Thursday, 30 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫০

আগেই খোঁজ খবর করে আমার কর্তামশাই এর ভাঁড়াড়ে মজুত করা ছিল নানা রকম বেরকমের আপদ বালাই এর অতীত অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান । কয় জনা আবার বলে দিয়েছিল ... স্টেশনে অতি সাবধানী থেকো । ওদিকে নাকি ছিনতাই হয়ে থাকে । ব্যাগ পত্তর তো বটেই কন্যার হাত শক্ত করে চেপে পিতাশ্রী এগোলেন টোটোর দিকে। টোটো খানা র শ্রীহীন অবয়ব দেখে মনে হল এই বাহন কি আমাদের মতন ওজনদার কর্তা-গিন্নিকে ধারণ করতে পারবে ??? তার উপরে আমাদের দুই পরিবারের বাক্স প্যাটরা ওজনে সমান সমান । এ বলে আমাকে দেখ তো ও বলে আমিও কম যাই না !!! যদিও ওদিকের কর্তা গিন্নি সিলিম ( Slim ) । ভাগ্যিস তাই সবাই টোটোতে এঁটে গেলাম ... বলা ভাল আমাদের ওজনজন্য ওরা আঁটকে গেল টোটোর ফাঁদে । মুখোমুখি সিটের স্লিম অংশের অংশীদার হয়ে কোন মতে সেখানে বসল দিবাকর , তার পিছনে গদি সদৃশ আমার কর্তামশাই টোটো চালকের পাশ টি তে বসেছিল কোন মতে । রূপা পিছনের সিটে খানিক হেলে হেলান দিয়ে হেলদোলহীন অবস্থানে ছিল আমি নামক গদিতে ওর কোন আরাম ঘটে নি । এদিকে আমি অনেকখানি ঠিকঠাক বসে ছিলাম দুই ছানাসহ পায়ের সামনে ও কোলে ব্যাগ বোঝাই হয়ে। কন্যাকে স্থান পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেও তার দিবাকর আঙ্কেল হা হা করে আমাকে থামিয়ে দিলো , আবার বললে পুপের রূপা আন্টি নির্ঘাত নামিয়ে দিত । অগত্যা চেপে গেলাম। যে কোনো সাকিনে আমার কানাকড়ি মূল্য নেই গো !!! পুপের একখান পরভোলানী স্বভাব আছে ... খানদানী। না না মোটেও ভেবে না শ্বশুর বাড়ির দিককার গপ্প। এ একদম আমার নিজস্ব রকম ঘরাণা। মা আমাকে ওই বিশেষণে বিশেষিত করতেন রেগে গেলেই !!!! 🤫

যাইহোক রূপা রা আগে কসবাতে ই থাকত। হাঁটা পথ । যাওয়া আসা আগের থেকে কমে এল ওরা ঠিকানা বদল করার ফলে । নতুন স্কুল ভবন যেখানে গড়ে উঠছে তার কাছেই ওদের এখনকার বাসভবন। আগে রূপার কাছে মেয়েকে রেখে গিয়েছি কাজে কর্মে। রূপা আমার থেকে বছর খানেক ছোট আর দিবাকর ওরফে দিবা মাসখানেক ছোট, যদিও তার ধারণা ছিল আমি নাকি অনেক ছোট !!! আহা , এমন শুনতে কার না ভাল লাগে !!! যেখানে মেঘে মেঘে বেলা অর্ধ শতকের লেজ ধরব ধরব করছে সেখানে এমন ভাবনা তো মনের বয়স কমিয়ে দেবেই , সব রাতের শেষ আছে .... পথ যদি না শেষ হয় তবে ভাল না খারাপ হয় ? এ প্রশ্নের উওর দুরকম আঙ্গিকে অবশ্যই দু রকম । আমাদের টোটো ভ্রমণের দিক থেকে পথের শেষ না হলে গায়ে গতরে বিস্তর ব্যাথা শূলো র সম্ভাবনা !!! দিবা শুরুতে গান শুরু করলেও ওই রকম দুমড়ে বসার দরুণ গান বেশি সুর বিস্তার করতে পারল না। 

আমরা চলেছিলাম বোদ্ধগয়া। গয়া থেকে একদিকে বোদ্ধগয়া, বিপরীতে রাজগীর পেরিয়ে নালন্দার অবস্থান। খাওয়ার শেষ পাতে থাকে মিষ্টি আর মধ্য পাতে থাকে centre of attraction / বিশেষ আকর্ষণীয় পদ । নালন্দা ছিল আমাদের মধ্যেকার সেই আকর্ষণীয় স্থান। শেষপাতে ছিল রাজগীর। যেখানে কিছু স্মরণীয় ঘটনা রয়ে গেলেও স্মৃতির সরণি বেয়ে তাদের খোঁজ খবর করে হয়রাণ হলাম শুধু । তবুও ভাল লাগা রয়ে গেল ।

গান যখন gone ... তার আরও কিছু পর ভরপুর ভর দুপুরে আমরা বোদ্ধগয়া পৌঁছলাম। হোটেলের অবস্থান দেখেই আমরা আহ্লাদে আটের জায়গায় ষোলখান হয়ে গেলাম। এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই ... এই গানের লাইন বাই লাইন মেনে যেন হোটেল গড়ে উঠেছে ... আকাশ টা কে শুধু চোখে রেখে মন হারানোর দুরন্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে । হোটেল চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের পাশাপাশি ঘরের মধ্যেই । চমক আর কিছুই না , পাশাপাশি দুই ঘর পরস্পর যুক্ত একখান দরজা র সাহায্যে দুয়ারে দুয়ার বলাই যায় !!! তাই না ???

রূপা পথের খাবার কিছু বানিয়ে এনেছিল। সে সব বৃথা যাওয়া ঠিক না , তাই ঘরের ও পরের ( হোটেলের )মেলবন্ধন ঘটিয়ে আমরা বেলাশেষে আরো একবার কিছু কিছু খাবারে পেট ভরিয়ে নিলাম । 

তারপর রূপাদের ঘরে গল্প গুজবের মাঝেই দিবাকর একটু পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নিল। তারপর সন্ধ্যার সময় সকলে বেরিয়ে পড়লাম বোদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ মহাবোধি মন্দির দর্শন করতে। পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বৌদ্ধ মন্দির ও মঠের পাশ কাটিয়ে আলো ঝলমলে বাজার চত্বরের পরেই টোটোর চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন এক জায়গায়। তারপর অল্প হণ্টনেই গেট দেখতে পেলাম। ক্যামেরার টিকিট কেটে আমরা মন্দির চত্বরে ঢুকতেই দেখি নারী ও পুরুষের পৃথক লাইন । সে সব পেরিয়ে , ব্যাগ পত্তর ও নিজেদের মেলে ধরে মেলাই চেকআপের পাট মিটিয়ে অতঃপর ভিতরে প্রবেশ। বলতে নেই ...অসংখ্য জনতা , বুদ্ধং শ্মরণং গচ্ছামির ঢিমে লয়ের গমগমে মন্ত্রোচ্চারণে সমস্ত মন্দির চত্বর যেন আমাদের নিয়ে গেল এক ভিন্ন জগতে। নানান রকম আলোতে মন্দির এক একবার একেক রকম ভাবে জেগে উঠে তা যেন ভাল লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছিল সকলকে। যথারীতি ভিড় দেখে দুই পুরুষ সহচর ভয়ানক ভড়কে নিজেরা শলাপরামর্শ করে আমাদের দুই মাতাশ্রীকে দুই গ্যাড়া ও গেড়ি সহ মন্দির দর্শনে পাঠিয়ে নিজেরা কোয়ালিটি টাইমে মেতে গেল দুই ভিন্ন ভাষী দেশী ও বিদেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাথে। পরে শুনি দিবাকর ওনাদের একজনকে মশার কামড় থেকে উদ্ধার করতে , ওনার সামনে মশা মেরে এক কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড বাঁধিয়ে শেষে কাচুমাচু মুখে ওনাদের বক্তব্য শুনেছে। দিবাকরের অনেক আচরণে ছেলেমানুষী প্রকট তা এই ভ্রমণে ভাল করে আমরা জানলাম। আমি যদিও বুড়োমানুষী যুক্ত তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখলাম দিবাকর কতকটা আমার মতন , ওদিকে রূপা কতকটা এদিকের সিনিয়র জনের মতন। এ ভাবেই বোধহয় সংসারের ভারসাম্য বজায় থাকে।

রূপা পূজা দেওয়ার লাইন পাকড়াও করল আর আমি তাতে খাড়া না থেকে টুকটুক করে খোঁজ খবর করে বোধি বৃক্ষের সন্ধানে রত হলাম। একে ওকে রাষ্ট্র ভাষার হাত ধরে শুধিয়ে মন্দিরের পিছনে দেখে নিলাম ঘেরাটোপ বন্দী বোধিবৃক্ষ ও অনেক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরণ কারী ভক্ত। যারা কোন রকম অতিরঞ্জন ছাড়াই প্রার্থনারত নিজের মতন করে। ভক্ত ভগবানের চিরাচরিত সম্পর্কে দেখনদারী আড়ম্বর থাকার যে কোন প্রয়োজন থাকে না , তা কিন্তু সত্যিই শিক্ষণীয়। দেখনদারী ঢেকে দেয় ভক্তের প্রকৃত আকুতিকে , প্রার্থনাকে। 

সব শেষে লাইন মন্দির মুখী হওয়ার মুখেই আমি দলযুক্ত হলাম ... দর্শন করলাম । এরপর দুই কর্তামশাই এর কাছে হাজির হতেই তারা আরো কিছু ঘোরার নির্দেশ দিল। খানিক ঘুরে ফিরে , ছবি তুলে আমরা এক সময় মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। ছবি তোলার পর দেখি ফের আমার ছবিতে স্পটের ছড়াছড়ি , যা নাকি তেনাদের উপস্থিতির দ্যোতক !!! কন্যার আতঙ্কিত মুখে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো র মজা নিতে নিতে আমরা সামনে এগিয়ে চললাম । যথা নিয়মে যথাস্থানে আরেক টোটো র দেখা পেলাম। তাতে এদিক ওদিক করে সবাই আঁটকে গিয়ে আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম । হোটেলের পথ দিনের আলোয় বাবা-মায়ের যত রোমান্টিক লেগেছিল , রাতে আমাদের ফুলন দেবীর ততটাই ভৌতিক লাগল । 

হোটেল দৃশ্যমান হওয়ার আগেই হোটেল পেরিয়ে খানিক দূরে অবস্থিত তারা দেবী বৌদ্ধ মন্দিরের ওপরের তারা দেবীর মূর্তির দর্শন মিলল । একসময় আলোকোজ্জ্বল আমাদের হোটেল বোদ্ধবিলাসের দেখা মিলল। 

ফিরে ক্লান্ত আমরা কিছুক্ষণ ঘরোয়া আড্ডার আসর জমালাম অল্প কিছু খাই দাই করে । এরপর রাত সাড়ে নয়টা র সময় রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম নিমেষে র মধ্যেই। ঠাণ্ডার রাতে নরম নরম শুভ্র বসনা লেপ যেন আদর করে সকলকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল। শুধুমাত্র আমাদের দলের ম্যানেজার ভদ্র বাবু ৫২/৫৩ এর হিসেব করতে বসলেন। ওই হিসাবে ভুল নাই। এদিকে ঘরেও হিসাব করেন , আর নজরদারি করেন জব্বর। উপায় নাই রে ভাই ... বৌ খান যে ভয়ানক রকম বেহিসাবী। এখানেও সেই ভারসাম্য !!!!! 🤫🤭

No comments:

Post a Comment