স্মৃতিটুকু থাক
শুচিস্মিতা ভদ্র
সমুদ্রের জলে ফসফরাস থাকে, তাই এত রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাড়ে জলরাশির আছড়ে পড়া এত দূর থেকেও রত্নাকর দেখছেন।একের পর এক ঢেউ আসছে, আবার আসছে, আবার আসছে........।অবিরাম এর কোনো শেষ নেই। এখন রাত প্রায় দুটো, রত্নাবলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কিন্তু রত্নাকরের আজ ঘুম আসবে না ।
কী অদ্ভুত নাম "রত্নাকর"।বাবা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ? এই প্রশ্ন করলে শুধু হাসতেন, কোনো উত্তর দিতেন না । স্কুলে, কলেজে , বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র বন্ধুরা নামকরণ করে দিয়েছিল।এমনকি কলেজের মানব স্যার ও দস্যু রত্নাকর বলে সম্বোধন করতেন। এক এক সময় খুব অভিমান হোতো বাবার ওপর। আর কী অন্য কোনো ভাল নাম ছিল না !!!! একদিন কাছে ডেকে মানব স্যার বলেছিলেন "নামে কিবা আসে যায় !!! যে রত্নাকর সেই তো মহা কবি বাল্মীকি, তা কী ভুলে গেছো ?"
খুবই শান্ত শিষ্ট ছিলেন। রত্নাবলী র সাথে যখন বিয়ে হলো, তখন বাসরে শ্যালিকারা নামটি নিয়ে মজা করার সুযোগ ছাড়েনি মোটেই।
যাইহোক এই বছর ফাল্গুন মাসে তাদের বিয়ের সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হল।সেই দিনে ও দুজনের কেউ ই জানতেন না যে ভবিষ্যৎ এ কী অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য।
"কাল রাতে ঘুমাওনি না গো ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে রত্নাকর একটু অবাক হন। "তুমি কি ভাবো, আমি কিছুই টের পাবো না ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে, একটু অসহায় লাগে রত্নাকরের। চায়ের কাটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখেন। হোটেলের বারান্দা থেকে ভোরের সমুদ্রকে একবার দেখে নেন। বলেন-- "ঘুম আসছিলো না, আর আজই তো ফেরার ট্রেন, তাই ভালো করে রাতের নির্জন সমুদ্র কে দেখছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো ।তুমি রাগ করলে রত্না ?
রত্নাবলী হেসে ফেলে, আবার মায়া ও হয় । ভাবেন--এরপর কি হবে? এত সংবেদনশীল মানুষটার মনটাকে কে বুঝবে? কিন্তু না; এসব কোনো কথাই তিনি বলেন না।তাহলে যে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। এবারের ভ্রমণে কোনো মন খারাপের কথা বলা চলবে নাযে।এমন কথা তো এখানে আসার আগে দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবু ও মনের উপরে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন দুজনেই। খুব স্বাভাবিক।আসলে আজ ই তো তাদের ঘরে ফেরার দিন। ট্রেন সন্ধ্যায় ।এই হয়তো তাদের একসাথে কাটানো শেষ ভালো কিছু মুহূর্ত।হয়তো ই বা ভাবছেন কেন ? এটা ই তো তাদের শেষ ভ্রমণ।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে, স্বামীর দিকে তাকান রত্নাবলী। সেখানেও কষ্টকে চাপা দেওয়ার কষ্টকর প্রয়াস দেখতে পান।কিন্তু এমনটা আজ কেন হচ্ছে কে জানে ? এখানে কি আসার পর থেকে গত চারদিন তারা দুজনে যা আনন্দে কাটালেন, তা মনের মণিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মনের জোরে কিছুটা ঘোরাফেরা ও করেছেন গত কয়েকদিন।
বিগত মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই রত্নাবলী অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাঝে মাঝে মধ্যেই ভীষণ হাপিয়ে যাচ্ছিলেন।নিছক হার্টের সমস্যা ই ভেবেছিলেন।কিন্তু না না রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও কিছুই সঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।ওনারা নিঃসন্তান।কাজেই সব রকম ছুটোছুটি করে রত্নাকর ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন।কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি।শেষে নানা রকম পরীক্ষা র শেষে ডাক্তার সন্দেহ করেন যে রত্নাবলীর শরীরে কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধি আশ্রয় নিয়েছে। যেদিন সেই রোগ সম্পর্কে ডাক্তার সহ ওনারা দুজনেই নিশ্চিত হন, সেদিন রাতে রত্নাকর খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। এক নিমেষে যেন বয়সটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
রত্নাবলী কাছে এসে , রত্নাকরের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিলেন--"এসো আজ আমরা একে অপরকে একটা প্রতিশ্রুতি দিই।" অবাক চোখে রত্নাকর তাকিয়ে ছিলেন, রত্নাবলী আবার বলেছিলেন ---"তোমার এমন হেরে যাওয়া , অবসন্ন মুখ আমি দেখতে চাই না।তুমি তো কিছু লুকোওনি আমার কাছে , আমি তো সবটা জানি, কাজেই এই দিন গুলো একটু অন্য ভাবে কাটাই আমরা । চলো না গো , আমরা বিয়ের পর পর যে সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম , সেখানেই আবার যাই।"
"কিন্তু রত্না তোমার শারীরিক কষ্ট. ......" রত্নাকর কে থামিয়ে দিয়ে রত্নাবলী বলেছিল-"শারীরিক কষ্টের জন্য যা করণীয়, ওষুধ পথ্য সব চলুক তাতে আপত্তি করিনি তো ! কিন্তু মন ভরে একটু ঘুরে আসি আমরা দুজন।"
রত্নাকর আপত্তি করেননি।ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেই মতো সব বন্দোবস্ত করেই তারা চলে এসেছিলেন কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে।অসুস্থতা সম্বন্ধে কাউকে বিশেষ জানাননি।কি হবে ? অহেতুক মানুষজনকে বিব্রত করার ঘোর বিরোধী ওরা দুজনেই।
শুধু আসার আগে নিজেদের কাছেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন যে, এ কদিন কোনো দুঃখের ছোঁয়া যেন তাদের ধারে পাশে না থাকে। শারীরিক কষ্ট তো কিছু আছেই, থাকবে ও , কিন্তু তা যেন তাদের আনন্দে আঁচড় কাটতে না পারে ।
রত্নাকর , রত্নাবলী নামের দিক থেকে আশ্চর্য মিল।তাদের দুজনের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত এসেছে আর পাঁচ জনের মতো ই ।দুজনের অনেক মিল, অমিল জীবনে চলার পথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এবার বোধহয় দ্বৈত জীবনের ছন্দপতনের সময় এসে গেছে।
ওনারা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের " বোঝাপড়া" কবিতার বিখ্যাত কটি লাইন মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।খুব সহজ নয় বটে, তবে অসম্ভব ও নয়---"মনে রে আজ কতো যে, ভালো মন্দ যাহা আসুক, সত্য রে লও সহজে।"
শুচিস্মিতা ভদ্র
সমুদ্রের জলে ফসফরাস থাকে, তাই এত রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাড়ে জলরাশির আছড়ে পড়া এত দূর থেকেও রত্নাকর দেখছেন।একের পর এক ঢেউ আসছে, আবার আসছে, আবার আসছে........।অবিরাম এর কোনো শেষ নেই। এখন রাত প্রায় দুটো, রত্নাবলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কিন্তু রত্নাকরের আজ ঘুম আসবে না ।
কী অদ্ভুত নাম "রত্নাকর"।বাবা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ? এই প্রশ্ন করলে শুধু হাসতেন, কোনো উত্তর দিতেন না । স্কুলে, কলেজে , বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র বন্ধুরা নামকরণ করে দিয়েছিল।এমনকি কলেজের মানব স্যার ও দস্যু রত্নাকর বলে সম্বোধন করতেন। এক এক সময় খুব অভিমান হোতো বাবার ওপর। আর কী অন্য কোনো ভাল নাম ছিল না !!!! একদিন কাছে ডেকে মানব স্যার বলেছিলেন "নামে কিবা আসে যায় !!! যে রত্নাকর সেই তো মহা কবি বাল্মীকি, তা কী ভুলে গেছো ?"
খুবই শান্ত শিষ্ট ছিলেন। রত্নাবলী র সাথে যখন বিয়ে হলো, তখন বাসরে শ্যালিকারা নামটি নিয়ে মজা করার সুযোগ ছাড়েনি মোটেই।
যাইহোক এই বছর ফাল্গুন মাসে তাদের বিয়ের সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হল।সেই দিনে ও দুজনের কেউ ই জানতেন না যে ভবিষ্যৎ এ কী অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য।
"কাল রাতে ঘুমাওনি না গো ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে রত্নাকর একটু অবাক হন। "তুমি কি ভাবো, আমি কিছুই টের পাবো না ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে, একটু অসহায় লাগে রত্নাকরের। চায়ের কাটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখেন। হোটেলের বারান্দা থেকে ভোরের সমুদ্রকে একবার দেখে নেন। বলেন-- "ঘুম আসছিলো না, আর আজই তো ফেরার ট্রেন, তাই ভালো করে রাতের নির্জন সমুদ্র কে দেখছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো ।তুমি রাগ করলে রত্না ?
রত্নাবলী হেসে ফেলে, আবার মায়া ও হয় । ভাবেন--এরপর কি হবে? এত সংবেদনশীল মানুষটার মনটাকে কে বুঝবে? কিন্তু না; এসব কোনো কথাই তিনি বলেন না।তাহলে যে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। এবারের ভ্রমণে কোনো মন খারাপের কথা বলা চলবে নাযে।এমন কথা তো এখানে আসার আগে দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবু ও মনের উপরে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন দুজনেই। খুব স্বাভাবিক।আসলে আজ ই তো তাদের ঘরে ফেরার দিন। ট্রেন সন্ধ্যায় ।এই হয়তো তাদের একসাথে কাটানো শেষ ভালো কিছু মুহূর্ত।হয়তো ই বা ভাবছেন কেন ? এটা ই তো তাদের শেষ ভ্রমণ।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে, স্বামীর দিকে তাকান রত্নাবলী। সেখানেও কষ্টকে চাপা দেওয়ার কষ্টকর প্রয়াস দেখতে পান।কিন্তু এমনটা আজ কেন হচ্ছে কে জানে ? এখানে কি আসার পর থেকে গত চারদিন তারা দুজনে যা আনন্দে কাটালেন, তা মনের মণিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মনের জোরে কিছুটা ঘোরাফেরা ও করেছেন গত কয়েকদিন।
বিগত মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই রত্নাবলী অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাঝে মাঝে মধ্যেই ভীষণ হাপিয়ে যাচ্ছিলেন।নিছক হার্টের সমস্যা ই ভেবেছিলেন।কিন্তু না না রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও কিছুই সঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।ওনারা নিঃসন্তান।কাজেই সব রকম ছুটোছুটি করে রত্নাকর ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন।কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি।শেষে নানা রকম পরীক্ষা র শেষে ডাক্তার সন্দেহ করেন যে রত্নাবলীর শরীরে কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধি আশ্রয় নিয়েছে। যেদিন সেই রোগ সম্পর্কে ডাক্তার সহ ওনারা দুজনেই নিশ্চিত হন, সেদিন রাতে রত্নাকর খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। এক নিমেষে যেন বয়সটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
রত্নাবলী কাছে এসে , রত্নাকরের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিলেন--"এসো আজ আমরা একে অপরকে একটা প্রতিশ্রুতি দিই।" অবাক চোখে রত্নাকর তাকিয়ে ছিলেন, রত্নাবলী আবার বলেছিলেন ---"তোমার এমন হেরে যাওয়া , অবসন্ন মুখ আমি দেখতে চাই না।তুমি তো কিছু লুকোওনি আমার কাছে , আমি তো সবটা জানি, কাজেই এই দিন গুলো একটু অন্য ভাবে কাটাই আমরা । চলো না গো , আমরা বিয়ের পর পর যে সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম , সেখানেই আবার যাই।"
"কিন্তু রত্না তোমার শারীরিক কষ্ট. ......" রত্নাকর কে থামিয়ে দিয়ে রত্নাবলী বলেছিল-"শারীরিক কষ্টের জন্য যা করণীয়, ওষুধ পথ্য সব চলুক তাতে আপত্তি করিনি তো ! কিন্তু মন ভরে একটু ঘুরে আসি আমরা দুজন।"
রত্নাকর আপত্তি করেননি।ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেই মতো সব বন্দোবস্ত করেই তারা চলে এসেছিলেন কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে।অসুস্থতা সম্বন্ধে কাউকে বিশেষ জানাননি।কি হবে ? অহেতুক মানুষজনকে বিব্রত করার ঘোর বিরোধী ওরা দুজনেই।
শুধু আসার আগে নিজেদের কাছেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন যে, এ কদিন কোনো দুঃখের ছোঁয়া যেন তাদের ধারে পাশে না থাকে। শারীরিক কষ্ট তো কিছু আছেই, থাকবে ও , কিন্তু তা যেন তাদের আনন্দে আঁচড় কাটতে না পারে ।
রত্নাকর , রত্নাবলী নামের দিক থেকে আশ্চর্য মিল।তাদের দুজনের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত এসেছে আর পাঁচ জনের মতো ই ।দুজনের অনেক মিল, অমিল জীবনে চলার পথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এবার বোধহয় দ্বৈত জীবনের ছন্দপতনের সময় এসে গেছে।
ওনারা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের " বোঝাপড়া" কবিতার বিখ্যাত কটি লাইন মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।খুব সহজ নয় বটে, তবে অসম্ভব ও নয়---"মনে রে আজ কতো যে, ভালো মন্দ যাহা আসুক, সত্য রে লও সহজে।"
No comments:
Post a Comment