Sunday, 22 June 2025

মুম্বাই জমজমাট

  মুম্বাই জমজমাট 


 আমাদের বিয়ের বছর চারেক পর আমরা মুম্বাই গিয়েছিলাম। যাওয়ার মাস চারেক আগে থেকেই চাপানউতোর চলছিল জায়গার বাছাই নিয়ে । মুম্বাই যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার মত ছিল অজন্তা , ইলোরা হয়ে মুম্বাই গমন । ওদিকের মতামত ছিল ভিন্ন ... খাজুরাহো হলে কথা ছিল অন্য, বৌদ্ধ, জৈন আর হিন্দুদের গুহা স্থাপত্য দেখার কোন মানে নাকি নেই !!! কিন্তু মুম্বাই ঘুরে গোয়া যাওয়ার মানে আমি বিনা চশমাতেও পষ্টাপষ্টি বুঝেছিলাম । মন ভার , মুখ ভার ... মন খারাপের দিস্তা নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে স্কুলের বান্ধবীর অজন্তার বর্ণনা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম .... অতঃপর ভাগ্য সুপ্রশন্ন হল বলতে হবে ... কর্তা মশাই রাজি হলেন অবশেষে । আহা !! মোটেও গিন্নির মুখ চেয়ে ... এমন ভাবার কারণ নেইকো । ওই চাপানউতোর কালে বলা ভালো হেনকালে মুক্তি পেল সন্দীপ রায়ের পরিচালিত " কৈলাশে কেলেঙ্কারি " । আমরা দেবাদেবী দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়া প্রেক্ষাগৃহে দেখতে গেলাম ... দেখলাম...মন জয় করলো কিনা সিনেমার ইলোরার গুহা মন্দির !! ভাবা যায় ?? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে , বাড়ি ফেরার পথেই বলতে শুনলাম... " এবার অজন্তা ইলোরাটা ঘুরে আসি , কি বলো ? পরের বার গোয়া যাবক্ষণ ।".. মনের উচ্ছ্বাস মনে চেপে , মনে মনেই বললাম... তা আর বলতে ?? মত বদলালো , সেই মতো পথও বদল হলো । 


এক বাঁধা দূর করলেন সন্দীপ রায় , টিকিট কাটা ও অন্যান্য কাজ যখন একটু একটু এগিয়ে পড়েছে , আবারও বাঁধা । এবারের বাধা বাসা বাঁধল আমার কোমরে । দুঃখের কথা কাকে বলি ,বালতি তুলতে গিয়ে ফিক লেগে ব্যাথা একদম পিকে ( peak )। তাকে ঠিক করতে নানা দাওয়াই , সাথে বিশ্রাম চলতে থাকল । আরাম হারাম হ্যায় বলে যেই কাজে যোগ দিই ব্যারাম আবার কোমরের দখল নেয় । আমাদের মন খারাপ ... সময় বেশি নেই , মেরে কেটে বেরিয়ে পড়তে বাকি মাস দেড়েক । আমার মায়ের অনুরোধে গেলাম শেষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডেরায় ... কর্তা নিমরাজি , নিজে গেলেন না , বিশ্বাস নেই, এদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কথা ফেলা সব দিকে থেকেই বিপদের !! এলোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথির বিবাদটা কিসের কে জানে ? তবে শেষরক্ষা করলেন হোমিওবাবুই । অনেকদিনের পরিচিত ডাক্তার একদমই রোমিও সুলভ যুবক নন ... সব শুনেই , যাওয়ার দিনক্ষণ জেনে বললেন .. চিন্তার কিছু নেই, তুমি ঘুরতে যেতে পারবে । আর সত্যিই পারলাম আর দৌলতাবাগ ফোর্টের ৩৫০ সিঁড়ি আর প্রতাপগড় ফোর্টের ৪০০ সিঁড়ি নিজে হেঁটেই উঠেছিলাম ... মোটেই কোলে কাঁখে চাপিনি । কর্তা মশাই মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার জেঠুর মহিমা মেনে নিলেন তখনকার মতো , কলকাতার জল হাওয়াতে ফিরে আবার স্বমহিমায় ফিরে ওনাদের এলোপ্যাথির গুণ কীর্তন করে চলেছেন সেই ইস্তক। উনি এযালোপ্যাথ চিকিৎসক কিনা !!!


শেষমেষ দূগ্গা দূগ্গা করে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস করে রওনা দিলাম। স্লীপারের টিকিট ছিল ... বয়সের সাথে সাথে বায়নাক্কার দোহাই দিয়ে দুজনেই স্লীপার থেকে আপার মুখী হয়েছি ... দুজনেই সহমত তাই নেই চাপ । আর তখন না থাকলেও এখন আমারও সাথে পুপে ( আমাদের কন্যা ) নামক শিখণ্ডী আছে । সে কিছু বললে ( অবশ্যই বেড়ানোর সময় ) তার বাবা কেমন যেন নরম পাকের মাখা সন্দেশের মতন মোলায়েম হয়ে যায় । কিন্তুক !!! অন্য সময় কড়া পাকের হালুম হালুমে আমরা মা মেয়ে গেলুম হয়ে যাই বাড়িতে । তবে সত্যিই বলছি ... বেড়ানোর সময় কর্তা মেয়ের কাছে নরম পাক আর আমার কাছে একদম উত্তমকুমার 😄 কি রোমান্টিক !!! বাপ রে !!! এই জন্যই তো কবে থেকে বেড়াতে যেতে চাইছি । 


ট্রেনে এক রাত কাটিয়ে তারপরের দুপুরে ভুসওয়ালে নামলাম, এদিকের অনেকের বাণী শিরোধার্য করে ভুসওয়ালের বিখ্যাত কলা কেনার উপায় না থাকায় , আমরা ওখান থেকে সরাসরি ওমনি (মারুতি ভ্যান) ভাড়া করে ফরদাপুর সরকারি হোটেলে হাজির হলাম। হাইওয়ের পাশে ছড়ানো ছিটানো বিশাল এলাকা জুড়ে হোটেল । এখানেও বেশ কিছু হনু সপরিবারে থাকে । দূরে অজন্তার পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে , মনে একেবারে ফূর্তির বাণ ডাকল । তবে সন্ধ্যার দিকে বিজ্লি গন্ হওয়ার কিছু পরেই হোটেলের এক কর্মী এসে দুইখান মোমবাতি ধরিয়ে জেনারেটরের গোলযোগের তথ্য পরিবেশন করে গেল , অপরিচিত জায়গায় আলো আঁধারির মধ্যে দুজন ভুতের মতন বসে বসে হঠাৎই হৈ চৈ শুনে ঘাবড়ে গেলাম ... কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝলমলে আলোর ঝিলিকে সন্ত্রস্ত ভাব খানিক কেটে যেতেই ঘরের সামনের টানা বারান্দায় প্রথমে উকি , তারপর টুকি করতে করতে কর্তা মশাই গুটি গুটি এগিয়ে পড়লেন , খবর সংগ্রহ করে ফিরেও এলেন ... কৌতুহল নিবারণ হল , শুনলাম কোন সান্ত্রি বা মন্ত্রীর ছেলে ( এখন তিনি মন্ত্রী 🤫 ) গামলা গামলা আমলা সহ পায়ের ধুলো দিতে এসেছিলেন ...


এমারজেন্সির জন্য রাখা জেনারেটর চালু করতেই আলোয় ভুবন ভরা হলো । আর ওই আলো বন্ধ করলে বিপদ হতেও তো পারে , তাই আলো স্থায়ী হল , এক সময় বিজ্লিও হাজির হল। আমরা পরের দিনের ইতিহাস দেখার ভাবনায় মত্ত হয়ে ঘুম দিলাম নৈশ আহারের পরে পরেই ।


পরের দিন সকালেই খেয়ালে ধরা দিল , বাঙালি ছাড়া অন্য প্রদেশের এক দুইটি পরিবার হোটেলে থাকলেও বিদেশী বোর্ডারের ভিড় অনেক বেশি , যাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যে এগিয়ে চীনা ও জাপানি বোর্ডার । আমাদের বাঁ পাশের ঘরেই ছিল ভারি মিষ্টি এক জাপানি যুবতী । অজন্তা কেভস্ দেখতে যাওয়ার পথে আলাপও হয়েছিল তার সাথে , পেশায় সে নার্স ( সেবিকা )। তা শুনে যথারীতি আমার কর্তা ভারি খুশি হয়ে গিয়েছিল , পেশাগত নৈকট্যের কারণেই হয়তো । কি জানি 🤔 ? 


এরপর অটোর যাত্রার পর ব্যাটারি চালিত বাসে করে অজন্তার পাহাড়ের পাদদেশে অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই গাইড না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন , আমি পিছু নিলাম ... প্রথম গুহায় ঢুকেই সিদ্ধান্ত কেমন যেন ঝিমিয়ে গেল , আমি এসব ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে ওদিকের রকম দেখি ... সেই যে ঠোক্কর খেলো...আজ ওবধি ওই ঠেকে শেখা বিস্তর কাজে এসে চলেছে ঐতিহাসিক স্থান দেখতে গিয়ে । আসলে কি হয়েছিল জানো ? পাড়াতুত এক কাকু গাইডের জন্য খরচ যে বেকার এই মন্ত্র কানে দিয়েছিলেন আর আমার কর্তা মশাই বেড়াতে গিয়ে যথেচ্ছ খরচ করলেও , এমনিতে বুঝে খরচের মানুষ , যদিও আমার ক্ষেত্রে হাল পুরো না হলেও খানিক ছেড়ে দিয়েছে , তবে লাগাম এখনও ওদিকেই । কিছু বিশেষণ যুক্ত বাক্যবাণ শুনলেই বলে ... উঁহু ওমন বলতে নেই , বলো আমি মিতব্যায়ী । এই ওবধি ঠিক ছিল , পরে যোগ করে ... "না হলে হাতি পুষবো কি করে ?? " ... দেখলে তোমরা কেমন আমাকে হাতি বলে দিলো ?? তাও ভুল বাংলায় ?? হস্তিনী হবে তো !!! যাই বলুক ওর সাথে পথে বেরলে একটা মানানসই চেহারা না হলে কি ভালো দেখায় ? তোমরাই বলো !!! 


তো যা বলছিলাম, শেষ ওবধি সব দেখাদেখি হলো গাইডের দেখানো পথেই, ফিরে হোটেলে দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়ে অজন্তাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি করে আমরা চলে গেলাম ঔরঙ্গাবাদ। সেখানকার সরকারী হোটেলে গিয়ে জানলাম, আমাদের জন্য যে ঘর নির্ধারিত, তাতে নাকি সন্দীপ রায় ছিলেন ..." কৈলাশে কেলেঙ্কারি " সিনেমার শুটিং এর সময় । সত্য মিথ্যার বিচার কে করবে জানি না , আমরা সত্য ধরে বিগলিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম । সন্ধ্যার সময় ওদিকের বিখ্যাত শাড়ির খোঁজে দুজন , দু রকম মেজাজ নিয়ে অটো ধরে প্রথমে দোকান, পরে শাড়ির কারখানা ঘুরে , গায়ে শাড়ি ফেলে এদিক ওদিক দেখে একখান বগলদাবা করে ফিরলাম ... যদিও , যে শাড়ির খোঁজে গেলাম, তাকে তখনও পাওয়া হল না । আপন করতে আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আমার এক মুম্বাই নিবাসী বান্ধবী নিয়ে এসেছিল তাকে । সেই তাক লাগানো অরিজিনাল পৈঠানির মূল্য অতদিন আগেও বেশ বেশি ছিল , আমার বান্ধবী নিয়ে এসেছিল সেমি পৈঠানি । অরিজিনালের আঁচলের পাখির মোটিফে নাকি সোনার জরির কাজ একে অমূল্য করেছে । প্রধানত দুরকমের পাখি ... টিয়া ও ময়ূর । কোনটার মূল্য বেশি বুঝতেই পারছ !!! আমার ছোটদির ছেলে সব শুনে বলেছিল... " কাকের মোটিফ কিনলে ভাল করতে .. মেসোর পকেট ফ্রেন্ডলি হোতো !!!!" 😡👿 


      পরের দিন one day package এ গাইড সহ আমাদের বাস ছাড়ল হোটেলের অফিসের সামনে থেকেই। কজন বাঙালি সহযাত্রী সহ বেরিয়ে পড়লাম। গাইডের বলার ধরণ একটু নাটকীয় , তাতে ক্ষতি ছিল না , তবে গলার উত্থান, পতন ছিল মারাত্মক !! পতনের দিকের বর্ণনা কিছুই কর্ণগোচর হয়নি সেবার । তো খানিক খানিক গোচরিভূত তথ্য নিয়েই একে একে দৌলতাবাগ ফোর্ট , ইলোরার গুহা মন্দির, পানি চক্কি , বিবি কা মকবরা , ঔরঙ্গজেবের সমাধি সব দেখা হল । এর মধ্যেই খাওয়ার বিরতি ছিল , ইলোরা দেখার মাঝে । ইলোরাতে ভাগাভাগি করে দুই দিকে স্থাপত্য...একদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ গুহা , যেখানেই সেই বিখ্যাত কৈলাশ মন্দির, যার জন্য আমার ইচ্ছাপূরণ হল , আর অন্য দিকে জৈন গুহা মন্দির। জৈন গুহা মন্দিরের সিঁড়ি দেখে আক্কেল গুড়ুম, প্রায় ছোটবেলার style এ ( মনে নেই ছোটকালের কথা ) হামা দিয়ে হ্যাঁচোর প্যাচোড় করে উঠলাম শেষমেষ। কর্তা ছিলেন পিছে , তাই টেনে তোলার উপায় নেই। এদিকে ইলোরাতে আরেক কাণ্ড ধরা পড়ল ... কর্তা মশাই এর সদ্য উপহার স্বরূপ পাওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা আর আগেকার আমার কোডাক k20 এই দুইখান নিয়েই বেড়ু বেড়ু করতে গিয়েছিলাম... ভাগ্যিস !!! কর্তা মশাই এর বিবেচনার কথা বলতেই হবে । ইলোরা চত্বরে নজরে এল এ যাবৎকালের সব ছবির কিছুই নতুন ক্যামেরা আর দেখাচ্ছে না । কি হবে ?? কত কায়দার ছবি তুলে দিয়েছিল কর্তা মশাই !!! 🤔😥

নাহ্ সে সব গেলোই , ভাগ্যিস ভাগযোগ করে দুই যন্ত্রেই ধরে রেখেছিলাম ছবি .... । খুব মন ভার হয়েছিল। তাজমহলের আদলে তৈরি বিবি কা মকবরাতে এই মিঞা বিবি পুরাতন পদ্ধতির সহায়তায় ছবিও তুলেছিলাম, যা আজও অক্ষত। 

এই ঘোরাঘুরির মধ্যেও শাড়ির কারখানা পরিদর্শন ছিল । সেখানে বাসের সকল মহিলা হাসি মুখে আর কর্তারা বিরস বদনে হাজিরা দিলেন। মায়ের জন্য একখান শাড়ি কিনেছিলাম, নিজেই । জামাইকে আর দুঃখের ভাগিদার করিনি । তাতেও মুখ ভার !!! বিয়ের পর থেকেই বুঝিয়ে আসছি ... তোমার টাকা আমার টাকা এবং আমার টাকা আমার টাকা !!! তা শুনলেও মানলে তবে না ? আচ্ছা তোমরাই বলো দেখি , বিয়ের মন্তর কে বলে পুরোহিত মশাই এর সাথে ? আমরা তো বসে বসে ভাবি এরপর কি কি হবে ??? হতে চলেছে ??? তবে ?? ওখানে যদিদং .... ইত্যাদির ইতিবৃত্ত অনুযায়ী তোমার সবই আমার... সে যাই বলো না বলো .... । 

যাক সেদিন হা ক্লান্ত হয়ে ফিরে , খেয়ে দেয়ে ঘুম , পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে পুনে হয়ে আমরা রওনা দেবো পাহাড়ী গন্তব্য মহাবালেশ্বর । 

 অজন্তা , ইলোরার ঘোরার পাট চুকিয়ে , পরের ভোরে ঔরঙ্গাবাদ থেকে পুনে গামী বাসে রওনা দিলাম। তখন পুনা আর পুনে এই দুই নামের মাঝে ওই স্থান ঝুলছে বা দুলছে । পুরাতন নাম তল্পি গোটায়নি আর নতুন নামও শিকড় গাড়েনি । রওনা দিলাম । কাচ ফিক্সড করা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস , সাথে সিনেমা দেখার সুব্যবস্থা যুক্ত । কিন্তু ওই ব্যবস্থা আমার ক্ষেত্রে সু থাকল না , কু এ পর্যবসিত হল । সেই থেকেই জানলাম চলমান বাস বা গাড়িতে আমার এসব দেখা চলবে না । এখনও ট্রেন ছাড়া অন্যত্র ( যানবাহন) মোবাইল দর্শন মানা হ্যায় । যদি সিগন্যাল দেখে ফোনে মন দিয়ে ফেলি , তৎক্ষণাৎ লোকাল গার্জেন গর্জন করেন । আমিও সমঝে যাই । তো এক ভয়ানক সিনেমা চলছিল, ওয়েলকাম । বাপ রে ওয়েলকামের ধরণেই কিনা জানি না , খানিক দেখেই শরীর গোলমাল ( ওই সিনেমা হজম করা সহজ নয় ), ফলে চোখ বুজেই পুনে ওবধি কাটিয়ে দিলাম।

কিন্তু আমার কর্তা মশাই এর এক কথা জীবনের হাজারো ঝামেলা , তাই সাধ করে জীবন মুখী সিনেমার গভীর ও গম্ভীর বিষয় কেন দেখব ??? তাই তার মন পসন্দ সিনেমা সে মন দিয়ে মজা নিয়েই দেখা শেষ করল । এ দিকে পুনেও গুনে গুনে সময় মতন চলে এল । আমার গা গোলানো তখন অনেকটাই কমের দিকে । সম্ভবত বেলা ১১ টার একটু পরেই পুনেতে নামলাম। লটবহর আমার জিম্মা করে তিনি গেলেন মহাবালেশ্বরের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে আর মুম্বাই নিবসী তার এক বন্ধুকে কল করতে ।কারণ মুম্বাই পৌঁছে নবী মুম্বাইতে তারই ডেরায় আমাদের ওখানকার সাকিন নির্দিষ্ট, আগে থেকেই। সেদিন শনিবারের বারবেলা , আমাদের সাথে কথা বলেই সে বাজারের পথ ধরবে । আমরা যাবো কিনা !!! আর গিয়ে কতো ঘুরবো ... তার জন্য ভাল করে বাঙালি খাবার খেয়ে দেয়ে নিজেদের শক্ত পোক্ত করতে হবে তো !!! বাইরে এ কদিন বাঙালি খাবার তো মেলেনি , উল্টে ঔরঙ্গাবাদে হোটেলে অদ্ভুত স্বাদের একটা কেমন কেমন চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস খেয়েছিলাম । আসলে বাঙালি চাইনিজ খেয়ে অভ্যস্ত জিভ , মারাঠি চাইনিজ সহ্য কেন করবে , সেটা নয় উহ্যই থাক । 

গাড়ি ঠিক করা নিয়ে গোল বাঁধলেও, শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ এর মতন গাড়ি আমাদের নিয়ে গতি বাড়িয়ে গড়গড়িয়ে মহাবালেশ্বরের পথে রওনা দিল । গাড়িতে উঠে খোলা জানলার নির্মল বাতাসে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । আগের বাস জার্নির সময় তেমন কিছুই খাওয়ার সুযোগ হয়নি , শরীর গোলমালের দরুন। বিস্কুট খেয়েছিলাম বোধহয় তেনার তাড়নায় । এবার খিদে খিদে ভাব জেগে উঠল , আমরাও ড্রাইভার দাদার recommendation এ এক জায়গায় পাত পেড়ে খেয়ে নিলাম। আর খিদের মুখে কি বাঙালি কি মারাঠি সবই অমৃত । কাজে কাজেই খাবার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা তোলা থাকল তখনকার মতন । আবার চলতে চলতে... বরং বলা যায় ভাত ঘুম দিতে দিতে দুজনেই পাহাড়ি পথ ধরে ফেললাম। হ্যাঁ তো , মহাবালেশ্বর তো পাহাড়েই । আর পাহাড়ের প্রতি আমাদের দুজনেরই আকর্ষণ আর প্রেম ভয়ানক রকম বেশি । এক সময় ঘুম ভাঙার পর "ও সাথি চল তু...." গানের কলি মনে আনা গোনা করতে লাগল ... এ পথেই তো এক সময়ের অসংখ্য বলিউডের তারকাদের নাচা গানার আদর্শ স্থান ছিল বলে শুনেছি । এক সময় পাহাড়ি পথের বাঁকে গন্তব্য দৃশ্যমান হল , আরো কিছু পথ পেরিয়ে একটা চার্চের পাশ কাটিয়ে M.T.D.C এর হোটেলে পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যার আঁধার নামছে । এখানেও গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কটেজ আর ডাইনিং হল অন্য পাশে । পাশাপাশি আলাদা আলাদা ছোট্ট কটেজের একটাতে আমাদের স্হান হল । এখানেও আগাম মোমবাতি ধরিয়ে দিল হোটেলের রুম সার্ভিসের মধ্য বয়স্ক কর্মীটি । হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজে মন মেজাজ তখন বেজায় খুশ্ । মোমবাতি , খাবার জলের ব্যবস্থা সব সম্পন্ন করে যাওয়ার আগে ওই কর্মী ঘরের সামনের লাগোয়া বারান্দায় কিছু না রাখার কথা বলে গেলেন । কিছু বলতে কাপড় জামা , জুতো ইত্যাদি । বাঙালি ঘরনী আর ধোপানীর খুব পার্থক্য নেই কো !!! আমি ট্রেনেও ছোটখাট তোয়ালে , গামছা শুকতে দিতে দেখেছি আর তা থেকে শিক্ষিত হয়েছি , এক দুবার .... । মোদ্দা কথা হল যে এখানেও বাঁদর । পরের দিন সক্কাল সক্কাল আমরা দুই মক্কেল নিজেদের বারান্দার চেয়ারে ফিট করে সকালের তাজা ভাবটা নিজেদের ভিতর ভর্তি করতে করতে এক খুদে বাঁদরের বাঁদরামি দেখছিলাম। মজাও লাগছিল। 

তো সেদিন সন্ধ্যার দিকে হাঁটি হাঁটি করে একটু আশে পাশের সাথে পরিচিত হতে গেলাম। প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে আমি চনমনে আর সে মিনমিনে হয়ে গেল । কেন বলো তো ? ঠিক ধরেছ মার্কেট প্লেসে হাজির হয়েছিলাম যে !!! কোন দিকের বিপদ কে জানে ? আমার পরিচিত মহলের জন্য টুকটুক কিছু কিনে থাকি প্রতিবারই , সেই টোকেন খোঁজাখুঁজির ফাঁকে ফ্রুট জুস খাওয়া হল , স্ট্রবেরী জুস । ওদিককারই ফল , পরের দিন স্ট্রবেরী ফার্মেও গিয়েছিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর , পরের দিনের ঘুরপাক খাওয়ার গাড়ি ঠিক করতে ওখানকার অনেক ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে একটা অফিসে কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লাম। পর পর অনেক এজেন্সি থাকলে , অপরিচিত শহরে কে আর সঠিক পথের দিশা দেবে ? তবে টুরিস্ট স্পট গুলোতে সাধারণত এলোমেলো ঘটনা কম ঘটে । তিনি দস্তুর মতন সব যাচাই করতে শুরু করলেন । আমি এদিক ওদিক দেখে , ওখানকার এক স্লীপার কোচের ছবি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। পথে এমন বিজ্ঞাপিত ছবি আরো কটি এজেন্সির সামনে দেখলেও মরমে পশেনি , এবার আমার এক নতুন ইচ্ছে মনে ডানা মেলল .... আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী দুই রাত মহাবালেশ্বরে কাটিয়ে , তৃতীয় দিনের দিন ভোরে বা সকালে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবো ,আর সাগ্নিকের বাড়ি দুপুর দুপুর পৌঁছে যাব । কিন্তু ... কর্তা মশাই কে একটু অন্যরকম ভাবে বোঝাতে হবে , তো যে পথ সোজা সেটাই পাকড়াও করলাম...ভাড়া গাড়ি আর বাসের (তা সে হোক না শীততাপ নিয়ন্ত্রিত) ভাড়ার বিস্তর ফারাক । তবে ?? আর একটা রাত হোটেলের বদলে নয় , স্লীপার কোচেই কাটুক। ভোর ভোর বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে । চিড়ে ভিজল এক কথায় , পরের দিন ও রাতের দু ধরনের বাহনের আগাম বুকিং করে , বুক ভরা খুশি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু মুশকিল কি জানো ? ও পক্ষও আমাকে হাঁড়ে হাঁড়ে চেনে 🤔। ফেরার পরে একগাল হেসে বললে ... " আমার টাকা save করলে , নাকি ওই বাসে চড়ার শখ চাগাড় দিয়েছে ?" .... যাহ্ পুরো জল ঢেলে দিল । এই করে জানো তো ; যা ভাবি ঠিক ধরে ফেলে !! আর কি ; ধরা পড়ে , ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ইতি টেনে আমিও হেসেই দিলাম... কি আর করি !!! রাতে খেতে গিয়ে শুনি ওখানকার রান্না ঘরে একজন বাঙালি কুক আছে , বাঙালি টুরিস্টের কৌলিন্যই আলাদা , তাই সে কথা মাথায় রেখে পশ্চিম বাংলার রতন , পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে , ওখানকার রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে । তাকে ডাকা হলো , ফরমায়েশ মতন যখন খাবার পরিবেশিত হল , বুঝলাম এ রতন আর সে রতন নেই । পরোটা ও মাংসের ঝোলের বদলে কুলচা আর এক চিড়বিড়ে ঝাল চিকেন খেয়ে তখন দুজনেই বুঝতেই পারছিলাম ... নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে ? কিন্তু গাওয়ার অবস্হায় ছিলাম না কেউই । আমার কর্তার গানের দৌড়োদৌড়ি মেঘের কোলে ওবধি । তবে গান শুনতে ভালবাসে আর কোন জমায়েতে গেলেই লজ্জিত মুখে বলে ফেলেন ... জানো তো/ জানিস তো শিল্পী( আমি ) গান জানে । এবার তাদের শুনতে হয়ই , না চাইলেও 🤫 কারণ অনিচ্ছুক বুঝে যদি চেপে যাই , সে চেপে ধরবেই ... কই শুরু করো !!! বোঝো একবার ; আমি আগাপাসতলা বুঝেও এই শ্রোতার উৎসাহের স্রোত থামাতে অপারগ 🙄

তো যাইহোক পরের দিন জলদি সাজুগুজু করে বেরিয়ে পড়লাম। রোদে ভাজা হবার আগে আগেই ।যা যা দেখার দেখতে দেখতে চললাম। পাহাড়ের কয়েকটা কমন ভিউ পয়েন্ট দেখার সাথে সাথে , মন্দির ( পঞ্চগঙ্গা মন্দির ) , লেক , বোটিং আর না না ধরনের মার্জিত রোমান্টিক ছবিও তোলা হলো ড্রাইভার দাদার সৌজন্যে । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, বসে , পদপ্রান্তে বসে ( আমি) ছবি তোলার পর , খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে স্ট্রবেরী ফার্ম দর্শন করে , ঐতিহাসিক প্রতাপগড় ফোর্টের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলাম। ফোর্টের চূড়ান্ত উঁচু স্হানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ঘোড়ায় বসা একখান চির পরিচিত মূর্তি দেখে , এবার ফেরার পথ ধরলাম। মন্দিরের একটা বিষয় মনে আছে , বেশ কয়েকটি নদীর জল সরাসরি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে দুটি পৃথক জলাধারে মিশেছে ।প্রতিটা নদীর নাম লেখা নল , যা পাথরের তৈরি গো-মুখের সাদৃশ্য যুক্ত , তা দিয়েই পঞ্চ নদীর জলের জলাধারে প্রবেশ । বেশ অভিনব লেগেছিল বিষয়টা । পাঁচটি নদী সম্ভবত কৃষ্ণা , কোয়েনা , ভেন্না , গায়েত্রী ও সাবিত্রী আর ধর্মীয় মতে ওই জল আমাদের গঙ্গা জলের মতনই পবিত্র বলে বিবেচ্য। ওদিকে তো গঙ্গা নেই । সম্ভবত দুই জলাধারের একটির জল পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয় আর অন্যটি মন্দিরের দর্শনার্থীদের হাত , পা ধোয়া জন্য ব্যবহৃত হয় ।

সব দেখা দেখির পর ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল , ফিরে বিশ্রাম, নৈশ আহারের পরেই ইচ্ছাপূরণ ট্রিপ । সে বাস ছাড়ল রাত ৯ টার সময় । খানিক আগেই সেখানে পৌঁছে , মাল পত্তর বাসের পেটে ভরে বাসে উঠে পড়লাম। উঠেই আমি মুগ্ধ !!! করিডোরের দুপাশে জোড়া বার্থ আপার আর লোয়ার । সমস্ত বার্থে দুখান বালিস , দুখান ব্ল্যাঙ্কেট , আলোর ব্যবস্থা , চার্জ দেওয়ার পয়েন্ট আর সবটাই হাল্কা ঘিয়ে রঙের পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী । আহা !! কি রোমান্টিক পরিবেশ । ভাগ্যিস ইচ্ছে জেগেছিল ; নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে নিলাম মনে মনে । কিন্তু এ কি আমার এমন রোমান্টিক কর্তা মশাই এমন চিন্তিত কেন ? মুখে তার হাসি নাই দেখলাম । কি হলো ??? আমাদের রাজ্যের পাহাড়ি পথে রাতে গাড়ি চলাচলের বিধিনিষেধ ( কম চলে ) থাকলেও ওদিকের বন্দোবস্ত ভিন্ন আর তাতেই আমার চিন্তামণি চিন্তিত হয়েছেন , সে পরে বুঝেছিলাম। নাহ্ ওমন রোমান্টিক অ্যামবিয়েন্স মাঠে থুড়ি পাহাড়ি পথেই মারা পড়ল । আমি আবার মনের দুঃখ আর চিন্তা সইতে পারিনা , ঘুমিয়ে পড়ে মনকে রেহাই দিই , অগত্যা ঘুম দিলাম। তিনিও জাগন্ত হয়ে পাশে শুলেন , পরে যে ঘুমালেন তা বুঝলাম নামার আগের কন্ডাক্টারের জায়গার নামের অ্যানাউন্সমেন্টে !!! আসলে হয়েছিল কি ... আমাদের নামতে হবে নবী মুম্বাই এর খারগারে , সেই মত কথা ছিল কন্ডাক্টর আমাদের একটু আগে পানভেলে ঘুম থেকে তুলে দিলেই , কর্তা মশাই বন্ধুকে ফোন করে দেবে আর আমরা যথাস্থানে নামার পর , সে তার বাহন চালিয়ে এসে তার ডেরায় নিয়ে যাবে । কিন্তু .... পানভেলে আমরা সবাই ঘুমন্ত মায় কন্ডাক্টরও , ঘুম ভেঙে দু স্টপ পেরিয়ে খারগার আসতে দেখে সে হৈ চৈ রবে খারগারের নাম ঘোষণা করল ... ধড়মড়িয়ে দুজন উঠে পড়ে নামার তাড়নায় , সে বাছাধনকে আর আগে না ডাকার জন্য বকুনি দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। খারগার বাসস্টপ পেরিয়ে গিয়ে একটু অন্ধকার রাস্তার ওপর রাত ৩টে ৩০ মিনেটে আমাদের লটবহর সহ নামিয়ে শূনশান পথে বাস হুস্ করে বেরিয়ে গেল । 

কর্তা মশাই চটপট রাস্তার আরো ধারে আমাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধুকে ফোন লাগাল , ওই অন্ধকার ভাল লাগছিল না , আলোর দিকে আসলেই বকুনি দিয়ে আঁধারে মশার জিম্মায় থাকতে বলছিল । বললাম... মশা তো তুলে নিয়ে যাবে এবার ?? রাগত উত্তর এলো ... "তুলুক , অন্য কেউ না তুললেই হলো ।" এবার আলো আঁধারির কার্যকারণ ধরতে পারলাম , কেঁপে উঠলাম... সত্যিই তো , এ তো ভাবিনি !! ওই সময়টা তো বিপদজনক আর মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে দিয়ে চার চাকার ছোট বড় গাড়ি তো বেরিয়ে যাচ্ছে অনবরত । বয়স কম , সাথে জাঁদরেল সাথি , বেড়ানোর রোমাঞ্চকর আনন্দে বাস্তবকে ভুলে মেরে দিয়েছি যে , দিনকালের হালচাল তো ভাল নয় । ভয় ভয় করতে লাগল । এমন পরিস্থিতিতে সময় যেন কাটতেই চায় না । ওর বন্ধু দুই রিঙেই ফোন ধরে , নেমে গেছি শুনেই আর দেরি করেনি , ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে এল ... মনের ঝাল মেটানোর আগেই লটবহর আর আমাদের তুলে নিয়ে রওনা দিল ওর বাসস্থানের দিকে । প্রথমেই আমাদের বেআক্কেলে সময়ে আসার জন্য বেছে বেছে শব্দ প্রয়োগ শুরু হলো ...আর তারপরেই কটাক্ষ লটবহরের সংখ্যাধিক্যের জন্য, কিন্তু তোমরাই বলো কন্ডাক্টর যদি আমাদের আগাম না ডাকে আমরাই বা কি করব ??? যাক ... চিন্তার কারণেই বাক্যবাণ, যা ভালবাসার আরেক নাম ... সোহাগ করে যে , সে তো শাসন করতেই পারে , তাই না ??? 

এবার ভোরের অপেক্ষা আর মুম্বাই বেড়ু ....  

 ভোর রাতে মুম্বাই পৌঁছলাম আমরা । আগেই লিখেছি , যার ডেরায় আমাদের মুম্বাই এর দিন গুলো কাটাবো বলে স্থির করা , সে হল আমার কর্তা মশাই এর পাড়াতুত বন্ধু , সে আমার থেকে বছর দেড়েকের বড় মোটে । আমাদের কোর্টসিপ পর্বেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল । তখন থেকেই সে আমারও বন্ধু । পাড়াতুত বন্ধুত্ব তো বয়স মেনে হয় না , কাজেই আমার কর্তার থেকে সে বছর তিনেক ছোটই । এখন যদিও দুজনের পাড়া ভিন্ন কিন্তু বন্ধুত্ব অভিন্ন হৃদয়ের । সাগ্নিকের তখন বিয়ে হয়নি , ও কর্মসূত্রে ওখানে থাকত কমলকে নিয়ে । সে একাধারে সাগ্নিকের বাজার সরকার, রাঁধুনি , সবকিছু । ওদের পূর্ব পরিচিত , বিশ্বাসী কলকাতার ছেলে । কাকিমা , মানে সাগ্নিকের মা , তার ছেলেকে একা একা অচেনা শহরে পাঠাতে নারাজ , তাই এই ব্যবস্থাপনা । কমলের যেমন সুন্দর ব্যবহার, তেমন রান্নার হাত । সেদিন সপ্তাহের শুরুয়াত , কাজেই সাগ্নিকের সাথে আগের বলা কথা অনুযায়ী ঠিক হল যে , সারা সপ্তাহে ওর ব্যবস্হাপনায় আমরা সব ঘুরবো , দেখবো দুজনায় । রাতে ওর সাথে দেখা হবে ঘরে ফিরে , সপ্তাহান্তে এক সাথে সবাই খেতে যাব ওর পরিচিত কোন রেস্তোরাঁতে । অতএব মেঘনাদের ভূমিকায় সাগ্নিক অবতীর্ণ হল আর আমাদের বোম্বাই ওরফে মুম্বাই দর্শন শুরু হল সেদিন একটু পর থেকেই। 

মুম্বাইতে আমার ছোটবেলার দুই বান্ধবীর বসবাস , বৈবাহিক সূত্রে । তাদের সাথেও এই সুযোগে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেবার ভাবনা মনে রয়েছে । সেই মতনই প্রথম দিন সাগ্নিকের দেখানো পথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, অফিস যাওয়ার পথে ভাসি (Vashi )স্টেশনে আমাদের নামিয়ে , ও চলে গেল । ওখান থেকে ট্রেনে ভি.টি , ওখান থেকে সমুদ্র তট ,তারপর খানিক সমুদ্র বিহারে এলিফ্যান্টা কেভস্ দর্শন, ফিরতি পথে এক বান্ধবীর সাথে মোলাকাত ... বেড়ু পুরো জমে ক্ষীর । কিন্তু .... পরন্তু বলেও একটা ব্যাপার আছে তো ; সেদিন সবই হল বটে তবে ... "কিন্তু যুক্ত" হয়ে ভরপুর ভাবে। ভাসি থেকেই যে ট্রেন সরাসরা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস (ভি.টি ) যায় ,

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৫

 বেড়ানোর কথা ভাবতে মানা নেই কোনো। অর্থাৎ কিনা মানস ভ্রমণ। এ বছরের গোড়ার দিকে কর্তামশাই অন্যের অপারেশন করার বদলে নিজের অপারেশন করালেন। শরীরে খান কতক গুড়ি গুড়ি পাথর যুক্ত হয়ে , বিস্তর সমস্যার সৃষ্টি করছিল। অতএব দাও তাদের বের করে !!! সে সব মিটতে , দুজনায় ঠিক করলাম , এ বছর এখন আর ঘুরতে যাওয়ার প্রশ্ন না তোলাই ভাল । অপারেশনের পরে বেড়ানোর রেশনে তখন টান। খানিক সামলে সুমলে একটু দূরের দিকে যাওয়ার কথা ঠিক হল পরের দিকে। যদিও তার রাফ ওয়ার্ক এখন বিশ বাও জলে । হেনকালে তেনার ছোটকালের পাড়াতুত বন্ধু বেড়ানোর পোকা কে টোকা দিয়ে জাগিয়ে দিল .... কিন্তুক মনস্থির করার পরেই সে বেড়ানোর গাছে তোলার মই সরিয়ে অফিসের টুরের গপ্পো শুনিয়ে হাওয়া হলেন !!!! এদিকের জন তো গাছে বসেই গর্জন করে ব্যক্ত করলেন যে , হাম জায়েঙ্গে জরুর। রেগে গেলে ইংরেজি অথবা হিন্দি বলার দস্তুর থাকলেও তিনি নির্যস বাংলাতে বলে দিলেন যে যাবোই যাবো। কেউ যাক না যাক !!! 

দুঃখের কথা বলি কারে ??? কন্যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গীদের সাথে বেড়াতে কিঞ্চিত বোর ফিল করে কিনা কখনও খোলসা করে না বললেও "তিন জনে যাব শুধু !!!" বললে একখান দুখী রামের মতন মুখ করে থাকে , তাতে আমার মন দুঃখে থৈ থৈ হয়ে যায়। ভাবনাতে তা দিয়ে আমাদের নদী থেকে পাহাড়ের ভ্রমণের সঙ্গী দেবাশ্রিতাকে ফোন লাগালাম । এবারে সমুদ্র হবে কি হবে না এ সব ভাবতে ভাবতেই ওদিক থেকে সবুজ সংকেত মিলল তবে খান কতক দিন পরে যাওয়ার অনুরোধ এলো। 

জায়গা নির্বাচন নিয়ে খানিক চাপানউতোরের পর ঠিক হল রূপনারায়ণ নদীর ধারের কোলাঘাট। যাওয়ার পথে দেউলটি নামক ফাউ যদি ঘুরে নিতে পারি , দারুণ হবে ব্যাপারখান। সবাই জানি যে দেউলটিতে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একখান বসতবাটি ছিল , যা এখন অবশ্যই এক দর্শনীয় স্থান। যাওয়ার আগে বেশ সপ্তাহ দুয়েক লম্বা সময়ের মধ্যেই দেবাশ্রিতা আকুলি বিকুলি করে সমুদ্র সৈকত যাওয়ার সুপ্ত বাসনা মনের গুপ্ত স্হান থেকে বের করতেই , যাওয়ার লিস্টি নদী থেকে সাগর মুখী হল। নদী বাদ পড়ল এমন ভাবার কারণ নেই কো। বলা ভাল নদীর সাথে সাগর যুক্ত হল। ভাই দেবাশ্রিতা .... রইল বাকি ঠাণ্ডা ও গরম দুরকমের মরুভূমি এবং অরণ্য । মনে ইচ্ছে বজায় রেখো । হয়ে যাবে কখনও কোন একদিন ।

অবশেষে এল সেই আকাঙ্খিত দিন। চাটিবাটি গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একখান মিটিং পয়েন্টে মীট করে স্থান অদল বদল করে আমরা চলমান হলাম। মেয়ে আর বাবার মন রাখতে , মনে ভার নিয়ে অন্য গাড়িতে দেবাশ্রিতার চারআনা র সাথে ভাব জমাতে লেগে পড়লাম। দুই বান্ধবী র ফুর্তি ধরে না আর !!! মা নামক "না " সাথে নেই ... এ কি কম কথা। ছোটকালে পিতাশ্রী ঘাড় পাততো না এক্কেরে !!! তখন মেয়ে আবার পথে বেরিয়েই পেটের সব হজম না হওয়া খাবার উগরে দিত !!! এখনও দেয় তবে রয়ে সয়ে , আগাম নোটিশ ধরিয়ে । সর্বোপরি বন্ধু বিহীন পথ চললে । এবার সে সব আপদ বালাই বলতে গেলে ছিলই না। কাজেই দুই গাড়ি চলল । 

আমাদের গাড়ির চালক অভিজিৎ দক্ষ চালক। সে হুস হয়ে গেল অচিরেই। এদিকের চালক দেবাশ্রিতা নভীস না হলেও নিত্য চালক নয় , সর্বোপরি তার কর্তামশাই এর ভয় সুলভ নির্দেশনা মেনে গাড়ি চালাতে চালাতে শুরু হল টক ঝাল মিষ্টি কথার  পিঠে কথা !!! আমি পুরো হাসতে হাসতে পথ পেরতে লাগলাম। মধ্যে দেবাশ্রিতা জুনিয়র হিল্লোলের সাথে ভাব জমা শুরু হল !!!! পথে বাহন চালনা করার ভাগযোগ কর্তা-গিন্নি করেই বেরিয়েছে। উলুবেড়িয়া থেকে গিন্নি গাড়ির চালকের আসন দিয়ে দেবে তার কর্তামশাই কে। অদল বদল হতেই গিন্নিমা মোক্ষম শোধ তুলতে তুলতে এগিয়ে চললেন । পুরো কৌতুক মাখা চিত্র নাট্য শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল মজাসে !!! তবে ওদিকের গিন্নির পরিষ্কার কথা ... আগে তুমি খুঁত ধরেছ যখন , ফেরত না দিলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে । তা কি ঠিক ???? 

চলতে চলতে পথের ধারের ভাঁড়ের চা পান অবশ্য পালনীয়। সে সব মিটিয়ে চটপটা কিছু রেডিমেড খাবারের প্যাকেট আমাদের ঝোলায় ভরে দেউলটির দিকে চলতে লাগলাম। পথে বেরোলে বরাবর আমার ক্ষিদে ভয়াবহ আকার নেয়। বাড়ি থেকে যত ই পেট পূজো করে বাইরে যাই , পরবর্তী পূজোর টাইম চট জলদি পেটের দুয়ারে হাজির হয়ে পড়ে। চটপট চটপটা কে ঝোলার ভিতর ঘাঁটি গাড়তে না দিয়ে ঘেঁটি ধরে বের করে সকলে মিলে জুলে পেটে চালান করতে না করতেই হাইওয়ে থেকে এক অন্য পথে একটু ভিতরে ঢুকে কথাশিল্পীর বাড়ি এসে পড়তেই, দুয়ারে নেমে পড়লাম। গণগণে রোদ মাথায় করে ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম, দর্শন করতে হবে আধা ঘন্টার মধ্যেই। কারণ ১২টা র সময় বাইরে র মানুষের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যায় ‌। 

ভিতরে এক অযাচিত বয়স্ক গাইড অদ্ভুত এক সুরেলা কিন্তু ওঠা পড়াবিহীন স্বরে বলে যেতে লাগলেন বাড়ির ঘর গুলির ইতিহাস সাথে সে বাড়ির মালিকের ইতিবৃত্ত। একতলা পেরিয়ে দোতলায় এসে ঘর লাগোয়া প্রশস্ত বারান্দা দেখে সকলে লাগাম ছাড়া হলাম। শহুরে ঘর বাড়ির এক চিলতে বারান্দায় যে কচি থেকে ধাড়ি কারোর মন ভরে না !!! তা সবার আচরণে প্রকট। শুধু মাত্র যে এমন ফূর্তি আমাদের মনে দেখা দিয়েছিল একদমই তা নয়। ওখানে আগত অন্যান্য দের দেখেও তা বুঝেছিলাম স্পষ্ট। ওপরের ঘর গুলোকে নিচের ঘরের মতনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালার গারদের ওপারে দেখলাম। এমন পরিবেশে দাঁড়িয়ে মন আবিষ্ট হয়। অদ্ভুত শিহরন খেলে যায় শরীরে। মন অবাক হয়ে ভাবে ; এই ঘরে , বারান্দায়, বাগানে কথাশিল্পী একদিন দিনযাপনের ইতিহাস লিখেছেন। বহু যুগের ওপার হতে যেন কল্পনা বিলাসী হলেও হওয়া  যেতো। কিন্তু সময় সীমিত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাই রূপনারায়ণ নদীর দেখা পেলাম। শুনেছিলাম আগের বারে ‌.... নদী , লেখকের আমলে বাড়ির কাছ‌ দিয়ে বয়ে যেত। গতিপথ একটু একটু করে সরে গেছে খানিক দূরে। আগে যেবার এসেছিলাম পুপে তখন ১১ মাসের কুচো। যদিও কথাশিল্পীর সম্পর্কে তার তখনকার আর এখনকার জ্ঞানের পরিধি র পার্থক্য খুব সামান্য। ওই টুকখান পার্থক্য র জন্য দায়, দায়িত্ব, অবদান যাই বলো ‌তা আমার নয়কো মোটেই। অবদান Hoichoi এর " পরিনীতা " নামক web series এর !!!! 

সব দেখার পর ছবির পালা মিটিয়ে আমরা সকলে আরেক প্রস্থ ছবি তুলতে হাজির হলাম সামনের বাগানে। নানা রকম ফুলসহ বাগানের একপাশে আরো দুই জনার সাথে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেতপাথরের স্মৃতি বেদী দেখলাম। তার এক পাশে রয়েছে বাঁশ ঝাড়। বাঁশ গাছের আধিক্য দেখা র মতন। বড় বাঁশ ঝাড় ছাড়াও কিছু ছোট একত্রিত বাঁশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওদিকের কর্তা গিন্নি দেখি বিগলিত । একজন আরেকজনকে বললে ‌.... এসো তো দেখি আমরা এখানেই ছবি তুলি ; একে অপরকে বাঁশ দিয়েই থাকি যখন !!! মনে মনে কি ওরা আরো জোরালো বাঁশের সন্ধান করেছিল ? নাকি বাঁশ ঝাড় নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছিল কে জানে ? তবে ভাব ভাব , আড়ি আড়ি হলে তবেই তো জীবন চটপটা তাই না ? তরঙ্গ একদম না থাকলে যে সব আলুনি !!!! 

এরপর গাড়ি দিল পাড়ি অল্প খানিকটা দূরের রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে র সাজুগুজু করা হোটেল সোনার বাংলা তে । সে গল্প নিয়ে আসছি জলদি।

@শুচিস্মিতা ভদ্র 




Saturday, 21 June 2025

 আজ একটা অন্য গল্প বলি .... সবাই নয় না-ই শুনলো থুড়ি পড়লো , কেউ কেউ তো পড়বেই। তো যা বলছিলাম .... আমার ছোটবেলার প্রথম পুষ্যির কথা। আমার বন্ধুরা সকলেই নামে তো বটেই , কেউ কেউ আবার রীতিমত তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ও চেনো। হ্যাঁ , একদম ঠিক ধরেছ আমি কুট্টুসের কথা-ই বলছি। ওর আগে কিছু পোষার শখ থাকলেও , মায়ের অনুমতি মেলেনি। তাহলে কুট্টুস -ই বা এলো কেমনে ?? সেটা ই হলো ওই কুট্টুস নামের মতোই ছোট্ট একটা গল্পের হাত ধরে। কুট্টুস ছিল একটা কাঠবেড়ালি। ওই যে ছোটদের ছড়ার বই এ দেখেছিলাম , পড়েছিলাম কাজী নজরুল এর জবানীতে.... " কাঠবিড়ালি, কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও ??? " সেই পরিচিত একরত্তি ছোট্ট প্রাণী।

সরস্বতী দির ছেলে একদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ে পড়ে যাওয়া ছোট্ট বাচ্চা কাঠবিড়ালি কে পেয়েছিল , আমাদের পিছনের পাড়া আমবাগানের রাস্তায়। বাড়ি ফিরে সে তার মাকে দিয়েছিল .... তারপর হাত বদল হয়ে মায়ের জিম্মায়। খাওয়া শেখেনি। আমাদের খাবার টেবিলে একটা খবর কাগজে ওকে রাখলাম.... দক্ষিণের জানলার হাওয়ায় কাগজ সহ সে উড়ে যায় আর কি !!! এতোই ক্ষীণজীবি তখন। তুলোয় ভিজিয়ে দুধ খাইয়ে তিনি ক্রমে শক্তিমান হলেন। কিন্তু আজীবন আর আহ্লাদে নিজে খেতে শিখলেন না । মা ব্রিটানিয়া বিস্কুট দুধে ভিজিয়ে নরম করে ওকে খাইয়ে দিতেন। আম কালে আমে ও রুচি ছিল, কিন্তু কবির বাণী নস্যাৎ করে পেয়ারা খেতে অরুচি দেখিয়েছিল। 

ওর জন্য কাঠের ঘর বানানো হলো , সেখানে থাকতো , জানালা বন্ধ করে ঘরের আগল খুলে দিলে আমাদের কাঁধ, মাথা আর জানালার পর্দায় দোল খেতো। মা অনেকক্ষণ ফোনে মন দিলে তার আবার ভারি রাগ হোতো , ফোনের তার বেয়ে যা তা করে , ফোন ছাড়তে বাধ্য করতো। রাগের মাত্রা বেশি হলে কাঁধে উঠে কানে কটাস !!!! ভাবো একবার কি দুঃসাহস !!!

ওকে নিয়ে ( ঝুড়ি বন্দী ) বাসে চেপে একবার মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। বাস শুদ্ধু সবার চোখে কি কৌতুক ও কৌতূহল । তিন বছর ওকে নিয়ে আমারা মেতে ছিলাম। কসবায় ও এসেছিল আমাদের সাথেই। বাসা বাড়িতে।

ও চলে যাওয়ায় জ্ঞানত প্রথম শোক কাকে বলে বুঝেছিলাম। যারা বোঝে না , তাদের হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হতেই পারে । কিন্তু তাতে কি আমার আর মায়ের কষ্ট কিছু কমে গিয়েছিল ??? 

আজ অনেক বছর পেরিয়ে, ফিরে দেখলাম। আরো অনেক কিছু মনে পড়ছে , কিন্তু থাক ওসব আমার নিজের কাছেই থাকলো। বলা ভালো বাকি টা ব্যাক্তিগত।

তাই ওদের যেখানে দেখি, ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করি । বড়ো চঞ্চল !!! সেই একই রকম স্বভাব .... বড্ড অশান্ত

 খাদ্য বিভ্রাট


পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে , কেউ জানি না । রয়েছে ভয় , আতঙ্ক আর ক্ষীণ আশা আগের মতন জীবনে ফেরার। আশা ছাড়া থাকতে পারি না আমরা। আর অধিকাংশ বাঙালি যা পারে না তাই হলো খাওয়া দাওয়ায় বাঁধন দিতে । সেই কবে থেকেই বাঙালি কবি ঈশ্বরী পাটনী কে দিয়ে মা অন্নপূর্ণার কাছে বর আদায় করে নিয়েছিলেন ... আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। 

অধিকাংশ বাঙালি ভ্রমণ বিলাসী যেমন সত্য , তেমনই সত্যি অধিকাংশ বাঙালির খাদ্য প্রীতি। তো এ হেন পরিস্থিতি তে তারা যে সব ফেলে খাদ্য না পাওয়া নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হবে , এ আর এমন কি ?? 

আর সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত বাঙালি মুক্ত কচ্ছ হয়ে বাজারে সিধিয়েছে নির্ধারিত সময়ে । থলে, ব্যাগ , বস্তা যা হাতের কাছে মিলছে সব ই চলেগা। হাতে থলে , মুখে মুখবন্ধ আর চোখে আতঙ্ক নিয়ে বাঙালি বাজারে, দোকানে সর্বত্র মানে যা তার নাগালের মধ্যে। 

এই পরিস্থিতি যে হতে পারে এমনটা সপ্তাহ দুয়েক আগে শুনেছি , গুরুত্ব দিই নি। তো কি ? আমি তো বাজার সরকার ন‌ই , তাই একটু একটু বেশি উপাদান মজুদ হতে শুরু করলো। একদিন রাগ করে বলেই ফেললাম যে , আগে অনেক বড়ো ফ্রিজ এর অর্ডার দেওয়া হোক । কিন্তু সে গুড়ে বালি !!! এখন যখন সত্যিই lockdown ঘোষণা হলো রসদ তখন অনেকটাই হজম হয়ে গেছে। আসলে নকলে মোদ্দা কথা হলো , খাদ্য মজুদ থাকা মানেই যে ঘুরছি ফিরছি খাচ্ছি ... করতে হবে এমন তো না , কিন্তু ভোজনরসিক গুনীজন তা শুনলে তবেই না ? রাতে মেনু ঠিক করা হচ্ছে পছন্দ অনুযায়ী... তবে আমি ওই সিলেবাস কেটে ছোট করছি। মানে করতে হচ্ছে-ই । আর দরকারি ও অদরকারী বিষয় যোগ বিয়োগে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি। 

আমার কর্তা মশাই এর কর্ম জরুরি পরিসেবা ভিত্তিক, সে বেরচ্ছে , ফিরে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার প্রথম প্রশ্ন কুশল বিনিময় ব বর্তমানপরিস্থিতিবিষয়ক ... এমন ভাবার কোন কারণ নেই .... প্রশ্ন নিছকই খাদ্য বিষয়ক । গতকাল ভাত, ডাল ও মাছের সাথে দুরকম তরকারি করেছিলাম মনে আশা নিয়ে যে আজ ও খানিক সামলে যাবে .... কিন্তু নাহ্ !! সে সব হজম হয়ে গেছে বটে !!! আজকের মেনুতে যা যা আবদার বলো ফরমাস বলো , ছিলো তার মধ্যে পটলের ডালনা ছিল , কিন্তু আজ ফ্রিজ খুলে পটল তুলি নি , মানে বের করিনি , কারণ কিছু ছবি হ‌ওয়ার আগের স্টেজের ভেণ্ডি ছিল, ওদের দিকে না তাকালে ওরা ফ্রিজেই ফ্রিজ করে যেতো !!! আরো কয়েকজন ঝিমিয়ে পড়া প্রতিবেশী ফ্রিজ থেকে কড়াইতে যেতে অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কাকে যে কোথায় গুজেছি আর কোথায় খুঁজেছি এ এক লাখ টাকার প্রশ্ন। আসলে ঠাণ্ডা মেশিনের ভিতরে নজর দেওয়ার আগে একটা গাইড ম্যাপ তৈরি করা উচিত ছিল, কিন্তু তালেগোলে সেটাই আর করা হয়ে ওঠেনি।আর সমস্যা সেখানে-ই।

এদিকে এবারের বিপদ বিশ্বায়নের জোয়ারে সমগ্র বিশ্বে। ইংল্যান্ড নিবাসী আমার বান্ধবী শ্বেতা-ও মজুদ সব্জীর স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ছে। আমি -ও ওমন করে কিছু সব্জি কে ঝিমিয়ে পড়ার হাত থেকে টেনে তুলেছি ( কিছু কিছু সব্জি{সব নয় } কেটেকুটে জলে না ধুয়ে কৌটো বা পলিপ্যাক বন্দী , রান্নার সময় ওদের স্নান করালে ই চলবে ) । ব্যাঙ্গালোরের বান্ধবী পরশু দিন-ই চিন্তা ব্যাক্ত করল তার মাথার সাইজের ( এটা কৌশিকীর বর্ণনা, আমার ভেবো না মোটেই) দুই কপির বাসস্থান নিয়ে। আশা করি কৌশিকীর মাথায় , নিশ্চিত কোন বুদ্ধিতে সেই কপি যুগল বিদ্ধ হয়েছে । আর কৌশিকী -ও নতুন কোন সব্জি সংকটে সংকোটমোচন এর দ্বারস্থ হয়েছে।

আমার ভোজন বিলাসী যা যা বাজার , দোকান থেকে বগলদাবা করছে , বাড়ি ফিরেই আলোচনা হচ্ছে , তা দিয়ে সম্ভাব্য কি কি পদ হতে পারে আর আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই যে , সেই সব পদের রাধনে আমি কোনটা তে দৌপদী আর কোনটা তে মা- গঙ্গা তার বিবরণ। আলোচনা হচ্ছে কি ফোনে ? মোটেই না , হচ্ছে খাদ্য বেরসিক পুপের সাথে। 

অতি ও অবশ্য প্রয়োজনীয় পদ মজুদ করার পর , এখন জোগাড় হচ্ছে দুধের ওপরের অতিরিক্ত মালাই(উপরি)।অর্থাৎ কিনা মা দিয়ে আহারে বাহার আসে। তবে মালাই এখন মিলছে না , দূরদর্শিতা দেখিয়ে আগেভাগেই ওসব অন্য কারোর ঘরে জমা পড়েছে। তো ভি আচ্ছা.... কে যেন বলেছেন... " একবার না পারিলে , দেখো শতবার"... তো এই বেদবাক্য শুনেই তো এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছি। তবে !!!!

সেদিন আমার ভাসুর , আমাদের মুশকিল আসান দাদা দুই পাউণ্ড পাউরুটি দিয়ে গেলেন। কোথায় রাখি, কোথায় তুলি এই করে বারান্দা য় রেখে রান্নার আঙিনা আলো করতে করতে ভুলে মেরে দিয়েছি..... কি সব্বোনাস !!! পরে দেখি মার্চ করে পিঁপড়ে চলছে পাউরুটি ফিস্টে যোগ দিতে .... তারপর !!! আর কি পাউরুটি দের পিঁপড়ে কূল থেকে উদ্ধার করে , পত্রপাট তাদের জায়গা মতো রেখে নিজে ও আজ সকালের "লুচি খাবো রবিবারে "... এই নাচন পাউরুটি দিয়ে চাপা দিয়েছি। তবে পুরোপুরি বাঁচি নি । ডিম পাউরুটি নাস্তি , টোস্ট শুধুমাত্র মাখন দিয়ে খেলে ওজন বেড়ে যাবে না ???? তো পাউরুটি টোস্ট সাথে মুরগির ঝোল । তো ওটা কিছু রেখে , কিছু ছেঁটে স্টু তে স্টিক্ করলাম। যাক্ বাবা , মেয়ে দুজনেই খুশ্। সাথে আমি -ও ।

তো রোজই আমার আতঙ্কিত খাদ্য চিন্তক কিছু না কিছু আনছে শুকনো , ভিজে । শুকনো এবার ঠাই নাই , ঠাই নাই করতে করতে আমাদের পুপেদিদিমণির আলমারি তে -ও সিধিয়েছে। জানি না কি হবে ?? আমার কথা হলো সামনের বিপদের কথা মাথায় রেখে খাওয়াতে একটু লাগাম দিতে হবেই। যা মজুদ করছি , তা যদি এখন ই শেষ করি , চলবে কি করে ? 

ভালো ভালো রান্না করতে ভালো তো লাগেই, উপকরণ ও রয়েছে। আমার মামাতো দেওর কাল , বিরিয়ানি রেঁধে নিজেই বোল্ড আউট।কারণ তার কাছে ই শুনলাম খেতে মন্দ হয়নি but বিরিয়ানী র স্বাদটা-ই যা missing। পুপের বন্ধু র মা ফোন করেছিলো , শুনলাম ওদের রান্নাঘর সেদিন রসোগোল্লা আর পান্ত্তুয়ার আতুড়ঘর হয়েছিল। দারুন না ? 

কারণ বেশি চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছে না, অন্তত আমি ওতো দৃঢ় মানসিকতার কোনোদিনই ন‌ই।

আমাদের বান্ধবী দের সাথে ও কথায় কথায় জানতে পারছি সবার বন্দীগীতিকা। একজনের খাদ্য রসিক কর্তা আর পুত্রের দফায় দফায় অর্ডারে সে বেচারি নাজেহাল। এদিকে গাদা গুচ্ছের বাজার করে তার বাম- মনোভাবাপন্ন কর্তামশাই অল্প রান্না করতে নির্দেশ ও দিচ্ছে.... কিন্তু নানা রকম ফরমায়েশি রান্নাতে বাম, ডান কোনো পন্থার ছোঁয়াচ নেই। 

এদিকে সব রকম খাবার জোগাড়ে ব্যতিব্যাস্ত আমার কর্তা মশাই ঠাকুরঘরের রেশনিং-এ বেভুল হয়েছেন। পাড়ায় , বাজারে হানা দিয়ে-ও নকুলদানা জোগাড়ে ব্যার্থ হয়ে মনোকষ্টে ভুগছিলেন। এক দাদা বরাভয় দান করেছেন , দূরাভাষের মাধ্যমে ঠাকুরের মেনুর উপাদান, পরিমাণ শুনে নিয়ে , গড়িয়াহাট বাজার থেকে সংগ্রহ ও করেছেন। নিশ্চিন্তি !!! কর্তা মশাই যারপরনাই খুশি। খুশির প্রকাশ এখন বেশ প্রবল , আশা করি দাদা সামলে নেবেন। বিপদে ওমন হয়েই থাকে । কি !! তাই না ??? 

এখন এমন খাওনদাওন চালু থাকলে সত্যিই পরে , কেউ কি কাউকে চিনতে পারবো ?? আয়তন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে ? না , এতো ভাবতে পারছি না । কারণ সব আতঙ্ক আর ভয় ছাপিয়ে কি কি খাবার বানাবো অল্প করে , এই ভাবনায় আমি আপাতত ভাবিত। ভাবছি আর খাবি খাচ্ছিল !!! 


** খাবার খাও রয়ে সয়ে , please । আমি -ও লাগাম টানছি অল্প করে , গল্প করে ... নিরূপায়। ঘরের সবার খাওয়া দাওয়া এখন আমার ওপরে-ই কিনা ..... !!!

 

 গোলমেলে কোভিড 

আলাপ পরিচয় 

নয় নয় করে , আর ভয় ভয় করে কাটিয়ে ফেললাম অনেকগুলো দিন , মাস । কিন্তু আর কতদিন ??? এই প্রশ্ন সবার , কিন্তু উত্তর জানা নেই কারোর। বেশ কিছু নতুন নতুন শব্দের সাথে আলাপ পরিচয় জমে উঠেছে এই কয় মাসে । স্যানিটাইজ , কোয়ারেন্টাইন , হোম আইসোলেসন , অ্যসিম্টমেটিক , লকডাউন , আনলক ওয়ান/ টু/থ্রি /ফোর , ওয়ার্ক ফ্রম হোম , অনলাইন ক্লাস, ওয়েবিনার , নিও নর্মাল ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে নিজেকে, পোশাক পরিচ্ছদকে , বাইরের ব্যবহার্য সামগ্রী কে , কাঁচা বাজারকে, প্যাকেটজাত দ্রব্য কে .... অর্থাৎ সব কিছুকেই আপাদমস্তক পরিস্কার করার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে কাঁচা সব্জিকে শুধুমাত্র জল দিয়েই ভালো ভাবে পরিস্কার করা স্বাস্থ্যসম্মত। সাবান জলে খাবার সামগ্রী কখনোই পরিস্কার করা উচিত নয়। এর ফলাফল মারাত্মক । এখন কিছু না হলেও ভবিষ্যতে কি হবে বলা মুশকিল। সাবান বা ডিটারজেন্ট কোনো ভাবেই শরীরের ভিতরে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

সব কিছু এখন অনেকটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শুরুর দিকের , কি যে করি ভাবটা খানিকটা হলেও বদলে গেছে। আমরা যে অভ্যাসের দাস , তা যেন আরো একবার নতুন ধারায় , নতুন ভাবে প্রমাণিত হলো ।

মাস্ক

এবার আসি মুখোস বা মাস্কের কথায়। আমাদের বর্তমান জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি সামগ্রী। সঠিক মাস্ক কোনটা , সেটা নিয়ে একটা সংশয় আছেই। আর তার ব্যবহারের পদ্ধতি নিয়েও গোলযোগের শেষ নেই।যে যেটি ব্যবহার করছেন, তার কাছে সেটাই সঠিক মাস্ক। সর্বক্ষেত্রে কিন্তু সেটা সঠিক নয়। তাহলে ??? উপায় কি ? উপায় নিশ্চয়ই আছে। সাধারণ বুদ্ধিতে একটা বিষয় সকলেই জানি, সার্জিক্যাল মাস্কের ব্যবহার হয় , যে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে , বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারে। যেখানে নানা ধরনের সংক্রমণ রোধের প্রয়োজনেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে দিনের পর দিন , বছরের পর বছর । এই ব্যবহার মোটেই হাল আমলের নতুন সংযোজন নয়। কাজেই এর ব্যবহার অনেকটাই নিশ্চয়তা দিতে পারে। তবুও কেন পুরোপুরি নিশ্চিত নয় ? এবার আসছি সেই কথায়। যে কোনো সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতার একটা সময় নির্ধারিত করা আছে। তারপরে তার ব্যবহার, অব্যবহারেরই সামিল । আর এই সার্জিক্যাল মাস্ক যদি ধোয়া হয়, তাহলে তার পোরস্ গুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলে নতুন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। না হলে সেটি শুধুমাত্র ডাস্টগার্ডে পরিণত হবে। প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। নানা ধরনের মাস্কের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করা উচিত। যেমন ভেন্ট যুক্ত মাস্ক প্রথম দিকে ব্যবহার করা হলেও, এখন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অনেকেই N-95 মাস্ক ব্যবহার করছেন। এটির ব্যবহারের কিছু নির্দেশাবলি আছে । সেই মতনই ব্যবহার করা উচিত। চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মী ,এছাড়াও প্রধাণত যারা সরাসরি এই কোভিড ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সাথে যুক্ত তাদের এই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, সাথে অন্যান্য সাজসরঞ্জাম। তবে আমরাও অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে N-95 মাস্ক ব্যবহার করছি। সঠিক সাবধানতা সব সময়ই প্রয়োজন। 

চিকিৎসা কেন্দ্রের সাবধানতা অবলম্বন যেমন জরুরি, বাইরের দুনিয়াতে অবস্থান কালে সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি । কেন ? কারণ বাইরের বিপদটা পুরোপুরি আমাদের অজানা। চিকিৎসা কেন্দ্রের বিপদের অস্তিত্ব আমাদের জানা বিষয়। তাই সেখানে দুপক্ষের সাবধানতা অবলম্বন, সতর্কতা অনেকটাই রক্ষাকবচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । কিন্তু বাইরের পরিবেশ আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। সেখানে বিপদের আশঙ্কা থাকতেও পারে , আবার না থাকতেও পারে । কিন্তু সেটাই বেশি ভয়ের । তাই যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন অবশ্যই জরুরি। 

পোশাকের সাথে ম্যাচ করে মাস্ক পরা কতোটা সঠিক, সেটাও জানা জরুরি। তেমন মনে করলে সঠিক মাস্কের ওপর ডিজাইনার মাস্ক বা ডাস্টগার্ড পরা যেতেই পারে , যদিও ব্যাপারটা বেশ কষ্টসাধ্য হবে। এছাড়া এক টানা মাস্ক পরা বেশ দমবন্ধকর। কিন্তু বিপদ বড়ই বালাই। তবে , নিঃশ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। দুটোই সমান দরকারি । নিরুপায় হয়ে আমাদের মুখ , নাক ঢাকতে হচ্ছে। তাই মাঝেমধ্যে ঢাকা সরিয়ে, একটু স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচল করতে দেওয়াও খুব দরকারি, তবে অবশ্যই পরিবেশ, পরিস্থিতি বিচার করে। 

জর্জরিত আমরা 

জ্বর নিয়েও চলেছে বিস্তর চাপানউতোর । প্রথমত জ্বর হলেই যেমন সেটা কোভিড আক্রান্ত ধরে নেওয়া অযৌক্তিক , তেমনই বেঠিক "আমার জ্বর কোভিড নয়" এই ধরনের গা জোয়ারি ভাবনা। যে কোনো জ্বরের কিছু সাধারণ লক্ষণ থাকে , কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বরের ও সে সব লক্ষণ থাকে , এছাড়াও তার আরো বেশ কিছু উপসর্গ আছে। যে গুলো আমরা এখন কিছুটা জেনেছি নানা বিশ্বস্ত সূত্রে। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর সেরে যাওয়ার পরও উপসর্গ রয়ে যাচ্ছে বা নতুন করে দেখা দিচ্ছে। এখন কথা হলো এই ভয়াবহ জ্বরের গতি প্রকৃতি বোঝা সত্যিই খুব কঠিন। কাকে কাবু করবে আর কে একে হারিয়ে নিজে জিতে ফিরবে এ কেউ বলতে পারছে না। কাজেই জ্বর হলেই ঘাবড়ে গেলে চলবে না। যা যা করণীয় তা করতে হবে। করণীয় বলতেই কোভিড পরীক্ষা নয়। তবে যদি প্রয়োজন হয়, চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করতে হবে বৈকি। আবার পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে , নিজের ও সঙ্গের সবার কথা ভেবে পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা আমরা নিজের পছন্দসই বিষয় শুনতে , ভাবতে ভালোবাসি। একজন ব্যক্তির পরীক্ষার ফল যদি দুই জায়গায় দুরকম আসে , আমরা তার থেকে পছন্দমত ফলাফল বেছে নিই । এক্ষেত্রে ভুল কোনটা যাচাই করা যখন মুশকিল, তখন আবারও পরীক্ষা করা যে জরুরি সেটা বুঝতে চাই না। ভুল যে হয় না , সেটা একদমই সঠিক নয় । কিন্তু ফলভোগকারি যে , তাকে তো নিজের ভালোর জন্য কিছু করতে হবেই। এরপরও যে তীরে এসে তরী ডুববে না , তাই বা কে বলবে ? এই গোলমেলে অসুখে সবকিছুই যেন হাতের বাইরে।  

বার বার পরীক্ষা, স্যানিটাইজ পদ্ধতি ভালো রকম ব্যয়বহুল। সরকারি পরিষেবাতে খরচ কম , কিন্তু সেই পরিষেবা গ্রহণে আগ্রহী কজন ? নেহাৎ নিরূপায় যারা , তারা ছাড়া !!! 

যে যে জ্বর আপন নিয়মে সেরে যাচ্ছে, তার সবগুলোই যে নির্দোষ সাধারণ জ্বর এমন ভাবা বোধহয় ঠিক নয়। কারণ পরীক্ষা ছাড়া কোনটা কি ধরনের জ্বর ছিল তা জানার উপায় নেই। এই ভাইরাসের প্রকার ভিন্ন ভিন্ন। কোন প্রকার কার শরীরে কি খেলা দেখাবে তা বলা বা বোঝা মুশকিল। কাজেই কেউ কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই যদি ভাবতে থাকে , ওটা কোভিড ছিলোই না, ভাইরাল জ্বর .... সেই ভাবনায় কিন্তু কিছু ভয় , কিছু সংশয় থেকেই যাচ্ছে । কি করে ? তার আশপাশে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে যদি সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিয়ে বসে ? এক্ষেত্রে করণীয় বিষয় একটাই যদি জ্বর খারাপ দিকে না গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে রোগী , যার কোনো রকম উপসর্গও নেই , কাজেই প্রশ্ন ওঠেনি পরীক্ষা করার , সে যেন অবশ্যই আশেপাশের সবার কথা ভেবে নিজেকে কদিন একটু আলাদা রাখে । এই অতিমারির পরিবেশে না পারা কতকিছুই তো করলাম, শিখলাম .... নিজের আপনজনের জন্য , পড়সিদের ভালোর জন্য এটুকু কি করতে পারবো না ??? হয়তো তার সাধারণ ভাইরাল ফিভারই হয়েছিল ।কিন্তু কথায় বলে সাবধানের মার নেই। কাজে কাজেই। 

সাবধানতা আরো

এই বিপদ কাটিয়ে যারা আবারও আমাদের মধ্যে ফিরেছেন , তাদের জবানিতে জেনেছি , ফেরার পরবর্তীকালের সাবধানতার কড়াকড়ি। কারণ শরীরের ভেতরে এই ভাইরাস যে ভয়াবহ পরিমান ক্ষয়ক্ষতি করে দেয়, তার থেকে আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগে অনেক , চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়। নিজের কাছের মানুষ জনের কষ্টকে দীর্ঘায়িত করার থেকে , নিয়ম মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়। 

আক্রান্ত ব্যক্তি যারা চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হচ্ছেন, ট্রিটমেন্টের পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর, প্রথমবার জ্বর হওয়ার ৪২ দিনের মধ্যে পুনরায় পরীক্ষা করলে আবারও পজিটিভ রিপোর্ট আসতেই পারে। যদিও তখন ভাইরাস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সব সময় এই রিপোর্ট যে পজিটিভ আসবে ,এমনও নয়, তবে বাড়ি ফেরার পর অথবা যারা বাড়িতে থেকেই সুস্থ হলেন সাবধানতার মাত্রা বেড়ে যাবে আরো অনেক বেশি । এই ভাইরাস ভয়ঙ্কর রকমের গোলমেলে ।ওই কারণেই সমস্ত পৃথিবী আজ দিশাহারা। 

নিয়ম মেনে সাবধানে চলার সঙ্গে সঙ্গে, পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাবার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি আর অতি অবশ্যই রুটিনমাফিক যোগব্যায়াম করতে হবে। ইমিউনিটি বর্ধনকারী হোমিওপ্যাথি অথবা এলোপ্যাথি ওষুধ যদি খেতে হয় অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে তা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ।

বিচার বিশ্লেষণ

একটা কথা খুব শুনছি .... এ বড়লোকদের অসুখ। যারা বস্তিবাসী তাদের হবেই না । কথাটা আংশিক সত্য, কিন্তু পুরোপুরি নয়। একটু তলিয়ে ভাবলেই গলদ কোথায় বুঝতে অসুবিধা নেই। আমরা অনেকেই অতি সাবধানী , তার থেকেও আরো এগিয়ে সাবধানী নিজের প্রিয় জনের প্রতি , সন্তানের প্রতি। সব সময় পক্ষী মাতার মতন আগলে চলেছি । ফল অতি বিষম । অল্পেই আমরা কাতর। সহ্য ক্ষমতা কমতে কমতে , কোথায় যে তা নেমেছে !! তা নিজেরাও জানি না । পক্ষীমাতাও এক সময় তার সন্তানদের খোলা আকাশে উড়তে শিখিয়ে , ছেড়ে দেয়। আমরা অনেকেই পারি না ছাড়তে। এর ফলে শারীরিক , মানসিক সব রকমের সহ্য ক্ষমতায় আমাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। রোগ বাসা বাঁধে সহজেই। কোন কিছুতেই লড়াই করার আগেই হেরে যাই। কিন্তু যারা জন্ম থেকেই প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ছে, তাদের শারীরিক ও মানসিক সহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি। আর সেখানেই এই মারণ ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হলেও, তারা অনেকেই অ্যসিম্টমেটিক হয়ে , নিজের অজান্তেই সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে। এক সময় স্বাভাবিক নিয়মে ভাইরাসও নিষ্ক্রিয় হয়ে তার সব রকম কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ততদিনে আরো অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো অ্যসিম্টমেটিক রয়েছে, আবার কেউ বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

এই পরিস্থিতির পুরোপুরি উপশম করা বোধহয় সম্ভব নয়। কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমনটা চিরদিন হয়ে এসেছে, তার খোলনলচে বদলানো যায় না , তবে মাঝামাঝি কোন একটা পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা হয়তো করা যায়। বাকিটা সময় আর ভাগ্য। এখন মনে হতে পারে সবই যদি ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাহলে এতো মত , পথের দরকার কি? যেমন চলেছে চলতে দিলেই তো হয় !!! কিন্তু তা যে সঠিক ভাবনা নয় , আমাদের তা জানা। 

এরপর আরো রয়েছে নানা ধরনের গুজবের ছড়িয়ে পড়া। যা এই ভাইরাসের মতনই সংক্রামক। অতিরিক্ত গরমে এই ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হবে.....এই প্রথম গুজব যে সর্বৈব ভুল ছিল , তা জেনেছি যথা সময়ে। ফ্রিজ নাকি এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর .... সে ভাবনাও সঠিক নয়। ভাইরাসের বাতাসে ভেসে বেড়ানো নিয়েও রয়েছে নানা মুনির নানা মত । এছাড়া রয়েছে বাজারে ভ্যাকসিন আসা নিয়ে নানারকম প্রচার। যে কোনো নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও নানা ধাপ পেরিয়ে তা বাজারে আসার প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘমেয়াদি। পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে এগিয়ে আনা কি আদেও সম্ভব ? 

শেষ নয়

এখানে একটা কথাই বলার , যে , এই জগতে কিছু নিত্য ঘটনা ছাড়া সব কিছুই অনিশ্চিত, তা জানা সত্ত্বেও এতো কিছুর আয়োজন তো আবহমান কাল থেকে চলে আসছেই। কোন কিছুর জন্যই জীবন থামে না, জগত থামে না । এগিয়ে যেতেই হয়। একদিন সব শেষ হবে জানি সবাই .... কিন্তু তা বলে শুরুর কথা ভাববো না তা কি হয় ??  

   আজ বেশ অনেকদিন হয়ে গেল , লকডাউন চলছে । আমরা অনেক কিছুই শিখলাম , জানলাম , স্বনির্ভর হলাম। যে কোন বিষয়ের দুরকম দিক থাকে-ই , এখানে-ও কোনো ব্যতিক্রম নেই। নেতিবাচক দিক সত্যিই ভয়ঙ্কর ও তার ব্যপ্তি বিশ্বজনীন। ইতিবাচক দিক-ও আছে । আমরা তা বুঝতে পারছি, কিন্তু মন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আতঙ্ক, তাই ইতিবাচক দিকের প্রভাব বিস্তার সুদূরপ্রসারী হচ্ছে না।

আপেক্ষিক ভাবে আমরা বেশ অসুবিধায় থাকলেও , এখন অনেকটাই ধাতস্ত হয়েছি। কষ্ট কি হচ্ছে না ? নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। অগত্যা। অনেকেই এখন নিরূপায় হয়ে সহকারিনী ডেকে নিয়েছেন।আমরা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক, আর ক'দিন টানতে পারি !!! 

তবে এই সুযোগে নতুন করে প্রকৃতি কে চিনলাম, জানলাম। দেখলাম যে , সে প্রতিদিন প্রাণে আসে নব নব রূপে। মন , প্রাণ ভরিয়ে দেয়। জীব জগতের উচ্ছাস দেখলাম মানুষ বাদে অন্যদের মধ্যে। কলকাকলিতে মুখরিত সকাল। তাদের ঘরে ফেরার গান আবার শুনি গোধূলি বেলায়। মাঝের সময়ে-ও তারা চারদিকে তাদের উপস্থিতি জানান দেয় নানাভাবে।ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া টিয়া, বক আরো নাম না জানা কতো শতো পাখি। 

নতুন ভাবে যোগাযোগ হলো পুরোনো সকলের সাথে, আলাপচারিতায় নতুন সম্পর্কের স্থাপনা-ও হলো। সকলে নিজের ছাড়াও আর সকলের খবর নিলাম। পুরোনো ফোন নম্বর খুঁজে , ডায়াল করা হোলো কতো ক্ষীণ হয়ে আসা যোগাযোগের উৎসে। নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালো লাগার বিষয়কে ফিরে দেখলাম।পুরোনো সেই কৈশোর, কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক ভেসে এলো কোন সুদূর হতে ? 

না পারা বিষয় ও কম পারা বিষয় কিছু টা হলেও আয়ত্তে এলো । আমার ক্ষেত্রে অনেকটা-ই আয়ত্তে এলো রুটি তৈরি, জীবনে প্রথম থোড় কাটলাম ( দেখলাম কঠিন নয় একদমই ) , এ্যঁচোড় কাটলাম ( এটা একটু মুশকিলের , কিন্তু it's ok ) । ইচ্ছে আর চেষ্টা থাকলে বোধহয় অনেকটাই এগোনো যায়।

এখন শুনছি সবার কাছে, এই বিপদ নিয়েই পথ চলতে হবে। সে কথা আভাসে ইঙ্গিতে বেশ কিছু দিন ই পাচ্ছিলাম... যখন কম না হয়ে বেড়েই চলেছিল ভাইরাসের আক্রমণ । এখন আমাদের হাতে আছে শুধুমাত্র সাবধানতা অবলম্বন । তাকে পাথেয় করা সহজ নয় ঠিক‌ই , কিন্তু তাকে নিয়ে-ই আমাদের চলতে হবেই, উপায় যখন নেই । যা যা বারণ তা না করে , যা করণীয় তা করে জীবনযাপনের অভ্যাস করতে হবে। পরিচিত অনেককেই দেখেছি , সর্বক্ষণ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকতে । আতঙ্ক নিয়ে সব সময় আলোচনা কিন্তু খুব ক্ষতিকর নিজের জন্য তো বটেই । আসেপাশের মানুষ জনের জন্য-ও বটে। তাই চোখ খুলে রেখে, সাবধানতা অবলম্বন করে পথ চলতে হবে। আর আমরা অভ্যাসের দাস। ঠিক এগিয়ে যেতে পারবো। অনেককেই হারালাম আমরা, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, এগিয়ে চলেছে। অনেক অসুবিধা সত্ত্বে-ও জানি আমাদের অনেকের থেকে আরো অনেক সমস্যায় রয়েছেন বহু মানুষ .... । 

কোনো অসুবিধায় ভেঙে পড়লে, মা সব সময় বলতেন আরো খারাপ পরিস্থিতিতে যারা আছেন, তাদের কথা। সত্যি বলতে কি মনে বল পেতাম। এখন মা আর সাহস যোগাতে পাশে নেই,..... "সময় তো থাকবে না গো মা, কেবলমাত্র কথা রবে"..... খুব সত্যি কথা । সেই সময় না থাকলেও, কথা রয়েছে ... তা সাহস যোগায় এখনো। 

এক আত্মীয় , একদিন এখানেই লিখেছিলেন, খুব আনন্দে আছিস ... এর উত্তর হ্যাঁ-বাচক ও , আবার না-বাচক ও । ভালো আছি অনেকের থেকে আর আনন্দে নেই , কারণ চিন্তামণি কাছে ই রয়েছে। খুব কাছের যারা তাদের কাছে বলে একটু হালকা হ‌ওয়া যায়। এই আর কি !!!! সে চিন্তা আমার নিজের কাছেই থাক না। চিন্তা ছড়িয়ে কি কোন লাভ আছে ? আনন্দ ছড়ালে , তা যদি একটু-ও ছড়িয়ে পড়ে ক্ষতি কি ? 

#আমরাকরবজয়নিশ্চয়


@শুচিস্মিতা ভদ্র

 গরমের সব্জি বাহার


আমাদের দেশে ছয় ঋতুর ভাগ যোগ যাই থাকুক না কেন , মোটামুটি তিন ধরনের আবহাওয়ার আবেদনই প্রবল । আর তা নিয়েই চলে আমাদের নানা নিবেদন । তো সেই তিন মূর্তি হলেন গলদ ঘর্ম গরমকাল , ঝমঝমে-ছিটেফোঁটা বর্ষাকাল আর সোনা রোদ আর লেপের ওম মাখানো শীতকাল। 

      শীতকালীন সব্জির রকম বাহারের পর গরমকালের সব্জি নিতান্তই ঝিম ধরা ধরনের। শীতকালীন সব্জির কথায় চোখের সামনে সারি সারি রঙীন সব্জির ছবি ভেসে ওঠে , সেখানে গরমের সব্জি একদমই সংখ্যালঘু দলের । কিছু কিছু আইটেম কমন পড়লেও , শীতকালের উপস্থাপনা আর গরমের উপস্থাপনার বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতন । গরমকালের সব্জির নামও বিশেষ সুবিধের নয় । ঝিঙে , পটল , ঢ্যাড়স গরমের বাজারের হিট আইটেম, কিন্তু হট্ ফেভারিট কি ?? আসলে নামই হট হ‌ওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় !!!! পটল ব্যাপারটার নামে না যাওয়াই ভালো , কেমন একটা পটল তুলেছি এমন ফিলিং হয়। তবে হাল্কা ঝোল , তেল গরগরে রান্নায় পটলের নাম ডাক মোটের ওপর ভালই। 

  বিয়ের পর আমার নতুন ঠিকানায় আসার পর , বাবা বললেন যে পটল দিয়ে ডালনা ছাড়া কি বা এমন হয় ?? হয় কিন্তু !!!! আর সে সব খেলে পটল তুলছি , এমনও মনে হয় না । আমার মা , নিজের পরিচিত দেশোয়ালি রান্না ছাড়াও যখন তখন যে কারো কাছ থেকে নতুন রান্না শিখে , তার সাথে নিজের পছন্দের আরো কিছু যোগ বিয়োগ করে , একটা দারুণ ব্যাপার বানিয়ে ফেলতেন । আর তখন সেই আটপৌরে রান্নার পদোন্নতি ঘটে যেত । 

         তো কথা হচ্ছে পটল নিয়ে , পটল চেরা চোখের যেমন কদর , পটলের আদরও নেহাত কম নয় । আর সত্যিই নামে কি বা এসে যায় বলো তো ?? পটল ভাজা যেমন মাঝখান চিরে হয় , আমাদের জেঠিমণির( জেঠিশ্বাশুড়ি) থেকে একটু আর্টিস্টিক ভাবে পটল কাটা শিখেছিলাম ভাজার জন্য। গোটা পটলের খোসা অল্প অল্প কেটে দুই পাশ থেকে তেরছা করে কাটতে হবে , একটু গ্যাপ রেখে রেখে , অথচ পটল থাকবে গোটা , লালচে করে ভাজার পর পুরু পাতার মতন দেখাবে । কি দারুণ না ??? এছাড়াও পটল পোস্ত , পটলের তেল ঝাল , নারকেল পটল , দৈ পটল , পটলের নিরামিষ দোলমা , পটলের আমিষ দোলমা , পটল আলু দিয়ে হাল্কা কালো জিরে ফোড়নের ঝোল , পটল আলুর গামাখা চচ্চড়ি , গামাখানো ডাল(মুগ)পটল , সরষে পটল , পোনা মাছের ঝোলেও পটল দেওয়ার চল্ আছে আমাদের (কালো জিরে /সাদা জিরে উভয়েই)ইত্যাদি প্রভৃতি । 

      শীত চলে যাওয়ার মুখে এদের নাম যাই হোক না কেন ? দাম কিন্তু মোটেই ফেলনা না । আর যারা দামেই দাম দেন বা দম দেন তারা এই সময়েই বাজারের ব্যাগ বাগিয়ে এদের ব্যাগস্থ করে ফেলেন। কারণ আসল সময়ে তাদের লিস্টিতে তখন শীতকালীন মূল্যবান সব্জির লাইন !!! আমি সময় মতন আর পকেট বুঝে বাজারে বিশ্বাসী ।আরও একটা বিষয়ে বিশেষ নজর রাখি .... সময়ের সব্জির স্বাদ অসময়ে যে মাইনাস হয়ে যায় , সেটা মানি । যদিও সারা বছরই এখন সব সব্জি পাওয়া যায় !!! তবে এই গরমের সব্জি দিয়ে সুক্তো , তেতো , সজনে ডাটা-কুমড়ো-লালআলুর কম্বিনেশন ,ঝিঙে পোস্ত, ঢ্যাড়স ভাজা , ঢ্যাড়স-কুমড়োর চচ্চড়ি , সর্ষে ঢ্যাড়স, কাঁচা আমের টক ... আহা !!! শুনেই মন আর পেট কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । কাঁচাপোস্ত বাটা পেট ঠাণ্ডা করে আর তা কাঁচা লঙ্কা ও সর্ষের তেল দিয়ে মেখে নিলে তো মনও ঠাণ্ডা !!! তাই না বলো ??? আরো আছে বিস্তর !!! 

   তবে আমরা যারা ভোজনরসিক, তারা কি শীত , কি গ্রীষ্ম , কি বর্ষা .... যাই হোক , যেমনই হোক খাবারের উপকরণ পেলেই হলো , উপকরণকে উপাদেয় করে নেবার দায়িত্ব নিতে ভয় পাই না । উপকরণ অল্প হলেও ক্ষতি নেই , তা নিয়েও গল্প লিখে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই কো । পেট কা সাওয়াল হ্যায় না ??? খাবার জন্যই তো অনেক কিছু ... সবটা নয় নাই হোলো । কি বলো তোমরা ????

                                 রোজনামচা

                              শুচিস্মিতা ভদ্র 

" একটু বেরিয়ে পড়লে কি খুব সমস্যা হবে ?" .... রিক্তার আকুলতা প্রলয়ের দৃষ্টি এড়ায় না । কিন্তু এই লকডাউনে বেরিয়ে পড়া উচিত না অনুচিত সেই নিয়ে মনের দ্বৈরথে প্রলয় নিজেও যথেষ্ট বিব্রত। বিগত কয়েক মাস ঘরের চার দেওয়ালে কাজের বোঝা , একঘেয়েমি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। 

অতিমারির অভিজ্ঞতা কারোর নেই । প্রলয়ের বাবা, মা ও দুই দাদা থাকে হাওড়ার কদমতলায়। সেখানেও যাওয়ার উপায় নেই। কতদিন আদরের দুই ভাইঝি তিথি আর মিঠিকে দেখেনি !! ওয়ার্ক ফ্রম হোমের গেরোয় জীবন জেরবার। সে একটা বেসরকারি ফার্মে কর্মরত। বাড়িতে বেশ আনন্দে, নিশ্চিন্তে আছিস .... এমনটা যারা বলছে , তাদের হাতের কাছে পেলে , প্রলয় যে কি করতো !!! 

রিক্তা গৃহবধূ , কিন্তু সে একমাত্র সন্তান। এই পরিস্থিতিতে বাপের বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। বাপি ও মামনি সব সামলে নিলেও মেয়ে কে বিয়ের পর এতোদিন না দেখে থাকেন নি। রিক্তা র ও মনে জমেছে নিরূপায়ের মেঘ। আনলক ওয়ান এরপর একদিন অল্প সময়ের জন্য নামমাত্র দেখা করে এসেছে। মন ভরেনি। কিন্তু বয়স্ক মা , বাবার বিপদের আশঙ্কায় মনকে বুঝিয়ে নিয়েছে। ভিডিও কল-ই এখন ভরসা। নানারকম কাজে বেরনো পুরোপুরি বন্ধ। আগে মনে হোতো বাইরে এতো কাজের থেকে একটু ছুটি মিললে ভালো হয়। কিন্তু এখন !!! সবার মনে একই প্রশ্ন .... এই ছুটি শেষ হবে কবে ?

" সেটা ই বুঝতে পারছি না। মা তো ও বাড়িতে যেতেও বারন করছে। কি যে চলছে !! আর এতো বাড়ছে .... কি ভরসায় বেরবো ? " .... প্রলয়ের উত্তরে রিক্তা নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়। 

" কিন্তু আমি তো কারো বাড়িতে যাওয়ার কথা বলিনি আর ও বাড়িতে এখন যাবোই বা কি করে ? ওটা তো কনটেনমেন্ট জোন । আমি মিকিকে নিয়ে চিন্তিত। ওর আচরণ তুমি কি লক্ষ্য করেছো ? " 

প্রলয় , একটু অবাক চোখে তাকায় !! 

" কেন ? এর মধ্যে আবার মিকি এলো কি করে ? " 

রিক্তা বিষন্ন হাসে " আসবে কেন বুলু (প্রলয়ের ছোট ডাক নাম ) ? ও তো প্রথম থেকেই ছিল । একই ভাবে , একই ঘরবন্দি জীবনে। বাধ্যতা বোঝার বয়স কি ওর হয়েছে ? আমরা বুঝেও বুঝতে চাইছি না। ও কি করবে ?" 

" কিন্তু ভিকু তো আছে , ওর খেলার সাথি ।" .... প্রলয়ের উওরে এবারও রিক্তা করুণ হাসি হাসে , প্রলয়ের কাছে আসে ল্যাপটপ টেবিলের কাছে , পাশে দাঁড়িয়ে প্রলয়ের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটে, বলে .... " সব কিছু কি ওমন নিয়ম অনুযায়ী হয় ? একজন বন্ধু ছাড়াও , ওর আরো কতো বন্ধু আছে ভাবো একবার .... স্কুলের, পাড়ার, ফুটবল ক্লাবের। আর যতোই যা হোক ভিকু তো কুকুর !!!!

ভিকুর সাথে সারা দিন গল্প, খেলা , ঝগড়া চলে মিকির । সাথে আদরের পর্বও চলে। কিন্তু ইদানীং মিকি র গরম মেজাজের তাপে ভিকুও বেশ নিরানন্দ জীবন কাটাচ্ছে। একে রোজনামচায় পরিবর্তন হয়ে ইস্তক তার মন মেজাজ বিগড়ে আছে , তারপর মিকির আদরের বহরটা ও ইদানীং কমে গেছে। এসব কথা যে ভিকুকেও ভাবিত করেছে ..... তা ওর চুপ করে সামনের দুই পায়ে মাথা রেখে শুতে দেখলেই ..... রিক্তার কেন জানি এসবই মনে হয়। 

পাড়ার মাঠের হৈচৈ , এখন নৈঃশব্দ্য বুকে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। একের পর এক , ছোট থেকে বড় দের খেলা , আড্ডা, গল্প সব যেন মৌন ব্রত অবলম্বন করেছে । 

এই আলোচনার পর আরো বেশ কদিন পেরিয়েছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের চাপে , বিষয়টা নিয়ে ভাবার অবকাশ মেলেনি প্রলয়ের। সকালে ঘুম থেকে উঠে, রোজনামচার পর ই লগইন করে সেই যে অফিস শুরু হয় , কোন কোনো দিন, বিশেষ করে যেদিন বাজার যেতে হয় জলখাবার খাওয়া হয়ে ওঠে না। লাঞ্চ ব্রেক পেতে পেতে ৩ /৪ টে হয়ে যায়। আর লগআউট করতে করতে হয় ৭.৩০ । তখন আর অন্য কিছু ভাবার ইচ্ছে থাকে না। আজও লগআউট করার ঘন্টা খানেক আগে, একতলা থেকে রিক্তার চীৎকার কানে আসছিল , সাথে ভিকুর ভৌ ডাক। কিছু নিশ্চয়ই মা-ছেলেতে বেঁধেছে। মিকির কান্না। কি যে করে !! ওই টুকু ছেলে , তাকে-ও সামলাতে পারছে না। একটু বিরক্তি নিয়ে, সামনের ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসে। সবে রাত সাড়ে আটটা। কে বলবে ? চারদিক, সারা পাড়ার রাস্তার যতো টা চোখে পড়ল, সব শুনশান। শুধু প্রতিটা আলোকিত বাড়ি ও ফ্ল্যাট জানান দিচ্ছে, এখনো সকলে জেগে । এখনো অতো রাত হয়নি। তবে সব যেন ভীষণ দম বন্ধ করা পরিবেশ।

 " তুমি এখানে ? সেদিন বললাম মিকির ইদানীং এর আচরণের ব্যপারে, কান-ই দিলে না । জানো আজ কি করেছে ? " .... রিক্তার গলায় উষ্মা চাপা থাকে না । প্রলয় ব্যালকনি র রেলিংয়ে ভর দিয়ে রাস্তা দেখছিল , ঘাড় ঘুরিয়ে রিক্তার দিকে তাকায়, রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট এর মৃদু আলোয় , ভালো দেখতে পায় না, বিরক্তি একটু বাড়ে ..... " ওই টুকু ছেলে , কি আবার করবে ? সারাদিন ঘরে থেকে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মানছি এভাবে ভালো লাগে না, বাপি , মামনির কাছে যেতে পারছো না । তা সেই ফ্রাসট্রেশনে মিকির ওপর রাগারাগি করবে ? ৭ বছরের একটা ছোট্ট শিশু কে সামলাতে পারছো না ? তুমি কি সাংঘাতিক জোরে চীৎকার করছিলে জানো ?? ভিকু পর্যন্ত ভয়ে চীৎকার করছিলো।" 

" তোমার বলা শেষ হয়েছে ? আমি কিছু বলি এবার ? "... ঠাণ্ডা গলায় রিক্তা বলে । প্রলয় উত্তর দেয় না। রিক্তা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শুরু করে .... " আমি কি পারি আর কি পারি না , তার কৈফিয়ত আমি এই মুহূর্তে দেবো না , কারণ এখন সব বিচার করার মতন অবস্থায় তুমি নেই , আমি জানি তুমি এতক্ষণ অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলে। বাট্ ফর ইয়োর কাইণ্ড ইনফরমেশন, জানিয়ে রাখছি , আমাদের একরত্তি মিকি র একটা খেলনা নিয়ে ভিকু খেলছিল , সেটা দেখে মিকি প্রথমে ভিকুর খেলার একটা লাল বল পিটিয়ে নষ্ট করেছে , তারপর ভিকুর লেজ পেঁচিয়ে ব্যাথা দিয়ে তাকে শাস্তি দিচ্ছিলো।" .... কথা শেষ করে রিক্তা দাঁড়ায় না। 

প্রলয় ঘুরে দাঁড়িয়ে, রিক্তার চলে যাওয়া দেখে । হতবাক হয়ে যায় ঘটনা শুনে ।

" সরি রিক্তা। "..... প্রলয়ের কথায় রিক্তা কোন উত্তর দেয় না। এমনকি সে যেভাবে মিকিকে জড়িয়ে শুয়েছিলো , সেভাবেই শুয়ে থাকে। প্রলয়ের কথায় আজ তার রাগের থেকেও দুঃখ হয়েছে বেশি। সাংসারিক অনেক ছোটখাটো সমস্যা সে নিজেই সমাধান করে নেয়। আর অনেক ক্ষেত্রে প্রলয়ের মতামতের জন্য তাকে জানাতেই হয়, প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, পরে সব শোনে , পরামর্শ দেয়। কিন্তু এভাবে সরাসরি দোষারোপ করতে দেখেনি। যদিও এই পরিস্থিতিতে সবাই বিরক্ত , সে বোঝে , কিন্তু তাকেও তো কেউ বুঝবে ? বিশেষ করে প্রলয় বুঝবে না তাকে ? অজান্তে ই চোখ ভিজে যায়। 

সকাল থেকে কাজের মাঝে খেই হারিয়ে, আবার যখন সমে ফেরার ফুরসত মিলল , তখন রিক্তার খেয়ালে মিকি আর ভিকুর নির্ধারিত জায়গায় অনুপস্থিতি ধরা পড়লো। গেলো কই ? আবার কি বাধালো দুটোতে ? এসব ভাবতে ভাবতেই ছাদের সিঁড়ি তে পা দিল। ছাদের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘর আছে । পুরনো জিনিসপত্র রাখা হয়। ইদানিং ভিকু আর মিকির গোসা ঘর-ও বটে , আবার খেলাঘর-ও বলা যায়। যতটা সম্ভব চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকল রিক্তা। ছাদের ঘরে চুপিচুপি উঁকি মেরে প্রথমে কিছু ই নজরে এলো না , পরে আরো মুখ বাড়িয়ে দেখল যে মিকি মাদুরে অঘোরে ঘুমিয়ে, আর তার পায়ে মাথা রেখে ভিকু ও ঘুমিয়ে কাদা। ওই জন্যই সাড়া নেই। অনলাইন ক্লাসের পর কখন দুটোতে এখানে এসে ঘুম দিয়েছে , তা রিক্তা জানতেও পারেনি। ঘরে ঢুকে,আসতে ধীরে ওদের পাশে বসে। কেমন অসহায় ভঙ্গিতে দুজনে ঘুমিয়ে আছে , মনটা ভালোলাগায় থৈথৈ হয়ে যায়। হঠাৎ চোখে পড়ে, মাদুরের একপাশে একটি পুরনো খাতা , মিকির পেনসিল বক্স চাপা দেওয়া। খাতাটা হাতে নিতেই ভিতর থেকে পেজ মার্ক দেওয়া স্কেলটা বেরিয়ে পড়ে। রিক্তা খাতাটা খোলে ..... মিকি মাঝেমধ্যে অনেক আগডুম বাগডুম লেখে , কখনো বাবাকে দেখায় । মাকে ও কখনো বা। রিক্তা বারণ করে না , লেখা যেমনই হোক, এই অভ্যাস ভালো ই । আর এখন মিকি মোটে ৭ বছরের। কি বা লেখার বয়স ? 

 " একি ? এভাবে এ ঘরে বসে আছো কেন ? ওরাই বা এখানে ঘুমোচ্ছে কেন ? " .... প্রলয়ের প্রশ্নে চমক ভাঙে রিক্তার। " কিছু বলছ ? " - - জানতে চায়। প্রলয় , এগিয়ে আসে , বসার সময় নেই । হঠাৎ কারো সাড়া না পেয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওপরে উঠে এসেছে । এভাবে ওঠা যায় না, লগ আউট করাও যায় না , করেও নি , হঠাৎ খুব শান্ত, শব্দ হীন বাড়ির বাতাবরণে ঘাবড়ে গিয়েছে সে। এমনিতেই সেদিনের পর থেকে রিক্তা একটু দূরে দূরেই থাকছে। খুব অভিমানী সে। আজ থেকে তো নয়, সেই কলেজের সময় থেকেই তো রিক্তা তার চেনা।

খাতার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে মিকির শিশু মনের ভাবনা। কিন্তু তাতে রিক্তা আর প্রলয়ের এতো চিন্তা কেন ? আসলে সেই ভাবনায় থাবা গেড়েছে বিদেশী ভাইরাস। ওতেই বাবা ও মা ভয় পেয়েছে। সেদিনের মিকির ভিকুকে শাস্তি দেওয়ার মূল কারণের আভাস-ও আছে ওই লেখার মধ্যে। দুজনে বল নিয়ে খেলছিল , আসলে টেলিভিশনের কল্যাণে সবার জানা করোনা ভাইরাসের আকার বলের মতনই গোলগাল। কাজেই ভিকুর একটা বলকে করোনা বলে চিহ্নিত করে নষ্ট করা নিয়ে ভিকুর সাথে আগাম আলোচনা করা সত্ত্বেও, ভিকু নিজের বল ফেলে মিকির বল নষ্ট করেছে ....তাই শাস্তি। আর মা তো মিকিকে বলেই যে কান মুললে খুব ব্যাথা লাগে , তাই তো ভিকুর লেজ মুলেছিল, আর তাতে ভিকু এতো চীৎকার করলো , মা এসে গেল আর ভিকুর জন্যই বকুনি, মার সব জুটলো !!!! 

" আমরা সবাই কি পাগল হয়ে যাচ্ছি রে ? " .... প্রলয়ের প্রশ্নে আলয় , প্রলয়ের দাদা , কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে, ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর দেয় " এই পরিস্থিতিতে সবাই কমবেশি অবসাদগ্রস্ত। কিন্তু কাটাতে হবে আমাদের ই । কবে কি হবে , সবার অজানা। অতি ভয় যেমন খারাপ, অতিরিক্ত ক্যাজুয়াল অ্যপ্রোচ-ও ক্ষতিকর। বেরিয়ে পড়্ ওদের নিয়ে। ঘুরে আয়। বিপদ বাড়িতে বসেও হতে পারে। বরং সাবধানতা অবলম্বন করে বেরিয়ে পর একটু। ইমিউনিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। সেটা তো ঘরে বসে থেকে পুরোপুরি গোল্লায় যেতে বসেছে। "

" বলছিস ? রিক্তা একদিন বলছিল রে । কিন্তু .... " প্রলয়ের কথা থামিয়ে আলয় বলে .... " ঠিকই বলেছে । ছোটদের মনের খোঁজ কে রেখেছি বল ? ওরা কোনো কিছুই ভালো করে বুঝতে পারে না। এখনকার বাচ্চাদের সমস্যা টা কি জানিস ? অনেকটাই জগাখিচুড়ি ধরন । " 

" মানে ? এখন আর তখন ... প্রলয় আবারও বাঁধা পায় .... " তুলনা আসেই রে বুলু । আমরা বড়দের ব্যাপারে কিছুই বুঝতাম না, সেই সময়-ও ছিল না। ভাব একবার , সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুল , ফিরে জামা বদলে খেলার মাঠ, দেরি করলে বাবার পিটুনি আর তারপর পড়াশোনা করে খেয়ে , আবার ঘুম । এর মধ্যে বাবা, মা , কাকামণি, কাকিমা, পিসি সকলেই ছিলেন, কিন্তু তাদেরকে নিয়ে বা তাদের বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল কি ? যতটুকু দরকার ছিল, তাতেই যোগাযোগ । কাকামণির কাছে ঘুড়ি ওড়ানোর দরকার, পিসির কাছে আবদার...মায়ের কাছে-ও বাবার থেকে কোন সম্মতি আদায়ের বায়না.... এসব ওরা পায় কোথায় ? আমাদের বাড়ি তো ছিল হট্টমালার রাজ্য। যাক ওসব ভেবে লাভ নেই রে , এখনকার সময় অনুযায়ী ওদের সামলাতে হবে। ওরা থাকে পাকাদের ঘিরে , পাকাদের মানে আমাদের মাঝে । তাই বুদ্ধি না পাকলেও , পাকামোর ছোঁয়া লাগে , ওদের বুদ্ধি দিয়ে ওদের মতন করে কঠিন বিষয় কে বোঝে , বোঝার চেষ্টা করে.... ওদের পাকা বলে লাভ আছে? আর সেই বোঝার বোঝা নিয়ে আরো বিরক্তি আসে। ওকে সময় দে , একটু খেলা কর, গল্প শোনা, উৎসাহিত করতে থাক ওর পছন্দমত বিষয়ে। নিয়ে বেরো। সাবধান হয়ে বেরিয়ে পড়। ওতেও যে সব আগের মতই হবে তা নয়, কিন্তু কিছু তো হবেই। " 

" বুঝলাম। কিন্তু দাদা একটা কথা বলো দেখি, বেরিয়ে পরার উপায় যাদের নেই, তারা কি করবে ? " 

" দেখ বুলু , সবার সব উপায় থাকে না। আবার কিছু না কিছু তো আছেই। সেই মতনই ভাবনাকে এডযাস্ট করতে হবে। তুই ফুটপাতের বাচ্চাদের কখনো মন দিয়ে লক্ষ্য করেছিস ? ওদের কিছুই নেই। কিন্তু খেলা , খুশি, আনন্দের অভাব নেই। এই প্রতিকূলতার সাথে লড়ছে , আবার কারো ফেলে দেওয়া পুরোনো , ভাঙা জিনিস নিয়ে মজায় খেলছে। তাহলে ? আর আমাদের ছোটরা ও দেখবি অদ্ভুত সব অ-খেলনা নিয়ে খেলে। কাজেই আনন্দ খুঁজে নিতে ওরা আমাদের থেকে অনেক ভালো জানে , আমাদের শুধুমাত্র খেয়াল রাখতে হবে , যে ওদের আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম টা সঠিক কিনা । আর সঙ্গ দিতে হবে। " ..... দাদার কথায় আসস্ত প্রলয় সম্মতি জানায়। 

" মিকি তো কতো ছোট্ট। আমাদের বাড়ির দুটোতে কি কম ঝামেলা করছে ? তবে ওই যে , ওরা তাও দুজন। মিকি তো একা । তোরা তো অন্য কিছু ভাবলি না । এখন যেটা ভাবার সেটা ভাব আর সকলে মিলে সাবধানতা অবলম্বন করে বেরিয়ে পর। দেখবি কতো ভালো লাগবে সকলের। ভিকুর-ও আনন্দ দেখতে পাবি। "

দাদার সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা হয় প্রলয়ের। এবার একদিন মিকির জন্য, নিজেদের জন্য-ও বেরিয়ে পড়তে হবে। সেদিন ফুসফুসে ভরে নিতে হবে বাইরের মুক্ত , সতেজ বাতাস। তা জীবাণুমুক্ত কিনা , এই মুহূর্তে সত্যিই তা ভাবতে রাজি নয় প্রলয়। প্রলয় এখন একটু বেরিয়ে পড়ার ভাবনাতেই মাতোয়ারা, বেরলে না জানি কি হবে ?? ভালো-মন্দ যাই হোক , রোজনামচায় একটু তো অন্য রকম হবে .... । প্রতিদিনের এই আতঙ্ক থেকে একটু হলেও তো প্রাণ ভরে বাঁচবে !!!! তাই বা কম কি ????? 

 নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ আছে । তার মধ্যে শারীরিক কিছুর ব্যাপার এবার শীতে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম...এখনো পাচ্ছি । নানাবিধ ব্যাথায় যারপরনাই কেলান্ত হয়ে পড়েছি বটে । সে.....ই পূজোর পর পর কানের কনকনানি পর্ব শেষ হতে না হতেই ঠাণ্ডা কাল সাথে নিয়ে এলো হাড়ে হাড়ে ব্যথার আলিঙ্গন। কি আপদ !! কি বিপদ !! বেতো রুগীর মতন সর্বাঙ্গে ব্যাথা ... মনে পড়ল ঠাকুমার ঝুলির সেই সব রাজকন্যেদের কথা , দুষ্টু রাণীদের কথা , যাদের কিনা হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম ছিল । তবে সেখানে তা সারাই করতে প্রাণপাত করত রাজকুমার অথবা স্বয়ং রাজা মশাই । এখন সে রামও নেই, সে রাজ্যও নেই । ইনি একদমই প্রবচনের রাম,নিদেন পক্ষে রামায়ন খ্যাত শ্রী রাম চন্দ্র, কিন্তু কদাপি রাজনৈতিক নয়কো🤫।

তো যা বলছিলাম, মনের ব্যথা, মাথার ব্যথা, পেটের ব্যথার ও কানের ব্যথার পর নতুন সংযোজন হাড়ের ব্যথা । মাথার ব্যথার এক ধরনের কারণে সেই ছোটকালে চশমা ধারণ করতে হয়েছিল । আরো অনেক কারণ সমুদ্রে সে তার অংশের কাজ করে চলেছে , সেই থেকে । আমার কর্তার মতে মাথা থেকে ব্যথার গতি যখন নিম্নগামী তখন তা শিগগিরই দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে ...নামতে নামতে । এ সব কথায় বড়ই ব্যথা পাই মনে .... । 

শুরুর দিকে মাথার ব্যথার কার্যকারণ পরম্পরা শোনার পর আমার কর্তা মশাই, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিজের অপারগতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন, বলেছেন এতো রকম বেরকম কারণের দামী মাথা ব্যথার উপশম করার ক্ষমতা তার কেন ? কারও নেই কো 😟 !!! 

চোখের জ্যোতিও স্বাভাবিক নিয়ম মেনে কিঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত, তাই নাকের ওপরে চশমা না আঁটলেই অক্ষর কেন পিপিলিকার সাথে তুলনীয় .... একদম পোস্কার বুঝতে পারি ইদানিং।

কিন্তু এবার পুরো হাতে হ্যারিকেন কেস, করতেই হবে ফেস।

সামনেই জন্মদিনের হাতছানি , এরই মধ্যে বেশ ওজনদার আর বিখ্যাত মানুষ জনের হাড়ের ব্যমো হাতে এসেছে উপহার স্বরূপ। any guess ?? পারলে না তো ?? টেনিস এলবো ... আহা কি ঝম্পেস একখান্ নাম বলো দেখি !!! কর্তা মশাই আন্দাজ করছিলেন , তাও জুনিয়র বন্ধুর কাছে দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে কেমন যেন চিন্তিত হলেন , বলতে নেই, দেখে মনের ও হাতের দুই ব্যথাই কেমন যেন কম কম লাগল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে !!!

 বিখ্যাত খেলোয়াড়দের এমন হয় বল পেটাপেটি করে , অনেক কসরত করে অর্জিত , আমার কেন হলো ক্যায়া মালুম ?? ফোন টেপাটেপি করে ??? অতএব ফোনে মন দানকারী মহিলা মহল(?) সাবধান!! সাবধান!! সাবধান!!

দুষ্টু লোকের ধারনা অনুযায়ী ওই কাজটি খুব মন দিয়ে করে থাকি আর বাকি কাজের জন্য তিনি স্বয়ং আছেন with আম গায়ের লোক ( আম আদমি 🤫রাজনৈতিক নয়কো🙏) ।

হাতের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আরো এক অঙ্গ সঙ্গ দিয়েছে , কিন্তু তার কথা পরে একদিন বলব । হাতের একখান গয়নাও শিগগির হাতে আসবে , তাতেই নাকি ফল পাবো হাতে নাতে .... দেখা যাক.... দিল্লী আভি দূর হ্যায় ।।

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ( যুক্ত )

শুচিস্মিতা ভদ্র 

বেড়ানোর ইতিবৃত্ত 

বেড়ানোর একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে ... কতশত অচেনা মানুষ ক্ষণিকের জন্য চেনা হয়ে যায় ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে এই বিষয়ক ... "এই যে পথের এই দেখা , হয়তো পথেই শেষ হবে ..... তবুও হৃদয় মোর ভাবে সঞ্চয় কিছু যেন রবে .... ক্ষণিকের এই জানা শোনা ... স্মরণে করে যে আনাগোনা ..... " 🎶🎶🎶🎶.... এমনটা জীবনের পথ চলতে গিয়েও হয় আর তারই সংক্ষিপ্তকরণ হয় বেড়াতে গিয়ে। এই স্বল্প পরিচিত মানুষের কাছ থেকে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যে আমরা সমৃদ্ধ হ‌ই। 

অপরিচিতকে পরিচিত করতে আমার কন্যার জুড়ি মেলা ভার। একবার জামসেদপুর বেড়িয়ে ফিরতি ট্রেনে উঠে, সিটে বসেই পুপের প্রথম প্রশ্ন ... "আচ্ছা মা , ওরা কারা ( আমাদের সামনের যাত্রীদের নির্দেশ করে ) ? চিনতে পারছি না তো !!!!".... বোঝো কাণ্ড !!! দুনিয়া শুদ্ধু সবাইকে যে চেনা যায় না , তা সে মানতে নারাজ। একে জীবন জুড়ে চেনা মানুষই হঠাৎ হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যায় কারণে, অকারণে ,সামান্য কারণে !!! তো এভাবেই যাত্রা পথে আলাপচারিতায় মনোনিবেশ করে আমার কন্যা। দিনকালের হালহকিকত বেশ ঘোরালো , তাই আমাকেও ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করে কন্যার পাহারাদারী করতে হয়। 

বনে থাকে বাঘ

একবার আমরা নর্থবেঙ্গল গিয়েছি। ঘোরা ফেরার মধ্যে চা বাগানে হাজির হয়ে , অনেক ছবি তোলার পর ফেরার পথে গল্প জমে উঠেছে ড্রাইভার দাদার সাথে । তিনি তার নানা রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছেন । সেবারই জানলাম যে চা বাগানে অজগরের থাকার সম্ভাবনা প্রচুর আর থাকে চিতা বাঘ। বাপ্ রে .... কি সাঙ্ঘাতিক !! এমন তথ্য পরিবেশনের পর জানলাম যে এ তথ্য আমার কর্তা মশাই এর অজানা নয়কো ।এদিকে ছবি তোলার সময় তো ওখানেই ভয়ানক ভাবে সিধিয়ে গিয়ে ছবি তুলেছিলাম !!! সতর্ক করার কথা মনে ছিল না তো। নাকি তিনি ভেবেছিলেন তেনারা আমাকে পাত্তাই দেবে না ??? নাকি আমি ওনাদের থেকেও ভয়ানক !!!!

লাটাগুড়ির জঙ্গল সাফারিতে কিছুই দেখলাম না । কিন্তু গল্পের গরু থুড়ি চিতা বাঘকে গাছে উঠতে শুনলাম। তা হয়েছিল কি ... জিপ সাফারিতে পর পর জিপ ঢুকছে জঙ্গলের অন্দরে ... ময়ূর দেখে উৎফুল্ল হবো কিনা ভাবছি , কারণ আমার সহকর্মী সঞ্চিতাদি বলে দিয়েছিলো যে , জঙ্গল ভ্রমনে প্রথম ময়ূর দর্শন নাকি অপয়া , এমন সময় সামনের জিপের মানুষজনের চাঞ্চল্য নজরে এলো ... একটু অপেক্ষা করে শুনলাম একটু দূরে ঝোপে কিছু নড়তে দেখা যাচ্ছে .... কিন্তু তারপর আবার সব চুপচাপ। কিছুই দেখা হলো না... যাত্রা প্রসাদ watch tower এ আমাদের guide নিয়ে গেলই না। ওখানে গেলে কিছু না কিছু দেখতে পেতামই ... এমন guidance পেয়েছিলাম নীলাঞ্জনাদি আর সঞ্চিতাদির কাছে। ফিরতি পথে গরু মারা অভয়ারণ্য থেকে বেরিয়ে খান পাঁচেক গরু দেখতে দেখতে মন ভার করে গেস্ট হাউসে ফিরলাম। 

সন্ধ্যায় বারান্দায় চা , পাকোড়া খেতে খেতে , ওখানকার রাঁধুনির কাছে শুনলাম চিতা বাঘের নাকি দেখা পাওয়া গিয়েছে সেদিন। বেশ আফসোস হোলো , তবে কি একটুর জন্য মোলাকাত হলো না ?? কিন্তু !!! সত্য দা আর আমার কর্তার জেরার মুখে গল্পের চিতা একেবারে চিতপাত হলো , ধরাশায়ী হলো আমাদের গেস্ট হাউসের দোতলার বারান্দায়.... ওই যে ঝোপ নড়েছিল .... সেই ঘটনাই গল্পাকারে ডানা মেলে উড়ে কোথায় যে উড়েছে .... কোথায় যে থেমেছে !! ভেবেই চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ঝোপ নড়ে চিতা শুধু দর্শনই দেন নি ... শিকার ধরে আবার তা টেনে নিয়েও গিয়েছে ..... উফ্ পু্রো বাংলা serial !!! আমাদের কপালে ময়ূর আর হরিণ ছাড়া দেখা মিলেছিল গরুর ... বুঝেছিলাম গরু মারা নাম খানিকটা হলেও সার্থক । না দেখেছি বাইসন , না গণ্ডার , না হাতি !!! আমাদেরই কপাল মন্দ ছিল সেবার। 

বেড়ানোর বিড়ম্বনা

বেড়াতে গিয়ে পথ চলতি motion sickness এ এখন সিদ্ধহস্ত আমার কন্যা। ওকে সামলাতে গিয়ে আমার sickness ফিকে হতে হতে এখন সম্পূর্ণ সেরে গেছে। এখন এমন পরিস্থিতিতে আমি পুপেকে নিয়ে আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গাড়িতে পিছনে বসি , সামনে ড্রাইভারের সাথে খোস গল্পে যোগ দেয় আমার কর্তা।আর মেয়ের ওরকমের sickness দেখা দিলেই মনে হয় আমি আর আমার কন্যা ছাড়া , অন্য সহযাত্রী ... বিশেষ করে আমার কর্তা যেন অপরিচিত । গাড়ি এগিয়ে চলে থামতে থামতে , নামতে উঠতে সময় গড়িয়ে যায় ... । সব রকম টোটকার application চলে । সাধারণ নিয়মে কখনো সে থামে ... টোটকার হাতযশ এই ভাবনা নিমেষে নস্যাৎ হয়ে যায় । আবার চলা শুরু হয়। কিন্তু আমাদের দমাতে পারেনা। চলতে থাকি। হালে হোমিওপ্যাথির হাতযশে কোন কোন বার সমস্যার সমাধান ঘটছে , কোনো কোনো বার সে বেচারাও ফেল করে যাচ্ছে । মালুম হচ্ছে , আমার মতন সময় ও পরিস্থিতির আগমন না হ‌ওয়া ওবধি এ ধারা ফিকে না হয়ে টিকে যাবে .... 

চেক লিস্ট 

 আমার বেড়ানোর গল্পের ঝুলি খুলে দেখতে গেলেই কাহিনীর বাহিনী ঝুলি থেকে বেরোনোর জন্য আকুলি বিকুলি করতে থাকে। তো আমিও তাদের পেশ করি তোমাদের দরবারে।বিয়ে ঠিক হ‌ওয়ার পর , সবার অনুমতি নিয়েই আমাদের দেখা হয়েছিল বৃষ্টি মুখর রথের দিনে। সে অন্য গল্প। আমাদের সেই প্রথম সাক্ষাৎ এর হোতা ছিলেন আমার শ্বশুর মশাই। সেই দিনের আলাপচারিতায় জেনেছিলাম ওপক্ষের বেড়ানোর প্রতি ভালোবাসার কথা। পরে যখন বেড়াতে যাওয়ার স্থান নির্বাচন হলো ... জানলাম বিয়ের পর আমরা দার্জিলিং এ যাব । কিন্তু জগন্নাথ দেবের ইচ্ছা ছিল অন্য। নিয়ে গেলেন পুরী। আসলে রথের সাথে পুরীর যোগাযোগ যে বড়ই নিবিড় ।

তো বেড়ানোর অভিজ্ঞতা , তখন আমার বলতে গেলে negative । এমন সময় , প্রথম ঘুরতে যাওয়ার শুরুতেই দেখলাম , আমাদের দুজনের নামের heading দিয়ে , চটজলদি লিস্টি লেখা হলো। সে অনুযায়ী সব গোছানো ও হলো ... আমি ঘরের একদিকে চুপ করে বসে মুগ্ধতা আর কাটাতেই পারি না..... কিন্তু এ হল প্রথম প্রথম impressive session এর বাজার। এই বাজারে দুজন‌ই দুজনকে উঠে পড়ে impressed করতে চায়। এখন অনেক বছর পেরিয়ে নানা কারণেই depressing session চলে সকলের মতোই। তবে প্রথম অধ্যায়ের মতোই সে ক্ষণিকের....ভাগ্যিস । 

এখনও লিস্টি লেখা হয় , জড়ো হয় সব ... কিন্তু গোছানোর দিন দেখা যায় , বিপরীত চিত্র একজন বড়ো বাজারের গদিওয়ালা মাড়োয়ারির মতো সব জড়ো জিনিসের মাঝে সেই লিস্টি হাতে গদিওমান হন আর তারপরে যা যা জড়ো হয়নি , সে সব আনার ফর্মান জারি হয় ... চলতে থাকে ইয়ে লাও , উয়ো লাও... আর আমি এক মুহুর্ত বসার সুযোগ না পেয়ে সেই সব জিনিস জড়ো করতে থাকি .... ছুটোছুটি কি এ বয়সে পোষায় ? হাঁপিয়েও যাই। কাজেই বুঝলে তো সেদিনের সঙ্গে মিল খুব একটা নেই। কিছু বললে , ওদিক থেকে উত্তর আসে ... " এতো দিনে কি কি শেখালাম, কি কি শিখলে তার পরীক্ষা দাও এবার " .... উফ্ সেই রামায়নের যুগ থেকেই একই রকম চলছে ... পরীক্ষা পরীক্ষা আর পরীক্ষা । কী অবস্থা ভাবো !! আমি যখন মুগ্ধ হচ্ছি, তখন উনি ভবিষ্যতের ভাবনায় আমায় training দিচ্ছিলেন !!!! 

যাক্ সে কথা। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি almost ছোটখাটো একটা সংসার নিয়ে র‌ওনা দিই। যা নিয়েও সঙ্গী সাথীদের মজাদার কথার আদান-প্রদান চলে ... কিন্তু পরে ওই নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জিনিসটা যখন প্রয়োজনের তালিকা ভুক্ত হয় , তখন .... । আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী একবার বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা করে দিতে বলেছিল ... দিলাম । কিন্তু সেই লম্বা লিস্টি দেখে তার কর্তা নাকি বেড়াতে যাবেই না বলে স্থির করেছে। বড়ো দুঃখ পেয়েছিলাম !! কিন্তু কি আর করা !!! 

আগাম আগমন

একবার আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম , সাথে জিনিয়া ও আছে সপরিবারে। ফেরার পথে ঠিক হয়েছে , সিমুলবাড়ি চা বাগানে একটা রাত কাটিয়ে ফিরব। ওই চা বাগানের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রূপক , জিনিয়ার ভাই এর বন্ধু। সেবার আমরা মিরিক হয়ে নামছি , পাহাড় থেকে। কন্যার motion sickness পুরোদমে চালু রয়েছে। এক সময় পথ শেষ হলো। আমরা চা বাগানে রূপকদের কোয়ার্টারে পৌঁছলাম। চারিদিকে সবুজ চায়ের বাগান , মধ্যে কোয়ার্টার। দোতলায় ওরা থাকে। রূপক , ওর স্ত্রী আর কন্যা মিঠি। পুপের থেকে সামান্য বড়ো। ওখানে পাশেই চা processing factory । ওখানে শুনলাম মাঝে মাঝেই রাতে / ভোরে হাতি আসে। দূরে পাহাড়ের রেখা । আর চিতা বাঘও অতর্কিতে আসে , গ‌হপালিত পশু শিকার করে নিয়ে যায়। আমাদের সেদিন রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে NJP থেকে ফেরার ট্রেন। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলাম যে , একরাতের বদলে আরো একটা দিন পেলে দারুন মজা হোতো। রাত ফুরিয়ে ভোর হলেই বেরিয়ে পরতে হবে। তা সত্ত্বেও অনেক গল্পই হোলো। বিকেলের জলখাবার , রাতের ভুরিভোজ খেয়ে ঘুম দিলাম। পথশ্রমের ক্লান্তিতে এক ঘুমেই রাত কেটে গেল। ভোরে উঠে সব গুছিয়ে নিয়ে NJP এর উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে পরলাম। রূপকের স্ত্রী ভোরে উঠে আমাদের জন্য খাবার বানিয়ে দিল। স্টেশনে পৌঁছলাম যথাসময়ে । ট্রেন ও এলো । উঠেই বিপত্তি। দেখি আমাদের সীট নাম্বারে অন্য যাত্রী বসে রয়েছে। আমাদের কাছে e - ticket রয়েছে। তারাও তাদের টিকিট দেখাচ্ছে। এবার বচসা ... তারপর প্রায় হাতাহাতি হ‌ওয়ার জোগাড় !!! সেবার টিকিট কেটেছিলেন আমার ভাসুর । ট্রেন তখনো স্টেশনে দাঁড়িয়ে .... আমি দুবার পরামর্শ দিতে গিয়ে , ধমক ধামক খেয়ে থেমেছি। এমন সময় আমার কথা একটু শোনার সুবুদ্ধি হলো , ফোনাফোনি হলো .... তারপর !!!! হঠাৎ শুনলাম আমাদের অন্য compartment এর টিকিট ... বোঝো !!! এখনি নামতে হবে .... এতোক্ষণ যাদের সাথে বাকবিতণ্ডা হচ্ছিল , তারাই ক্ষমা ঘেন্না করে আমাদের বাক্সপেটরা সব নামিয়ে দিলেন ... একজন ওর মধ্যেই বললেন -- " কি যে করেন ? দেখে উঠবেন তো ? এখনি ছাড়বে জলদি করুন " । কিন্তু .... তাদের মতো আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম আমার কর্তা মশাই এর হেলদোলহীন অবস্হান । আমি আকুল হয়ে বললাম ... " কি গো চলো তাড়াতাড়ি , ট্রেন যে ছেড়ে দিচ্ছে " । চাপা গলায় উত্তর এলো ... " চেপে যাও । আমাদের ট্রেন আজ নয় , কাল " । "এ্যা ? সেকি ?" সমস্বরে আমরা সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম। জিনিয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে বলল .. চলো আমরা ওই tea stall এর পিছনে লুকিয়ে পড়ি। সবাই দেখছে যে " । ট্রেন তখন আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওই কম্পার্টমেন্টের আপামর জনসাধারণ অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে, তারা গালি ,তালি দিতে ভুলেই গেছে !!!এতো অবাক বোধহয় তারা কোনদিন হয়নি। আমরা অগত্যা ওই stall এর পিছনে দাঁড়িয়ে বা লুকিয়ে যাই বলো ট্রেন যাওয়া ওবধি অপেক্ষা করলাম। আসলে আমাদের ট্রেন ছিল পরেরদিন। আমরা আগাম এসে গিয়েছিলাম। দেরির কারণে ট্রেন miss হয় সবাই শুনেছি। কিন্তু আগাম আসার জন্য ফেরা বাতিল হয় ... এমন শুনেছ কেউ ? শুনতেই পারো !!! তবে বেশি যে এমনটা শোনোনি নিশ্চিত। তারপর ?? আর কি সিমুলবাড়িতে আরো একদিনের আনন্দের হাট বসল । আরো একটা গোটা দিন , গোটা রাত কাটিয়ে পরের দিন নির্ধারিত সময়ে ট্রেনে উঠলাম।

বলো দেখি এখন , লাগলো কেমন ?

ভোজন সংবাদ

বেড়ানোর গল্পে , খাওয়ার অংশ বাদ দেওয়া উচিতই নয়। যেখানে আমরা দুই মক্কেলই ভোজন বিলাসী । খাদ্যের পরিমাণে হেরফের অবশ্যই আছে ,কিন্তু ভোজনরসিক দুজন‌ই। কার intake বেশি আর কার কম .... তোমরাই বুঝে নিও কেমন ? ও সব বিতর্কিত বিষয়ে আমি বাবা নেই।তো কথা হলো গিয়ে , বেড়াতে বেরলে আমাদের দুজনেরই ক্ষিদে অনেক বেড়ে যায়। আর কি আশ্চর্য খাবার সব দিব্বি হজম হয়ে যায় !!!! অথচ এই আমারই নিজ শহরে থাকাকালীন হজম নিয়ে হাজারো সমস্যা !!! কারণটা যে কি তা ভগাই জানে ? নিজের রাজ্যে বেড়াতে গিয়ে মনোমতো খাবার নিয়ে সমস্যা নেইকো !!! কিন্তু ভিন রাজ্যে পছন্দের খাদ্য মেলা ভার !! তো আমিষের common কিছু পদ নিয়েই চলতে থাকে ক্ষুধা নিবারণ। মুম্বাইতে মাছ পাওয়া গেলেও , ঔরঙ্গাবাদ ও মহাবালেশ্বরে চিড়বিড়ে মশলাদার চিকেন ও বিরিয়ানি খেয়েছিলাম !!! চোখের জলে ,নাকের জলে ভেসে গিয়েছিলাম। আর চেন্নাইতে তো টক স্বাদের রান্না খেয়ে , কান্না আটকাতে পারিনি !!!

কয়েক বছর আগে , আমার অসুস্থতার কারণে আমাদের বারাণসী যাওয়া বাতিল হ‌ওয়ার পর , মাস তিনেক পরে গরমের সময় গেলাম উত্তরাখণ্ড। ওখানে গরমে পৈটিক গোলযোগের কারণে কিছু লোভনীয় পদ খাওয়ার সাহস করিনি মোটেই। কারণ ... ছোট থেকেই আমি পেট রোগা । স্কুল , কলেজের বন্ধুরা আমার টিফিনের বিখ্যাত চিড়ে সিদ্ধর সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত।সেই গোলোযোগ এখনো থাকলেও , এখন ওই ভয়কে অনেকটাই জয় করেছি... কর্তার অভয় দানে , কখনো বা ওষুধ দানে। খাবারও খাই , ওষুধও খাই... সমান উৎসাহে । একবার দীঘাতে হোটেল "মানসকন্যা" তে খেতে বসে ... সাবধানতা অবলম্বন জনিত কারণে আগাম ওষুধ খেতে দেখে আমার কর্তার বন্ধু পার্থ দা অবাক বিস্ময়ে বলেছিল ... "তুই medicine খেতেও সমান ভালোবাসিস দেখছি"। যা খানিকটা সত্যই বটে । কোন একটা গল্পে যেন পড়েছিলাম ,রোগ হ‌ওয়ার আগেই সারাও ... সম্ভবতঃ শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন সিরিজ। সে যাই হোক ... সে যাত্রায় গরমের গুঁতোয়় হরিদ্বারে রাবড়ি খাওয়ার সাহস করতে পারিনি। আর দুঃখের কথা কাকে বলি !!! ওখানে নিরামিষ খেয়ে মন ভার হয়ে গিয়েছিল। আমরা দুজন ভয়ানকভাবে আমিষের ভক্ত। মুসৌরি গিয়ে দুঃখ খানিকটা মিটবে ভেবেছিলাম... পুরো মেটেনি। ওখানে যে হোটেলে আমাদের বুকিং ছিল , সেই হোটেল বিষ্ণু প্যালেস ছিল নিরামিষ হোটেল। জানতে পেরে কি যে দুঃখ পেয়েছিলাম !!!! বলার নয়। অবশ্য আমরা ওখানে সব সময় খেতাম না .... আমিষ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়তাম । দিনে যাই হোক.... রাতে আমিষ চাই চাই।

  একবার আমরা গিয়েছিলাম , হিমাচল প্রদেশ। সেখানেও এক‌ই দুঃখ। বেশিরভাগ হোটেলই নিরামিষ খাবারের। কিন্তু হিমাচলে আমাদের থাকার হোটেল ছিল আমিষ , কাজেই, সেখানে পৌঁছে সন্ধ্যা থেকেই আমিষ খেয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করতাম। দুষ্টু লোক জন সে সব গল্প শুনে , অনেক কিছুই বলেছে .... হিমাচলের বাজার থেকে ওই কদিন নাকি আমিষ পদের আকাল দেখার সম্ভাবনা হয়েছিল.... ওসবে আমরা কানও দিই নি। পাগলে কি না বলে !!!! তবে আমরা ছাগল ন‌ই কো। মোটেও সব কিছু আমরা খাই না । তো একদিন সকালে জলখাবারে আলুর পরোটা খেয়ে একটু গোলমেলে ব্যাপার হয়ে গেল। সে এক কাণ্ড বটে .... খেয়ে দেয়ে আমরা র‌ওনা দিলাম ... চাম্বা হয়ে খাজিয়ার যাবো। অনেকটা পথ.... ৮০ কিলোমিটার। পথ চলা শুরু হ‌ওয়ার পর পৈটিক গোলযোগের হাল্কা আভাস পেলেও , ওতো গুরুত্ব না দিয়ে প্রাকৃতিক নৈসর্গের দিকে মন দিলাম। কিন্তু..... । একসময় পাহাড়ী পথের বাঁকে , একে একে দোকানপাট পিছনে রেখে আমাদের গাড়ি যখন দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে.... তখন শেষ আশ্রয়ের মতো একটা হোটেলের দেখা পেয়ে .... গাড়ি থামিয়ে নামতে বাধ্য হলাম। উপায় নেই। এমন পরিস্থিতিতে , মায়ের কাছে শুনেছি বাঘকেও ভয় লাগে না !!! লজ্জা , ঘেন্না , ভয় সব একদিকে , আর আমি অন্যদিকে। এখানেও .... "আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা" .... এমন ভাবেই এক‌ই সাথে হাত ধরাধরি করে অচেনা হোটেলে গেলাম বিপদমুক্ত হতে। সাদর অভ্যর্থনা ও পেলাম , সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ জন ... এগিয়ে এসে একটু আগে খালি হয়ে যাওয়া একটা রুম খুলে দিল। সব সময় আমার পাশে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ যে , সে বাইরে অপেক্ষায় র‌ইল। আমার কন্যা গাড়িতে ওর মাসি ও মেসোর কাছেই ছিল। আবার যাত্রা শুরু হলো .... আমার জামাই বাবু স্মরনীয় এমন একখান্ ঘটনার কথা লেখার অনুরোধ জানালো , সেই সাথে এক‌ই অনুরোধ এলো তার ভাইরাভাই এর তরফে ..... অগত্যা। তোমাদের দুজনের কথা কি ফেলতে পারি বলো ???? 

খা‌ওয়ার জন্যই তো সব কিছু তোমরাই বলো । যাই হোক না কেন ওকে বড়োই ভালোবাসি। এর কিছুদিন পর মাইথনে গিয়েও , সন্ধ্যায় কিছুই করার না থাকায় টুকটাক খেতে শুরু করলাম.... আমার কর্তা খেতে খেতেই বলল যে .... আমরা তিনজন যা খাচ্ছি !!! হোটেলের রান্না ঘরে হৈচৈ পড়ে গেছে !!! যা order দেওয়া হচ্ছে আসা ইস্তক । আমি সম্মতি জানানোর আগেই আমার একরত্তি কন্যা টিভি দেখা থামিয়ে বলে কি না ... তিনজন কৈ ? তোমরা তো দুজন !!! আমি খাচ্ছি কোথায় ? ..... কাণ্ডটা শুনলে একবার !!! টিভি দেখলেও কানটা এদিকেই ছিল তেনার । আর দুঃখের কথা কি জানো ? এমন খানে‌ওয়ালা বাবা-মা এর এমন নিখাকী কন্যা কেমনে হয় বলো দেখি ? আমি তো বুঝি না।আশায় আছি ... নিশ্চয়ই পুপে পরে বড়ো হয়ে নিরাশ করবে‌ না.... ।

 অবসাদ .... কথাটা আজকাল খুব শুনতে পাই। আমরা আজকাল মাঝে মাঝে ই বলি , খুব ডিপ্রেস্ড লাগছে । কেন ? আমরা কি খুব একা হয়ে যাচ্ছি ? মন খুলে কথা বলার লোক নেই? নাকি আজকের অনেক কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছি কূল হারা সাগরে ? কিন্তু কাজের ধরণ বদল হলেও কখনো ভেবেছি কি , আগেকার মানুষের কাজ কম ছিল না, আর তাদের কায়িক পরিশ্রমের কথা নাই বা বললাম। তাহলে কি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করবো না ? ফিরে যাবো পুরাতন দিনে ? মোটেই না, এগিয়ে যাওয়া , নতুন কে , ভালো-কে গ্রহণ করার মধ্যেই তো সামগ্রিক উন্নতি । 

কিন্তু তার পরেও ভাবতে হবে .... কবি গুরু বলেছেন... " তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে, আমায় কভু, ক্ষণিক তরে , আজি হাতে আমার যা কিছু কাজ আছে,আমি সাঙ্গ করবো পরে...." কি সুন্দর ভাবনা । এই তুমি হতে পারে যে কোনো প্রিয় জন। মা, বাবা, সন্তান, বন্ধু , দিদি, দাদা , স্বামী , স্ত্রী অথবা অন্য কেউ। নিজের মনের আনন্দ, কষ্ট যে শুষে নেবে এক লহমায়। আমার ও মায়ের অনেকটা এমন রসায়ন ছিল। আমি চলে যাওয়ার পর মা আস্তে আস্তে অবসাদগ্রস্ত হয়েছিলেন , বিশেষ করে আমাদের পোষ্য সারমেয় চলে যাওয়ার পর যা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। যদিও মায়ের মনের মতন কাছাকাছি ই আমার ঠিকানা বদল হয়েছিল। তা - ও মনের মেঘ কাটেনি। বুঝে ও অবুঝ হতেন । এমন সবার না হলেও অনেকেরই হয় , জানি । 

এখনকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। অনেকেই হতাশা গ্রস্থ। আমার-ও যে খারাপ কখনও লাগে না , বলতে পারি কি ? কিন্তু যখন যেমন , তখন তো তেমন ভাবেই চলতে হবে। চলবো না বলে হেরে যাবো ? থেমে যাবো ? সে কেমন কথা ? ছোট থেকেই তো কিছু না কিছু বাঁধার মুখে আমরা পড়েছি, কখনো লড়েছি, কখনো এড়িয়ে গেছি .... কিন্তু থামিনি তো !! যার যার সমস্যা , তার তার কাছে কিন্তু বড়োই । বিপরীত দিক থেকে মনে হয় , আমার মতো তোমরা জীবনকে দেখোনি..... । আসল কথা হলো নিজের ছায়াকে মস্ত লাগেই। কাজেই তোমার সমস্যা ছোট , আমার টা আকাশ চুম্বি.... এ কথা অর্থহীন। কারণ আমার সমস্যা হয়তো বা ছোট কিন্তু আমার তাকে এঁটে ওঠার ক্ষমতা কম। আবার তোমার সমস্যা বড়ো, কিন্তু তুমি লড়াকু মনোভাবাপন্ন। কাজেই যার যার সমস্যা , তার তার থাক । কথা হলো সমস্যা যেন আমাদের ওপর চেপে বসে , আমাদের না জীবন বিমুখ করে তোলে। 

কারণ জীবন একটাই । পরজন্ম আছে না নেই সত্যিই জানা নেই। আর আমরা কেউই একা ন‌ই। অনেক সম্পর্কে আবদ্ধ। কারোর সন্তান, কারো বোন, কারো দাদা, কারো ভাই, কারো দিদি , কারো বাবা, কারো স্ত্রী ... সবচেয়ে বড়ো কথা কারোর মা । এতো সম্পর্কের দায়ভার তো অস্বীকার করা যায় না । 

নিজেকে সম্মান করা জরুরি। যেখানে অপমান, অবজ্ঞা , সেখানে যাওয়ার দরকার নেই তো !!! যে জায়গায় যেতেই হবে কাজের দায়ে , সেখানে নিজেকে সামলাতে জানতে হবে ।আমার হয়তো এ ব্যাপারে আরো যত্নবান হতে হবে। 

তবে আমাদের স্কুল ও কলেজের বন্ধু দের , বিশেষ করে কলেজ এর whatsapp group এ আমরা এতো অদরকারী, আবোলতাবোল কথা বলি , যেটা অনেকটা stress buster এর কাজ করে । অদ্ভুত topic এ যে কত রকম বাজে বকা যায় , তার ক্লাস নিতে পারবো আমরা সকলে। এসব ও জরুরি। সব সময় কাজের কাজি হয়ে থাকাও এক সময় অবসাদ এনে দেয় হয়তো বা। সবার সাথে অকাজের আলোচনা তো করার দরকার নেই। কিন্তু ভালো থাকতে হবেই .... আর নিজের কাছেই আছে ভালো থাকার ওষুধ। কেউ হয়তো সাহায্য করতে পারে , কিন্তু আসল তো নিজের ইচ্ছাশক্তি।

কালকের ঘটনা আমাদের আবার নাড়িয়ে দিলো। খবর টা শুনে একটা কথাই মনে হলো , ধোনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও কি কিছু নিজের জীবনে গ্রহণ করতে পারলো না সে ?? অন্য সব মুভি আমার দেখা নেই। সে যাই হোক না কেন এভাবে সব শেষ হয়ে গেল !!!

এখনকার প্রজন্ম কি জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে না ? পারে টিভি ও সোস্যাল মিডিয়া র নানা রকমের অ-দরকারি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে !!!

মন খুলে ঝগড়া , কথা, কান্না যে কতো খানি জরুরি আবার বোধহয় জানলাম। মাপা কথা , চাপা কান্না় যে কতো বিষাক্ত আরো একবার প্রমাণ হলো। 

আত্মার শান্তি কামনা করি সকলে । জানি না শান্তি কি মিলবে তার ? অপূর্ণ আশা , আকাঙ্খা নিয়ে , মন কেমনের মাঝে যারা হারিয়ে যায় , তারা কি আদেয় শান্তি পায় ????

@শুচিস্মতা ভদ্র

 "হাতে কালি , মুখে কালি 

বাবা আমার লিখে এলি ?" ... ছোট্ট বেলায় স্কুল ফেরৎ অনেক পড়ুয়াদের এমন দশা নিয়েই কোন আদ্যিকালে যে এই ছড়া কাটা হয়েছিল, কে জানে ? মায়ের মুখে শুনতাম। যদিও ওমন ধারা আমার ক্ষেত্রে হলেও, তুলনায় কম হোতো । একটু ঠাণ্ডা স্বভাবের জন্য কালি ঝুলি মেখে কালিন্দী হয়ে বকুনি খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। আমার বকুনি ছিল দীর্ঘমেয়াদী খাওয়া বিষয়ক । যাক সে কথা । তো কথা হচ্ছিল কালি নিয়ে । আমাদের অক্ষর পরিচয় হলো , হাতে এলো পেনসিল । লেখো , ইরেসার দিয়ে মুছে ফেলো , ভোঁতা হলে শার্পনার দিয়ে কেটে ফেল । ছোট হয়ে গেলে মায়ের ভাঁড়ার থেকে আরো নতুন পেনসিল চেয়ে নিলেই হোলো । কি সুন্দর সহজ সরল ছোট্ট জগত । নিজের সেই সব অমূল্য সম্পদ রাখার জন্য রঙ্গীন একখান্ পেনসিল বাক্স !!! ভাবা যায় ??? এর পরে হঠাৎই চোখে ধরা দিল আরো সম্মানজনক পেন , যদি ফাউন্টেন পেন হয় ... তাহলে তো কথাই নেই!!!

 কাজ, কাজ আর কাজ। বলা যায় কাজ সাগরে / মাঝারে ডুব দিয়েছি .....তবে অরূপরতনের আশা নিয়ে নয় একেবারে-ই । তবে কিছু অরূপরতন মিলেছে ... ওজন নামক অবাধ্য ব্যাপারটা বাধ্য হয়েই কিছু টা কমেছে অথবা আর বাড়ে নি , পুরোনো কিছু হারানো বিষয় আবার ভুস্ করে অনেক দিন পরে ভেসে উঠেছে । তবে নিশ্চিত সবাই, যে , আমরাও পারি । বিদেশে যারা প্রবাসী , তারা আগেই দেখিয়ে দিয়েছেন যে , তারা কি, না পারে একা হাতে !! আমরা তখন বলেছি যে , ওখানে সহজেই সব করার উপায় হাজির। এখন কিন্তু বলতেই পারি , আমরা কি না পারি !!! 

ঘরের সবাই এখন সকল কাজের কাজি আর বাঁধা বাঁধন ছাড়াই সব কাজে হাত লাগাই আমরা। নিরূপায়.... । কাজ আর অকাজ দিয়ে আতঙ্কিত মনকে যতটা চাপা দেওয়া যায় আর কি !!

"জগত জুড়ে ভয়ের মেলা, ভয় ভেঙে দাও প্রভু ".... এ এখন আমাদের সবার আকুতি। এই ভয়ের রাজ্যে আমার কর্তা এখনো ধীর , স্থির এক‌ই রকম , কি করে ?? জানা নেই। চুপিচুপি হয়তো বা অতোটা ধীর নয়। আমার ভয় ব্যাকুলতা যদি beyond control হয়ে যায় ,ওকে দেখে !!! এ হয়তো তার জন্য করা কড়া সংযম ।

 আমি সবকিছুর মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে ভয়কে নিজের মধ্যে ঢুকতে দেবো না , এমনটা ভাবলে -ও টুক করে কিছু না কিছু খবর কানে সিধোচ্ছে আর এক‌ই সাথে হাত, পা পেটে সিধিয়ে যাচ্ছে। শুনবো না খবর বললে-ই হোলো ? কত শত খবর সরবরাহকারি আমাদের ঘিরে আছে না ?? 

ছোটদের স্কুল কর্তৃপক্ষ হৈ হৈ করে ওন লাইনের আইনে আমাদের আপামর বাবা মায়ের সবেধন নীলমণি দের আটক করার শমন জারী করেছেন। কেউ কেউ শুরু করে-ও দিয়েছে ওন-লাইন হাঙ্গামা। সেদিন শুনলাম আমার পরিচিত একজনের একরত্তি পুত্র(play school এর student সে )তার মায়ের কোলে গদিওমান হয়ে একঘন্টা ( নামেই) ওন-লাইন ক্লাস করছে (?) মাঝে মাঝেই কোল থেকে নেমে দে ছুট্। কি অত্যাচার বলো দেখি !! ও কি বা বোঝে ?

আমার কন্যার-ও শুরু হ‌ওয়ার ওমন শমন হাজির। খুব ই কমন সমস্যা। আমার নীলমণি বেশ আনন্দেই আছে, মাকে সব সময় কাছে পেয়ে সে আহ্লাদে ১৬ খানা হয়ে ঘুরছে ফিরছে, পড়াশোনা বোধহয় আবার সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে(?), নতুন দফায় শুরু করতে হবে। পড়ার কথা শুনতে পায়-ই না, পেলে কেমন যেন মুখ খানার ১৬ খান আহ্লাদ ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় !! তবে খাওয়ার দিকে অল্প হলেও মন ঘুরেছে। অকাজের ( সবার নয় মোটেই )সময় নাকি খুব ক্ষিদে পায় ... এ শোনা কথার প্রমাণ মিলেছে এবারের পরিস্থিতি তে।সময়ের পরিবর্তনে আমর কন্যা বিশ্বাসী নয় একেবারেই... তাই বেশ সময় নিয়ে-ই খাচ্ছেন তবে কিছু কিছু পদ মনোযোগ দিয়ে, ভালোবেসেই খাচ্ছেন তিনি। 

 এদিকে বাড়িতে কাজের কাজির পারদর্শিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কদিন আগেই মেশিনে বিছানা, বালিসের সরঞ্জাম কাচতে দিয়ে রাঁধতে গিয়েছি, মেশিন যখন কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করলো সিটি বাজাকে , গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ !! মেশিন যে কাপড় ছাড়াও ইলেকট্রনিক জিনিসের সাফাই করে জানা ছিল না 🙄। দেখি ঝকঝকে চকচকে রিমোট কাপড়ের উপর শুয়ে আছে !!! হায় হায় !! কি হবে !!! সরাই হবে কি করে ?? অগত্যা তাকে সূজ্জি মামার জিম্মায় দিলাম , ব্যাটারি খুলে। দিব্যি চলছে। যাক্ বাবা !!! আমার কর্তা বলেছেন, কদিন দেখো , isolation এ রাখো , দেখো !!! ও সব কি কথা !! বালাই ষাট, সত্তর , আশি !!! ওসবে করোনা ধরে না । তাও কি জানো না ???


@ শুচিস্মিতা ভদ্র

 ভ্রমণ যখন গল্প 

শুচিস্মিতা ভদ্র 

কথাটির আক্ষরিক অর্থ যে ঘুরতে যাওয়া / পর্যটন / বেড়াতে যাওয়া তা আমরা সকলেই কম , বেশি জানি । আরেক ধরনের ভ্রমণ হয় মনে মনে । কবি বলেছেন যে , কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে । খুবই সত্যিই। মনে মনে আমরা স্বদেশে , বিদেশে , কল্পলোকে যে কোন স্থানে ভ্রমণ করতে পারি । এ ধরণের ভ্রমণের সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচনা না করে , একটা কথা বলাই যায় এমন মানস ভ্রমণ তো বটেই, যে কোন বেড়ানোর খুঁটিনাটি তথ্য বোঝাই বই পড়তে ভ্রমণ পিপাসু মন সব সময়ই রাজি । মনের ভ্রমণকে বাস্তবায়িত করতে হলে এমন একজন সঙ্গীর দরকার সব সময়ই। এমন , সঙ্গী বলো , বন্ধু বলো আর কে বা আছে বই ছাড়া ? বর্তমানে অবশ্যই আছে আমাদের মুঠোফোন, যাতে নেট ঘেটে বেড়ানোর আদি অন্ত সবই আমাদের নখদর্পনে , তবুও বই এর, কোন বিকল্প হয় না । তাই আজও ভ্রমণ কাহিনী , ভ্রমণ পত্রিকা হারিয়ে যায়নি । নতুন নামে , নতুন মোড়কে ভ্রমণ সাহিত্য আজও চির নবীন। 

মানস ভ্রমণের পিছনেও থাকে কোন না কোন রসদ , যেমন সত্যিকারের শোনা কোন বেড়ানোর গল্প, কোনও বইতে পড়া অথবা ছবিতে দেখা বেড়ানোর ইতিবৃত্ত , এ ছাড়া আছে দূরদর্শনের কোন চ্যানেল অথবা কোন না কোন ছায়াছবির দৃশ্যায়ন । ভ্রমণ সাহিত্যে শঙ্কু মহারাজ , নবনীতা দেবসেন , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেক খ্যাতিমান লেখক লেখিকা রয়েছেন আমাদের সমৃদ্ধ করতে ।

বই এর ক্ষেত্রে এমনই একটা বিখ্যাত বই হল " ভ্রমণ সঙ্গী " । আমাদের বাড়িতে বইটা আছে । আমার মা বেড়াতে খুব ভালবাসতেন । সময় , সুযোগ অনুকূল ছিল যখন , নিজের উদ্যোগে কিছু কিছু ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করেছেন । সেই সব গল্প আজীবন তাঁর মনেরমণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিল । যখন‌ই সে সব কথা বলতেন , উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন । পরবর্তীকালে পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার কারণে ভ্রমণ যখন বন্ধ , একবার সম্ভবত বই মেলা থেকে নিয়ে এসেছিলেন "ভ্রমণ সঙ্গী" । মাঝে মাঝে পড়তেন আর মানস ভ্রমণে হয়তো বা সামিল হতেন । 

এশিয়া পাবলিশং কোম্পানির থেকে এই বিখ্যাত ভ্রমণ সংক্রান্ত বইটি প্রকাশিত হয় । আমাদের বাড়ির বইটি ছিল ১৯৮৬ সালের প্রকাশনা । মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে , ওই বই এর সব তথ্য কতদিনের জন্য গ্রহণযোগ্য থাকে ? এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমাকে বিচলিত করেছিল ... এই একটা জায়গায় বই একটু পিছিয়ে রয়েছে । মা বলেছিলেন যে কিছু কিছু তথ্য অপরিবর্তিত থাকলেও যাতায়াত, থাকা , খাওয়ার খরচ ... এমন কিছু ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে পারে , সেটা ধরে নিয়ে বেড়ানোর itenary তৈরি করতে হয় । জায়গার বর্ণনা , দর্শনীয় স্থান তো আর বদল হচ্ছে না !!! কারণ নতুন নতুন তথ্য বা অপডেটেড তথ্যের জন্য প্রতি বছরই বই এর পরবর্তী সংস্করণ কেনা তো সম্ভবপর নয় ; ভ্রমণ মূলক ম্যাগাজিন তাও এই সমস্যার সুরাহা করে কিছুটা হলেও, বেড়ানোর নানা জায়গার, নিত্য, নতুন তথ্য আমাদের কাছে পেশ করে থাকে । 

নেটের ক্ষেত্রেও এই সমস্যার সমাধান রয়েছে , সেই মাধ্যম নতুন নতুন আপডেটেড তথ্য আমাদের দরবারে হাজির করে লেখা , স্টিল ছবি , ছবির ভিডিও ইত্যাদি আরো আকর্ষণীয় পরিবেশনার দ্বারা । 

তবে তা সত্ত্বেও বই এর বিকল্প হয় না । কারণ নেট দুনিয়াও কখনও সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত নয় , সেখানকার পরিবেশনার আকর্ষণ বেশী হলেও সব তথ্য যে সঠিক নয় , সে খবরও আমরা পেয়ে থাকি , আছে নেটওয়ার্ক বা সংযোগ সংক্রান্ত অনেক গোলোযোগ। বই যেসব সমস্যার থেকে অনেকটাই মুক্ত।  

আমাদের বাড়িতে আরেকটি ভ্রমণ সমগ্র আছে , সেটিও মায়ের সংগ্রহ। অমূল্য সেই সমগ্রটি এখন আর প্রকাশিতও হয় না । আমি এক সময় খোঁজ নিয়েছিলাম, তখনই জেনেছিলাম, এ ব্যাপারে । ২৪ (24) পর্ব বিশিষ্ট ভ্রমণ মূলক সমগ্রটি হল "রম্যাণি বীক্ষ্য "। লেখক শ্রী সুবোধ কুমার চক্রবর্তী । সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা ভ্রমণ সাহিত্য। 

     ১৯১৮ সালের ১৫ই মার্চ, কোচবিহারের কাটামারি জমিদার পরিবারে শ্রী সুশীল চক্রবর্তীর ২য় পুত্র সন্তান সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর জন্ম হয় । রাজ্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন সুবোধ চক্রবর্তীর পিতা । তাঁদের পরিবারের সাথে কোচবিহার রাজপরিবারের সুসম্পর্ক ছিল । ওখানকার জেনকিন্স স্কুল থেকে পড়াশোনার পর ১৯৩৮ সালে ২০ বছরের যুবক সুবোধের বিয়ে হয়ে যায় । তারপর তিনি কলকাতায় আসেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে । উচ্চশিক্ষা শেষ করে এলাহাবাদে , পণ্ডিত নেহেরুর লিঁয়াজো অফিসারের ভুমিকা পালন করেন কিছুদিনের জন্য , এরপর যোগ দেন রেলওয়ে বোর্ডে । টুণ্ডলাতে ছিলেন বেশ কিছুদিন , এরপর পাকাপাকি ভাবে , ইস্টার্ন রেলওয়েতে কাজ নিয়ে চলে আসেন আসানসোল। 

এখানেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্য চর্চা । আসানসোলের জি. টি . রোড ও ইয়েল রোডের সংযোগস্থলের বাংলোতে বনফুল সহ অনেক বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের আনাগোনা ছিল । রেলের কাজ নিয়ে ১৯৫৩-৫৪ সালে দক্ষিণ ভারত যেতে হয় তাঁকে । ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলেন , সম্পূর্ণ নতুন ধারায় । ১৯৫৪ সালে কলকাতার এক পত্রিকার "শনিবারের চিঠি " নামক বিভাগে ছেপে বেরনোর পর , অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় সেই লেখা । এরপর পাঠকের অনুরোধ রক্ষার্থে ধারাবাহিক ভাবে বেরতে শুরু হয় তাঁর রচিত দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা । ১৯৫৫ সালে "শনিবারের চিঠি" র সম্পাদক, শ্রী রজনীকান্ত দাশ মহাশয় , তাঁর নিজের প্রকাশনা - রঞ্জন পাবলিশার্স থেকে প্রথম পর্ব টি বই আকারে ছেপে বের করেন । প্রথম সংস্করণ হিসাবে ছাপা হয়েছিল ১১০০ কপি । এরপর ২য় সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ২২০০ কপি ... সব বিক্রি হয়ে যায় । পাঠক মুগ্ধ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা ভ্রমণ সাহিত্য পাঠ করে । 

দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা , বই আকারে ছেপে বেরনোর পর , লেখক তাঁর পরবর্তী কাহিনীর নাম ঠিক করেন , মহাকবি কালীদাসের " অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ " এর এক বিখ্যাত ও চিরস্মরনীয় শ্লোক থেকে । শ্লোকটি হল - " রম্যাণি বীক্ষ্যে মধুশ্চারং নিশম্য শব্দান " । কবিগুরু এই " রম্যাণি বীক্ষ্য " শব্দ বন্ধের অনুবাদ করেছিলেন ' সুন্দর নেহারি ' । অর্থাৎ নানা রম্যস্থান প্রত্যক্ষ করে মনে যে ভাব এল , তারই অভিব্যক্তি এই রচনা । সজনী কান্ত দাশের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত " রম্যাণি বীক্ষ্য " নামটি এক রেখে পর্ব গুলির নাম ভিন্ন করা হয় । যেমন - কালিন্দী পর্ব, অবন্তী পর্ব, মগধ পর্ব, কামরূপ পর্ব, উৎকল পর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি । 

প্রথম যখন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেন , লেখকের মনে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের রেশ ছিল , কারণ তথাকথিত ভ্রমণ বর্ণনার থেকে তার রচনা ছিল ভিন্ন ধরনের, কিন্তু পরবর্তীকালে পাঠক কুলের সবাত্মক গ্রহনে সব সংশয় কেটে যায় , তার জায়গায় দখল নেয়, আরো লেখার নতুন উৎসাহ। সেই মতো পরবর্তীকালে প্রতি বছর দুবার করে ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরতে যেতেন , ফিরে এসে অবলীলায় লিখে ফেলেছিলেন অবিস্মরনীয় আরো অনেক পর্ব। 

চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখক সল্টলেকে বসবাস করতে শুরু করেন । সেই সময় মাঝে মধ্যে জন্মস্থান কোচবিহারে গেলেও বেশিদিন থাকতেন না । ১৯৯২ সালের ১৮ই জানুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন ।

সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর সব থেকে বড় সাফল্য ভিন্ন 

ধারার ভ্রমণ সাহিত্যের প্রবর্ত্তক রূপে । ধণী মামা , অঘোর গোস্বামী তাঁর স্ত্রী ও অনূঢ়া কন্যা স্বাতিকে নিয়ে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের জন্য হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে এসেছেন। এই সময় প্ল্যাটফর্মে অপ্রত্যাশিত ভাবে পাতানো ভাগ্নে গোপালের সঙ্গে দেখা । গোপাল পেশায় কেরানীর কাজ করে , সে লোকাল ট্রেনের যাত্রী। মামা -মামী তাকে সঙ্গী হবার অনুরোধ জানালেন আর স্বাতির দৃষ্টিতে গোপাল আবিষ্কার করল এক আন্তরিক আবেদন । চলতি ট্রেনে সে উঠে পড়ল । এ ভাবেই শুরু হল গোপাল আর স্বাতির অভিযান । প্রতি পর্বে গোপাল ও স্বাতির সম্পর্কের রসায়ন অন্য মাত্রা দিয়েছে পর্ব গুলিকে । তাদের দুজনের চোখ দিয়ে এখানে পাঠকের ভারত দর্শন হয়েছে । লেখক কোথাও সেই অর্থে গাইডের কাজ করেননি । হোটেলের খরচা , তার নাম , দ্রষ্টব্য স্থানের প্রবেশ মূল্য নিয়েও রচনা দীর্ঘায়িত করেননি । গ্রন্থকার এই বইতে একদিকে যেমন ভারতের পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় দিয়েছেন, অন্যদিকে সমকালীন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আলোচনাও করেছেন । যে কোন জায়গার সর্বাঙ্গীন আলোচনার ফলে পাঠকের কাছে অতীত ও বর্তমানের ভারতের সামগ্রিক ছবি ফুটে উঠেছে । আর এখানেই এই বই অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীর থেকে স্বতন্ত্র। লেখকের আরো রচনা থাকা সত্ত্বেও তিনি " রম্যাণি বীক্ষ্য " গ্রন্থের লেখক হিসাবেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসীন হয়েছিলেন ।

লেখকের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে .... শাশ্বত ভারত , সৌর পুরাণ , মেঘ , আমাদের দেশ, কী মায়া , তুঙ্গভদ্রা , অন্য এক দেশ , সেই উজ্জ্বল মুহূর্ত, পুরাভারতি ইত্যাদি , ইত্যাদি । রচনা গুলি অধিকাংশই ভ্রমণ কেন্দ্রিক।  

জন্ম শতবর্ষ অতিক্রান্ত সাহিত্যিক সুবোধ কুমার চক্রবর্তীর জীবন ও সৃষ্টি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অজানা , অচেনা । তাঁকে গভীর ভাবে পাঠ করলে বোঝা যায় কি ভাবে সংসারে থেকেও মানুষ হয়ে উঠতে পারে পথের সাথি ।

রম্যাণি বীক্ষ্য সমগ্র : - 

অন্ধ্র পর্ব , তামিল পর্ব, কেরল পর্ব , কর্ণাট পর্ব , কালিন্দী পর্ব , রাজস্থান পর্ব , সৌরাষ্ট্র পর্ব , কোঙ্কণ পর্ব , অবন্তী পর্ব, উৎকল পর্ব , মগধ পর্ব, কোশল পর্ব, হিমাচল পর্ব , কাশ্মীর পর্ব , কামরূপ পর্ব , গৌড় পর্ব, ভাগিরথী পর্ব , হিমালয় পর্ব , মরুভারত পর্ব , প্রাচী পর্ব , কিষ্কিন্ধ্যা পর্ব , অরণ্য পর্ব , নেপাল পর্ব ও ভুটান পর্ব