তরুণ তুর্কি
শুচিস্মিতা ভদ্র
পল্টন , ঘন্টাই , গুণগুণ, রুণি, পুটাস, পটাই , মাম্পা এমন সব অদ্ভুত নামীদের নিয়েই "তরুণ তুর্কি" যাত্রা শুরু করেছিল বছর তিনেক আগে । তবে ভাগ্যিস এ সব এদের ডাক্ নাম । তো যে কথা হচ্ছিল ..... "তরুণ তুর্কি" কি কোনো খেলার দল ? নাকি কোনো ক্লাব ? নাকি সমাজ সেবা মূলক সংস্থা ??
হযবরল যারা পড়েছ , তারা তো সকলেই কাক্কেশ্বর কে চেনা , তারা তো বুঝতেই পারছো যে এই প্রশ্নের উত্তরে কাক্কেশ্বর কি বলতে পারে ?? একদম ঠিক ধরেছ , উত্তরটা হতো .... " হয়নি হয়নি ফেলে ।"
সত্যিই ডাহা ফেল ।" তরুণ তুর্কি" হলো গিয়ে ঘনঘটা দত্তরায় ওরফে ঘটাদার কোচিং সেন্টার। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনীর কয়েকটা বিষয়ের পঠনপাঠন হয় এখানে । এখনকার সব বোর্ডের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়েই গড়া এই তরুণ তুর্কি বাহিনী । তবে এক বিশেষ কারণ জন্য ছাত্র ছাত্রীর স্রোত বয়ে চলে না এখানে ।
কেন ???? আসলে এখানে পড়াশোনার সাথে সাথে আরো কিছু বিষয় প্রাধান্য পায় , বলা ভাল পড়াশোনার আগে সেই সব বিষয়ের অবস্থান। আর সেই কারণে ইদানিং কালের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় সামিল কোচিং সেন্টার গুলোর থেকে এই তরুণ তুর্কি অনেকটাই পিছিয়ে।তাতে অবশ্যি ঘটাদা আদেও বিচলিত নয় । তার এক কথা , আগে প্রকারের বাড়বৃদ্ধি হোক , যুব সমাজ প্রকৃত মানুষ হোক ..... বাকি সব ওর পিছন পিছন হয়েই যাবে । যদি ভালো মানুষই না হলো , তো গাদা গাদা নম্বর বগলদাবা করে , উচ্চপদের মোটা টাকার চাকরি বাগিয়ে কি হবে ??
কিন্তু এমন ভাবনায় গা ভাসালে যে হাতে হ্যারিকেন ধরতে হবেই ..... এমন ভাবনায় ভাবিত মা , বাবার সংখ্যাধিক্যের জন্যই ঘটাদার তরুণ তুর্কির সংখ্যা কমের দিকেই । তো ভি আচ্ছা । ঘনঘটার মতে উচ্চমার্গের ভাবনা সবার জন্য নয় । তাই যেমন চলছে চলুক। পড়াশোনা কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই হয় এখানে। ঘনঘটা বিজ্ঞানের ছাত্র। সে আর তার এক বন্ধু নির্বিঘ্ন মিলে বিজ্ঞানের দিকটা দেখে । স্ত্রী নীপা পড়ায় বাংলা ।ঘনঘটার এক খুড়তুতো বোন আছে , সে পড়ায় ইংরেজী। বাকি অন্যান্য বিষয় এখনো কিছু পড়ানো হয় না । খুব বেশী নয় ছাত্রছাত্রী , তাই অসুবিধা নেই। তবে এখানকার ছাত্রছাত্রী মানে ঘটাদার তরুণ তুর্কিদের যেটা অবশ্যই জানতে হয় , না জানলে এখানকার তুর্কি হওয়াও নাকচ হয়ে যাবে হয়তো বা ..... তা হলো প্রত্যেককে প্রত্যেকের ভালো , খারাপ, পছন্দ অপছন্দ সমান ভাবেই গ্রহণ করতে হবে , জানতে হবে । নিজের বিষয় কম জানলেও চলবে । ঘটাদা বলে ..... ' প্রত্যেকে আমরা পরের তরে বুঝলি রে ?? তোরা এখন একান্নবর্তী পরিবার মানে joint family এর ব্যপারটা জানিসই না। যে সময়টা এখানে থাকবে তখন অন্তত "আমি আমি" ভাবনাকে চাবি বন্ধ করে সবার জন্য ভাববি , না হলে এখানে আসবে না , বুঝলি !!!! '
পড়ার দিন ছাড়াও রবিবারের সকালের ঘরোয়া পরিসরে চলে "খোলা হাওয়া " নামের আড্ডা বৈঠক ।সেখানে পড়ার বাইরের কথা হয়। একমাত্র ঝাঁপ বন্ধ থাকে বিশেষ কোন কারণজন্য আর পরীক্ষার মরসুমে। ওই দিন ভাগযোগ করে গল্প, গান, কবিতা পাঠ , খাওয়া সব রকম চলতে থাকে । কখনো নীপা বৌদি চটজলদি কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে ফেলে তুর্কিদের জন্য। তরুণদলও কখনো বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসে, কখনো একদমই খালি মুখে গল্প চলে আর মোড়ের বঙ্কিমদার দোকানের মুড়ি চানাচুর তো হাতের পাঁচ আছেই।
নীপা বনগাঁ লাইনের হাবড়াতে একটা সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা আর ঘনঘটা আপাতত কোচিং নিয়েই ব্যাস্ত , বলা ভালো ব্যতিব্যাস্ত । বেশ কয়েকটা বেসরকারী চাকরিতে হাত পাকালেও , ওই প্রকারের উন্নয়নের চক্করে পড়েই সব চাকরিতে ফুলস্টপ পড়েছে। তাতে অবশ্যি ঘটাদা আদেও চিন্তিত নয়। কোচিং তরুণ তুর্কির তুর্কিদের আত্মিক উন্নয়ন বা প্রকারের বাড় বাড়ন্তের ভাবনা নিয়েই তার দিন কেটে যায় । পড়াশোনার উন্নয়ন নিয়ে বেশি ভাবিত নীপা আর ঘনঘটার বোন আহ্লাদিনী। ননদ বৌদি মিলে সেদিকে যা যা করণীয় তার যথাসাধ্য ব্যবস্থাপনা করে । ঘটাদাও থাকে সেসবের , তবে তার এক কথা -- ' আগে মানুষ হতে হবে মানুষের মতন , প্রকার শানাতে হবে। তারপর বাকি সব ..... ।'
নীপা বৌদি বলেন -- ' বুঝলাম , কিন্তু পড়াশোনা ছাড়া শুধুমাত্র প্রকার দিয়ে এযুগে কিছু হয়না । '
' তেমন তো একবারও বলিনি , তুমি অন্তত অন্যদের মতন , আমার ধ্যান ধারণার অপব্যাখ্যা করো না । ' -- রেগে জবাব দেয় ঘটাদা।
অধিকাংশ সময়ের মতনই এই তর্ক বিতর্কের সমাধানে আহ্লাদিনী হাল ধরে -- ' তোমরা দুজনেই ঠিক । কিন্তু দাদাসোনা, প্রকার যে উন্নত করবে , তার জন্য কি ওরা কিছু করছে ? মানে আমি বলতে চাইছি যে তুমি কি বোধদয়ের পাঠ জাতীয় কিছুর ক্লাস নাও ? যদিও আমি বেশি দিন এখানে যুক্ত হইনি , কিন্তু কিছু তো তেমন দেখিনি । তাহলে সে সব হবে কি করে ? বা আদেও ওমন উন্নতি কি ওদের কিছু হচ্ছে ? '
' তোরা সব বুদ্ধির জাহাজ , পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে বসে থাকিস !!!! ' ----মেজাজকে নিজের আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করে আহ্লাদিনীর দাদাসোনা।
' ক্লাসে এসব পড়াবো ?? বই নিয়ে বোঝাবো কি ভালো আর কি মন্দ ? আর বই এর ভারি ভারি কথা শুনে ওদের মনের প্রসার ঘটবে , প্রকারের উন্নয়ন হবে ???'--- বিরক্তি চাপা থাকে না ঘনঘটার উত্তরে।
ননদ বৌদি দুজনেই দৃষ্টি বিনিময় করে ....... ঘনঘটার দৃষ্টি এড়ায় না, মুখে হাসি খেলে যায় ‐--- ' আমি পড়ানোর মধ্যে গল্পের ছলে ওদের অনেক গম্ভীর বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করি । পাঠ্য বই তো জ্ঞানের বাণীতে ঠাসা । ওর বাইরে যদি একই ভাবে ওসব শোনাতে যাই , ওরা তো পালাবে । ভালো লাগবে না , মনে দেবে না , তাই সব বুঝতেও পারবে না । গল্পের ছলে , জীবনের থেকে, পারিপার্শ্বিক থেকে , বাড়ির থেকে , আমাদের থেকে সব দেখুক, বুঝুক ,তারপর শিখুক। সব যে ভালো শিখবে , তা নয় , কিন্তু নিজে বুঝে যেটা মনে করবে গ্রহণ করুক। আমাদের কাজ আমরা করি , তারপর দেখা যাবে। আমরা কোন পথ দেখলাম, সেটা অনেকটা matter করে। '
একটু থেমে দম নিয়ে নেয় ঘনঘটা , জল খেয়ে আবার শুরু করে --- ' আমাদের এই "তরুণ তুর্কি " এর ট্যাগ লাইন জানিসই, সকলকে সকলের সবটা জানতে হবেই। দোষ গুণ সব। আর শুধুমাত্র জানা নয় , মানতে হবে , মানাতে হবে । আমাদের কাছে সবাই সমান হবে। কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকা চলবে না । মেধা সবার সমান নয় , গ্রহণ ক্ষমতাও সমান নয়। যে যেমন বুঝবে , যতবার বলবে বুঝিয়ে দেবো । নম্বর যে যেমন পাবে , সেটা তার নিজের অর্জিত। আর রেজাল্ট বেরোনোর আগেই জমজমাট সেলিব্রেশন করব আমরা সবাই। কারণ ভালো নম্বর, খারাপ নম্বরের পক্ষপাতিত্বকে এড়ানো মুশকিল। কিন্তু আমাদের তরুণ তুর্কিরা যেন মুখ ভার না করে। '
নীপা বৌদি চোখ গোল করে বলে ----- ' দেখেছ তো !! তোমার দাদাসোনার প্ল্যান । এভাবে কোন কোচিং সেন্টার চলে ? লাটে উঠবে বলে দিলাম। ব্যবসা করতে আমিও বলছি না । কিন্তু কিছু তো মানবে !! সেদিন স্কুলের মুখার্জি দা বলছিলেন.....'কি হে তোমাদের তরুণ তুর্কি কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা ছাড়া অন্য বিষয়ে নাকি বেশি জোর দেওয়া হয় ? এটা সত্যিই নাকি ? '
***************
আহ্লাদিনী মাস দুয়েক এখানে পড়ানো শুরু করেছে । আসলে সে পাকাপাকি ভাবে কোনও চাকরিতে এখনো যোগ দেয়নি , এখন সে নানা ধরণের কম্পিটেটিভ পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে । দাদাসোনার অনুরোধে এখানে পড়ানো শুরু করেছে । পড়াতে ভালই লাগছে । বেশ কড়া মেজাজের আহ্লাদিনীর, নামের সাথে প্রকৃতিগত মিল একদমই নেই। ঘটাদার তুর্কিরা এরই মধ্যে একটা নামকরণও করে ফেলেছে । সেটা যদিও আহ্লাদিনী জানে না । তবে নীপাবৌদি আর ঘটাদা একদিন শুনে ফেলেছে ......... আহ্লাদিনীর অপভ্রংশ লাদিনী , সেখান থেকে কড়া মেজাজের জন্য লাদেন ম্যাম। ঈশ্ !!!! পারেও বটে । শুনে মুখ লুকিয়ে ঘনঘটা হেসেও ফেলেছিল। তবে তুর্কিদের সামনে মেকি গাম্ভীর্যে মুখ ঢেকে নিয়েছিল। ওরাও কিছু বুঝতে পারেনি।
' আচ্ছা বৌদি তুমি মাঝে মাঝেই কেন বলো এখানে সব লাটে উঠবে ? পড়াশোনা তো ভালোই হচ্ছে ।' ..... আহ্লাদিনীর প্রশ্নে নীপার মুখে কৌতুক খেলে যায় , বলে ..... ' শোনো এই যে শনিবার করে ওরা খোলা হাওয়া খায় , মানে ওই যে আড্ডার আসর বসায় , এমন কোনও কোচিং সেন্টারে কখনো দেখেছ বা শুনেছ ? সরস্বতী পুজো আর কোনও একটা , দুটো সেন্টারে একটা বিজয়া মিট , এই তো পালন হয়। এসবের জন্য তোমার দাদাসোনার তুর্কি বাহিনীর গার্জেনরা না আবার গর্জন করেন !!!! '
ঘটাদা ফুৎকারে নীপার কথা উড়িয়ে দেয় --- ' এমন গর্জন এখনো কানে আসেনি আর ছুটির দিনে অন্য রকম আড্ডা না দিয়ে , ওরা যে এখানে মিলিত ভাবে হৈচৈ করে , তাতে বরং ওনারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। কারণ এখনকার প্রজন্মের আড্ডার ধরনের বেশ বদল হয়েছে , অনেকক্ষেত্রে আবার সঙ্গীর রকম ফেরে তা স্বাস্থকর আড্ডাও নয়। আর by the way তুমিই তো খুব উৎসাহের হাওয়া দিয়ে , "খোলা হাওয়া" নাম দিলে । তবে এখন উল্টো গান ধরলে কেন ? '
নীপা মৃদু হাসে, কথোপকথন চলতে থাকে .... ' কিন্তু দাদাসোনা , ওদের নিজস্ব পরিসরে , আমাদের সব সময় থাকাটা তো সুস্থ নয়। "
' থাকি না তো !!! আর যার যেমন সুবিধা , তেমনই আসে , কোনো জোরাজুরি নেই। নিজেরা মজা করে ,গল্প, গান চলতে থাকে , কখনো ওরাই ডাকে , কখনো অল্প যোগ দিয়ে , চলে আসি । '
আহ্লাদিনী আশ্বস্ত হয় কিছুটা । নীপা বৌদি সংশয় প্রকাশ করে -- ' কিন্তু এখনকার প্রজন্ম বড় বেশী আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর, ওরা কতটা তোমার ভাবনার কদর করবে , আমার সন্দেহ হয় ।'
' ওরা আমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা , কিন্তু সেটা শুধুমাত্র নেতিবাচক এটা আমার মনে হয় না । ওদের মধ্যে ভালোমন্দের বোধের থেকেও প্রতিযোগিতার দৌড়ে সামিল করিয়ে দেওয়ার ঝোঁকটাই আমাদের প্রজন্মের গুরুজনদের মধ্যে বেশি। ' .-- ঘটাদার গলায় হতাশা ঝরে পড়ে।
' প্রতিযোগিতা কবে ছিল না বলো দেখি ? '----- নীপার কথা ঘনঘটা হাত তুলে থামিয়ে দেয় ----- ' সুস্থ প্রতিযোগিতা এখন কোথায় নীপা ? একজনের ভালো নম্বর দেখে তার সতীর্থ হিংসা করছে , সেখানে আমরা বাঁধা না দিয়ে ইন্ধন জোগাতে ব্যস্ত। সুস্থ প্রতিযোগিতা তো ভালোও, আবার উপকারীও। আমার আর ইন্দ্র মধ্যেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা ছিল স্কুলে , তারপর কলেজেও , কিন্তু কোনো হিংসাত্মক ভাবনা সেখানে কাজ করতো না । কখনো নম্বরে ইন্দ্র এগিয়ে , আবার কখনো আমি । ' ----- স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে ঘনঘটা ।
ঘটাদার যুক্তি অকাট্য। তার মতে , তার ভাবনা অনুযায়ী অল্প কজনই যদি জীবনে পথ চলে , তাই চলুক না , সবাই যে সব গ্রহণ করবে এমন তো নয় !!!!
****************
" শীতের হাওয়ার লাগল নাচন " --------- বড় দিনের ছুটি পড়ে গেছে স্কুলে আর ঘটাদার " তরুণ তুর্কি কোচিং সেন্টার " - ও কদিনের জন্য ছুটি। ছুটির দিন গুলোর নিস্তব্ধ ঘটাদা , নীপা বৌদির ভালোই লাগে না । তবে শনিবারের "খোলা হাওয়া "-তে ওরা ইচ্ছে করলেই আসতে পারে , তবে এসময় ছুটির মেজাজে , পিকনিকের হল্লায় বেশিরভাগই কোন তুর্কির আগমন ঘটে না । ঘনঘটা কোন এক অজ্ঞাত কারণজন্য এদের নিয়ে অন্য কোথাও পিকনিকের আয়োজনে রাজি নন । আর কোচিং সেন্টারে আর আলাদা করে পিকনিক করার কথা কারো মাথায় ও আসেনি , কারণ ওদের সবার মুক্তির ঠিকানা , খোলা হাওয়া তো আছেই ।
এবার আহ্লাদিনীও কদিনের জন্য দুই বন্ধুর সাথে ছুটি কাটানোর জন্য শান্তিনিকেতন গেছে।
' চলো না , আমরা কদিন কোথাও ঘুরে আসি ।' ---- নীপার কথায় দাদা নড়েচড়ে বসে।
' গেলে হয় , কিন্তু আগাম ব্যবস্থা না করে তো এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। একটা ছুটি পেলেই তো সবাই দে ছুট......সব বুকিং আগে থেকেই Done । ' ঘনঘটা স্বগোতোক্তি করে।
' যা বলেছ !! তবে চলো একদিনের জন্য দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি , কতবার যেতে বলে !! ' ... নীপাবৌদি ইচ্ছা প্রকাশ করে।
হঠাৎ বাইরের গেটের শব্দে দুজনেই তাকিয়ে দেখে তরুণ তুর্কির কজন তুর্কি বাগানের গেট খুলে ঢুকছে , চোখে মুখে উদ্বেগ আবার উত্তেজনার মিশেলে অদ্ভুত অভিব্যক্তি । ঠিক ধরতে পারে না তারা , নীপা বৌদি উঠে আসে ।
' কি রে তোরা ? পল্টন তোর আজ বাড়িতে বড় দিনের অনুষ্ঠান আছে না ? ( পল্টন খ্রীষ্টান) আর রুণির তো আজই ধানবাদ যাওয়ার কথা !! আর বাকি তাদেরও তো কি সব হল্লাহাটির গল্প বলেছিলি । তো সে সব বাদ দিয়ে তোরা এখানে হাজির হয়েছিস যে !!! ' .... নীপা বৌদির প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই ঘটাদা চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে ..... ' আহ্ !! কি শুরু করলে ? এসেছে বেশ করেছে ।ওরা না আসলে আমার যে কিছু ভালো লাগে না , তা তো তোমার অজানা নেই। ওদের আসতে দাও আগে । পরে কথা হবে ।'
ওরা ছয়জন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ী করে , ঘরের ভিতর ঢুকে একটু ইতস্তত করে শেষমেশ পল্টন বলে .... ' স্যার , একটা বিপদ ঘটে গেছে ' ----- ঘটাদা , বৌদি দুজনেই শঙ্কিত মুখে ওদের দিকে তাকায় ---- ' না মানে গুণগুণ তো পিসির বাড়ি গিয়েছিল , শান্তিনিকেতনে , ওখানেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, বাঁ হাতে প্লাস্টার করতে হয়েছে ।'
' সেকি রে ? বেড়াতে গিয়ে কি বিপদে পড়ল !! আর কোথাও কোন চোট নেই তো ? তা তোরা কি দল বেঁধে ওখানে যাবি ? ' .... ঘটাদার প্রশ্নে , এবার মাম্পা উত্তর দেয় .... ' না স্যার, এতজন মিলে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয় । গুণগুণের পিসির বাড়ি যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই , আর এই ছুটির হিড়িকে কোন হোটেলে ঘর ফাঁকা পাবো না , আর সপ্তাহ খানেক পর ওরা গাড়ি ভাড়া করে ফিরেও আসবে , গুণগুণ বলছিল। তবে আমরা আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়েই এসেছিলাম। '
ইতস্তত করতে থাকা মাম্পাকে আশ্বস্ত করে নীপা বৌদি ---- ' এতো না ভেবে বলেই ফেলো । রাখার মতন হলে রাখব , না হলে রাখা যাবে না ..... এই তো ব্যাপার । এর বাইরে তো আর কিছু হবে না !! '
তুর্কিদের যে কোন ব্যাপারে ঘটাদা খুব সংবেদনশীল। নীপাকে থামিয়ে .... ' আহ্ !! আগে তো অনুরোধটা শুনি !!! বাকি কথা পরে হবে । বল্ তো কি বলছিস ? '
রুণি বলে ওঠে ... ' স্যার , আমরা সবাই যদি ছুটির কদিন রোজ কোচিং ক্লাসে বসে গল্প করে ভিডিও কলের মাধ্যমে গুণগুণের মন খারাপটা একটু কমাতে পারি , তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে ? Please please বৌদি , স্যার একটু দেখুন যদি হয় । '
রূণির আদুরে আবদারে পল্টন চোখ পাকায় , ভুন্টাই বলে .... ' দাঁড়া , স্যারকে কিছু বলতে দে , যদি কোন অসুবিধা না থাকে , তাহলে......নয়তো....
ঘটাদা নীপার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে, পল্টনের দিকে ফিরে বলে ------ ' বাঃ , দারুণ ভেবেছিস তো ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। কি বলো নীপা ? তবে তোদের তো সবারই কিছু না কিছু ফিক্সড প্রোগ্রাম ছিলো , তার কি হবে ? '
নীপা তার স্বামীকে খুব ভালোই চেনে , কাজেই সে বুঝতে পারে , তরুণ তুর্কিদের এমন একটা ভালো সিদ্ধান্তে তার আপনভোলা ছাত্রছাত্রী পাগল ঘনঘটা কি পরিমান খুশি হয়েছে !!! তুর্কিদের এমন প্রকারগত উন্নয়নের স্বপ্নই তো ঘনঘটা সব সময় দেখে।
' স্যার , বাড়ির সবার জন্য সেসব বজায় থাকছে , আর আমরা তো এখানেই সবচেয়ে বেশি মজা করব। রুণি ওর ঠাকুমার সাথে বাড়িতেই থাকছে , ধানবাদে যাবে না , আমাদের মধ্যে শুধু প্রলয় আর রেহান ওদের কলেজ পিকনিক ক্যান্সেল করতে রাজি হল না ।' ..... পল্টনের রাগ চাপা থাকে না ।
' পল্টন হাতের প্রতিটা আঙুল সমান হয় না । তবে প্রয়োজন সবগুলোরই। ওরা আজ একটু অন্যরকম ভাবে ভাবছে , হয়তো একদিন ওরা তোমাদের মতোই বন্ধুর জন্য ভাববে । রাগ করো না ।'.... নীপা বৌদি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করে।
ঘটাদাও একই ভাবে বলে - ' ওসব নিয়ে ভাবিস না , তোদের লাদেন ম্যাম এখন শান্তিনিকেতনে , গুণগুণের পিসির বাড়ির ফোন নম্বর টা দিস , দেখি ওকে বলি , একবার যোগাযোগ করতে, পারলে দেখা করে আসবে না হয় ।'
পল্টনদের দল তাদের স্যারের মুখে ম্যামের ওই তাদের দেওয়া নামের ব্যবহার দেখে কোনদিকে পালাবে ভেবে পায় না আর নীপা ও ঘনঘটা সমস্বরে হেসে ওঠেন । তুর্কি বাহিনীও মাথা চুলকে হেসে ফেলে ।
*****************************
২/৩ দিন পর , রাতে খাওয়ার পরবর্তী পাঠ মিটিয়ে , নীপা ঘরে ঢুকে দেখল ঘনঘটা খাটে বসে বই পড়ছে । নীপাকে দেখে ঘনঘটা বইটা বন্ধ করে , নীপা মৃদু হেসে খাটে এসে ঘনঘটার উল্টোদিকে বসে।
' কি মশাই মন মেজাজ তো বেশ খুশি খুশি দেখছি '---- নীপার কথায় সম্মতি জানায় ঘটাদা -- ' হ্যাঁ , ছুটির কদিন বেশ ভালোই কাটলো । আসলে কি জানো !!! আমার তুর্কিরাই এ বাড়ির প্রাণ ভোমরা , বুঝলে ?? '
' সে আর বলতে ? তবে তুমি এবারে আরো খুশি হয়েছে ওদের এই সিদ্ধান্তে । ' --- নীপা বলে।
' একদম ঠিক বলেছ নীপা , দেখলে তো এ প্রজন্মকে অযথা দোষারোপ না করে , সঠিক দিকে ওদের চালনা করতে হবে আমাদেরই। যুগ বদলেছে, সবটা আগের মতন নেই। কিন্তু ভালোমন্দের বোধের সব কালেই এক।তার অদল বদল হয়নি। তবে সবাই আমার মত মানবে না , ঠিক আছে , অল্প কজনকে যদি শেখাতে পারি , তাই অনেক। '
' ঠিক বলেছ, তবে কি জানো ? তরুণ মন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুভূতি প্রবণ হয় , ছোট মনের পরিচয়বাহী হয়না সাধারণত। ব্যাতিক্রম সব সময়ই আছে । সে কথা থাক, কিন্তু জটিলতা বাড়ে বয়সের সাথে সাথেই। ' --- নীপা
' কথাটা মানছি নীপা , কিন্তু মূল ভাবনা যদি সঠিক হয় , আর তা যদি ছোট থেকেই , বিশেষ করে তরুণ মনে ঠিক মতো প্রথিত হয়ে যায় , তা রয়েই যায় । জটিলতা তাকে সাময়িক ভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে , দেয় ও, কিন্তু উপড়ে ফেলতে পারে না ।আমাদের সকলের মধ্যেই ভালো খারাপ দুইয়ের সহবস্থান আছে। কিন্তু কাকে মাথায় বসাবো , তার শিক্ষা গ্রহণ করতে করতেই আমরা বড় হই । এখানে পরিবেশ , পরিস্থিতির যেমন ভূমিকা আছে , তেমনই ভূমিকা আমাদের সকলের , যাদের ঘিরে ওরা বড় হচ্ছে । ' --- ঘনঘটা।
" তরুণ তুর্কি" এর তুর্কিরা এমন ভাবে প্রকারে বেড়ে উঠুক ---- ঘনঘটা দত্তরায়ের স্বপ্ন পূর্ণতা পাক। ব্যতিক্রম ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তরুণ ছাত্রদল নতুন যৌবনের দূত হয়ে হাল ধরে গড়ে তুলুক আদর্শ সমাজ । প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাত ধরে তারুণ্য হয়ে উঠুক অমর , চিরন্তন ও শাশ্বত মূর্তি ।।
¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤