয়াতে ফিরে আবার স্বমহিমায় ফিরে ওনাদের এলোপ্যাথির গুণ কীর্তন করে চলেছেন সেই ইস্তক। 

শেষমেষ দূগ্গা দূগ্গা করে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস করে রওনা দিলাম। স্লীপারের টিকিট ছিল ... বয়সের সাথে সাথে বায়নাক্কার দোহাই দিয়ে দুজনেই স্লীপার থেকে আপার মুখী হয়েছি ... দুজনেই সহমত তাই নেই চাপ । আর তখন না থাকলেও এখন আমারও সাথে পুপে নামক শিখণ্ডী আছে । সে কিছু বললে ( অবশ্যই বেড়ানোর সময় ) তার বাবা কেমন যেন নরম পাকের মাখা সন্দেশের মতন মোলায়েম হয়ে যায় । কিন্তুক !!! অন্য সময় কড়া পাকের হালুম হালুমে আমরা মা মেয়ে গেলুম হয়ে যাই বাড়িতে  । তবে সত্যিই বলছি ... বেড়ানোর সময় কর্তা মেয়ের কাছে নরম পাক আর আমার কাছে একদম উত্তমকুমার 😄 কি রোমান্টিক !!! বাপ রে !!! এই জন্যই তো কবে থেকে বেড়াতে যেতে চাইছি । 

ট্রেনে এক রাত কাটিয়ে তারপরের দুপুরে ভুসওয়ালে নামলাম,  এদিকের অনেকের বাণী শিরোধার্য করে ভুসওয়ালের বিখ্যাত কলা কেনার উপায় না থাকায় , আমরা ওখান থেকে সরাসরি ওমনি (মারুতি ভ্যান) ভাড়া করে  ফরদাপুর সরকারি হোটেলে হাজির হলাম।  হাইওয়ের পাশে  ছড়ানো ছিটানো বিশাল এলাকা জুড়ে হোটেল । এখানেও বেশ কিছু হনু সপরিবারে থাকে  ।  দূরে অজন্তার পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে , মনে একেবারে ফূর্তির বাণ ডাকল । তবে সন্ধ্যার দিকে বিজ্লি গন্ হওয়ার কিছু পরেই হোটেলের এক কর্মী এসে দুইখান মোমবাতি ধরিয়ে জেনারেটরের গোলযোগের তথ্য পরিবেশন করে গেল , অপরিচিত জায়গায় আলো আঁধারির মধ্যে দুজন ভুতের মতন বসে বসে হঠাৎই হৈ চৈ শুনে ঘাবড়ে গেলাম ... কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝলমলে আলোর ঝিলিকে সন্ত্রস্ত ভাব খানিক কেটে যেতেই ঘরের সামনের টানা বারান্দায় প্রথমে উকি , তারপর টুকি করতে করতে কর্তা মশাই গুটি গুটি এগিয়ে খবর সংগ্রহ করে ফিরে এল ... কৌতুহল নিবারণ হল , শুনলাম কোন সান্ত্রি বা মন্ত্রীর ছেলে ( এখন তিনি মন্ত্রী 🤫 ) গামলা গামলা আমলা সহ পায়ের ধুলো দিতে এসেছিলেন ...

এমারজেন্সির জন্য রাখা জেনারেটর চালু করতেই আলোয় ভুবন ভরা হলো । আর ওই আলো বন্ধ করলে বিপদ হতেও তো পারে , তাই আলো স্থায়ী হল , এক সময় বিজ্লিও হাজির হল। আমরা পরের দিনের ইতিহাস দেখার ভাবনায় মত্ত হয়ে ঘুম দিলাম নৈশ আহারের পরে পরেই ।

পরের দিন সকালেই খেয়ালে ধরা দিল , বাঙালি ছাড়া অন্য প্রদেশের এক দুইটি পরিবার হোটেলে থাকলেও বিদেশী বোর্ডারের  ভিড় অনেক বেশি , যাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যে এগিয়ে চীনা ও জাপানি বোর্ডার । আমাদের বাঁ পাশের ঘরেই ছিল ভারি মিষ্টি এক জাপানি যুবতী । অজন্তা কেভস্ দেখতে যাওয়ার পথে আলাপও হয়েছিল তার সাথে , পেশায় সে নার্স ( সেবিকা )। তা  শুনে যথারীতি আমার কর্তা ভারি খুশি হয়ে গিয়েছিল , পেশাগত নৈকট্যের কারণেই হয়তো । কি জানি 🤔 ? 

এরপর অটোর যাত্রার পর ব্যাটারি চালিত বাসে করে অজন্তার পাহাড়ের পাদদেশে অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই গাইড না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন , আমি পিছু নিলাম ... প্রথম গুহায় ঢুকেই সিদ্ধান্ত কেমন যেন ঝিমিয়ে গেল , আমি এসব ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে ওদিকের রকম দেখি ... সেই যে ঠোক্কর খেলো...আজ ওবধি ওই ঠেকে শেখা বিস্তর কাজে এসে চলেছে ঐতিহাসিক স্থান দেখতে গিয়ে । আসলে কি হয়েছিল জানো ? পাড়াতুত এক কাকু গাইডের জন্য খরচ যে বেকার এই মন্ত্র কানে দিয়েছিলেন আর আমার কর্তা মশাই বেড়াতে গিয়ে যথেচ্ছ খরচ করলেও , এমনিতে বুঝে খরচের মানুষ , যদিও আমার ক্ষেত্রে হাল পুরো না হলেও খানিক ছেড়ে দিয়েছে , তবে লাগাম এখনও ওদিকেই । কিছু বিশেষণ যুক্ত বাক্যবাণ শুনলেই বলে ... উঁহু ওমন বলতে নেই , বলো আমি মিতব্যায়ী । এই ওবধি ঠিক ছিল , পরে যোগ করে ... "না হলে হাতি পুষবো কি করে ?? " ... দেখলে তোমরা কেমন আমাকে হাতি বলে দিলো ?? তাও ভুল বাংলায় ?? হস্তিনী হবে তো !!! যাই বলুক ওর সাথে পথে বেরলে একটা মানানসই চেহারা না হলে কি ভালো দেখায় ? তোমরাই বলো !!! 

তো যা বলছিলাম, শেষ ওবধি  সব দেখাদেখি হলো গাইডের দেখানো পথেই,  ফিরে হোটেলে দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়ে অজন্তাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি করে আমরা চলে গেলাম ঔরঙ্গাবাদ।  সেখানকার সরকারী হোটেলে গিয়ে জানলাম,  আমাদের জন্য যে ঘর নির্ধারিত,  তাতে নাকি সন্দীপ রায় ছিলেন ..." কৈলাশে কেলেঙ্কারি " সিনেমার শুটিং এর সময় । সত্য মিথ্যার বিচার কে করবে জানি না , আমরা সত্য ধরে বিগলিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম । সন্ধ্যার সময় ওদিকের বিখ্যাত শাড়ির খোঁজে দুজন , দু রকম মেজাজ নিয়ে অটো ধরে প্রথমে দোকান,  পরে শাড়ির কারখানা ঘুরে , গায়ে শাড়ি ফেলে এদিক ওদিক দেখে একখান বগলদাবা করে ফিরলাম ... যদিও , যে শাড়ির খোঁজে গেলাম,  তাকে তখনও পাওয়া হল না । আপন করতে আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আমার এক মুম্বাই নিবাসী বান্ধবী নিয়ে এসেছিল তাকে । সেই তাক লাগানো অরিজিনাল পৈঠানির মূল্য অতদিন আগেও বেশ বেশি ছিল , আমার  বান্ধবী নিয়ে এসেছিল সেমি পৈঠানি । অরিজিনালের আঁচলের পাখির মোটিফে নাকি সোনার জরির কাজ একে অমূল্য করেছে । প্রধানত দুরকমের পাখি ... টিয়া ও ময়ূর । কোনটার মূল্য বেশি বুঝতেই পারছ !!! আমার ছোটদির ছেলে সব শুনে বলেছিল... " কাকের মোটিফ কিনলে ভাল করতে .. মেসোর পকেট ফ্রেন্ডলি হোতো !!!!" 😡👿 

      পরের দিন one day package এ গাইড সহ আমাদের বাস ছাড়ল হোটেলের অফিসের সামনে থেকেই।  কজন বাঙালি সহযাত্রী সহ বেরিয়ে পড়লাম।  গাইডের বলার ধরণ একটু নাটকীয় , তাতে ক্ষতি ছিল না , তবে গলার উত্থান,  পতন ছিল মারাত্মক !! পতনের দিকের বর্ণনা কিছুই কর্ণগোচর হয়নি সেবার । তো খানিক খানিক গোচরিভূত তথ্য নিয়েই একে একে দৌলতাবাগ ফোর্ট , ইলোরার গুহা মন্দির, পানি চক্কি , বিবি কা মকবরা , ঔরঙ্গজেবের সমাধি সব দেখা হল । এর মধ্যেই খাওয়ার বিরতি ছিল , ইলোরা দেখার মাঝে । ইলোরাতে ভাগাভাগি করে দুই দিকে

স্থাপত্য...একদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ গুহা , যেখানেই সেই বিখ্যাত কৈলাশ মন্দির,  যার জন্য আমার ইচ্ছাপূরণ হল , আর অন্য দিকে জৈন গুহা মন্দির। জৈন গুহা মন্দিরের সিঁড়ি দেখে আক্কেল গুড়ুম,  প্রায় ছোটবেলার style এ ( মনে নেই ছোটকালের কথা ) হামা দিয়ে হ্যাঁচোর প্যাচোড় করে উঠলাম শেষমেষ।  কর্তা ছিলেন পিছে , তাই টেনে তোলার উপায় নেই। এদিকে ইলোরাতে আরেক কাণ্ড ধরা পড়ল ... কর্তা মশাই এর সদ্য উপহার স্বরূপ পাওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা আর আগেকার আমার কোডাক k20 এই দুইখান নিয়েই বেড়ু বেড়ু করতে গিয়েছিলাম...  ভাগ্যিস !!! কর্তা মশাই এর  বিবেচনার কথা বলতেই হবে । ইলোরা চত্বরে নজরে এল এ যাবৎকালের সব ছবির কিছুই নতুন ক্যামেরা আর দেখাচ্ছে না । কি হবে ?? কত কায়দার ছবি তুলে দিয়েছিল কর্তা মশাই  !!! 🤔😥

নাহ্ সে সব গেলোই , ভাগ্যিস ভাগযোগ করে দুই যন্ত্রেই ধরে রেখেছিলাম ছবি .... । খুব মন ভার হয়েছিল। তাজমহলের আদলে তৈরি বিবি কা মকবরাতে এই  মিঞা বিবি পুরাতন পদ্ধতির সহায়তায় ছবিও তুলেছিলাম,  যা আজও অক্ষত। 

এই ঘোরাঘুরির মধ্যেও শাড়ির কারখানা পরিদর্শন ছিল । সেখানে বাসের সকল মহিলা হাসি মুখে আর কর্তারা বিরস বদনে হাজিরা দিলেন। মায়ের জন্য একখান শাড়ি কিনেছিলাম,  নিজেই । জামাইকে আর দুঃখের ভাগিদার করিনি । তাতেও মুখ ভার !!! বিয়ের পর থেকেই বুঝিয়ে আসছি ... তোমার টাকা আমার টাকা এবং আমার টাকা আমার টাকা !!! তা শুনলেও মানলে তবে না ? আচ্ছা তোমরাই বলো দেখি , বিয়ের মন্তর  কে বলে পুরোহিত মশাই এর সাথে ? আমরা তো বসে বসে ভাবি এরপর কি কি হবে ??? হতে চলেছে ???  তবে ?? ওখানে যদিদং .... ইত্যাদির ইতিবৃত্ত অনুযায়ী তোমার সবই আমার... সে যাই বলো না বলো .... । 

যাক সেদিন হা ক্লান্ত হয়ে ফিরে , খেয়ে দেয়ে ঘুম , পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে পুনে হয়ে আমরা রওনা দেবো পাহাড়ী গন্তব্য মহাবালেশ্বর । তার গল্প আবার হবে কেমন ??


@শুচিস্মিতাভদ্র

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ১৮ 

পরীক্ষার শেষ প্রহরের দেখা এবারও মিলল , হোক না সে অনলাইনের পরীক্ষা । আপাতত করোনা জন্য ট্রেন অথবা প্লেনের বুকিং আমাদের  শিকেয় তোলা , যদিও পরিষেবা চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে কপাল ঠুকে যাচ্ছেন বটে , তবে আমরা এখনও ও পথ ধরিনি। তবে আগামী দিনে যে ধরব না , এমনও বলিনি ।  just দেখছি, ভাবছি ....অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছি। গতবছর আমরা যখন ভালোয় ভালোয় ঘুরে  ঘরে ফিরলাম,  তারপর করোনা ডালপালা বিস্তার করল , সব যাতায়াত বন্ধ হলো । পরে আস্তে ধীরে আবার আমরা বন্দী দশার বাইরে এদিক ওদিক দেখে , সাবধান হয়ে কাজে কর্মে , মনের টানাপোড়েন কাটিয়ে মনের ডাকে ভয়ের থেকে ছুটি নিলাম... বেরিয়ে পড়লাম। 

এমন ধারার বেড়ুর মার নেই , এ যেমন ঠিক , আবার সাবধান হয়েও সব বিপদ যে এড়ানোর নয় , তাও ভুল নয়। এবারের আলাপ, বিলাপ  , জোগাড় সব শেষ করে আমাদের জয়যাত্রা শুরু হলো মন্দারমণির দিকে । মেয়ে তো শুরুতেই সুরুৎ করে অন্য গাড়িতে আর দুই খুদের সঙ্গী হোলো আর আমি ঝাড়া হাতপায়ে বাকিদের সঙ্গ দিলাম।  পুরোপুরি বিঘ্ন শূন্য যাত্রা যে হবে না , তা জানতামই । আরে বুঝলে না ?? চিরকালীন বাবা যে আমাদের সাথেই ছিল মেয়ের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে !!! 

আমরা জমজমাট গল্পের আসর বসিয়ে এগিয়ে পড়লাম,  পুপে দিদি আর তার খুদে সঙ্গী পথে খাওয়ার পালা শেষ করে , পথে কিছু দানও করল !! এবারও আমাদের সাথে সবার জন্যই ছিল হরেক রকম ঘরে তৈরি করা খাবার।  দলের চার গৃহিনীর রান্না ঘরে তৈরি দুধ চা, আলুর দম, রুটি , দু রকম কেক , মিষ্টান্ন ( এটা দোকানের বটে ) ও আমিষ আর নিরামিষ স্যাণ্ডউইচ। খাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি ও চলল গড়গড়িয়ে , আমরাও গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পথের শোভা ও রাজনৈতিক নানা দলের নানা ফুলের মেলা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। সামনেই যেমন বসন্তের দোল উৎসব , তেমনি আবার কাছেই ভোট উৎসব .... কাজে কাজেই সব ধরনের ফুলের মেলা দেখতে দেখতেই এক সময় পথের শেষে আমাদের মন্দারমণির বাসস্থানে পৌঁছলাম। 

এবারের এই বেড়ুর উত্তেজনা একটু উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল , কারণ নতুন দুই খুদে , যারা নাকি পুপে দিদি বলতে অজ্ঞান,  তারা সজ্ঞানে সাথে ছিল । কদিন আগে থেকেই বেড়ু সিদ্ধ জ্ঞানদা দিদির ভূমিকায় পুপে , তাদের বাণী বিতরণ করছিল । আর ওদের উত্তেজনা যে আমাদের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল  তা আর বলতে ?? আমাদের পোষাক , জুতো  , সাজন , গোজন দেখে দুষ্টু লোক কি কি বলতে পারে , সে সব আগাম আমরাই বলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আরে ভাই !!! মন্দারমণি কিসে কমতি ? শুধু পাটায়া হলেই সাজের বাহার হবে ???? 

পৌঁছে,  খানিক ধাতস্ত হয়ে , সকলে সমুদ্রের সাথে ধস্তাধস্তি করতে বেরিয়ে পড়লাম। বেলা তখন মন্দ হয়নি । তবে আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সকলের লটবহরে কড়া নজর রাখলাম। পরে শরতদার জিম্মায় সব রেখে অল্প জলে পা , হাঁটু ভিজিয়ে সবাই হোটেলে ফিরে ভোজন পর্বে ডুব দিলাম। সকলের পেটে তখন খাই খাই রব । সব রকমের খাবারে ভুরিভোজ হলো , যদিও শেষ পাতে কিছু কম পড়েছিল , কিন্তু  ততক্ষণে সব ফুরুৎ 🤫 । পরে অল্প বিরতি নেওয়া হল। যদিও খুদে বাহিনীর তাতে খুব সমর্থন ছিল না । কিন্তু আমার কন্যা আগের দিন রাত থেকেই যাওয়ার উত্তেজনায় প্রায় জাগন্তই ছিল .... কাজেই তাকে না শোয়ালেই নয়। কিন্তু ঘন্টা দেড়েক পরেই সে হ্যাচড় পাচড় করে উঠে মেতে উঠল ,অপর  দুই  খুদেকে নিয়ে । চায়ের সাথে ভালো রকমটা খেয়ে আমরা সকলে ঘর বন্ধ করে হোটেলের বীচ সংলগ্ন বাগানে জমজমাট আসর বসালাম। 

আকাশে আসন্ন পূর্ণিমার চাঁদ , সামনে সাগরের ঢেউ এর উথাল পাথালের মাঝে বেমানান শুধুই বাগানের হাল্কা বৈদ্যুতিক বাতির সারি । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁধন প্রয়োজন আছে বৈকি !!! এমন মন মাতানো পরিবেশ , প্রকৃতিতে গান আপনিই এসে যায় .... আমার কর্তা মশাই আর মৌ এর উৎসাহে গান চালু হলো , বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ হলাম শরতদার গানে , মৌয়ের কাছে আগেই জেনেছিলাম,  এবার শুনলাম, অপূর্ব। গান চলতে থাকল আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে। আমার কর্তা মশাই এর কিছু পেটেন্ট গান আছে ... যা এমনতর আসরে আমাকে পরিবেশন করতেই হয় , এবারও হোলো । রাতের খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে ঘরে এসে শুতেই গভীর ঘুমে সবাই ডুবে গেলাম...সারাদিনের ক্লান্তি , ধকল তখন দিনের শেষে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল । 

ঘুম ভেঙে উঠে পেলাম কুয়াশার চাদরে মোড়া সমুদ্র। বারান্দা থেকে মনে মনে শুনতে পেলাম ... সাগর ডাকে আয় , আয় .. যে কোন বেড়ানোর জায়গাতেই ভোরে ঘুম ছুটে যায় জলদি আর জায়গা বুঝে কোথাও কোথাও আমি একাকি ঘোরাঘুরি করি ,এ সময় তাজা বাতাস ফুসফুসে ভরে নিতে দারুন লাগে। তবে খুব বেশি ভোরে নয় অবশ্যই আর সর্বত্র নয়ও । বাবা ও মেয়ের তখনও ঘুমের ঘনঘটা জারি রয়েছে , কর্তা মশাইকে জানান দিয়ে ক্যামেরা আর মোবাইল নিয়ে সাগর দার ডাকে সাড়া দিলাম। এমন ডাকে সাড়া দিতে বয়ৈ গেছে কি বলা যায় ?? 

নিজের মনে কিছু বিরল মুহুর্তকে মন-বন্দী , ক্যামেরা -বন্দী করার পর হাঁটতে হাঁটতে  জলের ধারে চলে গেলাম , কতজন যে নিজের খেয়ালে হাঁটছেন, ঝিনুক কুড়াচ্ছেন...এরপর আস্তে ধীরে ঘরে ফিরলাম। পরের পর্ব খুব সংক্ষিপ্ত। চা আর জলখাবারের পাঠ মিটিয়ে আবার সাগরে সমর্পন । এ দিন দুই ছানাকে সামলে, জলের ধারেই বসেছিলাম নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে । তা কি কারো সহ্য হয় ?? সমুদ্রের ঢেউ যেখানে তার শক্তি হারিয়ে ম্রিয়মান হয়ে যায় , সেখানে থাকতেই আমার ভালো লাগে ।   ঢেউ এর সাথে পাগলামী করতে কি ওদের মানা করেছি ?? তা তো নয় , কিন্তু এক এক বার এক এক জন আয় আয় , আরেকটু আয় বলে কোন সুদূরে নিয়ে হাজির করল !!! কয়েকবার আমার কর্তা মশাই এর পিছনে লুকিয়ে পড়ে ঢেউ আটকেছি , কিন্তু জলে নামলে কি ওভাবে জলীয় বিপদ এড়ানো যায় ?? নুন জলও খেতে হলো , নাকের জলে , চোখের জলে অবস্থা । আমার ক্ষেত্রে রেকর্ড ব্রেকিং বুক সমান জল ...ভাবা যায় ?? এর মধ্যে দুই দম্পতি আবার জলের মধ্যেই কোলে পিঠে ও চড়ে ভাসতে শুরু করল , একজনের অবশ্যি কাঁধ জানান দিচ্ছে , এমন  কানাঘুসো শুনতে পেলাম  পরে !!! যদিও সে মানতে নারাজ । ওদিকে জলের মধ্যে একজন তার কর্তা কে ধরে , একটু রোমান্টিক হতে গেল তো সেই দাদা লজ্জিত হয়ে ... আমাকে ধরছো কেন ?? বলে পগার পারের মতন  সাগর পার হয়ে গেল প্রায় প্রায় । দাদার ঘরনীও ফোলা গাল আরো  ফুলিয়ে দূরে দূরেই সাঁতরে ফিরল । এদিকে আমাকে তোলা মুশকিল,  ওজন নেহাৎ ফেলনা নয় মোটেই। না হলে এমন রোমান্টিক সুযোগ হারাতে দিতাম নাকি ?? বয়স হয়েছে তো কি ?? দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি !!! তবে ??? 

বেলা শেষে ফিরে পরিষ্কার জলে স্নান পর্ব মিটিয়ে আবার হামলে পড়ে খাওয়া হলো । এবারে সবাই সাবধানী , আগাম বেশি করেই খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। খাওয়ার পর আমার কন্যা ছলোছলো চোখে নাটকীয় পরিবেশের অবতারণা করে ছোট্ট সাথি আদির সাথে রিমিদের ঘরে  ঘুমাতে গেল ।  পুরানো দিনের বাংলা ছায়াছবির কড়া মেজাজের বাবার বদলে মোলায়েম মেজাজ বজায় রেখে বেড়ানোর সঙ্গে তাল রাখার উপদেশ  দিয়ে এ দিকের বাবাকে ঠাণ্ডা করে ঘুমানোর উপদেশ দিলাম। সে ঘুমানোর আগে আমিই ঘুমিয়ে কাদা । ঘুম ভাঙল দরজার পেটাপেটিতে , খুলে দেখি জন মানিষ্যি নেই....এ কাদের কারবার  !!! বুঝতে কি আর বাকি থাকে ???

এই দিন ছিল সপ্তাহের শনিবার,  কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই খুদে বাহিনী হোটেলের বাগানে খেলতে গেল আর কজন গেল সমুদ্রের বীচ মুখী গার্ডেন চেয়ারের দখল নিতে ।কেন ??  সপ্তাহান্তের ভিড় তো এ চত্বর জুড়ে ছড়ানো । না হলে পরে আসর বসাবো কি করে ??? 

সেদিন ছিল মাঘী পূর্ণিমা। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ  মামাকে দেখে আকুল হয়ে সব ভাগ্নে ভাগ্নি নীচে নেমে এলাম। এসেই ছন্দ পতন !!! এক তো হোটেলের বাগানময় আলোর আলপনায় চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর দফা রফা তাতে আবার গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত চটুল হিন্দী গানের আলাপন !!!! মেজাজটা একটু পানসে হয়ে গেল , সেদিনে কি কি গাইব সেসব গানের লিস্টি সেই থেকে মনে নিয়েই ঘুরছি 🤫 । সুযোগ পেলেই গেয়ে শোনাবো কিন্তু । অগত্যা মনের ব্যাথা মনে রেখেই বীচে নামলাম... মন ভরে গেল , বুঝলাম কেন চাঁদ নিয়ে এত রচনা । সাগরকে কি অপূর্ব যে দেখাচ্ছিল চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মেখে , ব্যাখ্যার ভাষা নেই আমার ভাঁড়াড়ে । এক সময় ফিরলাম,  ফিরতেই হলো । সাথে ছিল সত্যদা আর মঞ্জুশ্রী , জল বাড়ছিল , বাড়ছিল তীব্রতা । ফিরে এসে জমাটি আড্ডা চালু হল চা ও টা সহযোগে , কিন্তু ঠাণ্ডা ‌হাওয়ার উৎপাতে আমরা মহিলা মহল আর একটু পরে এণ্ডী গেণ্ডী সহ ঘরে এসে  চিৎপাত হলাম  আর ওরা থাকল ওধারে ।ওদেরও একটু পিএনপিসির সুযোগ দেওয়ার দায়িত্ব তো আমাদেরই,  তাই না ?? রাতের খাওয়ার শেষে যে যার ঘরে উপুড় হলাম। রবিবার সকালেই আমাদের ঘরে ফেরার পালা ....মনে তখন মন খারাপের দিস্তা । তার মধ্যেও চা ,জলখাবারের পাঠ মিটিয়ে অঞ্জন,মৌ আর শরৎদা আরো একবার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে এল। ছোটদের ইচ্ছেকে আপাতত চাবি দিয়ে রাখা হল। তারপর সাগরের ডাকাডাকি উপেক্ষা করে , তাকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। এবারও পুপে দিদি অন্যত্র থাকল। যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি, শয়ন এসবের মাঝেই বাড়ি এসে পড়ল । অনেক অনেক আনন্দে ঝাঁপি বোঝাই করে , আগামী বেশ কিছুদিনের মনের খোরাক জমিয়ে নিত্য দিনের কাজে নিজেদের জুড়ে নিলাম।  ফেরার পর আমাদের খুদে সদস্য আদিবাবু ঘোষণা করেছে মহিলা মহলকে  বাদ দিয়ে বাবা, দাদা আর কাকুদের সাথে সে শিগগিরই সমুদ্রে বেড়ু যাবেই যাবে ।

" আজ তবে এই টুকু থাক .... 🥰🥰🥰🥰🥰

#শুচিস্মিতাভদ্র