Friday, 24 May 2024

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৫

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৫

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল যথা সময়ে । দেখি আগের দিনের তুলনায় আকাশ একটু গাল ফুলিয়েছে  , কিন্তু আমাদের গ্যাংটকের দেখা  প্রথম প্রভাতের মতন সে অতোটাও বিষন্ন নয় । মন বলল .. এ হল মানিয়ে নেওয়ার মতন মুখ ভার । তাও মনে যে সংশয়ের দোলচাল একেবারেই ছিল না ; তা নয় । তবে আস্তে ধীরে সময় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আকাশ আরো খানিক ভার মুক্ত হলো। আমাদের হোটেল ম্যানেজারের দেখানো পথে আমরা আমাদের মন পবনের নাও থুড়ি চার চাকার বাহনে আসীন হয়ে বেরিয়ে পড়লাম জলখাবার খেয়ে। কথা হয়েই ছিল যে আমরা প্রথমেই ছাঙ্গুর পারমিট নিয়ে সেদিকে রওনা দিয়ে , বরফ দেখে আবার ফিরে আসব গ্যাংটকের হোটেলে । সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে মালপত্র সহ বেরিয়ে পড়ব রাবাংলার উদ্দেশ্যে। সকালে বেরনোর আগেই আমাদের চাবি বন্ধ সব লটবহর হোটেলের রিসেপশনে জিম্মা করে আমরা হোটেলের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলাম । 

অনেক বছর আগে ছাত্র জীবনে আমার কর্তামশাই বার ২/৩ এ দিক পানে ঘুরে গেছেন তার নানান সেট অফ ফ্রেণ্ডস দের সাথে ( একবার স্কুল / একবার কলেজ / একবার পাড়াতুত বন্ধুরা ) । কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আর বন্ধ ই হয় না !!! এমন কি ফেরার পরে বিদেশ ও স্বদেশ নিবাসী বন্ধুরা অনেকেই নস্টালজিক হয়ে দূরাভাসে , মুখপুস্তিকার দরবার আলো করে স্মৃতিচারণে হাজিরা দিল । তো সে যাই হোক , শুনলাম যে আগের বদলে ছাঙ্গুগামী নতুন পথ তৈরি হয়েছে , যা আগের পথের থেকে অনেক প্রসস্ত কিন্তু একটু সময় সাপেক্ষ। প্রথমে চোখ ছানাবড়া হল যখন পারমিট হাতে এল , দেখলাম কাতারে কাতারে গাড়ি পারমিট মেলার জন্য অপেক্ষারত । কিন্তু এর পরে যে আরো অনেক কিছুই বাকি তা বুঝলাম যখন এক অফিসার আমাদের গাড়ির কাছে এসে পারমিট নিয়ে তাতে নম্বারিং করে দিলেন । দেখলাম আমাদের গাড়ির ক্রমিক সংখ্যা , ট্যারা হয়ে গেলাম ...  serial no.536  !!!!

আস্তে ধীরে আমরা কুয়াশার চাদরে মোড়া পথের মধ্যে ঢুকে পড়লাম , ঘন কুয়াশার জন্য সামনের গাড়ি আর একপাশের অতলান্ত খাদ দুই ই প্রায় প্রায় অদৃশ্য। কখনও কুয়াশার আস্তরণ হাল্কা হলে কিছু কিছু দৃশ্যমান হচ্ছিল চারপাশ । সার বাঁধা মন্ত্র লেখা পতাকার সারিবদ্ধ রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছিলাম আমরা। পুরোটাই আর্মির অঞ্চল। তার চিহ্নও দেখছিলাম মধ্যে মধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা আর্মির বিশালাকার শক্তিমান ( বাহন ) গুলোর ধেয়ে চলার গতিতে । কোনটা বোঝাই আর্মির জিনিসপত্রে তো কোনটাতে আর্মির সেনা বাহিনীর জওয়ান। অদ্ভুত একটা অনুভূতির উদয় হয় এই নিরলস পরিশ্রমী বীর দের দেখলে , এদের জন্যই আমরা নিরাপদে , নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াই দেশের নানান প্রান্তে। এদিকের পাহাড়ের ওদিকেই নাকি রহস্যের খাসমহল চীন দেশ । কোন সুদূর অতীতে এই সব পাহাড়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিদেশী বণিক , পর্যটক , ধর্ম প্রচারক গণ চলাচল করতেন । এখনকার সুযোগ সুবিধা তখন স্বপ্নাতীত।  কি ভাবে তারা আসতেন ভাবতেই অবাক লাগে !!!

ছাঙ্গু যাওয়ার পারমিট মিলেছিল মূল স্থানের থেকে সম্ভবত ৫কিমি আগে ১৫ মাইল নামক স্হানে। কোন জায়গার নাম যে এমন হতে পারে ধারনা পরিষ্কার হতে বিস্তর সময় লেগেছে । তাও কি হয়েছে !!!! কলকাতার হাজির হতে তবে বুঝেছি বলে মনে করছি । পাহাড়ী পথে বেশ ঝগড়া লেগে গিয়েছিল আমাদের দুজনার ... এ কেমনতর কথা এই শুনছি ৫ কিলোমিটার আবার এই বলছ ১৫ মাইল এলে নেমে পড়ো !! একে তো ঠাণ্ডা তে জমে কুলফি হয়ে যাচ্ছি ওই ১১নাকি সাড়ে এগারো হাজার ফিট ওপরে !! তারপর এমন বিতিকিচ্ছিরি অঙ্ক ধরিয়ে দিলে কার ভাল লাগে ? এমনিতেই অঙ্ক দেখলে আমার হাত পা কলকাতার চরম গরমেও ঠাণ্ডা হয়ে যায় তায় ওই ঠাণ্ডার মধ্যে এসব কারণে যারপরনাই গম্ভীর হয়ে বরফে হাঁটার উপযুক্ত বুট ভাড়া করতে ও পরে ফেলতে নেমে পড়লাম এক দোকানে। সেখানে বুট ভাড়া ছাড়াও রয়েছে চা জলখাবার, দুপুরের খাবারের ঢালাও ব্যবস্থা ( ধুমায়িত ভাত , সব্জি আর পাহাড়ী মুরগীর ঝোল )আবার খুচরো কিছু শীত পোশাকের বিক্রি বাটার ব্যবস্থাপনা।  মালকিন এক কথায় সত্যিই দশভূজা । একা হাতে ভাড়া জুতো পরাচ্ছেন হাসি মুখে অত্যন্ত যত্ন সহকারে , পরমূহুর্তেই চা / জলখাবার পরিবেশন করছেন সমান ক্ষিপ্রতার সাথে ... মুখে হাসি লেগেই আছে। 

আরো কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে দুদিকের পাহাড়ে বরফ সাথে বরফ দেখে পাগল হওয়া সমতলবাসী দৃশ্যমান হল । গাড়ির চালক বিজয় ভাইয়া ,  বললেন যে গাড়ি নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।  সত্যিই বরফের বদলে গাড়ির গলিগুজির মধ্যেই নেমে পড়লাম !!! বাপ রে !!! বরফ নিয়ে কাব্য তখন গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গেছে !!! কর্তামশাই চট করে ধাতস্ত হয়ে একপাশে সরিয়ে আনলেন মা - মেয়েকে ... বললে ... যা দেখার , ছবি তোলার এখানেই সারো আর সরে পড়ো। কারণ এই উচ্চতা সমতলবাসীদের অনভ্যস্ত শরীরের পক্ষে খুব সুবিধাজনক নয় । অসুস্থ হলেও হতে পারি । বলতে না বলতেই আমাদের সামনে একটি বাচ্চা মেয়েকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলাম। 

ভিড়ে আমার বড় এ্যালার্জি চিরকাল !!! বরফ যতটা দেখার দেখে ছবি নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। কন্যা ওইটুকু পথের ধারের গাড়ির মেলার পাশ কাটিয়ে ভিন্ন প্রদেশের ( দক্ষিণ ভারত ) এক তরুণীর সাথে স্নোম্যান বানিয়ে ফেলেছিল  কিন্তুক মনের সুখে বরফের গোল্লা ছোড়াছুড়ি টা তেমন জমলো না !! ও সব ফাঁকা বরফ বেছানো প্রান্তরে সম্ভব, যা শুধু চলচিত্র কেন ? আমরা পেয়েছিলাম ও সম্ভব করেছিলাম খাজিয়ারে , কাশ্মীরে , ডালহৌসী আর সোলাং ( আমরা দুজন ) ভ্যালিতে । এখানে তার কোনরকম সম্ভবনা ছিল না ....  অগত্যা কি আর করা !!! ফেরার পথ ধরতে দেখলাম শরীরটা অল্প অল্প বিগরোচ্ছে ... মাথা ব্যথা আর গা গোলানো। যা আমার সমতলেও কমন সিলেভাস। যদিও কোনরকম দাওয়াই ছাড়াই তা সেরে গেল খানিক নামার পরে পরেই। এদিকের ঘরের চিকিৎসক মশাই কইলেন ওটা অলটিটিউড সিকনেস।  কে জানে ভাই !! এ সব জানি না , কারণ কলকাতার গরমে , পথে ঘাটে দূরে কোথাও চারচাকায় আসীন হলে এমন ধারা সিকনেস আমার হয়ে থাকে অনেক সময় !!! হয়তো মনটা বেরলেই পাহাড়মুখী হয়ে ওমন ঘটায় । মন রোগ বিশেষজ্ঞ কইতে পারেন । থাক ওসব খুব ঝামেলায় না ফেললে যেমন চলছে চলুক ।

এরপর আমরা ফিরে এলাম গ্যাংটকের হোটেলে । সেখানে ভরপেট্টা ঘরোয়া খাবারে ক্ষিদে মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাবাংলার দিকে । বরফ দেখার রেশ ধরেই এগিয়ে চললাম সামনের নতুন কিছু দেখার বাসনা নিয়ে।

No comments:

Post a Comment