Monday, 3 July 2023

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪০

পৃথিবী যে গোলাকার তার প্রমাণ কিছু না কিছু ভাবে মিলতেই থাকে। কন্যার বান্ধবীর মায়ের পরিচিত এক কাশ্মীরের বাসিন্দার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল ওখানে যাওয়ার বেশ কয়েক মাস আগে । পরে জানা গেল , আমাদের বেড়ানোকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারী সুমিত দা ( ট্রাভেল গাইড ) ওনার পরিচিত । আর আমাদের অজান্তেই আমরা নাজির ভাই এর হাউস বোট ও তার পাশের হাউসবোট বুক করেছি , সুমিত দা র মাধ্যমে । নাজির ভাই  , অনুত্তমার ( কন্যার বান্ধবীর মাতৃদেবী ) রেফারেন্সে আমাদের সাথে শ্রীনগর পৌঁছনোর পরের দিনেই ব্যক্তিগত ভাবে এসে হোটেলে দেখা করেন । আমরা ওখান থেকে ফেরার পরেও যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি এখনও।  

আমরা আমাদের লটবহর নিয়ে শিকারা চালকদের খানিক হাসির খোরাক সাপ্লাই করে দুখান শিকারা চেপে ডাক লেকের রাজকীয় হাউসবোটে আসীন হলাম । হাউসবোটে পৌঁছেই বিষন্নতার সুর বেজে উঠল কারণ একখান হাউসবোটে ৬ জনার বেশি থাকার উপায় নেইকো । তাই আমরা টিম ১১ দু ভাগে ভাগ হয়ে পাশাপাশি দু খান বোটে থাকার বন্দোবস্তে ন্যাস্ত হলাম। ছোট দুই বান্ধবীর হাই মাউ আর থামেই না , হেনকালে আমার মুশকিল আসান কর্তামশাই দুই সখীকে আস্বস্ত করল এই বলে যে আলাদা থাকলেও রাতে একসাথে গপ্পো করে খ্যাটন পর্ব মিটবে । দুই সহচরীর মুখের হাজার বাতির ঝিলিক আসতে না আসতেই বাতিল হল ওখানকার কর্মচারীদের হাউমাউ শুনে ... এবার তারা যা বললে তাতে নিজ্জস বুঝলাম যে ৬ এর বেশি মানুষের ওজন হাউসবোট সইতে পারে না । সংখ্যার বাড়াবাড়িতে জলের ওপরের বদলে ভিতরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা প্রবল । অতএব মুখের মেঘ নিয়ে দুই সখী দুই বোটের ঘরে প্রবেশ করল । 

রাজকীয় কাশ্মীরি কাঠের আসবাব , গালিচা সব কিছু নিয়ে কামাল করা অন্দরসজ্জা দেখে মনে আর মেজাজেও একখান রাজকীয় ব্যাপারেও আনাগোনা হতে লাগল । মেজাজে তা দিতে দিতেই দেখি ধুমায়িত গাঢ় দুধের চা হাজির সাথে কিছু মিষ্টি বিস্কুট। অনেক দিন পরে শরীর তখন নিজের দখলে ফেরত এসেছে ... ঘোরাঘুরির ২য় দিন থেকেই সে বেজায় ব্যাজার হয়ে পড়েছিল । আরাম করে চা পান করতে করতেই শুনলাম... ছোটগিন্নির সাথে আমরা কজনা স্হলে যাব ... শেষ মুহূর্তের ফাইনাল কেনাকিনির জন্য। আমার গেঁড়ি পত্রপাট পাশের হাউসবোটে সিঁধিয়ে গেল তার বান্ধবীর কাছে। ওদিকের বোট আর আমাদের বোটে যাওয়ার কমন পথ আছে একখান ...  জলের ওপরে ডেকের সাথে তা যুক্ত। 

অতএব আমরা ৫জন আবার জল পেরিয়ে স্থলে হাজির হলাম , হামলে পড়ে বাদ বাকি কেনা কাটা সামলে নিতে ।আমার কর্তামশাই ভয়ানক দরদাম করার পক্ষের লোক । সে দামাদামি শুরু করলে দোকানদারের করুণ মুখ দেখে সত্যিই আমার মায়া লাগে । আর বলতে নেই ওমন রাশভারী ওজনদার মানুষকে চট করে কেউ ঘাঁটায় না , ফুটপাতে তো বটেই খোদ সরকারী এম্পোরিয়ামেও সে তার দরদামের বাতজিৎ এ বাজিমাত করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিল এবার । কেনার পর্ব মিটিয়ে আমরা চললাম পেটে চালান করার মতন কিছু সান্ধ্যকালীন আহারের বন্দোবস্ত করতে । যদিও সন্ধ্যা তখন গড়িয়ে রাতের দিকে যেতে শুরু করেছে । সব যখন জোগাড় হল তখন আবার জল পেরিয়ে হাউসবোটে ফিরে এলাম। এতদিনের ঘোরাঘুরির ফলে সকলেই তখন বেশ ক্লান্ত ... 

জলে থুড়ি জলের ঘরে হাজির হয়ে দেখি রাতের খাবার রাজকীয় ডাইনিং টেবিলে সুসজ্জিত। সান্ধ্যকালীন আহারের জন্য যে সব খাবার  স্থল থেকে আনা হয়েছিল তাও ডিনারে যুক্ত করে তাদের মুক্তির পথ খুললাম । ছোটগিন্নিও ওদিকের খাবার ঘর সাজিয়ে ফেলল। আমরা যার যার হাউসবোটে রাতের খাবার খেতে বসে গেলাম । রাতের মেনুতে ভাত , তরকারি , রুটি , ডাল আর চিকেন হাজিরা দিচ্ছিল টেবিলে । সাথে ছিল সতেজ স্যালাড আর আমাদের আনা তন্দুরী চিকেন । 

 খেতে বসে ভাত আর ডালের অনবদ্য যুগলবন্দীতে মনে হল মাছে-ভাতে যেমন বাঙালির প্রমাণ মেলে , তেমন প্রমাণ ডালে ভাতে বাঙালিতেও মজুত।  যেখানেই যাই বাঙালি ডালে ডালে চলে , মানে খেতে গিয়ে ডাল খোঁজাখুঁজি করে ... বাঙলার বাইরে কালি ডাল / ডাল মাখানি আর ইয়লো ডাল বলে যা মেলে তা আর যাইহোক বাঙালির চিরাচরিত স্বাদের ডাল সে নয় । তবুও তা দিয়েই রসনাকে রসিয়ে নেয় তারা। কিন্তুক এই জলের ওপরের জলীয় ডাইনিংরুমে আমরা যেন এক যুগ পরে  ( যদিও মোটে এক সপ্তাহ) বাঙালি ডাল পেলাম এবং খেলাম । ডাল লেকের মহিমা নাকি মনের ভুল !!! বোঝা দুষ্কর।  পরেরদিন আমাদের ফেরার গল্প লেখার কথা । তার আগে আছে সব কিছু সুন্দর করে মাপে মাপে খাপে খাপে ভরে গুছোগুছির পাট । সেই মতন খাওয়ার পর আমাদের এক একজনের ব্যাগ পত্তরের ডালা খুলে মেলে ধরে হিসেব কষে কষে কাজ গুছিয়ে তুললাম তুলনামূলক মধ্য রাতে । রাত নিঝুম দাও না ঘুম ... বলার মতন সময় এগিয়ে এসেছে অনেক আগেই , আমার কন্যা তখন মোটাসোটা নরম গরম ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে ঘুমন্ত রাজকুমারী হয়ে নিদ্রামগ্ন। আমিও ঘুমের দেশের পথ ধরলাম । ধরার আগে একটু ফোনে মন দিলাম, এক খান গোটা সপ্তাহ শেষ করে ... সেদিনই প্রথম wifi এর সাথে যুক্ত হতে পেরেছি। আগে উপায় থাকলেও নিজে ছিলাম উপায়ের খোঁজাখুঁজি আর বোঝাবুঝির উর্ধ্বে। জলের ওপরে ঠাণ্ডার প্রকোপ কিছুটা বেশি হলেও তখন তা খানিক সয়ে গেছে । আর ওমন রাজকীয় পরিবেশে আমার কিন্তু বেশ মেজাজের সাথে ঘুম এসে পড়ল । এদিকে তিনি ভারী খুঁতখুঁতে, তাই নানা রকম খুঁতখুঁতানি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন । নিস্তব্ধ কনকনে ঠাণ্ডার রাতের বুক চিরে আসা অল্প শব্দও ভীষণ হয়ে তার ঘুমন্ত মোডকে জাগন্ত করে দিচ্ছিল । কাঠের মেঝেতে চলাচলের শব্দেও সে জেগে উঠছিল।  এক সময় ঘুম জাগরণের পালা মিটিয়ে ভোর হল । আরো কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে ডাল লেকের ভোর দেখলাম, যাকে কোন মতেই ডাল বলা যায় না। সকলে তখনও ঘুমের মাঝে , আমি ক্যামেরাসহ হাউসবোটের ডেকে আসীন হয়ে খানিক  মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করলাম, বাদবাকি থাকল মনে বন্দী হয়ে । এরপর যথা নিয়মে চা ও জলখাবারের পর্ব মিটিয়ে আমরা লেকের জলে ভেসে পড়লাম শিকারা রাইডে।  রকম বেরকম স্পটের লিস্টি নিয়ে আগেই দরদাম হয়ে গিয়েছিল । ঘন্টা দেড় দুই ঘুরে ফেরার কথা পাকাপোক্ত হয়ে ছিল আগেই।  দুলকি চালে শিকারা চড়ে বিনা কসরতে ভেসে চলতে তখন বেশ লাগছিল । কারণ সারা ঘোরাঘুরির শেষ পর্বে এসে শরীরের অন্দরমহলে তখন ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভুর সুর শোনা যেতে শুরু করেছে ।  একে একে পশরা সাজানো ভাসমান ও চলমান দোকানপত্র পাশে পাশে সাথে সাথে হাজিরা দিতে দিতে চলল । অবাক হবার কিছুই নেই শিকারাতে আসীন হয়ে দোকানপাটের ঢালাও আয়োজন আছে এই জলের মাঝেই।  এমনকি ওখানে কাশ্মীর কি কলি সাজার ও তার স্মৃতি টুকু থাক সম সাজনগোজনের ছবি তোলার বন্দোবস্তও ভেসে ভেসে হাজির হল । কিন্তুক কি ছবি , কি খাবি ( খাবার )  তখন পকেটের দিকে তাকিয়ে সবই মায়া ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না । দুলকি চালের গতিটা বেশ লাগছিল।  একে একে পেরিয়ে গেল ফ্লোটিং পোস্ট অফিস, ফ্লোটিং মার্কেট, ফ্লোটিং গার্ডেন, মীণা বাজার । এখানে কোন কোন হাউসবোট বিখ্যাত হয়েছে দূরদর্শনের ধারাবাহিক ( গুল গুলসন গুলফম) ও নানা চলচ্চিত্রের দাক্ষিণ্যে সে সবও দেখা সাক্ষাত হল । এরপর ফ্লোটিং মার্কেটের এক ড্রাই ফ্রুটের দোকানে নেমে পড়লাম ... ওর্ডারী কিছু কেনাকেনির জন্য। বিশাল দোকানে থরে থরে সাজানো অসংখ্য শুখা ফলের সম্ভার । শুধুমাত্র চোখে দেখা আর কেনা নয় ... সাথে ছিল চেখে দেখার সুযোগ । তবে ঘরের জন্য অল্প কিছু আর পরের জন্য আনতে দেওয়া শুকনো ফলের সাথে আমার রান্নাঘরের জন্য হিঙ আর কাশ্মীরের বিখ্যাত লাল লঙ্কা ( রঙের জন্য বিখ্যাত) কিনেছিলাম শুধুই চোখে দেখার বিনিময়ে। ওসব চেখে না দেখাই ভাল।  পরে সময় মতন চেখে দেখার জন্যই তো আনা ... তাই না ???😄 

এরপরে ছিল ঘরে ফেরার নতুনত্ব হীন পর্ব । আমরা দুলকি চালে ভেসে ভেসে হাউসবোটে ফিরে ফাইনাল প্যাকিং শেষ করে আবার স্থলের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়লাম। লটবহর নিয়ে ঘাটে ওঠার পর দেখা গেল দূরের হাইসবোটের ডেকে আমাদের আহেরীর সুন্দর গোলাপী রঙের ব্যাগপ্যাক খান একা একা বিষন্ন চেহারা নিয়ে এদিক পানে চেয়ে বসে আছে .... আবার বকাবকি আর ফোনাফুনির পাট চুকিয়ে সে তার মালকিনের জিম্মায় হাজির হল । আহেরীর মুখে হাসি ফুটল। খানিক অপেক্ষার পর ইমরাণের টেম্পো ট্রাভেলারে চড়ে  সব বোচকা সহ আমরা রওনা দিলাম ... প্রথমেই দুপুরের খাবারের পাট মেটানোর জন্য ডাল লেকের সামনের বুলেভার্ড রোডের ওপরে অবস্থিত এক হোটেলে সবাই নামলাম। পেট পূজোর পর এগিয়ে চললাম এয়ারপোর্টের পথে। ফেরার পথের খানা তল্লাশি গাল ভরা গল্প আগেই কানে এসেছিল পাড়াতুত নীলাঞ্জনাদির মারফত  .... এবারে তার খাস মহলে প্রবেশ করলাম। বাক্স প্যাটরা , আণ্ডা বাচ্চা সহ প্রত্যেকের আপাদমস্তক পাট পাট করে তল্লাশি এয়ারপোর্ট ঢোকার আগে পরে মিলিয়ে প্লেনে ওঠা ওবধি ক্ষেপে ক্ষেপে হতেই থাকল ৪/৫ বার , তখন আমরাও মনে মনে ক্ষেপে গেলেও কিন্তুক  চেপে আছি সে সব । এ সবের মাঝে স্ক্যানারে ধরা পড়ল আমার ব্যাগে নাকি নারকেল ???? কয় কি ?? সে আবার কি কথা ??? পরে শুনি পেপার পাল্পের তৈরি ছোট ছোট কানের দুল রাখার জুয়েলিরী বক্স ( যা টোকন স্বরূপই কেনা হয়েছিল ) নাকি ওমন ইম্প্রেশন দিয়ে মাত করেছে । অথচ একই স্ক্যানার আমার দিদি আর ছোটগিন্নির কৌটো ধরতে আপারগ। স্ক্যানারের কি মহিমা !!!! বোঝো কাণ্ড।  বেশ ইচ্ছে হলে ধরে আর ইচ্ছে হলে ছাড়ে 😊😊 

এ সব পেরিয়ে অনেক অপেক্ষার পর আকাশ পথ ধরে ফেললাম। মাঝপথে চণ্ডীগড়ে প্লেনে বসেই অপেক্ষার পালা মিটিয়ে আরো কিছু নেমে যাওয়া প্যাসেঞ্জারের সীট ভরে নিয়ে আমরা কলকাতার দিকে উড়তে শুরু করলাম । দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে গপ্প ও ঘুম সব ঝালিয়ে নিল । সময় মতন আমরা ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে এলাম । 

শরীরের অবসন্নতা সত্ত্বেও মনে অনেকখানি তরতাজা , টাটকা বাতাস নিয়ে ঘরে ফিরলাম । আজ পেরিয়ে গেছে প্রায় মাস তিনেক ... তাও মনে হয় ... এই তো সেদিন আমরা ভূস্বর্গের মাঝে ঘুরছিলাম আনন্দে ।

@শুচিস্মিতা ভদ্র 

Sunday, 4 June 2023

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৯

পরেরদিন সকালে সব গুছিয়ে , তা গাড়িতে সাজিয়ে শ্রীনগরের চারদিকের বাদ বাকি ঘুরে দেখার স্হান দেখতে চললাম সকলে মিলে , আমাদের যার যা বরাদ্দ সে জলখাবার গলধঃকরণ করে নিয়ে। চুপি চুপি বলি ছোট গিন্নিরা শ্রীনগরে এসেই ইংলিস ব্রেকফাস্টে ফিট করেছিল নিজেদের। শুরুর পরে পরেই চিড়েতে ভিড়লেও ব্রেক নিয়েছিল কিছু পরে । এদিকে আমরা এ যাত্রায় চিড়েতন কে সাথেই রেখেছিলাম।  শুরুর দিন আর শেষ দিন বাদে চিড়ে তে চিড় ধরতে দিইনি । 

শ্রীনগরের সৌন্দর্যে আকুল ব্যাকুল ছিলেন মুঘল বাদশাকূলের অনেকেই। তাদের প্রতিষ্ঠিত বাগ বাগিচার মোটে একখান দেখা হয়েছিল শ্রীনগরে ঘোরার শুরুতে । বাকি গুলো না দেখলে কি আর আমাদের ঘোরাঘুরি শ্রী যুক্ত হয় ? লিস্টি মোতাবেক আমরা বাগ বাগিচাগামী হলাম । এবারেও খানিক পথ পেরিয়ে টিউলিপ বাগানের কাছেই আমাদের ছেড়ে ইমরাণ তার বাস নিয়ে জায়গা মতন সরে পড়ার পর , আমরা আটো ধরে পাহাড়ের চড়াই পথ ধরে ফেললাম। 

শ্রীনগর পৌঁছনোর পর হোটেলের বারান্দা থেকে দৃশ্যমান এক পাহাড়ের মাথায় একখান কেল্লা দেখে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করার ইচ্ছে চাগিয়ে উঠলেও পরে ইচ্ছেটাতে তা দেওয়া যায়নি  , কারণ ছানবিন করে জানা গেল ওটি মুঘলাই কেল্লা হলেও , এখনকার রাজা অর্থাৎ সরকারের আওতাধীন।  

আপাতত কেল্লা ছেড়ে বাগানের পথ ধরে , বাগানের দোরগোড়ায় হাজির হলাম । শুনলাম এখানে খান দুয়েক মুঘল গার্ডেন দেখে আমরা অন্য আরেক মুঘল গার্ডেন এর দর্শন করব । সব শেষে ডাল লেকের পাশে অবস্থিত পবিত্র স্হান হজরতবাল মসজিদ দর্শন করে সেদিনের মতন জলচর হব অর্থাৎ স্বপ্নের সফরের আরেক স্বপ্ন সফল করতে হাউসবোটে আসীন হব। প্রথম ক্ষেপে আমরা হাজির হলাম পীর মহল নামধারী মুঘল গার্ডেনে যা লোক মুখে পরিচিত পরি মহল নামেই।  কোথায় পীর আর কোথায় পরি এ সব আলোচনায় না গিয়ে আমরা সরাসরি বাগানে ঢুকেই পরি সাজতে লেগে পড়লাম ছুড়ি ও ধাড়ি সবাই। একে একে কাশ্মীর কি কলি ক্যামেরা বন্দী হতে লাগল । ছোটি, মোটি , নাটি সব রকম কলি সেদিন পরি মহলে ঘোরাঘুরি করলেও , কলকাতায় সব ফিরেছি কাশ্মীর সে কালি হয়ে ... জয় মা 🙏🏻। পরি মহলেও ধাপে ধাপে হাঁপ ধরার ব্যাপার ছিল । সে সব ধাপে  ওঠার বায়না যে ধোপে টেকসই হলো না , এমন অপবাদ শত্তুরেও দিতে পারবে না । সব রকম ধাপ ঘুরে আমরা বাগান থেকে বেরিয়ে অটো চড়ে উতরাইতে আরেক বাগ চশমেসাহিতে হাজির হলাম রোদ চশমা লাগিয়ে .... তখন রোদের তেজ না হোক , বেশ খোলতাই হয়েছিল।  তবে আমরা এখন কলকাতায় যে রোদের সাথে মোলাকাত করি তার কাছে এ নেহাতই শিশু। অটো থেকে নেমেই আমরা সকলে সফ্টি খেয়ে গরমে আরাম পেলাম । স্বপ্না কাকিমা চশমেসাহীর সিঁড়িতে আর ভিড়লেন না  , কোমরের ব্যাথা তো ছিলই  সাথে । ওখানেও বাগানের মাঝের ফুল , ফোয়ারা , রকমবেরকমের নাম না জানা গাছের শোভায় মুগ্ধ হলাম । সকলে এখানেও খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে দু ধাপ পেরিয়ে বাগানে ধপাস হলাম । সাদা ফুলে ছাওয়া গাছের সামনে , পাশে হেলে , দুলে একা , সকলে বেশ কতক ছবি তোলার পর মন খুশ হয়েছে কি না হয়েছে , হঠাৎই দেখি ক্যামেরা আর ছবি তুলছে না  !!!! আনন্দ হঠাৎই ভুস করে ডুবে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেল। এক দিকে ছবির ছড়িয়ে থাকা বিষয় আর অন্য দিকে ক্যামেরার হরতালে মাথায় তখন করতাল বাজতে শুরু করেছে । এর মধ্যেই এই বাগিচার ফোয়ারার উৎস স্থলে ছবি তোলার হিড়িক তখন তুঙ্গে । দলে দলে ছবি তুলিয়ে লাইনে । আমরাও হাজির হলাম , মৌমাছির চাক বাঁচিয়ে ছবি জিন্দাবাদ হল মোবাইলের হাত ধরে । এদিকে মন তখন ক্যামেরা শোকে উথাল পাতাল !!! ছবি  তোলা হয়েছে অগুন্তি ... সে গুলো কি গেল ? এই আতঙ্কে মন বিষন্ন।  কারণ আমাদের মুম্বাই দর্শনের সময় এই গোলযোগে কত কেতাদুরস্তু ছবি মাঠে থুড়ি ক্যামেরাতেই শহীদ হয়েছিল ... বলার নয় । মেট্রো গলিতে ক্যামেরা বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েও সে সব উদ্ধার হয় নাই । 

সামনেই ভিন্ন প্রদেশের একজনকে পাকড়াও করে ভয়ানক হিন্দিতে সমস্যা ব্যক্ত করলাম ... তিনি খানিক ছানবিন করে যা বললেন ... বুঝলাম ... ক্যামেরা ছবির ভারে ভারাক্রান্ত।  ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই কেস । তবে তিনি কিছু অদরকারী ছবি বাতিল করার সুপরামর্শ দিলেন । অথবা বাগানের বাইরের দোকান থেকে আরেকখান মেমরি কার্ড কেনার আরেক রকম উপায় বাতলে দিলেন । এ সবে আমার কর্তামশাই দিলদরিয়া ... কিন্তুক ক্যামেরার দোকানের মালিককে খুব একটা কফিডেন্ট লাগল না এ ব্যাপারে । আর আমাদের কাছে কার্ড বিক্রির থেকে বাগানে আগত টুরিস্ট দের কাশ্মীর কি কলি বেশে র ছবির দ্রুত প্রিন্ট আউট বের করতেই তার ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে । অগত্যা আমরা, ক্যামেরা যেটা আমার কাছে বড়ই আদরের , তাকে পরের হাতে দেওয়ার বদলে নিজের ব্যাগে যত্ন করে ভরে ফেললাম । এরপরের পর্ব পেটপূজো সংক্রান্ত।  সকলে সেদিন দক্ষিণী ধোসায় কাশ্মীরি মধ্যাহ্ন ভোজন সমাপন করলাম। এরপর গেলাম আরেক শাহী বাগ শালিমার বাগে। সেখানে সকলে নামলেন না । মেরা প্যায়ার শালিমার গানের কলি গুনগুন করতে করতে সেই বাগে আগুয়ান হলাম ... কিন্তু মেরা প্যায়ারে তখন মেরামতির কেরামতি দেখাচ্ছে কারিগরবৃন্দ। এখানে বাঁশ সেখানে দড়ির ফাঁস সব টপকে খানিক খানিক দেখা সাক্ষাত হল । এখানে ধাপের চাপ নেই । সমতল বাগানে নানা রকম ফুলের ছড়াছড়ি। ছবি তোলার পর আকাশ পানে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম কজনা ... কারণ তখন ঈশাণ কোণে মেঘ জমেছে , মনের মধ্যে গানের কলিও বদলে গেছে ..." মেঘ কালো আঁধার কালো .... " এবারে আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার চলল ডাল লেকের পাশে অবস্থিত হজরতবল মসজিদ দর্শন করতে । আকাশের মুখ ভার তখন কেটেছে বটে , তবে দিনের শেষ হওয়ার রঙ লেগেছে তার চোখে মুখে। কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির পাশ কাটিয়ে আমরা মসজিদ চত্বরের সামনে নামলাম । ভিতরে নারী ও পুরুষের আলাদা আলাদা দিকে ভাগ করা অঞ্চল ঘুরে আমরা সকলে ডাল লেকের পাশে চলে এলাম। কনকনে ঠাণ্ডাতে হাল বেহাল হলেও আস্তে ধীরে সইয়ে নিতেই হল । ছবি তোলা বাকি ছিল তো ??? সবার ছবি তোলার জন্য এখানে খোদ কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির কজন ছাত্রীকেও পেয়ে গেলাম । ছোটগিন্নি চোস্ত হিন্দীতে ওদের সাথে নানা বিষয় বার্তালাপ করে ফেলল। জানা গেল ভূস্বর্গ ছেড়ে ওরা কোনদিন কোথাও যায়নি বেড়াতে। আসলে সুন্দরের মাঝে যাদের বাস , তারা সুন্দরের খোঁজে কেনই বা বেরবে ?? 

দেখাদেখির পর ফিরতি পথে ছোটখাটো কিছু খরিদারী মিটিয়ে আমরা দুই গিন্নি বাকিদের নিয়ে ডাল লেকের যে দিকে আমাদের হাউসবোটের অবস্থান  , সেদিকে এগিয়ে চললাম। ঘাটের ধারে আমাদের পাহাড় প্রমাণ লাগেজ দেখে শিকারা চালকেরা চোখ কপালে তুলে বেশ ঘোট পাকালেও আমরা হাসি দিয়ে সব ঢাকা দিলাম । প্রথমে সামান তারপর টিমের  তামাম সকলে দুলকি চালে দুখান শিকারা চড়ে ডাল লেকের জলে ভেসে পড়লাম। এত সুন্দর একখান লেক কেন যে ডাল হবে কে জানে ? নামের নিশ্চিত কোন না কোন সুন্দর ব্যাখ্যা আছে  , যা আমার অজানা । 


Wednesday, 17 May 2023

 


বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৮

রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরেই দেখি আরেক বিপদ তার ডাল পালা মেলে ধরেছে ... কন্যা পরেরদিন বেরতে নারাজ । আর বাপসোহাগীর বাবা ধরাশায়ী মানসিক ভাবে । কি আপদ বলাই বলো তো ? শারীরিক মানসিক সব রকমের গোলযোগ সামলানো কি মুখের কথা ? এমনিতেই আমার  আশা নিরাশার দোলচাল সর্বক্ষণ চলতে থাকে  ... কিন্তু ঘুরতে বেরনোর আমি খুব আশাবাদী বটে । ভাবলাম রাত গ্যাই  বাত গ্যাই হলেও তো হতে পারে !!!! দেখাই যাক না সকাল ওবধি । গরম ব্ল্যাঙ্কেটের ওমে নিজেকে সেট করে আশার ভাবনা ভাবতে ভাবতে দিনের শেষে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।  যথানিয়মে সকাল হল .... আগের রাতে আমার জামাই বাবুও কাত হয়েছিলেন  , সকালে খবরাখবর নিতে দিদির ঘরে গিয়ে দেখি আগের রাতের কাত জামাই বাবু সোনমার্গ যাওয়ার উৎসাহে মাত ।জামাই বাবু যা বললেন  গানে গানে তার  মানে দাঁড়ায় ... ছোড়ো কাল কি বাতে, কালকে বাতে পুরানী....আমি খানিক হালে পানি পেলাম । যদিও ঘরের সিনিয়র তখনও যাব কি যাব না গানের মাঝেই রয়েছে। তার  মনের ইচ্ছে ... মেয়ের সাথে থেকে যাওয়ার  !!! হোটেলের এক ঘরে আশার আলো জ্বালিয়ে  নিজের ঘরে ফিরে দেখি আলো আবার নিভু নিভু । কেন  কেন ?? মেয়ে ঘুম কাটিয়ে উঠে তার পেট গুলু গুলুর খবরে ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে তার বাবার , আমারও বটে  !!!! তার মধ্যেই নাটুকে নাকি চিৎপুরী উক্তিতে বাবা - মা ধরাশায়ী । কন্যা উবাচ ... " মা , আমার ইচ্ছে করছে না যেতে , কিন্তু তোমার এতদিনের ইচ্ছাপূরণ করতে কষ্ট হলেও আমি যাব মা 🤔🙄 ।" 

হেনকালে ছোটগিন্নির আগমন ... এসেই হল সমাধান ... "আজ মায়ের কাছে হিয়াকে ( আহেরীর ডাক নাম )রেখে যাব গো । ওর শরীর ভাল নেই মোটেই। পেট গুলু গুলুর সাথে আরো উপসর্গ উপস্থিত ।" আমরা তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেললাম ভবিষ্যত কার্যাবলী ... দুই বন্ধু হোটেলে থাকবে দিদার কাছে । মেয়েকে ছাড়া সোনমার্গ যাব ভেবে মনটা একটু উদাস হলেও পরমুহূর্তে দুই বন্ধুর উল্লাস আর এরপরে হোটেলের বারান্দা থেকে বিদায় জানানোর আনন্দিত রূপে পষ্ট বোঝা গেল ওদের স্বাধীনতা দিবস ভালই কাটবে । ওদের খাওয়ার ব্যবস্থাও হোটেলের রান্নাঘর মারফত প্রস্তুত করার পর আমাদের দুজনার রোজের চিড়ে সেদ্ধ খেয়ে আর ইলেকট্রল প্রস্তুত করে সোনমার্গ রওনা হলাম । 

বাস চালু হতেই আমি চক্ষু বুজে আর দেবাশ্রিতার দেওয়া হজমি , মৌরি খেতে খেতে শরীরের নানা রকম আপদ বালাইকে হজম করার চেষ্টার ত্রুটি রাখলাম না । মাঝে মাঝে পথের শোভাও দেখা চলছিল । পুরো মুদিত নয়ন থেকে  এমন মন মাতানো প্রকৃতির রূপকে না দেখার মতন বোকামি করা কি যায় ? তবে শরীরকেও পুরো উপেক্ষা করার উপায় নেই।  তাই ব্যালেন্সের থিয়োরী অ্যাপলাই করতে করতে চলেছিলাম।  আমাদের হিল্লোলও কখনও জাগন্ত, কখনও খেলন্ত আবার কখনও বা ঘুমন্ত হয়ে আমাদের সাথ দিচ্ছিল।  পথে এক জায়গাতে সিন্ধু নদ দেখে ইতিহাস ছুঁতে আকুলি বিকুলি করে বাস থেকে নেমে পড়লাম।  সে সব ছবি ফেরার পর ফেসবুকে ইতিহাসের হাত ধরে পোস্টিয়েছি , হেনকালে আমার ছোটকালের বান্ধবী যে আবার বেড়ানোর ডিগ্রীধারি, ধরল চেপে ... কাশ্মীরে সিন্ধু নদ পেলেই হোলো?  এ কি মগের মুলুক নাকি !!! সে তো লে /লাদাক হয়ে পাশের মুলুকে ধায় !! আবার ছানবিন চলল ... তথ্য মিলল। একই নামে ভিন্ন এ নদী । যাক সে সব তৎক্ষণাৎ শুধরে নিয়ে এগিয়ে চলি , কেমন ... ?

প্রকৃতির সাজুগুজু এ পথে বার বার আমাদের মুগ্ধ করেছে , নেমেও পড়েছি বার দুয়েক। অন্য ভ্রমণার্থিরাও একই ভাবে পথের মাঝে থেমে , নেমে ছবিতে ছবিতে হিমালয়ের গল্প লিখেছে অগুন্তি। এক সময় সোনমার্গ পৌঁছলাম সকলে । এখানেও স্নোবুট পড়ে থপ থপিয়ে শম্বুকের গতি প্রাপ্ত হয়ে সবার পিছু পিছু চললাম মূল রঙ্গমঞ্চের দিকে । কর্তামশাই ভারি কাহিল তখন , একদিকে চিড়ে খাওয়া দুবলা শরীর, সাথে ঠাণ্ডার কাঁপন এবং সর্বোপরি স্নোবুট পরে হন্টনের ধকল। যেখানে পৌঁছে খেলা জমে উঠল , সেখানে হাজির হতে হাঁটতে হবে অনেকখানি ( যেটা সব মেটানোর পর জেনেছি) , শর্টকাট ধরতে আমাদের দেশের সকলের জুড়ি মেলা ভার ... প্রথমেই শুনলাম ঘেরা অংশ নাকি টপকাতে হবে । শুনেই মনে হচ্ছিল টেনে ছুট দিই। সে পথও বন্ধ।  এই ভয়ানক বুট পরে হাঁটতেই অস্থির, তাতে ছোটা তো আরেক বিপদের গল্প !!! মনে মনে প্রমাদ গুনলেও যখন উপায় নাস্তি ( উপায় ওবধি কেউ যাচ্ছিলেন না , তাতেই আরো গোলযোগ) এদিকে ওদিকপানে র হাতছানি প্রবল ... অগত্যা জয় মা বলে কিছুটা আপদ বালাই কমের দিকে এমন টপকানোর দিশা ধরে এগিয়ে পড়লাম।  এক কাশ্মীরি স্লেজ চালকের হাত ধরে শেষমেষ যেন এভারেস্ট জয় করলাম  , কিন্তু হলে কি হবে এ সবে যার হাতযশ দারুণ বলে জানি তিনি টপকানো পর বরফের ওপর আছাড় খেয়ে আমার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরালেন । আরো জনা দুয়েক স্লেজ চালক তেনাকে খাড়া করে , এবার দুজনকেই স্লেজে চাপাতে উদগ্রীব হয়ে উঠল । একদিকে কৃতজ্ঞতা অন্য দিকে অনিচ্ছা এর দোলচাল চলতেই লাগল মনে , সাথে তেনাদের সেন্টিমেনটাল কথার দরুণ কিছু মূল্যের বিনিময়ে নিষ্কৃতি পেলাম শেষমেষ ... দলের বাকিরা আগেভাগেই স্নোস্কুটারের টিকিট কেটে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল ... আমরা এ সব মিটিয়ে ভুট্টা খেয়ে আরও একবার বরফে আছাড় খেয়ে ( আমি নই ) দলযুক্ত হয়ে স্নো স্কুটারে আসীন হয়ে .... আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে বলে আরো উর্ধে ধেয়ে চললাম। আসে বরফ পাশে বরফ , যত দূর দৃষ্টি ধায় সবেতেই বরফ .... বরফে খানিক গড়াগড়ি খানিক ধরাধরি ( স্নো বল ) করে বিস্তর ছবির পর্ব মিটিয়ে এবার উতরাই পথ ধরতাই করতে ফেরার স্নো স্কুটারে উঠে পড়লাম।  ক্যামেরাসহ ব্যাগ পিঠে , সাইড ব্যাগকে মালা করে গলায় ঝুলিয়ে রওনা দিলাম।  গলায় ঝোলালাম  , কারণ যাওয়ার সময় চড়াই পথে কাঁধের ব্যাগ হাওয়া আর স্কুটারের গতির গুঁতোয় উড়ি উড়ি গতি প্রাপ্ত হচ্ছিল । তাই এই সাবধানতা । উতরাই এর আগের সকলের স্কুটারে আসীন মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করল ছোটগিন্নি । তারপরের কয়েক মিনিট পুরো আতঙ্কিত আত্মারাম কে সামলাতে সামলাতে হুস করে নীচে নেমে এলাম । এসে দেখি বাকিদের মুখের অভিব্যক্তি আমার মতনই ফ্যাকাসে পানা । ছোটগিন্নি তো ছবি তুলে ছানা আর ব্যাগ কোলে কাঁখে নিয়ে এক হাতে ব্যালেন্স সামলে আর ছোটো র জ্যাকেট টেনে ধরে ফেরত এলো । হিল্লোল স্কুটারের বদলে খানিক হাওয়ার মধ্যেই রাইড সেরে ফিরল । ছোট্ট মানুষ, ভয়ের বোধ এখনও হয়নি তার। এদিকে আমরা সব শুনেই আতঙ্কিত।  রাইডের শেষে গাইডের গাইডলাইন ধরে সকলে  চা পানে রত হলাম।  এরপর আবার ধরাধরি করে রেলিং টপকিয়ে আমাদের বাহনের দিকে পা চালালাম । সোনমার্গ দেখা শেষ হল ... ভাড়া করা বুট থেকে পদ যুগলকে মুক্ত করে এবার ফেরার পথ ধরে ফেললাম। ফোনাফুনির মারফত ওদিকে র খবরাখবর নেওয়ার পর বুঝলাম ... তেনাদের সারা কাশ্মীর ভ্রমণের সেরা দিন ছিল নিজেদের মতন করে কাটানো হোটেলের দিনযাপন । 

সন্ধ্যার মুখে ঘরে ফিরে ক্ষণিকের বিরতি কাটিয়ে দল ঝাঁপ দিল সামনের মার্কেট চত্বরে , যে যার মতন এদিক ওদিক ছড়ালেও জুটবো একসাথে হোটেল শামিয়ানায় তেমন কথা আগে হয়েছিল । দেবাশ্রিতার কথায় সবাই সায় দিয়েছিলাম এ ব্যপারে যে শেষ দিকে এক দু দিন কাশ্মীরি   রান্না না খেল চলে না । আসার আগের দেখা ফুড ব্লগ কে এভাবে পুরোটাই বেকার করে দেওয়া রীতিমত দুঃখজনক !!! কাজ কাজেই কেনাকিনির পর কাশ্মীরি ভেজ আর নন-ভেজে মন ভিজল , শরীর জুড়োলো তো বটেই । পরের দিন আমাদের ঘোরাঘুরির পালা চুকিয়ে স্থলের বাস উঠিয়ে জলের বাসস্থানে একরাতের জন্য থিতু হওয়ার কথা । কাজেই মনের মতন খ্যাটন  মিটিয়ে ১১ টা পেরনো রাতে বুলেভার্ড রোডের হোটেলের ঘরে ফিরে সব গুছু হল এক প্রস্থ । তারপর ঘুমের ঘোরে ডুবে যাওয়ার সময় এসে গেল । 


 @শুচিস্মিতাভদ্র

Thursday, 11 May 2023

 


বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৭

বছরের এই সময়ে টিউলিপ বাগানের দোর খোলে , দেশ বিদেশ থেকে আগত টুরিস্ট ভিড় করে । এবারের উন্মাদনার পারা প্রথম থেকেই উচ্চগ্রামে বাঁধা। বাংলা তো বটেই ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ থেকেও জনতা জনার্দন এসেছে কাশ্মীরে, যেন কবির কথার সাথে মিল রাখতেই ... বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান । এ বারে টিউলিপ  বাগানের দোর খুলেছে ১৯ মার্চ আর আমরা বাগানে পা দিলাম ২৮শে মার্চ ( ২০২৩) । 

মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা আবার অটো , টেম্পো সব পর্ব পেরিয়ে বাগানের কাছেই কিলবিলে জনতার মাঝে ল্যান্ড করলাম। চড়া রোদে তখন ঠাণ্ডার প্রকোপ বলতে গেলে নেই নেই । নেমেই ছোটগিন্নি আকুলিবিকুলি করে ফুচকার লাইন পাকড়াও করার আব্দার পেশ করে ফেলতেই, আমরা কজনা এক ফুচকাওয়ালা কে পাকড়াও করলাম .... কি সাহস আমার ?? পেটের মধ্যস্থলে অবস্থিত চিড়ের জাস্ট ওপরে একখান শুখা ফুচকা চালান করলাম। পরের বায়নাক্কায় যুক্ত হল কাঠি আইসক্রিম .... সেদিকে না ভিড়ে আমি বায়নার আয়নায় একখান লাল টুপি বাগালাম। রেশমী চুড়ির প্রতি তেমন টান নেইকো আর বায়না না মিটলে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার চিরকালের ভরসা আমার ফর্সা হয়েছে অনেকদিন , কাজেই ও নেহাতই বেকার আমার কাছে । টুপি পরার পর দেখি ছোটদি যারপরনাই গম্ভীর !!! একবার বলেই ফেললে ... " বড়ো দেরি করছিস তোরা  !!! দেখার সময় কমে যাচ্ছে তো .... " 

অতঃপর টিম আগুয়ান হল । এবারের পথের বিপরীত পাশের বাগানের কিছু কিছু বিষয়ের দিকে ক্যামেরা তাক করে আরো খানিক সময় ব্যয়িত হল ... টিকিট কেটে বাগানে ঢুকতেই  নানান রঙের মুগ্ধতা ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের যেন অবস করে দিল । কন্যা তার বান্ধবীর সাথে সেঁটে ওদের সাথে ঘুরন্ত হল , এদিকের ফুলের বাহারে আমরা দুজনা আহারে বলে ক্যামেরা বাগিয়ে অপর দিকে হাঁটা দিলাম।  কন্যাকে নিয়ে চিন্তামণি হওয়ার কারণ নেই কারণ ওদিকে র দল যারপরনাই ভর ভরন্ত গার্জেন সমাগমে। আমরা নিজেদের মতন দলছুট হয়ে মুগ্ধ নয়ন মেলে একে অপরকে কম দেখে রঙের মেলায় নিজেদের মেলে ধরে মেলাই ছবি তুলতে লেগে পড়লাম। হঠাৎই দেখি এক নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান বিশাল লেন্স আর তার স্ট্যান্ডসহ স্যাণ্ডিংমোডে লেন্স তাক করে টিউলিপ রাশির ছবি বন্ধী করছেন ... সুযোগ মতন তেনাকে ধরে খান কতক যুগলের যুগলবন্দী ছবি তুলিয়ে নিলাম ... ধন্যবাদের পর্ব মিটতে না মিটতেই দলের বাকিরা ধরা দিল ... এবার দল , নির্দল ইত্যাদি প্রভৃতি ছবির লাইন লেগে গেল । পিচ পরিবার ও শ্বেত পরিবার সকলেই নানা অ্যাঙ্গেল থেকে চোখেচোখ , হাতে হাত , শুভদৃষ্টি পোস যেরকম যেরকম ছবিতে ধরা সম্ভব ( শোভনতার মাত্রাযুক্ত অবশ্যই) সব ধরতাই করে ফেললাম।  এক সময় আমাদের কুচোকাচা গণ ক্লান্ত হয়ে ভুঁয়ে বসে পড়েছিল ... বাবা - মা দের ছবি তোলার  অক্লান্ত উন্মাদনা তারা আর সইতে পারছিলো না । সব ছবি ক্যামেরা বন্দী করা যায় না , তা আর কে না জানে ... অগত্যা টিউলিপ দের বিদায় জানাতেই হল । বার বার পিছে ফিরে চাইতে চাইতে এক সময় দরজার ওপারে বেরিয়ে এলাম সবাই ... সবার শেষে অবশ্যই আমি । সুযোগ পেলে আরো একদিন সময় করে যেতাম । এখন সুযোগের অভাব চারপাশে । অগত্যা .... 

চোখের ক্ষুধার নিবারণের পর পৈটিক খিদে চাগিয়ে উঠল ... তবে আমরা সাবধানী।  ঘোরাঘুরির বাকি তখনও বেশ কিছু । সাবধান না হলে চলবে কেন ? অগত্যা আসার আগে ফুড ব্লগ থেকে দেখা কাশ্মীরি কুইজিন কে মনের ভিতরে চাপা দিয়ে রেখে , চেখে না দেখার ভাবনায় মনের কষ্ট মনে ঢেকে রেখে ম্যাগী আর চাউ ভাগযোগ করে হামলে পড়ে খাওয়া হল । তবে দিদি ইলেকট্রলের বাইরে চোখই রাখল না আর জামাই বাবু রুমালি রুটি খেলেন ভেজ কারি দিয়ে ।এই জন্যই তো আরেক কবি বলেছিলেন ... ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।

এরপরে দুখান বাগ বাগিচা দেখার কথা সাথে পবিত্র ভূমি হজরতবল মসজিদ। কিন্তু শেষমেষ কিছু বাদছাদ দিতেই হল .... সময় আর শরীর তখন বেশ ভিন্ন মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে । অগত্যা ..... ডাল লেকের সামনে অবস্থিত নিশাত বাগে হাজির হলাম । টিউলিপ বাগের ঘোরাঘুরির ফলে স্বপ্না কাকিমার কোমরের যাতনা তখন আর ঘোরাঘুরির পর্যায়ে নেই ... ব্যাথা কোমরে স্থির হয়ে ভয়ানক কষ্ট দিতে শুরু করেছে .. কাকিমা নামলেন না ... আমরা গোধূলি বেলায় নানা ফুলের ভরা , পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মুঘল গার্ডেন এর অন্যতম নিশাত বাগে ঢুকে পড়লাম । আমাদের দেশের রাজা , বাদশাহ দের সৌন্দর্য চর্চা তে আরো একবার মুগ্ধ হতে হতে ওপরে উঠে এলাম .... পিছনে পাহাড় বিপরীতে ডাল লেক ... ধাপে ধাপে সাত তলা এই বাগানের মাঝখান দিয়ে নামছে জলের ফোয়ারা .... একদম সামনে পাথরের বিশাল স্ল্যাবে বসার ব্যবস্থা । আমার কন্যা আর তার পিতাশ্রী সেই আসনে গদিওমান হলেন .... বললেন ... তোমরা ঘোরো , আমরা বসলাম  !!! জোরাজুরি আর জারিজুরি খাটবে না তা জানা সেই পথচলার শুরুর থেকেই ( যাতে মত মেলে তাতে তিনি আমার সাথ দেন 🤫) আর দিন রাতের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে তাই আমি ক্যামেরাসহ প্রায় ছুটতে শুরু করলাম।  হাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে এবং কাঁপিয়ে( শীত করতে শুরু করেছে তখন ) ছবি তুলে কিছুক্ষণ পরে ফেরত এলাম  .....  তেনারা তখনও নট নড়নচড়ন।  বলার উপায় নাই নাই ... এমনিতেই তেনার শরীর গতিক গোলমেলে ... একসাথে সব দেখতে পেরেই আমি যারপরনাই আনন্দিত তখন। এখানেও এক শখের ক্যামেরা পারসনের সহায়তায় খান কতক দোকা ছবি তুলিয়ে নিলাম । 

এবার ফেরার পালা হোটেল পানে । ফিরে একটু বিরতির পর টিম ১১ এর তিন খুদে আর একজনকে তাদের দেখভালে রেখে বাকিরা ডাল লেকের এ পারের ঢালাও মার্কেট চত্বরে নিজেদের মন প্রাণ ঢেলে দিলাম । স্বপ্না কাকিমাও কেনাকিনির নামে কেমন যেন ব্যথাশূল ভুলে বেরিয়ে পড়লেন । তারপর  ???? তার আর পর নেই  , নেই  কোন ঠিকানা । হারে রে রে জনতা আঁছড়ে পড়েছে ... যেদিকে তাকাই দেখি বাঙালির ঢল ... কিতনা দাম বোলা ? বহুত জাদা হো গয়া । কম করকে দিয়ে দো  না !!! এক দোকানিকে বলতে শুনলাম... " পুরা বাঙগাল উঠ কে আ গায়া " এক সময় মনে হল এ যেন বাঙালীর দ্বিতীয় ঘরবাড়ি পুরীর স্বর্গদ্বারের দোকানপাট ... যদিও এও আরেক স্বর্গ ... ভূস্বর্গ। কিনতে কিনতে আর তার থেকে বেশি দেখতে দেখতে আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম, এর মধ্যেই দুই ভায়রাভাই সাথের শেষ হয়ে যাওয়া চিড়ের খরিদারি করে ফিরে এল , কিন্তু ফেরার পথেই ছন্দপতনে যোগদান করলো স্বয়ং আমার জামাই বাবু । তুরন্ত জামাই বাবুকে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম ...  হোটেলের পাশেই ছিলাম আমরা । ঘরে ফিরে দেখা গেল যে ছোট্ট হিল্লোল বাদে বাকি তিনজন ঘুমন্ত ও ঝিমন্ত । যদিও খুদে সদস্য হিলুকে ঘুম পাড়ানোর জন্যেই তার বাবা বাকি দুই সেমি ছানা দিদিদের নিয়ে ঘরে ছিলেন ।

 সেই রাতে দিদিরা যুগলেই চিড়ে তে ভিড়ে গেল , এদিকে আমি একদিন পর ভাত ডালে ফেরত গেলাম সাথে অল্প ডিম ভুজিয়া ... তবে তা মুখে গুজিয়া দিতে বড়ই চিন্তার উদ্রেক হচ্ছিল  , তিনি অভয় দান করলেন । তো খেয়েই নিলাম । পরের দিন সকলের যাওয়ার কথা সোনমার্গ বা সোনামার্গ । কিন্তুক  সেখানেও গল্পের ঘনঘটা শুরু হল রাত থেকেই  .... 

@শুচিস্মিতাভদ্র

Saturday, 6 May 2023

বেড়াতেগিয়েমজারু ৩৬

গুলমার্গ থেকে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে , পেটে তখন সবারই বিধংসী ক্ষিদে। বিশেষ করে আমার তখন আকাশ খাই , পাতাল খাই অবস্থান কারণ সকালের শারীরিক গোলমাল ধামাচাপা দিয়েছিলাম দেবাশ্রিতার বানানো চিড়ে সেদ্ধ আর ইলেকট্রল সহযোগে । সে সব পেটের এক কোণায় থাকতে থাকতে হজম হয়ে মিলিয়ে গেছে বটে। আসার পথে নজর করে রাখা একখান হোটেলে আমাদের টিম ১১ ঝাঁপিয়ে পড়ল ... শরীর তখন বেশ গোলমালের মধ্যে থাকলে কি হবে ? হোটেলের বিপরীতে অবস্থিত পশরা সাজানো এম্পোরিয়াম মহিলাদের শরীরে গতির সঞ্চার করল। অপর দিকের ভদ্র মহোদয় গণ যেন কেমন মিইয়ে গেল আরো 🤔 । ঝটপট পাতিলেবু আর এক চামচে ডাল সহযোগে অল্প ভাত চটকে চটপট পেটে চালান করলাম, সাথের বাকিরাও হাল্কা কিছুতে পেট ভরালো ... কেনাকিনির আগাম ভয় ব্যকুলতায় নাকি (?) একসময় নজর করে দেখলাম তিনি হাল্কা ঘামতেছেন । গুরুত্ব না দিলেও পরে বুঝেছিলাম যে তেনার শারীরিক গোলযোগের সূত্রপাতের নোটিফিকেশন তখন আসতে শুরু করেছিল। তিনি এসব ব্যাপারে ভয়ানক চাপা , মাপা কথা বলার দরুণ শ্রীনগর পৌঁছনোর পর বুঝলাম যে শরীর গতিক গণ্ডোলার থেকে ল্যান্ড করার পর থেকেই বিরক্তির ঝাঁপ খুলেছিল । 

খাওয়ার পর সকল মহিলা কূল নিজেদের এম্পোরিয়ামে মেলে ধরলাম । লাগামধারী কর্তামশাই এর জন্য অল্প দেখে আর একখান ব্যাগ ব্যাগস্থ করে ওখানকার তল্পি গোটালাম। চক্ষু মুদিয়া বাসে আসন গ্রহণ করে এবার শ্রীনগর পানে ধেয়ে চললাম। এম্পোরিয়ামজাত উৎসাহে তখন ভাঁটার টান । 

শ্রীনগরের বুলেভার্ড রোডে , সেই স্বপ্নের ডাল লেকের ঘাট নম্বর ৬এর বিপরীতে অবস্থিত জম্মু কাশ্মীর টুরিসমের হোটেল হিমলে আণ্ডা বাচ্চা ও বাক্স প্যাটরাসহ ল্যান্ড করলাম। এরপরে ঘরে ঢুকেই কর্তা গিন্নি দুজনেই খাটিয়া পাকড়াও করলাম। কন্যা মনে খুশি আর মুখে দুঃখ নিয়ে পাশের ঘরে বন্ধুর সাথে যুক্ত হল । কন্যা মুক্ত আমরা অঘোরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম ... ঘুম ভাঙল রাত আটটা নাগাদ ডোরবেলের শব্দে । পাশের ঘরের জনতা আমার পুঁটি কে নিয়ে তখন হোটেলের বাইরে চলেছে খ্যাটনে ... আমরা যাওয়ার অবস্থান রহিত জেনে ওরা এগিয়ে পড়তেই ... পত্রপাট আবার আমরা বিছানা আকড়ালাম....কর্তামশাই এর তখন হি হি করে কাঁপুনির সাথে জ্বর হাজিরা দিচ্ছে ... স্বগোতক্তি শুনলাম .... "শরীর আগে । কাল বেরবো না ।" খাঁটি কথা । তবে আমি ছিলাম স্বভাব বিরুদ্ধ রকম আশাবাদী । দেবাশ্রিতা ফিরে এসে মেয়ে সহ এক গামলা চিড়ে সেদ্ধ ডিনার দিয়ে শুভ রাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল , তখনই শুনলাম ওদিককার ঘরে আমার দিদির শরীরে ও বিপদ সংকেত ধ্বনিত !!!! বোঝো কাণ্ড !!!! 

আমি চিরকালের পেট রোগা , তাই চিড়ে সেদ্ধ খাওয়ার সাথে আমার হরিহর আত্মার সম্পর্ক, কিন্তু তেনার তো চিড়ে সেদ্ধ দেখেই আত্মারাম আঁতকে উঠল .... বাবা বাছা করে খাওয়া পাট চুকলো , নড়বড় করতে করতে তিনি গড়বড়ে শরীর সারাতে ওষুধের প্যাটরা খুলে , ছড়িয়ে খান কতক ওষুধ গলধঃকরণ করে ঘুমাতে গেলেন .... আমিও অনুগামিনী হয়ে শুয়ে পড়লাম ... জ্বর তখন উত্তাপ বাড়াচ্ছে.... এদিকে আমাকে ঘামিয়ে দিচ্ছে চিন্তায় । এ জাতীয় বিষয়ে বেশি চিন্তা আমার আবার সহ্য হয় না !!! অগত্যা ঘুম দিয়ে নিষ্কৃতি পেলাম। সব রাতের শেষ আছে .... ভোরের দোর খুলল , বাবা ও কন্যা তখন ঘুমের ঘোরে , আমি উঠে খুচরো কাজে হাত লাগালাম । মনে আশা নিরাশার দোলচাল .... হেনকালে জাগন্ত হয়ে তিনি ঘোষণা করলেন .... " যেতে পারি , কিন্তু শঙ্করাচার্য মন্দিরের চড়াই চড়তে জোর করা চলবে না । " সম্মতি দিলাম ইতিবাচক দিকেই ... কিন্তু আবার এক আপদের উৎপাত চিতপাত করার তোড়জোড়ে এগিয়ে এল .... তেনার জ্বর গন ( gone ) হলে কি হবে , এবার শুরু হল পৈটিক গুলু গুলু 🤫😔😭 কোন দিকে যে কি সামলাবো ভেবেই খেই পাচ্ছিলাম না । কিন্তু খেই তো পেতেই হবে ভূস্বর্গ বলে কথা !!! অতএব চালাও চিড়ে (সেদ্ধ)ঢালাও । ছোটগিন্নি জানালে কলকাত্তাইয়া চিড়ে টিম টিম করছে । টিম ১১ তো টিমটিমে নয় আর সকাল বিকেল চিড়েতে ভিড়ে গেলে (সবাই নয় যদিও) তা তো ফুরুৎ হবেই। কর্তামশাই তখন খানিক কাঁপুনি মুক্ত.... অভয় দান করলেন সন্ধ্যাবেলায় চিড়ে মার্কেটিং এর ব্যপারে। প্রতিবার চিড়ে , মুড়ি আমাদের সাথে সাথে ঘুরে আবার ফেরত আসে কলকাতায় । এক দুবার বেড়ুর সময় আমার গেঁড়ির কাজে লাগলেও , এমন ভাবে ধাড়ি আর ধেড়ে দের ধরে ফেলেনি । এবার চিড়ে চড় চড় করে নিজের ডিমান্ড বাড়িয়ে , হারানো সম্মান ফিরে পেল । 

সেদিন মন্দির দর্শন করার পর বাগানে আগুয়ান হওয়ার কথা .... আসার আগে ছোটগিন্নি পোষাকের রঙ মিলন্তির প্ল্যানিং করে রেখেছিল। সকলে এক রঙে নিজেদের রাঙিয়ে বাগানে প্রবেশের আইডিয়া জম্পেশ হলে হবে কি ? সে রঙের বায়না মেটাতে আমার কর্তামশাই এর মুখে নানা রঙের খেলা শুরু হল ... গড়িহাটের এক দোকানের সামনে সেই রঙীন মুখ দেখে আমার রঙ উড়ে যাওয়ার উপক্রম !!! শেষমেশ নিদান দিল ছোটগিন্নি .... অন্ততপক্ষে এক এক পরিবার একই রঙে রাঙিয়ে নিও (পোশাক পোরো )। খরচের আপদ বালাই দূর হতেই তিনি ফুরফুরে মেজাজে আমাদের আর দিদিদের জন্য সাদা রঙ বাছাই করলেন .... বলতে নেই টিউলিপের রঙ বেরঙের নজরকাড়া বাগানে আমাদের সফেদ ( হাতি আমরা দুজনা বটে ) আর পিচ রঙা থিম হিট করে গেল ... ছবি তার প্রমাণ।  

যাক যে যার থিমের পোষাক পর চিড়ে ( আমরা আর দিদি-জামাই বাবু )খেয়ে আর এক বোতল ইলেকট্রল নিয়ে টিম ১১ মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম কপাল ঠুকে। টেম্পো ট্রাভেলার পাহাড়ী পথে খানিক এগিয়ে নামিয়ে দিলো , এরপরে যাত্রা অটুট রাখলো অটো তারপরে চেকিং বিরতি মিটিয়ে হন্টনের জন্য অসংখ্য সিঁড়ি দৃশ্যমান হল , কোমরের ব্যাথার দরুণ স্বপ্না কাকিমা মন্দিরের সিঁড়ির পথ ধরলেন না , রইলেন নীচে আমাদের ফেরার অপেক্ষায় । এ দিকে চিড়ে আর ইলেকট্রল সমৃদ্ধ আমার কর্তামশাই কে উৎসাহিত করার রেডিও তো অন্ করাই ছিল ... তিনি পিছু পিছু জিরিয়ে জিরিয়ে আগু পিছু করে এগিয়ে পড়লেন । এক যাত্রায় পৃথক ফল যখন আর পৃথক না রয়ে একে পর্যবসিত হল আমিও জোরালো পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগলাম ... আরেক কাকিমা ( দেবাশ্রিতার শ্বাশুড়ি মা) একবার বলেই ফেললেন ... ওমন করে ছুটে ছুটে উঠে , বলি হবেটা কি ?" ও যে আমার এক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তা আর বলি কেমনে ?? 

অবশেষে মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ করে সবাই সামনের বাঁধাই করা গাছের ঘেরাটোপের ওপর ধপাশ হয়ে দম নিলাম। দিদিরা সবার আগে পৌঁছে তখন দম পর্ব মিটিয়ে উঠে মূল মন্দিরের সিঁড়ির পাণে চেয়ে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ব্যক্ত করল ... " আরে ?? এই সিঁড়িতেই তো রাজেশ খান্না আর মুমতাজ এর লিপে সেই বিখ্যাত গানের কিছুটার দৃশ্যায়ন হয়েছে !!!! " জয় জয় শিব শঙ্কর " এ বারে উত্তেজনার পারা ঘুরে গেল অনিন্দ্য ওরফে ছোটকর্তার দিকে ... তৎক্ষণাৎ youtube থেকে গান বেরিয়ে পড়ল । এই বার দলের নায়ক ও নায়িকাগণ বয়স নির্বিশেষে সিঁড়িতে ছবি তোলার জন্য ভিড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠল ... একা , দোকা , তেকা , দলবদ্ধ , ঘন্টাধারী ও ঘন্টা ছাড়ি রকম বেরকম পোসে। তবে সিঁড়ির লাগাতার ভিড়ের জন্য এসবের জন্য কিঞ্চিত অপেক্ষা করতে হল । সেই অপেক্ষার সময়ে মন্দির চত্বর, আরো সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ , আদি গুরু শঙ্করাচার্যের মূর্তি , ওপর থেকে পাখির চোখে গোটা শ্রীনগরের দর্শন সব কমপিলিট করলাম । সময়ের দাম না দিলে কি চলে নাকি ?? ছবি হল আগের দিন ওই একই গানের বাকি অংশের দৃশ্যায়ন সমৃদ্ধ আরেক মন্দির ও সংলগ্ন উপত্যকা দেখেছি গুলমার্গের হোটেল রুম থেকে ... তা ধরেছি মনের ও জাগতিক ক্যামেরাতে কিন্তু সে মন্দির ধরতাই এর সীমানা তে ছিল না সময়জনিত কারণে । এখানে সে আক্ষেপে ফুলস্টপ দিলাম । এরপরে দুই রঙে রঙিন থিম পরিবার এগিয়ে পড়লাম জগত বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেনের ডেরায় ।

ক্রমশঃ

@শুচিস্মিতাভদ্র


গুলমার্গ থেকে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে , পেটে তখন সবারই বিধংসী ক্ষিদে। বিশেষ করে আমার তখন আকাশ খাই , পাতাল খাই অবস্থান কারণ সকালের শারীরিক গোলমাল ধামাচাপা দিয়েছিলাম দেবাশ্রিতার বানানো চিড়ে সেদ্ধ আর ইলেকট্রল সহযোগে । সে সব পেটের এক কোণায় থাকতে থাকতে হজম হয়ে মিলিয়ে গেছে বটে। আসার পথে নজর করে রাখা একখান হোটেলে আমাদের টিম ১১ ঝাঁপিয়ে পড়ল ... শরীর তখন বেশ গোলমালের মধ্যে থাকলে কি হবে ? হোটেলের বিপরীতে অবস্থিত পশরা সাজানো এম্পোরিয়াম মহিলাদের শরীরে গতির সঞ্চার করল। অপর দিকের ভদ্র মহোদয় গণ যেন কেমন মিইয়ে গেল আরো 🤔 । ঝটপট পাতিলেবু আর এক চামচে ডাল সহযোগে অল্প ভাত চটকে চটপট পেটে চালান করলাম, সাথের বাকিরাও হাল্কা কিছুতে পেট ভরালো ... কেনাকিনির আগাম ভয় ব্যকুলতায় নাকি (?) একসময় নজর করে দেখলাম তিনি হাল্কা ঘামতেছেন । গুরুত্ব না দিলেও পরে বুঝেছিলাম যে তেনার শারীরিক গোলযোগের সূত্রপাতের  নোটিফিকেশন তখন আসতে শুরু করেছিল। তিনি এসব ব্যাপারে ভয়ানক চাপা , মাপা কথা বলার দরুণ শ্রীনগর পৌঁছনোর পর বুঝলাম যে শরীর গতিক গণ্ডোলার থেকে ল্যান্ড করার পর থেকেই বিরক্তির ঝাঁপ খুলেছিল । 

খাওয়ার পর সকল মহিলা কূল নিজেদের এম্পোরিয়ামে মেলে ধরলাম । লাগামধারী কর্তামশাই এর জন্য অল্প দেখে আর একখান ব্যাগ ব্যাগস্থ করে ওখানকার তল্পি গোটালাম। চক্ষু মুদিয়া বাসে আসন গ্রহণ করে এবার শ্রীনগর পানে ধেয়ে চললাম। এম্পোরিয়ামজাত উৎসাহে তখন ভাঁটার টান । 

শ্রীনগরের বুলেভার্ড রোডে , সেই স্বপ্নের ডাল লেকের ঘাট নম্বর ৬এর বিপরীতে অবস্থিত জম্মু কাশ্মীর টুরিসমের হোটেল হিমলে আণ্ডা বাচ্চা ও বাক্স প্যাটরাসহ ল্যান্ড করলাম। এরপরে ঘরে ঢুকেই কর্তা গিন্নি দুজনেই খাটিয়া পাকড়াও করলাম। কন্যা মনে খুশি আর মুখে দুঃখ নিয়ে পাশের ঘরে বন্ধুর সাথে যুক্ত হল । কন্যা মুক্ত আমরা অঘোরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম ... ঘুম ভাঙল রাত আটটা নাগাদ ডোরবেলের শব্দে । পাশের ঘরের জনতা আমার পুঁটি কে নিয়ে তখন হোটেলের বাইরে চলেছে খ্যাটনে ... আমরা যাওয়ার অবস্থান রহিত জেনে ওরা এগিয়ে পড়তেই ... পত্রপাট আবার আমরা বিছানা আকড়ালাম....কর্তামশাই এর তখন হি হি করে কাঁপুনির সাথে জ্বর হাজিরা দিচ্ছে ... স্বগোতক্তি শুনলাম .... "শরীর আগে । কাল বেরবো না ।"  খাঁটি কথা । তবে আমি ছিলাম স্বভাব বিরুদ্ধ রকম আশাবাদী । দেবাশ্রিতা ফিরে এসে মেয়ে সহ এক গামলা চিড়ে সেদ্ধ ডিনার দিয়ে শুভ রাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল  , তখনই শুনলাম ওদিককার ঘরে আমার দিদির শরীরে ও বিপদ সংকেত ধ্বনিত  !!!! বোঝো কাণ্ড  !!!! 

আমি চিরকালের পেট রোগা , তাই চিড়ে সেদ্ধ খাওয়ার সাথে আমার হরিহর আত্মার সম্পর্ক, কিন্তু তেনার তো চিড়ে সেদ্ধ দেখেই আত্মারাম আঁতকে উঠল .... বাবা বাছা করে খাওয়া পাট চুকলো  , নড়বড় করতে করতে তিনি গড়বড়ে শরীর সারাতে ওষুধের প্যাটরা খুলে , ছড়িয়ে খান কতক ওষুধ গলধঃকরণ করে ঘুমাতে গেলেন .... আমিও অনুগামিনী হয়ে শুয়ে পড়লাম ... জ্বর তখন উত্তাপ বাড়াচ্ছে.... এদিকে আমাকে ঘামিয়ে দিচ্ছে চিন্তায় । এ জাতীয় বিষয়ে বেশি চিন্তা আমার আবার সহ্য হয় না !!! অগত্যা ঘুম দিয়ে নিষ্কৃতি পেলাম। সব রাতের শেষ আছে  .... ভোরের দোর খুলল , বাবা ও কন্যা তখন ঘুমের ঘোরে , আমি উঠে  খুচরো কাজে হাত লাগালাম । মনে আশা নিরাশার দোলচাল .... হেনকালে জাগন্ত হয়ে তিনি ঘোষণা করলেন .... " যেতে পারি , কিন্তু শঙ্করাচার্য মন্দিরের চড়াই চড়তে জোর করা চলবে না । " সম্মতি দিলাম ইতিবাচক দিকেই ... কিন্তু আবার এক আপদের উৎপাত চিতপাত করার তোড়জোড়ে এগিয়ে এল .... তেনার জ্বর গন ( gone ) হলে কি হবে , এবার শুরু হল পৈটিক গুলু গুলু 🤫😔😭 কোন দিকে যে কি সামলাবো ভেবেই খেই পাচ্ছিলাম না । কিন্তু খেই তো পেতেই হবে ভূস্বর্গ বলে কথা !!! অতএব চালাও চিড়ে (সেদ্ধ)ঢালাও । ছোটগিন্নি জানালে কলকাত্তাইয়া চিড়ে টিম টিম করছে । টিম ১১ তো টিমটিমে নয় আর সকাল বিকেল চিড়েতে ভিড়ে গেলে (সবাই নয় যদিও) তা তো ফুরুৎ হবেই। কর্তামশাই তখন খানিক কাঁপুনি মুক্ত.... অভয় দান করলেন  সন্ধ্যাবেলায় চিড়ে মার্কেটিং এর ব্যপারে। প্রতিবার চিড়ে , মুড়ি আমাদের সাথে সাথে ঘুরে আবার ফেরত আসে কলকাতায় । এক দুবার বেড়ুর সময় আমার গেঁড়ির কাজে লাগলেও , এমন ভাবে ধাড়ি আর ধেড়ে দের ধরে ফেলেনি । এবার চিড়ে চড় চড় করে নিজের ডিমান্ড বাড়িয়ে , হারানো সম্মান ফিরে পেল । 

সেদিন মন্দির দর্শন করার পর বাগানে আগুয়ান হওয়ার কথা .... আসার আগে ছোটগিন্নি পোষাকের রঙ মিলন্তির প্ল্যানিং করে রেখেছিল। সকলে এক রঙে নিজেদের রাঙিয়ে বাগানে প্রবেশের আইডিয়া জম্পেশ হলে হবে কি ? সে রঙের বায়না মেটাতে আমার কর্তামশাই এর মুখে নানা রঙের খেলা শুরু হল ... গড়িহাটের এক দোকানের সামনে সেই রঙীন মুখ দেখে আমার রঙ উড়ে যাওয়ার উপক্রম !!! শেষমেশ নিদান দিল ছোটগিন্নি .... অন্ততপক্ষে এক এক পরিবার একই রঙে রাঙিয়ে নিও (পোশাক পোরো )। খরচের আপদ বালাই দূর হতেই তিনি ফুরফুরে মেজাজে আমাদের আর দিদিদের জন্য সাদা রঙ বাছাই করলেন .... বলতে নেই টিউলিপের রঙ বেরঙের নজরকাড়া বাগানে আমাদের সফেদ ( হাতি আমরা দুজনা বটে ) আর পিচ রঙা থিম হিট করে গেল ... ছবি তার প্রমাণ।  

যাক যে যার থিমের পোষাক পর চিড়ে ( আমরা আর দিদি-জামাই বাবু )খেয়ে আর এক বোতল ইলেকট্রল নিয়ে টিম ১১ মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম কপাল ঠুকে।  টেম্পো ট্রাভেলার পাহাড়ী পথে খানিক এগিয়ে নামিয়ে দিলো , এরপরে যাত্রা অটুট রাখলো অটো তারপরে চেকিং বিরতি মিটিয়ে হন্টনের জন্য অসংখ্য সিঁড়ি দৃশ্যমান হল , কোমরের ব্যাথার দরুণ স্বপ্না কাকিমা মন্দিরের সিঁড়ির পথ ধরলেন না , রইলেন নীচে আমাদের ফেরার অপেক্ষায় । এ দিকে চিড়ে আর ইলেকট্রল সমৃদ্ধ আমার কর্তামশাই কে উৎসাহিত করার রেডিও তো অন্ করাই ছিল ...  তিনি পিছু পিছু জিরিয়ে জিরিয়ে আগু পিছু করে এগিয়ে পড়লেন । এক যাত্রায় পৃথক ফল যখন আর পৃথক না রয়ে  একে পর্যবসিত হল আমিও জোরালো পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগলাম ... আরেক কাকিমা ( দেবাশ্রিতার শ্বাশুড়ি মা) একবার বলেই ফেললেন ... ওমন করে ছুটে ছুটে উঠে , বলি হবেটা কি ?" ও যে আমার এক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তা আর বলি কেমনে ?? 

অবশেষে মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ করে সবাই সামনের বাঁধাই করা গাছের ঘেরাটোপের ওপর ধপাশ হয়ে দম নিলাম। দিদিরা সবার আগে পৌঁছে তখন দম পর্ব মিটিয়ে উঠে মূল মন্দিরের সিঁড়ির পাণে চেয়ে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ব্যক্ত করল ...  " আরে ?? এই সিঁড়িতেই তো রাজেশ খান্না আর মুমতাজ এর লিপে সেই বিখ্যাত গানের কিছুটার দৃশ্যায়ন হয়েছে !!!! " জয় জয় শিব শঙ্কর " এ বারে উত্তেজনার পারা ঘুরে গেল অনিন্দ্য ওরফে ছোটকর্তার দিকে ... তৎক্ষণাৎ youtube থেকে গান বেরিয়ে পড়ল । এই বার দলের নায়ক ও নায়িকাগণ বয়স নির্বিশেষে সিঁড়িতে ছবি তোলার জন্য ভিড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠল ... একা , দোকা , তেকা , দলবদ্ধ , ঘন্টাধারী ও ঘন্টা ছাড়ি রকম বেরকম পোসে।  তবে সিঁড়ির লাগাতার ভিড়ের জন্য এসবের জন্য কিঞ্চিত অপেক্ষা করতে হল । সেই অপেক্ষার সময়ে মন্দির চত্বর, আরো সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ , আদি গুরু শঙ্করাচার্যের মূর্তি , ওপর থেকে পাখির চোখে গোটা শ্রীনগরের দর্শন সব কমপিলিট করলাম । সময়ের দাম না দিলে কি চলে নাকি ?? ছবি হল আগের দিন ওই একই গানের বাকি অংশের দৃশ্যায়ন সমৃদ্ধ আরেক মন্দির ও সংলগ্ন উপত্যকা দেখেছি গুলমার্গের হোটেল রুম থেকে ... তা ধরেছি মনের ও জাগতিক ক্যামেরাতে কিন্তু সে মন্দির ধরতাই এর সীমানা তে ছিল না সময়জনিত কারণে । এখানে সে আক্ষেপে ফুলস্টপ দিলাম । এরপরে দুই রঙে রঙিন থিম পরিবার এগিয়ে পড়লাম জগত বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেনের ডেরায় ।

@শুচিস্মিতাভদ্র

Wednesday, 3 May 2023

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৫

গুলমার্গের হোটেল পৌঁছনোর পর একে একে অনেকেই কাত হল । সে রাতের মতন কেউ কেউ মুড়ি চিড়ের ওপর থাকল , কেউ পেটে কিল মেরে দরজায় খিল দিলো , আমার শরীর কাত হবো হবো করলেও খেতে বড় ভালবাসি , তাই  ও কিছু হবে না ভেবে রাতে  হোটেলের ডাইনিংহলে গিয়ে অল্প করে ভেজ ও নন ভেজ পেটে চালান করলাম .... রাতের ঠাণ্ডার মাঝে গরম ব্ল্যাঙ্কেটের ওমে হারিয়ে গেলেও ভোর রাতে মা - মেয়ে দুজনেই একে একে বাথরুম মুখী হলাম .... এরপর আপদ বালাই বাড়তেই লাগল ... এক দিকে পেটুতে গোল অন্য দিকে কর্তামশাই এর কলরোল ... পেট গুলু গুলু সাথে বকুনির ঠ্যালায় বুক দুরুদুরু অবস্থায় খান ৩/৪ রঙ বেরঙের ওষুধ খেয়ে আমি কন্যাসহ ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় লুকিয়ে পড়লাম।  এ দিকে আগের রাতে যারা পেটে কিল মেরে নিদ্রামগ্ন হয়েছিল ... তেনারা হাজির হয়ে অনেক উপদেশ দিয়ে গেলেন । কারণ তেনারা তখন যারপরনাই ফিট। তাদের না খেয়ে থাকা হিট করে গেছে । এমতাবস্থায় মুখে কুলুপ আঁটাই দস্তুর....। হেনকালে তিনি  ঘোষণা করলেন ... " যেতে হলে চলো , না হলে হোটেলেই থাকো" 

কাভি নেহী .... রেগে গেলে বাঙালি সব ভাষা বলতে পারে , আর রাষ্ট্র ভাষা কে না জানে ? উঠে পড়লাম, মানে উঠতেই হল । মনে পড়ল প্রবচন ... পড়েছ যবনের হাতে , খানা খেতে হবে সাথে । আর একটু কষ্ট হলেও যেতে নিশ্চয় পারব ... পরে কি হয় তখন দেখে নিলে হবে ... এর মধ্যেই ছোটগিন্নি চিড়ে সেদ্ধ বানিয়ে দিয়ে গেল , ওদিকের কজনাও (সবাই  নয় )চিড়ে খেয়ে রেডি স্টেডি গো মোডে চলে গেছে । আমরাও গুটি গুটি সব গুটিয়ে , নিজেদের গুলমার্গের কেবলকার ওরফে গণ্ডোলা রাইডের পথ ধরে ফেললাম। গুটিয়ে নিতে হল এ জন্যই ফেরার পরই ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ার আগাম ব্যবস্থা হয়ে আছে ।

প্রথম গেলাম স্নোবুটের ঠেকে।  ওরে বাপ !! সেই বুট পরে হাঁটতেই নিজেকে ইয়েতির মতন মনে হল । যাক , দেখলাম সকলেই পরে নিয়েছে ... আরো খানিক গাড়ি করে এগোতেই গণ্ডোলার লম্বা লাইনের অলি গলি চলি তে  চালু হয়ে সিঁধিয়ে গেলাম । আমার কর্তামশাই এর আবার বদ্ধতার ব্যরাম আছে ... ওই জন সমুদ্র দেখেই তিনি কেমনতর ফ্যাকাসে পাণা হয়ে একখান চেয়ার পাকড়াও করে বসে পড়লেন , সাথের গাইড ( নেওয়া হয়েছিল , পরে দেখি লাভ বিশেষ হয় নাই তাকে নিয়ে )এ ব্যাপারে তাকে সাহস জুগিয়ে আকাশে মানে গণ্ডোলায় তুলে দিল । তোলার আগের চার প্রস্থ ঘুরপাক খেয়ে আরো লাইনের আইন মেনে তবে কেষ্ট র থুড়ি গণ্ডোলার দেখা মিলল । তাতে উঠে নিজেদের ফিট করে নিলাম, কেবলকারে কেবল বসার বিধান দেওয়া আছে ... ছবি তোলার জন্য আমার দিদি আকুলি বিকুলি করে উঠে পড়ে ঘুরে মোবাইল তাক করতে যেতেই আমরা তেনারে থামিয়ে দিলাম।  সামনে , পাশে ও নীচে  সাদা বরফের চাদরের মাঝে মাঝে দাঁড়ানো পাইনের পাশ দিয়ে চলেছিলাম ঝুলতে ঝুলতে । শরীর নানা গোলোযোগের কথা অল্প জানান দিলেও প্রকৃতি সব আস্তে আস্তে ভুলিয়ে দিচ্ছিল । নীচে মাঝে মাঝে বরফের মধ্যে সেনা ছাউনি (সম্ভবত) দেখতে পাচ্ছিলাম । দূর থেকে বোঝার উপায় নেই । অবশেষে ফেস ওয়ানে এসে নামলাম .... দেখলাম মেলাই জনতা । তারমধ্যে চলেছে ভয়ানক বিকিকিনি...যেমন চলছে আদরে করে চাদর / শাল দেখানো তেমন কাহওয়া পানের অনুরোধ আর সর্বোপরি স্লেজ/ স্ক্যাটিং/ স্নো স্কুটার চড়ার অনুরোধ সহ ব্যাখান। মানতেই হয়েছে তেনাকে আমার থেকেও ঘ্যানঘ্যানে মানুষ পৃথিবী থুড়ি দেশেই আছে। আমি তো শিশু !! কিছু কেনার বায়না ক দিন ঘ্যানোর ঘ্যানোর করেই ক্ষান্ত দিই। এদের সময় কম হাতে ... তাই এই ব্যাপারে পরিশ্রম লাগাতার ... লে লিজিয়ে না , স্লেজ পে রাইড কিজিয়ে না , কাহওয়া পিজিয়ে না , স্ক্যাটিং কিজিয়ে না , আগর ডর লাগে তো সির্ফ খড়ে হো কর ফোটো লে লিজিয়ে না 🙏🏻 মাথা র পুরো পাগলা কন্ডিশন হয়ে গিয়েছিল। 

আমাদের ছোটগিন্নি ২য় ফেজের দিকে রওনা হল , আমার ইচ্ছাপূরণ হল না । দুই ভায়রাভাই একজোট হয়ে আমাদের দুই দিদি আর বোনকে যেতে দিলেন না ।  ওপরে যদি কেবলকারে গোলযোগ হয় !!! কথা হল ঝুলন্ত কেবলকারে এ পর্যন্ত আসার ব্যাপারেও একই রকম ভাবনার  সম্ভাবনা ভাগ্যিস মাথায় উঁকি দেয়নি । দিলে খুব মুশকিল হতো , গুলমার্গ দেখাই হতো না । ছোট ভায়রাভাই বড়জনের মাথায় যেই ঢুকিয়ে দিল খোদ কলকাতায় বসে যে ওতো ওপরে কিছু সমস্যা ঘটলেও ঘটতে পারে বটে .... তখন ???? আমার জামাই বাবুও এক বাক্যে বিধান দিলেন ... আমি আমার বৌকে যেতে নাহি দিব । এদিকে আমার জন এক কাঠি এগিয়ে বলে কিনা ... তুমি ওদের সাথে গেলে যাও , মেয়ে কে ছাড়ব না আমি । এ কেমনতর কথা বটে ? রাগ করে ঘ্যান ঘ্যানানি তে ইতি দিলাম। উৎসাহই পেলাম না । মাঝখান থেকে পাহাড়ের মাথায় ওঠা হল না , এমনিতেও কারোর মাথায় ওঠার সুযোগ পাইনি , পাহাড়ের ক্ষেত্রেও সে সুযোগে বঞ্চিত হলাম ।

ছোটগিন্নিও তার ছোটছানা নিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠতে গেল ছোটকর্তা সহ আর এদিকে আমরা ফেজ ওয়ান আলো করে সব রকমের অপসনের ( স্লেজ / পানীয় / স্কুটার / স্ক্যাটিং ) ঝাড়াই বাছাই করে শেষমেষ স্লেজ চেপে বসলাম ... কর্তামশাই গেলেন না কজনার সাথে রয়ে গেলেন।  আমি কন্যাসহ, দিদি , জামাই বাবু স্লেজ বিলাসী হলাম । একটু কসরত করে দড়ি চেপে খানিক গেলাম , ছবির পর্ব চুকিয়ে স্লেজ চালককে পাকড়ে ধরে এদিক ওদিক ঘুরে ফেরত এলাম । কর্তামশাই এর মেজাজখান দেখলাম অতো ঠাণ্ডার মধ্যেও বিশেষ সুবিধার নয় ... যাক এরপরে সব মিটিয়ে শারীরিক কষ্ট চেপে চুপে হোটেল ফিরলাম।  সেদিনই পরের গন্তব্যে রওনার বায়নাক্কা আছে । ফিরে দেখি আমাদের পাহাড় প্রমাণ লটবহর আগের কথা মতন রিসেপশন আলো করে আমাদের জন্য অপেক্ষা রত । কি আর করা অনেক অনুরোধেও বিশ্রাম ও দ্বিপ্রাহরিক আহার যখন মেলা ভার বোঝা গেল ... ( রোজা চলছিল সব কর্মী উপস্থিত ছিল না ... বদল ডিইটিরত) তখন মানে মানে তল্পি গুটিয়ে সরে পড়লাম সাথের টেম্পো ট্রাভেলার এসে পড়ার পর ।

@শুচিস্মিতাভদ্র

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৪

কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেই পাইনাস রিসর্টে পৌঁছলাম।  মূল পথ থেকে পাহাড়ী পথের খানিকটা হেঁটে উঠেই হেঁপোরাম হয়ে গেলাম ... ছোট্ট বাগান ঘেরা দুখান দোতলা কটেজের একখানা জুড়ে আমাদের দলের সকলের জন্য বরাদ্দ করেছেন আমাদেরসুমিত দা । কন্যার বান্ধবীর পিতাশ্রী সাদর অভ্যর্থনা জানালেন , শুনলাম বাকিরা গরমাগরম ইলেকট্রিকাল ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় ঘুমন্ত। দিদিরা নিচে রইল আমরা লটবহর সহ ওপরের একখান ঘরের দখল নিলাম। খানিক কাঁপাকাঁপি করে গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম । এরপর দলের যারা যারা পরস্পর অপরিচিত ছিলাম ... আলাপচারিতা সেরে নিলাম। এসবের মাঝেই রাতের খাবার এসে গেল । দল বেঁধে খাওয়ার পর সবাই দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাবার আগে পরের দিনের ঘুরপাক এর লিস্টি রেডি করে ফেললাম। বাইরে তখনও ঝমাঝম বৃষ্টির কনসার্ট চলছিল ।

বেড়ানোর সময়েও অভ্যাস বশে ঘুম ভাঙল ভোরে , তখন পুরোটাই অন্ধকার ঘুমপুরী । ঘুম জাগরণের মাঝেই একে একে সবাই জাগন্ত হল । আলো ফুটতে দেখা গেল আসে বরফ , পাশে বরফ । বরফ পড়েছে তো !!  সকাল সকাল স্নানের পাট না চোকালে উষ্ণ মণ্ডলের মানুষজনের আবার সমস্যাই সমস্যা । সে সব মেটানোর খবরে আমাদের ছোটগিন্নিও উৎসাহিত হয়ে সজল এলো চুলে জলখাবারের টেবিলে হাজির হলেন বাকি সব ঘরের খুচরো দায় দায়িত্ব সামলে নিয়ে । 

আণ্ডা বাচ্চা সহ সকলে ভিগি ভিগি আবহাওয়ায় দুখান গাড়ি ভাড়া ( হোটেল থেকে সিন্ডিকেট মারফত) করে বেরিয়ে পড়লাম, চললাম আরুভ্যালির দিকে । রাস্তার পাকদণ্ডী আমাদের নর্থবেঙ্গলের ধারে কাছেও আসেনা। সুন্দর পথ , কিন্তুক সকালের জলখাবারের কাঁচা পাউরুটি এবার শরীরে পাক মারতে শুরু করল। কন্যার এই পাকের ব্যপার টা পাকাপোক্ত, এবার সাথে আমিও যোগ দিলাম।  কন্যার বান্ধবী আহেরীও পো ধরে ফেলল। এ সব পাকের মাঝেই দেখি ভ্যালি ভেলকি দেখিয়ে হাজির .... এক পাল ভ্রমণার্থী, যার অধিকাংশই বাঙালি , অসংখ্য ঘোড়া , বৃষ্টি , ঠাণ্ডা হাওয়ার এবং সর্বোপরি কাদা মাখা পথে অবতীর্ণ হলাম । বলতে নেই , কনকনে হাওয়াতে শারীরিক কষ্ট সাময়িক হাওয়া হল । তবে ছাতা ব্যাগ আর ক্যামেরা সামলে আমি নাজেহাল।  আমাকে সামলাতে দিদি , জামাই বাবুকে ফিট করে দিল । মাথায় ছাতা ধরে ছবি তোলায় অ্যাসিস্ট্যান্ট হল জামাই বাবু। আমার কর্তামশাই প্রতিবারের মতন ছানাদের দেখভাল করতে করতে এগিয়ে গেল । 

আমার পরিচিত এক ক্যামেরা বিশেষজ্ঞের গাইডলাইন মেনে ছবি তোলা শেষ হতেই আমার জ্যাকেটের মধ্যেই ক্যামেরা চালান করছিলাম প্রতিবার । এই ঠাণ্ডায় তাকেও গরম রাখা জরুরি ... তার দরুণ  আমার অবয়বখান খোলতাই হয়েছিল .... জামাই বাবু এক সময় বলেও ফেললেন ... "তোর কি সাহস রে শিল্পী  !!! এই অবস্থায় ঘুরতে এসেছিস ? " শুনে সকলের কি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি রে বাবা  !!!!  

আরুভ্যালির বৃষ্টি , কনকনে হাওয়ার ঝাপটা , কাদা কাদা পথ সব ভাল লাগাতে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল । আমার কর্তামশাই যথারীতি তার ছানা সামলে আগুয়ান হয়েছিলেন । অগত্যা দিদি আমার ছবি তোলার সহকারী হিসাবে জামাই বাবুকে ফিট করে দেয় , সহকারী এ কারণেই বলছি ... কারণ বৃষ্টিপাতের জন্য ছাতা সামলে ক্যামেরা তাক করতে পারছিলাম না .... কি বিপদ । শেষমেষ জামাই বাবু ছত্রপতি হলেন , কিছু ছবিও তোলা হল মিলিয়ে জুলিয়ে ক্যামেরায় ও মোবাইলে । কিন্তুক এ সবের মধ্যেই স্বপ্না কাকিমার পা পিছলে পড়ে যাওয়া এক বিরাট ছন্দ পতন । ব্যাথা যন্ত্রণার দরুণ বেড়ু একশ শতাংশ সম্ভব হল না । তবে কাকিমার সহ্য ক্ষমতা অসীম ... ফিরে যখন এক্সরে রিপোর্ট হাতে এল , সকলের চোখ কপালে ... compression fracture। কাকিমা আপাতত কন্যার বাড়িতে কমপ্লিট বেড রেস্টে।  কিন্তু কিছু কিছু চড়াই উতরাই বাদে কাকিমার অসীম সহ্য শক্তির পরিচয় আমাদের বিস্মিত করেছে বার বার । 

আরুভ্যালি থেকে ফেরার পথে খানিক ধুমায়িত চা পান করার পর ... আকাশ খানিক ফর্সা হয়ে ভরসা জোগালো । এগিয়ে পড়লাম চন্দনওয়াড়ির দিকে ... যেখান থেকে তীর্থ যাত্রীদের অমরনাথ যাত্রা শুরু হয় । উচ্চতার সাথে সাথে বরফের প্রকোপ বাড়ছিল , পথের দুপাশে । এদিকে আমার শরীরে তখন  আবার পাকাপোক্ত পাক মারা শুরু হয়েছে ... জামাইবাবু পরিবেশ হাল্কা রাখতে বলেই চলেছেন ... এই অবস্থায় তো ওমন হয়েই থাকে । সেদিনের পর ক্যামেরা ব্যাটাকে ব্যাগে রেখেছি জ্যাকেটের পেটে রাখিনি ... নিজে গরম থেকে আমাকেও ঘামিয়ে দিচ্ছিল পাক মেরে !!! 

পথের ধারে এক জায়গাতে পাগল পারা লোকজন দেখতে পেলাম ... কারণ তখন তুষারপাত শুরু হয়েছে । গাড়ি থামতেই কারা তেড়ে এসে না নামার আদেশ দিলেও ড্রাইভার দাদা ইঙ্গিতে নামতে বললেন । কে সত্যি আর কে মিথ্যা কথার পশরা সাজিয়ে পরিবেশন করল বোঝা দুষ্কর... বাধা দানের কারণ আমাদের ড্রাইভার অনেক আগে নামিয়েই চন্দনওয়াড়ি পৌঁছনোর গল্প বলছে , এদিকে ড্রাইভারের বয়ান ... এই আসল চন্দনওয়াড়ি । এই চাপানউতোরের মাঝে তুষারপাতের আনাবিল আনন্দ একটু হলেও হাল্কা হয়ে গেল ... কারণ বাধাদানকারীরা মরিয়া ... আমাদের ওখানে থাকতেই দেবে না । একেই আমরা অজানা রাজ্যে , তায় কাশ্মীরে কাজে কাজেই মিনিট দশকের মধ্যেই মানে মানে সরে পড়লাম ... ফেরার পথে পাহাড়ী পথের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ই অনেক উঁচু থেকে দেখলাম বেতাব ভ্যালি । সেই বিখ্যাত মুভি র দৃশ্যায়ন সমৃদ্ধ। তবে নীচে নামতে কেউ ই রাজী হলাম না , বিশেষত আমার কন্যা তখন হোটেলে ফিরতে বেতাব । শরীরের ভিতর তার তখন বেশ হৈ চৈ চলছে । আমারও খানিক খানিক একই অবস্থান।  ফিরতি পথে মুঘল দরবারে খাবার খাওয়ার ওপরে তখন তালা পড়ে গেছে ... সেই তালা বন্ধই থাকল সারা বেরুতে । ওখানকার খাবার খেতে আবার যেতে হবে ... যা দেখা গেল শেষমেষ ।

ফেরার পর আকাশে ও সবার মুখের মেঘ কেটে আলোর ঝলমলানি ফেরত এলো । খানিক পরে হোটেলেই আমাদের মনের মতন হাল্কা খাবারের পাত পড়ল, সে সব পর্ব মিটিয়ে সবে গরমাগরম ইলেকট্রিকাল ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে লম্বা হবো ভাবতেই দিদি গর্জে উঠল ..."  এখানে কি  শুতে এসেছিস ? চল লিডার  নদীর ধারে " সাথে আমাদের ছোটগিন্নিরও জল ছুঁই ছুঁই ইচ্ছে চাগিয়ে উঠল ... সে তো আসার আগেই কল্পনার রঙে লীডারের পারে হাঁটা র স্বপ্নে বিভোর ছিল তাও আবার কনকনে রাতে , পাহাড়ী নদীর কলকলানি সহ ... সে স্বপ্ন তো আগের রাতের বৃষ্টিপাতে ভিজে জাব হয়ে গেছে । কাজেই সে  তুরন্ত ছোট্ট জনকে মায়ের জিম্মা করে রেডি স্টেডি গো হল ... দুই দিদার কাছে দুই ঘুমন্ত আর এক জাগন্ত ছানাকে রেখে আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে সোজা লিডার নদীর ধারে এলাম । কিন্তু আকাশ তখন আবার মুখ ভার করতে করতে ভ্যাক করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল আর আমরাও খান চারেক ছাতার মাঝে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করতে করতে আর আধা ভিজতে ভিজতে হোটেলের দিকে মুখ ফেরালাম ... ফিরতেই হল । 

ফিরে দেখি সব আঁধার হয়ে আছে । পাওয়ার কাট .... আমরা নীচের হলে ছড়িয়ে বসে হাপ ছাড়লাম । বাইরে তখন বৃষ্টির বাড় বাড়ন্ত। হেনকালে গপ্পো জমাট বাঁধার মুখেই আলো হাজির হল , সাথে চায়ে গরম !!! আগের রাতের আলোচনায় আমরা দুই গিন্নি ঘোড়ায় চেপে বৈশারণ যাওয়ার বায়না ধরলেও এদিকের কর্তামশাই তা একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছিলেন ... আগাম বন্ধু / প্রতিবেশি মারফত কিছু ভয়ানক বিবরণ শুনে । আমি আবার সম্পূর্ণ অনুকূল বিবরণ পেলেও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে ওদিকের ইচ্ছে চাপা দিয়েছিলাম তবে সেদিন সকালের ঘুরুর সময়ের বৃষ্টি আর তারপরে স্লিম ট্রিম ঘোড়া দেখে মন বলল কর্ম টা বোধহয় ঠিকই হয়েছে। ও বেচারার আমাদের যুগলের ওজনে যারপরনাই কষ্ট পেত  ... এদিকে অবলা জীব , মুখে না বললেও ওজনের বহরে যদি গা ঝাড়া দেয়  তা থেকে হয়ে যেতে পারত  একখান বড়সড় কাণ্ড !!! আর বৃষ্টির জলে কাদায় ঘোড়া - ঘুড়ি  সব কাদায় স্নাত । চেহারা গুলো না ওজনে না দেখনে কিছুতেই খোলতাই ছিল না।

পরের দিন আমাদের গুলমার্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার কথা ... রাতে সাহস নিয়ে সকলে মটন রোগানজোস খেয়ে ঘুম দিলাম।  পরের দিন ওই জোস খাওয়ার দরুণ নাকি পাহাড়ের জলে সবার হোস একে একে যেতে শুরু করল ... তা বলা মুশকিল। এই খতরনাক জোটের জোস কাটিয়ে হোস  ফেরত এলো ঘোরাঘুরির শেষ দিকে । আসলে কেনা জল সাথে থাকলেও তার হিমশিতলতা আমাদের হোটেলের রান্নাঘরের গরম জলের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়েছিল । সাথের ইলেকট্রিকাল কেটেলটি আমরা ব্যবহার করতে পারিনি হোটেল কর্মীদের কড়া নজরদারির জন্য। 

আণ্ডা বাচ্চা , শীতের প্রকোপ আর শরীরের গোলোযোগের পর্ব খানিক সাজিয়ে গুছিয়ে একটু গড়ানো বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম গুলমার্গের উদ্দেশ্যে। 

বেশি খাওয়ার ও কম খাওয়ার দু রকম শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিল যাত্রা পথে দুজনার , তবে শুরুতেই রোদ ঝকঝকে দিনে লিডার নদীর পাশে বাস থেকে নেমে একটু ছবি তোলার হুজুগে কজন নেমেও পড়লাম।  আমাদের টিমের লিডার লিড করে নিয়ে গেলেন । প্রতিবারে সবার ছবি আমি তুলি , আমার ছবি ভুলি ... এমন ধারা হলেই জোর জুলুম করে তুলিয়ে নিই নিজের ছবিছাবা। এবার ভূস্বর্গের কি মহিমা ... আমি যথানিয়মে ছবি তুলছি আর তিনিও ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে এক্কেরে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন । কখনো মোবাইল ক্যামেরা তো কখনো আমার ক্যামেরা খান হাতে করে ক্যামেরায় ধরে ফেলেছে আমাকে ... আমিও ভারি গদো গদো হয়েছি এবারে । 

শরীরের হুজ্জুতি যখন যেমন চলুক , তার নিদান দিয়ে ফের আমরা সর্ষে ক্ষেত, নদীর ধার , বরফের চাদরের আদর , গাছের পাশে , ডাল ধরে ... যা যা পোস পসিবল সবে ক্যামেরা ভর্তি করে ফেলেছি । শরীর সাথ না দিক ইচ্ছে শক্তি আর মনের জোর জোরদার ছিল ... ছবিতে ছবিতে কাশ্মীরি কবিতা লিখে ফেলেছি ভরপুর । ছবি দেখে কে বলবে যে আমরা এক একদিন এক একজন  শারীরিক কষ্টের সাথে পথ চলেছি .... 

সেদিন পথে একজনের মাথা ঘুরু ঘুরু তো অন্য জনের পেট গুলু গুলুর দরুণ চলতি পথে ফুলওয়ামা পেরিয়ে পাণ্ডব কূলের বাসভূমি অবন্তীপুরা যাওয়া হল না । তার আগে অবশ্যি সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে জেগে উঠেছিলাম সকলেই।  এরপর রুখাশুখা আপেল বাগিচার পাশের দোকান থেকে জনতা জনার্দন ( আমি বাদে ) কোল্ডস্টোরেজের সবুজ আপেলের রস খেয়ে আপ্লুত হয়েছিল। এরপর উইলো গাছের কাঠের তৈরি ব্যাট ফ্যাক্টরী দেখতে নামলেন শুধুই আমার কর্তামশাই। তারপরে পেট পূজোর পর্ব মিটিয়ে সবাই খানিক ক্লান্ত শরীর বাসে করে এগিয়ে গুলমার্গের পানে ধেয়ে চললাম .... পৌঁছনোর কিছু আগেই তুষার শুভ্রতা নিয়ে দূর থেকেই যেন হাতছানি দিল গুলমার্গের হিমালয় । তখন আমি আর ছোটগিন্নি দুজনেই কাহিল , কারণ পেটের মধ্যে তখন বড় রকমের গোলযোগ চালু হয়ে গেছে । পথের পাশের তুষারের  শুভ্রতা তখন মনোরম এর বিপরীত দিকে ঘোরাঘুরি করছে । অবশেষে গুলমার্গের হোটেল আফরবতে পৌঁছলাম .... ঘরে ঢুকে কাজের চাপে ছোটগিন্নির পেট কেস ডিসমিস হয়ে গেলেও, আমি তখনও পথের শেষ দেখা বাকি .... 


@শুচিস্মিতাভদ্র

 




বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৩


কাশ্মীর চিরকালের স্বপ্ন রাজ্য আর অধরা গন্তব্য। ছোট থেকেই মায়ের কাছে গল্প শুনলেও ওখানকার পরিস্থিতির খবরাখবরে জানতাম ওসব স্বপ্নে আর হিন্দী চলচ্চিত্রের গানে গানে দেখে নেব । কিন্তু ... হঠাৎই সাজো সাজো রব ... যেদিকে কান পাতি শুনি কাশ্মীরের ডাকে জনতা ধেয়ে চলেছে ওদিক পানে । দেখছি , শুনছি ... হেনকালে গতবছর কর্তা মশাই কাশ্মীরের নামের গন্ধ ছড়ানো উড়িষ্যার কাশ্মীরের নিয়ে গেলেন , বলতে নেই মন্দ লাগেনি । তবে হ্যাঁ তুলনামূলক আলোচনা তোলা থাক। ওসব ভালো নয়কো । মধ্য মার্চে গিয়ে গরমে পুরো ভাজা ভাজা হয়ে গিয়েছিলাম।

 এরপরের পর্ব ইতিহাস .... কন্যার বান্ধবীর মাতৃদেবীর উৎসাহে টাকা জমানোর পর্ব শুরু হলেও, হাল তো কর্তামশাই এর হাতে । মাঝে মাঝেই ঝপ করে সোমে ফিরে আসে ... খরচের দিকে তাকিয়েই এই দোলচাল । উৎসাহের সাথে সাথে মানসিক নানা রকম ভাব অভাব পেরিয়ে গতবছর দূর্গা পূজোর অষ্টমীর দিন যখন টিকিট কেটে ই ফেলা হল আমাদের ট্রাভেল এজেন্সির সুমিতদার কাছে গিয়ে ... তখন মন নেচে উঠল । সুমিতদাও ভরসা জোগালেন আর সুবিধাজনক কিছু উপায় বাতলে দিতে , কর্তামশাই খানিক ঠাণ্ডা হলেন । তখনও কিন্তু ঢের পথ বাকি । নড়বড়ে কর্তামশাই কে ফিক্সড করার জন্য আমার মতন খরুচে যখন টাকা বাঁচাও আন্দোলনের হাল ধরল তিনি খানিক হাপ ছাড়লেন।  নাহলে যে কোন সময়ে ব্যপারটা গড়বড়ে হয়ে যেত । যদিও স্বভাব  অনুযায়ী তেনার ৫২/৫৩ এর হিসেব কষাকষি মাঝে মাঝেই আমায় ভয় পাইয়ে দিত  !!!! 

আস্তে ধীরে প্রস্তুতির খরিদারী শুরু হল, চলতে থাকল ... সময় এগিয়ে আসতে লাগল , হেনকালে আমার ছুটির ঝুটিতে টান পড়ল ... সে সবও উতরে গেল অনেকের সহযোগিতার মাধ্যমে । যে কোন বেড়ানোর আগে এই বাঁধার বাধ্যতামূলক একখান ব্যাপার প্রতিবারেই হয় এবং এক একবার এক একজনকে নাড়িয়ে দেয় । এবারের নাড়া টা আমি খেলাম।  গেলাম গেলাম করতে করতে সব মিটিয়ে নড়ানড়ি থামিয়ে যথাস্হানে পাড়ি দিলাম রাত তিন ঘটিকায় । 

আকাশ পথে চলা শুরু হল , সাথে দিদি জামাই বাবু তো ছিলেনই।  সহযাত্রী হিসেবে এক মামাকেও পেয়ে গেলাম।  গল্পে গল্পে রাজধানীর মাটি ছুয়ে , টারমিনাল বদল করে আর খিদের খাবার প্যাক করে যখন পরের বিমান মুখী হলাম ... তখন সবারই ছুটন্ত মোড, কারণ ফাইনাল কলিং হচ্ছে তখন । এর মধ্যে আবার দিক ভুল করে আমরা কজন বাইরের দিকের পথ ধরে ফেলেছিলাম 🤫 তারপর এই বয়সে যা ধমক খেলাম !!!! বাপ রে .... 

শেষমেষ শ্রীনগরগামী বিমানে চড়ে প্যাক করা খাবার আনপ্যাক আর হুস হাস করে পেটকে শান্ত করা হল । মুড়ি আর ভুড়ির কি সুন্দর কানেকশন...ভুড়ি শান্ত হতেই মুড়ি অর্থাৎ মাথা ঠাণ্ডা হল । শুরু হওয়া মাথা ব্যাথা সেরে গেল ঝটপট । আগের বিমানে কানের কটকটানি বেশ জোরালো হলেও , ছোটদি আর এক সহযাত্রিনীর উপদেশ মেনে কানে তুলো গুজে এবার ওসব আপদ বালাই থেকে সকলেই রেহাই পেয়েছিলাম।  দুদিন আগে খানিক একই পথে কাটরা ( কলকাতা - দিল্লি - শ্রীনগর [২০মিনিট হল্ট] - জম্মু) যাওয়া ছোটগিন্নি ওরফে দেবাশ্রিতার (যার উৎসাহে আমরা কাশ্মীর মুখী হলাম )থেকে ও আরো অনেকের থেকে আকাশ থেকে কাশ্মীরের পাহাড়কে ছবিতে ধরার জন্য মোবাইল তাক করে বসে ছিলাম । এক সময় কারাকোরাম দৃষ্টিপথে দৃশ্যমান হলেও সেদিনের মেঘলা দিনের জন্য ছবি একটু মায়াবী টাইপের আধো আলো আধো ছায়া মাখা  এক অন্য রকম হল । ওপর থেকে হলুদ সবুজ জমি দেখলাম বিস্তারিত বর্ণময় শাড়ির মতন ছড়িয়ে থাকা । পরে যখন আকাশ থেকে জমিতে ল্যান্ড করে পহেলগাও যাত্রা করলাম ... সেই হলদে সবুজ দিগন্ত ব্যাপী সর্ষে ক্ষেত দেখে নীল দিগন্তের খোঁজ করতে লাগলাম।  পরে পেলেও সেদিন দিগন্ত ছিল ঘনঘোর মেঘের সঙ্গী। পথে কাব্যি ঠাসা মন নিয়ে সর্ষে ক্ষেতে নেমেই থেমে যেতে হল ঠাণ্ডা হাওয়ার দরুণ। কবি বলেছেন শীতের হাওয়ার লাগল নাচন। একদম সত্যিই নাচন কাঁপনে ভরপুর হয়ে ছবি তুলেছি কি না তুলেছি ... ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হতেই সবাই দে ছুট... বাসে উঠে পড়লাম। শ্রীনগর থেকে আমাদের সাথে ছিল চালক ইমরাণের টেম্পো ট্রাভেলার । দোকা ছবির জন্য  ( বৃষ্টিপাতের জন্য হয় নাই যে) তেনাকে ভাল দেখে সর্ষেক্ষেত চিহ্নিত করার টাস্ক দিয়ে নিদ্রামগ্ন হলাম ... সেই মধ্য রাতে উঠেছি কিনা !!! বেশ কিছুক্ষণ পর বাস থামার ঝাঁকুনিতে জাগন্ত হয়ে খানিক ধাতস্ত হয়ে দেখি এক হোটেলের সামনে বাস থেমেছে ... ওমা !! এসে গেল !!! মনে করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই শুনলাম ... চা বিরতি... আরো দূরে ... চলো যাই বলে আমাদের যেতে হবে আরো ... তখন সবে বিকেল ৪টে । আরো ঘন্টা ২ তখনও বাকি । "বাপ রে"... বাস থেকে নেমেই ঠাণ্ডার প্রকোপে সবার প্রথম অভিব্যক্তি ছিল ঠিক এই । আমাদের টিমের বাকি পঞ্চাশ শতাংশ আগের দিনে জয় মাতা বৈষ্ণোদেবীর দর্শন করে সকাল সকাল কাটরা থেকে পহেলগাওয়ের দিকে রওনা দিয়েছিল । শ্রীনগর থেকে একই পথ ... ওরা খানিক আগে আগে আর আমরা পিছু পিছু চলেছি ... দূরাভাসে কথা আর ছবি চালাচালি হচ্ছিল .... চা-বিরতিতে যখন আমরা চা আর টা নামক পাকোড়া কে পাকড়াও করলাম ... ওরা তখন পহেলগাওয়ের হোটেল পৌঁছে , হোটেলের চা পানে রত । পথের আপেল বাগানে আপেলের রস খেয়ে আর ন্যাড়া গাছের পাশে দাঁড়ানো ছবি গ্রুপের দরবারে আমরা আগেই দেখে নিয়েছি । তবে আমাদের সেদিন সর্ষে বাগানে নামা হলেও রুখা শুখা আপেল বাগানে নামা হয়নি আর এ দিকের বিখ্যাত জাফরাণ ক্ষেতও দূর থেকে দেখেছি । আপেল আর জাফরাণ দুজনার সময় এখন নয়কো , তাই তারা তাদের রঙের খেলা দেখাতে পারে নি । 

এরপর পাহাড়ী পথের শোভা দেখতে দেখতে দিদি আর আমি" কিতনি খুবসুরত ইয়ে তসবীর হ্যায়"🎶🎶 ..  গাইতে গাইতে পাইনাস রিসর্টে র দিকে ধেয়ে চললাম । আজ্ঞে হ্যাঁ , সেখানেই আমাদের দুদিনের ঘর সংসার । কিন্তু .... পথের এক দিক ওদিকে চোখ চালিয়েও পাইনাস এর দেখা না পেয়ে ... পাশে বয়ে চলা লিডার নদীর শোভা কিঞ্চিত মাইনাস হয়ে গেল । ফোনাফুনির শেষে পাহাড়ের গায়ে সাইনবোর্ডের দেখা মিলল ... মূল পথ থেকে বেশ খানিক ওপরে পাহাড়ের গায়ে দেখা মিলল পাইনাস রিসর্ট। ভিজে ভিজে থম থমে আর কনে কনে পাইনাসে এন্ট্রি নিলাম , এনার্জি লেভেল তখন মাইনাসে .... 


#শুচিস্মিতাভদ্র

Saturday, 1 April 2023

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩২


   ক্যালেন্ডার মোতাবেক এখন শীতকাল ,তায় আবার বড়দিনের ছুটি বলে কথা ... ফুল ফটুক না ফুটক ... এর মতন শীত আসুক না আসুক আজ বড়দিন .... বলা যেতেই পারে কি বলো ??? আমি তো মনে মনে আর জোরে জোরে সে কথা বলেছি , যদিও শীতপোষাক পরলেই মন মেজাজ মায় শরীর ওবধি ভয়ঙ্কর মেজাজ দেখিয়ে গরম হয়ে উঠছে । অতএব ওসব আপাতত সাথে থাকছে , অঙ্গে শোভা পাচ্ছে না । তো কথা হচ্ছে , বড়দিনের ছুটি সে গরম গরম হোক আর শীতের আমেজ মাখা নতুন গুড়ের গন্ধ যুক্ত হোক সে যখন হাতের কাছে এসেই পড়ল , কোথাও তো যেতে হবে  !!! বিশেষ করে আগের কিছু বিপদজনক বছর পার করে বাঙালি এখন ছুটি পেলেই খপ করে তা ধরে ফেলে সুযোগ মতন দূরে বা কাছে পাড়ি জমাচ্ছে ।

আমার কর্তা মশাই বেশ কদিন ধরেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ( কাজের , আমাদের নয় ) যেতে আকুল হয়েছেন । তবে নানা রকম কারণে দূরে যাওয়ার উপায় এবার নেই কো । অগত্যা কাছাকাছির মধ্যেই বেড়ুর উপযুক্ত স্থানের ছানবিন চালু হল । স্থির করলাম ... চন্দন নগরের গঙ্গার পাড় , শ্রীরামপুরের নতুন সংযোজন ডেনমার্ক ট্যাভার্ন আর কোন্নগরে অবস্থিত অবনীন্দ্রনাথের বাগান বাড়ি, যেটি পুরসভার উদ্যোগে সদ্য ই এক সুন্দর দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে ... যাব বড়দিনে । ঠিক হলে কি হবে .... যাওয়ার সময় বোধহয় এখনও হয় নাই।  মা বলতেন ... যেতে চাইলেই সব যাওয়া হয়ে ওঠে না । তাই হল ... চার পরিবার একত্রিত হলেও শেষে তা যখন অর্ধেকে নেমে দাঁড়ালো আর সাথের এক বান্ধবী দুঃখ ব্যক্ত করেই ফেলল , যে ... এ সব যাওয়া আর বোধহয় তার হল না , তখন ভাবলাম ... একটা ব্যবস্থা যদি করার উপায় হয় !!!! সে মতন দিন বদলের প্রস্তাব এক যোগেই বাতিল হল , শেষে বন্ধুকে অভয় দিয়ে জায়গা বদল করে ফেললাম ... ফোনবার্তায় অভয় দান পর্ব মিটিয়ে , ভাবনার কিছু অংশ তার জন্য তুলে রেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা । 

কর্তা মশাই এর এক সহকর্মী দিদির দেখানো পথে আমরা সকালের জলখাবারের পাট মিটিয়ে , সাথে অল্প কিছু খাবারের পোটলা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অম্বিকা-কালনা র উদ্দেশ্যে । এটি বর্ধমানে অবস্থিত। দিনের দিন ফিরব শুনেই কন্যার মুখ হাড়ি হয়ে গেল , বলেই ফেলল ... এ কেমন ঘোরা , এতখানি পথ গিয়ে হোটেলে থাকব না ??? বোঝো কাণ্ড  !!! বেড়ানোর দ্রষ্টব্য দেখার থেকেও হোটেলে রাত্রিযাপন অধিক আনন্দের ... জানলাম । কত কম যে জানি !!!! যাক সে সব পেরিয়ে পথ পেরিয়ে আমরা দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে এক সময় দিল্লী রোড ধরে ফেললাম।  মেয়ে আবার অবাক ... "মা আজই দিল্লী ঘুরে রাতে ফিরে আসব  !!! " মাগো রক্ষা করো , অঙ্ক অঙ্ক করে ভূগোল টাও মার খাচ্ছে গো , ঠিক করলাম ... ছুটি কাটিয়ে ভূগোল বিষয়খানও চেপে ধরতে হবে বটে !!! 

 এর মধ্যেই গোল বাঁধল আরেক ... শক্তিগড়ের আগেই একখান ডান দিকের পথ ধরার বদলে আমাদের বাহনচালক দাদা শক্তিগড়ের ল্যাঙচা খাওয়াতে সেখানে নিয়ে হাজির করলেন , খাবার পর ( শুধুই চা ) পিছিয়ে না এসে তিনি সোজা ধরলেন শান্তিনিকেতন এর পথ । একবার বলতে গেলেও তিনি নিশ্চিত,  যে এ পথেই পড়বে  কালনা ... পথ ঘাট তার কাছে খেলনার মতনই সোজা সরল । এ দিকে আমার কর্তামশাই আগের দিন সারা সকাল থেকে দুপুরে নাকি খুঁটিয়ে পথের দিশা দেখে নিয়েছেন নেট দুনিয়ায় , কিন্তু তিনি যেহেতু সত্যদাকে ( কর্তা মশাই এর বন্ধু ) ন্যাভিগেটর করে গাড়ির সামনে বসিয়েছেন , তিনি দায় কেন নেবেন ?? এ দিকে সত্যদা আমার মতনই সন্দিহান !!! যাচ্ছি কি ঠিক বটে ??? Google দা কে চালু করতেই তিনি উল্টো দিক দেখাচ্ছেন !!! সর্বনাশ .... কর্তামশাই চশমা টাকে নিয়ে চিন্তিত , আমার কন্যার হতাশ ... দিল্লী তো দূরের কথা ... কোথায় যাচ্ছি রে বাবা ভাব চোখে মুখে । আমি চুপ করে খানিক দেখলাম,  শুনলাম... জানলাম আমরা ২৭কিমি এগিয়ে গিয়েছিলাম .... শেষমেষ সঠিক পথ ধরে ফেলার পর রোদচশমা মাথা থেকে চোখে নামল ... মেয়েকে শান্ত করলাম এই বলে যে .. হেমন্ত মুখার্জি তো গানে গানে বলেছিলেন ... " পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি ... " শোনেই নি এ সব গান ... শোনাতে গেলে বলে ঘুম পাচ্ছে ... এরেই কয় generation gap । তো সে কিছু বুঝলো না , বাকিরা টাক নাড়িয়ে সম্মতি জানাল ।

সাথের খাইদাই পদের কিছু কিছু সদ্ব্যবহার হলেও সবটা হয়নি ... এক সময়ে সত্য ই কালনা লেখা বোর্ড দৃশ্যমান হল আর আমরাও উৎসাহে দম দিয়ে ঝিমন্ত ভাব কাটিয়ে উঠলাম। ঘড়ির কাটা তখন ১.১৫ ... পৌঁছলাম। পথের এক পাশে কালনার বিখ্যাত ১০৮ শিব মন্দির আর অন্য পাশে রাজবাড়ি চত্বর।  প্রথমেই দেব দর্শন বাঞ্ছনীয় , তাই জুতো জমা করে ঢুকে পড়লাম মন্দির দর্শন করতে । কন্যা সকলের দেখাদেখি তার বাবার ফোনখান বাগিয়ে ভিডিও করতে লেগে পড়ল ... আমি আমার আসল ক্যামেরাকে সচল করতে উদ্যোগ নিলাম। যার যার যেমন পছন্দ সেই মতন কাজকর্ম চালতে থাকল । 

এখন যত্রতত্র অসংখ্য ক্যামেরাধারী ( ওই দলগুলোর মধ্যে আমিও 😎আছি বটে ) আর সাথে নানা কায়দায় ক্যামেরা বন্দী হওয়ার চলমান বিষয়বস্তু । চলমান বিষয়েরা আবার আমার ক্যামেরায় তেমন বন্দী হতে চান না , তাই তাদের অল্প সল্প ছবি তুলে আমি অচল , অবিচ্ছেদ্য বিষয়দের ক্যামেরার ঘেরাটোপে ধরার চেষ্টা করলাম। দিব্যি ধরা দিল তারা । বেশ কিছু তরুণ-তরুণী দলের গ্রুফি,  একাকী ( single shot ) ছবি তোলার হিড়িকে ময়দান ফাঁকা পাওয়া ই যাচ্ছিল না । একজনকে আমার কন্যার আন্টি সম্বোধন যারপরনাই ক্রোধান্বিত করে তুলেছিল।   মন্দিরের দর্শন সম্পন্ন করে আমরা এরপর বিপরীত  দিকের রাজবাড়ি চত্বর মুখী হলাম । চত্বর জুড়ে শুধুই মন্দির আর মন্দির।  রয়েছে ছাদ বিহীন নাটমন্দির।  এত সব মন্দির দেখে আমাদের মঞ্জুশ্রীর যুক্তি সঙ্গত প্রশ্ন ছিল একটাই ... রাজবাড়ি চত্বরের মন্দির নাহয় বোঝা গেল , কিন্তু রাজ বাড়ি গেল কোথায় ? নাকি রাজা রাণী মন্দির নিবাসী ছিলেন ??? ভাবার বিষয় । তবে এর উত্তর দেওয়ার মতন কাউকে ধারে পাশে ধরতে পারলাম না , তবে মন্দির চত্বর পার করে খানিক পিছের দিকে একখান বড়সড় বাড়ি দৃশ্যমান হয়েছিল ... আমার ধারণা ওটিই হয়তো বা প্রকৃত রাজবাড়ি । এখনও হয়তো রাজ পরিবারের  কেউ  আছেন ওখানে । খুব ভগ্ন দশাগ্রস্ত নয় সেটি । কৌতুহল নিবৃত করার উপায় খুঁজে পাইনি । কাজেই  ওই অংশ রহস্যাবৃত ই থাকল আপাতত।  সব দেখার পালা চুকিয়ে , খেয়াল হল যে বেলা বেশ বেশি রকম এগিয়ে গেছে আর এমন উত্তপ্ত বড়দিন প্রথমবার পালন করে আমরা সবাই খুবই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। 

আগেই পরিচিত একজনের থেকে একখান খাবারের দোকানের সাকিন ঠিকানা জোগাড় করাই ছিল ... সেই মতন নতুন বাস স্ট্যান্ডের বিপরীতে অবস্থিত প্রিয়দর্শিনী হোটেলে পাত পড়ল আমাদের। ক্ষিদের মুখে সবই অমৃত সমান।  তবে সত্যিই রান্নার স্বাদ অসাধারণ ছিল । পেট পূজোর পর ফিরতি পথ ধরলাম।  ঠিক হল দিল্লী রোড থেকে একটু ভিতরে ঢুকে শ্রীরামপুরের ডেনমার্ক ট্যাভার্ন দেখে বাড়ি ফিরব । উত্তমকুমার তো সেই কবেই প্রশ্ন করেছিলেন ... এই পথ যদি না শেষ হয় , তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো ?? তুমি আর তুমির চক্করে পড়ে , তার উওর এখনও আমাদের অজানা ... একটু খোঁজ করার ইচ্ছে হতেই পারে , তাই না ??

ডেনমার্ক ট্যাভার্ন একটি রেস্টুরেন্ট,  যেটি ড্যানিস রা তৈরি করেছিলেন ১৭৮৬ সালে । প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্তির পথেই হাঁটছিল এই রেস্টুরেন্ট।  যাকে নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হয়েছে । বর্তমানে পার্ক হোটেল গোষ্ঠী এটিকে অধিগ্রহণ করেছে । থাকার বন্দোবস্ত আছে । আমরা নদীর ধারের এই রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখে , সামান্য সান্ধ্যকালীন আহার গ্রহণ করে বাড়ির পথ ধরলাম । ওখানে মন চা চা করলেও , পাই নাই । চা নাকি শেষ তাই ফিরতি পথে পথের ধারের খুড়ি চা ই জিন্দাবাদ।  ঘরে ফিরলাম রাত ৯ টা । মন তখন পূর্ণ,  তবে শরীর তখন ছেড়ে দে মা শুয়ে বাঁচি র গান বাজাচ্ছে।  যা ই বাজুক কমন কাজকর্ম শেষ করে তবেই বাজনা অনুযায়ী সবাই খাজনা দিলাম ... ঘুম দিলাম।  ভরপুর Our One Day out শেষ হল এ ভাবেই । 

@শুচিস্মিতা ভদ্র