বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫২
রাত পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হল আরো একটা ঝকঝকে তকতকে দিন। বেড়াতে গেলে দিনক্ষণ আর বারের হিসাব বরাবর থাকে না আমার। তা আবার ফেরত আসে ফিরতি পথ ধরে ধীরে ধীরে। যাওয়ার দিন আর ফেরার দিনের মাঝে পুরো সময়টা বেহিসেবী । যার খেয়াল রাখেন এ দিকের তিনি। তেনার বেজায় খেয়াল। সেদিন আমাদের সকাল সকাল বোধগয়ার পাট গুটিয়ে নালন্দা ঘুরে রাজগীর যাওয়ার কথা । থাকার কথা পূর্ব নির্ধারিত নালন্দা রেসিডেন্সিতে। যেটির অবস্থান রাজগীরে। রাজগীর অর্থাৎ রাজগৃহ পুরাণ আর ইতিহাসের এক খিঁচুড়ি সমৃদ্ধ স্থান। সেই খিঁচুড়ির সহযোগের ঘৃত বলো ভাজা বলো তা হল আমার একান্ত আপন কিছু অতীত স্মৃতি। যা ক্রমশ প্রকাশিত হোক। এখন চলি রাজগীরের দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথের ধারের গল্পেরঝুলি উপুড় করতে করতে।
পেটকে সকালের খাবার সহযোগে শান্ত করে , সব গুছিয়ে নিয়ে বেলা নয়টা নাগাদ বেরিয়েই পড়লাম নালন্দার উদ্দেশ্যে । ম্যানেজার সামনে , দুই ছানা সহ রূপা মাঝে , ঝটতি পড়তি বাকি দুই পিছে নিজেদের গুছিয়ে বোধগয়াকে টাটা করলাম। গাড়িতে ভোজপুরি সুরবাহার ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আমরা বলি ও টলি উডকে youtube মারফত ধরে ফেললাম। নতুবা আমাদের সকলের সকালের ভোজ ভোজবাজির মতন হজম না হয়ে বদহজমের দিকে পা বাড়াতো । তবে বদহজমের কিছু উপাদান এদিকে গুজতে গুজতে চলল আমাদের দুই পরিবারের দুই জুনিয়র।
ওই একখান এমন জায়গা , যেখানে আপামর বাবা মা নিজে থেকেই টাইট 😥। আমার মামাতো দাদা ভয়ানক ম্যাও বিদ্বেষী ছিলেন , আমার মায়ের সাথে তার নিত্য ঝঞ্ঝাট হোতো এই ম্যাও প্রীতি নিয়ে আমার মায়ের বিবাহ উত্তর সময়কালে। সেই দাদা র একমাত্র কন্যা হল খানদানী ম্যাও প্রীতিযুক্ত।কিছু ক্ষেত্রে তার পিসি ঠাম্মার থেকেও এগিয়ে গেল সে। হালের চালচিত্রে এখন খান আটেক ম্যাও সহ আমার সেই দাদা এখন প্রবল ম্যাও ভক্ত 🙃।
এ ও তেমন গপ্প। আমাদের পছন্দের গানের ওপর দুই ছোট নানান রকম বেরকমের আমাদের অপছন্দের গান চাপাতে চাপাতে চলেছিল । এই চাপাচাপি আর বাছাবাছিতে কখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তো কখনও ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে বিহারের প্রকৃতি খানিক রুখা শুখা হলেও গ্রাম বাংলার মতন এক এক জায়গার তাল , খেজুর আর আরো হরেক রকম গাছ কোথাও জড়িমড়ি করে , কোথাও দূরে দূরে অবস্থান করে এক প্রাকৃতিক ছবি আঁকতে আঁকতে চলেছিল। গাড়ির বেগ তার সাথে প্রকৃতির নিত্য নতুন ধরতে না পারা রূপকে পিছনে ফেলে আর মনের ক্যামেরাতে ভর্তি করতে করতে আমরা চলে এলাম সেই গহলৌর নামধারী গ্রামে , যেখানে থাকতেন এক আপাত ক্ষ্যাপাটে মানুষ দশরথ মাঝি, যিনি সবার হাসির পাত্র হয়ে একা একাই পাহাড় কেটে পথ বানাতে শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে । তার ২২ বছরের চেষ্টার ফল ভোগ করছে আজকের গেহলৌর গ্রামের মানুষ জন। এই গ্রাম গেহলৌর, গেলহৌর পাহাড়ের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন ছিল কাছের শহর ওয়াজিরগঞ্জ থেকে । যে কোন কাজে ওই শহরে যেতে গেলে পেরোতে হোতো আরো ৫৫ কিলোমিটার হাঁটা পথ । দশরথের বৌ একবার পা পিছলে পাহাড় থেকে পরে মারা যায় কাছের শহর ওয়াজির গঞ্জের হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই। সেই শোক দশরথকে পাহাড় কেটে পথ তৈরির প্রেরণা জোগালো। আজ তিনি নেই, কিন্তুক আছে পাহাড় কেটে তার শুরু করা সেই পথ , যা পরবর্তি কালে তাকে করেছে বিখ্যাত , তার দূরদর্শিতা কে সাধুবাদ জানিছে সারা দেশ। এখন রাস্তার ছড়াছড়ি সারা গ্রাম জুড়ে , শহর জুড়ে , দেশ জুড়ে। যখন গরিবের কথা বাসি হয়ে দামি হল , তখন তাকে দাম দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তারই গ্রামের আরো কিছু যুবক । পথ শেষ হয়েছিল ২২ বছর পর। আজ তিনি নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর তৈরি করা সেই পথ। দশরথ আমরা মাঝিকে নিয়ে বলিউডি ছায়াছবি The Mountain man দেখেছিলাম বেশ কিছু বছর আগে । এবারে দেখলাম সেই পাহাড় কেটে তৈরি করা পথ । গাড়ি থেকে সকলে ভাগযোগ করে খানিক নামলাম , ওই পথ এখন ব্যস্ততম পথ। তার ব্যস্ততা আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে গাড়িতে তুলে দিল। থামার উপায় নাস্তি। ঘোরার উপায় মায় ছবি তোলার উপায় নাস্তি !!! আমরা গ্রামের পথ পেরিয়ে যেতে লাগলাম অল্প কিছু ছবি তোলার পরেই। গাড়ির মধ্যেই টুকটাক গান শোনার পাশাপাশি গল্প , খাওয়া চলছিল। একবার ওর মধ্যেই অন্য কোন এক গ্রামের পথের গোলকধাঁধায় মেলাই গাড়ির ভিড়ে আমরা নট নড়নচড়ন হতে না হতেই তিনি ট্রাফিক সার্জেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । এ তেনার আরেক অভ্যাস। কর্ম জনিত পশার হোক না হোক এমন আরো কয়েক দিকে সম্ভাবনার অন্ত নেই। বাকি সম্ভাবনা ক্রমশ প্রকাশ্য। কারণ তেনার মূল পেশা পাবলিক ঘেষা, আর তাতেই মাঝে মাঝে গোলযোগ মেশার মেলাই সম্ভাবনা। মেশেও বিস্তর।
যাক সেসব মিটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম গয়া পেরিয়ে রাজগীরের দিকে। রাজগীর পেরিয়ে সিধে পথ আমাদের নিয়ে যাবে আমার স্বপ্নের নালন্দাতে। সেখানে ঘুরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা যাব পাওয়াপুরী। তারপরে ফিরতি পথে রাত্রি ও পরের গোটা দিন-রাত যাপনের সাকীনে হাজির হবো। এমনই বাসনা নিয়ে দুপুর নাগাৎ নালন্দা চত্বরের সামনে হাজির হলাম। গাড়ি থেকে নামার আগেভাগেই কজন টোটো নাকি অটোওয়ালা হাজির আমাদের বাহন চালকের চোখের ইশারায়। এদিকের কড়া দৃষ্টির ফাঁদ কি যে সে !!! আমরা কজন তো আর একটু হলেই টো টো করে ঘুরে দেখব বলে উঠে পড়ছিলাম আরকি টোটোতে ... রূপা আর আমার কর্তামশাই কটমটিয়ে ওদের ভাগিয়ে , আমাদের জাগিয়ে দিল। তারা জাদুঘর ঘুরিয়ে , নতুন গড়ে ওঠা নালন্দা ঘুরিয়ে এ দিকে আসবে ... এমন বার্তা মেলে ধরেছিল। আমি , দিবাকর বার্তা শুনে ভাড়া গোনাগুনি শুরু করতে না করতেই তেনারা আমাদের খপাৎ করে ধরে আমার দেখার ইচ্ছের আদর কদর করে ঝটিতি পদে সবাইকে নিয়ে স্বপ্নের সফরের টিকিট কাটতে নালন্দা চত্বরে ঢুকে পড়ল। আগু পিছু করে ঢুকেই লক্ষ্য স্থির হল একদম । সাথে পেলাম বয়ঃজৈষ্ঠ এক পথ প্রদর্শক গাইড। "গাতা রহে মেরা দিল" এর গাইড নাই হোক , চাপ নেই তবে মনে পুরো "আজ ফির জিনে কি তামান্না" র সুর বাজতে লাগল। নাচটা আমার আসে না ... একদমই। এই যা রক্ষে !!!! শুনতে শুনতে ফটো না তোলার ফতোয়া জারি করলেন তিনি। না ... রাগের প্রশ্ন ই নেই !!! অসংখ্য ভ্রমণার্থির ভিড় বাঁচিয়ে , হল্লাহাটির থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনে নিয়ে দেখতে বললেন তিনি আর তখনইফটো তোলার বিধান দিলেন। আমরা সেই মতন ইতিহাসের মাঝে হারানোর সাথে সাথে দেখার কাজ করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। শীতের ছুটিতে বিশালাকার চত্বরে মানুষের ঢল নেমেছে। স্কুলের থেকে আগত ছাত্র ছাত্রীদের সাথে এসেছেন তাদের শিক্ষক শিক্ষিকা। ভ্রমণার্থি রয়েছেন দেশী ও বিদেশী। বাংলা বিহার উড়িষ্যা তখন এক । ভিন্ন নয় ।তখন ছিল না প্রাদেশিকতার দ্বন্দ্ব । এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান সহ আরো অনেক কিছুর শিক্ষা দেওয়ার খবর শোনার পর থেকেই আমার পুপে একটু ভড়কে ইতি উতি চেয়ে ওসব এখনও কোথাও উঁকি মারছে কিনা দেখে নিচ্ছিল !!! আহা রে , এত ভয় পেলে চলে ? মা ভীতু হলে তাকেও কি হতে হবে ?? এ কেমনতর কথা !!! পুরুষ সিংহ পিতাশ্রীর মতন তো অনেক কিছুই আছে । তবে আসলে নকলে মোদ্দা কথা এই যে, দুজনের থেকে ভাগযোগ করে ভাল মন্দ জড়ো করেছে আমাদের কন্যা রত্নটি। যাক ওসব কথা আপাতত চাবি বন্ধ থাকাই ভাল। ওই চাবি তো একমাত্র ঘুরু ঘুরুর সময় non functional থাকে।
এক সময় ইতিহাস বই বন্ধ হলেও আমরা দেখতে লাগলাম ঘুরে ফিরে । মন ভরে । গাইড কাকু সব বুঝিয়ে , হিসেব পত্তর বুঝে চলে গেলেন । যাওয়ার আগেভাগেই আমরা শষ্য ভাণ্ডার , ছাত্রাবাস সহ আরো অনেক কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে , ছাত্রাবাসের একটা ছাদবিহীন ঘরে নিজেদের মেলে ধরে মেলাই ছবি তুলে নিলাম। অতীতের এক বলিউডী চলচ্চিত্রের গানে দেখা নালন্দার চত্বর দেখে মুগ্ধতা ভরে নিচ্ছিলাম মনের অন্দরে। আমাদের গাইড কাকু ছিলেন বয়স্ক মানুষ। তিনি যখন যুবা , তখন ওই চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণ দেখেছিলেন সে গল্প ও তার মুখে খানিক শুনে নিয়েছিলাম , সব দেখা ও শোনার মাঝে ।
এরপর প্রশস্ত চত্বরে ছড়ানো ধ্বংসাবশেষের মাঝে এক গাছের নিচে সকলে বিশ্রাম নিতে বললেও , প্রথমে রূপা ও তার পিছে পিছে আমি হারানোর গানে গা ভাসালাম। ওরা বসেই রইল, আমরা মোবাইল ও ক্যামেরা সহ আরো খানিক ঘুরপাক খেয়ে গাছ তলায় ফেরত এলাম । এবারে সকলেরই খেয়ালে সময় আর ক্ষিদে দুইই ধরা পড়ল। ফিরে চললাম খাবারের সন্ধানে। বেরিয়েই প্রথমে সেদ্ধ ছোলা র চাট খেয়ে খানিক ক্ষিদে আটক করে কাছের এক খাবারের দোকান অ্যাটাক করা হল। ধুমায়িত ভাত , ডাল , ভাজা , স্যালাড, ডিম , চিকেন কারি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা পাওয়াপুরী র পথ ধরলাম।
দিনের শেষাশেষি পৌঁছলাম পাওয়াপুরী। পথের একদিকে এক জৈন মন্দির, যার কারুকাজ দেখার মতন আর পথের অপর দিকে এক পদ্ম সরোবরের মাঝে জৈন ধর্ম গুরু মহাবীরের সমাধিস্থল। পাওয়াপুরী জৈন ধর্মের তীর্থ ভূমি। এখানেই জন্ম লাভ করেছিলেন ২৩তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর। তার কর্ম ভূমিও ছিল এই পাওয়াপুরী। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন পাওয়াপুরী পৌঁছলাম তখন অহেতুক কিছু কারণে মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। প্রথমেই যে কারণ জন্য বিরক্তির উদ্রেক হল তা হল প্রচণ্ড ভিড় । আর দ্বিতীয়ত এখানে ছবি তোলার বিধিনিষেধ। পদ্ম সরোবরে পদ্মের দেখা মিলল না আর ভিড়ে ভড়কে গিয়ে যদি কিছু কেপমারি হয় , বিশেষত ফোন , যা এখন আমাদের জিয়ন কাঠিও বটে !! তাই আমার অতি সাবধানী তিনি তাড়া লাগিয়ে বের করলেন আমাদের। খানিক মন্দির চত্বরে বসলেও ভিড়ের জন্য ফিরে এলাম। গাড়িতে উঠে বাহন চালকের পাশটির দখল নিতেই পিছনে আমার কন্যার হাহাকার ধ্বনিত হল , শান্ত সিষ্ঠ সিদ্ধার্থ কে সে বলল ... " youtube এর দখলদারী মায়ের হাতে গেল রে !!! ঘুম পাড়ানী গানে এবার ঠিক ঘুম আসবে !!!!" ওসবে কান দিলে চলে না !!! লেগে পড়লাম গানের আসরের গান বাছাই করতে।
এক সময় আঁধার নামা পথে টাঙ্গা দেখতে পেলাম। যাওয়ার পথেও দেখেছিলাম !!! পরের দিনের দিনপঞ্জীর ছক কাটতে কাটতে দেখি বিশাল এক হোটেল কম্পাউণ্ডে গাড়ি ঢুকছে জ্বলজ্বলে লেখায় দেখলাম হোটেল রাজগীর রিজেন্সী। কিন্তুক টুকটাক শোনা স্মৃতি হাতড়ে পাচ্ছি অন্য নাম ... হোটেল নালন্দা রিজেন্সী। এ কি ধন্ধ রে বাবা !!! বাহন চালক সন্দিহান !!! পরে ধুন্ধুমার না বেঁধেই সব পোস্কার ( পরিস্কার) হল। আগে একবার ওদিকে গিয়েছিল সে , এদিকের বোর্ডার কে নামাতে , তাই এবার ওদিকের বোর্ডার দের এদিকে হাজির করে দিয়েছে। কি মুশকিল বলো দেখি। আর আমরা ৫ তারকা খচিত হোটেল দেখে হেঁচকি তুলছি গাড়ির ভিতরে বসে ই !!! নামার ভরষা পাচ্ছিলাম না যে !!!! কর্তামশাই অবশ্যি এসবে ড্যাম স্মার্ট আর দিবাকর তো আবার বিদেশেও বসবাস করে ফেলেছে। কাজেই এই হেঁচকিতে তেনারা সাথে ছিলেন না । যাক শেষ মেষ হেঁচকি থামিয়ে যথাস্থানে বোঁচকা নামিয়ে আমাদের বাহন চালক হিসেব মতন সব বুঝে নিয়ে চলে গেলেন আর আমরা আমাদের রাজগৃহ যাপন শুরু করে দিলাম ।
No comments:
Post a Comment