বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৭
রাবাংলার শান্ত পাহাড়ি পরিবেশ ছাড়তে মন না চাইলেও আমাদের ওখানে থাকার মেয়াদ ফুরিয়েছিল তাই আমরা সময় মতন শান্ত সমাহিত পাহাড়ী জনপদ রাবাংলা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
আবার পাহাড়ের পাকদণ্ডী , কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ,পথের পাশের নাম না জানা অযত্ন লালিত ফুলের শোভা দেখতে দেখতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘন্টা দুই আড়াই পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম সন্ড্রুপসে স্তুপা দর্শনে । প্রবেশদ্বার থেকে টিকিট কেটে স্তুপার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম পথের একপাশে সারিবদ্ধ নানান রঙের মন্ত্র লেখা পতাকা । মা - মেয়ে খানিক রঙ মেলান্তি খেলায় মেতে উঠলাম। বেড়াতে বেরলে আমাদের সুপ্ত অনেক ছেলেমানুষী মনের গহীন থেকে বেরিয়ে , আমাদের অবাক করে দেয় । আমাদের পরিধেয় র সাথে রঙ মিলিয়ে পতাকা বেছে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিছাবা তুলে স্তুপের সামনে হাজির হলাম !!! কনকনে ঠাণ্ডা আর খানিক সিঁড়ি ওপরে উঠে আমরা হাঁপিয়ে কাপিয়ে একশেষ। বিশেষ করে আমি । শরীর জানান দিচ্ছিল জলদি জলদি পাহাড়ের বেড়ু সেরে ফেলতে হবে । এখানেও যথারীতি বৌদ্ধ ধর্ম গুরু পদ্মনাভ র বিশালকার মূর্তির নিচে এক বৌদ্ধ মনাস্ট্রির প্রেয়ার হল। প্রেয়ার হলের মধ্য দিয়েই পদ্মনাভ র সামনে পৌঁছনোর সিঁড়ি । এখানে ভিতরে বাইরে অসংখ্য সিঁড়ি র ভুলভুলাইয়া !!! ওপরে উঠে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া পুরো কাঁপন ধরালেও বেশ ভাল লাগল। যদিও মেঘের চাদরে সব ঢাকা পড়ার জন্য আসল সৌন্দর্য দেখা দিল না। অন্য এক ভ্রমণার্থির মুখে শুনলাম, ওখান থেকে সামনে বিস্তারিত কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মেলে। দুর্ভাগ্য আমাদের কাঞ্চন দা দেখা দিলেন না এবার । নামার সময় প্রেয়ার হলের একপাশের টেবিলে রাখা অসংখ্য প্রদীপের আলোর স্নিগ্ধ রূপ ভারি ভাল লাগল , ওমন নিরিবিলি পরিবেশে । বেলা তখন বেশ খানিক এগিয়ে গেছে , বেড়ানোর সাথে যুক্ত আমার খাই খাই বাই তখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে , কারণ সকালের ৯ টার জলখাবার হজম হয়ে গেছে অনেক আগে । বেলা তখন বেশ বেশি !!! এরপর নাকি চারধাম দর্শনের পালা । আমাদের বাহন চালক বিজয় ভাইয়া র মতে চারধামের আগে পথেই পৈটিক ধামের পূজা হবে । চললাম এগিয়ে , এরপর পথের পাশের এক ছোট কিন্তু গোছানো ছিমছাম খাবার হোটেলে আমরা পেট পূজো সেরে নিয়ে চারধাম পৌঁছলাম বিকেল ৩.৪৫ এর কাছে ।
এক সাথে বদ্রিনাথ, রামেশ্বরম , জগন্নাথ ধাম , দ্বারকাধামের , আদলে তার ছোট্ট মিনিয়েচার সহ , মহাদেবের জ্যোতিরলিঙ্গের মন্দির সব মিলিয়ে এক মন্দিরের মেলা । প্রসস্ত চত্বরে নানান রঙ বাহারি ফুলের সমারোহের মাঝে বিশালাকার ভোলা নাথের মুর্তির সামনে বিস্তারিত চত্বরের নানান মন্দির ।
পড়ন্ত দিনের শেষে ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়ছিল আর সাথে অসংখ্য সিঁড়ির চড়াই পেরিয়ে ওপরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শারীরিক কষ্টের ছাপ বোধহয় পড়েছিল মুখের আয়নায় । মন চাইছে না মানতে , এদিকে শরীর চাইছে বোঝাতে যে সে ঠিকঠাক কাজ করছে না !!! এক সময় আমার লোকাল গার্জেন গর্জন না করেই শান্ত কন্ঠে আমাকে ক্ষেমা দিতে বললেন । তখনও বেশ কিছু মন্দির ঘুরে দেখা হয়নি ।আমি খুব প্রতিবাদী নই , তার উপর আবার একেবারেই সিলেভাস বহির্ভূত হেঁপো রুগী টাইপ আচরণ সারা শরীর জুড়ে প্রভাব বিস্তার করছে .... অগত্যা প্রসস্ত চত্বরের সামনে এক বিশালকার ঘন্টার সামনে ধপাস হলাম। আমার ভোলানাথ (?) এর ভয়ানক ভক্তি , তিনি শিব শম্ভু র দর্শন করবেন না তা কি হয় ??? কন্যা আমার জিম্মায় নাকি আমি কন্যার জিম্মায় !!! রইলাম , কে জানে ?? তিনি আরও কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে ভোলে বাবার দর্শন করে ফিরলেন আমাদের কাছে।
সব দেখাশোনা র সাথে বিস্তর ছবি তোলার পালা সাঙ্গ করে পরবর্তী গন্তব্য পেলিং এর পথ ধরলাম আমরা। ক্লান্ত শরীর তখন ঘরের উষ্ণতা র জন্য উন্মুখ হলেও সামনে তখনও ঘন্টা দুয়েকের আঁধারের ঘেরাটোপে বন্দী পাহাড়ী পথের পাকদণ্ডী।
বেশ একটা গা ছমছমে পথের মাঝে একবার চা পান বিরতি নিলাম। সেখানে আলাপ থেকে পেলিং থেকে ফেরত আসা দুই বাইকার ভ্রমণার্থি দ্বয়ের সাথে । তারা নানান ঘোরাঘুরি করছে বাইকের ভরষা য় , টিকিট পেলাম নাকি পেলাম না তাকে তোয়াক্কা না করেই। তবে এ কথাও ঠিক ওনাদের ভাবনা আর আমাদের ছাপোষা মানুষের বেড়ানোর ভাবনা সমান্তরাল , সমান নয় । ক্লান্তির সাথে অদ্ভুত এক প্রাপ্তির খুশি দেখেছিলাম ওদের চোখে মুখে । আমরা ও রসে বঞ্চিত তাই ট্যারা হয়ে চায়ের কাপে মন দিলাম ওনাদের কথা শুনতে শুনতে । এক সময় দুই ভিন্ন ও বিপরীত পথ ও ভাবনায় ভাবিত আমরা আর ওনারা আবার পথে নামলাম, উভয়ের গন্তব্যবিপরীতমুখী। চা তথা কথিত এনার্জি দায়ক পানীয় , তা পান করে নতুন উদ্যমে আঁধার নামা পাহাড়ী পথে আমরা এগিয়ে চললাম।
আবার সেই পাহাড়ী চড়াই পথে আঁধার ঘেরা রাতে আমাদের পথ চলা শুরু হল । মাঝে মাঝে পাহাড়ী জনপদ এর আলো পেরিয়ে আবার আঁধারের মাঝে হারাতে হারাতে পেলিং এর দিকে এগিয়ে চললাম। চলতে চলতেই এক সময় দেখলাম আমার কন্যা আগের বারের মতন গুটি শুটি মেরে আমার কোলের ঘেঁসে বসেছে। ভাল লাগল যেমন , তেমন মজাও লাগল। এখন আর সেই ছোট্ট টি নেই যদিও , তবে এখনও মা ছাড়া তার চলে না । যেটা খুব স্বাভাবিক। ফেরার পর এক ভ্রমণ পাগল দিদির কাছে শুনলাম রাবাংলা তে নাকি ভূতের দেখা মেলে । সেখানে মেলাই ভূত !!! তবে সত্যিই বলছি ... ওমন কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতা ঘটেনি । এমন কি যে দিদি এই তথ্য প্রদান করল , সে নিজেও খোঁজ খবর করেও সন্ধান পায়নি । ওখানে গিয়েও হোটেলের রিসেপশনে শুনেছিল যে তেনারা আছেন বটে !!! কিন্তুক সদ্য আগত অতিথিদের সাথে দেখা সাক্ষাত করেনি জানান দিয়ে ।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় তারা ই বা যায় কোথায় পাহাড় ছাড়া ? কিছু কি আর বাকি রেখেছি আমরা মানুষেরা !!! ফাঁকা আর নিরালা র সন্ধান পেলেই তো আমরা বাক্স গুছিয়ে ফাঁকা স্থান ভরিয়ে ফেলছি !!!!
যাইহোক , এক সময় পেলিং নজরে ধরা দিল ... তখনও আমরা পাহাড়ী পথের বাঁকে । দূর থেকে আলোর জোনাকি জ্বালানো পাহাড়ী শহর দৃশ্যমান হল। চিনিয়ে দিলেন আমাদের বাহন চালক বিজয় ভাইয়া। অবশেষে আমরা আপার পেলিং এর হোটেল সামথেনলিং এ পৌঁছলাম সন্ধ্যা ৭.৩০ টা র সময় ।
হোটেলের ঘরে ঢুকে আপাদমস্তক কাঁপুনি ধরে গেল !!! বাপ রে কি ঠাণ্ডা !! কিন্তুক আগের রুমহিটার জনিত ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে এ দিকের আমাদের লোকাল গার্জেনের ভয়ানক আপত্তি। একদম গর্জন করে থামিয়ে দিলেন বটে 🥺 । বুঝতেই চাইল না যে রাবাংলার হোটেলের ঘরের থেকে পেলিং এর হোটেলের ঘর অনেক বড়। তাই কোনা কানাচিতে ভাল রকম ঠাণ্ডা জমে আছে । কে আর কবে আমাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে ??? আজীবন দেখে দেখে মন পাথর হয়ে যেতে যেতেও যাচ্ছে না 😭। আমার কথা তখনই শোনা হয় যখন লোকাল গার্জেনের সাথে বিষয়টা মিল খায়।
যাক দুঃখের কথা বেশি বলা অনুচিত !!! ওখানে দু রাতের সংসার ভাল করে গুছু করে ফেললাম। এবার পেটপূজো না করলেই নয় । তাই চা ও টা খেয়ে গুটি গুটি বিছানার ডবল কম্বলের মাঝে সিঁধিয়ে গেলাম সাথে আনা গল্পের বই সহ। ওদিক থেকে বাণী নাকি নির্দেশ জারি হল ... ঘুম দিলে চলবে না রাতের খাবার খেতে হবে। .... এটা একটা কথা ?? আমি ঘুমালে খাব না ??? এতদিন ঘর করে আমার খাওয়া নিয়ে সন্দেহ ? আমি ঘুমিয়ে পড়ে , খাব না ??? আলবাৎ খাব । জেগে উঠে খাব। যত রাগ হোক , মা বলতেন খাবারের পরে রাগ করতে নেই। মায়ের অনেক কথা মেনে নিয়েছি ভাল না লাগলেও ( আখেরে ভালই যদিও হয়েছে ) কিন্তুক এ কথা খান মেনে তো নিয়েইছি, মনেও নিয়ে রেখে দিয়েছি । যাক কথা বাড়ালাম না ।
যথা সময়ে খাবার খেয়ে কনকনে ঠাণ্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে দাঁত কাপাটির বাজনা শুনতে শুনতে বিছানার ডবল কম্বলের ওমে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। ভোরে ঘুম ভাঙল কর্তামশাই এর ডাকাডাকির জেরে। ধাতস্ত হওয়ার আগেই টেনে নিয়ে গেল বারান্দায় ।
দূরে দুদিক বিস্তার করে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন জানালো সুপ্রভাত। মনটা ভাল লাগায় ভরে গেল। ঘুমিয়ে শরীরটা ঝরঝরে হয়ে গিয়েছিলই, কাঞ্চন দা দেখা দিয়ে মনটাও ভাল করে দিল ।
No comments:
Post a Comment