ভ্রমণ যখন গল্প
শুচিস্মিতা ভদ্র
কথাটির আক্ষরিক অর্থ যে ঘুরতে যাওয়া / পর্যটন / বেড়াতে যাওয়া তা আমরা সকলেই কম , বেশি জানি । আরেক ধরনের ভ্রমণ হয় মনে মনে । কবি বলেছেন যে , কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে । খুবই সত্যিই। মনে মনে আমরা স্বদেশে , বিদেশে , কল্পলোকে যে কোন স্থানে ভ্রমণ করতে পারি । এ ধরণের ভ্রমণের সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচনা না করে , একটা কথা বলাই যায় এমন মানস ভ্রমণ তো বটেই, যে কোন বেড়ানোর খুঁটিনাটি তথ্য বোঝাই বই পড়তে ভ্রমণ পিপাসু মন সব সময়ই রাজি । মনের ভ্রমণকে বাস্তবায়িত করতে হলে এমন একজন সঙ্গীর দরকার সব সময়ই। এমন , সঙ্গী বলো , বন্ধু বলো আর কে বা আছে বই ছাড়া ? বর্তমানে অবশ্যই আছে আমাদের মুঠোফোন, যাতে নেট ঘেটে বেড়ানোর আদি অন্ত সবই আমাদের নখদর্পনে , তবুও বই এর, কোন বিকল্প হয় না । তাই আজও ভ্রমণ কাহিনী , ভ্রমণ পত্রিকা হারিয়ে যায়নি । নতুন নামে , নতুন মোড়কে ভ্রমণ সাহিত্য আজও চির নবীন।
মানস ভ্রমণের পিছনেও থাকে কোন না কোন রসদ , যেমন সত্যিকারের শোনা কোন বেড়ানোর গল্প, কোনও বইতে পড়া অথবা ছবিতে দেখা বেড়ানোর ইতিবৃত্ত , এ ছাড়া আছে দূরদর্শনের কোন চ্যানেল অথবা কোন না কোন ছায়াছবির দৃশ্যায়ন । ভ্রমণ সাহিত্যে শঙ্কু মহারাজ , নবনীতা দেবসেন , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেক খ্যাতিমান লেখক লেখিকা রয়েছেন আমাদের সমৃদ্ধ করতে ।
বই এর ক্ষেত্রে এমনই একটা বিখ্যাত বই হল " ভ্রমণ সঙ্গী " । আমাদের বাড়িতে বইটা আছে । আমার মা বেড়াতে খুব ভালবাসতেন । সময় , সুযোগ অনুকূল ছিল যখন , নিজের উদ্যোগে কিছু কিছু ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করেছেন । সেই সব গল্প আজীবন তাঁর মনেরমণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিল । যখনই সে সব কথা বলতেন , উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন । পরবর্তীকালে পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার কারণে ভ্রমণ যখন বন্ধ , একবার সম্ভবত বই মেলা থেকে নিয়ে এসেছিলেন "ভ্রমণ সঙ্গী" । মাঝে মাঝে পড়তেন আর মানস ভ্রমণে হয়তো বা সামিল হতেন ।
এশিয়া পাবলিশং কোম্পানির থেকে এই বিখ্যাত ভ্রমণ সংক্রান্ত বইটি প্রকাশিত হয় । আমাদের বাড়ির বইটি ছিল ১৯৮৬ সালের প্রকাশনা । মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে , ওই বই এর সব তথ্য কতদিনের জন্য গ্রহণযোগ্য থাকে ? এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমাকে বিচলিত করেছিল ... এই একটা জায়গায় বই একটু পিছিয়ে রয়েছে । মা বলেছিলেন যে কিছু কিছু তথ্য অপরিবর্তিত থাকলেও যাতায়াত, থাকা , খাওয়ার খরচ ... এমন কিছু ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে পারে , সেটা ধরে নিয়ে বেড়ানোর itenary তৈরি করতে হয় । জায়গার বর্ণনা , দর্শনীয় স্থান তো আর বদল হচ্ছে না !!! কারণ নতুন নতুন তথ্য বা অপডেটেড তথ্যের জন্য প্রতি বছরই বই এর পরবর্তী সংস্করণ কেনা তো সম্ভবপর নয় ; ভ্রমণ মূলক ম্যাগাজিন তাও এই সমস্যার সুরাহা করে কিছুটা হলেও, বেড়ানোর নানা জায়গার, নিত্য, নতুন তথ্য আমাদের কাছে পেশ করে থাকে ।
নেটের ক্ষেত্রেও এই সমস্যার সমাধান রয়েছে , সেই মাধ্যম নতুন নতুন আপডেটেড তথ্য আমাদের দরবারে হাজির করে লেখা , স্টিল ছবি , ছবির ভিডিও ইত্যাদি আরো আকর্ষণীয় পরিবেশনার দ্বারা ।
তবে তা সত্ত্বেও বই এর বিকল্প হয় না । কারণ নেট দুনিয়াও কখনও সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত নয় , সেখানকার পরিবেশনার আকর্ষণ বেশী হলেও সব তথ্য যে সঠিক নয় , সে খবরও আমরা পেয়ে থাকি , আছে নেটওয়ার্ক বা সংযোগ সংক্রান্ত অনেক গোলোযোগ। বই যেসব সমস্যার থেকে অনেকটাই মুক্ত।
আমাদের বাড়িতে আরেকটি ভ্রমণ সমগ্র আছে , সেটিও মায়ের সংগ্রহ। অমূল্য সেই সমগ্রটি এখন আর প্রকাশিতও হয় না । আমি এক সময় খোঁজ নিয়েছিলাম, তখনই জেনেছিলাম, এ ব্যাপারে । ২৪ (24) পর্ব বিশিষ্ট ভ্রমণ মূলক সমগ্রটি হল "রম্যাণি বীক্ষ্য "। লেখক শ্রী সুবোধ কুমার চক্রবর্তী । সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা ভ্রমণ সাহিত্য।
১৯১৮ সালের ১৫ই মার্চ, কোচবিহারের কাটামারি জমিদার পরিবারে শ্রী সুশীল চক্রবর্তীর ২য় পুত্র সন্তান সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর জন্ম হয় । রাজ্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন সুবোধ চক্রবর্তীর পিতা । তাঁদের পরিবারের সাথে কোচবিহার রাজপরিবারের সুসম্পর্ক ছিল । ওখানকার জেনকিন্স স্কুল থেকে পড়াশোনার পর ১৯৩৮ সালে ২০ বছরের যুবক সুবোধের বিয়ে হয়ে যায় । তারপর তিনি কলকাতায় আসেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে । উচ্চশিক্ষা শেষ করে এলাহাবাদে , পণ্ডিত নেহেরুর লিঁয়াজো অফিসারের ভুমিকা পালন করেন কিছুদিনের জন্য , এরপর যোগ দেন রেলওয়ে বোর্ডে । টুণ্ডলাতে ছিলেন বেশ কিছুদিন , এরপর পাকাপাকি ভাবে , ইস্টার্ন রেলওয়েতে কাজ নিয়ে চলে আসেন আসানসোল।
এখানেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্য চর্চা । আসানসোলের জি. টি . রোড ও ইয়েল রোডের সংযোগস্থলের বাংলোতে বনফুল সহ অনেক বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের আনাগোনা ছিল । রেলের কাজ নিয়ে ১৯৫৩-৫৪ সালে দক্ষিণ ভারত যেতে হয় তাঁকে । ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলেন , সম্পূর্ণ নতুন ধারায় । ১৯৫৪ সালে কলকাতার এক পত্রিকার "শনিবারের চিঠি " নামক বিভাগে ছেপে বেরনোর পর , অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় সেই লেখা । এরপর পাঠকের অনুরোধ রক্ষার্থে ধারাবাহিক ভাবে বেরতে শুরু হয় তাঁর রচিত দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা । ১৯৫৫ সালে "শনিবারের চিঠি" র সম্পাদক, শ্রী রজনীকান্ত দাশ মহাশয় , তাঁর নিজের প্রকাশনা - রঞ্জন পাবলিশার্স থেকে প্রথম পর্ব টি বই আকারে ছেপে বের করেন । প্রথম সংস্করণ হিসাবে ছাপা হয়েছিল ১১০০ কপি । এরপর ২য় সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ২২০০ কপি ... সব বিক্রি হয়ে যায় । পাঠক মুগ্ধ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা ভ্রমণ সাহিত্য পাঠ করে ।
দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা , বই আকারে ছেপে বেরনোর পর , লেখক তাঁর পরবর্তী কাহিনীর নাম ঠিক করেন , মহাকবি কালীদাসের " অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ " এর এক বিখ্যাত ও চিরস্মরনীয় শ্লোক থেকে । শ্লোকটি হল - " রম্যাণি বীক্ষ্যে মধুশ্চারং নিশম্য শব্দান " । কবিগুরু এই " রম্যাণি বীক্ষ্য " শব্দ বন্ধের অনুবাদ করেছিলেন ' সুন্দর নেহারি ' । অর্থাৎ নানা রম্যস্থান প্রত্যক্ষ করে মনে যে ভাব এল , তারই অভিব্যক্তি এই রচনা । সজনী কান্ত দাশের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত " রম্যাণি বীক্ষ্য " নামটি এক রেখে পর্ব গুলির নাম ভিন্ন করা হয় । যেমন - কালিন্দী পর্ব, অবন্তী পর্ব, মগধ পর্ব, কামরূপ পর্ব, উৎকল পর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি ।
প্রথম যখন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেন , লেখকের মনে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের রেশ ছিল , কারণ তথাকথিত ভ্রমণ বর্ণনার থেকে তার রচনা ছিল ভিন্ন ধরনের, কিন্তু পরবর্তীকালে পাঠক কুলের সবাত্মক গ্রহনে সব সংশয় কেটে যায় , তার জায়গায় দখল নেয়, আরো লেখার নতুন উৎসাহ। সেই মতো পরবর্তীকালে প্রতি বছর দুবার করে ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরতে যেতেন , ফিরে এসে অবলীলায় লিখে ফেলেছিলেন অবিস্মরনীয় আরো অনেক পর্ব।
চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখক সল্টলেকে বসবাস করতে শুরু করেন । সেই সময় মাঝে মধ্যে জন্মস্থান কোচবিহারে গেলেও বেশিদিন থাকতেন না । ১৯৯২ সালের ১৮ই জানুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন ।
সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর সব থেকে বড় সাফল্য ভিন্ন
ধারার ভ্রমণ সাহিত্যের প্রবর্ত্তক রূপে । ধণী মামা , অঘোর গোস্বামী তাঁর স্ত্রী ও অনূঢ়া কন্যা স্বাতিকে নিয়ে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের জন্য হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে এসেছেন। এই সময় প্ল্যাটফর্মে অপ্রত্যাশিত ভাবে পাতানো ভাগ্নে গোপালের সঙ্গে দেখা । গোপাল পেশায় কেরানীর কাজ করে , সে লোকাল ট্রেনের যাত্রী। মামা -মামী তাকে সঙ্গী হবার অনুরোধ জানালেন আর স্বাতির দৃষ্টিতে গোপাল আবিষ্কার করল এক আন্তরিক আবেদন । চলতি ট্রেনে সে উঠে পড়ল । এ ভাবেই শুরু হল গোপাল আর স্বাতির অভিযান । প্রতি পর্বে গোপাল ও স্বাতির সম্পর্কের রসায়ন অন্য মাত্রা দিয়েছে পর্ব গুলিকে । তাদের দুজনের চোখ দিয়ে এখানে পাঠকের ভারত দর্শন হয়েছে । লেখক কোথাও সেই অর্থে গাইডের কাজ করেননি । হোটেলের খরচা , তার নাম , দ্রষ্টব্য স্থানের প্রবেশ মূল্য নিয়েও রচনা দীর্ঘায়িত করেননি । গ্রন্থকার এই বইতে একদিকে যেমন ভারতের পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় দিয়েছেন, অন্যদিকে সমকালীন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আলোচনাও করেছেন । যে কোন জায়গার সর্বাঙ্গীন আলোচনার ফলে পাঠকের কাছে অতীত ও বর্তমানের ভারতের সামগ্রিক ছবি ফুটে উঠেছে । আর এখানেই এই বই অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীর থেকে স্বতন্ত্র। লেখকের আরো রচনা থাকা সত্ত্বেও তিনি " রম্যাণি বীক্ষ্য " গ্রন্থের লেখক হিসাবেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসীন হয়েছিলেন ।
লেখকের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে .... শাশ্বত ভারত , সৌর পুরাণ , মেঘ , আমাদের দেশ, কী মায়া , তুঙ্গভদ্রা , অন্য এক দেশ , সেই উজ্জ্বল মুহূর্ত, পুরাভারতি ইত্যাদি , ইত্যাদি । রচনা গুলি অধিকাংশই ভ্রমণ কেন্দ্রিক।
জন্ম শতবর্ষ অতিক্রান্ত সাহিত্যিক সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর জীবন ও সৃষ্টি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা , অচেনা । তাঁকে গভীর ভাবে পাঠ করলে বোঝা যায় কি ভাবে সংসারে থেকেও মানুষ হয়ে উঠতে পারে পথের সাথি ।
রম্যাণি বীক্ষ্য সমগ্র : -
অন্ধ্র পর্ব , তামিল পর্ব, কেরল পর্ব , কর্ণাট পর্ব , কালিন্দী পর্ব , রাজস্থান পর্ব , সৌরাষ্ট্র পর্ব , কোঙ্কণ পর্ব , অবন্তী পর্ব, উৎকল পর্ব , মগধ পর্ব, কোশল পর্ব, হিমাচল পর্ব , কাশ্মীর পর্ব , কামরূপ পর্ব , গৌড় পর্ব, ভাগিরথী পর্ব , হিমালয় পর্ব , মরুভারত পর্ব , প্রাচী পর্ব , কিষ্কিন্ধ্যা পর্ব , অরণ্য পর্ব , নেপাল পর্ব ও ভুটান পর্ব
No comments:
Post a Comment