Saturday, 1 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫১

পরের দিন যথারীতি ভোর ভোর ঘুম পাট গোটালো। প্রথমেই নিজের ধোলাই, সাফাই করে নিয়ে ওদিকের দরজাতে টোকা দেবো কি দেবো না ভাবতে না ভাবতেই রূপাদের বার্তালাপ শুনেই দিলাম হাঁক , হাঁকপাক করে ওদিকের দরজা খুলে দিল রূপা । এ দিকের দুজন তখনও গভীর নিদ্রায়। চায়ে গরম হাঁক ডাক দেওয়ার জন্য আমার অপছন্দের লাল চা বানিয়ে ফেললাম। আমার পছন্দের দুধ চা পেতে একটু অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে হয় । জলখাবার সহযোগে তিনি রঙ্গমঞ্চ থুড়ি খাবার টেবিলে হাজির হন। হাঁক ডাকের চোটে অগত্যা বিরক্তি কাটাতে কাটাতে চা পানে তিনি এ দিকের রূপাদের ঘরে এলেন । এ দিকের ঘরেও ঘুম ঘুম ভাব প্রবল , এক রূপা ছাড়া । আমরা ছানাদের স্কুলের কল্যাণে ভোরের রাগ-রাগিনীর সাথে পরিচিত। 

সকাল বেলার আরাম আরাম ঠাণ্ডার আমেজ বেশ মনোরম। আমাদের দুই ঘরের সাথে আবার তাদের নিজস্ব বারান্দা মজুত। সেখানে উঁকি দিয়ে ঘষা কাঁচ মার্কা ভোরাই এর সুর শুনতে ও দেখতে পেলাম। এদিকের তিনি বেড়াতে গেলে বরাবরই রসিকলাল। কুয়াশা দেখে মুগ্ধ হয়ে , ডেকে দেখালেন সকলকে। আমরাও ম্যানেজার সহ মুগ্ধ হলাম !!! 

আগের দিনের ছবি তোলা হয়েছে সব যন্ত্র পাতি তোলপাড় করে ... শুধু ক্যামেরাতে , মোবাইল ক্যামেরা তে । মোবাইলের সম্পত্তি মোবাইল বন্দী বটে , কিন্তু .... ক্যামেরা সম্পত্তির জায়গা বদল নানান জটিল নিয়ম নির্ভর।  প্রতিবার অপেক্ষার প্রহরে তা দিই ঘরে ফেরা ওবধি । এবারে দিবাকর কর্ দিয়া কামাল !!! কম্পিউটারে পুপের দিবাকর আঙ্কেলের দক্ষতার শেষ নাই ... এ দিকে আমাদের অজ্ঞতা ও শিক্ষানবিসী আবার যেতে যেতেও যায় না । তার ফলশ্রুতি স্বরূপ সক্কাল সক্কাল ক্যামেরা থেকে ছবিদের মোবাইলে ভর্তি করে নিলাম খানিক খানিক খানিক শেখার পরে । কি যে শান্তি !!! দেবা ন জনান্তি 🤫

এরপর সকলে জলখাবার খেয়ে চলি চলো বলে বোধগয়া সরেজমিনে দেখতে আবার টোটোতে টপ করে উঠে পড়লাম দু পরিবার।  হোটেলের সামনে দিয়ে টোটো কম্পানির নিত্য যাতায়াত। তাই টোটোর পিছনে ছোটো ... এমনটা নয়কো। বরং গাদা খানিক টোটো ই প্রতিবার আমাদের পিছনে ছুটছিল 🙃 । এখানে এসে তথ্য জড়ো হল আরো কিছু ... এখানকার সব ব্যবস্থাপনার পরিচালিত হয় সুদূর জাপান থেকে। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্ম যে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সে সব দেশের নাগরিক হামেসাই এখানে আসা যাওয়া করেন। ধর্ম তাদের টেনে আনে এই পুণ্যভূমিতে যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন বোধিবৃক্ষের নিচে বসে। সেই ঐতিহাসিক গাছ আমরা আগের দিন দর্শন করেছি ফেলেছি ।

এখানে এসে জানলাম যে , এখানে বৌদ্ধ মন্দিরে বাইরের পর্যটক দের যদিও অবারিত দ্বার, বৌদ্ধ মঠে নেই সাধারণের প্রবেশাধিকার। আমরা একে একে নানান দেশের নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির দর্শনে ও সাথে ফটোসেশনে মন দিলাম। ঝকঝকে দিনে ঠাণ্ডার কোন খোঁজ মিলল না । অনেকে যদিও ক্যালেন্ডার মেনে ভয়ানক শীত পোশাকে আবৃত তাও দেখলাম। তাদের দেখে আমার গরম লাগা আরো যেন বেড়ে গেল । একে একে তিব্বত, সিংহল, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান , ভিয়েতনাম , মায়নমার ইত্যাদির বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করলাম, যদিও শুরু করেছিলাম আমাদের হোটেলের কাছের তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম মতের অন্যতম স্বীকৃত দেবী তারা , তার মন্দির দর্শন করে। মন্দির টি নিরালা নির্জনে । কারণ মূল হল্লাহাটি থেকে খানিক দূরে অবস্থানের জন্য সব পর্যটক এখান পর্যন্ত আসেন বলে মনে হল না । শুধুমাত্র আমরা ছয় জন সময় নিয়ে ঘুরে ফিরে সবটা দেখলাম । বৌদ্ধ মন্দিরে সব কিছুই আদ্যান্ত উজ্জ্বল রঙে রাঙানো। তা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল ঝকঝকে রোদের আলোর ছোঁয়ায়।

এ দিন শুরুতেই সুড়ুৎ করে টোটো চালকের পাশটি দখল করেছিলাম। পিছনে বসা নিয়ে বেশ ঝড়ঝঞ্জা টের পাচ্ছিলাম !!! এদিকে সামনে বসে হাওয়া হাওয়াই হয়ে ঘুরছিলাম সারা বোধগয়া জুড়ে। এক জায়গায় লিটঠি চোখা র সাইনবোর্ড সাই করে চলে গেল , চেখে দেখা হল না। যদিও চেখে দেখার ইচ্ছে তেমন ছিল না। ইচ্ছে থাকলে সাই করে বেরিয়ে গেলেও টোটো চালক কে বলে বাই করে ঘুরিয়ে ওদিকে হাজির হতেম নির্ঘাত। আসলে দেশের মধ্যেই প্রাদেশিক ভাবসাবের বড় অভাব আমাদের স্বভাবে। বিহারীকে বলি মেড়ো , ওড়িয়া কে বলি উড়ে 😞। তবে উড়িষ্যার রান্নার ঠাকুরদের বাংলাতে কদর আগেও ছিল এখনও আছে। কিন্তুক বিহার নিবাসীদের কদর খাদ্য বিভাগে নেই কো। 

যাক নওলাখা মন্দির সারাই হওয়ার দরুণ ঢাকা চাপা দিয়ে রাখা , তাতে খানিক খানিক ফাঁকা। সেই ফাঁক গলে আমরা দেখে নিলাম । কিছু জায়গায় টোটোতে বসার পর তেনারা এমন আঁটকে গেলে বার বার আটক মুক্ত হয়ে নামতে বেগড়বাই করে বাগড়া দিচ্ছিলেন। নিজেরা দেখবে না ,তো আটকে বসে থাকো না !!! আমি আর রূপা টুক করে নেমে ঘুরে নিচ্ছিলাম। রূপা হাল্কা শরীর দিয়ে আটক স্থান থেকে সুড়ুৎ করে নেমে আসছিল আর আমি টোটোর সামনের সীট থেকে মোটামুটি বোঝাই বস্তার মতন ধুপুস করে স্বশব্দে নেমে পড়ছিলাম। পিছনের সব তর্জন গর্জন খানিক না শোনার ভাণ করে । আচ্ছা তোমরাই বলো , যতটা পারি তা দেখব না ??? দেখতেই তো এসেছি !!!! ছানা দুটোকেও দুই বাবা প্রভাবিত করে ধরে রেখেছিল টোটোর মধ্যেই।  বলে কিনা সব তো একই বুদ্ধ দেব !!! এ কি কথা ??? দূর্গা পূজোর সময় তো একই দূর্গা দেখি রকম বেরকম !!! আর্টের ঠেলায় তো কাউকে আবার দেবী বলে চিনতে ওবধি পারি না !!! এখানে তো সবাই কে বুদ্ধ বলে দিব্যি চিনতে পারছি। সে ৮০ ফিট উচ্চতার হোক , কি বসা হোক কি অনন্ত শয়ান বুদ্ধ মূর্তি হোক !!! এ সব দেখতে দেখতে এলাম সুজাতা মন্দিরে , বোধি লাভ করার জন্যে যখন কঠোর তপস্যা করছিলেন দিনের পর দিন না খেয়ে , তখন তিনি শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ,  সেই অবস্থায় এক অর্থপূর্ণ স্বপ্ন দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে উপোস করে , অহেতুক শরীরকে কষ্ট দিয়ে কখনও অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না । সেই সময়ে গৌতম বুদ্ধ তার উপোস ভেঙেছিলেন  সুজাতা র তৈরি পায়েস খেয়ে। তিনি বনদেবীকে পায়েস নিবেদন করার জন্যই বনে এসেছিলেন । বুদ্ধ কে তা নিবেদন করেছিলেন। সেই পায়েস খাওয়ার পরেই শরীরের শক্তি  ফিরে পেয়ে তিনি পুনরায় তপস্যা করে অবশেষে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। 

দেখা হোল একদল জাপানি ভক্তের সাথে । তারাও সুজাতা মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। আমরা ভাষার অন্তরায় আর তাদের ঝুঁকে পরে অভিবাদনের ভয়ে ওদিকে না ভিড়ে মন্দির থেকে দৃশ্যমান গ্রামীণ প্রকৃতিকে দেখে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে সামনে এগিয়ে হাজির হলাম এক ধ্বংসস্তুপ দর্শনে , যা লোকমুখে সুজাতা র বাড়ি হিসেবেই চিহ্নিত। আর্কিওলজি বিভাগ সেটিকে যত্নে রেখেছে দেখলাম । এতক্ষণ সব ঠিকঠাক চলছিল যতই বেলা বাড়ুক !!! সুজাতা দেবীর পায়েস ফের বিস্তর গোল পাকালো। আমাদের সবার ভয়ানক ক্ষিদে উসকে দিল ওই এক বাটি পায়েসের গল্প। 

এদিকে আমাদের টোটো চালক এই তো আর একটু , আর একটু বলে আরেক নিরিবিলি আধা বন্ধ ও আধা খোলা দরজার সামনে এসে টোটো থামিয়ে দেখে নিতে অনুরোধ করল। ছেলে মানুষ !!! যখন বলল সেটি তার স্কুল ছিল , কাজের ফাঁকে রবিবারে সে এখানে ক্লাস করত , বর্তমানে স্কুলের বুদ্ধ মন্দিরটির দায়িত্ব নিয়েছেন শ্রীলঙ্কা সরকার , তখন তার অনুরোধ রাখতে চললাম ভিতরে । না গেলে সে বেচারা দুঃখ পেতো খুব !!! সারাদিন যত্ন করে সব ঘুরিয়ে বেশি কিছু কি সে চেয়েছিল ??  তার স্কুলের মন্দির দেখার অনুরোধ করেছিল শুধু। দেখব না শুনে যতটা আঁধার করেছিল তার মুখ , যখন আমি আর রূপা ও তার দেখাদেখি দুই কুচে বাদে সকলে নেমে এলাম ওর মুখে দেখলাম হাজার বাতির রোশনাই , তখন আরও একবার মনে হল সত্যিই মুখ মনের আয়না !!! আর সত্যিই না দেখলে ভুল করতাম । তারা দেবীর মন্দিরের মতন এখানেও দর্শনার্থী শুধুই আমরা। এক এক করে এক একটা তলা উঠে ঘুরে দেখলাম । সবশেষে ছাদে উঠে মন ভরে গেল !!! রাজগীরের শান্তিস্তুপের আদলে আরেক শান্তিস্তুপ। পাশেই অন্তঃসলীলা ফল্গু নদী যার বোধগয়ার নাম নিরঞ্জনা। টোটো চালকের সাথে সামনে বসে এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম আগেভাগেই। ছাদ থেকে দেখলাম নিরঞ্জনার ওপর পারে দূরে মহাবোধি টেম্পলেট চূড়া। আরেক দিকে অনেক দূরে পাহাড়ের আভাস । 

আগের দিনের রাতের আলোয় মহাবোধি টেম্পল দর্শন করে সেবারের অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের মতন দিনের আলোতে পুনরায় তা দেখার  বাসনা মনে আনাগোনা করলেও , শরীরে তখন ক্লান্তির সাথে ক্ষিদের কোরাস চলছে । আমরা এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে কলকাতার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা শুরু হওয়া বুদ্ধের অনন্ত শয়ান মূর্তি যেখানে রয়েছে সেই মন্দির অভিমুখে চললাম ... কলকাতা শুরুতে থাকলেও শেষ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার নিয়েছেন ভিয়েতনাম সরকার । সব দেখে আমরা ভর ভরন্ত মন ও ক্যামেরা সহ হোটেলে ফিরে এলাম। খাওয়ার পাট মিটল প্রায় প্রায় বিকেলে। আর মহাবোধি টেম্পল যাওয়া হল না। আমরা আমাদের ঘরে আড্ডার মজলিস বসালাম। দিবাকর পরে যোগ দিল কারণ তার কল ছিল .... ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও 😥 । আড্ডার বিষয় জানতে সঙ্গে আসুন !!!! 😃 কেমন ??? 

পরের দিন আমাদের বোধগয়া থেকে বেরিয়ে সেই আকর্ষণীয় ইতিহাস ঘাঁটতে যাওয়ার কথা । যার জন্য কত বছর অপেক্ষারত আমি , জানো কি তোমরা ???? 

No comments:

Post a Comment