Wednesday, 17 May 2023

 


বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৮

রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরেই দেখি আরেক বিপদ তার ডাল পালা মেলে ধরেছে ... কন্যা পরেরদিন বেরতে নারাজ । আর বাপসোহাগীর বাবা ধরাশায়ী মানসিক ভাবে । কি আপদ বলাই বলো তো ? শারীরিক মানসিক সব রকমের গোলযোগ সামলানো কি মুখের কথা ? এমনিতেই আমার  আশা নিরাশার দোলচাল সর্বক্ষণ চলতে থাকে  ... কিন্তু ঘুরতে বেরনোর আমি খুব আশাবাদী বটে । ভাবলাম রাত গ্যাই  বাত গ্যাই হলেও তো হতে পারে !!!! দেখাই যাক না সকাল ওবধি । গরম ব্ল্যাঙ্কেটের ওমে নিজেকে সেট করে আশার ভাবনা ভাবতে ভাবতে দিনের শেষে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।  যথানিয়মে সকাল হল .... আগের রাতে আমার জামাই বাবুও কাত হয়েছিলেন  , সকালে খবরাখবর নিতে দিদির ঘরে গিয়ে দেখি আগের রাতের কাত জামাই বাবু সোনমার্গ যাওয়ার উৎসাহে মাত ।জামাই বাবু যা বললেন  গানে গানে তার  মানে দাঁড়ায় ... ছোড়ো কাল কি বাতে, কালকে বাতে পুরানী....আমি খানিক হালে পানি পেলাম । যদিও ঘরের সিনিয়র তখনও যাব কি যাব না গানের মাঝেই রয়েছে। তার  মনের ইচ্ছে ... মেয়ের সাথে থেকে যাওয়ার  !!! হোটেলের এক ঘরে আশার আলো জ্বালিয়ে  নিজের ঘরে ফিরে দেখি আলো আবার নিভু নিভু । কেন  কেন ?? মেয়ে ঘুম কাটিয়ে উঠে তার পেট গুলু গুলুর খবরে ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে তার বাবার , আমারও বটে  !!!! তার মধ্যেই নাটুকে নাকি চিৎপুরী উক্তিতে বাবা - মা ধরাশায়ী । কন্যা উবাচ ... " মা , আমার ইচ্ছে করছে না যেতে , কিন্তু তোমার এতদিনের ইচ্ছাপূরণ করতে কষ্ট হলেও আমি যাব মা 🤔🙄 ।" 

হেনকালে ছোটগিন্নির আগমন ... এসেই হল সমাধান ... "আজ মায়ের কাছে হিয়াকে ( আহেরীর ডাক নাম )রেখে যাব গো । ওর শরীর ভাল নেই মোটেই। পেট গুলু গুলুর সাথে আরো উপসর্গ উপস্থিত ।" আমরা তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেললাম ভবিষ্যত কার্যাবলী ... দুই বন্ধু হোটেলে থাকবে দিদার কাছে । মেয়েকে ছাড়া সোনমার্গ যাব ভেবে মনটা একটু উদাস হলেও পরমুহূর্তে দুই বন্ধুর উল্লাস আর এরপরে হোটেলের বারান্দা থেকে বিদায় জানানোর আনন্দিত রূপে পষ্ট বোঝা গেল ওদের স্বাধীনতা দিবস ভালই কাটবে । ওদের খাওয়ার ব্যবস্থাও হোটেলের রান্নাঘর মারফত প্রস্তুত করার পর আমাদের দুজনার রোজের চিড়ে সেদ্ধ খেয়ে আর ইলেকট্রল প্রস্তুত করে সোনমার্গ রওনা হলাম । 

বাস চালু হতেই আমি চক্ষু বুজে আর দেবাশ্রিতার দেওয়া হজমি , মৌরি খেতে খেতে শরীরের নানা রকম আপদ বালাইকে হজম করার চেষ্টার ত্রুটি রাখলাম না । মাঝে মাঝে পথের শোভাও দেখা চলছিল । পুরো মুদিত নয়ন থেকে  এমন মন মাতানো প্রকৃতির রূপকে না দেখার মতন বোকামি করা কি যায় ? তবে শরীরকেও পুরো উপেক্ষা করার উপায় নেই।  তাই ব্যালেন্সের থিয়োরী অ্যাপলাই করতে করতে চলেছিলাম।  আমাদের হিল্লোলও কখনও জাগন্ত, কখনও খেলন্ত আবার কখনও বা ঘুমন্ত হয়ে আমাদের সাথ দিচ্ছিল।  পথে এক জায়গাতে সিন্ধু নদ দেখে ইতিহাস ছুঁতে আকুলি বিকুলি করে বাস থেকে নেমে পড়লাম।  সে সব ছবি ফেরার পর ফেসবুকে ইতিহাসের হাত ধরে পোস্টিয়েছি , হেনকালে আমার ছোটকালের বান্ধবী যে আবার বেড়ানোর ডিগ্রীধারি, ধরল চেপে ... কাশ্মীরে সিন্ধু নদ পেলেই হোলো?  এ কি মগের মুলুক নাকি !!! সে তো লে /লাদাক হয়ে পাশের মুলুকে ধায় !! আবার ছানবিন চলল ... তথ্য মিলল। একই নামে ভিন্ন এ নদী । যাক সে সব তৎক্ষণাৎ শুধরে নিয়ে এগিয়ে চলি , কেমন ... ?

প্রকৃতির সাজুগুজু এ পথে বার বার আমাদের মুগ্ধ করেছে , নেমেও পড়েছি বার দুয়েক। অন্য ভ্রমণার্থিরাও একই ভাবে পথের মাঝে থেমে , নেমে ছবিতে ছবিতে হিমালয়ের গল্প লিখেছে অগুন্তি। এক সময় সোনমার্গ পৌঁছলাম সকলে । এখানেও স্নোবুট পড়ে থপ থপিয়ে শম্বুকের গতি প্রাপ্ত হয়ে সবার পিছু পিছু চললাম মূল রঙ্গমঞ্চের দিকে । কর্তামশাই ভারি কাহিল তখন , একদিকে চিড়ে খাওয়া দুবলা শরীর, সাথে ঠাণ্ডার কাঁপন এবং সর্বোপরি স্নোবুট পরে হন্টনের ধকল। যেখানে পৌঁছে খেলা জমে উঠল , সেখানে হাজির হতে হাঁটতে হবে অনেকখানি ( যেটা সব মেটানোর পর জেনেছি) , শর্টকাট ধরতে আমাদের দেশের সকলের জুড়ি মেলা ভার ... প্রথমেই শুনলাম ঘেরা অংশ নাকি টপকাতে হবে । শুনেই মনে হচ্ছিল টেনে ছুট দিই। সে পথও বন্ধ।  এই ভয়ানক বুট পরে হাঁটতেই অস্থির, তাতে ছোটা তো আরেক বিপদের গল্প !!! মনে মনে প্রমাদ গুনলেও যখন উপায় নাস্তি ( উপায় ওবধি কেউ যাচ্ছিলেন না , তাতেই আরো গোলযোগ) এদিকে ওদিকপানে র হাতছানি প্রবল ... অগত্যা জয় মা বলে কিছুটা আপদ বালাই কমের দিকে এমন টপকানোর দিশা ধরে এগিয়ে পড়লাম।  এক কাশ্মীরি স্লেজ চালকের হাত ধরে শেষমেষ যেন এভারেস্ট জয় করলাম  , কিন্তু হলে কি হবে এ সবে যার হাতযশ দারুণ বলে জানি তিনি টপকানো পর বরফের ওপর আছাড় খেয়ে আমার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরালেন । আরো জনা দুয়েক স্লেজ চালক তেনাকে খাড়া করে , এবার দুজনকেই স্লেজে চাপাতে উদগ্রীব হয়ে উঠল । একদিকে কৃতজ্ঞতা অন্য দিকে অনিচ্ছা এর দোলচাল চলতেই লাগল মনে , সাথে তেনাদের সেন্টিমেনটাল কথার দরুণ কিছু মূল্যের বিনিময়ে নিষ্কৃতি পেলাম শেষমেষ ... দলের বাকিরা আগেভাগেই স্নোস্কুটারের টিকিট কেটে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল ... আমরা এ সব মিটিয়ে ভুট্টা খেয়ে আরও একবার বরফে আছাড় খেয়ে ( আমি নই ) দলযুক্ত হয়ে স্নো স্কুটারে আসীন হয়ে .... আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে বলে আরো উর্ধে ধেয়ে চললাম। আসে বরফ পাশে বরফ , যত দূর দৃষ্টি ধায় সবেতেই বরফ .... বরফে খানিক গড়াগড়ি খানিক ধরাধরি ( স্নো বল ) করে বিস্তর ছবির পর্ব মিটিয়ে এবার উতরাই পথ ধরতাই করতে ফেরার স্নো স্কুটারে উঠে পড়লাম।  ক্যামেরাসহ ব্যাগ পিঠে , সাইড ব্যাগকে মালা করে গলায় ঝুলিয়ে রওনা দিলাম।  গলায় ঝোলালাম  , কারণ যাওয়ার সময় চড়াই পথে কাঁধের ব্যাগ হাওয়া আর স্কুটারের গতির গুঁতোয় উড়ি উড়ি গতি প্রাপ্ত হচ্ছিল । তাই এই সাবধানতা । উতরাই এর আগের সকলের স্কুটারে আসীন মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করল ছোটগিন্নি । তারপরের কয়েক মিনিট পুরো আতঙ্কিত আত্মারাম কে সামলাতে সামলাতে হুস করে নীচে নেমে এলাম । এসে দেখি বাকিদের মুখের অভিব্যক্তি আমার মতনই ফ্যাকাসে পানা । ছোটগিন্নি তো ছবি তুলে ছানা আর ব্যাগ কোলে কাঁখে নিয়ে এক হাতে ব্যালেন্স সামলে আর ছোটো র জ্যাকেট টেনে ধরে ফেরত এলো । হিল্লোল স্কুটারের বদলে খানিক হাওয়ার মধ্যেই রাইড সেরে ফিরল । ছোট্ট মানুষ, ভয়ের বোধ এখনও হয়নি তার। এদিকে আমরা সব শুনেই আতঙ্কিত।  রাইডের শেষে গাইডের গাইডলাইন ধরে সকলে  চা পানে রত হলাম।  এরপর আবার ধরাধরি করে রেলিং টপকিয়ে আমাদের বাহনের দিকে পা চালালাম । সোনমার্গ দেখা শেষ হল ... ভাড়া করা বুট থেকে পদ যুগলকে মুক্ত করে এবার ফেরার পথ ধরে ফেললাম। ফোনাফুনির মারফত ওদিকে র খবরাখবর নেওয়ার পর বুঝলাম ... তেনাদের সারা কাশ্মীর ভ্রমণের সেরা দিন ছিল নিজেদের মতন করে কাটানো হোটেলের দিনযাপন । 

সন্ধ্যার মুখে ঘরে ফিরে ক্ষণিকের বিরতি কাটিয়ে দল ঝাঁপ দিল সামনের মার্কেট চত্বরে , যে যার মতন এদিক ওদিক ছড়ালেও জুটবো একসাথে হোটেল শামিয়ানায় তেমন কথা আগে হয়েছিল । দেবাশ্রিতার কথায় সবাই সায় দিয়েছিলাম এ ব্যপারে যে শেষ দিকে এক দু দিন কাশ্মীরি   রান্না না খেল চলে না । আসার আগের দেখা ফুড ব্লগ কে এভাবে পুরোটাই বেকার করে দেওয়া রীতিমত দুঃখজনক !!! কাজ কাজেই কেনাকিনির পর কাশ্মীরি ভেজ আর নন-ভেজে মন ভিজল , শরীর জুড়োলো তো বটেই । পরের দিন আমাদের ঘোরাঘুরির পালা চুকিয়ে স্থলের বাস উঠিয়ে জলের বাসস্থানে একরাতের জন্য থিতু হওয়ার কথা । কাজেই মনের মতন খ্যাটন  মিটিয়ে ১১ টা পেরনো রাতে বুলেভার্ড রোডের হোটেলের ঘরে ফিরে সব গুছু হল এক প্রস্থ । তারপর ঘুমের ঘোরে ডুবে যাওয়ার সময় এসে গেল । 


 @শুচিস্মিতাভদ্র

No comments:

Post a Comment