Thursday, 30 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫০

আগেই খোঁজ খবর করে আমার কর্তামশাই এর ভাঁড়াড়ে মজুত করা ছিল নানা রকম বেরকমের আপদ বালাই এর অতীত অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান । কয় জনা আবার বলে দিয়েছিল ... স্টেশনে অতি সাবধানী থেকো । ওদিকে নাকি ছিনতাই হয়ে থাকে । ব্যাগ পত্তর তো বটেই কন্যার হাত শক্ত করে চেপে পিতাশ্রী এগোলেন টোটোর দিকে। টোটো খানা র শ্রীহীন অবয়ব দেখে মনে হল এই বাহন কি আমাদের মতন ওজনদার কর্তা-গিন্নিকে ধারণ করতে পারবে ??? তার উপরে আমাদের দুই পরিবারের বাক্স প্যাটরা ওজনে সমান সমান । এ বলে আমাকে দেখ তো ও বলে আমিও কম যাই না !!! যদিও ওদিকের কর্তা গিন্নি সিলিম ( Slim ) । ভাগ্যিস তাই সবাই টোটোতে এঁটে গেলাম ... বলা ভাল আমাদের ওজনজন্য ওরা আঁটকে গেল টোটোর ফাঁদে । মুখোমুখি সিটের স্লিম অংশের অংশীদার হয়ে কোন মতে সেখানে বসল দিবাকর , তার পিছনে গদি সদৃশ আমার কর্তামশাই টোটো চালকের পাশ টি তে বসেছিল কোন মতে । রূপা পিছনের সিটে খানিক হেলে হেলান দিয়ে হেলদোলহীন অবস্থানে ছিল আমি নামক গদিতে ওর কোন আরাম ঘটে নি । এদিকে আমি অনেকখানি ঠিকঠাক বসে ছিলাম দুই ছানাসহ পায়ের সামনে ও কোলে ব্যাগ বোঝাই হয়ে। কন্যাকে স্থান পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেও তার দিবাকর আঙ্কেল হা হা করে আমাকে থামিয়ে দিলো , আবার বললে পুপের রূপা আন্টি নির্ঘাত নামিয়ে দিত । অগত্যা চেপে গেলাম। যে কোনো সাকিনে আমার কানাকড়ি মূল্য নেই গো !!! পুপের একখান পরভোলানী স্বভাব আছে ... খানদানী। না না মোটেও ভেবে না শ্বশুর বাড়ির দিককার গপ্প। এ একদম আমার নিজস্ব রকম ঘরাণা। মা আমাকে ওই বিশেষণে বিশেষিত করতেন রেগে গেলেই !!!! 🤫

যাইহোক রূপা রা আগে কসবাতে ই থাকত। হাঁটা পথ । যাওয়া আসা আগের থেকে কমে এল ওরা ঠিকানা বদল করার ফলে । নতুন স্কুল ভবন যেখানে গড়ে উঠছে তার কাছেই ওদের এখনকার বাসভবন। আগে রূপার কাছে মেয়েকে রেখে গিয়েছি কাজে কর্মে। রূপা আমার থেকে বছর খানেক ছোট আর দিবাকর ওরফে দিবা মাসখানেক ছোট, যদিও তার ধারণা ছিল আমি নাকি অনেক ছোট !!! আহা , এমন শুনতে কার না ভাল লাগে !!! যেখানে মেঘে মেঘে বেলা অর্ধ শতকের লেজ ধরব ধরব করছে সেখানে এমন ভাবনা তো মনের বয়স কমিয়ে দেবেই , সব রাতের শেষ আছে .... পথ যদি না শেষ হয় তবে ভাল না খারাপ হয় ? এ প্রশ্নের উওর দুরকম আঙ্গিকে অবশ্যই দু রকম । আমাদের টোটো ভ্রমণের দিক থেকে পথের শেষ না হলে গায়ে গতরে বিস্তর ব্যাথা শূলো র সম্ভাবনা !!! দিবা শুরুতে গান শুরু করলেও ওই রকম দুমড়ে বসার দরুণ গান বেশি সুর বিস্তার করতে পারল না। 

আমরা চলেছিলাম বোদ্ধগয়া। গয়া থেকে একদিকে বোদ্ধগয়া, বিপরীতে রাজগীর পেরিয়ে নালন্দার অবস্থান। খাওয়ার শেষ পাতে থাকে মিষ্টি আর মধ্য পাতে থাকে centre of attraction / বিশেষ আকর্ষণীয় পদ । নালন্দা ছিল আমাদের মধ্যেকার সেই আকর্ষণীয় স্থান। শেষপাতে ছিল রাজগীর। যেখানে কিছু স্মরণীয় ঘটনা রয়ে গেলেও স্মৃতির সরণি বেয়ে তাদের খোঁজ খবর করে হয়রাণ হলাম শুধু । তবুও ভাল লাগা রয়ে গেল ।

গান যখন gone ... তার আরও কিছু পর ভরপুর ভর দুপুরে আমরা বোদ্ধগয়া পৌঁছলাম। হোটেলের অবস্থান দেখেই আমরা আহ্লাদে আটের জায়গায় ষোলখান হয়ে গেলাম। এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই ... এই গানের লাইন বাই লাইন মেনে যেন হোটেল গড়ে উঠেছে ... আকাশ টা কে শুধু চোখে রেখে মন হারানোর দুরন্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে । হোটেল চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের পাশাপাশি ঘরের মধ্যেই । চমক আর কিছুই না , পাশাপাশি দুই ঘর পরস্পর যুক্ত একখান দরজা র সাহায্যে দুয়ারে দুয়ার বলাই যায় !!! তাই না ???

রূপা পথের খাবার কিছু বানিয়ে এনেছিল। সে সব বৃথা যাওয়া ঠিক না , তাই ঘরের ও পরের ( হোটেলের )মেলবন্ধন ঘটিয়ে আমরা বেলাশেষে আরো একবার কিছু কিছু খাবারে পেট ভরিয়ে নিলাম । 

তারপর রূপাদের ঘরে গল্প গুজবের মাঝেই দিবাকর একটু পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নিল। তারপর সন্ধ্যার সময় সকলে বেরিয়ে পড়লাম বোদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ মহাবোধি মন্দির দর্শন করতে। পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বৌদ্ধ মন্দির ও মঠের পাশ কাটিয়ে আলো ঝলমলে বাজার চত্বরের পরেই টোটোর চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন এক জায়গায়। তারপর অল্প হণ্টনেই গেট দেখতে পেলাম। ক্যামেরার টিকিট কেটে আমরা মন্দির চত্বরে ঢুকতেই দেখি নারী ও পুরুষের পৃথক লাইন । সে সব পেরিয়ে , ব্যাগ পত্তর ও নিজেদের মেলে ধরে মেলাই চেকআপের পাট মিটিয়ে অতঃপর ভিতরে প্রবেশ। বলতে নেই ...অসংখ্য জনতা , বুদ্ধং শ্মরণং গচ্ছামির ঢিমে লয়ের গমগমে মন্ত্রোচ্চারণে সমস্ত মন্দির চত্বর যেন আমাদের নিয়ে গেল এক ভিন্ন জগতে। নানান রকম আলোতে মন্দির এক একবার একেক রকম ভাবে জেগে উঠে তা যেন ভাল লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছিল সকলকে। যথারীতি ভিড় দেখে দুই পুরুষ সহচর ভয়ানক ভড়কে নিজেরা শলাপরামর্শ করে আমাদের দুই মাতাশ্রীকে দুই গ্যাড়া ও গেড়ি সহ মন্দির দর্শনে পাঠিয়ে নিজেরা কোয়ালিটি টাইমে মেতে গেল দুই ভিন্ন ভাষী দেশী ও বিদেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাথে। পরে শুনি দিবাকর ওনাদের একজনকে মশার কামড় থেকে উদ্ধার করতে , ওনার সামনে মশা মেরে এক কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড বাঁধিয়ে শেষে কাচুমাচু মুখে ওনাদের বক্তব্য শুনেছে। দিবাকরের অনেক আচরণে ছেলেমানুষী প্রকট তা এই ভ্রমণে ভাল করে আমরা জানলাম। আমি যদিও বুড়োমানুষী যুক্ত তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখলাম দিবাকর কতকটা আমার মতন , ওদিকে রূপা কতকটা এদিকের সিনিয়র জনের মতন। এ ভাবেই বোধহয় সংসারের ভারসাম্য বজায় থাকে।

রূপা পূজা দেওয়ার লাইন পাকড়াও করল আর আমি তাতে খাড়া না থেকে টুকটুক করে খোঁজ খবর করে বোধি বৃক্ষের সন্ধানে রত হলাম। একে ওকে রাষ্ট্র ভাষার হাত ধরে শুধিয়ে মন্দিরের পিছনে দেখে নিলাম ঘেরাটোপ বন্দী বোধিবৃক্ষ ও অনেক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরণ কারী ভক্ত। যারা কোন রকম অতিরঞ্জন ছাড়াই প্রার্থনারত নিজের মতন করে। ভক্ত ভগবানের চিরাচরিত সম্পর্কে দেখনদারী আড়ম্বর থাকার যে কোন প্রয়োজন থাকে না , তা কিন্তু সত্যিই শিক্ষণীয়। দেখনদারী ঢেকে দেয় ভক্তের প্রকৃত আকুতিকে , প্রার্থনাকে। 

সব শেষে লাইন মন্দির মুখী হওয়ার মুখেই আমি দলযুক্ত হলাম ... দর্শন করলাম । এরপর দুই কর্তামশাই এর কাছে হাজির হতেই তারা আরো কিছু ঘোরার নির্দেশ দিল। খানিক ঘুরে ফিরে , ছবি তুলে আমরা এক সময় মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। ছবি তোলার পর দেখি ফের আমার ছবিতে স্পটের ছড়াছড়ি , যা নাকি তেনাদের উপস্থিতির দ্যোতক !!! কন্যার আতঙ্কিত মুখে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো র মজা নিতে নিতে আমরা সামনে এগিয়ে চললাম । যথা নিয়মে যথাস্থানে আরেক টোটো র দেখা পেলাম। তাতে এদিক ওদিক করে সবাই আঁটকে গিয়ে আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম । হোটেলের পথ দিনের আলোয় বাবা-মায়ের যত রোমান্টিক লেগেছিল , রাতে আমাদের ফুলন দেবীর ততটাই ভৌতিক লাগল । 

হোটেল দৃশ্যমান হওয়ার আগেই হোটেল পেরিয়ে খানিক দূরে অবস্থিত তারা দেবী বৌদ্ধ মন্দিরের ওপরের তারা দেবীর মূর্তির দর্শন মিলল । একসময় আলোকোজ্জ্বল আমাদের হোটেল বোদ্ধবিলাসের দেখা মিলল। 

ফিরে ক্লান্ত আমরা কিছুক্ষণ ঘরোয়া আড্ডার আসর জমালাম অল্প কিছু খাই দাই করে । এরপর রাত সাড়ে নয়টা র সময় রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম নিমেষে র মধ্যেই। ঠাণ্ডার রাতে নরম নরম শুভ্র বসনা লেপ যেন আদর করে সকলকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল। শুধুমাত্র আমাদের দলের ম্যানেজার ভদ্র বাবু ৫২/৫৩ এর হিসেব করতে বসলেন। ওই হিসাবে ভুল নাই। এদিকে ঘরেও হিসাব করেন , আর নজরদারি করেন জব্বর। উপায় নাই রে ভাই ... বৌ খান যে ভয়ানক রকম বেহিসাবী। এখানেও সেই ভারসাম্য !!!!! 🤫🤭

Wednesday, 29 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৯

বছরের কিছু কিছু সময়ের সাথে একটা বেড়িয়ে পড়ার ডাক ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে থাকে। এমনিতে যদিও যখন খুশি বেরিয়ে পড়াতে কোন লিখিত বাঁধা নেই। কিন্তুক গণ্ডাখানেক বাঁধার গেরো সব সময়ই থাকে। আর তার সাথে ভ্রমণ পিপাসুদের চলে লুকোচুরি খেলা । এবারে বাংলা বছরের গোড়ার দিকে গরম যেমন মারাত্মক রাগিয়ে দিয়েছিল , ঠাণ্ডার কাঁপন তেমন মেঘের কোলে এক হাসিখুশি রোদের সাথে ভাসিয়ে শহর থেকে আরো অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই বলে হাজির হলো। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে গিয়েও ঝাড়খণ্ড যখন খণ্ড খণ্ড তখন মন ভার , মুখ ভার .... এবার আবার সেই কর্তা মশাই এর ব্লগ ভ্রমণের ফাঁক গলে ট্রেনের টিকিট, নেতারহাটের চলনসই বাসভূমি পিছলে গেল , হাতে রইল কেবল রাচি .... সোনা মুখ করে বলে কিনা চলো চলো আছে রাজরাপ্পা ... ওসবে আমি ভুলি ??? কভি নেহি !! নেতারহাটে , পত্রাতুর উপত্যকায় পরে যাবে নিয়ে আবার ??? ওদিক নিরুত্তর !!! কি ধাপ্পাা  , কি ধাপ্পা !! রাঁচিতে পুরো কাঁচি চালাতেই হল । আমি নিরূপায় । দেবাশ্রিতা শুনলে কাঁচি নিয়ে তাড়া করবে , ওর যে ওখানে মামা বাড়ি ভারি মজা , কিল চড় নাই !!! 🤫

আলোচনার সূত্রপাতে বিহারের বৌদ্ধ বিহার নালন্দা যা দেখতে যাওয়ার স্বপ্ন দু চোখে এঁকে দিয়েছিল স্কুলের পাঠ্যক্রম, তা নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি , কারণ অতীতের কোন ঘটনা ঘাটি গেড়ে বসেছিল নালন্দা ও আমাদের মধ্যেকার যাওয়ার পথে। এই বাঁধা আজকের না , পুপে দেবীর আগমনের আগেও একবার আমার নালন্দা যাওয়ার ভাবনাতে চাবি পড়েছিল আর শর্ত আরোপিত হয়েছিল ... শুধুই আমরা তিন ওদিক পানে যাব না। যদি হয় তিন অধিক টিম তবেই ... ।

এদিকে তেনার বন্ধু সাগ্নিক কর্মসূত্রে ওদিকে নিত্য যাত্রী, প্রস্তাব দিতেই নাকচ ... সাথে নালন্দার প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহে যত্ন না হলেই ভাল ... এমন মন খারাপ করা বার্তা জ্ঞাপন করে সে দুরভাষ থেকে দূরে ঘাটি গাড়ল । তাহলে কি এবার শীতে নিজ শহরেই কেক , সিঙ্গাড়া খেয়ে ঘরেই ঘুরপাক খাব ??? যদিও কলকাতার দ্রষ্টব্য দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া হয়ে থেমে আছে ... তার লিস্টি করে নেমে পড়া ই যায় !!! পুপেকে দেখানোর সাথে সাথে নিজের দেখাও হবে। সাথে যদি তিনি সহ আরো খানকতক গ্যাড়াগ্যাড়ি থাকে তাহলে তো কথাই নেই !!

খানিক খানিক চাপানউতোরের পর এদিকের সিংহ মশাই একদিন দুপুরের দিকে হালুম হালুম করে এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে জুনিয়র কলিগের বাড়ি বেরনোর আগে ভাগে বলেই বেরলেন ... আজ এসপার নয় ও ওসপার !!! কলকাতা ভ্রমণ করবে ??? কাভি নেহী !!! অতএব কলকাতা থাকুক কলকাতাতেই ... থাকুক "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া" ... এই প্রবচন, অক্ষয় হোক। 

বিকেল গড়াগড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছল। তেনার দেখা নাই রে , তেনার দেখা নাই !!! হেনকালে ফোন ... ওদিকের ব্যারিটোন কন্ঠ আরো গম্ভীর শোনাল ... বার্তা এল শর্ত কর্তন করে নাকি এবার সত্যিই আমরা তিন চলেছি নালন্দা দেখতে , সাথে আরো কয়খান দ্রষ্টব্য যুক্ত। মনে তখন উথাল পাতাল আনন্দ ... কিন্তুক ওদিকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এদিকও খানিক সংযত। গদোগদো আমি জলদি বাড়ি ফেরার নির্দেশ দিয়ে মনে মনে ঘুরতে শুরু করলাম ।

এরপরে পুরো কাটে নেহী কাটতে ইয়ে দিন ইয়ে রাত... কেস । একদিকে চিরাচরিত নিয়মে অপেক্ষার সময় কাটে না আবার অপেক্ষার শেষের দিন চলে যায় এক লহমায়। এবারে অপেক্ষার আরো একটু রকমফের ছিল ... প্রথম বার বন্দেভারত নামধারী ট্রেনে যাত্রার উত্তেজনা তখন উচ্চগ্রামে বাঁধা পড়েছে । 

তিনজনে ঘুরতে যাওয়া কিন্তুক বেড়ে দাঁড়াল ছয়ে । কেন কেন ??? ওদিকে টিম নিয়ে যাওয়ার কর্তিত শর্ত আরোপিত করলেন স্বয়ং উপরওয়ালা । কন্যার নার্সারি র বন্ধু সিদ্ধার্থ। তারা সপরিবারে জুড়ে একদম জড়াজড়ি করে আমরা এক স্মরণীয় ঘোরার সাক্ষী থাকলাম । ওদের সাথেও টিকিট কাটার আগে যোগাযোগ করে যুক্ত করে নিতে চাইলেও, জেনেছিলাম যে ওদের যাওয়া নির্ধারিত হয়েছে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিঙে। হোটেল বুকিং ডান ... ট্রেনের টিকিট হাতে এলেই ওরা উত্তর মুখী হবে । কিন্তুক পথ যখন বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী আর সে বাঁধন যখন দিলেন স্বয়ং উপরওয়ালা তখন কি আর ওদের গাড়ি উত্তর মুখী হওয়ার জো আছে ???ওদের টিকিট বাড়ন্ত হল আর অদ্ভুত ভাবে ঠিক তিনদিনের মাথায় এক গাড়ি ও একই হোটেলে কাছাকাছি ও পাশাপাশি আমাদের বুকিং টুক করে সুসম্পন্ন হল। যাওয়ার আগে একটা মিট জরুরি ... "কথা কিছু কিছু বলে নিতে হয় , সে তো ফোনে বলা যায় না , সে তো 🎼🎼 ফোনে বলা যায় না 🎼" অগত্যা আমরা কর্তা গিন্নি একদিন হাত ধরাধরি করে ওদের বাড়ি গিয়ে সব কথা বলে নিলাম আর অপেক্ষার শেষ প্রহরে এক আঁধার কাটা ভোরে হাওড়া মুখী হলাম। আমাদের ট্রেন ছিল হাওড়া-গয়া বন্দেভারত। সময় সকাল ৬.৫০ । তখন আমার কলেজে ওদিকে মেয়ের স্কুলে শীতের ছুটি জাকিয়ে শুরু হয়ে গেছে।

স্টেশনের খানিক অপেক্ষার পর রূপা বাহিনী কাহিনীতে মাত্রাযুক্ত করতে হাজির হল , দুই বন্ধুর এখন section ভিন্ন, তাই তেনারা দুদিকে মিটি মিটি হাসি মুখে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে সেঁটে গেলেন । ফেরার সময় তেনারা যে ফের অভিন্ন হবেন জানা ছিল । অবিকল হল তাই !!! 

 আমাদের দু দলের বগি এপারে থাকব আমি , তুমি রইবে ওপারে স্টাইলে .... একজনের C5 তো অন্যজনের C14 । কাজে কাজেই একই ট্রেনে দুই পরিবার একে অপরকে টা টা করে বাক্স প্যাটরা টেনে তুলে গদিওমান হলাম । 

আহা বড় ভাল ব্যবস্থাপনা। দরজা নিজে নিজে বন্ধ হতেই আমি হাফ ছাড়লাম । তেনার ট্রেনে ওঠার পর থেকে গন্তব্যের আগে ভাগেই টুকটাক নামা ওঠার এক কচি পানা অভ্যাস আছে , যার থেকে এই ট্রেন যে কি শান্তি দিয়েছে বলার না !!! যিনি এমন দরজার ভাবনা ভেবেছেন তেনার কাছের কেউ না কেউ এই নামা ওঠার সাথে অবশ্যই জড়িত ছিলেন তাকে আতঙ্কিত করে। আমি একদম নিশ্চিত। 

আহা কি আনন্দ মনের সব দিকে । মেয়ে রইল তার বাবার সাথে , ওরা থাকল ওধারে । আমি অন্য এক হৈচৈ পরিবারের সিনিয়র মোস্ট কর্তা ও গিন্নির পাশে নিজেকে ফিট করে খানিক গল্পের বই, খানিক ফোন দেখাদেখি , খানিক গান শোনাশুনি করতে করতেই দেখি জলখাবার হাজির সাথে মশলা চা । আমার পছন্দের দুধ চা । অন্য ধারার চা , তা আমার কাছে চিনি যুক্ত হোক, না হোক গরম জল সদৃশ লাগে। তবে কাঁচা পাউরুটি খানা খুব সুবিধাজনক লাগে না , আমার হজম শক্তি খুব মানী, সকলকে হজম করেন না তিনি। খাওয়ার পর্ব মিটলে মনে ওপারের বাসিন্দাদের সাথে দেখা করার যাই যাই ধ্বনি ধ্বনিত হতে শুরু করতেই , আমি ট্রেনের মধ্যেই হাঁটা শুরু করলাম। বগি সবাই পরস্পর পরস্পরের সাথে যুক্ত, যাওয়ার পথও প্রশস্ত। মর্নিং ওয়াকের বদলে ট্রেন ওয়াক করে এক সময় রূপা , দিবাকর আর সিদ্ধার্থ র বগিতে হাজির হলাম । খানিক গপ্প করার পর ঘরে অর্থাৎ আপাত নিজের বগিতে ফিরলাম। 

খানিক পর খ্যাটন পর্ব শুরু হল ... কিন্তু একি ??? সবাই কে দিলেও আমরা বাদ !!! তাও আবার খাবার থেকে ???এমন করতে হয় ? মাথা ঝুকিয়ে টুকি করে এবং ঝাকিয়ে কন্যা র আতঙ্কিত মুখ দেখতে পেলাম ..." আমাদের দেবে না মা ? " এ আতঙ্ক তখন অন্তসলীলা এ দিকেও। বলতে নেই, দেখাতে নেই !!! মা বলে কথা !!! বললাম ... দেবে দেবে !!! ভাবছিস কেন ? " কিছু পরে বাকিদের পেট ভর ভরন্ত ... আমরা খানিক রাগন্ত 😡 । তিনি মাঠে নামতেই খানা হাজির !!! আমরা জলদি ডান হাতের কাজে লিপ্ত হলাম । গয়া তখন প্রায় প্রায় আগ্যয়া। 

অবশেষে গয়া এল , বন্ধ দরজা চিচিং ফাঁক হল আর ঝকঝকে ও কটকটে রোদে আমরা গয়া স্টেশনে নেমে পড়লাম। গল্প জমাট বাঁধতে শুরু করল ... দুই পরিবার একত্রিত হয়ে ছবি বন্দী হয়ে এগিয়ে গেলাম টোটোর দিকে .... 


Saturday, 11 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৮

পেলিং এর দুই ভাগ আপার আর লোয়ার। আমাদের হোটেল সামথেনলিং ছিল আপার পেলিং এ। স্কাই ওয়াকের থেকে এগিয়ে খানিক গেলেই সেই আকাশ ছোঁয়ার চাবিকাঠির অবস্থান ছিল। নামচি থেকে পাহাড়ী পথ পেরিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পেলিং পৌঁছলাম। এ হোটেলের মালিক নির্ভেজাল বাঙালি। ঘরে ঢুকে আরেক রাউন্ড কাঁপন ধরল। বিশালাকার ঘরের কোণে কোণে যেন ঠাণ্ডা ঘাপটি মেরে বসেছিল। ম্যানেজার সহ আমার কর্তামশাই রুমহিটার নিতে ঘোরতর আপত্তি জানালেন । অগত্যা !!! খানিক সতেজ হলাম হাত মুখ ধুয়ে চায়ের সাথে টা খেয়ে । এরপর দু রাত থাকার উপযোগী গুছু করে লেপের আশ্রয়ে ঢুকে গেলাম । কর্তামশাই আতঙ্কিত হলেন , কারণ লেপের ওম ছেড়ে যদি রাত উপোসী থাকি ??? খাবার না খাওয়ার ভাবনায় তিনি ভয়ানক দুঃখিত হয়ে , দুঃখ কাটাতে আরো বেশি খেয়ে ফেলেন !!! বিপদ বলে বিপদ @!!! যাক সে সব বিপদ ঘটার কারণ ছিল না , কারণ খুব বেগতিক না দেখলে আমি বাপু খাবারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না। তাই আমি সময় মতন খাই দাই করতে গেলাম ডাইনিং হলে । খান তিনেক সদ্য পাশ করা ডাক্তারের সাথে আলাপ হল , তারা তিন বন্ধু ঘুরতে বেরিয়েছে। ফেরার পালা তাদের পরের দিনেই। খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ঘরে ফিরে চট জলদি দুখান কম্বলের নিচে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম , রাতে ওঠার অভ্যাস বোধ করি ঠাণ্ডার ঠেলায় জমে গিয়েছিল। সকালে কর্তামশাই এর খোঁচা খেয়ে জাগন্ত হলাম ... চমক দেওয়ার জন্য ঘর সংলগ্ন বারান্দায় নিয়ে গেল ... ঠাণ্ডার চমক নতুন করে দেওয়ার মানে কি ভাবতে ভাবতেই চমকের আসল কারণ দেখে সত্যিই চমকিত হলাম , সাথে মন ভাল হয়ে গেল । একদম ঠিক ধরেছ ... বারান্দা থেকে কোণাকুণি ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন দিলেন শেষমেষ !!!! 

মন প্রাণ দিয়ে কোন কিছু চাইলে কখনও কখনও তা মেলে বৈকি !!! কাঞ্চন দা কে দেখে এক রাশ খুশিতে মন ভরে গেল আর আমরাও জলদি জলদি জলখাবার খেয়ে ওদিকের সব দেখার ইচ্ছেতে দম দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকালে আরো একখান খুশির খবর পেলাম। ধস জনিত কারণে ঘুর পথে ঘুরপাক খেয়ে যখন সিকিমে প্রবেশ করেছিলাম , যে সহজ সরল পথ ধসের কারণে ধসে গিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। শুনলাম তা নাকি আর বন্ধ নেই। ভ্রমণার্থি সহ ওদিকের সকলের মনের গহনের প্রার্থনা শুনে পথ খুলে গেছে .... খোল খোল দ্বার , রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে !!! দুয়ারের যে দিকেই হাজির হইনা কেন অপর পারেই তো হয় রহস্যের খাসমহল চিরকালের চেনা জানা ঘরের হাতছানি !!! খানিক নিশ্চিন্তি , যে ঘন্টার পর ঘন্টা পথে কেটে যাবে ... এমন টা হবে না ।

পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে অগোছালো প্রকৃতি যে কতটা সুন্দর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমেই আমরা এ পাহাড় , ও পাহাড় করে খানিক ওপরের দিকে উঠলেও কিছু পরে ওপর থেকে সরু সূতোর মতন মিষ্টি নামের অধিকারী পাহাড়ি রিম্বি নদীকে দেখতে পেলাম , সাথে এক আসন্ন ভোট প্রচারের জনবহুল জমায়েত দেখে মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। একসময় আমরা শ্রুতিমধুর রিম্বি জলপ্রপাত ও নদীর কলতান শুনতে পেলেও তা ছাপিয়ে ভোট প্রচারের হট্টমেলা তে চারপাশে গাড়ি বন্দী হয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আবার যানবাহন চালু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম । এমন ক্ষেত্রে আমার ক্লসটোফোবিক কর্তামশাই হাত পা ছুড়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। এখানে গাড়ি দাড়ানোর বেকায়দায় নামতে না পেরে ভয়ানক গরম হতে লাগলেন মেজাজের দিক থেকে !!! গাড়ির কাঁচ নামানো থাকলেও গাড়ি থেকে পদ যুগল নামানোর উপায় নাস্তি । কি কাণ্ড !!! মেজাজ আমার যে ফুরফুরে ছিল , তা নয় । কিন্তু কি বা করি ??? এদিকে পুপে দেবী অধৈর্যের শিরোপা ধারী। সে তার পিতাশ্রীর কান বাঁচিয়ে আমার মাথা পাগল করছিল যত্ন সহকারে !!!🤫

সব রাতের শেষ আছে , কাজেই পথ পরিষ্কার হল , আমরা ঝিমন্ত মোড থেকে চলন্ত মোডে ফিরলাম। সচল গাড়ি আবার চড়াই পথ পাড়ি দিতে শুরু করল আর এক সময় আমরা খিচিপেরি লেক দেখতে নেমে পড়লাম। বিগত ঘোরার অভিজ্ঞতার সাথে কিছুই মেলাতে না পেরে এক সময় আমাদের লোকাল গার্জেন হাল ছেড়ে এগিয়ে চললেন ... টিকিট কেটে আমরা এখানকার বাসিন্দাদের কাছের অতি প্রিয় ও পবিত্র জলাশয় দেখতে চললাম। আমার কাছে এ পুরোপুরি নতুন কে চোখ মেলে দেখার অভিজ্ঞতা সংগ্রহ !!!

টিকিট কাটার পরে তোরণ পেরিয়ে খানিক এগিয়ে পৌঁছাতে হয় খিচিপেরি লেক এর ধারে , পথ টা বৃষ্টির জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে পুরো খোলতাই চেহারা নিয়ে আছাড় খাওয়ার ভয়টাকে আমাদের মধ্যে চারিয়ে দিল .... অতি সাবধানে পা টিপে টিপে আমরা এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। আকাশ বেশ মেঘলা, গাছের ছায়া র সাথে সঙ্গত করার মতন ছমছমে পরিবেশ টা শুধু পেলাম না , অসংখ্য ভ্রমণার্থির ভিড়ে। সেটা একটু যদি পেতাম , সোনায় সোহাগা হোতো। তবে এমন ভাবনা র এদিকের ওদিকের সকলেই আমরা ভিড়ের অংশ বিশেষ। পথের শুরুয়াতে ডান দিকে অবস্থিত এক বৌদ্ধ মনাস্ট্রির দর্শনে তিনি জোর দিয়ে জানালেন এসব নতুন সংযোজন , তেনারা আগে বন্ধুদের সাথে যখন এসেছিল এ স্থান তখন ছিল নিখুঁত নিখাদ প্রকৃতিময়। আর আমার মনের মতন ছমছমে , নিস্তব্ধ !!! সত্যিই খুব হৈ চৈ কোনকালেই আনন্দ দেয় না আমায় , সে কারণেই পূজোর সময় ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতন ফাঁকা প্যাণ্ডেলে বাজিমাত করি , যে কারণে আলোয় আলো আকাশ , শহর দেখা হয় না .... যাক সে সব ... এই লেকের জল এতোটাই স্বচ্ছ যে একটা পড়ে থাকা পাতাকে ও লেকের চারপাশের গাছে বসবাসকারী পাখি তা তুলে লেকের জলকে আগের অবস্থানে নিয়ে যায় ।

লেকের সামনেও নতুন সংযোজন বৌদ্ধ ধর্ম গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি। লেকের পাশেই পাহাড়ী পথে ট্রেকিং করে কোন এক ভিউ পয়েন্ট যাওয়ার উপায় বর্তমান। কর্তামশাই এ সব ক্ষেত্রে খানিক কম উৎসাহী !!! ভেবে দেখলাম সিকিম এসে থেকেই তো গাদা গাদা ভিউ হচ্ছে নানান পয়েন্ট থেকে , আলাদা করে আর ভিউ পয়েন্ট না ই দেখলাম 😃!!! এবার ফেরার সময়ে উতরাই ধরে নেমে এলাম যাওয়ার থেকে জলদি জলদি ... সামনে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত।যাওয়ার সময় নামি নাই। পথের এক পাশে নেমে সামান্য এগিয়েই ঝর্ণা র ঝরঝরিয়ে জল ছড়িয়ে নেচে নেচে চলার প্রথমে শব্দ আর তারপরে তার দেখা পেলাম । এমন প্রকৃতির মাঝে বসে গল্প করতে হয় নিজের সাথে !!! তার উপায় এখন নেই নেই হয়ে গেছে এমন মরশুমে ... অগত্যা খানিক দেখে খানিক ঝর্ণা কে সাথে করে ছবি তুলে নিলাম । আর যে ছবি তোলা হল না তা মনের ক্যামেরায় রইল । এরপর আমাদের পরবর্তি দর্শনীয় স্হান ছিল রিম্বি নদীর ধারের কমলালেবুর বাগান আর তার সাথে আরো নিচে ওই পাহাড়ী নদীর পাড়ে চলে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। বেলা বাড়লেও তাকে বাড়তে দিয়ে আমরা কমলা লেবুর বাগানে নেমে এলাম ধাপে ধাপে , ছোট্ট ছোট্ট গাছে ফলন্ত কমলা লেবু যেন গাছ গুলোকে আলো করে রেখেছে। আরো নিচে নেমে পাহাড়ী নদীর কলতান শুনতে আমি আর পুপে আরো এগিয়ে পাড়ের ছড়িয়ে থাকা পাথরের ওপরে জিরিয়ে নিতে বসেই পড়লাম। বয়সের সাথে সাথে পাহাড়ী পথে ওঠা নামা র সমস্যার কিছু কিছু এখন আমরা অর্জন করে ফেলেছি , সে সব বর্জন করা নেহাতই অসম্ভব। ওঠার সমস্যা দমে আর নামার সমস্যা পায়ে 🤫 

নদীর পাড়ে খানিক বসার পর উঠতেই হল কারণ তখন যথারীতি মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় পেরিয়ে গেছে !!! টুকটাক খুচরো খাবারে তখন টান , কাজেই আমরা এবার অন্য টানের দিকে নজর দিয়ে এগিয়ে পড়লাম। 

খাবারের ছোট্ট হোটেলে আসার পথে জানলাম , সাময়িক আশার আলো জ্বালিয়ে তা আবার নিভিয়ে ফেরার সোজা সরল পথের ঝাপ ফের বন্ধ হয়ে গেছে আগামী বেশ কদিনের জন্য । নোটিশ সব গাড়ির মালিকের মোবাইলে টুং টুং করে হাজির হয়েছে। কাজেই পরের দিনের ফেরার ট্রেন সন্ধ্যার হলেও আমাদের রওনা দিতে হবে সকাল ৭ টা নাগাদ !!! যেতে হবে ঘুরে ঘুরে দার্জিলিঙ হয়ে । কর্তামশাই কলার তুলে বলেই ফেলেন ফেরার সময় ... দার্জিলিঙ টাও ঘুরিয়ে দিলাম !!! টেকনিক্যালি সঠিক !!!

অতো ভেবে লাভ নেই , তাও আবার খাবার যখন সামনে !!! খেয়ে নিলাম ... এবারের আকর্ষণ পেলিং এর নব নির্মিত স্কাই ওয়াক। খাওয়ার খেয়ে বেরিয়েই সামান্য এগিয়ে আমরা চললাম স্কাই ওয়াকের টিকিট কাউন্টারের দিকে হাজির হলাম। তারপর ??? সোজা সিঁড়ি বেয়ে এক প্রশস্ত চত্বরে পৌঁছনোর পর দেখি একদিকে স্কাই ওয়াক আর অন্য দিকে পেলিং এর আরো এক প্রাচীন মনাস্ট্রির আরো উপরে ওঠার অগুন্তি সিঁড়ি । সবের মাঝে অনুপস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা , যা নাকি এই প্রশস্ত চত্বরের অন্যতম আকর্ষণ। তবে যা দেখলাম তা মোটেও কম নয় । সবের মাঝেই আছে সৌন্দর্য , তাই না ??? স্কাই ওয়াকের ওয়াক করার সময় আমার ভয়ের ঘাপটি মারা সত্ত্বা জেগে জেগে উঠছিল। পুরো জেগে গেলে আবার দেখার ভাণ্ডার ভরবে না , তাই ভয়টাকে সামলে সুমলে এবার মনাস্ট্রি সাঙ্গা চোওলিং এর দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। 

এই নাম নিয়ে এক গপ্পো আছে , আমার কর্তামশাই আগেও সিকিম এসেছিলেন , বলেছি আগেই, পেলিং এ তারা বন্ধুরা এই স্কাই ওয়াকের কাছাকাছি অবস্থিত হেলিপ্যাডের সামনের কোন এক হোটেলে ছিলেন বটে । সেই হেলিপ্যাড এখন নেই আর তখন স্কাই ওয়াক ছিল না । ভাগ্যিস !!! যা যা তিনি একদা দেখেছিলেন তার গপ্প এই কদিনে মুখস্থ হয়ে গেছে !!! পরীক্ষা নিলে গড়গড়িয়ে সব লিখে দিতে পারব .... একদম !! আবার এখন কেবলকার নেই , কিন্তু প্রস্তুতি চলছে । 

যা বলছিলাম ... এই সাঙ্গা চোওলিং মনাস্ট্রির নাম গুলিয়ে আমার তিনি খুঁজে চলেছেন সাঞ্ঝা চুলহা মনাস্ট্রি !!! বোঝো কাণ্ড!!! কোথায় দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত খাবারের দোকান আর কোথায় পেলিং এর মনাস্ট্রি ??? কিসে আর কিসে ???

এরপর দিনের আলো কমে আসার একটু আগে আমরা গেলাম পেলিং এর আরেক প্রাচীন মনাস্ট্রি পেমিয়াংসি দেখতে । ওখান থেকে এক ঝলক দেখে নিলাম রাবডানসে রুইনস , ওখানকার রাজার রাজ বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ইতিহাস আমাকে সব সময় টানাটানি করে , কিন্তুক এখানে রাস্তার বর্তমান আমাকে বাধ্য করল ফিরে আসতে । 

পথের ঝাঁপ খোলা থাকলে পরের দিন সকালে এই ইতিহাস ঘুরে দেখে সাথে পাখ পাখালি র জন্য চিহ্নিত অঞ্চল, যা আমাদের দেখার কথা ছিল তা দেখে আমরা ফিরতি পথ ধরতাম । 

কিন্তু !!!! বিধি বাম তাই পরের দিন সকাল ৭ টা তে প্রস্তুত হয়ে বাদ বাকি কাজ মিটিয়ে ৭.১৫ নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম....পথেই নানান ধরনের খ্যাটন ( জলখাবার ও মধ্যাহ্ন ভোজন ) পর্ব মিটিয়ে বিকেল বিকেল আমরা শিলিগুড়ি স্টেশনে পৌঁছলাম , পরের অধ্যায় সহজ সরল । সময় কাটিয়ে আমরা যথা সময়ে (সন্ধ্যা৭.৩০) ট্রেনে উঠে পড়লাম ....কু ঝিক ঝিক শব্দ তুলে রাতের বুক চিরে সকালে আমরা শিয়ালদহ তে পৌঁছে দিল আর আমরাও সময় মতন ঘরে ফিরে এলাম ।

Wednesday, 8 January 2025

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৭(ক)

রাবাংলাকে বিদায় জানিয়ে আমরা পাড়ি দিলাম নামচি র পথে । নামচি তে সত্যিই নামছি বলে নেমে এলাম অনেকখানি। রাবাংলার উচ্চতা নামচির থেকে বেশ বেশি ছিল। ঠাণ্ডার কাঁপনে তা ধরতে পারছিলাম হাঁড়ে হাঁড়ে ই। ওদিক থেকে বেলা ১১ নাগাদ বেরিয়ে গড়গড়িয়ে নেমে নামচিতে থামলাম বেলা সাড়ে বারটা র দিকে । পথে বেরলে আমাদের মা -মেয়ের খাই খাই বাই পেটে সিগনাল দিলেও তাকে পাত্তা না দিয়েই আমরা নামচির বিখ্যাত স্তুপ স্যাণ্ড্রুপসে দেখতে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। টপাটপ টিকিট কেটে গেট পেরিয়ে গটগটিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সিকিমের ঐতিহ্যবাহী নানা রঙের পতাকা র নিচে দাঁড়িয়ে আউট অফ সিলেভাস ছবি তোলা হল আমাদের মা - মেয়ের । আমাদের দু মক্কেলের বিরল মুহুর্ত বন্দী করা হল ক্যামেরাতে।এরপর হাল্কা চড়াই পেরিয়ে ওই স্তুপের সংলগ্ন মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য সিঁড়িতে উঠতে শুরু করলাম।মন্দিরের মাথায় বৌদ্ধ ধর্মের গুরু পদ্মসম্ভবের সুবিশাল মূর্তি সম্ভ্রম জাগায় । মূর্তির মুখখানি বেশ রাগি রাগি !!! নজর করল আমাদের কন্যা । দৈনন্দিন জীবনে রাগি মুখের সাথে তেনার ওঠা বসা , তাই ও চিনতে তেনার ভুল হয়নি !!! সে বলার পর আমরাও শতকরা একশ ভাগ সহমত হলাম পুপের সাথে । সত্যিই গুরুদেব পদ্মসম্ভব রাগি ছিলেন , মালুম হল !!! মূর্তির চোখের দিকে তাকিয়ে ।

ভাগ যোগ করে বিস্তর সিঁড়ির দেখা পেলাম এক সিঁড়ি বেয়ে খানিক ওপরে ওঠার পর । প্রসস্ত চত্বরের দুপাশ দিয়ে যেমন আরো দুখান সিঁড়ি নেমে গেছে , তেমন ই স্তুপের ভিতরের মন্দিরের মধ্য দিয়ে আরো ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির দেখা পেলাম। সেই সিঁড়ির শেষে হাঁপানো কাপানোর পর্ব চুকিয়ে পৌঁছে গেলাম বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবের পায়ের কাছে .... সামনে নাকি বিস্তারিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন দেন। কিন্তুক কপালের নাম গোপাল ... আমরা দর্শন পেলাম না। সামনের দিকের কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন ম্যাজিশিয়ানের যাদু দণ্ডের ছোঁয়ায় পুরোটাই ভ্যানিস !!!!

ওপরের চত্বরের এক সময় আমরা মা - মেয়ে বসে জিরিয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরে ফেললাম , স্যান্ড্রুপসে স্তুপের বাইরে বেরিয়ে আমরা যত জোর দিয়ে খাই খাই করলাম , তার থেকেও জোরালো যাই যাই এর পো ধরে আমাদের বাহন চালক চার চাকায় পথে নেমে পড়লেন আমাদের নিয়ে .... কিছুক্ষণ পরেই পথের ধারের এক চালু খাবারের দোকানে আমাদের নিয়ে এলেন , খেয়ে নিলাম তৃপ্তি করে । ক্ষিদের মুখে সব খাবার ই অমৃত !!! খাওয়ার পর আমরা চললাম নামচি চারধাম দেখতে ।

নামচি চারধাম পৌঁছলাম যখন , তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাকে ঘোড়া মনে হল ... কারণ সময় তখন প্রায় বিকেলের দিকে এগিয়ে চলেছে । এখানে দেখলাম আমাদের দেশের নানান ধামের অনুকরণে তৈরি এক মন্দিরের মেলা। সবাইকে সাথে আগলে রেখেছেন এক বিশালকার দেবাদিদেব মহেশ্বরের মূর্তি। একে একে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় শরীরে নানান পাক পাকাপাকি থাবা গাড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করল । মুখ নাকি শরীরের মনের আয়না .... অভিজ্ঞ কর্তামশাই সেই আয়না দেখে এক জায়গায় বসার নির্দেশ দিয়ে বাকি আরো কিছু মন্দির দর্শন করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে মন্দিরে গেলেন ... মেয়েকে আমার নাকি আমাকে মেয়ের জিম্মায় রেখে । আমিও কোন বায়না না করে সাজানো , গোছানো প্রশস্ত চত্বরের এক ধারে বসে পড়লাম। শরীরের কিছু অস্বস্তি হচ্ছিল সেই মূহুর্তে। 

কর্তামশাই মন্দির ঘুরে ফিরে আসার পর আমরা চারধাম থেকে ফিরতি পথে পা বাড়িয়ে আমাদের বাহনের কাছাকাছি হাজির হলাম !!! বাহন চালক বিজয়ের দেখা পাওয়া তো গেলই না , তার ফোনেও যোগাযোগ ব্যবস্থাকারী নেট সেট নেই এই বার্তা এসে আমাদের আপাদমস্তক সেটিং ঘেঁটে দিল !!! আমি অল্প ঘাবড়ে গেলেও বেশি ঘাবড়ালেন তিনি .... অচেনা স্থানে বৌ ও ছানা নিয়ে বেজায় চিন্তিত হলেও, তিন মোটেও দেখালেন না। সোজা কলকাতায় ফোন !!! কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি বিজয় একগাল হাসি নিয়ে সামনে হাজির !!! সে পার্কিং এর মাঝেই অন্য গাড়িতে দেশোয়ালি ভাই এর দেখা পেয়ে গল্পে মেতে গিয়েছিল !!! আমরা যে তার গাড়ির দুয়ারে হাজির, তা সে নজর করেনি। আসলে দুয়ারের কনসেপট টা একদম আমাদের সম্পত্তি !!! বালাই ষাট আর কারোকে দিতে পারি কিন্তু কেন দেব ? 

এরপর সাড়ে চারটে নাগাদ নামচি থেকে আবার যতটা নেমেছি , তা মেকাপ করতে পেলিং এর দিকে উঠতে শুরু করলাম !!!!