বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪১
বেড়ানোর গাড়ি কিছু সময়ের জন্য থামাতে হয়েছিল , আসলে নকলে মোদ্দা কথা হল পকেট পুরাণ। শেষবারের ভ্রমণে ভূস্বর্গের যুক্ত হওয়ার ফলে ছাপোষা বাঙালির যা হয় , আমাদেরও পকেট গড়ের মাঠ হয়েছিল। তার থেকে উত্থান পর্ব এখনও চালু , তবে মন বেশ অনেকদিন ধরেই আকুপাকু করছে । হেন কালে আপদ বিপদের প্রথম ঢেউ একেবারে আমায় খাটে শুইয়ে দিল ... পায়ের আঙ্গুল ভাঙল । বেরিয়ে পড়ার ভাবনা আবার বাক্স বন্দী হল । পদ যুগলের একখান সম্বল করে আর যাই হোক বেরিয়ে পড়া যায় না। ক্যালেন্ডার মোতাবেক শীতকাল হাজির হল । হাড় বিশেষজ্ঞের অনুমতি নিয়ে এক শনিবারের সকালে আমরা ঝোলা ঝুলিয়ে তিন পরিবার রওনা দিলাম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের দিকে। লোধাশুলি র জঙ্গলের নাম শুনেছি আগে মাওবাদীদের গল্পের পটভূমি স্বরূপ। সকলেই রোমাঞ্চিত .... আমি সদ্য পায়ের বিপদ কাটার পরবর্তী ভ্রমণ নিয়ে বেশ চিন্তিত , ইচ্ছে থাকলেও মনে বিস্তর ভয়ের আনাগোনা তখন । পারব তো ?? আমার জন্য অন্যদের ঘোরাঘুরির আনন্দে ছেদ পড়বে না তো ?? আগেও লিখেছি ... আমার ভয় ব্যকুলতা দুখান ক্ষেত্রে মাথা চাড়া দিলেও , ঘাঁটি গেড়ে ঘোট পাকাতে পারে না। তার মধ্যে একখান ক্ষেত্র অবশ্যই বেড়ানো । আর আমাদের কাণ্ডারী একটা কথাই বলছিলেন ... নিয়ম মেনে , সময় দিয়ে ভাঙা পায়ের মেরামত করার পরে যখন যাতায়াতের নির্ধারণ, তখন ভাবনাকে হাওয়ার সাথে ভাসিয়ে , সাবধানী হয়ে পথ চললেই হয় , যেখানে থামার নির্দেশ মিলবে , থেমে গেলেই হবে। অতএব....
পরিচিত কজনার নির্দেশ মেনে দুখান বাহনের একখানের পিছনের সিটে পদ যুগলকে যত্ন সহ শায়িত করে যাত্রা শুরু হল । আমাদের সাথের দুই ছানা অন্য গাড়িতে পুরোপুরি মজা নেবার জন্য রইল। মা র সাথে থাকা মানেই নানাবিধ জ্ঞানের ধারাবিবরণ শুনতে শুনতে পথ চলা। অন্য সময় যাও বা তা সয় , সইতে হয় , বেড়ানোর সময় যদি সুযোগ থাকে অন্যরকম , কে না তার সদ্ব্যবহার করে ?? পুপে তো কোন ছার ?? সাথের আরেক পুপে অবশ্যি মা নেওটা। আমার জন এক ব্যাপারে ভারি বিবেচক। নেওটা র ভাগাভাগাতে বাবা আর মা দুজনকেই সমান ভাগ দিয়েছে। যদিও মা মনে করে কন্যা বাপ-সোহাগী , ওদিকের জনের ভাবনায় কন্যা রত্নটি মা অন্ত প্রাণ। ও সব বিতর্কিত আলোচনা আনন্দ ক্ষণে তোলা থাক ।
মোটের পর মা আর কন্যা আলাদা বাহনে পেরিয়ে গেল লোধাশুলির জঙ্গল। ঝকঝকে পথের দুপাশে শালের জঙ্গলের রোদ ছায়া র লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে আমরা ঝাড়গ্রামে পৌঁছলাম। তখন দ্বিপ্রহর । মনে ভাবা হল ... মুখ হাত ধুয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনের পাট চুকিয়ে আমরা কাছেই অবস্থিত কনকদূর্গা মন্দির দেখতে যাব , যা নাকি ডুলুং নদীর ধারে অবস্থিত। এই কনকদূর্গা মন্দিরের পিছনে রয়েছে ডুলুং নদী । ওখানে সন্ধ্যারতি দেখে ফেরার ইচ্ছে নিয়ে আমরা ঝাড়গ্রামের টুরিস্ট লজের ডাইনিং রুমে হাজির হলাম ।
ওখানে ঢুকতেই নজরে এল একখান বিশৃঙখল চিত্র । কিছু কিছু বোর্ডার লাঞ্চে রত। কিছুজন অপেক্ষারত। আমরা নিজেদের দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত করে একখান অপরিষ্কার টেবিলের পাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। ডাইনিং হলের পাশের রান্নাঘরে উকি দিতে না দিতেই পাশ দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে খাবারের সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ট্রে নিয়ে বেয়ারা ছেলেটি বেয়াড়া ভাবে বেরিয়ে গেল , কিছু বাদেই একই রকম দুর্নিবার গতিতে ফেরত এলো। অতি কষ্টে তাকে সামনের টেবিল পরিষ্কার করার নির্দেশ দিতেই সে বললে ... অপেক্ষা করতে হবে। অগত্যা ... অপেক্ষার প্রহরে তা দিতে থাকলাম । পারদ উর্ধ্বগামী হচ্ছিল সবারই , খানিক অপেক্ষার পরেও অবস্থার পরিবর্তন যখন চোখে পড়ল না , সাথের পুরুষ সিংহদের সিংহত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছি কি না করেছি ... তাদের হালুম গর্জনে ডাইনিং হল পুরো গেলুম হয়ে গেল। ম্যানেজার ছুটে এলেন ... তুরন্ত খাবারেরও দেখা মিলল । আর .... !!! পাশের টেবিলের এক সুবেশা সুন্দরী এসে সিংহদের অভিবাদন জানিয়ে গেলেন । সিংহদের চোখে মুখে এক অদ্ভুত দ্যুতি খেলে গেল তৎক্ষণাৎ। এরপর সপরিবারে ভরপুর আহারের পর , দিন দেখি প্রায় যায় যায় ... চারটে বাজে প্রায় , তখন আর বেরনোর কথা ভাবা যায় ?? যাব কি যাব না , ভেবে ভেবে হায় রে !!! যাওয়া তো হলো না !!! অতএব আমরা কটেজ মুখী আর সাথের দুই পুপে , ( হ্যাঁ ওদের দুজনের নামই এক ) বাগানের দোলনামুখী হল । আমাদেরও ঘরে বিশেষ বসা হলো না , ক্যামেরা তাক করে বাগানে বাকিদের সাথে যোগ দিলাম। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই এই লজের বেশ কিছু বাসিন্দাদের ক্যামেরাবন্দী করলাম। লজের বাসিন্দা বলতে ছোট বেলার পড়া ছাড়ার সেই এক পাল হাঁস । যাদের দেখে শুনে কোন ছোটবেলায় মুখস্থ করা ছড়া মনে পড়ে গিয়েছিল .... এক পাল হাঁস শুধু হাসে প্যাকপেকিয়ে। রাজহাঁস, পাতি হাঁস তো বটেই, ছিল বেশ কটি কুকুর ছানা তাদের মা সহ আর ছিল দুখান টার্কি। যাদের ধারে কাছে না ঘোরাঘুরি করলেও বেশ একটা ভয় পাওয়ানো ভাব দেখানোর চেষ্টার ত্রুটি রাখছিল না তারা। পরে সত্য দা র মুখে শুনলাম যে বেসিক্যালি ওরা ভয় পেয়েই ওমন করছিল । আসলে আমরা মানুষেরাই বোধহয় সব চেয়ে ভয়ানক প্রাণী !!!!
সন্ধ্যার সময় যথা নিয়মে আমাদের ঘরেই আড্ডার মজলিস বসল। যদিও দুই পুপে তাদের ধন সম্পত্তি সহ অন্য ঘরে খেলতে গেল । সাথে সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত Animal ছবির গান শোনার ব্যবস্থাও সাথে নিল তারা । গল্প চলল , সাথে আমরা সকলেই ভোজন রসিক তাই আমাদের খাওয়ার বহরে ওখানকার রান্নাঘর ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমরা একসময় আড্ডার শেষে আড্ডাঘরে তালা ঝুলিয়ে খাওয়ার ঘরে গেলাম। এরপরের গল্পে কোন টুইস্ট নেই। খেয়ে ঘুম । পরের দিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবারেও দুই পুপে অন্য গাড়িতে । আমাদের গন্তব্য বেলপাহাড়ি ... সংলগ্ন এলাকার দর্শনীয় যতটা দেখা যায় । মাসখানেক আগেই পা ভেঙেছিল, তাই পায়ের যত্ন নিয়ে যতটা ঘোরা যায় ততটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। পায়ের প্রতি যত্নবান যেমন হয়েছিলাম , তেমনই ঝাড়গ্রামের ভয়ানক হাঁড় কাপানো শীতের গল্প আগাম কলকাতায় বসে শুনে সেই মতন যত্নবান হয়ে শীত পোষাক সাথে নিয়ে এবারে যাত্রা করেছিলাম। কিন্তু পরন্তু কথা হল , মিঠে রোদের দেখা মেলেনি , বরং খর রোদে শালের কাপড়ের তৈরি পোশাক পরে যারপরনাই অতিষ্ঠ হয়েছিলাম। একদিকে পা নিয়ে যাতনা , অন্যদিকে শরীর জোড়া গরমের যুগল বন্দী আমাদের এবারের বেড়ানোকে ধীর গতি সম্পন্ন করে দিয়েছিল । বেলপাহাড়ির ঘাঘরা ফলস্ গিয়ে একজায়গায় পাথরের ওপর আমাকে বসিয়ে সকলে ঘুরে দেখল চারিপাশ। আমি পাথরে পা ছড়িয়ে বসে খান কতক ছবি তুললাম মনের খুশিতে । সব কিছুর ইতিবাচক দিক থাকেই। আমি যখন সবার সাথে ঘুরি , দর্শনীয় স্থানের ছবি তুলতে থাকি আমাকে রেখে সবাই এগিয়ে যায় , এবারে সবার ঘোরাঘুরির পর আমাকে নিতে এলো , আমিও মন ভরে রুখাশুখা পাথরের আশপাশের সুন্দর প্রকৃতির ছবি তোলার পর আস্তে ধীরে পরের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম । এরপর খানদারানি লেক ও তারাফেনি জলাধার দেখে তপন মামা থুড়ি সুজ্জি মামার দাপটে ফেরার পথ ধরলাম ... আমার তখন গরমে শালের তৈরি পোশাক পরে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা !!! ওই চত্বরের আশেপাশে আরো কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা শুনলেও সে গুলোকে বাতিল করতেই হল । ফেরার পথে সকলেই খেঁজুরের গুঁড় ও পাটালি চাটাচাটি আর বাছাবাছি করে নিজেদের ও ফরমায়েস মোতাবেক খরিদারি হল । এরপরে ঠিক হল পেট পূজোর পর ঝাড়গ্রামের ফিরতি পথে টুরিস্ট লজমুখী না হয়ে আমরা যাব কনকদূর্গা মন্দির, ডুলুং নদী আর চিলকি গড়। বেলপাহাড়ি আসার পথে ফুড ব্লগ দেখে আমরা আগেই দুপুরের খাবারের অর্ডার করে দিয়েছিলাম " কাঁচা লঙ্কা " নামক খাওয়ার হোটেলে । ফিরতি পথে সেখানে এসে মালুম হল যে সকলেই দামু ছায়াছবির বিখ্যাত চরিত্র দামুর ন্যায় চালাক হয়ে গেছে। সকলেই ওখানে আগাম খাবারের বুকিং করেছেন এবং সে মত কুকিং হলেও স্থান সংকুলানে বেশ বিপদ । বেশ খানিক ধর্ণা দিয়ে তেঁতুল পাতায় ন'জন স্টাইলে সিলিম (slim) ট্রিম বেঞ্চিতে বসে ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে পরিবেশিত ইঞ্চি মাপা খাবারে পেট ঠাণ্ডা করলাম সবাই ।
খাওয়ার পর্ব চুকতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভাবনা অনুযায়ী। বেশ অনেকখানি পথের শেষে এসে পৌঁছলাম কনকদূর্গা মন্দিরের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয় । আমার পায়ের যাতনা জানান দিলেও থেমে থেমে এগিয়ে যেতে লাগলাম । যাওয়ার পথ আর আসার পথ একই। একটু এগিয়ে এক বৃদ্ধা ভদ্র মহিলাকে যখন ফিরতে দেখলাম লাঠিতে ভর দিয়ে , মনের মধ্যে থেকে কে যেন আমাকে নাড়িয়ে দিল ... ওনাকে দেখে মনে হল আমার হাঁটার কষ্ট কি ওনার থেকেও বেশি নাকি ??? অদ্ভুত জোর পেলাম। এরপর এগিয়ে চললাম আগের থেকে দ্রুত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে। বিশাল মন্দির চত্বরের একদিকে পুরাতন মন্দির অন্য দিকে নব নির্মিত মন্দির। তবে পুরাতন মন্দিরের সর্বাঙ্গে নতুন রঙের চমক । আগের ট্রাভেল ব্লগে দেখা ও আগে ঘুরতে আসা বন্ধুদের থেকে শোনা সেই পুরাতনের গন্ধ মাখা মন্দির কে না পেয়ে সকলে যারপরনাই হতাশ হলাম !!
প্রাঙ্গনে দর্শনার্থীদের থেকে ভিড় বেশি যাদের তারা গাছের ডালে ডালে , নাটমন্দিরের রেলিং এ সার দিয়ে লেজ ঝুলিয়ে কেউ বসে , কেউ ঝুলন্ত, দুলন্ত, চলন্ত ও ছুটন্ত মোডে বিদ্যমান ছিল । খানিকক্ষণ কাটানোর পর আমরা বেরিয়ে এলাম আস্তে ধীরে । এরপর আমরা ডুলুং নদীর ওপরের ব্রীজ পেরিয়ে পৌঁছলাম চিলকী গড়ে । তখন দিন ক্রমশঃ মিশে যাচ্ছে রাতের আঁধারে । চিলকিগড়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে আমরা গড়ের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম অন্ধকারের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে অনেক অজানা ইতিহাসের সাক্ষী বহনকারী চিলকিগড়। যদিও গড়ে ঢোকার কোন উপায় নেই , ব্যবস্থাও নেই। বাইরে থেকেই সবটা দেখে ফেরার পথ যখন ধরলাম তখন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ । শহুরে আলোর অভাবে চাঁদের আলোর জৌলুশ যে আরো বাড়ে তা বলা ই বাহুল্য ।
এরপরে আমরা ফিরে এলাম টুরিস্ট লজে। সেদিন লজের মধ্যেই সাঁওতাল নৃত্য দেখানোর বিস্তারিত আয়োজন হয়েছিল। এই নৃত্য দেখানোর একটা চল হয়েছে বেশ কিছু বছর। আগেও দেখেছি । এবারে একটু বেশি রকম প্রফেশনালিজমের ছোঁয়া সমৃদ্ধ সাঁওতালি নৃত্য দেখলাম।
ঘরোয়া আড্ডার মজলিস শেষে আমরা খেয়ে ঘুমের মাঝে হারিয়ে গেলাম। দিনের তাপ রাতে কমে এক আরামদায়ক পরিবেশের রচনা করেছিল , তাই ঘুম হলো অসাধারণ। পরেরদিন ফেরার পালা। পথে টুকটাক কিছু ঘুরে নেওয়ার কথাও ছিল । কিন্তু সব গোছাগুছির শেষ প্রহরে যখন বেলা ১১টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম, রোদের প্রখরতা আমাদের সব ঘোরাঘুরির ভাবনা বাতিল করতে বাধ্য করল। আমরা বাড়ির পথ ধরে ফিরে চললাম কলকাতার দিকে। ফেরার পর শুরু হয় যে কোনো নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার ভাবনা আর তার জন্য অপেক্ষা । অতএব আবার চলতে থাকুক অপেক্ষা !!!!
No comments:
Post a Comment