Saturday, 11 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৮

পেলিং এর দুই ভাগ আপার আর লোয়ার। আমাদের হোটেল সামথেনলিং ছিল আপার পেলিং এ। স্কাই ওয়াকের থেকে এগিয়ে খানিক গেলেই সেই আকাশ ছোঁয়ার চাবিকাঠির অবস্থান ছিল। নামচি থেকে পাহাড়ী পথ পেরিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পেলিং পৌঁছলাম। এ হোটেলের মালিক নির্ভেজাল বাঙালি। ঘরে ঢুকে আরেক রাউন্ড কাঁপন ধরল। বিশালাকার ঘরের কোণে কোণে যেন ঠাণ্ডা ঘাপটি মেরে বসেছিল। ম্যানেজার সহ আমার কর্তামশাই রুমহিটার নিতে ঘোরতর আপত্তি জানালেন । অগত্যা !!! খানিক সতেজ হলাম হাত মুখ ধুয়ে চায়ের সাথে টা খেয়ে । এরপর দু রাত থাকার উপযোগী গুছু করে লেপের আশ্রয়ে ঢুকে গেলাম । কর্তামশাই আতঙ্কিত হলেন , কারণ লেপের ওম ছেড়ে যদি রাত উপোসী থাকি ??? খাবার না খাওয়ার ভাবনায় তিনি ভয়ানক দুঃখিত হয়ে , দুঃখ কাটাতে আরো বেশি খেয়ে ফেলেন !!! বিপদ বলে বিপদ @!!! যাক সে সব বিপদ ঘটার কারণ ছিল না , কারণ খুব বেগতিক না দেখলে আমি বাপু খাবারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না। তাই আমি সময় মতন খাই দাই করতে গেলাম ডাইনিং হলে । খান তিনেক সদ্য পাশ করা ডাক্তারের সাথে আলাপ হল , তারা তিন বন্ধু ঘুরতে বেরিয়েছে। ফেরার পালা তাদের পরের দিনেই। খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ঘরে ফিরে চট জলদি দুখান কম্বলের নিচে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম , রাতে ওঠার অভ্যাস বোধ করি ঠাণ্ডার ঠেলায় জমে গিয়েছিল। সকালে কর্তামশাই এর খোঁচা খেয়ে জাগন্ত হলাম ... চমক দেওয়ার জন্য ঘর সংলগ্ন বারান্দায় নিয়ে গেল ... ঠাণ্ডার চমক নতুন করে দেওয়ার মানে কি ভাবতে ভাবতেই চমকের আসল কারণ দেখে সত্যিই চমকিত হলাম , সাথে মন ভাল হয়ে গেল । একদম ঠিক ধরেছ ... বারান্দা থেকে কোণাকুণি ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন দিলেন শেষমেষ !!!! 

মন প্রাণ দিয়ে কোন কিছু চাইলে কখনও কখনও তা মেলে বৈকি !!! কাঞ্চন দা কে দেখে এক রাশ খুশিতে মন ভরে গেল আর আমরাও জলদি জলদি জলখাবার খেয়ে ওদিকের সব দেখার ইচ্ছেতে দম দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকালে আরো একখান খুশির খবর পেলাম। ধস জনিত কারণে ঘুর পথে ঘুরপাক খেয়ে যখন সিকিমে প্রবেশ করেছিলাম , যে সহজ সরল পথ ধসের কারণে ধসে গিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। শুনলাম তা নাকি আর বন্ধ নেই। ভ্রমণার্থি সহ ওদিকের সকলের মনের গহনের প্রার্থনা শুনে পথ খুলে গেছে .... খোল খোল দ্বার , রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে !!! দুয়ারের যে দিকেই হাজির হইনা কেন অপর পারেই তো হয় রহস্যের খাসমহল চিরকালের চেনা জানা ঘরের হাতছানি !!! খানিক নিশ্চিন্তি , যে ঘন্টার পর ঘন্টা পথে কেটে যাবে ... এমন টা হবে না ।

পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে অগোছালো প্রকৃতি যে কতটা সুন্দর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমেই আমরা এ পাহাড় , ও পাহাড় করে খানিক ওপরের দিকে উঠলেও কিছু পরে ওপর থেকে সরু সূতোর মতন মিষ্টি নামের অধিকারী পাহাড়ি রিম্বি নদীকে দেখতে পেলাম , সাথে এক আসন্ন ভোট প্রচারের জনবহুল জমায়েত দেখে মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। একসময় আমরা শ্রুতিমধুর রিম্বি জলপ্রপাত ও নদীর কলতান শুনতে পেলেও তা ছাপিয়ে ভোট প্রচারের হট্টমেলা তে চারপাশে গাড়ি বন্দী হয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আবার যানবাহন চালু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম । এমন ক্ষেত্রে আমার ক্লসটোফোবিক কর্তামশাই হাত পা ছুড়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। এখানে গাড়ি দাড়ানোর বেকায়দায় নামতে না পেরে ভয়ানক গরম হতে লাগলেন মেজাজের দিক থেকে !!! গাড়ির কাঁচ নামানো থাকলেও গাড়ি থেকে পদ যুগল নামানোর উপায় নাস্তি । কি কাণ্ড !!! মেজাজ আমার যে ফুরফুরে ছিল , তা নয় । কিন্তু কি বা করি ??? এদিকে পুপে দেবী অধৈর্যের শিরোপা ধারী। সে তার পিতাশ্রীর কান বাঁচিয়ে আমার মাথা পাগল করছিল যত্ন সহকারে !!!🤫

সব রাতের শেষ আছে , কাজেই পথ পরিষ্কার হল , আমরা ঝিমন্ত মোড থেকে চলন্ত মোডে ফিরলাম। সচল গাড়ি আবার চড়াই পথ পাড়ি দিতে শুরু করল আর এক সময় আমরা খিচিপেরি লেক দেখতে নেমে পড়লাম। বিগত ঘোরার অভিজ্ঞতার সাথে কিছুই মেলাতে না পেরে এক সময় আমাদের লোকাল গার্জেন হাল ছেড়ে এগিয়ে চললেন ... টিকিট কেটে আমরা এখানকার বাসিন্দাদের কাছের অতি প্রিয় ও পবিত্র জলাশয় দেখতে চললাম। আমার কাছে এ পুরোপুরি নতুন কে চোখ মেলে দেখার অভিজ্ঞতা সংগ্রহ !!!

টিকিট কাটার পরে তোরণ পেরিয়ে খানিক এগিয়ে পৌঁছাতে হয় খিচিপেরি লেক এর ধারে , পথ টা বৃষ্টির জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে পুরো খোলতাই চেহারা নিয়ে আছাড় খাওয়ার ভয়টাকে আমাদের মধ্যে চারিয়ে দিল .... অতি সাবধানে পা টিপে টিপে আমরা এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। আকাশ বেশ মেঘলা, গাছের ছায়া র সাথে সঙ্গত করার মতন ছমছমে পরিবেশ টা শুধু পেলাম না , অসংখ্য ভ্রমণার্থির ভিড়ে। সেটা একটু যদি পেতাম , সোনায় সোহাগা হোতো। তবে এমন ভাবনা র এদিকের ওদিকের সকলেই আমরা ভিড়ের অংশ বিশেষ। পথের শুরুয়াতে ডান দিকে অবস্থিত এক বৌদ্ধ মনাস্ট্রির দর্শনে তিনি জোর দিয়ে জানালেন এসব নতুন সংযোজন , তেনারা আগে বন্ধুদের সাথে যখন এসেছিল এ স্থান তখন ছিল নিখুঁত নিখাদ প্রকৃতিময়। আর আমার মনের মতন ছমছমে , নিস্তব্ধ !!! সত্যিই খুব হৈ চৈ কোনকালেই আনন্দ দেয় না আমায় , সে কারণেই পূজোর সময় ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতন ফাঁকা প্যাণ্ডেলে বাজিমাত করি , যে কারণে আলোয় আলো আকাশ , শহর দেখা হয় না .... যাক সে সব ... এই লেকের জল এতোটাই স্বচ্ছ যে একটা পড়ে থাকা পাতাকে ও লেকের চারপাশের গাছে বসবাসকারী পাখি তা তুলে লেকের জলকে আগের অবস্থানে নিয়ে যায় ।

লেকের সামনেও নতুন সংযোজন বৌদ্ধ ধর্ম গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি। লেকের পাশেই পাহাড়ী পথে ট্রেকিং করে কোন এক ভিউ পয়েন্ট যাওয়ার উপায় বর্তমান। কর্তামশাই এ সব ক্ষেত্রে খানিক কম উৎসাহী !!! ভেবে দেখলাম সিকিম এসে থেকেই তো গাদা গাদা ভিউ হচ্ছে নানান পয়েন্ট থেকে , আলাদা করে আর ভিউ পয়েন্ট না ই দেখলাম 😃!!! এবার ফেরার সময়ে উতরাই ধরে নেমে এলাম যাওয়ার থেকে জলদি জলদি ... সামনে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত।যাওয়ার সময় নামি নাই। পথের এক পাশে নেমে সামান্য এগিয়েই ঝর্ণা র ঝরঝরিয়ে জল ছড়িয়ে নেচে নেচে চলার প্রথমে শব্দ আর তারপরে তার দেখা পেলাম । এমন প্রকৃতির মাঝে বসে গল্প করতে হয় নিজের সাথে !!! তার উপায় এখন নেই নেই হয়ে গেছে এমন মরশুমে ... অগত্যা খানিক দেখে খানিক ঝর্ণা কে সাথে করে ছবি তুলে নিলাম । আর যে ছবি তোলা হল না তা মনের ক্যামেরায় রইল । এরপর আমাদের পরবর্তি দর্শনীয় স্হান ছিল রিম্বি নদীর ধারের কমলালেবুর বাগান আর তার সাথে আরো নিচে ওই পাহাড়ী নদীর পাড়ে চলে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। বেলা বাড়লেও তাকে বাড়তে দিয়ে আমরা কমলা লেবুর বাগানে নেমে এলাম ধাপে ধাপে , ছোট্ট ছোট্ট গাছে ফলন্ত কমলা লেবু যেন গাছ গুলোকে আলো করে রেখেছে। আরো নিচে নেমে পাহাড়ী নদীর কলতান শুনতে আমি আর পুপে আরো এগিয়ে পাড়ের ছড়িয়ে থাকা পাথরের ওপরে জিরিয়ে নিতে বসেই পড়লাম। বয়সের সাথে সাথে পাহাড়ী পথে ওঠা নামা র সমস্যার কিছু কিছু এখন আমরা অর্জন করে ফেলেছি , সে সব বর্জন করা নেহাতই অসম্ভব। ওঠার সমস্যা দমে আর নামার সমস্যা পায়ে 🤫 

নদীর পাড়ে খানিক বসার পর উঠতেই হল কারণ তখন যথারীতি মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় পেরিয়ে গেছে !!! টুকটাক খুচরো খাবারে তখন টান , কাজেই আমরা এবার অন্য টানের দিকে নজর দিয়ে এগিয়ে পড়লাম। 

খাবারের ছোট্ট হোটেলে আসার পথে জানলাম , সাময়িক আশার আলো জ্বালিয়ে তা আবার নিভিয়ে ফেরার সোজা সরল পথের ঝাপ ফের বন্ধ হয়ে গেছে আগামী বেশ কদিনের জন্য । নোটিশ সব গাড়ির মালিকের মোবাইলে টুং টুং করে হাজির হয়েছে। কাজেই পরের দিনের ফেরার ট্রেন সন্ধ্যার হলেও আমাদের রওনা দিতে হবে সকাল ৭ টা নাগাদ !!! যেতে হবে ঘুরে ঘুরে দার্জিলিঙ হয়ে । কর্তামশাই কলার তুলে বলেই ফেলেন ফেরার সময় ... দার্জিলিঙ টাও ঘুরিয়ে দিলাম !!! টেকনিক্যালি সঠিক !!!

অতো ভেবে লাভ নেই , তাও আবার খাবার যখন সামনে !!! খেয়ে নিলাম ... এবারের আকর্ষণ পেলিং এর নব নির্মিত স্কাই ওয়াক। খাওয়ার খেয়ে বেরিয়েই সামান্য এগিয়ে আমরা চললাম স্কাই ওয়াকের টিকিট কাউন্টারের দিকে হাজির হলাম। তারপর ??? সোজা সিঁড়ি বেয়ে এক প্রশস্ত চত্বরে পৌঁছনোর পর দেখি একদিকে স্কাই ওয়াক আর অন্য দিকে পেলিং এর আরো এক প্রাচীন মনাস্ট্রির আরো উপরে ওঠার অগুন্তি সিঁড়ি । সবের মাঝে অনুপস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা , যা নাকি এই প্রশস্ত চত্বরের অন্যতম আকর্ষণ। তবে যা দেখলাম তা মোটেও কম নয় । সবের মাঝেই আছে সৌন্দর্য , তাই না ??? স্কাই ওয়াকের ওয়াক করার সময় আমার ভয়ের ঘাপটি মারা সত্ত্বা জেগে জেগে উঠছিল। পুরো জেগে গেলে আবার দেখার ভাণ্ডার ভরবে না , তাই ভয়টাকে সামলে সুমলে এবার মনাস্ট্রি সাঙ্গা চোওলিং এর দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। 

এই নাম নিয়ে এক গপ্পো আছে , আমার কর্তামশাই আগেও সিকিম এসেছিলেন , বলেছি আগেই, পেলিং এ তারা বন্ধুরা এই স্কাই ওয়াকের কাছাকাছি অবস্থিত হেলিপ্যাডের সামনের কোন এক হোটেলে ছিলেন বটে । সেই হেলিপ্যাড এখন নেই আর তখন স্কাই ওয়াক ছিল না । ভাগ্যিস !!! যা যা তিনি একদা দেখেছিলেন তার গপ্প এই কদিনে মুখস্থ হয়ে গেছে !!! পরীক্ষা নিলে গড়গড়িয়ে সব লিখে দিতে পারব .... একদম !! আবার এখন কেবলকার নেই , কিন্তু প্রস্তুতি চলছে । 

যা বলছিলাম ... এই সাঙ্গা চোওলিং মনাস্ট্রির নাম গুলিয়ে আমার তিনি খুঁজে চলেছেন সাঞ্ঝা চুলহা মনাস্ট্রি !!! বোঝো কাণ্ড!!! কোথায় দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত খাবারের দোকান আর কোথায় পেলিং এর মনাস্ট্রি ??? কিসে আর কিসে ???

এরপর দিনের আলো কমে আসার একটু আগে আমরা গেলাম পেলিং এর আরেক প্রাচীন মনাস্ট্রি পেমিয়াংসি দেখতে । ওখান থেকে এক ঝলক দেখে নিলাম রাবডানসে রুইনস , ওখানকার রাজার রাজ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ইতিহাস আমাকে সব সময় টানাটানি করে , কিন্তুক এখানে রাস্তার বর্তমান আমাকে বাধ্য করল ফিরে আসতে । 

পথের ঝাঁপ খোলা থাকলে পরের দিন সকালে এই ইতিহাস ঘুরে দেখে সাথে পাখ পাখালি র জন্য চিহ্নিত অঞ্চল, যা আমাদের দেখার কথা ছিল তা দেখে আমরা ফিরতি পথ ধরতাম । 

কিন্তু !!!! বিধি বাম তাই পরের দিন সকাল ৭ টা তে প্রস্তুত হয়ে বাদ বাকি কাজ মিটিয়ে ৭.১৫ নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম....পথেই নানান ধরনের খ্যাটন ( জলখাবার ও মধ্যাহ্ন ভোজন ) পর্ব মিটিয়ে বিকেল বিকেল আমরা শিলিগুড়ি স্টেশনে পৌঁছলাম , পরের অধ্যায় সহজ সরল । সময় কাটিয়ে আমরা যথা সময়ে (সন্ধ্যা৭.৩০) ট্রেনে উঠে পড়লাম ....কু ঝিক ঝিক শব্দ তুলে রাতের বুক চিরে সকালে আমরা শিয়ালদহ তে পৌঁছে দিল আর আমরাও সময় মতন ঘরে ফিরে এলাম ।

No comments:

Post a Comment