বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৪
প্রথমদিনের গ্যাংটকে ঘোরাঘুরি একদম ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে গেল। ঘরে থুড়ি হোটেলে ফিরে চা খেয়ে নিজেদের একটু গরম করে নিতে না নিতেই গ্যাংটকে গণ্ডোগোল .... গ্যাংটকের পার্ক স্ট্রিট সম এম.জি.মার্গে যাওয়া নিয়েই হোটেলের ঘরে গোলযোগের সূত্রপাত হতে না হতেই আবহাওয়ার মোড় ঘুরে গেল যথারীতি আমার কর্তামশাই এর দিকেই। আর ঝমঝমে বৃষ্টি আর কনকনে ঠাণ্ডার প্রকোপে আমরা তিনজনেই এম .জি .মার্গের বদলে লেপের ভিতরে গুটিশুটি মেরে ঢুকে পড়লাম আর ঘরের একমাত্র টেলিভিশনে এদিক ওদিক খিচুড়ি অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করলাম। আবহাওয়া নানান ধ্বণাত্মক শব্দ সহযোগে দুর্যোগের জানান দিতেই থাকল । এর মধ্যেই আমার কন্যা এখনকার জ্ঞানের আধার Google বাবুর( নেট তখনও সেট ছিল )শ্মরণাপন্ন হয়ে আগামী সব দিনের দুর্যোগের ঘোষণা করে মনটা কে আরো খারাপে ভিজিয়ে দিল । অগত্যা ভেবে নিলাম কটা দিন নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রামেই কাটানো যাবে । কর্তামশাই আমার ভাবনা শুনে চোখ কপালে তুলে বলেই ফেললেন ... তোমার কি লেবেল !!!! এত খরচ করে গ্যাংটকে এলে বিশ্রাম নিতে ???? কি বলব বলো ?? নুনের ছিটে হজম করে নিলাম । তোমরাই বলো , ঘুরতে না পারার হতাশার কথা ছোটজনকে বলা যায় ??? আর ওমন দুর্যোগে কি ঘুরতে এসেছি বলে ঘুরতে হবেই ???? তাই যেটা যুক্তি গ্রাহ্য সেটা করাই তো বাঞ্ছনীয় ।
ডিনার করার পর আমাদের হোটেল বজ্র রেসিডেন্সি র ম্যানেজার অতিরিক্ত নিশ্চিত ভাবেই আশার কথা শোনালেন ... বললেন আজ যখন এতো বৃষ্টির ঝরে পড়া হয়ে যাচ্ছে , কাল পাবেন ঝকঝকে রোদে ভরা দিন .... যদিও তখনও বাইরে তোড়ে বৃষ্টি পড়ছিল। ওনার মুখেই শুনলাম হোটেলের এক রুমের বোর্ডার গণ একদিন আগে ইয়ুমথাং ঘুরতে গিয়েছিলেন , তারা এই দুর্যোগের মধ্যেই ফিরছে। পাহাড়ী পথের দুর্যোগ আর রাতের আঁধার সত্যিই খুব চিন্তার বাতাবরণ তৈরি করল।
পরেরদিন সকালে সত্যিই সূজ্জি মামার আগমন ঘটল খুশীয়াল মুডে আর আমরাও গত রাতের সেই বোর্ডার দের দুর্যোগ পেরিয়ে হোটেলে ফেরার খবর নিয়ে জলখাবার গলধঃকরণ করে বেরিয়ে পরার জন্য প্রস্তুত হয়েই জানতে পারলাম আরেক দুঃখের খবর। আগের দিনের আবহাওয়ার দরুণ ঝরে পড়া বরফের পাহাড় আমাদের ছাঙ্গুর পারমিট বাতিল করে দিয়েছে। নাথুলাতে তো ঢ্যারা পড়েইছিল ছাঙ্গুও হাতছাড়া হল !!! একেই কি বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া ?? হবেও বা । শুধু শুধুই কি আর প্রবাদ প্রবচনের সৃষ্টি ??? আমাদের বাহন চালক বিজয় ভাইয়া ফোনের ওপারে আশাবাদী হলেন , বললেন ... তিনি আগের দিনের বাকি রয়ে যাওয়া দ্রষ্টব্য ঘুরিয়ে আনবেন । সেদিন বেরিয়ে পাহাড়ী পথের বাঁকে কচিত কদাচিৎ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিলেন । চকিত দর্শন হলোই বা !! কে বলবে আগের দিন ওমন অঝোর ধারা আমাদের ভিজিয়ে , ভাসিয়ে একশা করেছিল !!! প্রথমেই আমরা চললাম চড়াই পথ বেয়ে হনুমান টকের দিকে। এখানে যা বুঝলাম টক মানে হল মন্দির , যার সাথে ইংরেজি ও বাংলা কোন "টক"শব্দের অর্থের যে সমতা নেই তা টক করে বুঝে গেলাম। ঝকঝকে রোদে টপাটপ মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে আরো একটু উপরের দিকে উঠে পৌঁছলাম মন্দিরে । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শান্ত পরিবেশ বড় ভাল লাগল। মন্দির লাগোয়া রেলিং ঘেরা প্রসস্ত চত্বরের একপাশে আবার চকিতে দেখা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের চাদরে মুখ লুকিয়ে ফেললেন আর আমরা এগিয়ে চললাম পরের গন্তব্যের দিকে। একে একে দেখে নিলাম গণেশ টক, তাসি ভিউ পয়েন্ট। আমাদের গ্যাংটকের হোটেলের ম্যানেজার সহ সর্বমোট ৪/৫ জন কর্মচারী , প্রত্যেকেই বাঙালি। তাদের একজন আগের দিনেই বলেছিলেন যে সারা গ্যাংটকের সেরা বৌদ্ধ মনাস্ট্রি নাকি রাঙ্কাতে অবস্থিত, আর সে খান দেখে নিলে বাকি সব অদেখা মনাস্ট্রির দর্শন হয়ে যায় ... সেই মতনই পথের নিশানা ধরিয়ে দিলাম আমাদের সারথি বিজয় ভাইয়াকে । সামনেই নির্বাচণ , তার চিহ্ন ছড়ানো পথ থামতে থামতে পেরিয়ে ( মিছিল ) আমরা চললাম রাঙ্কা মনাস্ট্রির দিকে । পথ আর শেষ দেখাচ্ছে না দেখে আমরা মা - মেয়ে মায় মেয়ের বাবাও পর্যন্ত খানিক ঘুমন্ত , ঝিমন্ত ও জাগন্ত মোড সচল অচল করতে করতে পৌঁছলাম রাঙ্কা মনাস্ট্রির সুবিশাল চৌহদ্দীর ভিতরে । বলতে নেই ... অসম্ভব ভাল লাগল মনাস্ট্রির সবটুকু !!! দেখা শেষ করে পাশের ছোট খাওয়ার জায়গাতে পেটকে শান্ত করে , পাশের পশরা সাজানো দোকান থেকে টুকটাক কিছু খরিদারি করে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম । পথে নির্বাচণী নিদর্শন পেরিয়ে সন্ধ্যার মুখে হোটেলে ফিরে এলাম। সেদিন ঝকঝকে আবহাওয়ার দারুণ ঠিক হল এম . জি . মার্গ ভ্রমণ আর সেখানেই খ্যাটন পর্ব মিটিয়ে ঘরে থুড়ি হোটেলে ফিরব রাত করে। সেই মতনই ঘুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
পরের দিন আমাদের গ্যাংটক কে বিদায় জানানোর পালা। এদিকে আমাকে ছাঙ্গুর বরফ দেখাতেই হবে এমন পণ ম্যানেজার সহ বাকিদের । আমার দেওয়া যে প্রস্তাব এক কথায় কটমটে দৃষ্টিতে বাতিল করে দিয়েছিল এদিকের কর্তামশাই , সেই একই প্রস্তাব কার্যকর করতে লেগে পড়ল সদ্য পরিচিত সকলে। ঠিক হল পরের দিন আমাদের বাক্স প্যাটরা হোটেলের রিসেপশনে রেখে আমরা পারমিট বগলদাবা করে ছাঙ্গুর দিকে যাব ( যতটা পারমিশেবল) , দুপুরে ফিরে হোটেলে খেয়ে বিদায় জানাবো গ্যাংটক কে । তাই অনেক আশায় বুক বেঁধে আমি সে রাতে নিদ্রামগ্ন হলাম ।
No comments:
Post a Comment