বেড়ানোর কথা ভাবতে মানা নেই কোনো। অর্থাৎ কিনা মানস ভ্রমণ। এ বছরের গোড়ার দিকে কর্তামশাই অন্যের অপারেশন করার বদলে নিজের অপারেশন করালেন। শরীরে খান কতক গুড়ি গুড়ি পাথর যুক্ত হয়ে , বিস্তর সমস্যার সৃষ্টি করছিল। অতএব দাও তাদের বের করে !!! সে সব মিটতে , দুজনায় ঠিক করলাম , এ বছর এখন আর ঘুরতে যাওয়ার প্রশ্ন না তোলাই ভাল । অপারেশনের পরে বেড়ানোর রেশনে তখন টান। খানিক সামলে সুমলে একটু দূরের দিকে যাওয়ার কথা ঠিক হল পরের দিকে। যদিও তার রাফ ওয়ার্ক এখন বিশ বাও জলে । হেনকালে তেনার ছোটকালের পাড়াতুত বন্ধু বেড়ানোর পোকা কে টোকা দিয়ে জাগিয়ে দিল .... কিন্তুক মনস্থির করার পরেই সে বেড়ানোর গাছে তোলার মই সরিয়ে অফিসের টুরের গপ্পো শুনিয়ে হাওয়া হলেন !!!! এদিকের জন তো গাছে বসেই গর্জন করে ব্যক্ত করলেন যে , হাম জায়েঙ্গে জরুর। রেগে গেলে ইংরেজি অথবা হিন্দি বলার দস্তুর থাকলেও তিনি নির্যস বাংলাতে বলে দিলেন যে যাবোই যাবো। কেউ যাক না যাক !!!
দুঃখের কথা বলি কারে ??? কন্যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গীদের সাথে বেড়াতে কিঞ্চিত বোর ফিল করে কিনা কখনও খোলসা করে না বললেও "তিন জনে যাব শুধু !!!" বললে একখান দুখী রামের মতন মুখ করে থাকে , তাতে আমার মন দুঃখে থৈ থৈ হয়ে যায়। ভাবনাতে তা দিয়ে আমাদের নদী থেকে পাহাড়ের ভ্রমণের সঙ্গী দেবাশ্রিতাকে ফোন লাগালাম । এবারে সমুদ্র হবে কি হবে না এ সব ভাবতে ভাবতেই ওদিক থেকে সবুজ সংকেত মিলল তবে খান কতক দিন পরে যাওয়ার অনুরোধ এলো।
জায়গা নির্বাচন নিয়ে খানিক চাপানউতোরের পর ঠিক হল রূপনারায়ণ নদীর ধারের কোলাঘাট। যাওয়ার পথে দেউলটি নামক ফাউ যদি ঘুরে নিতে পারি , দারুণ হবে ব্যাপারখান। সবাই জানি যে দেউলটিতে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একখান বসতবাটি ছিল , যা এখন অবশ্যই এক দর্শনীয় স্থান। যাওয়ার আগে বেশ সপ্তাহ দুয়েক লম্বা সময়ের মধ্যেই দেবাশ্রিতা আকুলি বিকুলি করে সমুদ্র সৈকত যাওয়ার সুপ্ত বাসনা মনের গুপ্ত স্হান থেকে বের করতেই , যাওয়ার লিস্টি নদী থেকে সাগর মুখী হল। নদী বাদ পড়ল এমন ভাবার কারণ নেই কো। বলা ভাল নদীর সাথে সাগর যুক্ত হল। ভাই দেবাশ্রিতা .... রইল বাকি ঠাণ্ডা ও গরম দুরকমের মরুভূমি এবং অরণ্য । মনে ইচ্ছে বজায় রেখো । হয়ে যাবে কখনও কোন একদিন ।
অবশেষে এল সেই আকাঙ্খিত দিন। চাটিবাটি গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একখান মিটিং পয়েন্টে মীট করে স্থান অদল বদল করে আমরা চলমান হলাম। মেয়ে আর বাবার মন রাখতে , মনে ভার নিয়ে অন্য গাড়িতে দেবাশ্রিতার চারআনা র সাথে ভাব জমাতে লেগে পড়লাম। দুই বান্ধবী র ফুর্তি ধরে না আর !!! মা নামক "না " সাথে নেই ... এ কি কম কথা। ছোটকালে পিতাশ্রী ঘাড় পাততো না এক্কেরে !!! তখন মেয়ে আবার পথে বেরিয়েই পেটের সব হজম না হওয়া খাবার উগরে দিত !!! এখনও দেয় তবে রয়ে সয়ে , আগাম নোটিশ ধরিয়ে । সর্বোপরি বন্ধু বিহীন পথ চললে । এবার সে সব আপদ বালাই বলতে গেলে ছিলই না। কাজেই দুই গাড়ি চলল ।
আমাদের গাড়ির চালক অভিজিৎ দক্ষ চালক। সে হুস হয়ে গেল অচিরেই। এদিকের চালক দেবাশ্রিতা নভীস না হলেও নিত্য চালক নয় , সর্বোপরি তার কর্তামশাই এর ভয় সুলভ নির্দেশনা মেনে গাড়ি চালাতে চালাতে শুরু হল টক ঝাল মিষ্টি কথার পিঠে কথা !!! আমি পুরো হাসতে হাসতে পথ পেরতে লাগলাম। মধ্যে দেবাশ্রিতা জুনিয়র হিল্লোলের সাথে ভাব জমা শুরু হল !!!! পথে বাহন চালনা করার ভাগযোগ কর্তা-গিন্নি করেই বেরিয়েছে। উলুবেড়িয়া থেকে গিন্নি গাড়ির চালকের আসন দিয়ে দেবে তার কর্তামশাই কে। অদল বদল হতেই গিন্নিমা মোক্ষম শোধ তুলতে তুলতে এগিয়ে চললেন । পুরো কৌতুক মাখা চিত্র নাট্য শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল মজাসে !!! তবে ওদিকের গিন্নির পরিষ্কার কথা ... আগে তুমি খুঁত ধরেছ যখন , ফেরত না দিলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে । তা কি ঠিক ????
চলতে চলতে পথের ধারের ভাঁড়ের চা পান অবশ্য পালনীয়। সে সব মিটিয়ে চটপটা কিছু রেডিমেড খাবারের প্যাকেট আমাদের ঝোলায় ভরে দেউলটির দিকে চলতে লাগলাম। পথে বেরোলে বরাবর আমার ক্ষিদে ভয়াবহ আকার নেয়। বাড়ি থেকে যত ই পেট পূজো করে বাইরে যাই , পরবর্তী পূজোর টাইম চট জলদি পেটের দুয়ারে হাজির হয়ে পড়ে। চটপট চটপটা কে ঝোলার ভিতর ঘাঁটি গাড়তে না দিয়ে ঘেঁটি ধরে বের করে সকলে মিলে জুলে পেটে চালান করতে না করতেই হাইওয়ে থেকে এক অন্য পথে একটু ভিতরে ঢুকে কথাশিল্পীর বাড়ি এসে পড়তেই, দুয়ারে নেমে পড়লাম। গণগণে রোদ মাথায় করে ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম, দর্শন করতে হবে আধা ঘন্টার মধ্যেই। কারণ ১২টা র সময় বাইরে র মানুষের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যায় ।
ভিতরে এক অযাচিত বয়স্ক গাইড অদ্ভুত এক সুরেলা কিন্তু ওঠা পড়াবিহীন স্বরে বলে যেতে লাগলেন বাড়ির ঘর গুলির ইতিহাস সাথে সে বাড়ির মালিকের ইতিবৃত্ত। একতলা পেরিয়ে দোতলায় এসে ঘর লাগোয়া প্রশস্ত বারান্দা দেখে সকলে লাগাম ছাড়া হলাম। শহুরে ঘর বাড়ির এক চিলতে বারান্দায় যে কচি থেকে ধাড়ি কারোর মন ভরে না !!! তা সবার আচরণে প্রকট। শুধু মাত্র যে এমন ফূর্তি আমাদের মনে দেখা দিয়েছিল একদমই তা নয়। ওখানে আগত অন্যান্য দের দেখেও তা বুঝেছিলাম স্পষ্ট। ওপরের ঘর গুলোকে নিচের ঘরের মতনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালার গারদের ওপারে দেখলাম। এমন পরিবেশে দাঁড়িয়ে মন আবিষ্ট হয়। অদ্ভুত শিহরন খেলে যায় শরীরে। মন অবাক হয়ে ভাবে ; এই ঘরে , বারান্দায়, বাগানে কথাশিল্পী একদিন দিনযাপনের ইতিহাস লিখেছেন। বহু যুগের ওপার হতে যেন কল্পনা বিলাসী হলেও হওয়া যেতো। কিন্তু সময় সীমিত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাই রূপনারায়ণ নদীর দেখা পেলাম। শুনেছিলাম আগের বারে .... নদী , লেখকের আমলে বাড়ির কাছ দিয়ে বয়ে যেত। গতিপথ একটু একটু করে সরে গেছে খানিক দূরে। আগে যেবার এসেছিলাম পুপে তখন ১১ মাসের কুচো। যদিও কথাশিল্পীর সম্পর্কে তার তখনকার আর এখনকার জ্ঞানের পরিধি র পার্থক্য খুব সামান্য। ওই টুকখান পার্থক্য র জন্য দায়, দায়িত্ব, অবদান যাই বলো তা আমার নয়কো মোটেই। অবদান Hoichoi এর " পরিনীতা " নামক web series এর !!!!
সব দেখার পর ছবির পালা মিটিয়ে আমরা সকলে আরেক প্রস্থ ছবি তুলতে হাজির হলাম সামনের বাগানে। নানা রকম ফুলসহ বাগানের একপাশে আরো দুই জনার সাথে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেতপাথরের স্মৃতি বেদী দেখলাম। তার এক পাশে রয়েছে বাঁশ ঝাড়। বাঁশ গাছের আধিক্য দেখা র মতন। বড় বাঁশ ঝাড় ছাড়াও কিছু ছোট একত্রিত বাঁশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওদিকের কর্তা গিন্নি দেখি বিগলিত । একজন আরেকজনকে বললে .... এসো তো দেখি আমরা এখানেই ছবি তুলি ; একে অপরকে বাঁশ দিয়েই থাকি যখন !!! মনে মনে কি ওরা আরো জোরালো বাঁশের সন্ধান করেছিল ? নাকি বাঁশ ঝাড় নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছিল কে জানে ? তবে ভাব ভাব , আড়ি আড়ি হলে তবেই তো জীবন চটপটা তাই না ? তরঙ্গ একদম না থাকলে যে সব আলুনি !!!!
এরপর গাড়ি দিল পাড়ি অল্প খানিকটা দূরের রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে র সাজুগুজু করা হোটেল সোনার বাংলা তে । সে গল্প নিয়ে আসছি জলদি।
@শুচিস্মিতা ভদ্র
No comments:
Post a Comment