Sunday, 22 June 2025

মুম্বাই জমজমাট

  মুম্বাই জমজমাট 


 আমাদের বিয়ের বছর চারেক পর আমরা মুম্বাই গিয়েছিলাম। যাওয়ার মাস চারেক আগে থেকেই চাপানউতোর চলছিল জায়গার বাছাই নিয়ে । মুম্বাই যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার মত ছিল অজন্তা , ইলোরা হয়ে মুম্বাই গমন । ওদিকের মতামত ছিল ভিন্ন ... খাজুরাহো হলে কথা ছিল অন্য, বৌদ্ধ, জৈন আর হিন্দুদের গুহা স্থাপত্য দেখার কোন মানে নাকি নেই !!! কিন্তু মুম্বাই ঘুরে গোয়া যাওয়ার মানে আমি বিনা চশমাতেও পষ্টাপষ্টি বুঝেছিলাম । মন ভার , মুখ ভার ... মন খারাপের দিস্তা নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে স্কুলের বান্ধবীর অজন্তার বর্ণনা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম .... অতঃপর ভাগ্য সুপ্রশন্ন হল বলতে হবে ... কর্তা মশাই রাজি হলেন অবশেষে । আহা !! মোটেও গিন্নির মুখ চেয়ে ... এমন ভাবার কারণ নেইকো । ওই চাপানউতোর কালে বলা ভালো হেনকালে মুক্তি পেল সন্দীপ রায়ের পরিচালিত " কৈলাশে কেলেঙ্কারি " । আমরা দেবাদেবী দক্ষিণ কলকাতার প্রিয়া প্রেক্ষাগৃহে দেখতে গেলাম ... দেখলাম...মন জয় করলো কিনা সিনেমার ইলোরার গুহা মন্দির !! ভাবা যায় ?? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে , বাড়ি ফেরার পথেই বলতে শুনলাম... " এবার অজন্তা ইলোরাটা ঘুরে আসি , কি বলো ? পরের বার গোয়া যাবক্ষণ ।".. মনের উচ্ছ্বাস মনে চেপে , মনে মনেই বললাম... তা আর বলতে ?? মত বদলালো , সেই মতো পথও বদল হলো । 


এক বাঁধা দূর করলেন সন্দীপ রায় , টিকিট কাটা ও অন্যান্য কাজ যখন একটু একটু এগিয়ে পড়েছে , আবারও বাঁধা । এবারের বাধা বাসা বাঁধল আমার কোমরে । দুঃখের কথা কাকে বলি ,বালতি তুলতে গিয়ে ফিক লেগে ব্যাথা একদম পিকে ( peak )। তাকে ঠিক করতে নানা দাওয়াই , সাথে বিশ্রাম চলতে থাকল । আরাম হারাম হ্যায় বলে যেই কাজে যোগ দিই ব্যারাম আবার কোমরের দখল নেয় । আমাদের মন খারাপ ... সময় বেশি নেই , মেরে কেটে বেরিয়ে পড়তে বাকি মাস দেড়েক । আমার মায়ের অনুরোধে গেলাম শেষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের ডেরায় ... কর্তা নিমরাজি , নিজে গেলেন না , বিশ্বাস নেই, এদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের কথা ফেলা সব দিকে থেকেই বিপদের !! এলোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথির বিবাদটা কিসের কে জানে ? তবে শেষরক্ষা করলেন হোমিওবাবুই । অনেকদিনের পরিচিত ডাক্তার একদমই রোমিও সুলভ যুবক নন ... সব শুনেই , যাওয়ার দিনক্ষণ জেনে বললেন .. চিন্তার কিছু নেই, তুমি ঘুরতে যেতে পারবে । আর সত্যিই পারলাম আর দৌলতাবাগ ফোর্টের ৩৫০ সিঁড়ি আর প্রতাপগড় ফোর্টের ৪০০ সিঁড়ি নিজে হেঁটেই উঠেছিলাম ... মোটেই কোলে কাঁখে চাপিনি । কর্তা মশাই মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার জেঠুর মহিমা মেনে নিলেন তখনকার মতো , কলকাতার জল হাওয়াতে ফিরে আবার স্বমহিমায় ফিরে ওনাদের এলোপ্যাথির গুণ কীর্তন করে চলেছেন সেই ইস্তক। উনি এযালোপ্যাথ চিকিৎসক কিনা !!!


শেষমেষ দূগ্গা দূগ্গা করে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস করে রওনা দিলাম। স্লীপারের টিকিট ছিল ... বয়সের সাথে সাথে বায়নাক্কার দোহাই দিয়ে দুজনেই স্লীপার থেকে আপার মুখী হয়েছি ... দুজনেই সহমত তাই নেই চাপ । আর তখন না থাকলেও এখন আমারও সাথে পুপে ( আমাদের কন্যা ) নামক শিখণ্ডী আছে । সে কিছু বললে ( অবশ্যই বেড়ানোর সময় ) তার বাবা কেমন যেন নরম পাকের মাখা সন্দেশের মতন মোলায়েম হয়ে যায় । কিন্তুক !!! অন্য সময় কড়া পাকের হালুম হালুমে আমরা মা মেয়ে গেলুম হয়ে যাই বাড়িতে । তবে সত্যিই বলছি ... বেড়ানোর সময় কর্তা মেয়ের কাছে নরম পাক আর আমার কাছে একদম উত্তমকুমার 😄 কি রোমান্টিক !!! বাপ রে !!! এই জন্যই তো কবে থেকে বেড়াতে যেতে চাইছি । 


ট্রেনে এক রাত কাটিয়ে তারপরের দুপুরে ভুসওয়ালে নামলাম, এদিকের অনেকের বাণী শিরোধার্য করে ভুসওয়ালের বিখ্যাত কলা কেনার উপায় না থাকায় , আমরা ওখান থেকে সরাসরি ওমনি (মারুতি ভ্যান) ভাড়া করে ফরদাপুর সরকারি হোটেলে হাজির হলাম। হাইওয়ের পাশে ছড়ানো ছিটানো বিশাল এলাকা জুড়ে হোটেল । এখানেও বেশ কিছু হনু সপরিবারে থাকে । দূরে অজন্তার পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে , মনে একেবারে ফূর্তির বাণ ডাকল । তবে সন্ধ্যার দিকে বিজ্লি গন্ হওয়ার কিছু পরেই হোটেলের এক কর্মী এসে দুইখান মোমবাতি ধরিয়ে জেনারেটরের গোলযোগের তথ্য পরিবেশন করে গেল , অপরিচিত জায়গায় আলো আঁধারির মধ্যে দুজন ভুতের মতন বসে বসে হঠাৎই হৈ চৈ শুনে ঘাবড়ে গেলাম ... কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝলমলে আলোর ঝিলিকে সন্ত্রস্ত ভাব খানিক কেটে যেতেই ঘরের সামনের টানা বারান্দায় প্রথমে উকি , তারপর টুকি করতে করতে কর্তা মশাই গুটি গুটি এগিয়ে পড়লেন , খবর সংগ্রহ করে ফিরেও এলেন ... কৌতুহল নিবারণ হল , শুনলাম কোন সান্ত্রি বা মন্ত্রীর ছেলে ( এখন তিনি মন্ত্রী 🤫 ) গামলা গামলা আমলা সহ পায়ের ধুলো দিতে এসেছিলেন ...


এমারজেন্সির জন্য রাখা জেনারেটর চালু করতেই আলোয় ভুবন ভরা হলো । আর ওই আলো বন্ধ করলে বিপদ হতেও তো পারে , তাই আলো স্থায়ী হল , এক সময় বিজ্লিও হাজির হল। আমরা পরের দিনের ইতিহাস দেখার ভাবনায় মত্ত হয়ে ঘুম দিলাম নৈশ আহারের পরে পরেই ।


পরের দিন সকালেই খেয়ালে ধরা দিল , বাঙালি ছাড়া অন্য প্রদেশের এক দুইটি পরিবার হোটেলে থাকলেও বিদেশী বোর্ডারের ভিড় অনেক বেশি , যাদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যে এগিয়ে চীনা ও জাপানি বোর্ডার । আমাদের বাঁ পাশের ঘরেই ছিল ভারি মিষ্টি এক জাপানি যুবতী । অজন্তা কেভস্ দেখতে যাওয়ার পথে আলাপও হয়েছিল তার সাথে , পেশায় সে নার্স ( সেবিকা )। তা শুনে যথারীতি আমার কর্তা ভারি খুশি হয়ে গিয়েছিল , পেশাগত নৈকট্যের কারণেই হয়তো । কি জানি 🤔 ? 


এরপর অটোর যাত্রার পর ব্যাটারি চালিত বাসে করে অজন্তার পাহাড়ের পাদদেশে অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই গাইড না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্তা মশাই এগিয়ে গেলেন , আমি পিছু নিলাম ... প্রথম গুহায় ঢুকেই সিদ্ধান্ত কেমন যেন ঝিমিয়ে গেল , আমি এসব ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে ওদিকের রকম দেখি ... সেই যে ঠোক্কর খেলো...আজ ওবধি ওই ঠেকে শেখা বিস্তর কাজে এসে চলেছে ঐতিহাসিক স্থান দেখতে গিয়ে । আসলে কি হয়েছিল জানো ? পাড়াতুত এক কাকু গাইডের জন্য খরচ যে বেকার এই মন্ত্র কানে দিয়েছিলেন আর আমার কর্তা মশাই বেড়াতে গিয়ে যথেচ্ছ খরচ করলেও , এমনিতে বুঝে খরচের মানুষ , যদিও আমার ক্ষেত্রে হাল পুরো না হলেও খানিক ছেড়ে দিয়েছে , তবে লাগাম এখনও ওদিকেই । কিছু বিশেষণ যুক্ত বাক্যবাণ শুনলেই বলে ... উঁহু ওমন বলতে নেই , বলো আমি মিতব্যায়ী । এই ওবধি ঠিক ছিল , পরে যোগ করে ... "না হলে হাতি পুষবো কি করে ?? " ... দেখলে তোমরা কেমন আমাকে হাতি বলে দিলো ?? তাও ভুল বাংলায় ?? হস্তিনী হবে তো !!! যাই বলুক ওর সাথে পথে বেরলে একটা মানানসই চেহারা না হলে কি ভালো দেখায় ? তোমরাই বলো !!! 


তো যা বলছিলাম, শেষ ওবধি সব দেখাদেখি হলো গাইডের দেখানো পথেই, ফিরে হোটেলে দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়ে অজন্তাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি করে আমরা চলে গেলাম ঔরঙ্গাবাদ। সেখানকার সরকারী হোটেলে গিয়ে জানলাম, আমাদের জন্য যে ঘর নির্ধারিত, তাতে নাকি সন্দীপ রায় ছিলেন ..." কৈলাশে কেলেঙ্কারি " সিনেমার শুটিং এর সময় । সত্য মিথ্যার বিচার কে করবে জানি না , আমরা সত্য ধরে বিগলিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম । সন্ধ্যার সময় ওদিকের বিখ্যাত শাড়ির খোঁজে দুজন , দু রকম মেজাজ নিয়ে অটো ধরে প্রথমে দোকান, পরে শাড়ির কারখানা ঘুরে , গায়ে শাড়ি ফেলে এদিক ওদিক দেখে একখান বগলদাবা করে ফিরলাম ... যদিও , যে শাড়ির খোঁজে গেলাম, তাকে তখনও পাওয়া হল না । আপন করতে আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আমার এক মুম্বাই নিবাসী বান্ধবী নিয়ে এসেছিল তাকে । সেই তাক লাগানো অরিজিনাল পৈঠানির মূল্য অতদিন আগেও বেশ বেশি ছিল , আমার বান্ধবী নিয়ে এসেছিল সেমি পৈঠানি । অরিজিনালের আঁচলের পাখির মোটিফে নাকি সোনার জরির কাজ একে অমূল্য করেছে । প্রধানত দুরকমের পাখি ... টিয়া ও ময়ূর । কোনটার মূল্য বেশি বুঝতেই পারছ !!! আমার ছোটদির ছেলে সব শুনে বলেছিল... " কাকের মোটিফ কিনলে ভাল করতে .. মেসোর পকেট ফ্রেন্ডলি হোতো !!!!" 😡👿 


      পরের দিন one day package এ গাইড সহ আমাদের বাস ছাড়ল হোটেলের অফিসের সামনে থেকেই। কজন বাঙালি সহযাত্রী সহ বেরিয়ে পড়লাম। গাইডের বলার ধরণ একটু নাটকীয় , তাতে ক্ষতি ছিল না , তবে গলার উত্থান, পতন ছিল মারাত্মক !! পতনের দিকের বর্ণনা কিছুই কর্ণগোচর হয়নি সেবার । তো খানিক খানিক গোচরিভূত তথ্য নিয়েই একে একে দৌলতাবাগ ফোর্ট , ইলোরার গুহা মন্দির, পানি চক্কি , বিবি কা মকবরা , ঔরঙ্গজেবের সমাধি সব দেখা হল । এর মধ্যেই খাওয়ার বিরতি ছিল , ইলোরা দেখার মাঝে । ইলোরাতে ভাগাভাগি করে দুই দিকে স্থাপত্য...একদিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ গুহা , যেখানেই সেই বিখ্যাত কৈলাশ মন্দির, যার জন্য আমার ইচ্ছাপূরণ হল , আর অন্য দিকে জৈন গুহা মন্দির। জৈন গুহা মন্দিরের সিঁড়ি দেখে আক্কেল গুড়ুম, প্রায় ছোটবেলার style এ ( মনে নেই ছোটকালের কথা ) হামা দিয়ে হ্যাঁচোর প্যাচোড় করে উঠলাম শেষমেষ। কর্তা ছিলেন পিছে , তাই টেনে তোলার উপায় নেই। এদিকে ইলোরাতে আরেক কাণ্ড ধরা পড়ল ... কর্তা মশাই এর সদ্য উপহার স্বরূপ পাওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা আর আগেকার আমার কোডাক k20 এই দুইখান নিয়েই বেড়ু বেড়ু করতে গিয়েছিলাম... ভাগ্যিস !!! কর্তা মশাই এর বিবেচনার কথা বলতেই হবে । ইলোরা চত্বরে নজরে এল এ যাবৎকালের সব ছবির কিছুই নতুন ক্যামেরা আর দেখাচ্ছে না । কি হবে ?? কত কায়দার ছবি তুলে দিয়েছিল কর্তা মশাই !!! 🤔😥

নাহ্ সে সব গেলোই , ভাগ্যিস ভাগযোগ করে দুই যন্ত্রেই ধরে রেখেছিলাম ছবি .... । খুব মন ভার হয়েছিল। তাজমহলের আদলে তৈরি বিবি কা মকবরাতে এই মিঞা বিবি পুরাতন পদ্ধতির সহায়তায় ছবিও তুলেছিলাম, যা আজও অক্ষত। 

এই ঘোরাঘুরির মধ্যেও শাড়ির কারখানা পরিদর্শন ছিল । সেখানে বাসের সকল মহিলা হাসি মুখে আর কর্তারা বিরস বদনে হাজিরা দিলেন। মায়ের জন্য একখান শাড়ি কিনেছিলাম, নিজেই । জামাইকে আর দুঃখের ভাগিদার করিনি । তাতেও মুখ ভার !!! বিয়ের পর থেকেই বুঝিয়ে আসছি ... তোমার টাকা আমার টাকা এবং আমার টাকা আমার টাকা !!! তা শুনলেও মানলে তবে না ? আচ্ছা তোমরাই বলো দেখি , বিয়ের মন্তর কে বলে পুরোহিত মশাই এর সাথে ? আমরা তো বসে বসে ভাবি এরপর কি কি হবে ??? হতে চলেছে ??? তবে ?? ওখানে যদিদং .... ইত্যাদির ইতিবৃত্ত অনুযায়ী তোমার সবই আমার... সে যাই বলো না বলো .... । 

যাক সেদিন হা ক্লান্ত হয়ে ফিরে , খেয়ে দেয়ে ঘুম , পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে পুনে হয়ে আমরা রওনা দেবো পাহাড়ী গন্তব্য মহাবালেশ্বর । 

 অজন্তা , ইলোরার ঘোরার পাট চুকিয়ে , পরের ভোরে ঔরঙ্গাবাদ থেকে পুনে গামী বাসে রওনা দিলাম। তখন পুনা আর পুনে এই দুই নামের মাঝে ওই স্থান ঝুলছে বা দুলছে । পুরাতন নাম তল্পি গোটায়নি আর নতুন নামও শিকড় গাড়েনি । রওনা দিলাম । কাচ ফিক্সড করা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস , সাথে সিনেমা দেখার সুব্যবস্থা যুক্ত । কিন্তু ওই ব্যবস্থা আমার ক্ষেত্রে সু থাকল না , কু এ পর্যবসিত হল । সেই থেকেই জানলাম চলমান বাস বা গাড়িতে আমার এসব দেখা চলবে না । এখনও ট্রেন ছাড়া অন্যত্র ( যানবাহন) মোবাইল দর্শন মানা হ্যায় । যদি সিগন্যাল দেখে ফোনে মন দিয়ে ফেলি , তৎক্ষণাৎ লোকাল গার্জেন গর্জন করেন । আমিও সমঝে যাই । তো এক ভয়ানক সিনেমা চলছিল, ওয়েলকাম । বাপ রে ওয়েলকামের ধরণেই কিনা জানি না , খানিক দেখেই শরীর গোলমাল ( ওই সিনেমা হজম করা সহজ নয় ), ফলে চোখ বুজেই পুনে ওবধি কাটিয়ে দিলাম।

কিন্তু আমার কর্তা মশাই এর এক কথা জীবনের হাজারো ঝামেলা , তাই সাধ করে জীবন মুখী সিনেমার গভীর ও গম্ভীর বিষয় কেন দেখব ??? তাই তার মন পসন্দ সিনেমা সে মন দিয়ে মজা নিয়েই দেখা শেষ করল । এ দিকে পুনেও গুনে গুনে সময় মতন চলে এল । আমার গা গোলানো তখন অনেকটাই কমের দিকে । সম্ভবত বেলা ১১ টার একটু পরেই পুনেতে নামলাম। লটবহর আমার জিম্মা করে তিনি গেলেন মহাবালেশ্বরের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে আর মুম্বাই নিবসী তার এক বন্ধুকে কল করতে ।কারণ মুম্বাই পৌঁছে নবী মুম্বাইতে তারই ডেরায় আমাদের ওখানকার সাকিন নির্দিষ্ট, আগে থেকেই। সেদিন শনিবারের বারবেলা , আমাদের সাথে কথা বলেই সে বাজারের পথ ধরবে । আমরা যাবো কিনা !!! আর গিয়ে কতো ঘুরবো ... তার জন্য ভাল করে বাঙালি খাবার খেয়ে দেয়ে নিজেদের শক্ত পোক্ত করতে হবে তো !!! বাইরে এ কদিন বাঙালি খাবার তো মেলেনি , উল্টে ঔরঙ্গাবাদে হোটেলে অদ্ভুত স্বাদের একটা কেমন কেমন চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস খেয়েছিলাম । আসলে বাঙালি চাইনিজ খেয়ে অভ্যস্ত জিভ , মারাঠি চাইনিজ সহ্য কেন করবে , সেটা নয় উহ্যই থাক । 

গাড়ি ঠিক করা নিয়ে গোল বাঁধলেও, শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ এর মতন গাড়ি আমাদের নিয়ে গতি বাড়িয়ে গড়গড়িয়ে মহাবালেশ্বরের পথে রওনা দিল । গাড়িতে উঠে খোলা জানলার নির্মল বাতাসে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । আগের বাস জার্নির সময় তেমন কিছুই খাওয়ার সুযোগ হয়নি , শরীর গোলমালের দরুন। বিস্কুট খেয়েছিলাম বোধহয় তেনার তাড়নায় । এবার খিদে খিদে ভাব জেগে উঠল , আমরাও ড্রাইভার দাদার recommendation এ এক জায়গায় পাত পেড়ে খেয়ে নিলাম। আর খিদের মুখে কি বাঙালি কি মারাঠি সবই অমৃত । কাজে কাজেই খাবার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা তোলা থাকল তখনকার মতন । আবার চলতে চলতে... বরং বলা যায় ভাত ঘুম দিতে দিতে দুজনেই পাহাড়ি পথ ধরে ফেললাম। হ্যাঁ তো , মহাবালেশ্বর তো পাহাড়েই । আর পাহাড়ের প্রতি আমাদের দুজনেরই আকর্ষণ আর প্রেম ভয়ানক রকম বেশি । এক সময় ঘুম ভাঙার পর "ও সাথি চল তু...." গানের কলি মনে আনা গোনা করতে লাগল ... এ পথেই তো এক সময়ের অসংখ্য বলিউডের তারকাদের নাচা গানার আদর্শ স্থান ছিল বলে শুনেছি । এক সময় পাহাড়ি পথের বাঁকে গন্তব্য দৃশ্যমান হল , আরো কিছু পথ পেরিয়ে একটা চার্চের পাশ কাটিয়ে M.T.D.C এর হোটেলে পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যার আঁধার নামছে । এখানেও গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কটেজ আর ডাইনিং হল অন্য পাশে । পাশাপাশি আলাদা আলাদা ছোট্ট কটেজের একটাতে আমাদের স্হান হল । এখানেও আগাম মোমবাতি ধরিয়ে দিল হোটেলের রুম সার্ভিসের মধ্য বয়স্ক কর্মীটি । হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজে মন মেজাজ তখন বেজায় খুশ্ । মোমবাতি , খাবার জলের ব্যবস্থা সব সম্পন্ন করে যাওয়ার আগে ওই কর্মী ঘরের সামনের লাগোয়া বারান্দায় কিছু না রাখার কথা বলে গেলেন । কিছু বলতে কাপড় জামা , জুতো ইত্যাদি । বাঙালি ঘরনী আর ধোপানীর খুব পার্থক্য নেই কো !!! আমি ট্রেনেও ছোটখাট তোয়ালে , গামছা শুকতে দিতে দেখেছি আর তা থেকে শিক্ষিত হয়েছি , এক দুবার .... । মোদ্দা কথা হল যে এখানেও বাঁদর । পরের দিন সক্কাল সক্কাল আমরা দুই মক্কেল নিজেদের বারান্দার চেয়ারে ফিট করে সকালের তাজা ভাবটা নিজেদের ভিতর ভর্তি করতে করতে এক খুদে বাঁদরের বাঁদরামি দেখছিলাম। মজাও লাগছিল। 

তো সেদিন সন্ধ্যার দিকে হাঁটি হাঁটি করে একটু আশে পাশের সাথে পরিচিত হতে গেলাম। প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে আমি চনমনে আর সে মিনমিনে হয়ে গেল । কেন বলো তো ? ঠিক ধরেছ মার্কেট প্লেসে হাজির হয়েছিলাম যে !!! কোন দিকের বিপদ কে জানে ? আমার পরিচিত মহলের জন্য টুকটুক কিছু কিনে থাকি প্রতিবারই , সেই টোকেন খোঁজাখুঁজির ফাঁকে ফ্রুট জুস খাওয়া হল , স্ট্রবেরী জুস । ওদিককারই ফল , পরের দিন স্ট্রবেরী ফার্মেও গিয়েছিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর , পরের দিনের ঘুরপাক খাওয়ার গাড়ি ঠিক করতে ওখানকার অনেক ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে একটা অফিসে কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লাম। পর পর অনেক এজেন্সি থাকলে , অপরিচিত শহরে কে আর সঠিক পথের দিশা দেবে ? তবে টুরিস্ট স্পট গুলোতে সাধারণত এলোমেলো ঘটনা কম ঘটে । তিনি দস্তুর মতন সব যাচাই করতে শুরু করলেন । আমি এদিক ওদিক দেখে , ওখানকার এক স্লীপার কোচের ছবি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। পথে এমন বিজ্ঞাপিত ছবি আরো কটি এজেন্সির সামনে দেখলেও মরমে পশেনি , এবার আমার এক নতুন ইচ্ছে মনে ডানা মেলল .... আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী দুই রাত মহাবালেশ্বরে কাটিয়ে , তৃতীয় দিনের দিন ভোরে বা সকালে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবো ,আর সাগ্নিকের বাড়ি দুপুর দুপুর পৌঁছে যাব । কিন্তু ... কর্তা মশাই কে একটু অন্যরকম ভাবে বোঝাতে হবে , তো যে পথ সোজা সেটাই পাকড়াও করলাম...ভাড়া গাড়ি আর বাসের (তা সে হোক না শীততাপ নিয়ন্ত্রিত) ভাড়ার বিস্তর ফারাক । তবে ?? আর একটা রাত হোটেলের বদলে নয় , স্লীপার কোচেই কাটুক। ভোর ভোর বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে । চিড়ে ভিজল এক কথায় , পরের দিন ও রাতের দু ধরনের বাহনের আগাম বুকিং করে , বুক ভরা খুশি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু মুশকিল কি জানো ? ও পক্ষও আমাকে হাঁড়ে হাঁড়ে চেনে 🤔। ফেরার পরে একগাল হেসে বললে ... " আমার টাকা save করলে , নাকি ওই বাসে চড়ার শখ চাগাড় দিয়েছে ?" .... যাহ্ পুরো জল ঢেলে দিল । এই করে জানো তো ; যা ভাবি ঠিক ধরে ফেলে !! আর কি ; ধরা পড়ে , ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ইতি টেনে আমিও হেসেই দিলাম... কি আর করি !!! রাতে খেতে গিয়ে শুনি ওখানকার রান্না ঘরে একজন বাঙালি কুক আছে , বাঙালি টুরিস্টের কৌলিন্যই আলাদা , তাই সে কথা মাথায় রেখে পশ্চিম বাংলার রতন , পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে , ওখানকার রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে । তাকে ডাকা হলো , ফরমায়েশ মতন যখন খাবার পরিবেশিত হল , বুঝলাম এ রতন আর সে রতন নেই । পরোটা ও মাংসের ঝোলের বদলে কুলচা আর এক চিড়বিড়ে ঝাল চিকেন খেয়ে তখন দুজনেই বুঝতেই পারছিলাম ... নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে ? কিন্তু গাওয়ার অবস্হায় ছিলাম না কেউই । আমার কর্তার গানের দৌড়োদৌড়ি মেঘের কোলে ওবধি । তবে গান শুনতে ভালবাসে আর কোন জমায়েতে গেলেই লজ্জিত মুখে বলে ফেলেন ... জানো তো/ জানিস তো শিল্পী( আমি ) গান জানে । এবার তাদের শুনতে হয়ই , না চাইলেও 🤫 কারণ অনিচ্ছুক বুঝে যদি চেপে যাই , সে চেপে ধরবেই ... কই শুরু করো !!! বোঝো একবার ; আমি আগাপাসতলা বুঝেও এই শ্রোতার উৎসাহের স্রোত থামাতে অপারগ 🙄

তো যাইহোক পরের দিন জলদি সাজুগুজু করে বেরিয়ে পড়লাম। রোদে ভাজা হবার আগে আগেই ।যা যা দেখার দেখতে দেখতে চললাম। পাহাড়ের কয়েকটা কমন ভিউ পয়েন্ট দেখার সাথে সাথে , মন্দির ( পঞ্চগঙ্গা মন্দির ) , লেক , বোটিং আর না না ধরনের মার্জিত রোমান্টিক ছবিও তোলা হলো ড্রাইভার দাদার সৌজন্যে । পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, বসে , পদপ্রান্তে বসে ( আমি) ছবি তোলার পর , খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে স্ট্রবেরী ফার্ম দর্শন করে , ঐতিহাসিক প্রতাপগড় ফোর্টের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলাম। ফোর্টের চূড়ান্ত উঁচু স্হানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ঘোড়ায় বসা একখান চির পরিচিত মূর্তি দেখে , এবার ফেরার পথ ধরলাম। মন্দিরের একটা বিষয় মনে আছে , বেশ কয়েকটি নদীর জল সরাসরি মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে দুটি পৃথক জলাধারে মিশেছে ।প্রতিটা নদীর নাম লেখা নল , যা পাথরের তৈরি গো-মুখের সাদৃশ্য যুক্ত , তা দিয়েই পঞ্চ নদীর জলের জলাধারে প্রবেশ । বেশ অভিনব লেগেছিল বিষয়টা । পাঁচটি নদী সম্ভবত কৃষ্ণা , কোয়েনা , ভেন্না , গায়েত্রী ও সাবিত্রী আর ধর্মীয় মতে ওই জল আমাদের গঙ্গা জলের মতনই পবিত্র বলে বিবেচ্য। ওদিকে তো গঙ্গা নেই । সম্ভবত দুই জলাধারের একটির জল পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয় আর অন্যটি মন্দিরের দর্শনার্থীদের হাত , পা ধোয়া জন্য ব্যবহৃত হয় ।

সব দেখা দেখির পর ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল , ফিরে বিশ্রাম, নৈশ আহারের পরেই ইচ্ছাপূরণ ট্রিপ । সে বাস ছাড়ল রাত ৯ টার সময় । খানিক আগেই সেখানে পৌঁছে , মাল পত্তর বাসের পেটে ভরে বাসে উঠে পড়লাম। উঠেই আমি মুগ্ধ !!! করিডোরের দুপাশে জোড়া বার্থ আপার আর লোয়ার । সমস্ত বার্থে দুখান বালিস , দুখান ব্ল্যাঙ্কেট , আলোর ব্যবস্থা , চার্জ দেওয়ার পয়েন্ট আর সবটাই হাল্কা ঘিয়ে রঙের পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী । আহা !! কি রোমান্টিক পরিবেশ । ভাগ্যিস ইচ্ছে জেগেছিল ; নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে নিলাম মনে মনে । কিন্তু এ কি আমার এমন রোমান্টিক কর্তা মশাই এমন চিন্তিত কেন ? মুখে তার হাসি নাই দেখলাম । কি হলো ??? আমাদের রাজ্যের পাহাড়ি পথে রাতে গাড়ি চলাচলের বিধিনিষেধ ( কম চলে ) থাকলেও ওদিকের বন্দোবস্ত ভিন্ন আর তাতেই আমার চিন্তামণি চিন্তিত হয়েছেন , সে পরে বুঝেছিলাম। নাহ্ ওমন রোমান্টিক অ্যামবিয়েন্স মাঠে থুড়ি পাহাড়ি পথেই মারা পড়ল । আমি আবার মনের দুঃখ আর চিন্তা সইতে পারিনা , ঘুমিয়ে পড়ে মনকে রেহাই দিই , অগত্যা ঘুম দিলাম। তিনিও জাগন্ত হয়ে পাশে শুলেন , পরে যে ঘুমালেন তা বুঝলাম নামার আগের কন্ডাক্টারের জায়গার নামের অ্যানাউন্সমেন্টে !!! আসলে হয়েছিল কি ... আমাদের নামতে হবে নবী মুম্বাই এর খারগারে , সেই মত কথা ছিল কন্ডাক্টর আমাদের একটু আগে পানভেলে ঘুম থেকে তুলে দিলেই , কর্তা মশাই বন্ধুকে ফোন করে দেবে আর আমরা যথাস্থানে নামার পর , সে তার বাহন চালিয়ে এসে তার ডেরায় নিয়ে যাবে । কিন্তু .... পানভেলে আমরা সবাই ঘুমন্ত মায় কন্ডাক্টরও , ঘুম ভেঙে দু স্টপ পেরিয়ে খারগার আসতে দেখে সে হৈ চৈ রবে খারগারের নাম ঘোষণা করল ... ধড়মড়িয়ে দুজন উঠে পড়ে নামার তাড়নায় , সে বাছাধনকে আর আগে না ডাকার জন্য বকুনি দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। খারগার বাসস্টপ পেরিয়ে গিয়ে একটু অন্ধকার রাস্তার ওপর রাত ৩টে ৩০ মিনেটে আমাদের লটবহর সহ নামিয়ে শূনশান পথে বাস হুস্ করে বেরিয়ে গেল । 

কর্তা মশাই চটপট রাস্তার আরো ধারে আমাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধুকে ফোন লাগাল , ওই অন্ধকার ভাল লাগছিল না , আলোর দিকে আসলেই বকুনি দিয়ে আঁধারে মশার জিম্মায় থাকতে বলছিল । বললাম... মশা তো তুলে নিয়ে যাবে এবার ?? রাগত উত্তর এলো ... "তুলুক , অন্য কেউ না তুললেই হলো ।" এবার আলো আঁধারির কার্যকারণ ধরতে পারলাম , কেঁপে উঠলাম... সত্যিই তো , এ তো ভাবিনি !! ওই সময়টা তো বিপদজনক আর মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে দিয়ে চার চাকার ছোট বড় গাড়ি তো বেরিয়ে যাচ্ছে অনবরত । বয়স কম , সাথে জাঁদরেল সাথি , বেড়ানোর রোমাঞ্চকর আনন্দে বাস্তবকে ভুলে মেরে দিয়েছি যে , দিনকালের হালচাল তো ভাল নয় । ভয় ভয় করতে লাগল । এমন পরিস্থিতিতে সময় যেন কাটতেই চায় না । ওর বন্ধু দুই রিঙেই ফোন ধরে , নেমে গেছি শুনেই আর দেরি করেনি , ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে এল ... মনের ঝাল মেটানোর আগেই লটবহর আর আমাদের তুলে নিয়ে রওনা দিল ওর বাসস্থানের দিকে । প্রথমেই আমাদের বেআক্কেলে সময়ে আসার জন্য বেছে বেছে শব্দ প্রয়োগ শুরু হলো ...আর তারপরেই কটাক্ষ লটবহরের সংখ্যাধিক্যের জন্য, কিন্তু তোমরাই বলো কন্ডাক্টর যদি আমাদের আগাম না ডাকে আমরাই বা কি করব ??? যাক ... চিন্তার কারণেই বাক্যবাণ, যা ভালবাসার আরেক নাম ... সোহাগ করে যে , সে তো শাসন করতেই পারে , তাই না ??? 

এবার ভোরের অপেক্ষা আর মুম্বাই বেড়ু ....  

 ভোর রাতে মুম্বাই পৌঁছলাম আমরা । আগেই লিখেছি , যার ডেরায় আমাদের মুম্বাই এর দিন গুলো কাটাবো বলে স্থির করা , সে হল আমার কর্তা মশাই এর পাড়াতুত বন্ধু , সে আমার থেকে বছর দেড়েকের বড় মোটে । আমাদের কোর্টসিপ পর্বেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল । তখন থেকেই সে আমারও বন্ধু । পাড়াতুত বন্ধুত্ব তো বয়স মেনে হয় না , কাজেই আমার কর্তার থেকে সে বছর তিনেক ছোটই । এখন যদিও দুজনের পাড়া ভিন্ন কিন্তু বন্ধুত্ব অভিন্ন হৃদয়ের । সাগ্নিকের তখন বিয়ে হয়নি , ও কর্মসূত্রে ওখানে থাকত কমলকে নিয়ে । সে একাধারে সাগ্নিকের বাজার সরকার, রাঁধুনি , সবকিছু । ওদের পূর্ব পরিচিত , বিশ্বাসী কলকাতার ছেলে । কাকিমা , মানে সাগ্নিকের মা , তার ছেলেকে একা একা অচেনা শহরে পাঠাতে নারাজ , তাই এই ব্যবস্থাপনা । কমলের যেমন সুন্দর ব্যবহার, তেমন রান্নার হাত । সেদিন সপ্তাহের শুরুয়াত , কাজেই সাগ্নিকের সাথে আগের বলা কথা অনুযায়ী ঠিক হল যে , সারা সপ্তাহে ওর ব্যবস্হাপনায় আমরা সব ঘুরবো , দেখবো দুজনায় । রাতে ওর সাথে দেখা হবে ঘরে ফিরে , সপ্তাহান্তে এক সাথে সবাই খেতে যাব ওর পরিচিত কোন রেস্তোরাঁতে । অতএব মেঘনাদের ভূমিকায় সাগ্নিক অবতীর্ণ হল আর আমাদের বোম্বাই ওরফে মুম্বাই দর্শন শুরু হল সেদিন একটু পর থেকেই। 

মুম্বাইতে আমার ছোটবেলার দুই বান্ধবীর বসবাস , বৈবাহিক সূত্রে । তাদের সাথেও এই সুযোগে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেবার ভাবনা মনে রয়েছে । সেই মতনই প্রথম দিন সাগ্নিকের দেখানো পথে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, অফিস যাওয়ার পথে ভাসি (Vashi )স্টেশনে আমাদের নামিয়ে , ও চলে গেল । ওখান থেকে ট্রেনে ভি.টি , ওখান থেকে সমুদ্র তট ,তারপর খানিক সমুদ্র বিহারে এলিফ্যান্টা কেভস্ দর্শন, ফিরতি পথে এক বান্ধবীর সাথে মোলাকাত ... বেড়ু পুরো জমে ক্ষীর । কিন্তু .... পরন্তু বলেও একটা ব্যাপার আছে তো ; সেদিন সবই হল বটে তবে ... "কিন্তু যুক্ত" হয়ে ভরপুর ভাবে। ভাসি থেকেই যে ট্রেন সরাসরা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস (ভি.টি ) যায় ,

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৫

 বেড়ানোর কথা ভাবতে মানা নেই কোনো। অর্থাৎ কিনা মানস ভ্রমণ। এ বছরের গোড়ার দিকে কর্তামশাই অন্যের অপারেশন করার বদলে নিজের অপারেশন করালেন। শরীরে খান কতক গুড়ি গুড়ি পাথর যুক্ত হয়ে , বিস্তর সমস্যার সৃষ্টি করছিল। অতএব দাও তাদের বের করে !!! সে সব মিটতে , দুজনায় ঠিক করলাম , এ বছর এখন আর ঘুরতে যাওয়ার প্রশ্ন না তোলাই ভাল । অপারেশনের পরে বেড়ানোর রেশনে তখন টান। খানিক সামলে সুমলে একটু দূরের দিকে যাওয়ার কথা ঠিক হল পরের দিকে। যদিও তার রাফ ওয়ার্ক এখন বিশ বাও জলে । হেনকালে তেনার ছোটকালের পাড়াতুত বন্ধু বেড়ানোর পোকা কে টোকা দিয়ে জাগিয়ে দিল .... কিন্তুক মনস্থির করার পরেই সে বেড়ানোর গাছে তোলার মই সরিয়ে অফিসের টুরের গপ্পো শুনিয়ে হাওয়া হলেন !!!! এদিকের জন তো গাছে বসেই গর্জন করে ব্যক্ত করলেন যে , হাম জায়েঙ্গে জরুর। রেগে গেলে ইংরেজি অথবা হিন্দি বলার দস্তুর থাকলেও তিনি নির্যস বাংলাতে বলে দিলেন যে যাবোই যাবো। কেউ যাক না যাক !!! 

দুঃখের কথা বলি কারে ??? কন্যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গীদের সাথে বেড়াতে কিঞ্চিত বোর ফিল করে কিনা কখনও খোলসা করে না বললেও "তিন জনে যাব শুধু !!!" বললে একখান দুখী রামের মতন মুখ করে থাকে , তাতে আমার মন দুঃখে থৈ থৈ হয়ে যায়। ভাবনাতে তা দিয়ে আমাদের নদী থেকে পাহাড়ের ভ্রমণের সঙ্গী দেবাশ্রিতাকে ফোন লাগালাম । এবারে সমুদ্র হবে কি হবে না এ সব ভাবতে ভাবতেই ওদিক থেকে সবুজ সংকেত মিলল তবে খান কতক দিন পরে যাওয়ার অনুরোধ এলো। 

জায়গা নির্বাচন নিয়ে খানিক চাপানউতোরের পর ঠিক হল রূপনারায়ণ নদীর ধারের কোলাঘাট। যাওয়ার পথে দেউলটি নামক ফাউ যদি ঘুরে নিতে পারি , দারুণ হবে ব্যাপারখান। সবাই জানি যে দেউলটিতে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একখান বসতবাটি ছিল , যা এখন অবশ্যই এক দর্শনীয় স্থান। যাওয়ার আগে বেশ সপ্তাহ দুয়েক লম্বা সময়ের মধ্যেই দেবাশ্রিতা আকুলি বিকুলি করে সমুদ্র সৈকত যাওয়ার সুপ্ত বাসনা মনের গুপ্ত স্হান থেকে বের করতেই , যাওয়ার লিস্টি নদী থেকে সাগর মুখী হল। নদী বাদ পড়ল এমন ভাবার কারণ নেই কো। বলা ভাল নদীর সাথে সাগর যুক্ত হল। ভাই দেবাশ্রিতা .... রইল বাকি ঠাণ্ডা ও গরম দুরকমের মরুভূমি এবং অরণ্য । মনে ইচ্ছে বজায় রেখো । হয়ে যাবে কখনও কোন একদিন ।

অবশেষে এল সেই আকাঙ্খিত দিন। চাটিবাটি গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একখান মিটিং পয়েন্টে মীট করে স্থান অদল বদল করে আমরা চলমান হলাম। মেয়ে আর বাবার মন রাখতে , মনে ভার নিয়ে অন্য গাড়িতে দেবাশ্রিতার চারআনা র সাথে ভাব জমাতে লেগে পড়লাম। দুই বান্ধবী র ফুর্তি ধরে না আর !!! মা নামক "না " সাথে নেই ... এ কি কম কথা। ছোটকালে পিতাশ্রী ঘাড় পাততো না এক্কেরে !!! তখন মেয়ে আবার পথে বেরিয়েই পেটের সব হজম না হওয়া খাবার উগরে দিত !!! এখনও দেয় তবে রয়ে সয়ে , আগাম নোটিশ ধরিয়ে । সর্বোপরি বন্ধু বিহীন পথ চললে । এবার সে সব আপদ বালাই বলতে গেলে ছিলই না। কাজেই দুই গাড়ি চলল । 

আমাদের গাড়ির চালক অভিজিৎ দক্ষ চালক। সে হুস হয়ে গেল অচিরেই। এদিকের চালক দেবাশ্রিতা নভীস না হলেও নিত্য চালক নয় , সর্বোপরি তার কর্তামশাই এর ভয় সুলভ নির্দেশনা মেনে গাড়ি চালাতে চালাতে শুরু হল টক ঝাল মিষ্টি কথার  পিঠে কথা !!! আমি পুরো হাসতে হাসতে পথ পেরতে লাগলাম। মধ্যে দেবাশ্রিতা জুনিয়র হিল্লোলের সাথে ভাব জমা শুরু হল !!!! পথে বাহন চালনা করার ভাগযোগ কর্তা-গিন্নি করেই বেরিয়েছে। উলুবেড়িয়া থেকে গিন্নি গাড়ির চালকের আসন দিয়ে দেবে তার কর্তামশাই কে। অদল বদল হতেই গিন্নিমা মোক্ষম শোধ তুলতে তুলতে এগিয়ে চললেন । পুরো কৌতুক মাখা চিত্র নাট্য শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল মজাসে !!! তবে ওদিকের গিন্নির পরিষ্কার কথা ... আগে তুমি খুঁত ধরেছ যখন , ফেরত না দিলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে । তা কি ঠিক ???? 

চলতে চলতে পথের ধারের ভাঁড়ের চা পান অবশ্য পালনীয়। সে সব মিটিয়ে চটপটা কিছু রেডিমেড খাবারের প্যাকেট আমাদের ঝোলায় ভরে দেউলটির দিকে চলতে লাগলাম। পথে বেরোলে বরাবর আমার ক্ষিদে ভয়াবহ আকার নেয়। বাড়ি থেকে যত ই পেট পূজো করে বাইরে যাই , পরবর্তী পূজোর টাইম চট জলদি পেটের দুয়ারে হাজির হয়ে পড়ে। চটপট চটপটা কে ঝোলার ভিতর ঘাঁটি গাড়তে না দিয়ে ঘেঁটি ধরে বের করে সকলে মিলে জুলে পেটে চালান করতে না করতেই হাইওয়ে থেকে এক অন্য পথে একটু ভিতরে ঢুকে কথাশিল্পীর বাড়ি এসে পড়তেই, দুয়ারে নেমে পড়লাম। গণগণে রোদ মাথায় করে ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম, দর্শন করতে হবে আধা ঘন্টার মধ্যেই। কারণ ১২টা র সময় বাইরে র মানুষের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যায় ‌। 

ভিতরে এক অযাচিত বয়স্ক গাইড অদ্ভুত এক সুরেলা কিন্তু ওঠা পড়াবিহীন স্বরে বলে যেতে লাগলেন বাড়ির ঘর গুলির ইতিহাস সাথে সে বাড়ির মালিকের ইতিবৃত্ত। একতলা পেরিয়ে দোতলায় এসে ঘর লাগোয়া প্রশস্ত বারান্দা দেখে সকলে লাগাম ছাড়া হলাম। শহুরে ঘর বাড়ির এক চিলতে বারান্দায় যে কচি থেকে ধাড়ি কারোর মন ভরে না !!! তা সবার আচরণে প্রকট। শুধু মাত্র যে এমন ফূর্তি আমাদের মনে দেখা দিয়েছিল একদমই তা নয়। ওখানে আগত অন্যান্য দের দেখেও তা বুঝেছিলাম স্পষ্ট। ওপরের ঘর গুলোকে নিচের ঘরের মতনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালার গারদের ওপারে দেখলাম। এমন পরিবেশে দাঁড়িয়ে মন আবিষ্ট হয়। অদ্ভুত শিহরন খেলে যায় শরীরে। মন অবাক হয়ে ভাবে ; এই ঘরে , বারান্দায়, বাগানে কথাশিল্পী একদিন দিনযাপনের ইতিহাস লিখেছেন। বহু যুগের ওপার হতে যেন কল্পনা বিলাসী হলেও হওয়া  যেতো। কিন্তু সময় সীমিত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাই রূপনারায়ণ নদীর দেখা পেলাম। শুনেছিলাম আগের বারে ‌.... নদী , লেখকের আমলে বাড়ির কাছ‌ দিয়ে বয়ে যেত। গতিপথ একটু একটু করে সরে গেছে খানিক দূরে। আগে যেবার এসেছিলাম পুপে তখন ১১ মাসের কুচো। যদিও কথাশিল্পীর সম্পর্কে তার তখনকার আর এখনকার জ্ঞানের পরিধি র পার্থক্য খুব সামান্য। ওই টুকখান পার্থক্য র জন্য দায়, দায়িত্ব, অবদান যাই বলো ‌তা আমার নয়কো মোটেই। অবদান Hoichoi এর " পরিনীতা " নামক web series এর !!!! 

সব দেখার পর ছবির পালা মিটিয়ে আমরা সকলে আরেক প্রস্থ ছবি তুলতে হাজির হলাম সামনের বাগানে। নানা রকম ফুলসহ বাগানের একপাশে আরো দুই জনার সাথে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেতপাথরের স্মৃতি বেদী দেখলাম। তার এক পাশে রয়েছে বাঁশ ঝাড়। বাঁশ গাছের আধিক্য দেখা র মতন। বড় বাঁশ ঝাড় ছাড়াও কিছু ছোট একত্রিত বাঁশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওদিকের কর্তা গিন্নি দেখি বিগলিত । একজন আরেকজনকে বললে ‌.... এসো তো দেখি আমরা এখানেই ছবি তুলি ; একে অপরকে বাঁশ দিয়েই থাকি যখন !!! মনে মনে কি ওরা আরো জোরালো বাঁশের সন্ধান করেছিল ? নাকি বাঁশ ঝাড় নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছিল কে জানে ? তবে ভাব ভাব , আড়ি আড়ি হলে তবেই তো জীবন চটপটা তাই না ? তরঙ্গ একদম না থাকলে যে সব আলুনি !!!! 

এরপর গাড়ি দিল পাড়ি অল্প খানিকটা দূরের রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে র সাজুগুজু করা হোটেল সোনার বাংলা তে । সে গল্প নিয়ে আসছি জলদি।

@শুচিস্মিতা ভদ্র 




Saturday, 21 June 2025

 আজ একটা অন্য গল্প বলি .... সবাই নয় না-ই শুনলো থুড়ি পড়লো , কেউ কেউ তো পড়বেই। তো যা বলছিলাম .... আমার ছোটবেলার প্রথম পুষ্যির কথা। আমার বন্ধুরা সকলেই নামে তো বটেই , কেউ কেউ আবার রীতিমত তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ও চেনো। হ্যাঁ , একদম ঠিক ধরেছ আমি কুট্টুসের কথা-ই বলছি। ওর আগে কিছু পোষার শখ থাকলেও , মায়ের অনুমতি মেলেনি। তাহলে কুট্টুস -ই বা এলো কেমনে ?? সেটা ই হলো ওই কুট্টুস নামের মতোই ছোট্ট একটা গল্পের হাত ধরে। কুট্টুস ছিল একটা কাঠবেড়ালি। ওই যে ছোটদের ছড়ার বই এ দেখেছিলাম , পড়েছিলাম কাজী নজরুল এর জবানীতে.... " কাঠবিড়ালি, কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও ??? " সেই পরিচিত একরত্তি ছোট্ট প্রাণী।

সরস্বতী দির ছেলে একদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ে পড়ে যাওয়া ছোট্ট বাচ্চা কাঠবিড়ালি কে পেয়েছিল , আমাদের পিছনের পাড়া আমবাগানের রাস্তায়। বাড়ি ফিরে সে তার মাকে দিয়েছিল .... তারপর হাত বদল হয়ে মায়ের জিম্মায়। খাওয়া শেখেনি। আমাদের খাবার টেবিলে একটা খবর কাগজে ওকে রাখলাম.... দক্ষিণের জানলার হাওয়ায় কাগজ সহ সে উড়ে যায় আর কি !!! এতোই ক্ষীণজীবি তখন। তুলোয় ভিজিয়ে দুধ খাইয়ে তিনি ক্রমে শক্তিমান হলেন। কিন্তু আজীবন আর আহ্লাদে নিজে খেতে শিখলেন না । মা ব্রিটানিয়া বিস্কুট দুধে ভিজিয়ে নরম করে ওকে খাইয়ে দিতেন। আম কালে আমে ও রুচি ছিল, কিন্তু কবির বাণী নস্যাৎ করে পেয়ারা খেতে অরুচি দেখিয়েছিল। 

ওর জন্য কাঠের ঘর বানানো হলো , সেখানে থাকতো , জানালা বন্ধ করে ঘরের আগল খুলে দিলে আমাদের কাঁধ, মাথা আর জানালার পর্দায় দোল খেতো। মা অনেকক্ষণ ফোনে মন দিলে তার আবার ভারি রাগ হোতো , ফোনের তার বেয়ে যা তা করে , ফোন ছাড়তে বাধ্য করতো। রাগের মাত্রা বেশি হলে কাঁধে উঠে কানে কটাস !!!! ভাবো একবার কি দুঃসাহস !!!

ওকে নিয়ে ( ঝুড়ি বন্দী ) বাসে চেপে একবার মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। বাস শুদ্ধু সবার চোখে কি কৌতুক ও কৌতূহল । তিন বছর ওকে নিয়ে আমারা মেতে ছিলাম। কসবায় ও এসেছিল আমাদের সাথেই। বাসা বাড়িতে।

ও চলে যাওয়ায় জ্ঞানত প্রথম শোক কাকে বলে বুঝেছিলাম। যারা বোঝে না , তাদের হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হতেই পারে । কিন্তু তাতে কি আমার আর মায়ের কষ্ট কিছু কমে গিয়েছিল ??? 

আজ অনেক বছর পেরিয়ে, ফিরে দেখলাম। আরো অনেক কিছু মনে পড়ছে , কিন্তু থাক ওসব আমার নিজের কাছেই থাকলো। বলা ভালো বাকি টা ব্যাক্তিগত।

তাই ওদের যেখানে দেখি, ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করি । বড়ো চঞ্চল !!! সেই একই রকম স্বভাব .... বড্ড অশান্ত

 খাদ্য বিভ্রাট


পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে , কেউ জানি না । রয়েছে ভয় , আতঙ্ক আর ক্ষীণ আশা আগের মতন জীবনে ফেরার। আশা ছাড়া থাকতে পারি না আমরা। আর অধিকাংশ বাঙালি যা পারে না তাই হলো খাওয়া দাওয়ায় বাঁধন দিতে । সেই কবে থেকেই বাঙালি কবি ঈশ্বরী পাটনী কে দিয়ে মা অন্নপূর্ণার কাছে বর আদায় করে নিয়েছিলেন ... আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। 

অধিকাংশ বাঙালি ভ্রমণ বিলাসী যেমন সত্য , তেমনই সত্যি অধিকাংশ বাঙালির খাদ্য প্রীতি। তো এ হেন পরিস্থিতি তে তারা যে সব ফেলে খাদ্য না পাওয়া নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হবে , এ আর এমন কি ?? 

আর সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত বাঙালি মুক্ত কচ্ছ হয়ে বাজারে সিধিয়েছে নির্ধারিত সময়ে । থলে, ব্যাগ , বস্তা যা হাতের কাছে মিলছে সব ই চলেগা। হাতে থলে , মুখে মুখবন্ধ আর চোখে আতঙ্ক নিয়ে বাঙালি বাজারে, দোকানে সর্বত্র মানে যা তার নাগালের মধ্যে। 

এই পরিস্থিতি যে হতে পারে এমনটা সপ্তাহ দুয়েক আগে শুনেছি , গুরুত্ব দিই নি। তো কি ? আমি তো বাজার সরকার ন‌ই , তাই একটু একটু বেশি উপাদান মজুদ হতে শুরু করলো। একদিন রাগ করে বলেই ফেললাম যে , আগে অনেক বড়ো ফ্রিজ এর অর্ডার দেওয়া হোক । কিন্তু সে গুড়ে বালি !!! এখন যখন সত্যিই lockdown ঘোষণা হলো রসদ তখন অনেকটাই হজম হয়ে গেছে। আসলে নকলে মোদ্দা কথা হলো , খাদ্য মজুদ থাকা মানেই যে ঘুরছি ফিরছি খাচ্ছি ... করতে হবে এমন তো না , কিন্তু ভোজনরসিক গুনীজন তা শুনলে তবেই না ? রাতে মেনু ঠিক করা হচ্ছে পছন্দ অনুযায়ী... তবে আমি ওই সিলেবাস কেটে ছোট করছি। মানে করতে হচ্ছে-ই । আর দরকারি ও অদরকারী বিষয় যোগ বিয়োগে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি। 

আমার কর্তা মশাই এর কর্ম জরুরি পরিসেবা ভিত্তিক, সে বেরচ্ছে , ফিরে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার প্রথম প্রশ্ন কুশল বিনিময় ব বর্তমানপরিস্থিতিবিষয়ক ... এমন ভাবার কোন কারণ নেই .... প্রশ্ন নিছকই খাদ্য বিষয়ক । গতকাল ভাত, ডাল ও মাছের সাথে দুরকম তরকারি করেছিলাম মনে আশা নিয়ে যে আজ ও খানিক সামলে যাবে .... কিন্তু নাহ্ !! সে সব হজম হয়ে গেছে বটে !!! আজকের মেনুতে যা যা আবদার বলো ফরমাস বলো , ছিলো তার মধ্যে পটলের ডালনা ছিল , কিন্তু আজ ফ্রিজ খুলে পটল তুলি নি , মানে বের করিনি , কারণ কিছু ছবি হ‌ওয়ার আগের স্টেজের ভেণ্ডি ছিল, ওদের দিকে না তাকালে ওরা ফ্রিজেই ফ্রিজ করে যেতো !!! আরো কয়েকজন ঝিমিয়ে পড়া প্রতিবেশী ফ্রিজ থেকে কড়াইতে যেতে অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কাকে যে কোথায় গুজেছি আর কোথায় খুঁজেছি এ এক লাখ টাকার প্রশ্ন। আসলে ঠাণ্ডা মেশিনের ভিতরে নজর দেওয়ার আগে একটা গাইড ম্যাপ তৈরি করা উচিত ছিল, কিন্তু তালেগোলে সেটাই আর করা হয়ে ওঠেনি।আর সমস্যা সেখানে-ই।

এদিকে এবারের বিপদ বিশ্বায়নের জোয়ারে সমগ্র বিশ্বে। ইংল্যান্ড নিবাসী আমার বান্ধবী শ্বেতা-ও মজুদ সব্জীর স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ছে। আমি -ও ওমন করে কিছু সব্জি কে ঝিমিয়ে পড়ার হাত থেকে টেনে তুলেছি ( কিছু কিছু সব্জি{সব নয় } কেটেকুটে জলে না ধুয়ে কৌটো বা পলিপ্যাক বন্দী , রান্নার সময় ওদের স্নান করালে ই চলবে ) । ব্যাঙ্গালোরের বান্ধবী পরশু দিন-ই চিন্তা ব্যাক্ত করল তার মাথার সাইজের ( এটা কৌশিকীর বর্ণনা, আমার ভেবো না মোটেই) দুই কপির বাসস্থান নিয়ে। আশা করি কৌশিকীর মাথায় , নিশ্চিত কোন বুদ্ধিতে সেই কপি যুগল বিদ্ধ হয়েছে । আর কৌশিকী -ও নতুন কোন সব্জি সংকটে সংকোটমোচন এর দ্বারস্থ হয়েছে।

আমার ভোজন বিলাসী যা যা বাজার , দোকান থেকে বগলদাবা করছে , বাড়ি ফিরেই আলোচনা হচ্ছে , তা দিয়ে সম্ভাব্য কি কি পদ হতে পারে আর আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এই যে , সেই সব পদের রাধনে আমি কোনটা তে দৌপদী আর কোনটা তে মা- গঙ্গা তার বিবরণ। আলোচনা হচ্ছে কি ফোনে ? মোটেই না , হচ্ছে খাদ্য বেরসিক পুপের সাথে। 

অতি ও অবশ্য প্রয়োজনীয় পদ মজুদ করার পর , এখন জোগাড় হচ্ছে দুধের ওপরের অতিরিক্ত মালাই(উপরি)।অর্থাৎ কিনা মা দিয়ে আহারে বাহার আসে। তবে মালাই এখন মিলছে না , দূরদর্শিতা দেখিয়ে আগেভাগেই ওসব অন্য কারোর ঘরে জমা পড়েছে। তো ভি আচ্ছা.... কে যেন বলেছেন... " একবার না পারিলে , দেখো শতবার"... তো এই বেদবাক্য শুনেই তো এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছি। তবে !!!!

সেদিন আমার ভাসুর , আমাদের মুশকিল আসান দাদা দুই পাউণ্ড পাউরুটি দিয়ে গেলেন। কোথায় রাখি, কোথায় তুলি এই করে বারান্দা য় রেখে রান্নার আঙিনা আলো করতে করতে ভুলে মেরে দিয়েছি..... কি সব্বোনাস !!! পরে দেখি মার্চ করে পিঁপড়ে চলছে পাউরুটি ফিস্টে যোগ দিতে .... তারপর !!! আর কি পাউরুটি দের পিঁপড়ে কূল থেকে উদ্ধার করে , পত্রপাট তাদের জায়গা মতো রেখে নিজে ও আজ সকালের "লুচি খাবো রবিবারে "... এই নাচন পাউরুটি দিয়ে চাপা দিয়েছি। তবে পুরোপুরি বাঁচি নি । ডিম পাউরুটি নাস্তি , টোস্ট শুধুমাত্র মাখন দিয়ে খেলে ওজন বেড়ে যাবে না ???? তো পাউরুটি টোস্ট সাথে মুরগির ঝোল । তো ওটা কিছু রেখে , কিছু ছেঁটে স্টু তে স্টিক্ করলাম। যাক্ বাবা , মেয়ে দুজনেই খুশ্। সাথে আমি -ও ।

তো রোজই আমার আতঙ্কিত খাদ্য চিন্তক কিছু না কিছু আনছে শুকনো , ভিজে । শুকনো এবার ঠাই নাই , ঠাই নাই করতে করতে আমাদের পুপেদিদিমণির আলমারি তে -ও সিধিয়েছে। জানি না কি হবে ?? আমার কথা হলো সামনের বিপদের কথা মাথায় রেখে খাওয়াতে একটু লাগাম দিতে হবেই। যা মজুদ করছি , তা যদি এখন ই শেষ করি , চলবে কি করে ? 

ভালো ভালো রান্না করতে ভালো তো লাগেই, উপকরণ ও রয়েছে। আমার মামাতো দেওর কাল , বিরিয়ানি রেঁধে নিজেই বোল্ড আউট।কারণ তার কাছে ই শুনলাম খেতে মন্দ হয়নি but বিরিয়ানী র স্বাদটা-ই যা missing। পুপের বন্ধু র মা ফোন করেছিলো , শুনলাম ওদের রান্নাঘর সেদিন রসোগোল্লা আর পান্ত্তুয়ার আতুড়ঘর হয়েছিল। দারুন না ? 

কারণ বেশি চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছে না, অন্তত আমি ওতো দৃঢ় মানসিকতার কোনোদিনই ন‌ই।

আমাদের বান্ধবী দের সাথে ও কথায় কথায় জানতে পারছি সবার বন্দীগীতিকা। একজনের খাদ্য রসিক কর্তা আর পুত্রের দফায় দফায় অর্ডারে সে বেচারি নাজেহাল। এদিকে গাদা গুচ্ছের বাজার করে তার বাম- মনোভাবাপন্ন কর্তামশাই অল্প রান্না করতে নির্দেশ ও দিচ্ছে.... কিন্তু নানা রকম ফরমায়েশি রান্নাতে বাম, ডান কোনো পন্থার ছোঁয়াচ নেই। 

এদিকে সব রকম খাবার জোগাড়ে ব্যতিব্যাস্ত আমার কর্তা মশাই ঠাকুরঘরের রেশনিং-এ বেভুল হয়েছেন। পাড়ায় , বাজারে হানা দিয়ে-ও নকুলদানা জোগাড়ে ব্যার্থ হয়ে মনোকষ্টে ভুগছিলেন। এক দাদা বরাভয় দান করেছেন , দূরাভাষের মাধ্যমে ঠাকুরের মেনুর উপাদান, পরিমাণ শুনে নিয়ে , গড়িয়াহাট বাজার থেকে সংগ্রহ ও করেছেন। নিশ্চিন্তি !!! কর্তা মশাই যারপরনাই খুশি। খুশির প্রকাশ এখন বেশ প্রবল , আশা করি দাদা সামলে নেবেন। বিপদে ওমন হয়েই থাকে । কি !! তাই না ??? 

এখন এমন খাওনদাওন চালু থাকলে সত্যিই পরে , কেউ কি কাউকে চিনতে পারবো ?? আয়তন কোথায় গিয়ে পৌঁছবে ? না , এতো ভাবতে পারছি না । কারণ সব আতঙ্ক আর ভয় ছাপিয়ে কি কি খাবার বানাবো অল্প করে , এই ভাবনায় আমি আপাতত ভাবিত। ভাবছি আর খাবি খাচ্ছিল !!! 


** খাবার খাও রয়ে সয়ে , please । আমি -ও লাগাম টানছি অল্প করে , গল্প করে ... নিরূপায়। ঘরের সবার খাওয়া দাওয়া এখন আমার ওপরে-ই কিনা ..... !!!

 

 গোলমেলে কোভিড 

আলাপ পরিচয় 

নয় নয় করে , আর ভয় ভয় করে কাটিয়ে ফেললাম অনেকগুলো দিন , মাস । কিন্তু আর কতদিন ??? এই প্রশ্ন সবার , কিন্তু উত্তর জানা নেই কারোর। বেশ কিছু নতুন নতুন শব্দের সাথে আলাপ পরিচয় জমে উঠেছে এই কয় মাসে । স্যানিটাইজ , কোয়ারেন্টাইন , হোম আইসোলেসন , অ্যসিম্টমেটিক , লকডাউন , আনলক ওয়ান/ টু/থ্রি /ফোর , ওয়ার্ক ফ্রম হোম , অনলাইন ক্লাস, ওয়েবিনার , নিও নর্মাল ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে নিজেকে, পোশাক পরিচ্ছদকে , বাইরের ব্যবহার্য সামগ্রী কে , কাঁচা বাজারকে, প্যাকেটজাত দ্রব্য কে .... অর্থাৎ সব কিছুকেই আপাদমস্তক পরিস্কার করার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে কাঁচা সব্জিকে শুধুমাত্র জল দিয়েই ভালো ভাবে পরিস্কার করা স্বাস্থ্যসম্মত। সাবান জলে খাবার সামগ্রী কখনোই পরিস্কার করা উচিত নয়। এর ফলাফল মারাত্মক । এখন কিছু না হলেও ভবিষ্যতে কি হবে বলা মুশকিল। সাবান বা ডিটারজেন্ট কোনো ভাবেই শরীরের ভিতরে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

সব কিছু এখন অনেকটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শুরুর দিকের , কি যে করি ভাবটা খানিকটা হলেও বদলে গেছে। আমরা যে অভ্যাসের দাস , তা যেন আরো একবার নতুন ধারায় , নতুন ভাবে প্রমাণিত হলো ।

মাস্ক

এবার আসি মুখোস বা মাস্কের কথায়। আমাদের বর্তমান জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি সামগ্রী। সঠিক মাস্ক কোনটা , সেটা নিয়ে একটা সংশয় আছেই। আর তার ব্যবহারের পদ্ধতি নিয়েও গোলযোগের শেষ নেই।যে যেটি ব্যবহার করছেন, তার কাছে সেটাই সঠিক মাস্ক। সর্বক্ষেত্রে কিন্তু সেটা সঠিক নয়। তাহলে ??? উপায় কি ? উপায় নিশ্চয়ই আছে। সাধারণ বুদ্ধিতে একটা বিষয় সকলেই জানি, সার্জিক্যাল মাস্কের ব্যবহার হয় , যে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে , বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারে। যেখানে নানা ধরনের সংক্রমণ রোধের প্রয়োজনেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে দিনের পর দিন , বছরের পর বছর । এই ব্যবহার মোটেই হাল আমলের নতুন সংযোজন নয়। কাজেই এর ব্যবহার অনেকটাই নিশ্চয়তা দিতে পারে। তবুও কেন পুরোপুরি নিশ্চিত নয় ? এবার আসছি সেই কথায়। যে কোনো সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতার একটা সময় নির্ধারিত করা আছে। তারপরে তার ব্যবহার, অব্যবহারেরই সামিল । আর এই সার্জিক্যাল মাস্ক যদি ধোয়া হয়, তাহলে তার পোরস্ গুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলে নতুন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। না হলে সেটি শুধুমাত্র ডাস্টগার্ডে পরিণত হবে। প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। নানা ধরনের মাস্কের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করা উচিত। যেমন ভেন্ট যুক্ত মাস্ক প্রথম দিকে ব্যবহার করা হলেও, এখন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অনেকেই N-95 মাস্ক ব্যবহার করছেন। এটির ব্যবহারের কিছু নির্দেশাবলি আছে । সেই মতনই ব্যবহার করা উচিত। চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মী ,এছাড়াও প্রধাণত যারা সরাসরি এই কোভিড ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সাথে যুক্ত তাদের এই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, সাথে অন্যান্য সাজসরঞ্জাম। তবে আমরাও অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে N-95 মাস্ক ব্যবহার করছি। সঠিক সাবধানতা সব সময়ই প্রয়োজন। 

চিকিৎসা কেন্দ্রের সাবধানতা অবলম্বন যেমন জরুরি, বাইরের দুনিয়াতে অবস্থান কালে সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি । কেন ? কারণ বাইরের বিপদটা পুরোপুরি আমাদের অজানা। চিকিৎসা কেন্দ্রের বিপদের অস্তিত্ব আমাদের জানা বিষয়। তাই সেখানে দুপক্ষের সাবধানতা অবলম্বন, সতর্কতা অনেকটাই রক্ষাকবচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় । কিন্তু বাইরের পরিবেশ আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। সেখানে বিপদের আশঙ্কা থাকতেও পারে , আবার না থাকতেও পারে । কিন্তু সেটাই বেশি ভয়ের । তাই যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন অবশ্যই জরুরি। 

পোশাকের সাথে ম্যাচ করে মাস্ক পরা কতোটা সঠিক, সেটাও জানা জরুরি। তেমন মনে করলে সঠিক মাস্কের ওপর ডিজাইনার মাস্ক বা ডাস্টগার্ড পরা যেতেই পারে , যদিও ব্যাপারটা বেশ কষ্টসাধ্য হবে। এছাড়া এক টানা মাস্ক পরা বেশ দমবন্ধকর। কিন্তু বিপদ বড়ই বালাই। তবে , নিঃশ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। দুটোই সমান দরকারি । নিরুপায় হয়ে আমাদের মুখ , নাক ঢাকতে হচ্ছে। তাই মাঝেমধ্যে ঢাকা সরিয়ে, একটু স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচল করতে দেওয়াও খুব দরকারি, তবে অবশ্যই পরিবেশ, পরিস্থিতি বিচার করে। 

জর্জরিত আমরা 

জ্বর নিয়েও চলেছে বিস্তর চাপানউতোর । প্রথমত জ্বর হলেই যেমন সেটা কোভিড আক্রান্ত ধরে নেওয়া অযৌক্তিক , তেমনই বেঠিক "আমার জ্বর কোভিড নয়" এই ধরনের গা জোয়ারি ভাবনা। যে কোনো জ্বরের কিছু সাধারণ লক্ষণ থাকে , কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বরের ও সে সব লক্ষণ থাকে , এছাড়াও তার আরো বেশ কিছু উপসর্গ আছে। যে গুলো আমরা এখন কিছুটা জেনেছি নানা বিশ্বস্ত সূত্রে। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর সেরে যাওয়ার পরও উপসর্গ রয়ে যাচ্ছে বা নতুন করে দেখা দিচ্ছে। এখন কথা হলো এই ভয়াবহ জ্বরের গতি প্রকৃতি বোঝা সত্যিই খুব কঠিন। কাকে কাবু করবে আর কে একে হারিয়ে নিজে জিতে ফিরবে এ কেউ বলতে পারছে না। কাজেই জ্বর হলেই ঘাবড়ে গেলে চলবে না। যা যা করণীয় তা করতে হবে। করণীয় বলতেই কোভিড পরীক্ষা নয়। তবে যদি প্রয়োজন হয়, চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করতে হবে বৈকি। আবার পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে , নিজের ও সঙ্গের সবার কথা ভেবে পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা আমরা নিজের পছন্দসই বিষয় শুনতে , ভাবতে ভালোবাসি। একজন ব্যক্তির পরীক্ষার ফল যদি দুই জায়গায় দুরকম আসে , আমরা তার থেকে পছন্দমত ফলাফল বেছে নিই । এক্ষেত্রে ভুল কোনটা যাচাই করা যখন মুশকিল, তখন আবারও পরীক্ষা করা যে জরুরি সেটা বুঝতে চাই না। ভুল যে হয় না , সেটা একদমই সঠিক নয় । কিন্তু ফলভোগকারি যে , তাকে তো নিজের ভালোর জন্য কিছু করতে হবেই। এরপরও যে তীরে এসে তরী ডুববে না , তাই বা কে বলবে ? এই গোলমেলে অসুখে সবকিছুই যেন হাতের বাইরে।  

বার বার পরীক্ষা, স্যানিটাইজ পদ্ধতি ভালো রকম ব্যয়বহুল। সরকারি পরিষেবাতে খরচ কম , কিন্তু সেই পরিষেবা গ্রহণে আগ্রহী কজন ? নেহাৎ নিরূপায় যারা , তারা ছাড়া !!! 

যে যে জ্বর আপন নিয়মে সেরে যাচ্ছে, তার সবগুলোই যে নির্দোষ সাধারণ জ্বর এমন ভাবা বোধহয় ঠিক নয়। কারণ পরীক্ষা ছাড়া কোনটা কি ধরনের জ্বর ছিল তা জানার উপায় নেই। এই ভাইরাসের প্রকার ভিন্ন ভিন্ন। কোন প্রকার কার শরীরে কি খেলা দেখাবে তা বলা বা বোঝা মুশকিল। কাজেই কেউ কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই যদি ভাবতে থাকে , ওটা কোভিড ছিলোই না, ভাইরাল জ্বর .... সেই ভাবনায় কিন্তু কিছু ভয় , কিছু সংশয় থেকেই যাচ্ছে । কি করে ? তার আশপাশে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে যদি সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিয়ে বসে ? এক্ষেত্রে করণীয় বিষয় একটাই যদি জ্বর খারাপ দিকে না গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে রোগী , যার কোনো রকম উপসর্গও নেই , কাজেই প্রশ্ন ওঠেনি পরীক্ষা করার , সে যেন অবশ্যই আশেপাশের সবার কথা ভেবে নিজেকে কদিন একটু আলাদা রাখে । এই অতিমারির পরিবেশে না পারা কতকিছুই তো করলাম, শিখলাম .... নিজের আপনজনের জন্য , পড়সিদের ভালোর জন্য এটুকু কি করতে পারবো না ??? হয়তো তার সাধারণ ভাইরাল ফিভারই হয়েছিল ।কিন্তু কথায় বলে সাবধানের মার নেই। কাজে কাজেই। 

সাবধানতা আরো

এই বিপদ কাটিয়ে যারা আবারও আমাদের মধ্যে ফিরেছেন , তাদের জবানিতে জেনেছি , ফেরার পরবর্তীকালের সাবধানতার কড়াকড়ি। কারণ শরীরের ভেতরে এই ভাইরাস যে ভয়াবহ পরিমান ক্ষয়ক্ষতি করে দেয়, তার থেকে আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগে অনেক , চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়। নিজের কাছের মানুষ জনের কষ্টকে দীর্ঘায়িত করার থেকে , নিয়ম মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়। 

আক্রান্ত ব্যক্তি যারা চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হচ্ছেন, ট্রিটমেন্টের পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর, প্রথমবার জ্বর হওয়ার ৪২ দিনের মধ্যে পুনরায় পরীক্ষা করলে আবারও পজিটিভ রিপোর্ট আসতেই পারে। যদিও তখন ভাইরাস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সব সময় এই রিপোর্ট যে পজিটিভ আসবে ,এমনও নয়, তবে বাড়ি ফেরার পর অথবা যারা বাড়িতে থেকেই সুস্থ হলেন সাবধানতার মাত্রা বেড়ে যাবে আরো অনেক বেশি । এই ভাইরাস ভয়ঙ্কর রকমের গোলমেলে ।ওই কারণেই সমস্ত পৃথিবী আজ দিশাহারা। 

নিয়ম মেনে সাবধানে চলার সঙ্গে সঙ্গে, পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাবার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি আর অতি অবশ্যই রুটিনমাফিক যোগব্যায়াম করতে হবে। ইমিউনিটি বর্ধনকারী হোমিওপ্যাথি অথবা এলোপ্যাথি ওষুধ যদি খেতে হয় অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে তা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ।

বিচার বিশ্লেষণ

একটা কথা খুব শুনছি .... এ বড়লোকদের অসুখ। যারা বস্তিবাসী তাদের হবেই না । কথাটা আংশিক সত্য, কিন্তু পুরোপুরি নয়। একটু তলিয়ে ভাবলেই গলদ কোথায় বুঝতে অসুবিধা নেই। আমরা অনেকেই অতি সাবধানী , তার থেকেও আরো এগিয়ে সাবধানী নিজের প্রিয় জনের প্রতি , সন্তানের প্রতি। সব সময় পক্ষী মাতার মতন আগলে চলেছি । ফল অতি বিষম । অল্পেই আমরা কাতর। সহ্য ক্ষমতা কমতে কমতে , কোথায় যে তা নেমেছে !! তা নিজেরাও জানি না । পক্ষীমাতাও এক সময় তার সন্তানদের খোলা আকাশে উড়তে শিখিয়ে , ছেড়ে দেয়। আমরা অনেকেই পারি না ছাড়তে। এর ফলে শারীরিক , মানসিক সব রকমের সহ্য ক্ষমতায় আমাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। রোগ বাসা বাঁধে সহজেই। কোন কিছুতেই লড়াই করার আগেই হেরে যাই। কিন্তু যারা জন্ম থেকেই প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ছে, তাদের শারীরিক ও মানসিক সহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি। আর সেখানেই এই মারণ ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হলেও, তারা অনেকেই অ্যসিম্টমেটিক হয়ে , নিজের অজান্তেই সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে। এক সময় স্বাভাবিক নিয়মে ভাইরাসও নিষ্ক্রিয় হয়ে তার সব রকম কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ততদিনে আরো অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো অ্যসিম্টমেটিক রয়েছে, আবার কেউ বা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

এই পরিস্থিতির পুরোপুরি উপশম করা বোধহয় সম্ভব নয়। কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমনটা চিরদিন হয়ে এসেছে, তার খোলনলচে বদলানো যায় না , তবে মাঝামাঝি কোন একটা পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা হয়তো করা যায়। বাকিটা সময় আর ভাগ্য। এখন মনে হতে পারে সবই যদি ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাহলে এতো মত , পথের দরকার কি? যেমন চলেছে চলতে দিলেই তো হয় !!! কিন্তু তা যে সঠিক ভাবনা নয় , আমাদের তা জানা। 

এরপর আরো রয়েছে নানা ধরনের গুজবের ছড়িয়ে পড়া। যা এই ভাইরাসের মতনই সংক্রামক। অতিরিক্ত গরমে এই ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হবে.....এই প্রথম গুজব যে সর্বৈব ভুল ছিল , তা জেনেছি যথা সময়ে। ফ্রিজ নাকি এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর .... সে ভাবনাও সঠিক নয়। ভাইরাসের বাতাসে ভেসে বেড়ানো নিয়েও রয়েছে নানা মুনির নানা মত । এছাড়া রয়েছে বাজারে ভ্যাকসিন আসা নিয়ে নানারকম প্রচার। যে কোনো নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও নানা ধাপ পেরিয়ে তা বাজারে আসার প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘমেয়াদি। পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে এগিয়ে আনা কি আদেও সম্ভব ? 

শেষ নয়

এখানে একটা কথাই বলার , যে , এই জগতে কিছু নিত্য ঘটনা ছাড়া সব কিছুই অনিশ্চিত, তা জানা সত্ত্বেও এতো কিছুর আয়োজন তো আবহমান কাল থেকে চলে আসছেই। কোন কিছুর জন্যই জীবন থামে না, জগত থামে না । এগিয়ে যেতেই হয়। একদিন সব শেষ হবে জানি সবাই .... কিন্তু তা বলে শুরুর কথা ভাববো না তা কি হয় ??  

   আজ বেশ অনেকদিন হয়ে গেল , লকডাউন চলছে । আমরা অনেক কিছুই শিখলাম , জানলাম , স্বনির্ভর হলাম। যে কোন বিষয়ের দুরকম দিক থাকে-ই , এখানে-ও কোনো ব্যতিক্রম নেই। নেতিবাচক দিক সত্যিই ভয়ঙ্কর ও তার ব্যপ্তি বিশ্বজনীন। ইতিবাচক দিক-ও আছে । আমরা তা বুঝতে পারছি, কিন্তু মন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আতঙ্ক, তাই ইতিবাচক দিকের প্রভাব বিস্তার সুদূরপ্রসারী হচ্ছে না।

আপেক্ষিক ভাবে আমরা বেশ অসুবিধায় থাকলেও , এখন অনেকটাই ধাতস্ত হয়েছি। কষ্ট কি হচ্ছে না ? নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। অগত্যা। অনেকেই এখন নিরূপায় হয়ে সহকারিনী ডেকে নিয়েছেন।আমরা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক, আর ক'দিন টানতে পারি !!! 

তবে এই সুযোগে নতুন করে প্রকৃতি কে চিনলাম, জানলাম। দেখলাম যে , সে প্রতিদিন প্রাণে আসে নব নব রূপে। মন , প্রাণ ভরিয়ে দেয়। জীব জগতের উচ্ছাস দেখলাম মানুষ বাদে অন্যদের মধ্যে। কলকাকলিতে মুখরিত সকাল। তাদের ঘরে ফেরার গান আবার শুনি গোধূলি বেলায়। মাঝের সময়ে-ও তারা চারদিকে তাদের উপস্থিতি জানান দেয় নানাভাবে।ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া টিয়া, বক আরো নাম না জানা কতো শতো পাখি। 

নতুন ভাবে যোগাযোগ হলো পুরোনো সকলের সাথে, আলাপচারিতায় নতুন সম্পর্কের স্থাপনা-ও হলো। সকলে নিজের ছাড়াও আর সকলের খবর নিলাম। পুরোনো ফোন নম্বর খুঁজে , ডায়াল করা হোলো কতো ক্ষীণ হয়ে আসা যোগাযোগের উৎসে। নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালো লাগার বিষয়কে ফিরে দেখলাম।পুরোনো সেই কৈশোর, কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক ভেসে এলো কোন সুদূর হতে ? 

না পারা বিষয় ও কম পারা বিষয় কিছু টা হলেও আয়ত্তে এলো । আমার ক্ষেত্রে অনেকটা-ই আয়ত্তে এলো রুটি তৈরি, জীবনে প্রথম থোড় কাটলাম ( দেখলাম কঠিন নয় একদমই ) , এ্যঁচোড় কাটলাম ( এটা একটু মুশকিলের , কিন্তু it's ok ) । ইচ্ছে আর চেষ্টা থাকলে বোধহয় অনেকটাই এগোনো যায়।

এখন শুনছি সবার কাছে, এই বিপদ নিয়েই পথ চলতে হবে। সে কথা আভাসে ইঙ্গিতে বেশ কিছু দিন ই পাচ্ছিলাম... যখন কম না হয়ে বেড়েই চলেছিল ভাইরাসের আক্রমণ । এখন আমাদের হাতে আছে শুধুমাত্র সাবধানতা অবলম্বন । তাকে পাথেয় করা সহজ নয় ঠিক‌ই , কিন্তু তাকে নিয়ে-ই আমাদের চলতে হবেই, উপায় যখন নেই । যা যা বারণ তা না করে , যা করণীয় তা করে জীবনযাপনের অভ্যাস করতে হবে। পরিচিত অনেককেই দেখেছি , সর্বক্ষণ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকতে । আতঙ্ক নিয়ে সব সময় আলোচনা কিন্তু খুব ক্ষতিকর নিজের জন্য তো বটেই । আসেপাশের মানুষ জনের জন্য-ও বটে। তাই চোখ খুলে রেখে, সাবধানতা অবলম্বন করে পথ চলতে হবে। আর আমরা অভ্যাসের দাস। ঠিক এগিয়ে যেতে পারবো। অনেককেই হারালাম আমরা, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, এগিয়ে চলেছে। অনেক অসুবিধা সত্ত্বে-ও জানি আমাদের অনেকের থেকে আরো অনেক সমস্যায় রয়েছেন বহু মানুষ .... । 

কোনো অসুবিধায় ভেঙে পড়লে, মা সব সময় বলতেন আরো খারাপ পরিস্থিতিতে যারা আছেন, তাদের কথা। সত্যি বলতে কি মনে বল পেতাম। এখন মা আর সাহস যোগাতে পাশে নেই,..... "সময় তো থাকবে না গো মা, কেবলমাত্র কথা রবে"..... খুব সত্যি কথা । সেই সময় না থাকলেও, কথা রয়েছে ... তা সাহস যোগায় এখনো। 

এক আত্মীয় , একদিন এখানেই লিখেছিলেন, খুব আনন্দে আছিস ... এর উত্তর হ্যাঁ-বাচক ও , আবার না-বাচক ও । ভালো আছি অনেকের থেকে আর আনন্দে নেই , কারণ চিন্তামণি কাছে ই রয়েছে। খুব কাছের যারা তাদের কাছে বলে একটু হালকা হ‌ওয়া যায়। এই আর কি !!!! সে চিন্তা আমার নিজের কাছেই থাক না। চিন্তা ছড়িয়ে কি কোন লাভ আছে ? আনন্দ ছড়ালে , তা যদি একটু-ও ছড়িয়ে পড়ে ক্ষতি কি ? 

#আমরাকরবজয়নিশ্চয়


@শুচিস্মিতা ভদ্র

 গরমের সব্জি বাহার


আমাদের দেশে ছয় ঋতুর ভাগ যোগ যাই থাকুক না কেন , মোটামুটি তিন ধরনের আবহাওয়ার আবেদনই প্রবল । আর তা নিয়েই চলে আমাদের নানা নিবেদন । তো সেই তিন মূর্তি হলেন গলদ ঘর্ম গরমকাল , ঝমঝমে-ছিটেফোঁটা বর্ষাকাল আর সোনা রোদ আর লেপের ওম মাখানো শীতকাল। 

      শীতকালীন সব্জির রকম বাহারের পর গরমকালের সব্জি নিতান্তই ঝিম ধরা ধরনের। শীতকালীন সব্জির কথায় চোখের সামনে সারি সারি রঙীন সব্জির ছবি ভেসে ওঠে , সেখানে গরমের সব্জি একদমই সংখ্যালঘু দলের । কিছু কিছু আইটেম কমন পড়লেও , শীতকালের উপস্থাপনা আর গরমের উপস্থাপনার বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতন । গরমকালের সব্জির নামও বিশেষ সুবিধের নয় । ঝিঙে , পটল , ঢ্যাড়স গরমের বাজারের হিট আইটেম, কিন্তু হট্ ফেভারিট কি ?? আসলে নামই হট হ‌ওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় !!!! পটল ব্যাপারটার নামে না যাওয়াই ভালো , কেমন একটা পটল তুলেছি এমন ফিলিং হয়। তবে হাল্কা ঝোল , তেল গরগরে রান্নায় পটলের নাম ডাক মোটের ওপর ভালই। 

  বিয়ের পর আমার নতুন ঠিকানায় আসার পর , বাবা বললেন যে পটল দিয়ে ডালনা ছাড়া কি বা এমন হয় ?? হয় কিন্তু !!!! আর সে সব খেলে পটল তুলছি , এমনও মনে হয় না । আমার মা , নিজের পরিচিত দেশোয়ালি রান্না ছাড়াও যখন তখন যে কারো কাছ থেকে নতুন রান্না শিখে , তার সাথে নিজের পছন্দের আরো কিছু যোগ বিয়োগ করে , একটা দারুণ ব্যাপার বানিয়ে ফেলতেন । আর তখন সেই আটপৌরে রান্নার পদোন্নতি ঘটে যেত । 

         তো কথা হচ্ছে পটল নিয়ে , পটল চেরা চোখের যেমন কদর , পটলের আদরও নেহাত কম নয় । আর সত্যিই নামে কি বা এসে যায় বলো তো ?? পটল ভাজা যেমন মাঝখান চিরে হয় , আমাদের জেঠিমণির( জেঠিশ্বাশুড়ি) থেকে একটু আর্টিস্টিক ভাবে পটল কাটা শিখেছিলাম ভাজার জন্য। গোটা পটলের খোসা অল্প অল্প কেটে দুই পাশ থেকে তেরছা করে কাটতে হবে , একটু গ্যাপ রেখে রেখে , অথচ পটল থাকবে গোটা , লালচে করে ভাজার পর পুরু পাতার মতন দেখাবে । কি দারুণ না ??? এছাড়াও পটল পোস্ত , পটলের তেল ঝাল , নারকেল পটল , দৈ পটল , পটলের নিরামিষ দোলমা , পটলের আমিষ দোলমা , পটল আলু দিয়ে হাল্কা কালো জিরে ফোড়নের ঝোল , পটল আলুর গামাখা চচ্চড়ি , গামাখানো ডাল(মুগ)পটল , সরষে পটল , পোনা মাছের ঝোলেও পটল দেওয়ার চল্ আছে আমাদের (কালো জিরে /সাদা জিরে উভয়েই)ইত্যাদি প্রভৃতি । 

      শীত চলে যাওয়ার মুখে এদের নাম যাই হোক না কেন ? দাম কিন্তু মোটেই ফেলনা না । আর যারা দামেই দাম দেন বা দম দেন তারা এই সময়েই বাজারের ব্যাগ বাগিয়ে এদের ব্যাগস্থ করে ফেলেন। কারণ আসল সময়ে তাদের লিস্টিতে তখন শীতকালীন মূল্যবান সব্জির লাইন !!! আমি সময় মতন আর পকেট বুঝে বাজারে বিশ্বাসী ।আরও একটা বিষয়ে বিশেষ নজর রাখি .... সময়ের সব্জির স্বাদ অসময়ে যে মাইনাস হয়ে যায় , সেটা মানি । যদিও সারা বছরই এখন সব সব্জি পাওয়া যায় !!! তবে এই গরমের সব্জি দিয়ে সুক্তো , তেতো , সজনে ডাটা-কুমড়ো-লালআলুর কম্বিনেশন ,ঝিঙে পোস্ত, ঢ্যাড়স ভাজা , ঢ্যাড়স-কুমড়োর চচ্চড়ি , সর্ষে ঢ্যাড়স, কাঁচা আমের টক ... আহা !!! শুনেই মন আর পেট কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । কাঁচাপোস্ত বাটা পেট ঠাণ্ডা করে আর তা কাঁচা লঙ্কা ও সর্ষের তেল দিয়ে মেখে নিলে তো মনও ঠাণ্ডা !!! তাই না বলো ??? আরো আছে বিস্তর !!! 

   তবে আমরা যারা ভোজনরসিক, তারা কি শীত , কি গ্রীষ্ম , কি বর্ষা .... যাই হোক , যেমনই হোক খাবারের উপকরণ পেলেই হলো , উপকরণকে উপাদেয় করে নেবার দায়িত্ব নিতে ভয় পাই না । উপকরণ অল্প হলেও ক্ষতি নেই , তা নিয়েও গল্প লিখে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই কো । পেট কা সাওয়াল হ্যায় না ??? খাবার জন্যই তো অনেক কিছু ... সবটা নয় নাই হোলো । কি বলো তোমরা ????