বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৭
বছরের এই সময়ে টিউলিপ বাগানের দোর খোলে , দেশ বিদেশ থেকে আগত টুরিস্ট ভিড় করে । এবারের উন্মাদনার পারা প্রথম থেকেই উচ্চগ্রামে বাঁধা। বাংলা তো বটেই ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ থেকেও জনতা জনার্দন এসেছে কাশ্মীরে, যেন কবির কথার সাথে মিল রাখতেই ... বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান । এ বারে টিউলিপ বাগানের দোর খুলেছে ১৯ মার্চ আর আমরা বাগানে পা দিলাম ২৮শে মার্চ ( ২০২৩) ।
মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা আবার অটো , টেম্পো সব পর্ব পেরিয়ে বাগানের কাছেই কিলবিলে জনতার মাঝে ল্যান্ড করলাম। চড়া রোদে তখন ঠাণ্ডার প্রকোপ বলতে গেলে নেই নেই । নেমেই ছোটগিন্নি আকুলিবিকুলি করে ফুচকার লাইন পাকড়াও করার আব্দার পেশ করে ফেলতেই, আমরা কজনা এক ফুচকাওয়ালা কে পাকড়াও করলাম .... কি সাহস আমার ?? পেটের মধ্যস্থলে অবস্থিত চিড়ের জাস্ট ওপরে একখান শুখা ফুচকা চালান করলাম। পরের বায়নাক্কায় যুক্ত হল কাঠি আইসক্রিম .... সেদিকে না ভিড়ে আমি বায়নার আয়নায় একখান লাল টুপি বাগালাম। রেশমী চুড়ির প্রতি তেমন টান নেইকো আর বায়না না মিটলে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার চিরকালের ভরসা আমার ফর্সা হয়েছে অনেকদিন , কাজেই ও নেহাতই বেকার আমার কাছে । টুপি পরার পর দেখি ছোটদি যারপরনাই গম্ভীর !!! একবার বলেই ফেললে ... " বড়ো দেরি করছিস তোরা !!! দেখার সময় কমে যাচ্ছে তো .... "
অতঃপর টিম আগুয়ান হল । এবারের পথের বিপরীত পাশের বাগানের কিছু কিছু বিষয়ের দিকে ক্যামেরা তাক করে আরো খানিক সময় ব্যয়িত হল ... টিকিট কেটে বাগানে ঢুকতেই নানান রঙের মুগ্ধতা ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের যেন অবস করে দিল । কন্যা তার বান্ধবীর সাথে সেঁটে ওদের সাথে ঘুরন্ত হল , এদিকের ফুলের বাহারে আমরা দুজনা আহারে বলে ক্যামেরা বাগিয়ে অপর দিকে হাঁটা দিলাম। কন্যাকে নিয়ে চিন্তামণি হওয়ার কারণ নেই কারণ ওদিকে র দল যারপরনাই ভর ভরন্ত গার্জেন সমাগমে। আমরা নিজেদের মতন দলছুট হয়ে মুগ্ধ নয়ন মেলে একে অপরকে কম দেখে রঙের মেলায় নিজেদের মেলে ধরে মেলাই ছবি তুলতে লেগে পড়লাম। হঠাৎই দেখি এক নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান বিশাল লেন্স আর তার স্ট্যান্ডসহ স্যাণ্ডিংমোডে লেন্স তাক করে টিউলিপ রাশির ছবি বন্ধী করছেন ... সুযোগ মতন তেনাকে ধরে খান কতক যুগলের যুগলবন্দী ছবি তুলিয়ে নিলাম ... ধন্যবাদের পর্ব মিটতে না মিটতেই দলের বাকিরা ধরা দিল ... এবার দল , নির্দল ইত্যাদি প্রভৃতি ছবির লাইন লেগে গেল । পিচ পরিবার ও শ্বেত পরিবার সকলেই নানা অ্যাঙ্গেল থেকে চোখেচোখ , হাতে হাত , শুভদৃষ্টি পোস যেরকম যেরকম ছবিতে ধরা সম্ভব ( শোভনতার মাত্রাযুক্ত অবশ্যই) সব ধরতাই করে ফেললাম। এক সময় আমাদের কুচোকাচা গণ ক্লান্ত হয়ে ভুঁয়ে বসে পড়েছিল ... বাবা - মা দের ছবি তোলার অক্লান্ত উন্মাদনা তারা আর সইতে পারছিলো না । সব ছবি ক্যামেরা বন্দী করা যায় না , তা আর কে না জানে ... অগত্যা টিউলিপ দের বিদায় জানাতেই হল । বার বার পিছে ফিরে চাইতে চাইতে এক সময় দরজার ওপারে বেরিয়ে এলাম সবাই ... সবার শেষে অবশ্যই আমি । সুযোগ পেলে আরো একদিন সময় করে যেতাম । এখন সুযোগের অভাব চারপাশে । অগত্যা ....
চোখের ক্ষুধার নিবারণের পর পৈটিক খিদে চাগিয়ে উঠল ... তবে আমরা সাবধানী। ঘোরাঘুরির বাকি তখনও বেশ কিছু । সাবধান না হলে চলবে কেন ? অগত্যা আসার আগে ফুড ব্লগ থেকে দেখা কাশ্মীরি কুইজিন কে মনের ভিতরে চাপা দিয়ে রেখে , চেখে না দেখার ভাবনায় মনের কষ্ট মনে ঢেকে রেখে ম্যাগী আর চাউ ভাগযোগ করে হামলে পড়ে খাওয়া হল । তবে দিদি ইলেকট্রলের বাইরে চোখই রাখল না আর জামাই বাবু রুমালি রুটি খেলেন ভেজ কারি দিয়ে ।এই জন্যই তো আরেক কবি বলেছিলেন ... ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
এরপরে দুখান বাগ বাগিচা দেখার কথা সাথে পবিত্র ভূমি হজরতবল মসজিদ। কিন্তু শেষমেষ কিছু বাদছাদ দিতেই হল .... সময় আর শরীর তখন বেশ ভিন্ন মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে । অগত্যা ..... ডাল লেকের সামনে অবস্থিত নিশাত বাগে হাজির হলাম । টিউলিপ বাগের ঘোরাঘুরির ফলে স্বপ্না কাকিমার কোমরের যাতনা তখন আর ঘোরাঘুরির পর্যায়ে নেই ... ব্যাথা কোমরে স্থির হয়ে ভয়ানক কষ্ট দিতে শুরু করেছে .. কাকিমা নামলেন না ... আমরা গোধূলি বেলায় নানা ফুলের ভরা , পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মুঘল গার্ডেন এর অন্যতম নিশাত বাগে ঢুকে পড়লাম । আমাদের দেশের রাজা , বাদশাহ দের সৌন্দর্য চর্চা তে আরো একবার মুগ্ধ হতে হতে ওপরে উঠে এলাম .... পিছনে পাহাড় বিপরীতে ডাল লেক ... ধাপে ধাপে সাত তলা এই বাগানের মাঝখান দিয়ে নামছে জলের ফোয়ারা .... একদম সামনে পাথরের বিশাল স্ল্যাবে বসার ব্যবস্থা । আমার কন্যা আর তার পিতাশ্রী সেই আসনে গদিওমান হলেন .... বললেন ... তোমরা ঘোরো , আমরা বসলাম !!! জোরাজুরি আর জারিজুরি খাটবে না তা জানা সেই পথচলার শুরুর থেকেই ( যাতে মত মেলে তাতে তিনি আমার সাথ দেন 🤫) আর দিন রাতের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে তাই আমি ক্যামেরাসহ প্রায় ছুটতে শুরু করলাম। হাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে এবং কাঁপিয়ে( শীত করতে শুরু করেছে তখন ) ছবি তুলে কিছুক্ষণ পরে ফেরত এলাম ..... তেনারা তখনও নট নড়নচড়ন। বলার উপায় নাই নাই ... এমনিতেই তেনার শরীর গতিক গোলমেলে ... একসাথে সব দেখতে পেরেই আমি যারপরনাই আনন্দিত তখন। এখানেও এক শখের ক্যামেরা পারসনের সহায়তায় খান কতক দোকা ছবি তুলিয়ে নিলাম ।
এবার ফেরার পালা হোটেল পানে । ফিরে একটু বিরতির পর টিম ১১ এর তিন খুদে আর একজনকে তাদের দেখভালে রেখে বাকিরা ডাল লেকের এ পারের ঢালাও মার্কেট চত্বরে নিজেদের মন প্রাণ ঢেলে দিলাম । স্বপ্না কাকিমাও কেনাকিনির নামে কেমন যেন ব্যথাশূল ভুলে বেরিয়ে পড়লেন । তারপর ???? তার আর পর নেই , নেই কোন ঠিকানা । হারে রে রে জনতা আঁছড়ে পড়েছে ... যেদিকে তাকাই দেখি বাঙালির ঢল ... কিতনা দাম বোলা ? বহুত জাদা হো গয়া । কম করকে দিয়ে দো না !!! এক দোকানিকে বলতে শুনলাম... " পুরা বাঙগাল উঠ কে আ গায়া " এক সময় মনে হল এ যেন বাঙালীর দ্বিতীয় ঘরবাড়ি পুরীর স্বর্গদ্বারের দোকানপাট ... যদিও এও আরেক স্বর্গ ... ভূস্বর্গ। কিনতে কিনতে আর তার থেকে বেশি দেখতে দেখতে আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম, এর মধ্যেই দুই ভায়রাভাই সাথের শেষ হয়ে যাওয়া চিড়ের খরিদারি করে ফিরে এল , কিন্তু ফেরার পথেই ছন্দপতনে যোগদান করলো স্বয়ং আমার জামাই বাবু । তুরন্ত জামাই বাবুকে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম ... হোটেলের পাশেই ছিলাম আমরা । ঘরে ফিরে দেখা গেল যে ছোট্ট হিল্লোল বাদে বাকি তিনজন ঘুমন্ত ও ঝিমন্ত । যদিও খুদে সদস্য হিলুকে ঘুম পাড়ানোর জন্যেই তার বাবা বাকি দুই সেমি ছানা দিদিদের নিয়ে ঘরে ছিলেন ।
সেই রাতে দিদিরা যুগলেই চিড়ে তে ভিড়ে গেল , এদিকে আমি একদিন পর ভাত ডালে ফেরত গেলাম সাথে অল্প ডিম ভুজিয়া ... তবে তা মুখে গুজিয়া দিতে বড়ই চিন্তার উদ্রেক হচ্ছিল , তিনি অভয় দান করলেন । তো খেয়েই নিলাম । পরের দিন সকলের যাওয়ার কথা সোনমার্গ বা সোনামার্গ । কিন্তুক সেখানেও গল্পের ঘনঘটা শুরু হল রাত থেকেই ....
@শুচিস্মিতাভদ্র
No comments:
Post a Comment