খাদ্য বিভ্রাট
পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে , কেউ জানি না । রয়েছে ভয় , আতঙ্ক আর ক্ষীণ আশা আগের মতন জীবনে ফেরার। আশা ছাড়া থাকতে পারি না আমরা। আর অধিকাংশ বাঙালি যা পারে না তাই হলো খাওয়া দাওয়ায় বাঁধন দিতে । সেই কবে থেকেই বাঙালি কবি ঈশ্বরী পাটনী কে দিয়ে মা অন্নপূর্ণার কাছে বর আদায় করে নিয়েছিলেন ... আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
অধিকাংশ বাঙালি ভ্রমণ বিলাসী যেমন সত্য , তেমনই সত্যি অধিকাংশ বাঙালির খাদ্য প্রীতি। তো এ হেন পরিস্থিতি তে তারা যে সব ফেলে খাদ্য না পাওয়া নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হবে , এ আর এমন কি ??
আর সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত বাঙালি মুক্ত কচ্ছ হয়ে বাজারে সিধিয়েছে নির্ধারিত সময়ে । থলে, ব্যাগ , বস্তা যা হাতের কাছে মিলছে সব ই চলেগা। হাতে থলে , মুখে মুখবন্ধ আর চোখে আতঙ্ক নিয়ে বাঙালি বাজারে, দোকানে সর্বত্র মানে যা তার নাগালের মধ্যে।
এই পরিস্থিতি যে হতে পারে এমনটা সপ্তাহ দুয়েক আগে শুনেছি , গুরুত্ব দিই নি। তো কি ? আমি তো বাজার সরকার নই , তাই একটু একটু বেশি উপাদান মজুদ হতে শুরু করলো। একদিন রাগ করে বলেই ফেললাম যে , আগে অনেক বড়ো ফ্রিজ এর অর্ডার দেওয়া হোক । কিন্তু সে গুড়ে বালি !!! এখন যখন সত্যিই lockdown ঘোষণা হলো রসদ তখন অনেকটাই হজম হয়ে গেছে। আসলে নকলে মোদ্দা কথা হলো , খাদ্য মজুদ থাকা মানেই যে ঘুরছি ফিরছি খাচ্ছি ... করতে হবে এমন তো না , কিন্তু ভোজনরসিক গুনীজন তা শুনলে তবেই না ? রাতে মেনু ঠিক করা হচ্ছে পছন্দ অনুযায়ী... তবে আমি ওই সিলেবাস কেটে ছোট করছি। মানে করতে হচ্ছে-ই । আর দরকারি ও অদরকারী বিষয় যোগ বিয়োগে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি।
আমার কর্তা মশাই এর কর্ম জরুরি পরিসেবা ভিত্তিক, সে বেরচ্ছে , ফিরে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার প্রথম প্রশ্ন কুশল বিনিময় ব বর্তমানপরিস্থিতিবিষয়ক ... এমন ভাবার কোন কারণ নেই .... প্রশ্ন নিছকই খাদ্য বিষয়ক । গতকাল ভাত, ডাল ও মাছের সাথে দুরকম তরকারি করেছিলাম মনে আশা নিয়ে যে আজ ও খানিক সামলে যাবে .... কিন্তু নাহ্ !! সে সব হজম হয়ে গেছে বটে !!! আজকের মেনুতে যা যা আবদার বলো ফরমাস বলো , ছিলো তার মধ্যে পটলের ডালনা ছিল , কিন্তু আজ ফ্রিজ খুলে পটল তুলি নি , মানে বের করিনি , কারণ কিছু ছবি হওয়ার আগের স্টেজের ভেণ্ডি ছিল, ওদের দিকে না তাকালে ওরা ফ্রিজেই ফ্রিজ করে যেতো !!! আরো কয়েকজন ঝিমিয়ে পড়া প্রতিবেশী ফ্রিজ থেকে কড়াইতে যেতে অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কাকে যে কোথায় গুজেছি আর কোথায় খুঁজেছি এ এক লাখ টাকার প্রশ্ন। আসলে ঠাণ্ডা মেশিনের ভিতরে নজর দেওয়ার আগে একটা গাইড ম্যাপ তৈরি করা উচিত ছিল, কিন্তু তালেগোলে সেটাই আর করা হয়ে ওঠেনি।আর সমস্যা সেখানে-ই।
এদিকে এবারের বিপদ বিশ্বায়নের জোয়ারে সমগ্র বিশ্বে। ইংল্যান্ড নিবাসী আমার বান্ধবী শ্বেতা-ও মজুদ সব্জীর স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ছে। আমি -ও ওমন করে কিছু সব্জি কে ঝিমিয়ে পড়ার হাত থেকে টেনে তুলেছি ( কিছু কিছু সব্জি{সব নয় } কেটেকুটে জলে না ধুয়ে কৌটো বা পলিপ্যাক বন্দী , রান্নার সময় ওদের স্নান করালে ই চলবে ) । ব্যাঙ্গালোরের বান্ধবী পরশু দিন-ই চিন্তা ব্যাক্ত করল তার মাথার সাইজের ( এটা কৌশিকীর বর্ণনা, আমার ভেবো না মোটেই) দুই কপির বাসস্থান নিয়ে। আশা করি কৌশিকীর মাথায় , নিশ্চিত কোন বুদ্ধিতে সেই কপি যুগল বিদ্ধ হয়েছে । আর কৌশিকী -ও নতুন কোন সব্জি সংকটে সংকোটমোচন এর দ্বারস্থ হয়েছে।
আমার ভোজন বিলাসী যা যা বাজার , দোকান থেকে বগলদাবা করছে , বাড়ি ফিরেই আলোচনা হচ্ছে , তা দিয়ে সম্ভাব্য কি কি পদ হতে পারে আর আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই যে , সেই সব পদের রাধনে আমি কোনটা তে দৌপদী আর কোনটা তে মা- গঙ্গা তার বিবরণ। আলোচনা হচ্ছে কি ফোনে ? মোটেই না , হচ্ছে খাদ্য বেরসিক পুপের সাথে।
অতি ও অবশ্য প্রয়োজনীয় পদ মজুদ করার পর , এখন জোগাড় হচ্ছে দুধের ওপরের অতিরিক্ত মালাই(উপরি)।অর্থাৎ কিনা মা দিয়ে আহারে বাহার আসে। তবে মালাই এখন মিলছে না , দূরদর্শিতা দেখিয়ে আগেভাগেই ওসব অন্য কারোর ঘরে জমা পড়েছে। তো ভি আচ্ছা.... কে যেন বলেছেন... " একবার না পারিলে , দেখো শতবার"... তো এই বেদবাক্য শুনেই তো এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছি। তবে !!!!
সেদিন আমার ভাসুর , আমাদের মুশকিল আসান দাদা দুই পাউণ্ড পাউরুটি দিয়ে গেলেন। কোথায় রাখি, কোথায় তুলি এই করে বারান্দা য় রেখে রান্নার আঙিনা আলো করতে করতে ভুলে মেরে দিয়েছি..... কি সব্বোনাস !!! পরে দেখি মার্চ করে পিঁপড়ে চলছে পাউরুটি ফিস্টে যোগ দিতে .... তারপর !!! আর কি পাউরুটি দের পিঁপড়ে কূল থেকে উদ্ধার করে , পত্রপাট তাদের জায়গা মতো রেখে নিজে ও আজ সকালের "লুচি খাবো রবিবারে "... এই নাচন পাউরুটি দিয়ে চাপা দিয়েছি। তবে পুরোপুরি বাঁচি নি । ডিম পাউরুটি নাস্তি , টোস্ট শুধুমাত্র মাখন দিয়ে খেলে ওজন বেড়ে যাবে না ???? তো পাউরুটি টোস্ট সাথে মুরগির ঝোল । তো ওটা কিছু রেখে , কিছু ছেঁটে স্টু তে স্টিক্ করলাম। যাক্ বাবা , মেয়ে দুজনেই খুশ্। সাথে আমি -ও ।
তো রোজই আমার আতঙ্কিত খাদ্য চিন্তক কিছু না কিছু আনছে শুকনো , ভিজে । শুকনো এবার ঠাই নাই , ঠাই নাই করতে করতে আমাদের পুপেদিদিমণির আলমারি তে -ও সিধিয়েছে। জানি না কি হবে ?? আমার কথা হলো সামনের বিপদের কথা মাথায় রেখে খাওয়াতে একটু লাগাম দিতে হবেই। যা মজুদ করছি , তা যদি এখন ই শেষ করি , চলবে কি করে ?
ভালো ভালো রান্না করতে ভালো তো লাগেই, উপকরণ ও রয়েছে। আমার মামাতো দেওর কাল , বিরিয়ানি রেঁধে নিজেই বোল্ড আউট।কারণ তার কাছে ই শুনলাম খেতে মন্দ হয়নি but বিরিয়ানী র স্বাদটা-ই যা missing। পুপের বন্ধু র মা ফোন করেছিলো , শুনলাম ওদের রান্নাঘর সেদিন রসোগোল্লা আর পান্ত্তুয়ার আতুড়ঘর হয়েছিল। দারুন না ?
কারণ বেশি চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছে না, অন্তত আমি ওতো দৃঢ় মানসিকতার কোনোদিনই নই।
আমাদের বান্ধবী দের সাথে ও কথায় কথায় জানতে পারছি সবার বন্দীগীতিকা। একজনের খাদ্য রসিক কর্তা আর পুত্রের দফায় দফায় অর্ডারে সে বেচারি নাজেহাল। এদিকে গাদা গুচ্ছের বাজার করে তার বাম- মনোভাবাপন্ন কর্তামশাই অল্প রান্না করতে নির্দেশ ও দিচ্ছে.... কিন্তু নানা রকম ফরমায়েশি রান্নাতে বাম, ডান কোনো পন্থার ছোঁয়াচ নেই।
এদিকে সব রকম খাবার জোগাড়ে ব্যতিব্যাস্ত আমার কর্তা মশাই ঠাকুরঘরের রেশনিং-এ বেভুল হয়েছেন। পাড়ায় , বাজারে হানা দিয়ে-ও নকুলদানা জোগাড়ে ব্যার্থ হয়ে মনোকষ্টে ভুগছিলেন। এক দাদা বরাভয় দান করেছেন , দূরাভাষের মাধ্যমে ঠাকুরের মেনুর উপাদান, পরিমাণ শুনে নিয়ে , গড়িয়াহাট বাজার থেকে সংগ্রহ ও করেছেন। নিশ্চিন্তি !!! কর্তা মশাই যারপরনাই খুশি। খুশির প্রকাশ এখন বেশ প্রবল , আশা করি দাদা সামলে নেবেন। বিপদে ওমন হয়েই থাকে । কি !! তাই না ???
এখন এমন খাওনদাওন চালু থাকলে সত্যিই পরে , কেউ কি কাউকে চিনতে পারবো ?? আয়তন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে ? না , এতো ভাবতে পারছি না । কারণ সব আতঙ্ক আর ভয় ছাপিয়ে কি কি খাবার বানাবো অল্প করে , এই ভাবনায় আমি আপাতত ভাবিত। ভাবছি আর খাবি খাচ্ছিল !!!
** খাবার খাও রয়ে সয়ে , please । আমি -ও লাগাম টানছি অল্প করে , গল্প করে ... নিরূপায়। ঘরের সবার খাওয়া দাওয়া এখন আমার ওপরে-ই কিনা ..... !!!
No comments:
Post a Comment