Tuesday, 18 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৪

অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে দিতেই একে একে ওর্ডারী খাবার সার বেঁধে ওয়েটার দের হাতে হাতে হাজির হল এবং নিমিষের মধ্যেই ঘরের ছোট টেবিলখান হাঁক পাড়ল ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রবে। খাটের ওপরে একখান বাড়তি কাপড় পেতে সেখানেও কিছু প্লেট স্হান পেল !! ভাগ্যিস আমার মায়ের আমলের অথবা তেমন ভাবনার কোন অংশীদার সাথে ছিলেন না ... বকুনির ঠেলায় খাবারকে যাবার পথ দেখিয়ে, ওই চাদর আদর করে কাচাকুচি করতে হোতো !!! আর মা থাকলে প্রথমেই কপালে করাঘাত সাথে বাক্যাঘাতে আমি সহ সবাই হতাম কাত !!! আমি যেমন পুপেকে কিছু শেখাতে পারছি না ভেবে আকুল হচ্ছি , মা কেঁদে আকুল হতেন তার শিক্ষার অবস্থান বিছানা নিয়েছে দেখে !!! বিছানা যে সিনিয়র ও জুনিয়র ছানাদের শোয়া / বসার জায়গা , খাবারের স্থান না , তা আমরা সবাই জানি , তবে কিনা বেড়ানোর সময় অনেক নিয়ম নাস্তি হয়ে যায় আর তাতেই মেলে স্বস্তি !!! 

খাবারের বহর দেখে দিবাকর সহ আমিও আঁতকে উঠলাম !!! যদিও ওর্ডার প্লেস করার সময় আকাশ খাই , পাতাল খাই এমন ক্ষিদে পেটে করতাল বাজাচ্ছিল। তবে এমন রাজকীয় লাইন লাগানো খাবারের খান দুই প্লেট আর কোনোমতেই কারোর পেটেই জায়গা বের করতে পারল না। সে খান টেবিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল !!! খাওয়া আর গল্পের ফাঁকে রাত বাড়তে লাগল। আমরা তিন রাতের খাবার বাতিল করলাম। ওরা ঘরে গেলেও , পুপের দিবাকর আঙ্কেল আগেই ক্লান্তি কাটাতে চলে গিয়েছিল পাশের ঘরে !!! ওরা দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেষ রাতের জন্য খাবার হিসেবে ডাল - ভাত আর আলু ভাজা চালু করলেও, আমরা ঘুম চালু করে দিলাম। আর এ দিকের কর্তামশাইও হিসাবপত্তর বাদ দিয়ে সত্তর বিছানা বিলাসী হয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন !!! 

পরের দিন আমাদের ঘোরাঘুরির শেষ দিন। অল্প কিছু দেখার পালা সাঙ্গ করে সেদিন আমাদের রাজগীর থেকে গয়াতে ফেরার কথা। গয়া থেকেই আমাদের কলকাতা ফেরার ট্রেন বন্দেভারত। যা ছাড়বে দুপুর ৩.১৫ তে আর হাওড়াতে ঢুকবে রাত ৯.৩০ এ। পরেরদিন আমাদের ঝুলিতে ছিল জঙ্গল সাফারি। যেখানে বিশেষভাবে প্রস্তুত বাসে করে আমরা নানান ঘেরাটোপ পেরিয়ে ঢুকবো জঙ্গলের বাসিন্দাদের ডেরায়। যদি তেনারা দেখা দেন এই আশায় , দেখাশোনা র পাট মিটিয়ে পরের অংশের দরজা চিচিংফাঁক হবে। এক এক প্রজাতির জন্য নির্দিষ্ট এক এক এলাকা। রাজগীরের একদিকের পাহাড়ি এলাকা ঘিরে প্রস্তুত এই চিড়িয়াখানা , এখানকার এখনকার অন্যতম আকর্ষণ। এ হাল আমলের সংযোজন। আগে ছিল না। আরও আছে এ্যাডভেঞ্চার সাফারি । এই সাফারি র অনলাইন বুকিং এর ব্যবস্থাপনা । আমাদের দলের অনলাইনের মোডে সড়গড় দিবাকর জঙ্গল সাফারি র বুকিং করে রেখেছিল। তবে অন্য সাফারি র বুকিং মেলেনি। জনতা জনার্দন এখন ভয়ানক এ্যাডভেঞ্চার প্রেমী। যখন তখন এ্যাডভেঞ্চারের ঠেলায় মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা !!! কাজেই ইচ্ছে থাকলেও আমাদের সে ইচ্ছাপূরণ হল না। এই বুকিং ঘন্টা খানেকের স্লটে বিভক্ত । আমরা সাফারির প্রথম স্লটেই বুকিং নির্দিষ্ট করেছিলাম , দিবাকর কে আগেই বলা ছিল। কারণ সেদিন জঙ্গল ভ্রমণ মঙ্গলময় হবে তখনই যদি তা আমরা সকাল ১১ টার আশপাশ দিয়ে শেষ করতে পারি !! কারণ এক আমাদের ফিরতি পথ ধরতে তো হবেই আবার সে পথের শেষাশেষি পেট পূজোর জন্য সময়ও রাখতে হবে। 

সব লটবহর গুছিয়ে , জলখাবার খেয়ে আমরা সময় মতন হাজির হলাম জঙ্গল সাফারি র দুয়ারে । সেদিন সকাল থেকেই আমাদের মনটা ভার , ভ্রমণের শেষক্ষণ আগত , আর অদ্ভুত ভাবে দিনটার হালহকিকতও গোমড়া থেরিয়াম। আকাশের মুখ ভার। ঝকঝকে ভাব গায়েব। বেজায় ভিজে ভিজে আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। আমরাও সেই মতন মুড়িঝুড়ি দিয়ে সব রকম সাবধানতার বর্ম সেঁটে কয়েক প্রস্থ দুয়ারে মোবাইল বুকিং এর মোবাইল ছবি এক এক দ্বারে দণ্ডায়মাণ এক এক রক্ষী কে দেখিয়ে তাদের দেখানো পথ ধরে এক বাস স্ট্যান্ড সদৃশ ঝাঁ চকচকে জায়গার লাইনে খাঁড়া হলাম। সাথে সাথে আর্মি পোশাক সদৃশ রঙচঙে সম্ভবত ২৫ আসনবিশিষ্ট বাস হাজির হল। আমাদের লাইন এগিয়ে বাসে সিঁধিয়ে গেল। বাসখান সামনে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল , আবার অপেক্ষা । নাহ্ , আমরা লাইনে ছিলাম আইন মেনে খানিক পিছে । এবার লাইনের সামনে চলে এলাম আর আমাদের আসন নিয়ে অল্প পরেই হাজির হল পরের বাস। ছোট্ট, সুন্দর। বিশালাকার পুরু কাচের চকচকে জানালার পাশে আমি বসলাম ক্যামেরা বাগিয়ে , বাকিরাও বসে পড়ল যে যার মতন । 

বাস চলতে শুরু করতেই বাস চালকের সহকারি সুন্দর ভাবে আমাদের বলে দিলেন যে খান দুই দরজা পেরিয়ে প্রতিবার আমরা এক এক আবাসিকের অন্দরমহল না হোক বাহিরমহলে ঢুকব , অন্দরমহল থেকে তারা দেখা দেবেন কিনা তা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছে। আর বাসের ৭০% যেহেতু স্বচ্ছ কাঁচে ঢাকা যে কোন দিক থেকেই কিছু না কিছু দেখতে পাবই। এখানে অঞ্চলের ভাগযোগ স্পষ্ট। যিনি বা যারা যেখানে থাকছেন সেখানে অন্য জনের প্রবেশাধিকার নেই , বলা ভাল উপায় নেই । না হলে মানা করলে তারা থোড়াই শুনতেন !!! কথা শুনতে কার ই বা ভাল লাগে ??? মনুষ্য কূল পশুকূল সবার ধরণ এ ক্ষেত্রে একদম সমান সমান ।

প্রথমে ই বাস খানিক পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলো দরজার চিচিংফাঁক হতে , তারপর চলতে লাগল মেঠো পাহাড়ি পথ বেয়ে । কিছুটা যাবার পর হরিণ এর নাম লেখা ধাম হাজির ... দুখান গেটের খোলা বন্ধের পর্ব চুকিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাস গতি কমিয়ে ধীরে চলতে থাকল আমরা সারে সারে নানান প্রজাতির হরিণ দেখলাম মেলাই। বেরনোর সময় আবার চিচিংফাঁক পর্ব। এরপরের এলাকার নেমপ্লেটে দেখা দিলেন ছবি সহ ভালুক মশাই। ডবল দরজার আন্দরে ঢুকে দেখি সপরিবার বসে আছে অভ্যার্থনা জানাতে । তবে মনুষ্যেতর তো !! তাই একজন পিছন ফিরে বসেই অভ্যার্থনা জানালেন। আমরা দেখলাম তবে ইদানিং আমার চোখের দৃষ্টির গোলমাল চলছে তাই হবে বা , ছবি র অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে করতেই কয় খান মুহুর্ত সময় গলে বেরিয়ে গেল। তবে ছবি কিছু সফল ভাবেও উঠল । পরের এলাকা চিতা ... তাদেরও বেশ ভালোই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ঘটল। এমন কি একজন খানিক দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আপন খেয়ালে তাকেও খানিক দূর ওবধি পিছু ধরে দেখাও হল। ছবিও উঠল তার চলে যাওয়ার। কেউই ... "না যেও না"বলার সুযোগও পেলাম না । এবারে গাড়ি ঢুকলাম থমথমে পরিবেশে মামা বাড়িতে । এ মামা তো আর হাসিখুশি চাঁদ মামা নন , একদম রাগি রাগি বাঘ মামা ।পাহাড়ের বেশ উঁচুতে উঠে এসেছি আমরা , মালুম হচ্ছিল।পদ মর্জাদা বলে একখান ব্যাপার আছে না ?? তা ভুললে হবে ??? কিন্তুক মামা কই ?? হেনকালে রাজকীয় বাঘ মামার রঙ্গমঞ্চ প্রবেশ হল বেশ নাটকীয় ভাবে। মামা হাঁটছিলেন বাসের বেশ খানিক সামনে দিয়ে। আমাদের বাসে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। মোবাইল নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আমাদের বাহন চালক দাদাভাই বাস চালিয়ে মামার পিছনে যতটা কাছে নিয়ে যাওয়া যায় যেতে থাকল। বাঘ মামা তা বুঝে , বাসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, যেন অজানিতে ... এমন ভাব। মুখে হাঁ করা হাসিখুশি ভাব । যেন ছবি তোলার জন্য রেডি। যুগের হাওয়ার কি লীলা !!! পশুকূলে ওবধি ছবি তোলার হাওয়ার নাচন দেখা যাচ্ছে। বলতে নেই বেশ মিনিট পাঁচেক কি তার বেশি বাঘ মামা দিলেন ক্ষমা ঘেন্না করে ছবি তুলতে। মুশকিল হল আমার চোখের দৃষ্টি আর বাসে আমার সীটের অবস্থান, সর্বোপরি সামনের ঝোপের জন্য সামনা সামনি ছবি আমার কপালে জুটল না। তবে দিবাকর বাসের ভিতরে সামনের দিকে এগিয়ে তুলে আনল লাখ টাকার বাঘ মামার ঘ্যামা ছবি !!! এদিকে বাস ভর্তি ইয়ং জেনারেশনের উচ্ছাস খানিক হুংকার দিয়ে থামাতে আমার কর্তামশাই। তেনারা দাঁড়িয়ে মোবাইল তাক করে আমাদের মহিলাকূলের দর্শনে ব্যাগড়া দিচ্ছিলেন বিস্তর !!!

এরপর ??? হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে একদম রাজার মতন ফের চলতে শুরু করলেন বাঘ মশাই। ভাব খানা ... অনেক হোলো ... এবার যাও তো বাছা রা !!! এই ফটো তোলার নামে তোমরা সব ভুলে যেতে পারো । তবে আমার ওতো ছবি তুলতে বয়ৈ গেছে !!! 

এরপরের দরজার ওপারে থাকার কথা আরেক মামার তিনি সিংহ মামা। তবে বাহন চালক দাদা র থেকে শুনলাম...সদ্য মামা পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে তাই তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল। অন্দরমহল থেকে উঁকি মারার সম্ভাবনা কম । আমাদের ড্রাইভার দাদার সম্ভাবনা মিলে গেল। এই জঙ্গল ভ্রমণে আমরা একমাত্র রাজা মশাই এর দেখা পেলাম না। এই অন্য ধরণের ঘোরার উত্তেজনার মাঝে সময় যে কখন একছুটে সকাল ১১পার করব করব করেছে কারো খেয়ালেই ধরা দেয়নি। এরপরেই আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। নেমে দেখি একখান ময়ূর ওখানকার সাজানো গথেকেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছে যেতে দিল না ওখানকার কতৃপক্ষ।  দূর থেকেই সেই পোষা ময়ূরের কিছু ছবি নেওয়া হল । এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম গয়ার উদ্দেশ্যে। 

সারা ট্রিপের শেষে তখন সবার শরীরে ক্লান্তির ঢল। খানিক গল্পে , খানিক ঘুমিয়ে আমরা গয়াতে পৌঁছে এক হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সেদিন ছিল গতবছরের শেষদিন। হোটেলের ভিতরের মাঠে ইংরেজি নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন চলছিল জোরকদমে। খেয়ে আমরা গয়া স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।

স্টেশনের কাছাকাছি এসে পুরো তীরে এসে তরি ঢোবার কেস ... যানজটের এমন জটিল কুটিল মাকড়সার জাল সদৃশ অবস্থান বাপু আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না , যদিও বেনারস , ভাইজাগে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ঝোলাতে তুলেছি আগেই। কিন্তুক এ তার থেকে খানিক খানিক বেশি ডিগ্রীধারি, আর অদ্ভুত ভাবে নজর করলাম ওই যানবাহনের জটে মানুষ চালিত দু চাকা , তিনচাকা, চারচাকা তো বটেই গরুর গাড়িও আছে !!! সর্বোপরি আমাদের সাথের ড্রাইভার দাদা ভাবলেষ হীন মুখে যখন ঘোষণা করলেন যে এমন অবস্থার আরো খানিক ঘোরালো পানা না হলে ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিলবেই না , তখন আমি হরিবোল ধ্বনি তুলে হেসেই ফেললাম। কারণ মামলা গভীর করার ধারা আমাদের এ বাড়ির খানদানী ধারা , গভীরে না গেলে কোন রোগ বালাই এর নিদান দেওয়ার বিধান নেই পরিবারের কারো কারো জন্য 😄। কাজেই এই বিষয়ক আলোচনা আমার মজা পাওয়ার খোরাক জাগিয়ে দিল। ওদিক তখন শুনতেই পাচ্ছেন না , এমন মুখ নিয়ে জট পাকানো অবস্থা অবলোকন করছিলেন। কিছু পরেই ঘোরালো ব্যাপার আরো খানিক ঘোরালো হল ... আমাদের সাথের দাদাভাই ( আমার কর্তামশাই) কোন ভাবেই এখানে গাড়িপত্তর ম্যানেজ করার সুযোগ পেলেন না , কারণ গাড়ির দরজা খোলার উপায় নাই আর জানালা দিয়ে আমরা কর্তা-গিন্নি কেউ গলতে পারব বলে মনে হয় না !!! হেনকালে ঠিকঠাক গোল বেঁধেছে বুঝে লাঠি হাতে ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিলল। আর .... তারপরেই গাড়ি গতিপ্রাপ্ত হল। ঠিক আমাদের এদিকের হালহকিকতের অন্য উদাহরণ ... আমার কন্যার ডেঙ্গু হওয়ার পর যখন সে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরল বাড়ির চারদিকে ব্লিচিং ছড়াতে এল প্রশাসন। বললে ... বুঝলেন না ?? আমরা সাবধান হচ্ছি , কাজ করছি । আরো দেওয়া হবে যে যে বাড়িতে হয়েছে !!! এ হলো গিয়ে ... রোগ হওয়ার পরে সাবধানতা স্কিম .... "যস্মিন দেশে যদাচার "

স্টেশনের কাছে পৌঁছলাম। বন্দেভারত দণ্ডায়মাণ। আমরা ফের একে অপরকে বাই করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এবারও আমি গেলাম দেখা করতে , আমার সাথে রূপা এল । দুই বন্ধুর গল্পে গল্পে সাথে আনুষঙ্গিক পাট গোটাতে গোঠাতে অনেক অনেক স্মৃতির ঝোলা পূর্ণ করে রাত সাড়ে নয় টা তে হাওড়া তারপর ঘরে ফিরে এলাম। ঠিক হল আবারও আমরা এক সাথে বেড়াতে যাবোই যাব। কেমন ????

No comments:

Post a Comment