Tuesday, 18 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৪

অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে দিতেই একে একে ওর্ডারী খাবার সার বেঁধে ওয়েটার দের হাতে হাতে হাজির হল এবং নিমিষের মধ্যেই ঘরের ছোট টেবিলখান হাঁক পাড়ল ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রবে। খাটের ওপরে একখান বাড়তি কাপড় পেতে সেখানেও কিছু প্লেট স্হান পেল !! ভাগ্যিস আমার মায়ের আমলের অথবা তেমন ভাবনার কোন অংশীদার সাথে ছিলেন না ... বকুনির ঠেলায় খাবারকে যাবার পথ দেখিয়ে, ওই চাদর আদর করে কাচাকুচি করতে হোতো !!! আর মা থাকলে প্রথমেই কপালে করাঘাত সাথে বাক্যাঘাতে আমি সহ সবাই হতাম কাত !!! আমি যেমন পুপেকে কিছু শেখাতে পারছি না ভেবে আকুল হচ্ছি , মা কেঁদে আকুল হতেন তার শিক্ষার অবস্থান বিছানা নিয়েছে দেখে !!! বিছানা যে সিনিয়র ও জুনিয়র ছানাদের শোয়া / বসার জায়গা , খাবারের স্থান না , তা আমরা সবাই জানি , তবে কিনা বেড়ানোর সময় অনেক নিয়ম নাস্তি হয়ে যায় আর তাতেই মেলে স্বস্তি !!! 

খাবারের বহর দেখে দিবাকর সহ আমিও আঁতকে উঠলাম !!! যদিও ওর্ডার প্লেস করার সময় আকাশ খাই , পাতাল খাই এমন ক্ষিদে পেটে করতাল বাজাচ্ছিল। তবে এমন রাজকীয় লাইন লাগানো খাবারের খান দুই প্লেট আর কোনোমতেই কারোর পেটেই জায়গা বের করতে পারল না। সে খান টেবিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল !!! খাওয়া আর গল্পের ফাঁকে রাত বাড়তে লাগল। আমরা তিন রাতের খাবার বাতিল করলাম। ওরা ঘরে গেলেও , পুপের দিবাকর আঙ্কেল আগেই ক্লান্তি কাটাতে চলে গিয়েছিল পাশের ঘরে !!! ওরা দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেষ রাতের জন্য খাবার হিসেবে ডাল - ভাত আর আলু ভাজা চালু করলেও, আমরা ঘুম চালু করে দিলাম। আর এ দিকের কর্তামশাইও হিসাবপত্তর বাদ দিয়ে সত্তর বিছানা বিলাসী হয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন !!! 

পরের দিন আমাদের ঘোরাঘুরির শেষ দিন। অল্প কিছু দেখার পালা সাঙ্গ করে সেদিন আমাদের রাজগীর থেকে গয়াতে ফেরার কথা। গয়া থেকেই আমাদের কলকাতা ফেরার ট্রেন বন্দেভারত। যা ছাড়বে দুপুর ৩.১৫ তে আর হাওড়াতে ঢুকবে রাত ৯.৩০ এ। পরেরদিন আমাদের ঝুলিতে ছিল জঙ্গল সাফারি। যেখানে বিশেষভাবে প্রস্তুত বাসে করে আমরা নানান ঘেরাটোপ পেরিয়ে ঢুকবো জঙ্গলের বাসিন্দাদের ডেরায়। যদি তেনারা দেখা দেন এই আশায় , দেখাশোনা র পাট মিটিয়ে পরের অংশের দরজা চিচিংফাঁক হবে। এক এক প্রজাতির জন্য নির্দিষ্ট এক এক এলাকা। রাজগীরের একদিকের পাহাড়ি এলাকা ঘিরে প্রস্তুত এই চিড়িয়াখানা , এখানকার এখনকার অন্যতম আকর্ষণ। এ হাল আমলের সংযোজন। আগে ছিল না। আরও আছে এ্যাডভেঞ্চার সাফারি । এই সাফারি র অনলাইন বুকিং এর ব্যবস্থাপনা । আমাদের দলের অনলাইনের মোডে সড়গড় দিবাকর জঙ্গল সাফারি র বুকিং করে রেখেছিল। তবে অন্য সাফারি র বুকিং মেলেনি। জনতা জনার্দন এখন ভয়ানক এ্যাডভেঞ্চার প্রেমী। যখন তখন এ্যাডভেঞ্চারের ঠেলায় মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা !!! কাজেই ইচ্ছে থাকলেও আমাদের সে ইচ্ছাপূরণ হল না। এই বুকিং ঘন্টা খানেকের স্লটে বিভক্ত । আমরা সাফারির প্রথম স্লটেই বুকিং নির্দিষ্ট করেছিলাম , দিবাকর কে আগেই বলা ছিল। কারণ সেদিন জঙ্গল ভ্রমণ মঙ্গলময় হবে তখনই যদি তা আমরা সকাল ১১ টার আশপাশ দিয়ে শেষ করতে পারি !! কারণ এক আমাদের ফিরতি পথ ধরতে তো হবেই আবার সে পথের শেষাশেষি পেট পূজোর জন্য সময়ও রাখতে হবে। 

সব লটবহর গুছিয়ে , জলখাবার খেয়ে আমরা সময় মতন হাজির হলাম জঙ্গল সাফারি র দুয়ারে । সেদিন সকাল থেকেই আমাদের মনটা ভার , ভ্রমণের শেষক্ষণ আগত , আর অদ্ভুত ভাবে দিনটার হালহকিকতও গোমড়া থেরিয়াম। আকাশের মুখ ভার। ঝকঝকে ভাব গায়েব। বেজায় ভিজে ভিজে আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। আমরাও সেই মতন মুড়িঝুড়ি দিয়ে সব রকম সাবধানতার বর্ম সেঁটে কয়েক প্রস্থ দুয়ারে মোবাইল বুকিং এর মোবাইল ছবি এক এক দ্বারে দণ্ডায়মাণ এক এক রক্ষী কে দেখিয়ে তাদের দেখানো পথ ধরে এক বাস স্ট্যান্ড সদৃশ ঝাঁ চকচকে জায়গার লাইনে খাঁড়া হলাম। সাথে সাথে আর্মি পোশাক সদৃশ রঙচঙে সম্ভবত ২৫ আসনবিশিষ্ট বাস হাজির হল। আমাদের লাইন এগিয়ে বাসে সিঁধিয়ে গেল। বাসখান সামনে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল , আবার অপেক্ষা । নাহ্ , আমরা লাইনে ছিলাম আইন মেনে খানিক পিছে । এবার লাইনের সামনে চলে এলাম আর আমাদের আসন নিয়ে অল্প পরেই হাজির হল পরের বাস। ছোট্ট, সুন্দর। বিশালাকার পুরু কাচের চকচকে জানালার পাশে আমি বসলাম ক্যামেরা বাগিয়ে , বাকিরাও বসে পড়ল যে যার মতন । 

বাস চলতে শুরু করতেই বাস চালকের সহকারি সুন্দর ভাবে আমাদের বলে দিলেন যে খান দুই দরজা পেরিয়ে প্রতিবার আমরা এক এক আবাসিকের অন্দরমহল না হোক বাহিরমহলে ঢুকব , অন্দরমহল থেকে তারা দেখা দেবেন কিনা তা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছে। আর বাসের ৭০% যেহেতু স্বচ্ছ কাঁচে ঢাকা যে কোন দিক থেকেই কিছু না কিছু দেখতে পাবই। এখানে অঞ্চলের ভাগযোগ স্পষ্ট। যিনি বা যারা যেখানে থাকছেন সেখানে অন্য জনের প্রবেশাধিকার নেই , বলা ভাল উপায় নেই । না হলে মানা করলে তারা থোড়াই শুনতেন !!! কথা শুনতে কার ই বা ভাল লাগে ??? মনুষ্য কূল পশুকূল সবার ধরণ এ ক্ষেত্রে একদম সমান সমান ।

প্রথমে ই বাস খানিক পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলো দরজার চিচিংফাঁক হতে , তারপর চলতে লাগল মেঠো পাহাড়ি পথ বেয়ে । কিছুটা যাবার পর হরিণ এর নাম লেখা ধাম হাজির ... দুখান গেটের খোলা বন্ধের পর্ব চুকিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাস গতি কমিয়ে ধীরে চলতে থাকল আমরা সারে সারে নানান প্রজাতির হরিণ দেখলাম মেলাই। বেরনোর সময় আবার চিচিংফাঁক পর্ব। এরপরের এলাকার নেমপ্লেটে দেখা দিলেন ছবি সহ ভালুক মশাই। ডবল দরজার আন্দরে ঢুকে দেখি সপরিবার বসে আছে অভ্যার্থনা জানাতে । তবে মনুষ্যেতর তো !! তাই একজন পিছন ফিরে বসেই অভ্যার্থনা জানালেন। আমরা দেখলাম তবে ইদানিং আমার চোখের দৃষ্টির গোলমাল চলছে তাই হবে বা , ছবি র অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে করতেই কয় খান মুহুর্ত সময় গলে বেরিয়ে গেল। তবে ছবি কিছু সফল ভাবেও উঠল । পরের এলাকা চিতা ... তাদেরও বেশ ভালোই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ঘটল। এমন কি একজন খানিক দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আপন খেয়ালে তাকেও খানিক দূর ওবধি পিছু ধরে দেখাও হল। ছবিও উঠল তার চলে যাওয়ার। কেউই ... "না যেও না"বলার সুযোগও পেলাম না । এবারে গাড়ি ঢুকলাম থমথমে পরিবেশে মামা বাড়িতে । এ মামা তো আর হাসিখুশি চাঁদ মামা নন , একদম রাগি রাগি বাঘ মামা ।পাহাড়ের বেশ উঁচুতে উঠে এসেছি আমরা , মালুম হচ্ছিল।পদ মর্জাদা বলে একখান ব্যাপার আছে না ?? তা ভুললে হবে ??? কিন্তুক মামা কই ?? হেনকালে রাজকীয় বাঘ মামার রঙ্গমঞ্চ প্রবেশ হল বেশ নাটকীয় ভাবে। মামা হাঁটছিলেন বাসের বেশ খানিক সামনে দিয়ে। আমাদের বাসে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। মোবাইল নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আমাদের বাহন চালক দাদাভাই বাস চালিয়ে মামার পিছনে যতটা কাছে নিয়ে যাওয়া যায় যেতে থাকল। বাঘ মামা তা বুঝে , বাসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, যেন অজানিতে ... এমন ভাব। মুখে হাঁ করা হাসিখুশি ভাব । যেন ছবি তোলার জন্য রেডি। যুগের হাওয়ার কি লীলা !!! পশুকূলে ওবধি ছবি তোলার হাওয়ার নাচন দেখা যাচ্ছে। বলতে নেই বেশ মিনিট পাঁচেক কি তার বেশি বাঘ মামা দিলেন ক্ষমা ঘেন্না করে ছবি তুলতে। মুশকিল হল আমার চোখের দৃষ্টি আর বাসে আমার সীটের অবস্থান, সর্বোপরি সামনের ঝোপের জন্য সামনা সামনি ছবি আমার কপালে জুটল না। তবে দিবাকর বাসের ভিতরে সামনের দিকে এগিয়ে তুলে আনল লাখ টাকার বাঘ মামার ঘ্যামা ছবি !!! এদিকে বাস ভর্তি ইয়ং জেনারেশনের উচ্ছাস খানিক হুংকার দিয়ে থামাতে আমার কর্তামশাই। তেনারা দাঁড়িয়ে মোবাইল তাক করে আমাদের মহিলাকূলের দর্শনে ব্যাগড়া দিচ্ছিলেন বিস্তর !!!

এরপর ??? হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে একদম রাজার মতন ফের চলতে শুরু করলেন বাঘ মশাই। ভাব খানা ... অনেক হোলো ... এবার যাও তো বাছা রা !!! এই ফটো তোলার নামে তোমরা সব ভুলে যেতে পারো । তবে আমার ওতো ছবি তুলতে বয়ৈ গেছে !!! 

এরপরের দরজার ওপারে থাকার কথা আরেক মামার তিনি সিংহ মামা। তবে বাহন চালক দাদা র থেকে শুনলাম...সদ্য মামা পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে তাই তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল। অন্দরমহল থেকে উঁকি মারার সম্ভাবনা কম । আমাদের ড্রাইভার দাদার সম্ভাবনা মিলে গেল। এই জঙ্গল ভ্রমণে আমরা একমাত্র রাজা মশাই এর দেখা পেলাম না। এই অন্য ধরণের ঘোরার উত্তেজনার মাঝে সময় যে কখন একছুটে সকাল ১১পার করব করব করেছে কারো খেয়ালেই ধরা দেয়নি। এরপরেই আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। নেমে দেখি একখান ময়ূর ওখানকার সাজানো গথেকেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছে যেতে দিল না ওখানকার কতৃপক্ষ।  দূর থেকেই সেই পোষা ময়ূরের কিছু ছবি নেওয়া হল । এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম গয়ার উদ্দেশ্যে। 

সারা ট্রিপের শেষে তখন সবার শরীরে ক্লান্তির ঢল। খানিক গল্পে , খানিক ঘুমিয়ে আমরা গয়াতে পৌঁছে এক হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সেদিন ছিল গতবছরের শেষদিন। হোটেলের ভিতরের মাঠে ইংরেজি নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন চলছিল জোরকদমে। খেয়ে আমরা গয়া স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।

স্টেশনের কাছাকাছি এসে পুরো তীরে এসে তরি ঢোবার কেস ... যানজটের এমন জটিল কুটিল মাকড়সার জাল সদৃশ অবস্থান বাপু আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না , যদিও বেনারস , ভাইজাগে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ঝোলাতে তুলেছি আগেই। কিন্তুক এ তার থেকে খানিক খানিক বেশি ডিগ্রীধারি, আর অদ্ভুত ভাবে নজর করলাম ওই যানবাহনের জটে মানুষ চালিত দু চাকা , তিনচাকা, চারচাকা তো বটেই গরুর গাড়িও আছে !!! সর্বোপরি আমাদের সাথের ড্রাইভার দাদা ভাবলেষ হীন মুখে যখন ঘোষণা করলেন যে এমন অবস্থার আরো খানিক ঘোরালো পানা না হলে ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিলবেই না , তখন আমি হরিবোল ধ্বনি তুলে হেসেই ফেললাম। কারণ মামলা গভীর করার ধারা আমাদের এ বাড়ির খানদানী ধারা , গভীরে না গেলে কোন রোগ বালাই এর নিদান দেওয়ার বিধান নেই পরিবারের কারো কারো জন্য 😄। কাজেই এই বিষয়ক আলোচনা আমার মজা পাওয়ার খোরাক জাগিয়ে দিল। ওদিক তখন শুনতেই পাচ্ছেন না , এমন মুখ নিয়ে জট পাকানো অবস্থা অবলোকন করছিলেন। কিছু পরেই ঘোরালো ব্যাপার আরো খানিক ঘোরালো হল ... আমাদের সাথের দাদাভাই ( আমার কর্তামশাই) কোন ভাবেই এখানে গাড়িপত্তর ম্যানেজ করার সুযোগ পেলেন না , কারণ গাড়ির দরজা খোলার উপায় নাই আর জানালা দিয়ে আমরা কর্তা-গিন্নি কেউ গলতে পারব বলে মনে হয় না !!! হেনকালে ঠিকঠাক গোল বেঁধেছে বুঝে লাঠি হাতে ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিলল। আর .... তারপরেই গাড়ি গতিপ্রাপ্ত হল। ঠিক আমাদের এদিকের হালহকিকতের অন্য উদাহরণ ... আমার কন্যার ডেঙ্গু হওয়ার পর যখন সে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরল বাড়ির চারদিকে ব্লিচিং ছড়াতে এল প্রশাসন। বললে ... বুঝলেন না ?? আমরা সাবধান হচ্ছি , কাজ করছি । আরো দেওয়া হবে যে যে বাড়িতে হয়েছে !!! এ হলো গিয়ে ... রোগ হওয়ার পরে সাবধানতা স্কিম .... "যস্মিন দেশে যদাচার "

স্টেশনের কাছে পৌঁছলাম। বন্দেভারত দণ্ডায়মাণ। আমরা ফের একে অপরকে বাই করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এবারও আমি গেলাম দেখা করতে , আমার সাথে রূপা এল । দুই বন্ধুর গল্পে গল্পে সাথে আনুষঙ্গিক পাট গোটাতে গোঠাতে অনেক অনেক স্মৃতির ঝোলা পূর্ণ করে রাত সাড়ে নয় টা তে হাওড়া তারপর ঘরে ফিরে এলাম। ঠিক হল আবারও আমরা এক সাথে বেড়াতে যাবোই যাব। কেমন ????

Friday, 14 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৩ 

রাজগীর অর্থাৎ অতীতের রাজগৃহে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। শহরের জনবহুল এলাকাতে হোটেলের অবস্থান। হোটেলের ঘরে ঢুকেই গোলোযোগ চরমে উঠল। কারণ পাশাপাশি ঘরের একখানের সাজনগোজন বেশি তা নিয়ে ছোট দুজনের কাজিয়া। বলা ভাল আমার কন্যার মতামত চরমে। ওদিকের সিদ্ধার্থ তার স্বভাবসিদ্ধ ধারা মেনে মুখে মেঘ জমিয়ে ঠিক পাশের অল্প সাজানো ঘরে ফিরে গেল। ঘটনা খান চাক্ষুষ করে আমার মেজাজ সাই সাই করে উঠে গেল গরমে। মন ভেঙে খান খান হয়ে গেল !!! এ কি কথা বলো দেখি ??? একসাথে বেড়ানোর মানে কি শুধুমাত্র দর্শন। নেই কোন শিক্ষণ ??

আমরা একবার কুচে পুপেকে নিয়ে হাজির হয়েছিলাম আগ্রাতে, দুখান ঘরের একখান হোটেল মালিকের মুনাফা বাড়াতে দু দিকের সারবদ্ধ হোটেল রুমের মাঝের চৌকোনা হলের মাঝে অবস্থিত ছিল .... দেখলেই বোঝাই হয়ে বোঝা যায় পরে এ ঘরের সংযোজন, ফলে জানালা নেই কোনো। ছাদের কাছাকাছি একখান স্কাইলাইট ছিল কি ছিল না , আজ সময়ের তলে চাপা !!! তবে দিনমানেও আলো না জ্বালালে সে ঘরে ৩৬৫ দিনেই রাতের অবস্থান ঘাটি গেড়েছিল । সেই ঘরে আমাদের তিনজনের বিশেষ করে ছোট জনার হুটোপুটি করতে অসুবিধার কথা মাথায় রেখে , সত্য দা রা ঢুকতেই দেয়নি। যদিও বেড়ানোর কাণ্ডারি সুমিত দা এই ঘর খানা ই আমাদের জন্য না বুঝে বরাদ্দ করেছিলেন কলকাতাতে বসে ফোনাফুনির মারফত। এমন ছড়ানো দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের ঘোরার পরতে পরতে , সেখানে এ কোন ধারায় বইছে আমাদের পুপে দেবী ??? বকুনির তোড়ে গাল ফুলিয়ে মালপত্তর এধার থেকে তুলে ওধারে নিতে না নিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে রূপা রুখে দিল আমাকে। আবার পুপেকে রেসকিউ করতে দল বেঁধে ওদিকের তিনজন হাজির .... অগত্যা আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। চিন্তা কিন্তুক মনে থেকেই গেছে । কিছুই কি শেখাতে পারছি না ?? 

আমাদের প্রত্যেকের জীবন জুড়ে আছে গল্পের মেলা । হয়তো তা সাধারণ বা অসাধারণ , কিন্তু গল্প আছেই। আমার অনেক ছোট্ট কালের মাস খানেকের গল্প লেখা হয়েছিল এই রাজগীরে। মনের গুপ্ত কোণ থেকে আবছায়া হয়ে যাওয়া ছবিতে আছে একটা বাড়ির শুধুমাত্র দোতলায় ওঠার সিঁড়ি , যা উঠে এসেছে দোতলার ঝুল বারান্দায় , বারান্দার শেষ প্রান্তে অবস্থিত রান্নাঘরে রন্ধনরত আমার মা আর দিদিমা । আর আছেন আমার বাবা। তবে তার সাথে কাটানো গল্প যা স্মৃতির তল থেকে উদ্ধার করে বের করতে সক্ষম হলাম ... সেখানে রাজগীরের প্রধান দুই আকর্ষণ অদ্ভুত ভাবে জড়িত। সেখানে সেই দোলতা বাড়ির ঘরের কোন ছবি নেই। প্রথম আকর্ষণ অবশ্যই রাজগীরের তপ্ত পাণী বা উষ্ণ প্রস্রবণ। স্মৃতির বোতামে চাপ পড়লে ভেসে ওঠে আমার আর বাবার ওই প্রাকৃতিক গরমজলে অবগাহন দৃশ্য সাথে কোন এক প্রাণীর মুখাকৃতি বিশিষ্ট নল দিয়ে পড়া জলের দৃশ্য। ঠিক যেন চলচ্চিত্রের flashback !!! দ্বিতীয় আকর্ষণের কথায় পরে আসছি । না কৌতুহল বাড়ানোর জন্য নয় । যথাস্থানে তা প্রয়োগের জন্য। অসুস্থতার কারণে বাবা র শরীর সারাতে চিকিৎসকের পরামর্শে আমরা রাজগীরে একমাসের জন্য ভাড়া ছিলাম। সাময়িক শরীর সারলেও, পরবর্তী কালে তা স্থায়ী না হওয়ার ফলে আমার জীবনের আরো এক গল্প লেখা শুরু হয়েছিল। যাক সে কথা আমি আপাতত এই গল্পেই ফিরি ... রাজগীরের মধ্যের দেখার স্থান ছড়ানো চতুর্দিকে। আর সব থেকে মজার ঘটনা এই যে এখানে পুরাণ আর ইতিহাস জড়াজড়ি করে একাকার । তাই আমাদের গন্তব্যের লিষ্টিতে এই মহাভারতের ভীম তো ওই ইতিহাসের অজাতশত্রু বিম্বিসার সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ডাক দিচ্ছেন । এখানের রাস্তার দখল নিয়েছে আধুনিক যানবাহনের সাথে সাথে আগেকার ঘোড়া চালিত টাঙ্গা । 

গোড়া থেকেই শুরু করলে দেখা যাবে যে হোটেলের জনা কয়েকের নিদান বিধান মেনে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘোরাঘুরি কেটে ঘচাং ফু করে দিলেন সাথের দুই কর্তামশাই। মনটা হু হু করে উঠল। শুনলাম হোটেল থেকে জানা গিয়েছে ঘোড়া নাকি উল্টে যাওয়ার অভিজ্ঞতাযুক্ত। এমন অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই কো ? যে ঘাবড়ে যাব ???? কে তর্ক করবে ?? তর্ক বিদ্যা আয়ত্ত করে খাতায় বেশি নম্বর শুদ্ধ করা আর তার প্রয়োগ করা কি আর এক রে ভাই !!! অগত্যা সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে সাজু গুজু করে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে টোটোগামী হলাম। দরদাম করে উঠে পড়লাম। এবার আমি ভিতরে তাই একই ভাবে সবাই চেপে আটকে গেল। আমার কর্তামশাই নামক গদি গদি ব্যাপারে হেলান বলো ঠ্যাসান বলো দিয়ে আমি ভিতরে গদিওমান হলাম। চলল টোটো !!! কিন্তুক এ কি ??? ঠাণ্ডা হাওয়ার কাঁপন তো হাড়ে মজ্জায় সিধিয়ে যাচ্ছে !!!! আগের দিন কতকের অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে আমরা দুই মোটা মুটি তো গরম বস্ত্র সব হোটেলে রেখে এসেছি। পুপে পরেছে বটে অল্প সল্প !!! দিবা ফ্যামিলি খানিক খানিক সাবধানী হলেও পুরো সাবধান হয়নি !!! এ ব্যাপারে আর মেয়ের ব্যপারে চিন্তিত এদিকের বাবা জেগে উঠলেন .... অতঃপর টোটো পথে ঘুরপাক খেয়ে হোটেল ফেরত এলো আর আমরাও রূপা সহ ঘরে এসে বর্ম এঁটে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম সত্যি সত্যিই। রকমবেরকমের গরম বস্ত্র না থাকায় রূপার আদর করে দেওয়া শ্রাগ সাদরে গায়ে চাপিয়ে , টুপি তে কান ঢেকে খোলতাই হয়ে টোটোতে চেপে বসলাম। শ্রাগ খান যদি আমার মতন আকার প্রাপ্ত হয় , আমার দোষ নেই কো !!! বারবার সতর্ক করেছিনু !!! কারণ রূপা তণ্বী আমার মতন হস্তিনী নয় একেবারেই। পথে বেরিয়ে খানিক এগোতেই আবার টোটো ডাক তুলে অচল হল। শুনলাম , কিছু নাকি যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দিয়েছে । একটু পরেই আবার বাহন চালকের কিছু খুটখাটে টোটো সচল হল। 

এরপর একে একে মণিয়ার মঠ , সোনভাণ্ডার , বিম্বিসার জেল , মহাভারত খ্যাত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম আর জরাসন্ধের মল্লভূমি, শ্রীকৃষ্ণের রথের চাকার দাগ সব দেখতে দেখতে পুরাণ আর ইতিহাসের মাঝে লুকোচুরি খেলতে খেলতে টোটো থেকে নামা আর ওঠার মাঝে দিন চলে যেতে থাকল । মণিয়ার মঠের গল্প ভাল করে না বুঝে সকলে নানান ধারায় ছবি তুলে ফেললাম , রিল এ till now জ্ঞান গম্যি একদম নেই .. .ভাগ্যিস !!! তাই সেদিকে হাঁটলাম না। এমনিতেই জ্ঞান গম্যি কি কমতি ? একবার বড় ক্যামেরা একবার মোবাইল ক্যামেরা ভরতেই দম যাই যাই করছিল !!! আমার বড় ক্যামেরা খান বেশ ওজনদার। যদিও গত ভ্রমণ থেকে পুপে খানিক খানিক ক্যামেরাবাহকের কাজ করে দেয় !!! এক প্রস্থ নিজের , আরেক প্রস্থ ফেসবুক নামক সমাজের জন্য সেবামূলক ছবি তোলার দায়িত্ব কেউ না চাইতেও স্বেচ্ছায় নিয়েছি বলে কথা !!! তবে ???

সোনভাণ্ডার শুনলাম যে , সে নাকি বিম্বিসারের রত্ন ভাণ্ডার !!! গিয়ে অসংখ্য দর্শনার্থীদের সাথে দেখলাম আমাদের অসংখ্য পূর্ব পুরুষ গুহার আগে পিছে , গাছের গাছে দোল খাচ্ছে , বসে আছে !!! সে সব দেখে মল্লভূমি নাম স্বার্থক করে , প্রায় প্রায় যুদ্ধ করে ভিড় ঠেলে উঁচু সিঁড়ি বেয়ে সে সব দেখার পরেই ভোজবাজির মতন ময়দান ফাঁকা হতে দেখে , ইতিউতি তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম তার কারণ !!! সুন্দর নিরালা ঝকঝকে দিন আর আমরা ছাড়া আর কিছুর দেখা পেলাম না। বুঝলাম ঝাঁকের কই এর মতন একঝাঁক ভ্রমণার্থি , যারা অধিকাংশ ওদিকেরই গ্রাম গঞ্জের মানুষ, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভীম ভবানী ও জরাসন্ধের গল্পের গন্ধে গন্ধেই এই পবিত্র ভূমিতে ঝাঁপিয়ে কাঁপিয়ে ফের অন্য দর্শনীয় স্থানের কাঁপাতে সে দিক পানে চলে গেছে। আমরা নিরালাপ্রিয় কলকাতা বাসী। নিরালার খোঁজে কিছু না পেলে একদা অখ্যাত নিরালা নামক রেস্টুরেন্ট মুখী হতাম গড়িয়াহাটে। কাজেই ওখানকার বেঞ্চি আঁকড়ে খানিক বসে ফের চালু হলাম । পৌঁছলাম সেখানে , যেখানে বেশ খানিক পাহাড়ি পথ জুড়ে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের রথের চাকার দাগ। মা এক অতি প্রচলিত প্রবচন বলতেন সব সময়েই ... "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু , তর্কে বহুদূর "। কাজে কাজেই .... দেখার পালা মিটিয়ে আমরা পৌঁছলাম বিম্বিসারের জেল নামক স্থানে। একখান প্রশস্ত ফাঁকা খানিক উঁচু মাঠ , বন্দীশালার কোন চিহ্ন চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলেও অতীতের সাক্ষ বাহী ইঁটের দর্শন পেলাম , কারণ উঁচু ভিতের ইঁট সেই প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করছিল । এই বন্দীশালার জানালা দিয়ে বিম্বিসার দর্শন করতেন গৌতম বুদ্ধের নিকটস্থ পর্বত যাত্রাকে। কথিত আছে ওই পাহাড়ের শান্ত নির্জনতায় বুদ্ধদেব পায়ে হেঁটে যেতেন ধ্যান মগ্ন হতে । ওখানেই এখন অবস্থিত শান্তিস্তুপ । যা আমাদের সেদিনের দর্শনের তালিকাভুক্ত করাই ছিল। এসব দেখার পর খানিক এগিয়ে পথের একপাশে টোটো চালক আমাদের নামিয়ে টাঙ্গা ঠিক করে জানিয়ে দিলেন যে , শান্তিস্তুপ ওবধি যাওয়ার আগের কিছু পথ পাড়ি দিতেই আমাদের টাঙ্গার সাওয়ারি হতেই হবে। নিয়ম এখানে তেমনই। এই পথের শেষ মিশেছে আমার সেই স্মৃতি বাহিত দ্বিতীয় আকর্ষণের দুয়ারে। শান্তিস্তুপ উঠতে গেলে ভরসা হাঁটা পথের সাথে এক চেয়ারযুক্ত রোপ-ওয়ে আর নতুন শুরু হওয়া কেবলকার । এই একজন বসার উপযুক্ত চলমান চেয়ার জুড়েই আমার স্মৃতি জড়িত। এই চলমান চেয়ারে বাবার কোলে চড়ে পিছনের দুই চেয়ারে বসা দিদিমা আর মাকে টুকি দিতে দিতে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে শান্তিস্তুপ দেখতে গিয়েছিলাম।

অনেক কসরতের পর ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা চড়ে সকলে চলে এলাম স্মৃতি সরিয়ে বাস্তবের কেবলকারের টিকিট কাউন্টারে। একচেয়ারে যাত্রার সাহস এখন বয়সের সাথে সাথে স্মৃতির তলায় । আর বিগত বছরের কোন এক অ্যাক্সিডেণ্টের কারণে তা এখন আপাতত বন্ধ। নতুন যুক্ত হয়েছে ঘেরাটোপ বন্ধী দরজাযুক্ত উন্নত কেবলকার, যার সাথে বেশ আলাপ পরিচয় হয়েছে আগের বেশ কিছু বেড়ুর সময়। কিন্তুক টুকটাক খাবার খেয়ে কাউন্টারের সামনে এসে জনসমুদ্র দেখে আঁতকে উঠলাম সকলেই। ভাগ্যিস সাথে রূপা ছিল। নাহলে বাকিরা যা ব্যাকগিয়ার দিতে শুরু করেছিল ক্ষিদের দোহাই দিয়ে !!!! শান্তিস্তুপ দেখা ভোগে যেতো ঠিক । আমি আর রূপা আইন মেনে লাইনে সেঁটে গেলাম। পাকাপোক্ত এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের অপেক্ষার শেষে মেওয়া থুড়ি টিকিট পেলাম । এবার গেলাম কেবলকার চড়ার আরেক গোলকধাঁধার লাইনে । গোল গোল ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় পাহাড়ের গায়ে আমার সেই ছোটবেলার স্মৃতির থমকানো চলমানচেয়ার কে ঝুলে থাকতে দেখলাম !!! এখন কোনোমতেই ওতে উঠতে পারতাম না , ধরতাম কিনা সেটাও বড় প্রশ্ন 😄 !!!! এরপরের গল্প ঝটপট এগিয়ে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে কেবলকার চড়ে , শুধু একখান কেবলকারে সবার হল না । অগত্যা দুই ছানা ও অজানা তিনজনা সহ রূপা এগিয়ে যেতেই পরের কেবলকারে আমরা বাকিরা অচেনা আরো তিন সহ আসীন হয়ে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের ওপরে। দর্শন, প্রদক্ষিণ, ছবি সব মিটিয়ে আসে পাশের অসংখ্য কোপিকুল থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে লাইন পেরিয়ে এক কেবলকারে সকলে মিলে হুঁস করে পাহাড়ের পাদদেশে নেমে এলাম।

এরপরে হঠাৎই পেটের খাই খাই রব আমাদের চটজলদি টাঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেল। তখন দিনের শেষে রোদের তেজ কমিয়ে ঠাণ্ডা তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে নিচ্ছিল। হেনকালে টাঙ্গাতে উঠতে গিয়ে আঙুল মটকে নেলপালিশ রাঙানো একখান নখ শহীদ হল সাথে ব্যাথার ঠেলায় একশা। ছোট থেকেই মায়ের থেকে আতুশী শিরনাম ভূষিতা আমি , আবাক হয়ে চুপ করে ব্যথাখান গিলতে গিলতে হোটেল ফেরত এলাম !!! 

বাকিরা ঘরে চলে গেলেও আমরা দুজন রূপা সহ রান্নাঘর মুখী হলাম। আগের দিন হোটেলে ঢুকে পেট পূজোর উপকরণ পেতে বেশ সময় গড়িয়ে গিয়েছিল । তাই এই বেঁধে নিয়ে যাওয়ার তালে আমরা ওদিকে হাজির হয়েছিলাম । কিন্তুক এদের সার্ভিসে হতাশ হয়ে দ্বিতীয় পাণ্ডবের সম পরিমাণের কাছাকাছি খান কতক পদ বেশি বেশি করে ছয়জনার জন্য ওর্ডার করে ঘর মুখী হলাম । সারাদিনের ঘোরার ক্লান্তি তখন শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সাথে শরীরের চার্জ নামক খাবার তখনও রান্নাঘরের মধ্যেই নানান রূপে আকার প্রাপ্তির পথে । তাই আমরা আশার আলো জ্বালিয়ে ঘরে নিজেদের ঘসা মাজার করে অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে থাকলাম .... 


Wednesday, 5 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫২

রাত পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হল আরো একটা ঝকঝকে তকতকে দিন। বেড়াতে গেলে দিনক্ষণ আর বারের হিসাব বরাবর থাকে না আমার। তা আবার ফেরত আসে ফিরতি পথ ধরে ধীরে ধীরে। যাওয়ার দিন আর ফেরার দিনের মাঝে পুরো সময়টা বেহিসেবী । যার খেয়াল রাখেন এ দিকের তিনি। তেনার বেজায় খেয়াল। সেদিন আমাদের সকাল সকাল বোধগয়ার পাট গুটিয়ে নালন্দা ঘুরে রাজগীর যাওয়ার কথা । থাকার কথা পূর্ব নির্ধারিত নালন্দা রেসিডেন্সিতে। যেটির অবস্থান রাজগীরে। রাজগীর অর্থাৎ রাজগৃহ পুরাণ আর ইতিহাসের এক খিঁচুড়ি সমৃদ্ধ স্থান। সেই খিঁচুড়ির সহযোগের ঘৃত বলো ভাজা বলো তা হল আমার একান্ত আপন কিছু অতীত স্মৃতি। যা ক্রমশ প্রকাশিত হোক। এখন চলি রাজগীরের দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথের ধারের গল্পেরঝুলি উপুড় করতে করতে। 

পেটকে সকালের খাবার সহযোগে শান্ত করে , সব গুছিয়ে নিয়ে বেলা নয়টা নাগাদ বেরিয়েই পড়লাম নালন্দার উদ্দেশ্যে । ম্যানেজার সামনে , দুই ছানা সহ রূপা মাঝে , ঝটতি পড়তি বাকি দুই পিছে নিজেদের গুছিয়ে বোধগয়াকে টাটা করলাম। গাড়িতে ভোজপুরি সুরবাহার ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই আমরা বলি ও টলি উডকে youtube মারফত ধরে ফেললাম। নতুবা আমাদের সকলের সকালের ভোজ ভোজবাজির মতন হজম না হয়ে বদহজমের দিকে পা বাড়াতো । তবে বদহজমের কিছু উপাদান এদিকে গুজতে গুজতে চলল আমাদের দুই পরিবারের দুই জুনিয়র। 

ওই একখান এমন জায়গা , যেখানে আপামর বাবা মা নিজে থেকেই টাইট 😥। আমার মামাতো দাদা ভয়ানক ম্যাও বিদ্বেষী ছিলেন , আমার মায়ের সাথে তার নিত্য ঝঞ্ঝাট হোতো এই ম্যাও প্রীতি নিয়ে আমার মায়ের বিবাহ উত্তর সময়কালে। সেই দাদা র একমাত্র কন্যা হল খানদানী ম্যাও প্রীতিযুক্ত।কিছু ক্ষেত্রে তার পিসি ঠাম্মার থেকেও এগিয়ে গেল সে। হালের চালচিত্রে এখন খান আটেক ম্যাও সহ আমার সেই দাদা এখন প্রবল ম্যাও ভক্ত 🙃। 

এ ও তেমন গপ্প। আমাদের পছন্দের গানের ওপর দুই ছোট নানান রকম বেরকমের আমাদের অপছন্দের গান চাপাতে চাপাতে চলেছিল । এই চাপাচাপি আর বাছাবাছিতে কখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তো কখনও ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল। 

এদিকে বিহারের প্রকৃতি খানিক রুখা শুখা হলেও গ্রাম বাংলার মতন এক এক জায়গার তাল , খেজুর আর আরো হরেক রকম গাছ কোথাও জড়িমড়ি করে , কোথাও দূরে দূরে অবস্থান করে এক প্রাকৃতিক ছবি আঁকতে আঁকতে চলেছিল। গাড়ির বেগ তার সাথে প্রকৃতির নিত্য নতুন ধরতে না পারা রূপকে পিছনে ফেলে আর মনের ক্যামেরাতে ভর্তি করতে করতে আমরা চলে এলাম সেই গহলৌর নামধারী গ্রামে , যেখানে থাকতেন এক আপাত ক্ষ্যাপাটে মানুষ দশরথ মাঝি, যিনি সবার হাসির পাত্র হয়ে একা একাই পাহাড় কেটে পথ বানাতে শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে । তার ২২ বছরের চেষ্টার ফল ভোগ করছে আজকের গেহলৌর গ্রামের মানুষ জন। এই গ্রাম গেহলৌর, গেলহৌর পাহাড়ের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন ছিল কাছের শহর ওয়াজিরগঞ্জ থেকে । যে কোন কাজে ওই শহরে যেতে গেলে পেরোতে হোতো আরো ৫৫ কিলোমিটার হাঁটা পথ । দশরথের বৌ একবার পা পিছলে পাহাড় থেকে পরে মারা যায় কাছের শহর ওয়াজির গঞ্জের হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই। সেই শোক দশরথকে পাহাড় কেটে পথ তৈরির প্রেরণা জোগালো। আজ তিনি নেই, কিন্তুক আছে পাহাড় কেটে তার শুরু করা সেই পথ , যা পরবর্তি কালে তাকে করেছে বিখ্যাত , তার দূরদর্শিতা কে সাধুবাদ জানিছে সারা দেশ। এখন রাস্তার ছড়াছড়ি সারা গ্রাম জুড়ে , শহর জুড়ে , দেশ জুড়ে। যখন গরিবের কথা বাসি হয়ে দামি হল , তখন তাকে দাম দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তারই গ্রামের আরো কিছু যুবক । পথ শেষ হয়েছিল ২২ বছর পর। আজ তিনি নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর তৈরি করা সেই পথ। দশরথ আমরা মাঝিকে নিয়ে বলিউডি ছায়াছবি The Mountain man দেখেছিলাম বেশ কিছু বছর আগে । এবারে দেখলাম সেই পাহাড় কেটে তৈরি করা পথ । গাড়ি থেকে সকলে ভাগযোগ করে খানিক নামলাম , ওই পথ এখন ব্যস্ততম পথ। তার ব্যস্ততা আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে গাড়িতে তুলে দিল। থামার উপায় নাস্তি। ঘোরার উপায় মায় ছবি তোলার উপায় নাস্তি !!! আমরা গ্রামের পথ পেরিয়ে যেতে লাগলাম অল্প কিছু ছবি তোলার পরেই। গাড়ির মধ্যেই টুকটাক গান শোনার পাশাপাশি গল্প , খাওয়া চলছিল। একবার ওর মধ্যেই অন্য কোন এক গ্রামের পথের গোলকধাঁধায় মেলাই গাড়ির ভিড়ে আমরা নট নড়নচড়ন হতে না হতেই তিনি ট্রাফিক সার্জেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । এ তেনার আরেক অভ্যাস। কর্ম জনিত পশার হোক না হোক এমন আরো কয়েক দিকে সম্ভাবনার অন্ত নেই। বাকি সম্ভাবনা ক্রমশ প্রকাশ্য। কারণ তেনার মূল পেশা পাবলিক ঘেষা, আর তাতেই মাঝে মাঝে গোলযোগ মেশার মেলাই সম্ভাবনা। মেশেও বিস্তর। 

যাক সেসব মিটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম গয়া পেরিয়ে রাজগীরের দিকে। রাজগীর পেরিয়ে সিধে পথ আমাদের নিয়ে যাবে আমার স্বপ্নের নালন্দাতে। সেখানে ঘুরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা যাব পাওয়াপুরী। তারপরে ফিরতি পথে রাত্রি ও পরের গোটা দিন-রাত যাপনের সাকীনে হাজির হবো। এমনই বাসনা নিয়ে দুপুর নাগাৎ নালন্দা চত্বরের সামনে হাজির হলাম। গাড়ি থেকে নামার আগেভাগেই কজন টোটো নাকি অটোওয়ালা হাজির আমাদের বাহন চালকের চোখের ইশারায়। এদিকের কড়া দৃষ্টির ফাঁদ কি যে সে !!! আমরা কজন তো আর একটু হলেই টো টো করে ঘুরে দেখব বলে উঠে পড়ছিলাম আরকি টোটোতে ... রূপা আর আমার কর্তামশাই কটমটিয়ে ওদের ভাগিয়ে , আমাদের জাগিয়ে দিল। তারা জাদুঘর ঘুরিয়ে , নতুন গড়ে ওঠা নালন্দা ঘুরিয়ে এ দিকে আসবে ... এমন বার্তা মেলে ধরেছিল। আমি , দিবাকর বার্তা শুনে ভাড়া গোনাগুনি শুরু করতে না করতেই তেনারা আমাদের খপাৎ করে ধরে আমার দেখার ইচ্ছের আদর কদর করে ঝটিতি পদে সবাইকে নিয়ে স্বপ্নের সফরের টিকিট কাটতে নালন্দা চত্বরে ঢুকে পড়ল। আগু পিছু করে ঢুকেই লক্ষ্য স্থির হল একদম । সাথে পেলাম বয়ঃজৈষ্ঠ এক পথ প্রদর্শক গাইড। "গাতা রহে মেরা দিল" এর গাইড নাই হোক , চাপ নেই তবে মনে পুরো "আজ ফির জিনে কি তামান্না" র সুর বাজতে লাগল। নাচটা আমার আসে না ... একদমই। এই যা রক্ষে !!!! শুনতে শুনতে ফটো না তোলার ফতোয়া জারি করলেন তিনি। না ... রাগের প্রশ্ন ই নেই !!! অসংখ্য ভ্রমণার্থির ভিড় বাঁচিয়ে , হল্লাহাটির থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনে নিয়ে দেখতে বললেন তিনি আর তখনইফটো তোলার বিধান দিলেন। আমরা সেই মতন ইতিহাসের মাঝে হারানোর সাথে সাথে দেখার কাজ করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। শীতের ছুটিতে বিশালাকার চত্বরে মানুষের ঢল নেমেছে। স্কুলের থেকে আগত ছাত্র ছাত্রীদের সাথে এসেছেন তাদের শিক্ষক শিক্ষিকা। ভ্রমণার্থি রয়েছেন দেশী ও বিদেশী। বাংলা বিহার উড়িষ্যা তখন এক । ভিন্ন নয় ।তখন ছিল না প্রাদেশিকতার দ্বন্দ্ব । এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান সহ আরো অনেক কিছুর শিক্ষা দেওয়ার খবর শোনার পর থেকেই আমার পুপে একটু ভড়কে ইতি উতি চেয়ে ওসব এখনও কোথাও উঁকি মারছে কিনা দেখে নিচ্ছিল !!! আহা রে , এত ভয় পেলে চলে ? মা ভীতু হলে তাকেও কি হতে হবে ?? এ কেমনতর কথা !!! পুরুষ সিংহ পিতাশ্রীর মতন তো অনেক কিছুই আছে । তবে আসলে নকলে মোদ্দা কথা এই যে, দুজনের থেকে ভাগযোগ করে ভাল মন্দ জড়ো করেছে আমাদের কন্যা রত্নটি। যাক ওসব কথা আপাতত চাবি বন্ধ থাকাই ভাল। ওই চাবি তো একমাত্র ঘুরু ঘুরুর সময় non functional থাকে। 

এক সময় ইতিহাস বই বন্ধ হলেও আমরা দেখতে লাগলাম ঘুরে ফিরে । মন ভরে । গাইড কাকু সব বুঝিয়ে , হিসেব পত্তর বুঝে চলে গেলেন । যাওয়ার আগেভাগেই আমরা শষ্য ভাণ্ডার , ছাত্রাবাস সহ আরো অনেক কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে , ছাত্রাবাসের একটা ছাদবিহীন ঘরে নিজেদের মেলে ধরে মেলাই ছবি তুলে নিলাম। অতীতের এক বলিউডী চলচ্চিত্রের গানে দেখা নালন্দার চত্বর দেখে মুগ্ধতা ভরে নিচ্ছিলাম মনের অন্দরে। আমাদের গাইড কাকু ছিলেন বয়স্ক মানুষ। তিনি যখন যুবা , তখন ওই চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণ দেখেছিলেন সে গল্প ও তার মুখে খানিক শুনে নিয়েছিলাম , সব দেখা ও শোনার মাঝে । 

এরপর প্রশস্ত চত্বরে ছড়ানো ধ্বংসাবশেষের মাঝে এক গাছের নিচে সকলে বিশ্রাম নিতে বললেও , প্রথমে রূপা ও তার পিছে পিছে আমি হারানোর গানে গা ভাসালাম। ওরা বসেই রইল, আমরা মোবাইল ও ক্যামেরা সহ আরো খানিক ঘুরপাক খেয়ে গাছ তলায় ফেরত এলাম । এবারে সকলেরই খেয়ালে সময় আর ক্ষিদে দুইই ধরা পড়ল। ফিরে চললাম খাবারের সন্ধানে। বেরিয়েই প্রথমে সেদ্ধ ছোলা র চাট খেয়ে খানিক ক্ষিদে আটক করে কাছের এক খাবারের দোকান অ্যাটাক করা হল। ধুমায়িত ভাত , ডাল , ভাজা , স্যালাড, ডিম , চিকেন কারি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা পাওয়াপুরী র পথ ধরলাম। 

দিনের শেষাশেষি পৌঁছলাম পাওয়াপুরী। পথের একদিকে এক জৈন মন্দির, যার কারুকাজ দেখার মতন আর পথের অপর দিকে এক পদ্ম সরোবরের মাঝে জৈন ধর্ম গুরু মহাবীরের সমাধিস্থল। পাওয়াপুরী জৈন ধর্মের তীর্থ ভূমি। এখানেই জন্ম লাভ করেছিলেন ২৩তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর। তার কর্ম ভূমিও ছিল এই পাওয়াপুরী। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন পাওয়াপুরী পৌঁছলাম তখন অহেতুক কিছু কারণে মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। প্রথমেই যে কারণ জন্য বিরক্তির উদ্রেক হল তা হল প্রচণ্ড ভিড় । আর দ্বিতীয়ত এখানে ছবি তোলার বিধিনিষেধ। পদ্ম সরোবরে পদ্মের দেখা মিলল না আর ভিড়ে ভড়কে গিয়ে যদি কিছু কেপমারি হয় , বিশেষত ফোন , যা এখন আমাদের জিয়ন কাঠিও বটে !! তাই আমার অতি সাবধানী তিনি তাড়া লাগিয়ে বের করলেন আমাদের। খানিক মন্দির চত্বরে বসলেও ভিড়ের জন্য ফিরে এলাম। গাড়িতে উঠে বাহন চালকের পাশটির দখল নিতেই পিছনে আমার কন্যার হাহাকার ধ্বনিত হল , শান্ত সিষ্ঠ সিদ্ধার্থ কে সে বলল ... " youtube এর দখলদারী মায়ের হাতে গেল রে !!! ঘুম পাড়ানী গানে এবার ঠিক ঘুম আসবে !!!!" ওসবে কান দিলে চলে না !!! লেগে পড়লাম গানের আসরের গান বাছাই করতে। 

এক সময় আঁধার নামা পথে টাঙ্গা দেখতে পেলাম। যাওয়ার পথেও দেখেছিলাম !!! পরের দিনের দিনপঞ্জীর ছক কাটতে কাটতে দেখি বিশাল এক হোটেল কম্পাউণ্ডে গাড়ি ঢুকছে জ্বলজ্বলে লেখায় দেখলাম হোটেল রাজগীর রিজেন্সী। কিন্তুক টুকটাক শোনা স্মৃতি হাতড়ে পাচ্ছি অন্য নাম ... হোটেল নালন্দা রিজেন্সী। এ কি ধন্ধ রে বাবা !!! বাহন চালক সন্দিহান !!! পরে ধুন্ধুমার না বেঁধেই সব পোস্কার ( পরিস্কার) হল। আগে একবার ওদিকে গিয়েছিল সে , এদিকের বোর্ডার কে নামাতে , তাই এবার ওদিকের বোর্ডার দের এদিকে হাজির করে দিয়েছে। কি মুশকিল বলো দেখি। আর আমরা ৫ তারকা খচিত হোটেল দেখে হেঁচকি তুলছি গাড়ির ভিতরে বসে ই !!! নামার ভরষা পাচ্ছিলাম না যে !!!! কর্তামশাই অবশ্যি এসবে ড্যাম স্মার্ট আর দিবাকর তো আবার বিদেশেও বসবাস করে ফেলেছে। কাজেই এই হেঁচকিতে তেনারা সাথে ছিলেন না । যাক শেষ মেষ হেঁচকি থামিয়ে যথাস্থানে বোঁচকা নামিয়ে আমাদের বাহন চালক হিসেব মতন সব বুঝে নিয়ে চলে গেলেন আর আমরা আমাদের রাজগৃহ যাপন শুরু করে দিলাম ।

Saturday, 1 February 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫১

পরের দিন যথারীতি ভোর ভোর ঘুম পাট গোটালো। প্রথমেই নিজের ধোলাই, সাফাই করে নিয়ে ওদিকের দরজাতে টোকা দেবো কি দেবো না ভাবতে না ভাবতেই রূপাদের বার্তালাপ শুনেই দিলাম হাঁক , হাঁকপাক করে ওদিকের দরজা খুলে দিল রূপা । এ দিকের দুজন তখনও গভীর নিদ্রায়। চায়ে গরম হাঁক ডাক দেওয়ার জন্য আমার অপছন্দের লাল চা বানিয়ে ফেললাম। আমার পছন্দের দুধ চা পেতে একটু অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে হয় । জলখাবার সহযোগে তিনি রঙ্গমঞ্চ থুড়ি খাবার টেবিলে হাজির হন। হাঁক ডাকের চোটে অগত্যা বিরক্তি কাটাতে কাটাতে চা পানে তিনি এ দিকের রূপাদের ঘরে এলেন । এ দিকের ঘরেও ঘুম ঘুম ভাব প্রবল , এক রূপা ছাড়া । আমরা ছানাদের স্কুলের কল্যাণে ভোরের রাগ-রাগিনীর সাথে পরিচিত। 

সকাল বেলার আরাম আরাম ঠাণ্ডার আমেজ বেশ মনোরম। আমাদের দুই ঘরের সাথে আবার তাদের নিজস্ব বারান্দা মজুত। সেখানে উঁকি দিয়ে ঘষা কাঁচ মার্কা ভোরাই এর সুর শুনতে ও দেখতে পেলাম। এদিকের তিনি বেড়াতে গেলে বরাবরই রসিকলাল। কুয়াশা দেখে মুগ্ধ হয়ে , ডেকে দেখালেন সকলকে। আমরাও ম্যানেজার সহ মুগ্ধ হলাম !!! 

আগের দিনের ছবি তোলা হয়েছে সব যন্ত্র পাতি তোলপাড় করে ... শুধু ক্যামেরাতে , মোবাইল ক্যামেরা তে । মোবাইলের সম্পত্তি মোবাইল বন্দী বটে , কিন্তু .... ক্যামেরা সম্পত্তির জায়গা বদল নানান জটিল নিয়ম নির্ভর।  প্রতিবার অপেক্ষার প্রহরে তা দিই ঘরে ফেরা ওবধি । এবারে দিবাকর কর্ দিয়া কামাল !!! কম্পিউটারে পুপের দিবাকর আঙ্কেলের দক্ষতার শেষ নাই ... এ দিকে আমাদের অজ্ঞতা ও শিক্ষানবিসী আবার যেতে যেতেও যায় না । তার ফলশ্রুতি স্বরূপ সক্কাল সক্কাল ক্যামেরা থেকে ছবিদের মোবাইলে ভর্তি করে নিলাম খানিক খানিক খানিক শেখার পরে । কি যে শান্তি !!! দেবা ন জনান্তি 🤫

এরপর সকলে জলখাবার খেয়ে চলি চলো বলে বোধগয়া সরেজমিনে দেখতে আবার টোটোতে টপ করে উঠে পড়লাম দু পরিবার।  হোটেলের সামনে দিয়ে টোটো কম্পানির নিত্য যাতায়াত। তাই টোটোর পিছনে ছোটো ... এমনটা নয়কো। বরং গাদা খানিক টোটো ই প্রতিবার আমাদের পিছনে ছুটছিল 🙃 । এখানে এসে তথ্য জড়ো হল আরো কিছু ... এখানকার সব ব্যবস্থাপনার পরিচালিত হয় সুদূর জাপান থেকে। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্ম যে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সে সব দেশের নাগরিক হামেসাই এখানে আসা যাওয়া করেন। ধর্ম তাদের টেনে আনে এই পুণ্যভূমিতে যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন বোধিবৃক্ষের নিচে বসে। সেই ঐতিহাসিক গাছ আমরা আগের দিন দর্শন করেছি ফেলেছি ।

এখানে এসে জানলাম যে , এখানে বৌদ্ধ মন্দিরে বাইরের পর্যটক দের যদিও অবারিত দ্বার, বৌদ্ধ মঠে নেই সাধারণের প্রবেশাধিকার। আমরা একে একে নানান দেশের নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির দর্শনে ও সাথে ফটোসেশনে মন দিলাম। ঝকঝকে দিনে ঠাণ্ডার কোন খোঁজ মিলল না । অনেকে যদিও ক্যালেন্ডার মেনে ভয়ানক শীত পোশাকে আবৃত তাও দেখলাম। তাদের দেখে আমার গরম লাগা আরো যেন বেড়ে গেল । একে একে তিব্বত, সিংহল, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান , ভিয়েতনাম , মায়নমার ইত্যাদির বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করলাম, যদিও শুরু করেছিলাম আমাদের হোটেলের কাছের তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম মতের অন্যতম স্বীকৃত দেবী তারা , তার মন্দির দর্শন করে। মন্দির টি নিরালা নির্জনে । কারণ মূল হল্লাহাটি থেকে খানিক দূরে অবস্থানের জন্য সব পর্যটক এখান পর্যন্ত আসেন বলে মনে হল না । শুধুমাত্র আমরা ছয় জন সময় নিয়ে ঘুরে ফিরে সবটা দেখলাম । বৌদ্ধ মন্দিরে সব কিছুই আদ্যান্ত উজ্জ্বল রঙে রাঙানো। তা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল ঝকঝকে রোদের আলোর ছোঁয়ায়।

এ দিন শুরুতেই সুড়ুৎ করে টোটো চালকের পাশটি দখল করেছিলাম। পিছনে বসা নিয়ে বেশ ঝড়ঝঞ্জা টের পাচ্ছিলাম !!! এদিকে সামনে বসে হাওয়া হাওয়াই হয়ে ঘুরছিলাম সারা বোধগয়া জুড়ে। এক জায়গায় লিটঠি চোখা র সাইনবোর্ড সাই করে চলে গেল , চেখে দেখা হল না। যদিও চেখে দেখার ইচ্ছে তেমন ছিল না। ইচ্ছে থাকলে সাই করে বেরিয়ে গেলেও টোটো চালক কে বলে বাই করে ঘুরিয়ে ওদিকে হাজির হতেম নির্ঘাত। আসলে দেশের মধ্যেই প্রাদেশিক ভাবসাবের বড় অভাব আমাদের স্বভাবে। বিহারীকে বলি মেড়ো , ওড়িয়া কে বলি উড়ে 😞। তবে উড়িষ্যার রান্নার ঠাকুরদের বাংলাতে কদর আগেও ছিল এখনও আছে। কিন্তুক বিহার নিবাসীদের কদর খাদ্য বিভাগে নেই কো। 

যাক নওলাখা মন্দির সারাই হওয়ার দরুণ ঢাকা চাপা দিয়ে রাখা , তাতে খানিক খানিক ফাঁকা। সেই ফাঁক গলে আমরা দেখে নিলাম । কিছু জায়গায় টোটোতে বসার পর তেনারা এমন আঁটকে গেলে বার বার আটক মুক্ত হয়ে নামতে বেগড়বাই করে বাগড়া দিচ্ছিলেন। নিজেরা দেখবে না ,তো আটকে বসে থাকো না !!! আমি আর রূপা টুক করে নেমে ঘুরে নিচ্ছিলাম। রূপা হাল্কা শরীর দিয়ে আটক স্থান থেকে সুড়ুৎ করে নেমে আসছিল আর আমি টোটোর সামনের সীট থেকে মোটামুটি বোঝাই বস্তার মতন ধুপুস করে স্বশব্দে নেমে পড়ছিলাম। পিছনের সব তর্জন গর্জন খানিক না শোনার ভাণ করে । আচ্ছা তোমরাই বলো , যতটা পারি তা দেখব না ??? দেখতেই তো এসেছি !!!! ছানা দুটোকেও দুই বাবা প্রভাবিত করে ধরে রেখেছিল টোটোর মধ্যেই।  বলে কিনা সব তো একই বুদ্ধ দেব !!! এ কি কথা ??? দূর্গা পূজোর সময় তো একই দূর্গা দেখি রকম বেরকম !!! আর্টের ঠেলায় তো কাউকে আবার দেবী বলে চিনতে ওবধি পারি না !!! এখানে তো সবাই কে বুদ্ধ বলে দিব্যি চিনতে পারছি। সে ৮০ ফিট উচ্চতার হোক , কি বসা হোক কি অনন্ত শয়ান বুদ্ধ মূর্তি হোক !!! এ সব দেখতে দেখতে এলাম সুজাতা মন্দিরে , বোধি লাভ করার জন্যে যখন কঠোর তপস্যা করছিলেন দিনের পর দিন না খেয়ে , তখন তিনি শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ,  সেই অবস্থায় এক অর্থপূর্ণ স্বপ্ন দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে উপোস করে , অহেতুক শরীরকে কষ্ট দিয়ে কখনও অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না । সেই সময়ে গৌতম বুদ্ধ তার উপোস ভেঙেছিলেন  সুজাতা র তৈরি পায়েস খেয়ে। তিনি বনদেবীকে পায়েস নিবেদন করার জন্যই বনে এসেছিলেন । বুদ্ধ কে তা নিবেদন করেছিলেন। সেই পায়েস খাওয়ার পরেই শরীরের শক্তি  ফিরে পেয়ে তিনি পুনরায় তপস্যা করে অবশেষে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। 

দেখা হোল একদল জাপানি ভক্তের সাথে । তারাও সুজাতা মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। আমরা ভাষার অন্তরায় আর তাদের ঝুঁকে পরে অভিবাদনের ভয়ে ওদিকে না ভিড়ে মন্দির থেকে দৃশ্যমান গ্রামীণ প্রকৃতিকে দেখে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে সামনে এগিয়ে হাজির হলাম এক ধ্বংসস্তুপ দর্শনে , যা লোকমুখে সুজাতা র বাড়ি হিসেবেই চিহ্নিত। আর্কিওলজি বিভাগ সেটিকে যত্নে রেখেছে দেখলাম । এতক্ষণ সব ঠিকঠাক চলছিল যতই বেলা বাড়ুক !!! সুজাতা দেবীর পায়েস ফের বিস্তর গোল পাকালো। আমাদের সবার ভয়ানক ক্ষিদে উসকে দিল ওই এক বাটি পায়েসের গল্প। 

এদিকে আমাদের টোটো চালক এই তো আর একটু , আর একটু বলে আরেক নিরিবিলি আধা বন্ধ ও আধা খোলা দরজার সামনে এসে টোটো থামিয়ে দেখে নিতে অনুরোধ করল। ছেলে মানুষ !!! যখন বলল সেটি তার স্কুল ছিল , কাজের ফাঁকে রবিবারে সে এখানে ক্লাস করত , বর্তমানে স্কুলের বুদ্ধ মন্দিরটির দায়িত্ব নিয়েছেন শ্রীলঙ্কা সরকার , তখন তার অনুরোধ রাখতে চললাম ভিতরে । না গেলে সে বেচারা দুঃখ পেতো খুব !!! সারাদিন যত্ন করে সব ঘুরিয়ে বেশি কিছু কি সে চেয়েছিল ??  তার স্কুলের মন্দির দেখার অনুরোধ করেছিল শুধু। দেখব না শুনে যতটা আঁধার করেছিল তার মুখ , যখন আমি আর রূপা ও তার দেখাদেখি দুই কুচে বাদে সকলে নেমে এলাম ওর মুখে দেখলাম হাজার বাতির রোশনাই , তখন আরও একবার মনে হল সত্যিই মুখ মনের আয়না !!! আর সত্যিই না দেখলে ভুল করতাম । তারা দেবীর মন্দিরের মতন এখানেও দর্শনার্থী শুধুই আমরা। এক এক করে এক একটা তলা উঠে ঘুরে দেখলাম । সবশেষে ছাদে উঠে মন ভরে গেল !!! রাজগীরের শান্তিস্তুপের আদলে আরেক শান্তিস্তুপ। পাশেই অন্তঃসলীলা ফল্গু নদী যার বোধগয়ার নাম নিরঞ্জনা। টোটো চালকের সাথে সামনে বসে এই তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম আগেভাগেই। ছাদ থেকে দেখলাম নিরঞ্জনার ওপর পারে দূরে মহাবোধি টেম্পলেট চূড়া। আরেক দিকে অনেক দূরে পাহাড়ের আভাস । 

আগের দিনের রাতের আলোয় মহাবোধি টেম্পল দর্শন করে সেবারের অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের মতন দিনের আলোতে পুনরায় তা দেখার  বাসনা মনে আনাগোনা করলেও , শরীরে তখন ক্লান্তির সাথে ক্ষিদের কোরাস চলছে । আমরা এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে কলকাতার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা শুরু হওয়া বুদ্ধের অনন্ত শয়ান মূর্তি যেখানে রয়েছে সেই মন্দির অভিমুখে চললাম ... কলকাতা শুরুতে থাকলেও শেষ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার নিয়েছেন ভিয়েতনাম সরকার । সব দেখে আমরা ভর ভরন্ত মন ও ক্যামেরা সহ হোটেলে ফিরে এলাম। খাওয়ার পাট মিটল প্রায় প্রায় বিকেলে। আর মহাবোধি টেম্পল যাওয়া হল না। আমরা আমাদের ঘরে আড্ডার মজলিস বসালাম। দিবাকর পরে যোগ দিল কারণ তার কল ছিল .... ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও 😥 । আড্ডার বিষয় জানতে সঙ্গে আসুন !!!! 😃 কেমন ??? 

পরের দিন আমাদের বোধগয়া থেকে বেরিয়ে সেই আকর্ষণীয় ইতিহাস ঘাঁটতে যাওয়ার কথা । যার জন্য কত বছর অপেক্ষারত আমি , জানো কি তোমরা ????