বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪৬
গ্যাংটক থেকে আমরা চললাম রাবাংলার দিকে। কর্তামশাই যদিও সিকিমে বেশ কয়েকবার এসেছেন কিন্তু তিনি সিকিমের একই জায়গা গুলোর মধ্যেই গোল গোল ঘুরেছেন নানান ক্ষেত্রের বন্ধুদের সাথে । তেনার সাথের এত বছরের অভিজ্ঞতার রেশ ধরে বলতে পারি বিস্তর গাইড সদৃশ ভাবমূর্তির উপস্থাপনা করেই আর নতুন কিছু তার দেখা হয়ে ওঠেনি সেই সব ভ্রমণে । রাবাংলা আমাদের দুজনার কাছেই অচেনা ও অদেখা। পথ চললাম দুপাশের পাহাড়ী জনপদ, পাহাড়ী সৌন্দর্য আর নির্বাচনের নিদর্শন দেখতে দেখতে । বেলা গড়িয়ে বিকেল হল । রাবাংলার পথে শুনেছিলাম পড়বে বিখ্যাত টেমি চা বাগান। কথা ছিল আমরা সেখান ঘুরে নিয়েই রাবাংলার হোটেলের দিকে রওনা দেব। সেই মতন পথের দুপাশের চা বাগানের শোভা দেখতে দেখতে মুগ্ধতার রেশ কাটাতে না কাটাতেই আমাদের বাহন চালক বিজয় ভাইয়া একখান মোড় ঘুরে প্রসস্ত রাস্তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করলেন। নামতে নামতেই পথের বিপরীতে একই সাথে দেখতে পেলাম বড় করে লেখা ও পাহাড়ী ধাপে ধাপে নেমে আসা দুটিপাতা, একটি কুড়ি সমৃদ্ধ রাশি রাশি চা গাছ। ইদানিং সব কিছুতেই ভালবাসা জাহির করার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে , তাই হয়তো আসল ভালবাসা কম পড়িয়াছে 🤫 । প্রকৃতি প্রেমীকে , অঞ্চল প্রেমীকে আলাদা করে বলে দিতে হয়না যে প্রকৃতিকে, অঞ্চলকে সে ভালবাসে , তবে এখন এটাই দস্তুর। সেই মতন দেখলাম বড় বড় হরফে ভালবাসার প্রদর্শিত লিখন। I love Temi 😃.... সে সব হরফ জড়িয়ে হেলে দুলে খান কতক ছবি তুলে ফেললাম। এ সব ক্ষেত্রে নিজেদের ছবির থেকেও আমার কাছে প্রকৃতির ছবি অগ্রাধিকার পায় । ছবি তোলার পর দেখি সন্ধ্যার আঁধার নামব নামব করছিল !!! পাহাড়ী পথের আঁধার বেশ গা ছমছমে । চা বাগান থেকে বেরিয়ে একটু চা পান বিরতি নিয়ে ফেললাম সাথে ফেসবুকের কল্যাণে বাগানের দিকে চায়ের কাপ ধরা হাত শূন্যে তুলে এক কায়দাবাজী ছবিও তুলে ফেললাম কর্তামশাই এর নির্দেশে। তিনি ইদানিং ছবি তোলার নানান ধরনের রকম বেরকমের সমঝদার হয়েছেন ফেসবুক পরিবারের হাত ধরে । টেমি চা ফ্যাক্টরির নির্ধারিত দোকান থেকে অল্প করে চা কেনা হল। আবার পথ চলা শুরু করলাম আঁধার নামা পাহাড়ি পথে । উদয় শঙ্কর সরণী বেয়ে আমরা রাবাংলার দিকে চললাম। আমার কন্যার আতঙ্কিত মুখ দেখে বুঝলাম ... বেচারী অন্ধকার পাহাড়ী পথে অশরীরি উপস্থিতির কথা ভেবে ভয়ানক ভীত সন্ত্রস্ত !!! ভয়টাকে তার পিতাজী তা দিয়ে জোরালো করতে করতে পথ চলল আর কন্যা একদম আমার কোলের কাছে ঘেঁসে আতঙ্ক চেপে চলতে লাগল। এই ভাবেই আঁধার ঘেরা পথে এক সময় অনেক দূর থেকে আলোকিত বুদ্ধের শান্ত সৌম্য মূর্তি দেখা দিলেন পাহাড়ী পথের বাঁকে। মেয়েকে অভয় বাণী দিয়ে খানিক ধাতস্ত করলাম কারণ বুঝলাম আমরা আমাদের গন্তব্য রাবং অথবা রাবাংলাতে পৌঁছে গেছি । এবার শুরু হল হোটেলের খোঁজ .... আমাদের ভ্রমণ গাইড সুমিত দা র কথা মতন আমাদের হোটেল বুদ্ধা পার্ক রেসিডেন্সী রাবাংলার বিখ্যাত বুদ্ধা পার্কের ভিতরেই অবস্থিত। কিন্তু পরন্তু কথা হল ... হোটেল রিসেপশনের নানান পথ নির্দেশ আমাদের পুরো ঘেঁটে ঘ করে দিল !!! পরে দেখা গেল আমাদের গুগুল বাবু একমাত্র ঠিকঠাক নিশানা বাতলেছিলেন .... হোটেলের রিসেপশন আলো করে তখন যিনি ছিলেন তিনি পাহাড়ী ঠাণ্ডার প্রকোপ কমাতে একটু রঙিন হয়ে ছিলেন ক পাত্তর গলধঃকরণ করে 🤔 সেই সব চাপানউতোরের পাট মিটিয়ে ঘরে ঢুকে মোটামুটি শীতের হাওয়ার লাগল নাচন বলা ভাল লাগল কাঁপন । রাবাংলার উচ্চতা গ্যাংটকের থেকে বেশি আর ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ , তেমন জনবহুল নয় কাজেই ঠাণ্ডা বেশ বেশি ছিল। কিছু পরে আমার কাঁপাকাপি মাপামাপি করে আমার কর্তামশাই রিসেপশনের এক স্বাভাবিক কর্মী মারফত রুম হিটার আনা করালেন । সত্যিই তখন আরাম পেলাম !!! বিছানার পাশের দেওয়াল জোড়া কাচের শার্শি র পর্দা সরিয়ে বুদ্ধা পার্কের বুদ্ধদেবের দর্শন পেলাম । জানালার একটু ফাঁকের জন্যই ঘর যে ওমন ঠাণ্ডা তা বুঝলাম ।
একটু পরেই সদালাপী আমি পাশের ঘরের আরেক বাঙালি পরিবারের সাথে আলাপ করে এলাম । আগেই কর্তামশাই এর আলাপ হয়েছিল যখন রিসেপশন বিভ্রাট চলছিল তখন !!! দুজনেই কলকাতার সরকারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা সাথে ছোট্ট ছেলে । বছর পাঁচেক র । অল্প গল্প করে ঘরে ফিরে দুজনে মুখোমুখি খানিক গপ্পো জুড়লাম , কন্যার মন তখন ফোনে । নিজের সংসারে মুখোমুখি গপ্প করার বড়ই সময়াভাব । মাঝে এসে ভিড় করে কাঁচা বাজার , জলখাবারের পাট , মাসের বাজার ইত্যাদি প্রভৃতি । সেই প্রচলিত প্রবচন ... খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়ার এক পাঁচালি !!!
গপ্পো শেষে মুড়িঝুড়ি দিয়ে কনকনে ডাইনিং রুমে খেতে গেলাম । বিশালাকার খাওয়ার ঘরের একদিকে রান্না ঘরে যাওয়ার দরজা খান খোলা আর সেজন্যই ঠাণ্ডার প্রকোপ খাওয়ার ঘরে ভয়ানক। চটপট খেয়ে আমরা ঘরে ফিরে বিছানার নরম গদি আর দুখান লেপের মাঝে হারিয়ে গেলাম । ঘুম এসে গেল চটপট। পায়ের কাছে রুমহিটার ঘরকে হট করতে থাকল । কিন্তুক মাঝরাতে আমি আর আমার কন্যার এতোই হট হলাম যে আমাদের ছটফটানি গেল বেড়ে আর ঘুমন্ত কর্তামশাই জাগন্ত হয়ে রাগে হট হয়ে হিটারের সুইস বন্ধ করলেন ফট করে । কিছু কিছু রাগের বক্তব্য বিতরণ করে জল খেয়ে তিনি তুরন্ত নিদ্রামগ্ন হলেন , আমার নিদ্রা তখন ভগ্ন দশায় !!! দফায় দফায় মুখে চোখে কনকনে জল দিয়ে ও খেয়ে খানিক ধাতস্ত হয়ে নিদ্রায় মগ্ন হওয়ার আরাধনা করতে করতে এক সময় সত্যিই মগ্ন হলাম । ঘুম ভাঙল তখন ৫.৩০ , জানালা খুলতেই এক ঝাপটা কনকনে হাওয়া পুরো কাঁপিয়ে দিলেও ভোরের আলোয় গৌতম বুদ্ধের সৌম্য মূর্তি র দর্শন করলাম। মনটা ভারি ভাল হয়ে গেল ।রাতে যখন ঘুমের সাধনা চলছিল তখন একবার জানালার কাঁচে চোখ রেখে গৌতম বুদ্ধের দর্শন মেলেনি। অবাক কাণ্ড কিছুই নয় কুয়াশা ঢেকে রেখেছিল তাঁকে । বেলা বাড়ার সাথে সাথে এমন লুকোচুরি চলতে থাকল । আকাশের মুখ ভার মুক্ত হল না তাই বুদ্ধা পার্কের একপাশে যে আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে দর্শন দেন কাঞ্চনজঙ্ঘা তার কোন প্রমাণ মিলল না । তবে জলখাবার গলধঃকরণ করে আমরা সুবিশাল বুদ্ধের মূর্তি সহ প্রেয়ার হল , সুবিশাল পার্ক সবটাই হেঁটে ঘুরপাক খেলাম অনেক সময় নিয়ে । যদিও ব্যাটারী চালিত গাড়ির ব্যবস্থাপনা ছিল ওপরের প্রেয়ার হলে যাওয়ার ও পার্ক ঘোরার জন্য।
ঘোরাঘুরির পর আমাদের বাক্স প্যাটরাসহ বেরিয়ে যাওয়ার কথা আগে থেকেই ঠিক ছিল, পরবর্তি গন্তব্যের দিকে। রাবাংলার নিঝুম , শান্ত প্রকৃতি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না , কিন্তু যেতে তো হবেই। সেদিন আমাদের নামচি আর চারধাম ঘুরে রাতে পেলিং পৌঁছনোর কথা !!!