বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩২
ক্যালেন্ডার মোতাবেক এখন শীতকাল ,তায় আবার বড়দিনের ছুটি বলে কথা ... ফুল ফটুক না ফুটক ... এর মতন শীত আসুক না আসুক আজ বড়দিন .... বলা যেতেই পারে কি বলো ??? আমি তো মনে মনে আর জোরে জোরে সে কথা বলেছি , যদিও শীতপোষাক পরলেই মন মেজাজ মায় শরীর ওবধি ভয়ঙ্কর মেজাজ দেখিয়ে গরম হয়ে উঠছে । অতএব ওসব আপাতত সাথে থাকছে , অঙ্গে শোভা পাচ্ছে না । তো কথা হচ্ছে , বড়দিনের ছুটি সে গরম গরম হোক আর শীতের আমেজ মাখা নতুন গুড়ের গন্ধ যুক্ত হোক সে যখন হাতের কাছে এসেই পড়ল , কোথাও তো যেতে হবে !!! বিশেষ করে আগের কিছু বিপদজনক বছর পার করে বাঙালি এখন ছুটি পেলেই খপ করে তা ধরে ফেলে সুযোগ মতন দূরে বা কাছে পাড়ি জমাচ্ছে ।
আমার কর্তা মশাই বেশ কদিন ধরেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ( কাজের , আমাদের নয় ) যেতে আকুল হয়েছেন । তবে নানা রকম কারণে দূরে যাওয়ার উপায় এবার নেই কো । অগত্যা কাছাকাছির মধ্যেই বেড়ুর উপযুক্ত স্থানের ছানবিন চালু হল । স্থির করলাম ... চন্দন নগরের গঙ্গার পাড় , শ্রীরামপুরের নতুন সংযোজন ডেনমার্ক ট্যাভার্ন আর কোন্নগরে অবস্থিত অবনীন্দ্রনাথের বাগান বাড়ি, যেটি পুরসভার উদ্যোগে সদ্য ই এক সুন্দর দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে ... যাব বড়দিনে । ঠিক হলে কি হবে .... যাওয়ার সময় বোধহয় এখনও হয় নাই। মা বলতেন ... যেতে চাইলেই সব যাওয়া হয়ে ওঠে না । তাই হল ... চার পরিবার একত্রিত হলেও শেষে তা যখন অর্ধেকে নেমে দাঁড়ালো আর সাথের এক বান্ধবী দুঃখ ব্যক্ত করেই ফেলল , যে ... এ সব যাওয়া আর বোধহয় তার হল না , তখন ভাবলাম ... একটা ব্যবস্থা যদি করার উপায় হয় !!!! সে মতন দিন বদলের প্রস্তাব এক যোগেই বাতিল হল , শেষে বন্ধুকে অভয় দিয়ে জায়গা বদল করে ফেললাম ... ফোনবার্তায় অভয় দান পর্ব মিটিয়ে , ভাবনার কিছু অংশ তার জন্য তুলে রেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা ।
কর্তা মশাই এর এক সহকর্মী দিদির দেখানো পথে আমরা সকালের জলখাবারের পাট মিটিয়ে , সাথে অল্প কিছু খাবারের পোটলা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অম্বিকা-কালনা র উদ্দেশ্যে । এটি বর্ধমানে অবস্থিত। দিনের দিন ফিরব শুনেই কন্যার মুখ হাড়ি হয়ে গেল , বলেই ফেলল ... এ কেমন ঘোরা , এতখানি পথ গিয়ে হোটেলে থাকব না ??? বোঝো কাণ্ড !!! বেড়ানোর দ্রষ্টব্য দেখার থেকেও হোটেলে রাত্রিযাপন অধিক আনন্দের ... জানলাম । কত কম যে জানি !!!! যাক সে সব পেরিয়ে পথ পেরিয়ে আমরা দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে এক সময় দিল্লী রোড ধরে ফেললাম। মেয়ে আবার অবাক ... "মা আজই দিল্লী ঘুরে রাতে ফিরে আসব !!! " মাগো রক্ষা করো , অঙ্ক অঙ্ক করে ভূগোল টাও মার খাচ্ছে গো , ঠিক করলাম ... ছুটি কাটিয়ে ভূগোল বিষয়খানও চেপে ধরতে হবে বটে !!!
এর মধ্যেই গোল বাঁধল আরেক ... শক্তিগড়ের আগেই একখান ডান দিকের পথ ধরার বদলে আমাদের বাহনচালক দাদা শক্তিগড়ের ল্যাঙচা খাওয়াতে সেখানে নিয়ে হাজির করলেন , খাবার পর ( শুধুই চা ) পিছিয়ে না এসে তিনি সোজা ধরলেন শান্তিনিকেতন এর পথ । একবার বলতে গেলেও তিনি নিশ্চিত, যে এ পথেই পড়বে কালনা ... পথ ঘাট তার কাছে খেলনার মতনই সোজা সরল । এ দিকে আমার কর্তামশাই আগের দিন সারা সকাল থেকে দুপুরে নাকি খুঁটিয়ে পথের দিশা দেখে নিয়েছেন নেট দুনিয়ায় , কিন্তু তিনি যেহেতু সত্যদাকে ( কর্তা মশাই এর বন্ধু ) ন্যাভিগেটর করে গাড়ির সামনে বসিয়েছেন , তিনি দায় কেন নেবেন ?? এ দিকে সত্যদা আমার মতনই সন্দিহান !!! যাচ্ছি কি ঠিক বটে ??? Google দা কে চালু করতেই তিনি উল্টো দিক দেখাচ্ছেন !!! সর্বনাশ .... কর্তামশাই চশমা টাকে নিয়ে চিন্তিত , আমার কন্যার হতাশ ... দিল্লী তো দূরের কথা ... কোথায় যাচ্ছি রে বাবা ভাব চোখে মুখে । আমি চুপ করে খানিক দেখলাম, শুনলাম... জানলাম আমরা ২৭কিমি এগিয়ে গিয়েছিলাম .... শেষমেষ সঠিক পথ ধরে ফেলার পর রোদচশমা মাথা থেকে চোখে নামল ... মেয়েকে শান্ত করলাম এই বলে যে .. হেমন্ত মুখার্জি তো গানে গানে বলেছিলেন ... " পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি ... " শোনেই নি এ সব গান ... শোনাতে গেলে বলে ঘুম পাচ্ছে ... এরেই কয় generation gap । তো সে কিছু বুঝলো না , বাকিরা টাক নাড়িয়ে সম্মতি জানাল ।
সাথের খাইদাই পদের কিছু কিছু সদ্ব্যবহার হলেও সবটা হয়নি ... এক সময়ে সত্য ই কালনা লেখা বোর্ড দৃশ্যমান হল আর আমরাও উৎসাহে দম দিয়ে ঝিমন্ত ভাব কাটিয়ে উঠলাম। ঘড়ির কাটা তখন ১.১৫ ... পৌঁছলাম। পথের এক পাশে কালনার বিখ্যাত ১০৮ শিব মন্দির আর অন্য পাশে রাজবাড়ি চত্বর। প্রথমেই দেব দর্শন বাঞ্ছনীয় , তাই জুতো জমা করে ঢুকে পড়লাম মন্দির দর্শন করতে । কন্যা সকলের দেখাদেখি তার বাবার ফোনখান বাগিয়ে ভিডিও করতে লেগে পড়ল ... আমি আমার আসল ক্যামেরাকে সচল করতে উদ্যোগ নিলাম। যার যার যেমন পছন্দ সেই মতন কাজকর্ম চালতে থাকল ।
এখন যত্রতত্র অসংখ্য ক্যামেরাধারী ( ওই দলগুলোর মধ্যে আমিও 😎আছি বটে ) আর সাথে নানা কায়দায় ক্যামেরা বন্দী হওয়ার চলমান বিষয়বস্তু । চলমান বিষয়েরা আবার আমার ক্যামেরায় তেমন বন্দী হতে চান না , তাই তাদের অল্প সল্প ছবি তুলে আমি অচল , অবিচ্ছেদ্য বিষয়দের ক্যামেরার ঘেরাটোপে ধরার চেষ্টা করলাম। দিব্যি ধরা দিল তারা । বেশ কিছু তরুণ-তরুণী দলের গ্রুফি, একাকী ( single shot ) ছবি তোলার হিড়িকে ময়দান ফাঁকা পাওয়া ই যাচ্ছিল না । একজনকে আমার কন্যার আন্টি সম্বোধন যারপরনাই ক্রোধান্বিত করে তুলেছিল। মন্দিরের দর্শন সম্পন্ন করে আমরা এরপর বিপরীত দিকের রাজবাড়ি চত্বর মুখী হলাম । চত্বর জুড়ে শুধুই মন্দির আর মন্দির। রয়েছে ছাদ বিহীন নাটমন্দির। এত সব মন্দির দেখে আমাদের মঞ্জুশ্রীর যুক্তি সঙ্গত প্রশ্ন ছিল একটাই ... রাজবাড়ি চত্বরের মন্দির নাহয় বোঝা গেল , কিন্তু রাজ বাড়ি গেল কোথায় ? নাকি রাজা রাণী মন্দির নিবাসী ছিলেন ??? ভাবার বিষয় । তবে এর উত্তর দেওয়ার মতন কাউকে ধারে পাশে ধরতে পারলাম না , তবে মন্দির চত্বর পার করে খানিক পিছের দিকে একখান বড়সড় বাড়ি দৃশ্যমান হয়েছিল ... আমার ধারণা ওটিই হয়তো বা প্রকৃত রাজবাড়ি । এখনও হয়তো রাজ পরিবারের কেউ আছেন ওখানে । খুব ভগ্ন দশাগ্রস্ত নয় সেটি । কৌতুহল নিবৃত করার উপায় খুঁজে পাইনি । কাজেই ওই অংশ রহস্যাবৃত ই থাকল আপাতত। সব দেখার পালা চুকিয়ে , খেয়াল হল যে বেলা বেশ বেশি রকম এগিয়ে গেছে আর এমন উত্তপ্ত বড়দিন প্রথমবার পালন করে আমরা সবাই খুবই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আগেই পরিচিত একজনের থেকে একখান খাবারের দোকানের সাকিন ঠিকানা জোগাড় করাই ছিল ... সেই মতন নতুন বাস স্ট্যান্ডের বিপরীতে অবস্থিত প্রিয়দর্শিনী হোটেলে পাত পড়ল আমাদের। ক্ষিদের মুখে সবই অমৃত সমান। তবে সত্যিই রান্নার স্বাদ অসাধারণ ছিল । পেট পূজোর পর ফিরতি পথ ধরলাম। ঠিক হল দিল্লী রোড থেকে একটু ভিতরে ঢুকে শ্রীরামপুরের ডেনমার্ক ট্যাভার্ন দেখে বাড়ি ফিরব । উত্তমকুমার তো সেই কবেই প্রশ্ন করেছিলেন ... এই পথ যদি না শেষ হয় , তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো ?? তুমি আর তুমির চক্করে পড়ে , তার উওর এখনও আমাদের অজানা ... একটু খোঁজ করার ইচ্ছে হতেই পারে , তাই না ??
ডেনমার্ক ট্যাভার্ন একটি রেস্টুরেন্ট, যেটি ড্যানিস রা তৈরি করেছিলেন ১৭৮৬ সালে । প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্তির পথেই হাঁটছিল এই রেস্টুরেন্ট। যাকে নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হয়েছে । বর্তমানে পার্ক হোটেল গোষ্ঠী এটিকে অধিগ্রহণ করেছে । থাকার বন্দোবস্ত আছে । আমরা নদীর ধারের এই রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখে , সামান্য সান্ধ্যকালীন আহার গ্রহণ করে বাড়ির পথ ধরলাম । ওখানে মন চা চা করলেও , পাই নাই । চা নাকি শেষ তাই ফিরতি পথে পথের ধারের খুড়ি চা ই জিন্দাবাদ। ঘরে ফিরলাম রাত ৯ টা । মন তখন পূর্ণ, তবে শরীর তখন ছেড়ে দে মা শুয়ে বাঁচি র গান বাজাচ্ছে। যা ই বাজুক কমন কাজকর্ম শেষ করে তবেই বাজনা অনুযায়ী সবাই খাজনা দিলাম ... ঘুম দিলাম। ভরপুর Our One Day out শেষ হল এ ভাবেই ।
@শুচিস্মিতা ভদ্র
No comments:
Post a Comment