বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৪
কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেই পাইনাস রিসর্টে পৌঁছলাম। মূল পথ থেকে পাহাড়ী পথের খানিকটা হেঁটে উঠেই হেঁপোরাম হয়ে গেলাম ... ছোট্ট বাগান ঘেরা দুখান দোতলা কটেজের একখানা জুড়ে আমাদের দলের সকলের জন্য বরাদ্দ করেছেন আমাদেরসুমিত দা । কন্যার বান্ধবীর পিতাশ্রী সাদর অভ্যর্থনা জানালেন , শুনলাম বাকিরা গরমাগরম ইলেকট্রিকাল ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় ঘুমন্ত। দিদিরা নিচে রইল আমরা লটবহর সহ ওপরের একখান ঘরের দখল নিলাম। খানিক কাঁপাকাঁপি করে গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম । এরপর দলের যারা যারা পরস্পর অপরিচিত ছিলাম ... আলাপচারিতা সেরে নিলাম। এসবের মাঝেই রাতের খাবার এসে গেল । দল বেঁধে খাওয়ার পর সবাই দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাবার আগে পরের দিনের ঘুরপাক এর লিস্টি রেডি করে ফেললাম। বাইরে তখনও ঝমাঝম বৃষ্টির কনসার্ট চলছিল ।
বেড়ানোর সময়েও অভ্যাস বশে ঘুম ভাঙল ভোরে , তখন পুরোটাই অন্ধকার ঘুমপুরী । ঘুম জাগরণের মাঝেই একে একে সবাই জাগন্ত হল । আলো ফুটতে দেখা গেল আসে বরফ , পাশে বরফ । বরফ পড়েছে তো !! সকাল সকাল স্নানের পাট না চোকালে উষ্ণ মণ্ডলের মানুষজনের আবার সমস্যাই সমস্যা । সে সব মেটানোর খবরে আমাদের ছোটগিন্নিও উৎসাহিত হয়ে সজল এলো চুলে জলখাবারের টেবিলে হাজির হলেন বাকি সব ঘরের খুচরো দায় দায়িত্ব সামলে নিয়ে ।
আণ্ডা বাচ্চা সহ সকলে ভিগি ভিগি আবহাওয়ায় দুখান গাড়ি ভাড়া ( হোটেল থেকে সিন্ডিকেট মারফত) করে বেরিয়ে পড়লাম, চললাম আরুভ্যালির দিকে । রাস্তার পাকদণ্ডী আমাদের নর্থবেঙ্গলের ধারে কাছেও আসেনা। সুন্দর পথ , কিন্তুক সকালের জলখাবারের কাঁচা পাউরুটি এবার শরীরে পাক মারতে শুরু করল। কন্যার এই পাকের ব্যপার টা পাকাপোক্ত, এবার সাথে আমিও যোগ দিলাম। কন্যার বান্ধবী আহেরীও পো ধরে ফেলল। এ সব পাকের মাঝেই দেখি ভ্যালি ভেলকি দেখিয়ে হাজির .... এক পাল ভ্রমণার্থী, যার অধিকাংশই বাঙালি , অসংখ্য ঘোড়া , বৃষ্টি , ঠাণ্ডা হাওয়ার এবং সর্বোপরি কাদা মাখা পথে অবতীর্ণ হলাম । বলতে নেই , কনকনে হাওয়াতে শারীরিক কষ্ট সাময়িক হাওয়া হল । তবে ছাতা ব্যাগ আর ক্যামেরা সামলে আমি নাজেহাল। আমাকে সামলাতে দিদি , জামাই বাবুকে ফিট করে দিল । মাথায় ছাতা ধরে ছবি তোলায় অ্যাসিস্ট্যান্ট হল জামাই বাবু। আমার কর্তামশাই প্রতিবারের মতন ছানাদের দেখভাল করতে করতে এগিয়ে গেল ।
আমার পরিচিত এক ক্যামেরা বিশেষজ্ঞের গাইডলাইন মেনে ছবি তোলা শেষ হতেই আমার জ্যাকেটের মধ্যেই ক্যামেরা চালান করছিলাম প্রতিবার । এই ঠাণ্ডায় তাকেও গরম রাখা জরুরি ... তার দরুণ আমার অবয়বখান খোলতাই হয়েছিল .... জামাই বাবু এক সময় বলেও ফেললেন ... "তোর কি সাহস রে শিল্পী !!! এই অবস্থায় ঘুরতে এসেছিস ? " শুনে সকলের কি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি রে বাবা !!!!
আরুভ্যালির বৃষ্টি , কনকনে হাওয়ার ঝাপটা , কাদা কাদা পথ সব ভাল লাগাতে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল । আমার কর্তামশাই যথারীতি তার ছানা সামলে আগুয়ান হয়েছিলেন । অগত্যা দিদি আমার ছবি তোলার সহকারী হিসাবে জামাই বাবুকে ফিট করে দেয় , সহকারী এ কারণেই বলছি ... কারণ বৃষ্টিপাতের জন্য ছাতা সামলে ক্যামেরা তাক করতে পারছিলাম না .... কি বিপদ । শেষমেষ জামাই বাবু ছত্রপতি হলেন , কিছু ছবিও তোলা হল মিলিয়ে জুলিয়ে ক্যামেরায় ও মোবাইলে । কিন্তুক এ সবের মধ্যেই স্বপ্না কাকিমার পা পিছলে পড়ে যাওয়া এক বিরাট ছন্দ পতন । ব্যাথা যন্ত্রণার দরুণ বেড়ু একশ শতাংশ সম্ভব হল না । তবে কাকিমার সহ্য ক্ষমতা অসীম ... ফিরে যখন এক্সরে রিপোর্ট হাতে এল , সকলের চোখ কপালে ... compression fracture। কাকিমা আপাতত কন্যার বাড়িতে কমপ্লিট বেড রেস্টে। কিন্তু কিছু কিছু চড়াই উতরাই বাদে কাকিমার অসীম সহ্য শক্তির পরিচয় আমাদের বিস্মিত করেছে বার বার ।
আরুভ্যালি থেকে ফেরার পথে খানিক ধুমায়িত চা পান করার পর ... আকাশ খানিক ফর্সা হয়ে ভরসা জোগালো । এগিয়ে পড়লাম চন্দনওয়াড়ির দিকে ... যেখান থেকে তীর্থ যাত্রীদের অমরনাথ যাত্রা শুরু হয় । উচ্চতার সাথে সাথে বরফের প্রকোপ বাড়ছিল , পথের দুপাশে । এদিকে আমার শরীরে তখন আবার পাকাপোক্ত পাক মারা শুরু হয়েছে ... জামাইবাবু পরিবেশ হাল্কা রাখতে বলেই চলেছেন ... এই অবস্থায় তো ওমন হয়েই থাকে । সেদিনের পর ক্যামেরা ব্যাটাকে ব্যাগে রেখেছি জ্যাকেটের পেটে রাখিনি ... নিজে গরম থেকে আমাকেও ঘামিয়ে দিচ্ছিল পাক মেরে !!!
পথের ধারে এক জায়গাতে পাগল পারা লোকজন দেখতে পেলাম ... কারণ তখন তুষারপাত শুরু হয়েছে । গাড়ি থামতেই কারা তেড়ে এসে না নামার আদেশ দিলেও ড্রাইভার দাদা ইঙ্গিতে নামতে বললেন । কে সত্যি আর কে মিথ্যা কথার পশরা সাজিয়ে পরিবেশন করল বোঝা দুষ্কর... বাধা দানের কারণ আমাদের ড্রাইভার অনেক আগে নামিয়েই চন্দনওয়াড়ি পৌঁছনোর গল্প বলছে , এদিকে ড্রাইভারের বয়ান ... এই আসল চন্দনওয়াড়ি । এই চাপানউতোরের মাঝে তুষারপাতের আনাবিল আনন্দ একটু হলেও হাল্কা হয়ে গেল ... কারণ বাধাদানকারীরা মরিয়া ... আমাদের ওখানে থাকতেই দেবে না । একেই আমরা অজানা রাজ্যে , তায় কাশ্মীরে কাজে কাজেই মিনিট দশকের মধ্যেই মানে মানে সরে পড়লাম ... ফেরার পথে পাহাড়ী পথের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ই অনেক উঁচু থেকে দেখলাম বেতাব ভ্যালি । সেই বিখ্যাত মুভি র দৃশ্যায়ন সমৃদ্ধ। তবে নীচে নামতে কেউ ই রাজী হলাম না , বিশেষত আমার কন্যা তখন হোটেলে ফিরতে বেতাব । শরীরের ভিতর তার তখন বেশ হৈ চৈ চলছে । আমারও খানিক খানিক একই অবস্থান। ফিরতি পথে মুঘল দরবারে খাবার খাওয়ার ওপরে তখন তালা পড়ে গেছে ... সেই তালা বন্ধই থাকল সারা বেরুতে । ওখানকার খাবার খেতে আবার যেতে হবে ... যা দেখা গেল শেষমেষ ।
ফেরার পর আকাশে ও সবার মুখের মেঘ কেটে আলোর ঝলমলানি ফেরত এলো । খানিক পরে হোটেলেই আমাদের মনের মতন হাল্কা খাবারের পাত পড়ল, সে সব পর্ব মিটিয়ে সবে গরমাগরম ইলেকট্রিকাল ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে লম্বা হবো ভাবতেই দিদি গর্জে উঠল ..." এখানে কি শুতে এসেছিস ? চল লিডার নদীর ধারে " সাথে আমাদের ছোটগিন্নিরও জল ছুঁই ছুঁই ইচ্ছে চাগিয়ে উঠল ... সে তো আসার আগেই কল্পনার রঙে লীডারের পারে হাঁটা র স্বপ্নে বিভোর ছিল তাও আবার কনকনে রাতে , পাহাড়ী নদীর কলকলানি সহ ... সে স্বপ্ন তো আগের রাতের বৃষ্টিপাতে ভিজে জাব হয়ে গেছে । কাজেই সে তুরন্ত ছোট্ট জনকে মায়ের জিম্মা করে রেডি স্টেডি গো হল ... দুই দিদার কাছে দুই ঘুমন্ত আর এক জাগন্ত ছানাকে রেখে আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে সোজা লিডার নদীর ধারে এলাম । কিন্তু আকাশ তখন আবার মুখ ভার করতে করতে ভ্যাক করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল আর আমরাও খান চারেক ছাতার মাঝে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করতে করতে আর আধা ভিজতে ভিজতে হোটেলের দিকে মুখ ফেরালাম ... ফিরতেই হল ।
ফিরে দেখি সব আঁধার হয়ে আছে । পাওয়ার কাট .... আমরা নীচের হলে ছড়িয়ে বসে হাপ ছাড়লাম । বাইরে তখন বৃষ্টির বাড় বাড়ন্ত। হেনকালে গপ্পো জমাট বাঁধার মুখেই আলো হাজির হল , সাথে চায়ে গরম !!! আগের রাতের আলোচনায় আমরা দুই গিন্নি ঘোড়ায় চেপে বৈশারণ যাওয়ার বায়না ধরলেও এদিকের কর্তামশাই তা একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছিলেন ... আগাম বন্ধু / প্রতিবেশি মারফত কিছু ভয়ানক বিবরণ শুনে । আমি আবার সম্পূর্ণ অনুকূল বিবরণ পেলেও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে ওদিকের ইচ্ছে চাপা দিয়েছিলাম তবে সেদিন সকালের ঘুরুর সময়ের বৃষ্টি আর তারপরে স্লিম ট্রিম ঘোড়া দেখে মন বলল কর্ম টা বোধহয় ঠিকই হয়েছে। ও বেচারার আমাদের যুগলের ওজনে যারপরনাই কষ্ট পেত ... এদিকে অবলা জীব , মুখে না বললেও ওজনের বহরে যদি গা ঝাড়া দেয় তা থেকে হয়ে যেতে পারত একখান বড়সড় কাণ্ড !!! আর বৃষ্টির জলে কাদায় ঘোড়া - ঘুড়ি সব কাদায় স্নাত । চেহারা গুলো না ওজনে না দেখনে কিছুতেই খোলতাই ছিল না।
পরের দিন আমাদের গুলমার্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার কথা ... রাতে সাহস নিয়ে সকলে মটন রোগানজোস খেয়ে ঘুম দিলাম। পরের দিন ওই জোস খাওয়ার দরুণ নাকি পাহাড়ের জলে সবার হোস একে একে যেতে শুরু করল ... তা বলা মুশকিল। এই খতরনাক জোটের জোস কাটিয়ে হোস ফেরত এলো ঘোরাঘুরির শেষ দিকে । আসলে কেনা জল সাথে থাকলেও তার হিমশিতলতা আমাদের হোটেলের রান্নাঘরের গরম জলের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়েছিল । সাথের ইলেকট্রিকাল কেটেলটি আমরা ব্যবহার করতে পারিনি হোটেল কর্মীদের কড়া নজরদারির জন্য।
আণ্ডা বাচ্চা , শীতের প্রকোপ আর শরীরের গোলোযোগের পর্ব খানিক সাজিয়ে গুছিয়ে একটু গড়ানো বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম গুলমার্গের উদ্দেশ্যে।
বেশি খাওয়ার ও কম খাওয়ার দু রকম শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিল যাত্রা পথে দুজনার , তবে শুরুতেই রোদ ঝকঝকে দিনে লিডার নদীর পাশে বাস থেকে নেমে একটু ছবি তোলার হুজুগে কজন নেমেও পড়লাম। আমাদের টিমের লিডার লিড করে নিয়ে গেলেন । প্রতিবারে সবার ছবি আমি তুলি , আমার ছবি ভুলি ... এমন ধারা হলেই জোর জুলুম করে তুলিয়ে নিই নিজের ছবিছাবা। এবার ভূস্বর্গের কি মহিমা ... আমি যথানিয়মে ছবি তুলছি আর তিনিও ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে এক্কেরে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন । কখনো মোবাইল ক্যামেরা তো কখনো আমার ক্যামেরা খান হাতে করে ক্যামেরায় ধরে ফেলেছে আমাকে ... আমিও ভারি গদো গদো হয়েছি এবারে ।
শরীরের হুজ্জুতি যখন যেমন চলুক , তার নিদান দিয়ে ফের আমরা সর্ষে ক্ষেত, নদীর ধার , বরফের চাদরের আদর , গাছের পাশে , ডাল ধরে ... যা যা পোস পসিবল সবে ক্যামেরা ভর্তি করে ফেলেছি । শরীর সাথ না দিক ইচ্ছে শক্তি আর মনের জোর জোরদার ছিল ... ছবিতে ছবিতে কাশ্মীরি কবিতা লিখে ফেলেছি ভরপুর । ছবি দেখে কে বলবে যে আমরা এক একদিন এক একজন শারীরিক কষ্টের সাথে পথ চলেছি ....
সেদিন পথে একজনের মাথা ঘুরু ঘুরু তো অন্য জনের পেট গুলু গুলুর দরুণ চলতি পথে ফুলওয়ামা পেরিয়ে পাণ্ডব কূলের বাসভূমি অবন্তীপুরা যাওয়া হল না । তার আগে অবশ্যি সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে জেগে উঠেছিলাম সকলেই। এরপর রুখাশুখা আপেল বাগিচার পাশের দোকান থেকে জনতা জনার্দন ( আমি বাদে ) কোল্ডস্টোরেজের সবুজ আপেলের রস খেয়ে আপ্লুত হয়েছিল। এরপর উইলো গাছের কাঠের তৈরি ব্যাট ফ্যাক্টরী দেখতে নামলেন শুধুই আমার কর্তামশাই। তারপরে পেট পূজোর পর্ব মিটিয়ে সবাই খানিক ক্লান্ত শরীর বাসে করে এগিয়ে গুলমার্গের পানে ধেয়ে চললাম .... পৌঁছনোর কিছু আগেই তুষার শুভ্রতা নিয়ে দূর থেকেই যেন হাতছানি দিল গুলমার্গের হিমালয় । তখন আমি আর ছোটগিন্নি দুজনেই কাহিল , কারণ পেটের মধ্যে তখন বড় রকমের গোলযোগ চালু হয়ে গেছে । পথের পাশের তুষারের শুভ্রতা তখন মনোরম এর বিপরীত দিকে ঘোরাঘুরি করছে । অবশেষে গুলমার্গের হোটেল আফরবতে পৌঁছলাম .... ঘরে ঢুকে কাজের চাপে ছোটগিন্নির পেট কেস ডিসমিস হয়ে গেলেও, আমি তখনও পথের শেষ দেখা বাকি ....
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment