Tuesday, 28 August 2018

স্মৃতিটুকু থাক

শুচিস্মিতা ভদ্র

সমুদ্রের জলে ফসফরাস থাকে, তাই এত রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাড়ে জলরাশির আছড়ে পড়া এত দূর থেকেও রত্নাকর দেখছেন।একের পর এক ঢেউ আসছে, আবার আসছে, আবার আসছে........।অবিরাম এর কোনো শেষ নেই। এখন রাত প্রায় দুটো, রত্নাবলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কিন্তু রত্নাকরের আজ ঘুম আসবে না ।
কী অদ্ভুত নাম "রত্নাকর"।বাবা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ? এই প্রশ্ন করলে শুধু হাসতেন,  কোনো উত্তর দিতেন না । স্কুলে, কলেজে , বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র বন্ধুরা নামকরণ  করে দিয়েছিল।এমনকি কলেজের মানব স্যার ও দস্যু রত্নাকর বলে সম্বোধন করতেন। এক এক সময় খুব অভিমান হোতো বাবার ওপর। আর কী অন্য কোনো ভাল নাম ছিল না !!!! একদিন কাছে ডেকে মানব স্যার বলেছিলেন "নামে  কিবা আসে যায় !!! যে রত্নাকর সেই তো মহা কবি বাল্মীকি, তা কী ভুলে গেছো ?"
খুবই শান্ত শিষ্ট ছিলেন। রত্নাবলী র সাথে যখন বিয়ে হলো, তখন বাসরে শ্যালিকারা নামটি নিয়ে মজা করার সুযোগ ছাড়েনি মোটেই।
যাইহোক এই বছর ফাল্গুন মাসে  তাদের বিয়ের সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হল।সেই দিনে ও দুজনের কেউ ই জানতেন না যে ভবিষ্যৎ এ কী অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য।

"কাল রাতে ঘুমাওনি  না গো ?"  রত্নাবলীর প্রশ্নে রত্নাকর একটু  অবাক হন। "তুমি কি ভাবো, আমি কিছুই টের পাবো না ?" রত্নাবলীর  প্রশ্নে, একটু অসহায় লাগে রত্নাকরের। চায়ের কাটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখেন। হোটেলের বারান্দা থেকে ভোরের সমুদ্রকে একবার দেখে নেন। বলেন-- "ঘুম আসছিলো না, আর আজই তো ফেরার ট্রেন, তাই ভালো করে রাতের নির্জন সমুদ্র কে দেখছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো ।তুমি রাগ করলে রত্না ?
রত্নাবলী হেসে ফেলে, আবার মায়া ও হয় । ভাবেন--এরপর কি হবে?  এত সংবেদনশীল মানুষটার মনটাকে কে বুঝবে? কিন্তু না; এসব কোনো কথাই তিনি বলেন না।তাহলে যে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। এবারের ভ্রমণে কোনো মন খারাপের কথা বলা চলবে নাযে।এমন কথা তো এখানে আসার আগে দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবু ও মনের উপরে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন দুজনেই। খুব স্বাভাবিক।আসলে আজ ই তো তাদের ঘরে ফেরার দিন। ট্রেন সন্ধ্যায় ।এই হয়তো তাদের একসাথে কাটানো শেষ ভালো কিছু মুহূর্ত।হয়তো ই বা ভাবছেন কেন ? এটা ই তো তাদের শেষ ভ্রমণ।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে,  স্বামীর দিকে তাকান রত্নাবলী। সেখানেও কষ্টকে চাপা দেওয়ার কষ্টকর প্রয়াস দেখতে পান।কিন্তু এমনটা আজ কেন হচ্ছে কে জানে ? এখানে কি আসার পর থেকে গত চারদিন তারা দুজনে যা আনন্দে কাটালেন, তা মনের মণিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মনের জোরে কিছুটা ঘোরাফেরা ও করেছেন গত কয়েকদিন।
বিগত মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই রত্নাবলী অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাঝে মাঝে মধ্যেই ভীষণ হাপিয়ে যাচ্ছিলেন।নিছক হার্টের সমস্যা ই ভেবেছিলেন।কিন্তু না না রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও কিছুই সঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।ওনারা নিঃসন্তান।কাজেই সব রকম ছুটোছুটি করে রত্নাকর ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন।কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি।শেষে নানা রকম পরীক্ষা র শেষে ডাক্তার সন্দেহ করেন যে রত্নাবলীর শরীরে কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধি আশ্রয় নিয়েছে। যেদিন সেই রোগ সম্পর্কে ডাক্তার সহ ওনারা দুজনেই  নিশ্চিত হন, সেদিন রাতে রত্নাকর খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। এক নিমেষে যেন বয়সটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
রত্নাবলী কাছে এসে ,  রত্নাকরের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিলেন--"এসো আজ আমরা একে অপরকে একটা প্রতিশ্রুতি দিই।" অবাক চোখে রত্নাকর তাকিয়ে ছিলেন, রত্নাবলী আবার বলেছিলেন ---"তোমার এমন হেরে যাওয়া , অবসন্ন মুখ আমি দেখতে চাই না।তুমি তো কিছু লুকোওনি আমার কাছে , আমি তো সবটা জানি, কাজেই এই দিন গুলো একটু অন্য ভাবে কাটাই আমরা । চলো না গো , আমরা বিয়ের পর পর যে সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম , সেখানেই আবার যাই।"
"কিন্তু রত্না তোমার শারীরিক কষ্ট. ......" রত্নাকর কে থামিয়ে দিয়ে রত্নাবলী বলেছিল-"শারীরিক কষ্টের জন্য যা করণীয়, ওষুধ পথ্য সব চলুক তাতে আপত্তি করিনি তো ! কিন্তু মন ভরে একটু ঘুরে আসি আমরা দুজন।"
রত্নাকর আপত্তি করেননি।ডাক্তারের  সাথে কথা বলে সেই মতো সব বন্দোবস্ত করেই তারা চলে এসেছিলেন  কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে।অসুস্থতা সম্বন্ধে কাউকে বিশেষ জানাননি।কি হবে ? অহেতুক মানুষজনকে বিব্রত করার ঘোর বিরোধী ওরা দুজনেই।
শুধু আসার আগে নিজেদের কাছেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন যে,  এ কদিন কোনো দুঃখের ছোঁয়া যেন তাদের ধারে পাশে না থাকে। শারীরিক কষ্ট তো কিছু আছেই,  থাকবে ও , কিন্তু তা যেন তাদের আনন্দে আঁচড় কাটতে না পারে ।
রত্নাকর , রত্নাবলী নামের দিক থেকে আশ্চর্য মিল।তাদের দুজনের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত এসেছে আর পাঁচ জনের মতো ই ।দুজনের অনেক মিল, অমিল জীবনে চলার পথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এবার বোধহয় দ্বৈত জীবনের ছন্দপতনের সময় এসে গেছে।
ওনারা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের " বোঝাপড়া" কবিতার বিখ্যাত কটি লাইন মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।খুব সহজ নয় বটে, তবে অসম্ভব ও নয়---"মনে রে আজ কতো যে, ভালো মন্দ যাহা আসুক, সত্য রে লও সহজে।"

Saturday, 25 August 2018

বন্দী শৈশব

শুচিস্মিতা ভদ্র

 অন্ধকারে ঘরের দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ প্রথমে সময়টা ঠাওর করতে পারে না। আস্তে আস্তে night lamp এর মৃদু আলোয়, একটু ধাতস্থ হবার পর, সঠিক সময় টা দেখতে পায়। ঠিক , এখন প্রায় রাত আড়াইটে। আজ ও রীমি পাশে নেই। টিকলি , একটু কুঁকড়ে পাশবালিশ জড়িয়ে অঘোর ঘুমে , হয়তো বা স্বপ্নের রাজ্যে .....। ঘুমন্ত টিকলিকে বড়ো মায়াময় লাগে।
আজকের সন্ধ্যার ঘটনায় অনিরুদ্ধ , যারপরনাই হতবাক ও চিন্তিত। বাড়িতে ঢুকে অন্ধকার ঘরে মা আর মেয়ের বিষন্ন রূপ দেখে, খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল। পরে রীমির কাছে, বিষন্নতার কারণ শুনে এত অবাক হয়েছিল !!!! পরে হতবাক.... হতাশ.... চিন্তা .... সবের জগাখিচুড়ী একটা অনুভুতি নিয়ে দিনান্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ঘুম ভাঙার পর সেই mixture feelings টা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে।
অনিরুদ্ধ ওদের শোয়ার ঘরের বাইরে এসে , বসার ঘরে উঁকি দেয়, রীমি নেই। পাশের ছোট ঘরে রীমির দেখা মেলে। কিন্তু একি দেখছে সে ? রীমি টিকলির স্কুলের ব‌ই, খাতা টেবিলে ছড়িয়ে বসে , একমনে কিছু লিখছে। এই ঘরটা ওদের ঠাকুরঘর। যদিও অনিরুদ্ধর জীবনে ঈশ্বরের আবাহন, বিসর্জন কোনো টা ই স্হান পায়না। বিয়ের পর রীমি এই ছোট ঘরটায় ঠাকুরের আসন পেতেছিল। এখন ঠাকুরের আসনের অন্যান্য সব দেবদেবীর মধ্যে বিদ্যার দেবী মা সরস্বতীর সাধনপীঠ এ পরিণত হয়েছে এই ঠাকুর ঘর। রীমির মতে, "এই ঘরটা ঠাকুরঘর ও বটে, আবার টিকলির study ও বটে।" অনিরুদ্ধ মজা করে বলে, " মা সরস্বতীর জন্য workshop/lab বানিয়ে দিলে, অন্য দের মান অভিমান হলে ???? 
অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকে, টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়, রীমি টের ই পায় না। রীমির পিঠে হাত দিতেই, চমকে তাকায় সে। অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে- "রীমি এত রাতে তুমি কি করছো ?"
"দেখতে পাচ্ছো না !!! টিকলি র class work গুলো সব এক এক করে , পরিষ্কার করে লিখছি। ওর যা হাতের লেখা । একটু ও মন নেই। খালি দুষ্টুমি আর ফাঁকি বাজি। এই খাতায় লিখে নিচ্ছি, পড়াতে সুবিধা হবে।"
" তুমি কি পাগল হলে রীমি ? এই তো সবে টিকলির class - II হলো। তুমি এখন ই যদি এমন করো, পরে তো উন্মাদ হয়ে যাবে। "
"তো আমি কি করবো বলো ? ও তো পিছিয়ে পড়ছে। আমাকে ই তো পড়াতে হয়। তুমি কিছু দেখো ?? আগের দিন সাধারণ একটা বানান পারে নি। এতো অমনোযোগী।"আজ" দিয়ে বাক্য রচনা করেছে... " আজ আমার বাবার বিয়ে।" এ কি করবে ভেবে ভেবে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
"হুম। আর মেয়েকে ও পাগল করছো। রীমি তুমি ভুলে যাচ্ছো যে, ও এখনো শিশু। সাধারণ ভুল যেমন করছে, আবার অনেক কিছু তো অসাধারণ ভাবে পারছে ও।"
রীমি রাগত স্বরে বলে- " তাই আর কি !!! পারছে না আরো কিছু , অসাধারণ দুষ্টুমি পারছে।"
"একটা কথা সত্যি করে বলো তো রীমি , বাবার বিয়ে এই বাক্য দেখেই কি তুমি দিশেহারা ?"
রীমি রাগত  স্বরে তাকায় অনিরুদ্ধ র দিকে।অনিরুদ্ধ অল্প প্রশ্রয়ের হাসি হাসে, কথা বাড়ায় না , এই নিয়ে। একটু জোর করেই রীমিকে শোয়ার ঘরে নিয়ে আসে। একটু ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও খুব একটা লাভ হয় না।

"বলিস কি রে অনি ? রীমিকে তো খুব বুদ্ধিমতি বলেই জানতাম। আমি তো ভাবতেই পারছি না, সামান্য একটা বানান আর বাক্য রচনার গোলমালে মেয়েটাকে ওমন ভাবে মেরেছে ?"
অনিরুদ্ধ সম্মতি জানায়, চিন্তিত মুখে। অনিরুদ্ধ, আজ অফিস ফেরতা তার বন্ধু সরিৎ এর বাড়ি গিয়েছে। রীমিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তার কিছুতেই কাটছে না। টিকলি র পড়াশোনা নিয়ে রীমির বাড়াবাড়ি ক্রমাগত বাড়ছে। এ তো অসুস্থতার লক্ষণ !! প্রথম প্রথম এই বিষয় নিয়ে খুব ঠাট্টা করলে ও এখন যে তা আর ঠাট্টার পর্যায়ে নেই, তা পরিষ্কার।
সরিৎ , অনিরুদ্ধ এর ছোটবেলার বন্ধু। সরিৎ বন্ধুর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
" শোন অনি, তুই রীমিকে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা বোঝা।"
" বোঝাইনি ভাবছিস ? যে জেগে ঘুমায় , তাকে জাগাবে কে ? তুই ই বল !! আমি সত্যি ভেবে পাচ্ছি না।"
"হাল ছেড়ো না বন্ধু "-সরিৎ , একটু মজা করার চেষ্টা করে , FM এর কোনএক প্রভাতী অনুষ্ঠানের শিরোনাম কে , ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের আদলে ই বোলে। ম্লান হেসে সম্মতি জানায় অনিরুদ্ধ।

হঠাৎ করে দুদিনের ছুটি নিয়ে , অনিরুদ্ধ, রীমি আর টিকলি কে নিয়ে তাজপুর এসেছে। না , খুব একটা ভিড় নেই। যদিও সপ্তাহান্তে এ চত্বরে ইদানিং বেশ ভিড় হয়। হয়তো , কদিন এর এক নাগাড়ে বৃষ্টি সেই জনসমাগমে বাঁধা সৃষ্টি করেছে !! কারণ যাই হোক না কেন ? এই রকম অল্প tourist স্হান মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেয় বৈকি !! ওদের হোটেলের বারান্দায় বসেই ঢেউ এর আসা যাওয়া দেখছিল অনি। মা আর মেয়ের তো আনন্দ ধরে না। বৃষ্টি তে ভিজতে ভিজতে সমুদ্র তটে ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত।
অনিরুদ্ধ, আয়েস করে , একটা সিগারেট ধরায়, অনেক দিন পর বড় ভালো লাগছে। সরিৎ আর অফিসের রায় দার পরামর্শে তাদের এই স্বল্প ভ্রমণ। রীমি প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। কারণ ওই এক ..... টিকলি র পড়ার ক্ষতি !!!!
অনি একটু মজা করে বলতে গিয়েছিল -" দেখো রীমি , আমরা দুজন কি এমন বিদ্যার জাহাজ ? ওকে একটু ওর মতো করে চলতে দাও,তবে রাশ টা থাকবে তোমার হাতে। এই যেমন 'আমার রশি ধরেছ কষি'।"
কিন্তু না, রীমি মজা টা bodyতে  নিয়ে, ভয়ানক face দেখিয়ে , রান্না ঘরে সিধোলো। তারপর......। সে সব বলতে থুড়ি লিখতে গেলে  !!!!! মোটের ওপর মান ভাঙাতে অনিরুদ্ধর জান কয়লা হ‌ওয়ার পরবর্তী দৃশ্য তাজপুর সমুদ্র সৈকত।
অনির মনে আছে এখনো , সে তখন বেশ ছোট, টিকলি র থেকে বড়োজোর বছর খানেক বড়, স্কুলে annual পরীক্ষা হচ্ছে। অনি ও পরীক্ষা দিচ্ছে। যে সে পরীক্ষা নয়, অঙ্ক পরীক্ষা। অনি কলকাতা র ছেলে নয়। মফস্বলের অতি সাধারণ আধা সরকারি স্কুল।
একতলায় ক্লাস ঘরের জানালার পাশে খেলার মাঠ। যদিও ওটা স্কুলের ভিতরে নয়। ছোট একটা পাঁচিল ছিল বটে, কিন্তু তা টপকে যাতায়াত হোতো হামেশাই। স্যারেরা ও জানতেন সে কথা। স্কুলের মাঠ ছিল, পাশের মাঠের থেকে বেশ ছোট। তাই ছেলেদের আকর্ষণ এর কেন্দ্র বিন্দু ছিল, পাশের মাঠটা।
তো অনিরুদ্ধ অঙ্ক পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষা আধা ঘন্টা শুরু হয়েছে। এমন সময় পাঁচিলের ওপাশের মাঠ থেকে জয়ন্তর চুপি চুপি আহ্বান ... " এই অনি , আর কত লিখবি ? বাড়ি যাবি না ?" অনি চমকে তাকিয়ে জয়ন্তকে দেখতে পায়, আড় চোখে দেখে স্যার মন দিয়ে খবর কাগজ পড়ছেন। অনিরুদ্ধ আস্তে উত্তর দেয় -"যাব ? সব অঙ্ক তো করিনি।"
জয়ন্ত আস্বস্ত করে, "সব করতে হয় নাকি ? আমি ও সব করিনি"।
ব্যাস, খেল খতম, স্যার কে খাতা জমা করে সোজা বাড়ি। মা অবাক হয়ে বলেছিলেন-" তুই এখন বাড়ি ফিরে এলি ? তোর না আজ পরীক্ষা ছিল ?"অনির সোজা সাপটা জবাব ছিল-" জয়ন্ত ডাকলো যে !!!" সেই প্রাচীন মা একগাল হেসে বলেছিলেন-"দেখো ছেলের কাণ্ড !!!"
কোন বকুনি নেই, মার নেই.....ভাবা যায় ? সেই মায়ের কাছেই আরো বড়ো বয়সে দুষ্টুমি র জন্য বকুনি, মার সব ই জুটেছে। এখন সব ই একটু যেন অন্য রকম।

"কি গো, আপন মনে হাসছো কেন ? বেড়াতে এসে পেগলে গেলে ?" রীমির কথায় চমক ভাঙে অনিরুদ্ধর। রীমি মেয়েকে নিয়ে কখন ফিরে এসেছে , খেয়াল ই করেনি সে ।অনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জানে , বলে , সেই যেদিন মা তোমার ফটো খানা দেখিয়ে , বললেন .... " দেখ্ তো অনি , মেয়েটাকে পছন্দ হয় কিনা ? রীনা দির পাশের বাড়িতে থাকে।".... ব্যাস্ , হয়ে গেলো আমার। সেই থেকেই তো আমি পাগল তোমার জন্য । বুঝতে পারলে এতদিন পর ?"- ছদ্ম গাম্ভীর্যের আড়ালে, মুচকি হেসে বলে অনি।  রীমি খিলখিলিয়ে হেসে বলে -" তাই বুঝি ? সত্যিই বুঝিনি কিন্তু ।" কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনি বলে-" বুঝবে কি করে, আবার নতুন করে স্কুলে ভর্তি হলে , কতো পড়া, কতো লেখা !! "
রীমি একটু থমকায় , মুখে মেঘ, রোদের আনাগোনা শুরু হয়।মুখ অন্য দিকে ঘোরায়। অনি বলে, " এখানে কিন্তু রান্নাঘর নেই।" অবাক হয়ে , রীমি অনির দিকে মুখ ফেরায়, বোঝার চেষ্টা করে, অনির কথার অর্থ।
"রান্নাঘর !!!! মানে কি ?" অনি মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়। একটু থেমে বলে , "বিয়ের পর থেকে ই দেখেছি , যখন‌ই রেগে যাও, রাগটা আরো তাতিয়ে নিতে রান্না ঘরে হাঁটা দাও । আর কান্না পেলে গন্তব্য কলঘর , I mean বাথরুম । তাই বলছিলাম যে , এখানে তো....."
" কি বাজে বকতে ই না পারো তুমি !!!! "-রীমি হাসতে হাসতে অনিকে থামিয়ে দেয়।এর মধ্যে , মায়ের ওড়নার পুটুলি ভর্তি ঝিনুক নিয়ে আসরে টিকলি হাজির হয়।
"টিকলি , এত ঝিনুক তুই নিজে কুড়িয়েছিস ?"-বাবার প্রশ্নে টিকলি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। টিকলি মায়ের দিকে তাকিয়ে, মাকে বোঝার চেষ্টা করে, অনি টিকলি র মনোভাব ধরতে পারে। বলে..." চিন্তা করিস না। আজ মা কতদিন পর হাসছে দেখেছিস ? মাকে কি সুন্দর লাগছে বল !! "
টিকলি একটু আস্বস্ত হয়, মাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে, অনেক দিন পর রীমি ও মেয়েকে আদর করে , কোলে তুলে নেয়, গালে হামিতে হামিতে ভরিয়ে দেয়। অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে বলে, "এমা !! এতো বড়ো মেয়ে কোলে উঠে আদর খাচ্ছে ?" মা আর মেয়ে বিশেষ কান দেয় না। যেন বহুদিন পর একে অপরকে কাছে পেয়েছে নতুন করে। হঠাৎ টিকলি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় , বলে -  আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিই , না মা  ?"
এক নিমেষে পরিবেশ ভারি হয়ে যায়। রীমি , একটু যেন চমকায় ,  হঠাৎ রীমির দুচোখ ছাপিয়ে নামে জলের ধারা। অনিরুদ্ধ ওদের কাছে উঠে আসে। বলে..." নাও, এবার থামো। Cut...cut....cut.

রাতে, টিকলি কে ঘুম পাড়িয়ে, রীমি ওদের room এর বারান্দায় এসে , অনিরুদ্ধর পাশে বসে। "টিকলি ঘুমালো ? "-অনির প্রশ্নে সম্মতি জানায় রীমি।রীমি একটু ঘন হয়ে আসে অনির দিকে। এভাবে কিছুক্ষন কেটে যায়। কেউ কথা বলে না। ভালো লাগা টা উপলব্ধি করতে কথার প্রয়োজন হয় না। প্রথম নিরবতা ভাঙে অনিরুদ্ধ -" কতো দিন পর তুমি এভাবে এলে আমার পাশে বসতে । এত দূরে দূরে থাকো কেন ? কিসের এতো চিন্তা তোমার ?" রীমি, অনির হাত চেপে ধরে। কাঁধে মাথা রাখে। অনি বলে - " মেয়ের  জন্য চিন্তা করার সময় এখনো আসেনি রীমি। ও এখন কুঁড়ি। ফুটে উঠছে। একটু একটু করে। ওকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফুটে উঠতে দাও। ও পারছে না। ঠিক পারবে। সময় দাও। স্কুল ওদের বুঝতে চাইছে না। তুমি,আমি ও ওকে বুঝবো না ?"
রীমির চোখ ছলছল করে ওঠে, "কিন্তু অনি , তাহলে যে...." । অনিরুদ্ধ রীমিকে থামিয়ে দেয়...."কোন কিন্তু নয় , পড়াও , কিন্তু জোর দেবে না। ওকে পড়া ভালোবাসতে শেখাও, বোঝাও। ভীতি তৈরি হলে আরো মুশকিল হবে। কি ভাবে বোঝালে সহজ হয় বোঝা, তা নিয়ে ভাবো, আলোচনা করো। দেখবে উপায় বেরবে ই। কেউ দ্রুত শেখে, কেউ ধীরে শেখে। আমি ও ছুটির দিন দেখব, যতটা পারি।"
"তুমি ঠিকই বলেছ। আমার যে সেদিন কি হলো ? এতো মারলাম মেয়েটাকে !!!"-রীমি ফুঁপিয়ে ওঠে। অনি , রীমির পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়- " আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেদিন আমিও যত না কষ্ট পেয়েছিলাম, তার থেকে অবাক হয়েছিলাম বেশি। ভাবছিলাম যে তুমি তো এমন বদমেজাজি ন‌ও। তাহলে কি হোলো তোমার ? " রীমি কোনো উত্তর দেয় না। অনি , রীমির চোখের জল মুছে দেয়। আস্তে আস্তে বলে- " ও কিছু জানে না, বোঝে না এমন তুমি ভাবো, অথচ এটা তো দেখলে না, ওর মন টা কত অনুভূতি প্রবণ !!! ও মনে মনে ভাবে যে , ওর পড়া ঠিকমতো না পারার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে।" রীমি আবার ফুঁপিয়ে ওঠে। অনি , রীমির হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলে - " অনেক রাত হয়েছে। আর না। এবার ঘরে চলো। "

পরের দিন ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে , টিকলি অবাক !!! সেই ছোট্ট বেলার মতো মা আজ সকালে তাকে অনেক অনেক হামি দিয়ে , ঘুম থেকে জাগিয়েছে। টিকলি র তো বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে ই করছে না। কলকাতায় ফিরে গেলে মা কি আর এত আদর করবে ? মিষ্টি করে হেসে কথা বলবে ? আসলে তার যে মাঝে মাঝে পড়তে মোটেই ভালো লাগে না, কি করে সে ? রীতম একদিন স্কুলে বলছিল যে, জানিস তো অনুরীতা, মা বলেছে, আমাদের সবার মাথায় একটা পোকা আছে , সেটা যখন নড়াচড়া করে, তখন ই আমরা দুষ্টুমি করি।  প্রথমে অনুরীতা ওরফে টিকলি বিষয়টা নিয়ে খুব সংশয়ে ছিল !!! এখন বুঝতে পেরেছে যে ওই পোকার জন্য ই যত সমস্যা। ওই পোকার জন্য ই তো সেদিন বসার ঘরের দেওয়ালের ওপর ফুল এঁকে রং করে, কি বকুনি ই না খেলো !! তারপর একদিন স্কুলে ওর বন্ধু তোতার খাতায় ছবি এঁকে দিয়েছিল।অবশ্য ওই বকুনি তোতা ই খেয়েছে বাড়িতে মায়ের কাছে, কিন্তু তোতা পরদিন আড়ি করে দিয়েছিলো। অঙ্ক খাতায় একদিন বাংলা লিখে ফেলেছিল !!! আর‌একদিন ক্লাসের জানালা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল ,বেঞ্চের নীচে বসে একদিন পেনসিল আর রবার নিয়ে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছিল !!! একদিন জল ছিটিয়ে দিয়েছিল আনন্দির গায়ে , মন্দারের ব‌ই লুকিয়ে রেখেছিল । এমন আরো কতকিছু যে টিকলি করে, সব ই তো পোকার নড়াচড়া র জন্য।
যে কথা রীতমের মা জানে, তার মা কেন জানে না ? এ প্রশ্ন ও মাঝে মাঝেই খুব ভাবায় টিকলি কে।
"কি হে ? এতো কি ভাবনা চিন্তা হচ্ছে টিকলি বুড়ি ?"-বাবার কথা য় আপাতত টিকলি ভাবনায় চাবি দেয়। বাবা , টিকলি র মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে পাশেই বসে আর টিকলি ও সাথে সাথে বাবার কোলে উঠে বসে। "আচ্ছা, বাবা আমরা এখানেই কেন থাকি না ?" অনি একটু হেসে উত্তর দেয়-" তোর ভালো লেগেছে ?"টিকলি এক নিঃশ্বাসে বলে-" খুউউউউউব"।অনি বলে --"ওই জন্য ই তো ফিরতে হবে রে মা।  রোজ রোজ থাকলে তো ভালো লাগবে না। " নাহ্ , এই যুক্তি কি আর টিকলি বোঝে ? তার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অনি বলে-" আমরা আবার এখানে আসবো।" একটু আস্বস্ত হয় টিকলি , " বাবা বাড়ি ফিরে ও মা আমাকে এমন আদর করবে তো ???? " অনি এবার জোরে হেসে ওঠে। টিকলি র কানে কানে বলে -"  চিন্তা করিস না। মা কে আর বকতেই দেবো না । একটা ওষুধ দিয়েছি তোর মা কে। আর বকবে না। তুই ও একটু মায়ের কথা শুনিস। বেশি দুষ্টুমি করিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি।"
টিকলি চোখ গোল গোল করে বলে, " বাবা আমাকেও মাথার দুষ্টুমি পোকার জন্য ওষুধ দাও তো। তাহলে আমি ও আর দুষ্টুমি করবো না।" এবার অনির চোখ গোল করার পালা। "কি পোকা ? দুষ্টুমি পোকা ? " নাহ্, বাবা ও জানে না। অগত্যা রীতমের কাছ থেকে জানতে পারা তথ্যের পরিবেশন  করে টিকলি তার বাবার কাছে। অনিরুদ্ধ হোহো করে হেসে ওঠে। টিকলি র থুতনি নাড়িয়ে বলে - " বেড়ে বলেছেন তো তোর বন্ধুর মা । আর দেখা যাচ্ছে তোদের ও বেশ পছন্দ হয়েছে। "
রীমি , এতক্ষণ হোটেলের ফুলের বাগান ঘুরে দেখতে গিয়েছিল , রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে - " টিকলি র আবার কি পছন্দ হোলো ?"
মাকে দেখে টিকলি একটু দমে যায়। এসব মনের প্রাণের কথা তার বাবার সাথেই হয়। মা শুনলে বিস্তর ঝামেলা বাধার সম্ভাবনা । বাবা টিকলি র অবস্থা বুঝে, সামাল দেয় ---" সে সব আমাদের বাপ মেয়ের private talk , তোমার শোনা মানা।" রীমি একটু হেসে , বিষয়টা আর ঘাটায় না। কারণ অনি একসময় ঠিকই তাকে সব বলবে।আর সর্বোপরি এখন আর কোনো বিষয় নিয়ে মন কষাকষি সে চা‌ইছেই না। কালকে রাতে , অনি যা যা বলেছে, তা নিয়ে মনের ভিতরে একটা দোল চাল চলছে । অনির কথা ও ঠিক, আবার যত‌ই বলি আমাদের এখানকার শিক্ষা পদ্ধতি সঠিক নয় , এর বাইরে আমরা যাব ই বা কি করে ? আর প্রতি বছর এর মধ্যে দিয়েই তো ছাত্র ছাত্রীরা যাচ্ছে।
অনি , রীমির অন্যমনস্কতা খেয়াল করে, বলে - " টিকলি চল আমরা মাকে নিয়ে সমুদ্রে স্নান করে, আমাদের সব দুঃশ্চিন্তা জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।আর ওই সব রাগের পোকা, দুষ্টুমির পোকা গুলো কে ও জলে ফেলে দিয়ে আসি।"
রীমি  অনিরুদ্ধ র কথার মানে বোঝার আগেই, অনি আর টিকলি হৈ হৈ করে সমুদ্রের দিকে পাড়ি দেয়। রীমি ও আপাততো সব চিন্তা স্হগিত রেখে বাবা ও মেয়েকে অনুসরণ করে।
এভাবে সব কিছু সাথে নিয়েই চলতে হবে। সুস্থ, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। সব কিছু র মধ্যের আনন্দকে খুঁজে নিতে হবে। দুঃখ কে জয় করতে হবে। ।

Monday, 30 April 2018

আমাদের কাজের no ছুটি। আজীবন কাজ, কাজ আর শুধু ই কাজ। এ কাজ সেই কাজ যার কোন recognition নেই। তবে সান্তনা পুরষ্কার কিন্তু আছে 😁😁😁😁। সেটা বেশ বড় সড় ধরনের। " তুমি এ সংসারের সব(সঙ্)😁😁😁😁😁। ভিত....মালকিন।।
আর এই পুরস্কার পেয়ে আপামর মহিলা মহল গলে গল(জল)......।।
আচ্ছা বলোতো .... আমাদের একটু ছুটি কবে মিলবে????
বেড়াতে গিয়ে ????....... হয়নি হয়নি , ফেল।
একটু ভাবো please , বেড়াতে গিয়ে কিসের ছুটি?অন‍্য পরিবেশে ছুটোছুটি। কিছুটা মুক্তি অবশ্যই, তবে পুরোপুরি ছুটি নৈব নৈব চ । নিরবচ্ছিন্ন ছুটি নিলে সংসারের অবস্থা বেশ সংকটজনক। আর তা সমে ফেরাতে যা লেবার তার কথা ভেবে আমরা আতঙ্কিত।তাই ও পথে না হাঁটা ই ভালো।।
😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁😁

Wednesday, 11 April 2018

প্রকৃতির মাঝে সত্যি বিস্ময়ের ভাঁড়ার অফুরান। সে রূপ দেখে দেখে আঁখি ফেরাতে পারি না .....। প্রতিটি ঋতু ই নিজের মতো করে অপরূপ। আর সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় এই যে প্রতি বারের রং ,রূপ ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি প্রতিটি প্রাকৃতিক বিষয় বস্তু পৃথক। সত্যি সৃষ্টিকর্তা র সব সৃষ্টি ই বৈচিত্র্যময়। তোমারা অনেকেই নিশ্চিত
দেখেছ এমন ভাবে। না, দেখলে ও অসুবিধা নেই। আমাদের অনেকের ই প্রকৃতিকে দেখার জন‍্য‌ে আঁখি থাকলেও সময় নেই বা দরদী মনটা কোন অচীন দেশে পাড়ি দিয়েছে বলে সেই দৃষ্টি হারিয়ে গেছে। কাজের থেকে সাময়িক বিরতির সময় হয়তো আবেগী মন টা একটু ক্ষণ নাগালে আসে। আবার আমরা কেউ কেউ এই নগর সভ্যতা র আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করি। পুরোপুরি নগর সভ্যতা কে বিদায় জানানোর কথা আমরা ভাবতেই পারি না। কারণ নগর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের গভীরে।
গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে (spices and sauces restaurant এর বিপরীত ফুটপাতে) অবস্থিত একটি ছোট গাছের শৈল্পিক বিন‍্য‌াস আমাকে বার বার মুগ্ধ করে। এমন ভাবে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি আমাকে, আমাদের আকৃষ্ট করে, আবীষ্ট করে অনন্তকাল ধরে।

Tuesday, 10 April 2018

আমরা সকলেই কমবেশি ছুটে চলেছি। কেউ লক্ষ্য স্থির করে, কারোর লক্ষ্য হীন যাত্রা। কেউ নিজেকে গড়ছি, কেউ নিজের সন্তান কে গড়ে তোলার জগতে সামিল করছি। এভাবে দৌড়ে সামিল জীবন হাঁপিয়ে ওঠে। সর্বশক্তিমানের কাছে আকুতি জানায়ে "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু "।
চলমান জীবন , আবার ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠে। উঠতে যে হবেই। প্রাণপ্রাচূর্যের রসদ চারপাশ থেকে আহরণ করে, আবার বহতা নদীর মত জীবন বহমান হয়। এ যাত্রা থামার না।
যখন সত্যি সত্যি একদিন সব ভাঙা গড়ার পালার শেষে অবসর জীবন ভাবে .... "এবার আমার নিজের খুশিতে পথ চলা শুরু হবে" , তখন কিন্তু এই কর্ম হীনতা ও আনন্দ দেয় না।
এ সম্পূর্ণ "নদীর এ পার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারে তে স্বর্গ সুখ আমার বিশ্বাস।"

Monday, 26 March 2018

প্রতিবাদ
                                                                      শুচিস্মিতা ভদ্র
"এখন ঘোর ভাঙেনি তোর যে, মেলেনি তোর আঁখি"- অনেক দিন পর গানটা FMএ শুনে তন্ময় হয়ে গেছিল  লালিমা। বাবার বড়ই প্রিয় গান ছিল এটা।সকালে ছোট্ট লালিমাকে ঘুম থেকে জাগানোর পর আধো ঘুমন্ত , আধো জাগন্ত লালিমাকে প্রায় ই কোলে নিয়ে মজা করে ভরাট ও দরাজ গলায় গানটা গেয়ে উঠতেন শীর্ষেন্দু।বাবা আজ নেই, প্রায় বছর ঘুরতে চলল।সময় নদী যে কখন বয়ে গেল ? লালিমা টেরই পেল না।এতগুলো দিন যে কি ভাবে কেটে গেল বাবাকে ছাড়াই , ভাবলে লালিমা, বাবার আদরের লালি  অবাক হয়ে যায় !  অথচ এটাই সত্য।দিন চলে যায়, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন স্মৃতির মাঝে থেকে যায়।তাঁকে ছোঁয়া যায় না, আর কাছে পাওয়া-ও যায় না।কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে যেন সন্তানের মধ্যেই নিজের ছাপ রেখে যায়।মা, লালিমাকে চিরকাল বাপসোহাগী বলতেন ।তিনি এখনও লালির কথায়, কাজে নিজের বড় প্রিয় মানুষটার প্রতিরূপ দেখতে পান।
গানটা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই কলিংবেলের যান্ত্রিক শব্দে লালিমার ঘোর সত্যিই ভেঙে যায়।দরজা খুলে দেখে রূপ কে নিয়ে তার বাবা প্রান্তর  ফিরেছে।রূপ এখন সবে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে।
রাতে রূপকে ঘুম পাড়িয়ে যখন লালিমা স্মার্ট ফোন হাতে নিল, তখনও প্রান্তর শুতে আসেনি। রাতে একটু খবরের কাগজে চোখ বোলায় সে।এ তার বহু বছরের অভ্যাস। ড্রইংরুমের সোফায় বসে খবরের কাগজের সব  খুঁটিয়ে পড়াকে যোগ্য সঙ্গত করে, টেলিভিশনে চলতে থাকা কোন না কোন sports channel ।এ নিয়ে আগে লালিমার সাথে বচসা চলত।লালিমার বক্তব্য হলো, যে কোন একটা বিষয়ে মনোনিবেশ করো না কেন? কিন্তু এটাই যে তার ক্লান্তি মুক্তির একমাত্র উপায়, তা বোঝার পর লালিমা আর এ নিয়ে কিছু বলে না।
স্মার্ট ফোনের যুগে বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়।লালিমা, আজ অনেকক্ষণ ধরে তার বাবার প্রিয় গান গুলো খুঁজে বের করে online এ শোনার চেষ্টা করছিল।বিকেলে FM এ গানটা শোনার পর থেকে বাবাকে যেন খুব বেশি করে মনে পড়ছে।গানগুলো শুনতে শুনতে, কখন নিজের অজান্তেই চোখের জলে মাথার বালিশ ভিজে যাচ্ছিল খেয়াল ই , করেনি।হঠাৎ কপালে হালকা হাতের আলতো ছোঁয়ায় তাকিয়ে সে প্রান্তর কে দেখতে পায়।
"কি হয়েছে লালি ? বাবার কথা মনে পড়ছে ?"-প্র্রান্তরে প্রশ্নে লালিমা তাকে আঁকড়ে ধরে, সম্মতি জানায় মাথা নাড়িয়ে।
 রবিবার ছাড়া প্রতি সকালেই লালিমার ব্যস্ততা চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে। চা, জলখাবার, রূপকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা, প্রান্তর আর তার নিজের টিফিন তৈরি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা আর ছেলে ঝড় তুলে বেরিয়ে গেলে আধাঘন্টা একটু কাজের ছুটি মেলে।এই সময় সে একটু খবরের কাগজে চোখ বোলায়। এরপর রান্নার দিদি এসে গেলে তাকে সব বুঝিয়ে , নিজেকে ও বেরনোর জন্য প্রস্তুত হতে হয়।সে আজ বছর সাতেক একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা।
আজ খবরের কাগজের দু দুটো খবরে মনটা সকাল সকাল খারাপ হয়ে গেল।কাগজটা ভাঁজ করে সরিয়ে রাখল লালিমা। কিন্তু খারাপ খবরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও , আদৌ কি তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় ?
একটা ঘটনা, রাজস্থানের কোন এক বাজারে বোমা বিস্ফোরণে শতাধিক প্রাণহানি, জনা তিরিশ আহত, পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিস্ফোরণের কারন অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। বিস্ফোরণের কারন কোন জঙ্গি সংগঠন এখনও স্বীকার করেনি। দ্বিতীয় ঘটনা র স্থান, আমাদের ই শহর, কলকাতা।শিশু কন্যার ওপর পাশবিক অত্যাচার। এই সাতবছরের শিশুটি মানসিক ভারসাম্যহীন।
এ কোন যুগে আমরা বসবাস করছি ? হিংসা, ধর্ষণ, খুন ..... অপরাধ প্রবণতা দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। সকলেরই মনে নানা অসন্তোষ, তার  পরিনতি ই কি অবক্ষয়মূখী করে তুলেছে সকলকে ? লালিমার মতো করে এমন কথা প্রতি নিয়ত আমাদের মনে তোলপাড় হয়,  কিন্তু এর উত্তর কার কাছে ????
"লালিমা দি আজকের কাগজ পড়েছে ?"-রীমিকার  প্রশ্নে, খাতা দেখা না থামিয়ে,  লালিমা বলে-"হ্যাঁ রে, দুটো খবর ই দেখলাম সকালে, কাল হয়তো টেলিভিশনে দেখিয়েছে, আমার দেখা হয়নি।"
রীমিকা বলে-"এতো মানুষ মেরে কার কি লাভ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে বলো দেখি ? আর অন্য খবরটা তে যে victim তার কথা ভাবো, এরা সব মানুষ ????"
লালিমা মাথা নাড়ে, বলে-"কি সব যে হচ্ছে চারদিকে, ভালো লাগে না।তোর মেয়ে এবার IV এ উঠল না রে ?"রীমিকার সম্মতিতে লালিমা বলে -" সাবধানে রাখিস।"
"সে তো নজরে রাখি-ই , কিন্তু সর্ষের মধ্যেই তো ভূত লালিমা দি, তুমি নিশ্চিন্ত, তোমার তো ছেলে।"
"না রে ছোটছেলে রাও victim হয়, তবে বলতে পারিস বড়ো হয়ে গেলে অনেকটা নিশ্চিন্ত, আমাদের তো আজীবন সতর্কতার বর্ম পরে ঘুরতে হবে।এই আমরা কি ঘরে, বাইরে নানাবিধ অপ্রীতিকর ঘটনার থেকে রেহাই পেয়েছি বল ? আমাদের অনেকেরই তো বয়স নেহাত কম নয়।"
হঠাৎ ওদের আলোচনায় এসে যোগ দেন, অঙ্কের বয়োজ্যেষ্ঠ,  পুরূষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নিবারণ দা, বলেন -" তোমাদের চিনি, জানি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা ও দোষী, সে যাই বলো। আজকাল মেয়েদের হাবভাব, পোশাক পরিচ্ছদ এসবের জন্য অনেকখানি দায়ী।" নিবারণদার কথা শেষ হতে না হতেই ভূগোল এর ঋতুপর্ণা চীৎকার করে ওঠে-" নিবারণদার দা, কে কিভাবে নিজেকে project করবে, সেটা তার personal ব্যাপার।তার মানেই কি সে commodity ?তার সাথে যা ইচ্ছা করার  অধিকার জন্মে যায় ? আর কালকের ঘটনাতে কাকে দায়ী করবেন ? অসহায় একটা শিশু তা ও আবার মানসিক ভারসাম্যহীন - সে কি ভাবে দায়ী ?
                         হঠাৎ দেখা যায়, সাম্প্রতিক কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ও সেই ঘটনা গুলো কে কেন্দ্র করে যে সব হিংসাত্মক কার্যাবলি ঘটছে, এছাড়া ও সারা দেশের বর্তমান নানা হিংসাত্মক ঘটনা গুলো নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ দুটো দল তৈরি হয়ে teachers' room এ একটা জোরালো বাদানুবাদ শুরু হয়।আসলে সবে Annual Exam শেষ হয়েছে, তাই এখন ছাত্রছাত্রীদের ছুটি। টিচারদের ছুটি নেই, খাতা দেখা, result out করার নির্ধারিত দিনের আগের মধ্যে report card তৈরি এসব নিয়েই এখন হাল্কা ব্যস্ততা।
                     হঠাৎ হেডমিসট্রেস  অনুভাদি ,দরজা ঠেলে teachers' roomএ ঢোকেন।ওনার কাছে এই তর্কবিতর্কের খবর পৌঁছে গেছে অফিসের পিয়ন নন্দের এর মাধ্যমে। নন্দ সব দিকেই আছে।এদিকের খবর ওদিক, ওদিকের খবর এদিক করার জন্য বেশ প্রসিদ্ধ।শিক্ষক, শিক্ষিকা রা যে কোন বিষয় আলোচনার আগে খুব সাবধানে কথা বলে, কিন্তু আজকের আলোচনায়, বিবদমান দুই গোষ্ঠীর কেউই খেয়াল করেনি ! যথারীতি এই আলোচনার খবর পাওয়ার কিছু পরেই স্বয়ং অনুভাদি মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন।
        "আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো ? খারাপ ঘটনা গুলো নিয়ে teacher's room এ ঝড় না তুলে,  কিছু তো করার কথা ভাবতে পারেন !! আমাদের সবার যৌথ ভাবনায় ভালো কিছু হতে ও তো পারে। আমরা তো সকলেই ভবিষ্যতের নাগরিক গড়ার কারিগর।সেই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েই তো এই কর্ম বেছে নিয়েছি।হ্যাঁ অবশ্যই এ আমাদের রুজি রূটির মাধ্যম।কিন্তু আমরা এসবের প্রতিবাদ তো করতেই পারি, এমন মেজাজ না হারিয়ে।আর প্রতিবাদের ভাষার হিংসাত্মক হওয়ার কোন দরকার আছে কি ? আপনারা কি বলেন? "

লালিমা আর ঋতুপর্ণা সমস্বরে বলে ওঠে "কি ভাবে প্রতিবাদ করব দিদি ? What's app এ ছবি সরিয়ে, না মোমবাতি মিছিল করে ? লাভ হবে এভাবে? " অনুভাদি স্মিত হাসি ছড়িয়ে বললেন -" তন্ময় , তুমি তো ইতিহাসের ছাত্র।তুমি ই এর উত্তর দাও।ঘৃণ্য কাজের প্রতি সরব হওয়ার মাধ্যমটা  বড় কথা নয়, বড় কথা হল সরব হওয়াটা।প্রতিবাদের ভাষা যুগে যুগে একই।প্রকাশ ভঙ্গি পৃথক।না হলে,  স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কারাবাস হোতো না।সক্রিয় সংগ্রামে অংশ না নিয়ে ও অনেক কবি, লেখক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।এর নজির তো ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে।"
তন্ময়,  সম্মতি জানায় অনুভাদির কথায-"ঠিক বলেছেন দিদি,  সারা বিশ্বের বিপ্লবের ইতিহাস তো তাই বলে।" অনুভাদি বলেন -" একদমই তাই। আর লালিমা আর ঋতুপর্ণা আপনাদের দুজনকেই বলছি what's app এ ছবি সরানো ও একটা প্রতিবাদ।আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সামনের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তো  বর্তমানের এই সব হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাটক বা নৃত্য/গীতি আলেখ্য করতে পারি। এবছর এখনও পর্যন্ত এনিয়ে কোনো আলোচনা , সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।প্রতিবারের মত এবারও rest out হওয়ার পর ই হবে আলোচনা।এবছর এ ধরনের কিছু করা যায় কিনা দেখুন না !!! কি বিপাশা তুমি কি বলো ? আমাদের ছাত্রছাত্রীরা  পারবে না ?
 বিপাশা স্কুলের cultural committee এর সদস্য,  সে এগিয়ে আসে,  " দিদি ঠিক বলেছেন, এটাই হোক এ বছর আমাদের স্কুলের তরফে ছোট্ট শুরু।এই মঞ্চ ই হয়ে উঠুক আমাদের প্রতিবাদের মঞ্চ। " খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ে বিপাশা।যার প্রকাশ ঘটে তার কথায়।অনুভাদি বিপাশাকে আরো উৎসাহিত করেন -" এই তো চাই বিপাশা।   আমরা সবাই মিলে প্রতিবারের মত এবারও খুব সুন্দর একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব। আপনাদের আলোচনা আমাকে বিষয় নির্বাচন করতে সাহায্য করলো, কি বলেন ?"
                   লালিমা,  বাড়ি ফিরে,  রাতে খাবার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়ার পর প্রান্তরকে স্কুলের আলোচনার আদ্যোপান্ত শোনায়।প্রান্তর খুবই উৎসাহ দেয়।লালিমার গতকালের ভারাক্রান্ত  মনটা যেন একটু উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, বলে-" জানো প্রান্তর, বাবাদের অফিসের 9/10 জনের একটা ছোট দল ছিল। বাবা বলতেন "অণু দল"।বাবা ই নাম দিয়েছিলেন  " ভাষা"।একটা সময় "ভাষা" নানাধরনের পারিবারিক, সামাজিক, বিশ্বজনীন সমস্যা নিয়ে পথটা করত ।"
এবার প্রান্তরের   অবাক হবার পালা-" তাই নাকি ? দারুন তো ! বলনি তো কখনো !!!" লালিমার দৃষ্টি অতীতের মাঝে হারিয়ে যায়, বলে-" আসলে সে সব আমার ছোট বেলার কথা, ওই সব নাটকের ছোটখাট মহিলা র চরিত্র যখন থাকত তখন "ভাষা"র কোন না কোন সদস্যের সহধর্মিণী বা বোন বা মেয়ে সমস্যার সমাধান করে দিত।মা ও এক দুবার অভিনয় করেছেন।"প্রান্তর কপট রাগ দেখায় -" আর কি কি লুকিয়ে রেখেছ বলো তো ঝুলিতে ??"
লালিমা একটু হাসে, প্রান্তরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে-" কিন্তু শেষ পর্যন্ত "ভাষা"  বন্ধ হয়ে যায়। আসলে কয়েকজন বদলী হয়ে যান, আর প্রকাশ জেঠা হঠাৎ ই মারা যান। উনি রাস্তা য় নাটক করার অনুমতি পত্র জোগাড় করতেন, ওনার সাথে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিচয় ছিল।নাটকের script কিছুটা বাবা , বাকিটা লিখতেন রমেশ কাকু। সে সব বাদ দাও, আসলে পরবর্তী কালে কাজের চাপ বাড়ে, সাংসারিক না না দায়িত্ব বাড়ে সকলের ই। প্রাথমিক উত্তেজনা , উৎসাহে ভাটা পড়ে,  সব মিলিয়ে "ভাষা" থেমে যায়।তবে সে সময় বাবা খুব upset হয়ে পড়েছিলেন।পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। মায়ের কাছে হয়তো এখনো "ভাষা"র পথনাটিকার ছবি, script কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এবার যেদিন যাব, বলব মাকে।"
"আচ্ছা,  বাবা, ওই পথ নাটিকাতে গানের ব্যবহার করতেন ?"-প্রান্তরের প্রশ্নে লালিমা বলে -" হ্যাঁ,  বাবার গানের প্রতি আকর্ষণ তো তুমি জানো ই, আর কি সুন্দর যে গাইতেন। নাটকের বিষয় অনুযায়ী গান নির্বাচন করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুল গীতি ই বাবার পছন্দের শীর্ষে থাকত সবসময়। অন্য গান ও যে নেওয়া হোতো না , এমন নয়।আসলে ছোটবেলার কথা অত মনে নেই, তবে বাবা  বলতেন অনেক কিছু, আমি বড় হবার পর।" একটু থেমে লালিমা বলে-" আমার তো বাবার হাত ধরেই গান শেখা।গানকে ভালোবাসা।"-লালিমার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।
"লালি, এতো সুন্দর তোমার গানের গলা ! বাবা চলে যাওয়ার পর তুমি কেন গান করা বন্ধ করে দিলে ? এটা ঠিক নয় লালি।আমি বলছি, আবার শুরু করো।"
"ঠিকই বলেছ।আজ অনুভাদির কথায় খুব উৎসাহ পেলাম। বাবা চলে যাওয়ার পর গান করতে বড়ো কষ্ট হয় গো, অনেক কথা মনে পড়ে যায়।"--লালিমার গলা বুজে আসে।
প্রান্তর,  লালিমার হাত নিজের হাতের ভেতর নিয়ে অল্প চাপ দেয়, বলে-"বাবা যেটা তোমায়  দুহাত উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তা অবহেলা কোরো না।তুমি এগিয়ে যাও লালি।আমরা সকলেই আছি তোমার সাথে।আর মনে রেখো প্রতিবাদ মানে ই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রক্তপাত নয়। শিল্পী মনের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হবে।তাই তো শিল্পী মন সবার থেকে স্বতন্ত্র।কিন্তু এভাবে ই সব অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে  হবে।ফলের আশা করে ই প্রতিবাদ করে যেতে হবে।প্রত্যাশিত ফল না পেলে ও প্রতিবাদ থামালে চলবে না।"
"আর এভাবে এই প্রতিবাদের ভাষা সবার মাঝে ছড়িয়ে যাবে।রূপকে ও এই আদর্শে আমরা মানুষ করব। গুরুজনকে সন্মান করার সাথে সাথে মেয়েদের সন্মান করার শিক্ষা দেবো।সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করব অন্তত......" লালিমার  কথার বলিষ্ঠ প্রকাশ ভঙ্গি প্রান্তরের দৃষ্টি এড়ায় না। সে ও লালিমাকে সব রকমের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয় মনে মনে।