বেড়াতে গিয়ে মজারু ( যুক্ত )
শুচিস্মিতা ভদ্র
বেড়ানোর ইতিবৃত্ত
বেড়ানোর একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে ... কতশত অচেনা মানুষ ক্ষণিকের জন্য চেনা হয়ে যায় ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে এই বিষয়ক ... "এই যে পথের এই দেখা , হয়তো পথেই শেষ হবে ..... তবুও হৃদয় মোর ভাবে সঞ্চয় কিছু যেন রবে .... ক্ষণিকের এই জানা শোনা ... স্মরণে করে যে আনাগোনা ..... " 🎶🎶🎶🎶.... এমনটা জীবনের পথ চলতে গিয়েও হয় আর তারই সংক্ষিপ্তকরণ হয় বেড়াতে গিয়ে। এই স্বল্প পরিচিত মানুষের কাছ থেকে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যে আমরা সমৃদ্ধ হই।
অপরিচিতকে পরিচিত করতে আমার কন্যার জুড়ি মেলা ভার। একবার জামসেদপুর বেড়িয়ে ফিরতি ট্রেনে উঠে, সিটে বসেই পুপের প্রথম প্রশ্ন ... "আচ্ছা মা , ওরা কারা ( আমাদের সামনের যাত্রীদের নির্দেশ করে ) ? চিনতে পারছি না তো !!!!".... বোঝো কাণ্ড !!! দুনিয়া শুদ্ধু সবাইকে যে চেনা যায় না , তা সে মানতে নারাজ। একে জীবন জুড়ে চেনা মানুষই হঠাৎ হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যায় কারণে, অকারণে ,সামান্য কারণে !!! তো এভাবেই যাত্রা পথে আলাপচারিতায় মনোনিবেশ করে আমার কন্যা। দিনকালের হালহকিকত বেশ ঘোরালো , তাই আমাকেও ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করে কন্যার পাহারাদারী করতে হয়।
বনে থাকে বাঘ
একবার আমরা নর্থবেঙ্গল গিয়েছি। ঘোরা ফেরার মধ্যে চা বাগানে হাজির হয়ে , অনেক ছবি তোলার পর ফেরার পথে গল্প জমে উঠেছে ড্রাইভার দাদার সাথে । তিনি তার নানা রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছেন । সেবারই জানলাম যে চা বাগানে অজগরের থাকার সম্ভাবনা প্রচুর আর থাকে চিতা বাঘ। বাপ্ রে .... কি সাঙ্ঘাতিক !! এমন তথ্য পরিবেশনের পর জানলাম যে এ তথ্য আমার কর্তা মশাই এর অজানা নয়কো ।এদিকে ছবি তোলার সময় তো ওখানেই ভয়ানক ভাবে সিধিয়ে গিয়ে ছবি তুলেছিলাম !!! সতর্ক করার কথা মনে ছিল না তো। নাকি তিনি ভেবেছিলেন তেনারা আমাকে পাত্তাই দেবে না ??? নাকি আমি ওনাদের থেকেও ভয়ানক !!!!
লাটাগুড়ির জঙ্গল সাফারিতে কিছুই দেখলাম না । কিন্তু গল্পের গরু থুড়ি চিতা বাঘকে গাছে উঠতে শুনলাম। তা হয়েছিল কি ... জিপ সাফারিতে পর পর জিপ ঢুকছে জঙ্গলের অন্দরে ... ময়ূর দেখে উৎফুল্ল হবো কিনা ভাবছি , কারণ আমার সহকর্মী সঞ্চিতাদি বলে দিয়েছিলো যে , জঙ্গল ভ্রমনে প্রথম ময়ূর দর্শন নাকি অপয়া , এমন সময় সামনের জিপের মানুষজনের চাঞ্চল্য নজরে এলো ... একটু অপেক্ষা করে শুনলাম একটু দূরে ঝোপে কিছু নড়তে দেখা যাচ্ছে .... কিন্তু তারপর আবার সব চুপচাপ। কিছুই দেখা হলো না... যাত্রা প্রসাদ watch tower এ আমাদের guide নিয়ে গেলই না। ওখানে গেলে কিছু না কিছু দেখতে পেতামই ... এমন guidance পেয়েছিলাম নীলাঞ্জনাদি আর সঞ্চিতাদির কাছে। ফিরতি পথে গরু মারা অভয়ারণ্য থেকে বেরিয়ে খান পাঁচেক গরু দেখতে দেখতে মন ভার করে গেস্ট হাউসে ফিরলাম।
সন্ধ্যায় বারান্দায় চা , পাকোড়া খেতে খেতে , ওখানকার রাঁধুনির কাছে শুনলাম চিতা বাঘের নাকি দেখা পাওয়া গিয়েছে সেদিন। বেশ আফসোস হোলো , তবে কি একটুর জন্য মোলাকাত হলো না ?? কিন্তু !!! সত্য দা আর আমার কর্তার জেরার মুখে গল্পের চিতা একেবারে চিতপাত হলো , ধরাশায়ী হলো আমাদের গেস্ট হাউসের দোতলার বারান্দায়.... ওই যে ঝোপ নড়েছিল .... সেই ঘটনাই গল্পাকারে ডানা মেলে উড়ে কোথায় যে উড়েছে .... কোথায় যে থেমেছে !! ভেবেই চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ঝোপ নড়ে চিতা শুধু দর্শনই দেন নি ... শিকার ধরে আবার তা টেনে নিয়েও গিয়েছে ..... উফ্ পু্রো বাংলা serial !!! আমাদের কপালে ময়ূর আর হরিণ ছাড়া দেখা মিলেছিল গরুর ... বুঝেছিলাম গরু মারা নাম খানিকটা হলেও সার্থক । না দেখেছি বাইসন , না গণ্ডার , না হাতি !!! আমাদেরই কপাল মন্দ ছিল সেবার।
বেড়ানোর বিড়ম্বনা
বেড়াতে গিয়ে পথ চলতি motion sickness এ এখন সিদ্ধহস্ত আমার কন্যা। ওকে সামলাতে গিয়ে আমার sickness ফিকে হতে হতে এখন সম্পূর্ণ সেরে গেছে। এখন এমন পরিস্থিতিতে আমি পুপেকে নিয়ে আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গাড়িতে পিছনে বসি , সামনে ড্রাইভারের সাথে খোস গল্পে যোগ দেয় আমার কর্তা।আর মেয়ের ওরকমের sickness দেখা দিলেই মনে হয় আমি আর আমার কন্যা ছাড়া , অন্য সহযাত্রী ... বিশেষ করে আমার কর্তা যেন অপরিচিত । গাড়ি এগিয়ে চলে থামতে থামতে , নামতে উঠতে সময় গড়িয়ে যায় ... । সব রকম টোটকার application চলে । সাধারণ নিয়মে কখনো সে থামে ... টোটকার হাতযশ এই ভাবনা নিমেষে নস্যাৎ হয়ে যায় । আবার চলা শুরু হয়। কিন্তু আমাদের দমাতে পারেনা। চলতে থাকি। হালে হোমিওপ্যাথির হাতযশে কোন কোন বার সমস্যার সমাধান ঘটছে , কোনো কোনো বার সে বেচারাও ফেল করে যাচ্ছে । মালুম হচ্ছে , আমার মতন সময় ও পরিস্থিতির আগমন না হওয়া ওবধি এ ধারা ফিকে না হয়ে টিকে যাবে ....
চেক লিস্ট
আমার বেড়ানোর গল্পের ঝুলি খুলে দেখতে গেলেই কাহিনীর বাহিনী ঝুলি থেকে বেরোনোর জন্য আকুলি বিকুলি করতে থাকে। তো আমিও তাদের পেশ করি তোমাদের দরবারে।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর , সবার অনুমতি নিয়েই আমাদের দেখা হয়েছিল বৃষ্টি মুখর রথের দিনে। সে অন্য গল্প। আমাদের সেই প্রথম সাক্ষাৎ এর হোতা ছিলেন আমার শ্বশুর মশাই। সেই দিনের আলাপচারিতায় জেনেছিলাম ওপক্ষের বেড়ানোর প্রতি ভালোবাসার কথা। পরে যখন বেড়াতে যাওয়ার স্থান নির্বাচন হলো ... জানলাম বিয়ের পর আমরা দার্জিলিং এ যাব । কিন্তু জগন্নাথ দেবের ইচ্ছা ছিল অন্য। নিয়ে গেলেন পুরী। আসলে রথের সাথে পুরীর যোগাযোগ যে বড়ই নিবিড় ।
তো বেড়ানোর অভিজ্ঞতা , তখন আমার বলতে গেলে negative । এমন সময় , প্রথম ঘুরতে যাওয়ার শুরুতেই দেখলাম , আমাদের দুজনের নামের heading দিয়ে , চটজলদি লিস্টি লেখা হলো। সে অনুযায়ী সব গোছানো ও হলো ... আমি ঘরের একদিকে চুপ করে বসে মুগ্ধতা আর কাটাতেই পারি না..... কিন্তু এ হল প্রথম প্রথম impressive session এর বাজার। এই বাজারে দুজনই দুজনকে উঠে পড়ে impressed করতে চায়। এখন অনেক বছর পেরিয়ে নানা কারণেই depressing session চলে সকলের মতোই। তবে প্রথম অধ্যায়ের মতোই সে ক্ষণিকের....ভাগ্যিস ।
এখনও লিস্টি লেখা হয় , জড়ো হয় সব ... কিন্তু গোছানোর দিন দেখা যায় , বিপরীত চিত্র একজন বড়ো বাজারের গদিওয়ালা মাড়োয়ারির মতো সব জড়ো জিনিসের মাঝে সেই লিস্টি হাতে গদিওমান হন আর তারপরে যা যা জড়ো হয়নি , সে সব আনার ফর্মান জারি হয় ... চলতে থাকে ইয়ে লাও , উয়ো লাও... আর আমি এক মুহুর্ত বসার সুযোগ না পেয়ে সেই সব জিনিস জড়ো করতে থাকি .... ছুটোছুটি কি এ বয়সে পোষায় ? হাঁপিয়েও যাই। কাজেই বুঝলে তো সেদিনের সঙ্গে মিল খুব একটা নেই। কিছু বললে , ওদিক থেকে উত্তর আসে ... " এতো দিনে কি কি শেখালাম, কি কি শিখলে তার পরীক্ষা দাও এবার " .... উফ্ সেই রামায়নের যুগ থেকেই একই রকম চলছে ... পরীক্ষা পরীক্ষা আর পরীক্ষা । কী অবস্থা ভাবো !! আমি যখন মুগ্ধ হচ্ছি, তখন উনি ভবিষ্যতের ভাবনায় আমায় training দিচ্ছিলেন !!!!
যাক্ সে কথা। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি almost ছোটখাটো একটা সংসার নিয়ে রওনা দিই। যা নিয়েও সঙ্গী সাথীদের মজাদার কথার আদান-প্রদান চলে ... কিন্তু পরে ওই নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জিনিসটা যখন প্রয়োজনের তালিকা ভুক্ত হয় , তখন .... । আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী একবার বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা করে দিতে বলেছিল ... দিলাম । কিন্তু সেই লম্বা লিস্টি দেখে তার কর্তা নাকি বেড়াতে যাবেই না বলে স্থির করেছে। বড়ো দুঃখ পেয়েছিলাম !! কিন্তু কি আর করা !!!
আগাম আগমন
একবার আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম , সাথে জিনিয়া ও আছে সপরিবারে। ফেরার পথে ঠিক হয়েছে , সিমুলবাড়ি চা বাগানে একটা রাত কাটিয়ে ফিরব। ওই চা বাগানের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রূপক , জিনিয়ার ভাই এর বন্ধু। সেবার আমরা মিরিক হয়ে নামছি , পাহাড় থেকে। কন্যার motion sickness পুরোদমে চালু রয়েছে। এক সময় পথ শেষ হলো। আমরা চা বাগানে রূপকদের কোয়ার্টারে পৌঁছলাম। চারিদিকে সবুজ চায়ের বাগান , মধ্যে কোয়ার্টার। দোতলায় ওরা থাকে। রূপক , ওর স্ত্রী আর কন্যা মিঠি। পুপের থেকে সামান্য বড়ো। ওখানে পাশেই চা processing factory । ওখানে শুনলাম মাঝে মাঝেই রাতে / ভোরে হাতি আসে। দূরে পাহাড়ের রেখা । আর চিতা বাঘও অতর্কিতে আসে , গহপালিত পশু শিকার করে নিয়ে যায়। আমাদের সেদিন রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে NJP থেকে ফেরার ট্রেন। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলাম যে , একরাতের বদলে আরো একটা দিন পেলে দারুন মজা হোতো। রাত ফুরিয়ে ভোর হলেই বেরিয়ে পরতে হবে। তা সত্ত্বেও অনেক গল্পই হোলো। বিকেলের জলখাবার , রাতের ভুরিভোজ খেয়ে ঘুম দিলাম। পথশ্রমের ক্লান্তিতে এক ঘুমেই রাত কেটে গেল। ভোরে উঠে সব গুছিয়ে নিয়ে NJP এর উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে পরলাম। রূপকের স্ত্রী ভোরে উঠে আমাদের জন্য খাবার বানিয়ে দিল। স্টেশনে পৌঁছলাম যথাসময়ে । ট্রেন ও এলো । উঠেই বিপত্তি। দেখি আমাদের সীট নাম্বারে অন্য যাত্রী বসে রয়েছে। আমাদের কাছে e - ticket রয়েছে। তারাও তাদের টিকিট দেখাচ্ছে। এবার বচসা ... তারপর প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় !!! সেবার টিকিট কেটেছিলেন আমার ভাসুর । ট্রেন তখনো স্টেশনে দাঁড়িয়ে .... আমি দুবার পরামর্শ দিতে গিয়ে , ধমক ধামক খেয়ে থেমেছি। এমন সময় আমার কথা একটু শোনার সুবুদ্ধি হলো , ফোনাফোনি হলো .... তারপর !!!! হঠাৎ শুনলাম আমাদের অন্য compartment এর টিকিট ... বোঝো !!! এখনি নামতে হবে .... এতোক্ষণ যাদের সাথে বাকবিতণ্ডা হচ্ছিল , তারাই ক্ষমা ঘেন্না করে আমাদের বাক্সপেটরা সব নামিয়ে দিলেন ... একজন ওর মধ্যেই বললেন -- " কি যে করেন ? দেখে উঠবেন তো ? এখনি ছাড়বে জলদি করুন " । কিন্তু .... তাদের মতো আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম আমার কর্তা মশাই এর হেলদোলহীন অবস্হান । আমি আকুল হয়ে বললাম ... " কি গো চলো তাড়াতাড়ি , ট্রেন যে ছেড়ে দিচ্ছে " । চাপা গলায় উত্তর এলো ... " চেপে যাও । আমাদের ট্রেন আজ নয় , কাল " । "এ্যা ? সেকি ?" সমস্বরে আমরা সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম। জিনিয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে বলল .. চলো আমরা ওই tea stall এর পিছনে লুকিয়ে পড়ি। সবাই দেখছে যে " । ট্রেন তখন আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওই কম্পার্টমেন্টের আপামর জনসাধারণ অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে, তারা গালি ,তালি দিতে ভুলেই গেছে !!!এতো অবাক বোধহয় তারা কোনদিন হয়নি। আমরা অগত্যা ওই stall এর পিছনে দাঁড়িয়ে বা লুকিয়ে যাই বলো ট্রেন যাওয়া ওবধি অপেক্ষা করলাম। আসলে আমাদের ট্রেন ছিল পরেরদিন। আমরা আগাম এসে গিয়েছিলাম। দেরির কারণে ট্রেন miss হয় সবাই শুনেছি। কিন্তু আগাম আসার জন্য ফেরা বাতিল হয় ... এমন শুনেছ কেউ ? শুনতেই পারো !!! তবে বেশি যে এমনটা শোনোনি নিশ্চিত। তারপর ?? আর কি সিমুলবাড়িতে আরো একদিনের আনন্দের হাট বসল । আরো একটা গোটা দিন , গোটা রাত কাটিয়ে পরের দিন নির্ধারিত সময়ে ট্রেনে উঠলাম।
বলো দেখি এখন , লাগলো কেমন ?
ভোজন সংবাদ
বেড়ানোর গল্পে , খাওয়ার অংশ বাদ দেওয়া উচিতই নয়। যেখানে আমরা দুই মক্কেলই ভোজন বিলাসী । খাদ্যের পরিমাণে হেরফের অবশ্যই আছে ,কিন্তু ভোজনরসিক দুজনই। কার intake বেশি আর কার কম .... তোমরাই বুঝে নিও কেমন ? ও সব বিতর্কিত বিষয়ে আমি বাবা নেই।তো কথা হলো গিয়ে , বেড়াতে বেরলে আমাদের দুজনেরই ক্ষিদে অনেক বেড়ে যায়। আর কি আশ্চর্য খাবার সব দিব্বি হজম হয়ে যায় !!!! অথচ এই আমারই নিজ শহরে থাকাকালীন হজম নিয়ে হাজারো সমস্যা !!! কারণটা যে কি তা ভগাই জানে ? নিজের রাজ্যে বেড়াতে গিয়ে মনোমতো খাবার নিয়ে সমস্যা নেইকো !!! কিন্তু ভিন রাজ্যে পছন্দের খাদ্য মেলা ভার !! তো আমিষের common কিছু পদ নিয়েই চলতে থাকে ক্ষুধা নিবারণ। মুম্বাইতে মাছ পাওয়া গেলেও , ঔরঙ্গাবাদ ও মহাবালেশ্বরে চিড়বিড়ে মশলাদার চিকেন ও বিরিয়ানি খেয়েছিলাম !!! চোখের জলে ,নাকের জলে ভেসে গিয়েছিলাম। আর চেন্নাইতে তো টক স্বাদের রান্না খেয়ে , কান্না আটকাতে পারিনি !!!
কয়েক বছর আগে , আমার অসুস্থতার কারণে আমাদের বারাণসী যাওয়া বাতিল হওয়ার পর , মাস তিনেক পরে গরমের সময় গেলাম উত্তরাখণ্ড। ওখানে গরমে পৈটিক গোলযোগের কারণে কিছু লোভনীয় পদ খাওয়ার সাহস করিনি মোটেই। কারণ ... ছোট থেকেই আমি পেট রোগা । স্কুল , কলেজের বন্ধুরা আমার টিফিনের বিখ্যাত চিড়ে সিদ্ধর সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত।সেই গোলোযোগ এখনো থাকলেও , এখন ওই ভয়কে অনেকটাই জয় করেছি... কর্তার অভয় দানে , কখনো বা ওষুধ দানে। খাবারও খাই , ওষুধও খাই... সমান উৎসাহে । একবার দীঘাতে হোটেল "মানসকন্যা" তে খেতে বসে ... সাবধানতা অবলম্বন জনিত কারণে আগাম ওষুধ খেতে দেখে আমার কর্তার বন্ধু পার্থ দা অবাক বিস্ময়ে বলেছিল ... "তুই medicine খেতেও সমান ভালোবাসিস দেখছি"। যা খানিকটা সত্যই বটে । কোন একটা গল্পে যেন পড়েছিলাম ,রোগ হওয়ার আগেই সারাও ... সম্ভবতঃ শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন সিরিজ। সে যাই হোক ... সে যাত্রায় গরমের গুঁতোয়় হরিদ্বারে রাবড়ি খাওয়ার সাহস করতে পারিনি। আর দুঃখের কথা কাকে বলি !!! ওখানে নিরামিষ খেয়ে মন ভার হয়ে গিয়েছিল। আমরা দুজন ভয়ানকভাবে আমিষের ভক্ত। মুসৌরি গিয়ে দুঃখ খানিকটা মিটবে ভেবেছিলাম... পুরো মেটেনি। ওখানে যে হোটেলে আমাদের বুকিং ছিল , সেই হোটেল বিষ্ণু প্যালেস ছিল নিরামিষ হোটেল। জানতে পেরে কি যে দুঃখ পেয়েছিলাম !!!! বলার নয়। অবশ্য আমরা ওখানে সব সময় খেতাম না .... আমিষ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়তাম । দিনে যাই হোক.... রাতে আমিষ চাই চাই।
একবার আমরা গিয়েছিলাম , হিমাচল প্রদেশ। সেখানেও একই দুঃখ। বেশিরভাগ হোটেলই নিরামিষ খাবারের। কিন্তু হিমাচলে আমাদের থাকার হোটেল ছিল আমিষ , কাজেই, সেখানে পৌঁছে সন্ধ্যা থেকেই আমিষ খেয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করতাম। দুষ্টু লোক জন সে সব গল্প শুনে , অনেক কিছুই বলেছে .... হিমাচলের বাজার থেকে ওই কদিন নাকি আমিষ পদের আকাল দেখার সম্ভাবনা হয়েছিল.... ওসবে আমরা কানও দিই নি। পাগলে কি না বলে !!!! তবে আমরা ছাগল নই কো। মোটেও সব কিছু আমরা খাই না । তো একদিন সকালে জলখাবারে আলুর পরোটা খেয়ে একটু গোলমেলে ব্যাপার হয়ে গেল। সে এক কাণ্ড বটে .... খেয়ে দেয়ে আমরা রওনা দিলাম ... চাম্বা হয়ে খাজিয়ার যাবো। অনেকটা পথ.... ৮০ কিলোমিটার। পথ চলা শুরু হওয়ার পর পৈটিক গোলযোগের হাল্কা আভাস পেলেও , ওতো গুরুত্ব না দিয়ে প্রাকৃতিক নৈসর্গের দিকে মন দিলাম। কিন্তু..... । একসময় পাহাড়ী পথের বাঁকে , একে একে দোকানপাট পিছনে রেখে আমাদের গাড়ি যখন দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে.... তখন শেষ আশ্রয়ের মতো একটা হোটেলের দেখা পেয়ে .... গাড়ি থামিয়ে নামতে বাধ্য হলাম। উপায় নেই। এমন পরিস্থিতিতে , মায়ের কাছে শুনেছি বাঘকেও ভয় লাগে না !!! লজ্জা , ঘেন্না , ভয় সব একদিকে , আর আমি অন্যদিকে। এখানেও .... "আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা" .... এমন ভাবেই একই সাথে হাত ধরাধরি করে অচেনা হোটেলে গেলাম বিপদমুক্ত হতে। সাদর অভ্যর্থনা ও পেলাম , সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ জন ... এগিয়ে এসে একটু আগে খালি হয়ে যাওয়া একটা রুম খুলে দিল। সব সময় আমার পাশে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ যে , সে বাইরে অপেক্ষায় রইল। আমার কন্যা গাড়িতে ওর মাসি ও মেসোর কাছেই ছিল। আবার যাত্রা শুরু হলো .... আমার জামাই বাবু স্মরনীয় এমন একখান্ ঘটনার কথা লেখার অনুরোধ জানালো , সেই সাথে একই অনুরোধ এলো তার ভাইরাভাই এর তরফে ..... অগত্যা। তোমাদের দুজনের কথা কি ফেলতে পারি বলো ????
খাওয়ার জন্যই তো সব কিছু তোমরাই বলো । যাই হোক না কেন ওকে বড়োই ভালোবাসি। এর কিছুদিন পর মাইথনে গিয়েও , সন্ধ্যায় কিছুই করার না থাকায় টুকটাক খেতে শুরু করলাম.... আমার কর্তা খেতে খেতেই বলল যে .... আমরা তিনজন যা খাচ্ছি !!! হোটেলের রান্না ঘরে হৈচৈ পড়ে গেছে !!! যা order দেওয়া হচ্ছে আসা ইস্তক । আমি সম্মতি জানানোর আগেই আমার একরত্তি কন্যা টিভি দেখা থামিয়ে বলে কি না ... তিনজন কৈ ? তোমরা তো দুজন !!! আমি খাচ্ছি কোথায় ? ..... কাণ্ডটা শুনলে একবার !!! টিভি দেখলেও কানটা এদিকেই ছিল তেনার । আর দুঃখের কথা কি জানো ? এমন খানেওয়ালা বাবা-মা এর এমন নিখাকী কন্যা কেমনে হয় বলো দেখি ? আমি তো বুঝি না।আশায় আছি ... নিশ্চয়ই পুপে পরে বড়ো হয়ে নিরাশ করবে না.... ।
No comments:
Post a Comment