Saturday, 25 August 2018

বন্দী শৈশব

শুচিস্মিতা ভদ্র

 অন্ধকারে ঘরের দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ প্রথমে সময়টা ঠাওর করতে পারে না। আস্তে আস্তে night lamp এর মৃদু আলোয়, একটু ধাতস্থ হবার পর, সঠিক সময় টা দেখতে পায়। ঠিক , এখন প্রায় রাত আড়াইটে। আজ ও রীমি পাশে নেই। টিকলি , একটু কুঁকড়ে পাশবালিশ জড়িয়ে অঘোর ঘুমে , হয়তো বা স্বপ্নের রাজ্যে .....। ঘুমন্ত টিকলিকে বড়ো মায়াময় লাগে।
আজকের সন্ধ্যার ঘটনায় অনিরুদ্ধ , যারপরনাই হতবাক ও চিন্তিত। বাড়িতে ঢুকে অন্ধকার ঘরে মা আর মেয়ের বিষন্ন রূপ দেখে, খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল। পরে রীমির কাছে, বিষন্নতার কারণ শুনে এত অবাক হয়েছিল !!!! পরে হতবাক.... হতাশ.... চিন্তা .... সবের জগাখিচুড়ী একটা অনুভুতি নিয়ে দিনান্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ঘুম ভাঙার পর সেই mixture feelings টা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে।
অনিরুদ্ধ ওদের শোয়ার ঘরের বাইরে এসে , বসার ঘরে উঁকি দেয়, রীমি নেই। পাশের ছোট ঘরে রীমির দেখা মেলে। কিন্তু একি দেখছে সে ? রীমি টিকলির স্কুলের ব‌ই, খাতা টেবিলে ছড়িয়ে বসে , একমনে কিছু লিখছে। এই ঘরটা ওদের ঠাকুরঘর। যদিও অনিরুদ্ধর জীবনে ঈশ্বরের আবাহন, বিসর্জন কোনো টা ই স্হান পায়না। বিয়ের পর রীমি এই ছোট ঘরটায় ঠাকুরের আসন পেতেছিল। এখন ঠাকুরের আসনের অন্যান্য সব দেবদেবীর মধ্যে বিদ্যার দেবী মা সরস্বতীর সাধনপীঠ এ পরিণত হয়েছে এই ঠাকুর ঘর। রীমির মতে, "এই ঘরটা ঠাকুরঘর ও বটে, আবার টিকলির study ও বটে।" অনিরুদ্ধ মজা করে বলে, " মা সরস্বতীর জন্য workshop/lab বানিয়ে দিলে, অন্য দের মান অভিমান হলে ???? 
অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকে, টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়, রীমি টের ই পায় না। রীমির পিঠে হাত দিতেই, চমকে তাকায় সে। অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে- "রীমি এত রাতে তুমি কি করছো ?"
"দেখতে পাচ্ছো না !!! টিকলি র class work গুলো সব এক এক করে , পরিষ্কার করে লিখছি। ওর যা হাতের লেখা । একটু ও মন নেই। খালি দুষ্টুমি আর ফাঁকি বাজি। এই খাতায় লিখে নিচ্ছি, পড়াতে সুবিধা হবে।"
" তুমি কি পাগল হলে রীমি ? এই তো সবে টিকলির class - II হলো। তুমি এখন ই যদি এমন করো, পরে তো উন্মাদ হয়ে যাবে। "
"তো আমি কি করবো বলো ? ও তো পিছিয়ে পড়ছে। আমাকে ই তো পড়াতে হয়। তুমি কিছু দেখো ?? আগের দিন সাধারণ একটা বানান পারে নি। এতো অমনোযোগী।"আজ" দিয়ে বাক্য রচনা করেছে... " আজ আমার বাবার বিয়ে।" এ কি করবে ভেবে ভেবে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
"হুম। আর মেয়েকে ও পাগল করছো। রীমি তুমি ভুলে যাচ্ছো যে, ও এখনো শিশু। সাধারণ ভুল যেমন করছে, আবার অনেক কিছু তো অসাধারণ ভাবে পারছে ও।"
রীমি রাগত স্বরে বলে- " তাই আর কি !!! পারছে না আরো কিছু , অসাধারণ দুষ্টুমি পারছে।"
"একটা কথা সত্যি করে বলো তো রীমি , বাবার বিয়ে এই বাক্য দেখেই কি তুমি দিশেহারা ?"
রীমি রাগত  স্বরে তাকায় অনিরুদ্ধ র দিকে।অনিরুদ্ধ অল্প প্রশ্রয়ের হাসি হাসে, কথা বাড়ায় না , এই নিয়ে। একটু জোর করেই রীমিকে শোয়ার ঘরে নিয়ে আসে। একটু ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও খুব একটা লাভ হয় না।

"বলিস কি রে অনি ? রীমিকে তো খুব বুদ্ধিমতি বলেই জানতাম। আমি তো ভাবতেই পারছি না, সামান্য একটা বানান আর বাক্য রচনার গোলমালে মেয়েটাকে ওমন ভাবে মেরেছে ?"
অনিরুদ্ধ সম্মতি জানায়, চিন্তিত মুখে। অনিরুদ্ধ, আজ অফিস ফেরতা তার বন্ধু সরিৎ এর বাড়ি গিয়েছে। রীমিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তার কিছুতেই কাটছে না। টিকলি র পড়াশোনা নিয়ে রীমির বাড়াবাড়ি ক্রমাগত বাড়ছে। এ তো অসুস্থতার লক্ষণ !! প্রথম প্রথম এই বিষয় নিয়ে খুব ঠাট্টা করলে ও এখন যে তা আর ঠাট্টার পর্যায়ে নেই, তা পরিষ্কার।
সরিৎ , অনিরুদ্ধ এর ছোটবেলার বন্ধু। সরিৎ বন্ধুর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
" শোন অনি, তুই রীমিকে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা বোঝা।"
" বোঝাইনি ভাবছিস ? যে জেগে ঘুমায় , তাকে জাগাবে কে ? তুই ই বল !! আমি সত্যি ভেবে পাচ্ছি না।"
"হাল ছেড়ো না বন্ধু "-সরিৎ , একটু মজা করার চেষ্টা করে , FM এর কোনএক প্রভাতী অনুষ্ঠানের শিরোনাম কে , ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের আদলে ই বোলে। ম্লান হেসে সম্মতি জানায় অনিরুদ্ধ।

হঠাৎ করে দুদিনের ছুটি নিয়ে , অনিরুদ্ধ, রীমি আর টিকলি কে নিয়ে তাজপুর এসেছে। না , খুব একটা ভিড় নেই। যদিও সপ্তাহান্তে এ চত্বরে ইদানিং বেশ ভিড় হয়। হয়তো , কদিন এর এক নাগাড়ে বৃষ্টি সেই জনসমাগমে বাঁধা সৃষ্টি করেছে !! কারণ যাই হোক না কেন ? এই রকম অল্প tourist স্হান মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেয় বৈকি !! ওদের হোটেলের বারান্দায় বসেই ঢেউ এর আসা যাওয়া দেখছিল অনি। মা আর মেয়ের তো আনন্দ ধরে না। বৃষ্টি তে ভিজতে ভিজতে সমুদ্র তটে ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত।
অনিরুদ্ধ, আয়েস করে , একটা সিগারেট ধরায়, অনেক দিন পর বড় ভালো লাগছে। সরিৎ আর অফিসের রায় দার পরামর্শে তাদের এই স্বল্প ভ্রমণ। রীমি প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কারণ ওই এক ..... টিকলি র পড়ার ক্ষতি !!!!
অনি একটু মজা করে বলতে গিয়েছিল -" দেখো রীমি , আমরা দুজন কি এমন বিদ্যার জাহাজ ? ওকে একটু ওর মতো করে চলতে দাও,তবে রাশ টা থাকবে তোমার হাতে। এই যেমন 'আমার রশি ধরেছ কষি'।"
কিন্তু না, রীমি মজা টা bodyতে  নিয়ে, ভয়ানক face দেখিয়ে , রান্না ঘরে সিধোলো। তারপর......। সে সব বলতে থুড়ি লিখতে গেলে  !!!!! মোটের ওপর মান ভাঙাতে অনিরুদ্ধর জান কয়লা হ‌ওয়ার পরবর্তী দৃশ্য তাজপুর সমুদ্র সৈকত।
অনির মনে আছে এখনো , সে তখন বেশ ছোট, টিকলি র থেকে বড়োজোর বছর খানেক বড়, স্কুলে annual পরীক্ষা হচ্ছে। অনি ও পরীক্ষা দিচ্ছে। যে সে পরীক্ষা নয়, অঙ্ক পরীক্ষা। অনি কলকাতা র ছেলে নয়। মফস্বলের অতি সাধারণ আধা সরকারি স্কুল।
একতলায় ক্লাস ঘরের জানালার পাশে খেলার মাঠ। যদিও ওটা স্কুলের ভিতরে নয়। ছোট একটা পাঁচিল ছিল বটে, কিন্তু তা টপকে যাতায়াত হোতো হামেশাই। স্যারেরা ও জানতেন সে কথা। স্কুলের মাঠ ছিল, পাশের মাঠের থেকে বেশ ছোট। তাই ছেলেদের আকর্ষণ এর কেন্দ্র বিন্দু ছিল, পাশের মাঠটা।
তো অনিরুদ্ধ অঙ্ক পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষা আধা ঘন্টা শুরু হয়েছে। এমন সময় পাঁচিলের ওপাশের মাঠ থেকে জয়ন্তর চুপি চুপি আহ্বান ... " এই অনি , আর কত লিখবি ? বাড়ি যাবি না ?" অনি চমকে তাকিয়ে জয়ন্তকে দেখতে পায়, আড় চোখে দেখে স্যার মন দিয়ে খবর কাগজ পড়ছেন। অনিরুদ্ধ আস্তে উত্তর দেয় -"যাব ? সব অঙ্ক তো করিনি।"
জয়ন্ত আস্বস্ত করে, "সব করতে হয় নাকি ? আমি ও সব করিনি"।
ব্যাস, খেল খতম, স্যার কে খাতা জমা করে সোজা বাড়ি। মা অবাক হয়ে বলেছিলেন-" তুই এখন বাড়ি ফিরে এলি ? তোর না আজ পরীক্ষা ছিল ?"অনির সোজা সাপটা জবাব ছিল-" জয়ন্ত ডাকলো যে !!!" সেই প্রাচীন মা একগাল হেসে বলেছিলেন-"দেখো ছেলের কাণ্ড !!!"
কোন বকুনি নেই, মার নেই.....ভাবা যায় ? সেই মায়ের কাছেই আরো বড়ো বয়সে দুষ্টুমি র জন্য বকুনি, মার সব ই জুটেছে। এখন সব ই একটু যেন অন্য রকম।

"কি গো, আপন মনে হাসছো কেন ? বেড়াতে এসে পেগলে গেলে ?" রীমির কথায় চমক ভাঙে অনিরুদ্ধর। রীমি মেয়েকে নিয়ে কখন ফিরে এসেছে , খেয়াল ই করেনি সে ।অনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জানে , বলে , সেই যেদিন মা তোমার ফটো খানা দেখিয়ে , বললেন .... " দেখ্ তো অনি , মেয়েটাকে পছন্দ হয় কিনা ? রীনা দির পাশের বাড়িতে থাকে।".... ব্যাস্ , হয়ে গেলো আমার। সেই থেকেই তো আমি পাগল তোমার জন্য । বুঝতে পারলে এতদিন পর ?"- ছদ্ম গাম্ভীর্যের আড়ালে, মুচকি হেসে বলে অনি।  রীমি খিলখিলিয়ে হেসে বলে -" তাই বুঝি ? সত্যিই বুঝিনি কিন্তু ।" কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনি বলে-" বুঝবে কি করে, আবার নতুন করে স্কুলে ভর্তি হলে , কতো পড়া, কতো লেখা !! "
রীমি একটু থমকায় , মুখে মেঘ, রোদের আনাগোনা শুরু হয়।মুখ অন্য দিকে ঘোরায়। অনি বলে, " এখানে কিন্তু রান্নাঘর নেই।" অবাক হয়ে , রীমি অনির দিকে মুখ ফেরায়, বোঝার চেষ্টা করে, অনির কথার অর্থ।
"রান্নাঘর !!!! মানে কি ?" অনি মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়। একটু থেমে বলে , "বিয়ের পর থেকে ই দেখেছি , যখন‌ই রেগে যাও, রাগটা আরো তাতিয়ে নিতে রান্না ঘরে হাঁটা দাও । আর কান্না পেলে গন্তব্য কলঘর , I mean বাথরুম । তাই বলছিলাম যে , এখানে তো....."
" কি বাজে বকতে ই না পারো তুমি !!!! "-রীমি হাসতে হাসতে অনিকে থামিয়ে দেয়।এর মধ্যে , মায়ের ওড়নার পুটুলি ভর্তি ঝিনুক নিয়ে আসরে টিকলি হাজির হয়।
"টিকলি , এত ঝিনুক তুই নিজে কুড়িয়েছিস ?"-বাবার প্রশ্নে টিকলি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। টিকলি মায়ের দিকে তাকিয়ে, মাকে বোঝার চেষ্টা করে, অনি টিকলি র মনোভাব ধরতে পারে। বলে..." চিন্তা করিস না। আজ মা কতদিন পর হাসছে দেখেছিস ? মাকে কি সুন্দর লাগছে বল !! "
টিকলি একটু আস্বস্ত হয়, মাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে, অনেক দিন পর রীমি ও মেয়েকে আদর করে , কোলে তুলে নেয়, গালে হামিতে হামিতে ভরিয়ে দেয়। অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে বলে, "এমা !! এতো বড়ো মেয়ে কোলে উঠে আদর খাচ্ছে ?" মা আর মেয়ে বিশেষ কান দেয় না। যেন বহুদিন পর একে অপরকে কাছে পেয়েছে নতুন করে। হঠাৎ টিকলি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় , বলে -  আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিই , না মা  ?"
এক নিমেষে পরিবেশ ভারি হয়ে যায়। রীমি , একটু যেন চমকায় ,  হঠাৎ রীমির দুচোখ ছাপিয়ে নামে জলের ধারা। অনিরুদ্ধ ওদের কাছে উঠে আসে। বলে..." নাও, এবার থামো। Cut...cut....cut.

রাতে, টিকলি কে ঘুম পাড়িয়ে, রীমি ওদের room এর বারান্দায় এসে , অনিরুদ্ধর পাশে বসে। "টিকলি ঘুমালো ? "-অনির প্রশ্নে সম্মতি জানায় রীমি।রীমি একটু ঘন হয়ে আসে অনির দিকে। এভাবে কিছুক্ষন কেটে যায়। কেউ কথা বলে না। ভালো লাগা টা উপলব্ধি করতে কথার প্রয়োজন হয় না। প্রথম নিরবতা ভাঙে অনিরুদ্ধ -" কতো দিন পর তুমি এভাবে এলে আমার পাশে বসতে । এত দূরে দূরে থাকো কেন ? কিসের এতো চিন্তা তোমার ?" রীমি, অনির হাত চেপে ধরে। কাঁধে মাথা রাখে। অনি বলে - " মেয়ের  জন্য চিন্তা করার সময় এখনো আসেনি রীমি। ও এখন কুঁড়ি। ফুটে উঠছে। একটু একটু করে। ওকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটে উঠতে দাও। ও পারছে না। ঠিক পারবে। সময় দাও। স্কুল ওদের বুঝতে চাইছে না। তুমি,আমি ও ওকে বুঝবো না ?"
রীমির চোখ ছলছল করে ওঠে, "কিন্তু অনি , তাহলে যে...." । অনিরুদ্ধ রীমিকে থামিয়ে দেয়...."কোন কিন্তু নয় , পড়াও , কিন্তু জোর দেবে না। ওকে পড়া ভালোবাসতে শেখাও, বোঝাও। ভীতি তৈরি হলে আরো মুশকিল হবে। কি ভাবে বোঝালে সহজ হয় বোঝা, তা নিয়ে ভাবো, আলোচনা করো। দেখবে উপায় বেরবে ই। কেউ দ্রুত শেখে, কেউ ধীরে শেখে। আমি ও ছুটির দিন দেখব, যতটা পারি।"
"তুমি ঠিকই বলেছ। আমার যে সেদিন কি হলো ? এতো মারলাম মেয়েটাকে !!!"-রীমি ফুঁপিয়ে ওঠে। অনি , রীমির পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়- " আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেদিন আমিও যত না কষ্ট পেয়েছিলাম, তার থেকে অবাক হয়েছিলাম বেশি। ভাবছিলাম যে তুমি তো এমন বদমেজাজি ন‌ও। তাহলে কি হোলো তোমার ? " রীমি কোনো উত্তর দেয় না। অনি , রীমির চোখের জল মুছে দেয়। আস্তে আস্তে বলে- " ও কিছু জানে না, বোঝে না এমন তুমি ভাবো, অথচ এটা তো দেখলে না, ওর মন টা কত অনুভূতি প্রবণ !!! ও মনে মনে ভাবে যে , ওর পড়া ঠিকমতো না পারার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে।" রীমি আবার ফুঁপিয়ে ওঠে। অনি , রীমির হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলে - " অনেক রাত হয়েছে। আর না। এবার ঘরে চলো। "

পরের দিন ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে , টিকলি অবাক !!! সেই ছোট্ট বেলার মতো মা আজ সকালে তাকে অনেক অনেক হামি দিয়ে , ঘুম থেকে জাগিয়েছে। টিকলি র তো বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে ই করছে না। কলকাতায় ফিরে গেলে মা কি আর এত আদর করবে ? মিষ্টি করে হেসে কথা বলবে ? আসলে তার যে মাঝে মাঝে পড়তে মোটেই ভালো লাগে না, কি করে সে ? রীতম একদিন স্কুলে বলছিল যে, জানিস তো অনুরীতা, মা বলেছে, আমাদের সবার মাথায় একটা পোকা আছে , সেটা যখন নড়াচড়া করে, তখন ই আমরা দুষ্টুমি করি।  প্রথমে অনুরীতা ওরফে টিকলি বিষয়টা নিয়ে খুব সংশয়ে ছিল !!! এখন বুঝতে পেরেছে যে ওই পোকার জন্য ই যত সমস্যা। ওই পোকার জন্য ই তো সেদিন বসার ঘরের দেওয়ালের ওপর ফুল এঁকে রং করে, কি বকুনি ই না খেলো !! তারপর একদিন স্কুলে ওর বন্ধু তোতার খাতায় ছবি এঁকে দিয়েছিল।অবশ্য ওই বকুনি তোতা ই খেয়েছে বাড়িতে মায়ের কাছে, কিন্তু তোতা পরদিন আড়ি করে দিয়েছিলো। অঙ্ক খাতায় একদিন বাংলা লিখে ফেলেছিল !!! আর‌একদিন ক্লাসের জানালা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল ,বেঞ্চের নীচে বসে একদিন পেনসিল আর রবার নিয়ে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছিল !!! একদিন জল ছিটিয়ে দিয়েছিল আনন্দির গায়ে , মন্দারের ব‌ই লুকিয়ে রেখেছিল । এমন আরো কতকিছু যে টিকলি করে, সব ই তো পোকার নড়াচড়া র জন্য।
যে কথা রীতমের মা জানে, তার মা কেন জানে না ? এ প্রশ্ন ও মাঝে মাঝেই খুব ভাবায় টিকলি কে।
"কি হে ? এতো কি ভাবনা চিন্তা হচ্ছে টিকলি বুড়ি ?"-বাবার কথা য় আপাতত টিকলি ভাবনায় চাবি দেয়। বাবা , টিকলি র মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে পাশেই বসে আর টিকলি ও সাথে সাথে বাবার কোলে উঠে বসে। "আচ্ছা, বাবা আমরা এখানেই কেন থাকি না ?" অনি একটু হেসে উত্তর দেয়-" তোর ভালো লেগেছে ?"টিকলি এক নিঃশ্বাসে বলে-" খুউউউউউব"।অনি বলে --"ওই জন্য ই তো ফিরতে হবে রে মা।  রোজ রোজ থাকলে তো ভালো লাগবে না। " নাহ্ , এই যুক্তি কি আর টিকলি বোঝে ? তার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অনি বলে-" আমরা আবার এখানে আসবো।" একটু আস্বস্ত হয় টিকলি , " বাবা বাড়ি ফিরে ও মা আমাকে এমন আদর করবে তো ???? " অনি এবার জোরে হেসে ওঠে। টিকলি র কানে কানে বলে -"  চিন্তা করিস না। মা কে আর বকতেই দেবো না । একটা ওষুধ দিয়েছি তোর মা কে। আর বকবে না। তুই ও একটু মায়ের কথা শুনিস। বেশি দুষ্টুমি করিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি।"
টিকলি চোখ গোল গোল করে বলে, " বাবা আমাকেও মাথার দুষ্টুমি পোকার জন্য ওষুধ দাও তো। তাহলে আমি ও আর দুষ্টুমি করবো না।" এবার অনির চোখ গোল করার পালা। "কি পোকা ? দুষ্টুমি পোকা ? " নাহ্, বাবা ও জানে না। অগত্যা রীতমের কাছ থেকে জানতে পারা তথ্যের পরিবেশন  করে টিকলি তার বাবার কাছে। অনিরুদ্ধ হোহো করে হেসে ওঠে। টিকলি র থুতনি নাড়িয়ে বলে - " বেড়ে বলেছেন তো তোর বন্ধুর মা । আর দেখা যাচ্ছে তোদের ও বেশ পছন্দ হয়েছে। "
রীমি , এতক্ষণ হোটেলের ফুলের বাগান ঘুরে দেখতে গিয়েছিল , রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে - " টিকলি র আবার কি পছন্দ হোলো ?"
মাকে দেখে টিকলি একটু দমে যায়। এসব মনের প্রাণের কথা তার বাবার সাথেই হয়। মা শুনলে বিস্তর ঝামেলা বাধার সম্ভাবনা । বাবা টিকলি র অবস্থা বুঝে, সামাল দেয় ---" সে সব আমাদের বাপ মেয়ের private talk , তোমার শোনা মানা।" রীমি একটু হেসে , বিষয়টা আর ঘাটায় না। কারণ অনি একসময় ঠিকই তাকে সব বলবে।আর সর্বোপরি এখন আর কোনো বিষয় নিয়ে মন কষাকষি সে চা‌ইছেই না। কালকে রাতে , অনি যা যা বলেছে, তা নিয়ে মনের ভিতরে একটা দোল চাল চলছে । অনির কথা ও ঠিক, আবার যত‌ই বলি আমাদের এখানকার শিক্ষা পদ্ধতি সঠিক নয় , এর বাইরে আমরা যাব ই বা কি করে ? আর প্রতি বছর এর মধ্যে দিয়েই তো ছাত্র ছাত্রীরা যাচ্ছে।
অনি , রীমির অন্যমনস্কতা খেয়াল করে, বলে - " টিকলি চল আমরা মাকে নিয়ে সমুদ্রে স্নান করে, আমাদের সব দুঃশ্চিন্তা জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।আর ওই সব রাগের পোকা, দুষ্টুমির পোকা গুলো কে ও জলে ফেলে দিয়ে আসি।"
রীমি  অনিরুদ্ধ র কথার মানে বোঝার আগেই, অনি আর টিকলি হৈ হৈ করে সমুদ্রের দিকে পাড়ি দেয়। রীমি ও আপাততো সব চিন্তা স্হগিত রেখে বাবা ও মেয়েকে অনুসরণ করে।
এভাবে সব কিছু সাথে নিয়েই চলতে হবে। সুস্থ, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। সব কিছু র মধ্যের আনন্দকে খুঁজে নিতে হবে। দুঃখ কে জয় করতে হবে। ।

No comments:

Post a Comment