Sunday, 17 August 2025

স্টোন ম্যান

 ECG করতে গিয়েই সিস্টার যখন বললেন ... " স্যার আপনি কি স্ট্রেস করছেন ?" ডাক্তার বাবু দন্তবিকশিত করে বললেন ... " কৈ না তো !!!! " এদিকে অর্ধাঙ্গিনী র তখন সঙ্গীন অবস্থা। ভীতিজনক অবস্থান যার সর্বাঙ্গ জুড়ে তার কাছে এ সব ভারি ভয়ানক ব্যাপার। এদিকে বিকশিত দন্তের মালিকের হস্তগত রিপোর্ট বলছে যে তিনি স্টোন ম্যান। 

চিন্তামণি হয়ে আকুল হলাম ... তিনি  হাসলেন !!! ঘরে জড়াজড়ি ও আকুলতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে তিনি কলেজকে জড়ানোর নির্দেশ দিলেন। ভাবনা কমলো খানিক।  আমার পরিচিত সকলের অভিজ্ঞতার হাত ধরে জানলাম ... ভয়ের কিছু নাই । ছোট অপারেশন। ঘরে বলতেই খেলা গেল ঘুরে ... কে বলেছে ??? কন্যার কাছে এক সংবাদদাতার নাম শুনে পিতাশ্রী গম্ভীর হলেন। 

কটা দিন চলে গেল ভয় ভীতি ছাড়া ... একদিন কইলেন ... " সব বুঝে নাও কেমন ?" 

ভাবনা হাজির। দুয়ারে ভাবনা ... এ আবার কেমন কথা ?? হাঁকপাক করতে করতে কলেজ গেলাম। সকলে এক বাক্যে কইল ... নিজ্জস ভয় দেখাচ্ছে। শুধু কলেজ নয় আরো খান কতক বন্ধুগণ বললে ... একটু যদি চিন্তিত না হও, চলে ??? ডাক্তার বাবু চিন্তিত করে তোমাকে মাপছেন!!! 

এদিকে সব কিছু ই অজানা। যা জানতে চাই উওর ধরি মাছ না ছুঁই পানি। কি করি। আমার সহকর্মী মধুপর্ণা বলেই ফেলল ... এ কি অপারেশন নাকি সসপেন্স থ্রিলার ?? চিন্তা তখন চরমে ... পুপের পরীক্ষা নামক চিন্তা তখন নেহাতই পানসে !!! 

হেনকালে পরীক্ষার শেষ আর অপারেশন দিন আগত। এক ব্যাটেলীয়ান হাজির ভর্তির কিছু পরেই। আত্মীয় ও বন্ধুগণ ছত্রাকারে চারদিকে ... নার্সিংহোম কতৃপক্ষ ভিরমী প্রাপ্ত। তবে এ কিছুই না। আমি বিয়ের কিছু পরেই এমন দেখেছি , তবে সেখানে দল ছিল আরো হৃষ্টপুষ্ট। 

অপারেশন শেষে আমার আর দাদার অবস্থান পুরো অর্জুন আর কর্ণের মতন ... পুরো মহাভারত সদৃশ। কিন্তুক.... এ কি ... " মেয়েকে দেখো "  বলে কেঁদে আকুল , ফোলা গাল ফুলে টোপা কূল !!! এদিকে কাঁদুনি তকমাধারী আমি ডাক ছেড়ে সমবেত কান্না ধরে ফেলেছি তখন। আত্মীয় বন্ধু সামলে ধরল । 

এক বুদ্ধিমান  কইলেন ... মন খারাপ করো না , অভিমানও কোরো না , সামনে তুমি , তোমাকে দেখাই যাচ্ছে তাই মেয়েকে দেখো কয়েছে , কেউ কইল ...অপারেশনের ব্যথায় এ কাঁদন ।একজন খানিক অর্থপূর্ণ কথা কইল...অ্যানাসথেসিয়ার প্রভাব কমে আরো খানিক পরে !!! এ কাঁদন তেমন কাঁদন না।সব শুনে আমার এক ছোট্ট কালের বান্ধবী বললে ... "তুই এতজনকে বলিস কেন ?  "

আমি বাপু চেপেচূপে রাখতে পারিনা। সকলে থাকলে ভিতরের ভীতিজনক কান্না সামাতে সুবিধা হয় বাপু।

সব মিটিয়ে কাল ঘরে ফিরেছি তাকে নিয়ে। ঘরে ফিরে নিভৃতে জিগালাম..." সত্যি করে বলো !!! চিন্তা কিছু হচ্ছিল তোমার ?? " 

বললে ... " ছুরি কাঁচির নিচে সবার ভয় করে। অসংখ্য গলব্লাডার স্টোন অপারেশন করেছি তাই কি কি আপদ বিপদ হতে পারে অপারেশন শুরু হলে তা আমার জানা । তাতেই চিন্তিত ছিলাম। যতই অন্য সব রিপোর্ট স্বাভাবিক থাক । আমরা যে কোন অপারেশনে কত চিন্তিত থাকি আম আদমির বোঝা অসম্ভব। যে কোন অপারেশন যে কোন দিকে টার্ন নিতে পারে .... "   বেশি জানা যে ভাল না , ফের বুঝলাম। আর তাই বলি সবজান্তা না হলেই শান্তি মেলে। 

যদিও শান্ত হলাম সত্যিই কাল ঘরে ফিরে .... ভাগ্যিস কি কি হতে পারে আমাকে বলেনি 🙏🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻

বাধ্যতামূলক বাধ্যতা ?

 এক এক জগতের এক এক ধরন ধারণ । হাসপাতাল বলো কায়দা করে নার্সিং হোম ( বেসরকারি হাসপাতাল) বলো সে জগতের সাথে পরিচয় আমার দু ভাবেই বেশ পাকাপোক্ত। বৈবাহিক সূত্রে এ সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে ভাগেই মা কে নিয়ে চিকিৎসালয়ে যাতায়াতের হাতেখড়ি হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি এলেন ‌‌.... তখন তিনি ছাত্র। শিশুমঙ্গলের আবাসিক। DNB পাঠরত। ছাত্রাবাস থেকে সপ্তাহান্তে আসতেন , বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহরে তা দিতাম । মনের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিখ্যাত গান বাজতে থাকত। একদম appropriate গান ... এসো এসো এসো প্রিয়, এসো আমার ঘরে ‌... 😃

এরপর গঙ্গা য় অনেক জল বয়ে গেল ... দূর থেকে নার্সিং হোম কে দেখতে দেখতে পুপের আগমনের মাস দুয়েক আগে এক সমস্যা র জন্য observation এ গেলাম। একদিন শুয়ে , বসে লেজ নাড়িয়ে চলে এলাম । পরের বার তো পুপে দেবীর আগমন উপলক্ষ্যে হাজিরা ... বিস্তারিত জ্ঞান বোঝাই হয়ে ছানা কোলে ঘরে ফিরলাম। নার্সিং হোম এর ধরন দেখার মতন শরীর ও মন তখন নেই। ঘুম পূরণ হতে না হতেই কখনো গোলাপী তো কখনো সবুজ তো কখনো নীল পোঁটলা করে পুপেকে আমার কাছে দিয়ে যেতো নার্সারি র সিস্টার। বিকেল থেকে সবাই আসতেন দেখতে ... বেশ দর্শনীয় ব্যাপার তখন !!! 

নার্সিং হোম এর সাথে ভাল করে পরিচয় হল ‌‌... পুপের ডেঙ্গু, ভাইরাল ফিভার সহ আমার ও পুপের food poisoning এর সুবাদে।

আমার গল্প আগের , পুপের food poisoning এর গল্প একদম garden fresh টাটকা ... 

জ্বর সাধারণ হোক কি অসাধারণ হোক ছোট্ট পুপে তাকে বেশ ঘোরালো করেই ছাড়ত ... চিকিৎসকের মেয়ে বলে কথা !!! বাবাকে একটু বাজিয়ে দেখবে না ?

খাবার সহ জল না খেয়ে জ্বর উপোসী হতো , ফলে ‌হৈ চৈ পড়ে যেত ঘরে বাইরে । এদিক সেদিক থেকে মা কতটা বেকার ( খাওয়াতে পারে না ) শুনে নিয়ে আর নজর লাগার অযৌক্তিক থিয়োরি শুনতে শুনতে চুলে পাক ধরাতে লাগলাম।

পুপে খানিক বুঝদার হ‌ওয়ার পর আমাদের কর্তা গিন্নীর ভয় কাটল। এ বছর মাঝে পালা করে আমরা দুজন আলাদা আলাদা কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হলাম, ভর্তি হলাম।

পুপেই বা বাদ থাকে কেন ? আবার মা কাঠগড়ায় !!! টিফিন কেন টকে গেল ? এক মক্কেল দেখা করতে এসে কন্যার বাবাকে রান্না থুড়ি টিফিনের ব্যপারটা দেখতে বলে গেল। সত্যি দায়িত্ব টা hand over হলে তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাব sure। কিন্তু সে গুড়ে বালি !! 

গরমে টকে যাওয়া টিফিন খেয়ে পুপে ধরাশায়ী। কেন খেলি ? উত্তরে বাবা কাঠগড়ায়। বাবার ভয়ে !!!! 

কখন  বলেছি এমন যে নষ্ট খাবার ফেলা যাবে না ??? এমন বাধ্যতা দেখে আপামর জনতা মুগ্ধ। কি বাধ্য মেয়ে গো তোমার !!! তাই বটে ‌🤣🤣🤣

বাধ্য পুপে এবারে শরীর খারাপ হতেই লিটার দুয়েক ORS খেয়ে ভর্তি হয়ে গেল , সাথে র‌ইলাম আমি। চ্যানেল, ড্রিপ, injectable antibiotic সব চালু হল।  উপযোগী খাবার ওবধি বাধ্য না করতেই খেয়ে বাধ্য মেয়ের তকমাটা বেশ খোলতাই করে ফেলল । পুরাতন সিস্টার দিদিরা অবাক। আমি নির্বাক।

রাতে , সকালে , দুপুরে সিস্টার দিদি দের তোয়াজে মেয়ে তখন আকাশে। দু কান জুড়িয়ে গেল গো ... ভদ্র স্যারের মেয়ে , বোন কি বাধ্য আর শান্ত। কোন সিস্টার দিদি হাতে ষাট ষাট করে injection push করেছে , সে কথা ষাটের বেশি বার শুনে ফেলেছি ঘরে ফিরে। 

রাতে আর সকালে যেন স্টেশন চত্বরের ব্যস্ততা করিডোর জুড়ে। কর্তব্যরত চিকিৎসক গণ তখন তাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে অবস্থান করে। করিডোরে কাজের ফাঁকে গল্প আড্ডা য় মনের আগল তখন তাদের ( সিস্টার)খোলা ... ঘুমের আগে ও ফাঁক গলে ওদের রাতের মজলিসের ( অবশ্যই কাজের মধ্যে র ) টুকরো হাসি টুকরো কথা শুনেছি প্রতিবার । কখনো খেয়ালে তো কখনো বেখেয়ালে। 

ওখানে ভোর হয় অনেক আগে , রুগী ঘুমের দেশে তারা নিরলশ কাজের মাঝে ... সব নিয়মের ঘেরাটোপ বন্দী । 

ফেরার আগে এক সিস্টার বলে গেল পুপেকে , বিকেলের খাবার খেয়ে যাবি কিন্তু। চা খেলাম। টা খেলাম। ঘর তখন হাতছানি দিচ্ছে। ফিরলাম। পুপে সব সময়  বাধ্যতা বজায় রাখুক। সত্যি সত্যিই বাধ্যতা ভরে উঠুক ....

Wednesday, 16 July 2025

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৯

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৯

হতাশ অবসন্ন শরীর মন নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম সকলে। শরীর তখন হা ক্লান্ত। অবসন্ন শরীরে হাল্কা ঘুম দখল নিতে শুরু করল ; কারণ আমরা দীঘা ত্যাগী হয়ে ফেরার সেই সাগর পার দিয়ে পাড়ি জমানোর পথ ধরব ধরব করছি। আলো আঁধারের বুক চিরে নোনা হাওয়ার ঝাপটায় ঘুম আরো চোখের পাতায় আঠা মাখাচ্ছে। হেনকালে ঘুম জাগরণের মাঝে কানে এল চা পান বিরতির কথা ; এবং অত‌এব এক চায়ের ছাউনি র সামনে নেমে পড়লাম একে একে। আমরা দেবা-দেবী ক্ষতিকর দুধ চা , বাকি সব কলরব করে আগা পাশতলা লালা চায়ের গুণ কীর্তন করতে করতে নানান দল নানান চা পান done করলাম। বিয়ের পর খেয়ালে করে দেখেছি ; যে , খাদ্য তালিকায় আমার অপছন্দের খাবার নেহাৎ ই নগন্য । বৈবাহিক জীবন তখন নবীন ; খাবারের ভাগযোগ জনিত ‌হৃদয় বিদারক কথা কারে ক‌ই প্রাণসখা ছাড়া ? কি নিষ্ঠুর !!!! খান কতক দিন দুখের কথা নিবেদনের পর বলে কিনা ... " কোন খাবার টা ভালবাসো না বলো দেখি ? কোনটা কিঞ্চিৎকর হলেও মনে দুঃখের বাণ ডাকবে না ? " তো এখন আমি এত বছরে একদম লিস্টি করে ফেলেছি ‌.... কি কি খেতে মোটেও ভালবাসি না । এখন চোখ বুজে বলে দিতে পারি ‌... দিন শুরুর হোক বা পরের হোক চা যদি লাল চা হয় ; আমি মোটেও তা খেতে থুড়ি পান করতে ভালবাসি না। তখন out of syllabus এ উত্তর দে‌ওয়ার অভ্যাস একদমই ছিল না। এখনো যে অভ্যাস পোক্ত হয়েছে তার নয় , তবে তাও কিছু টা তো বটেই। আর‌ও কিছু যোগ হয়েছে NSS এর দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে। জায়গাটা শঙ্করপুর। চা পান করে এদিক ওদিক ঘুরে আমরা সকলে একটু সমুদ্র সৈকত পানে নজর ঘোরালাম। 

পাহাড় সমুদ্র দুয়ের বাছ বিচারে আমি পাহাড়কে ভোট দিলেও; পাহাড়ে যাওয়ার বায়নাক্কা অনেক ; তাই হাতের পাঁচ সমুদ্র বিলাসী হয়ে থাকি। তবে এ কথাও ঠিক আমার দু নম্বর পছন্দে সমুদ্র কে রেখেছি । এদিকে র জন পাহাড় কে এক নম্বর দিলেও জঙ্গল তেনার ভারি পছন্দের। জঙ্গল আমার ভারি ছমছমে রহস্যময় লাগে। সর্বোপরি জন মানুষ্যি নেই। নেই কেনা রাম হ‌ওয়ার সুযোগ। আর ওই খানেই তেনার কাছে জঙ্গল প্রিয়তা র বাড় বৃদ্ধি । 

আমরা শঙ্করপুর সৈকতে খানিক বসলাম চুপটি করে। এই চুপ শব্দে ভরপুর। বিশাল ঢেউ এর পাড়ে অবিরাম আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে বিজলী বাতির অনুপস্থিতি কে কল্পনা করতে লাগলাম। জানি যদিও অন্ধকারে কাব্য করার মতন পরিবেশ কোনদিন ছিল না ; এখনো আরও নেই। ভয়ের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি তো নেই !!! অন্ধকার চোখে সয়ে এলে যে তার‌ও এক মায়াবী রুপ আছে তা আমরা ভুলে যাচ্ছি ক্রমশঃ ।

খানিক পরে ফিরতি পথে আমরা রাত ৯টার কাছাকাছি মন্দারমণি ফিরে এলাম। ভয়ানক ক্লান্তি তখন শরীর জুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করছে। আমরা চট জলদি খাবার পর্ব মিটিয়ে ঘরে ফিরে ঘুমের দেশে যেতে তৈরি হলাম। সেদিন রাতে দুই বন্ধুর একসাথে নিদ্রা যাওয়ার কথা। আপত্তি করি নাই। আমাদের এই হোটেলে র ঘরখানা গড়ের মাঠে র সদৃশ আর তা ভরাট করাতে দুখান জোড়া খাট পাতা হয়েছে। দুপুরে ঘরে ঢুকেই দুই সখী প্ল্যান করে ফেলেছিল। এমন ক্ষেত্রে এক ঘরে বাবা - মা না থাকা খুবই বাঞ্ছনীয় ব্যাপার যদিও ; কিন্তু কথায় বলে নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল । তবে মা কে নিয়ে no চাপ !!! মায়ের খেয়াল টা বরাবর কমতি র দিকে ; পুপেকেই অনেক খেয়াল রাখতে হচ্ছে বিস্তর । চিন্তা র বিষয় অবশ্যই পিতাশ্রী। তবে কোড language হ্যায় না ??

হিল্লোল তো দুই দিদির মাঝে মূর্তিমান বিপদ। যাক তাকে বুঝিয়ে দেবাশ্রিতা ওদের ঘরে নিয়ে গেল। আমি সেদিন এতোই হা ক্লান্ত যে শুতে না শুতেই নট নড়নচড়ন। ভোরে আবার মন্দির দর্শন এর মহা যজ্ঞ আছে যে !!! 

ভোরে ঘুম থেকে ওঠা নতুন নয়। উঠে ৫টা তে স্নানের পালা চুকিয়ে আরো খানিকটা পরে বেরিয়ে পড়লাম। ভোর বরাবর ভারি স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে রাখে । কর্তা মশাই 

র‌ইলেন ছানাদের নিয়ে ঘুমের দেশে। একবার বলেছিলাম ... " তোমার দেখা হলো না তো !!! " সেই গাছে তোলা উক্তি পরিবেশিত হল মুচকি হাসি হেসে ... " তোমার দেখা হলেই আমার দেখা । " আগে ডগোমগো হলেও এখন মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লাম। হিল্লোল কে ও তার ডাক্তার জেঠুর জিম্মা করে আমরা বাকিরা দুয়ের বদলে একখান গাড়ি করে চললাম । দেবাশ্রিতাদের গাড়ির চালক রিঙ্কুও সাথে চলল।

সকাল সকাল ফাঁকা পথে হুস করে যেন দীঘা পৌঁছে গেলাম। এখনো জন মানুষ্যি নেই এমন নয়কো মোটেই। তবে আগের সন্ধ্যার নিরিখে সে কিছুই নয়। তবে বেশ ফ্যাচাংযুক্ত এখনো ; কারণ সবটা এখনো গোছানো হয়নি। জুতোর পাহাড় অরক্ষিত, ক্যামেরা সাথে রাখার অনুমতি নেই ; কিন্তু তা জমা রাখার সুবিধা নেই কোন , পদতলে বালির কিরকিরে অনুভূতি । যাক সে সব বাদে এক সুন্দর শৈল্পিক স্থাপত্য দেখে মন ভরে গেল। মন্দির বাহির দর্শন করে গেলাম মন্দিরের অন্দরে। দেখাশোনা শেষে গুটি গুটি বেরিয়ে এলাম। 

ফিরতি পথে দুই বাহন চালকের উৎসাহে আমরা ভেসে গেলাম দীঘা মোহনাতে। মোহনা তে সাগর এসে নদীতে মিশে যায়। দেখলাম মেলাই লোকের ভিড়, দোকান পাটের ভয়ানক ভিড় । নদী কৈ , নদী কৈ করে একসময় দেখা মিলল । তবে ততক্ষণে তোমরা কৈ তুমি কৈ করে ওদিক থেকে কল হাজির। দীঘার মোহনা শুনেই চিড়বিড় করে উঠল খানিকটা সংযত ভঙ্গিতে। শুনলাম , ওদিকের ঘর এখন ঘুম পুরি। 

এবার ফেরত আসার পথ ধরলাম। মন্দারমণিতে আগের বারে আমরা মোহনা তে গিয়েছিলাম । যা বুঝলাম নদী যেখানে সাগরের সাথে কোলাকুলি করেছে তার একপাশে দীঘা আর অপর পাশে মন্দারমণি। ভোরে আর শেষ দুপুরে জল সরে গেলে সমুদ্র সৈকত বরাবর এগিয়ে এলে মোহনা দর্শন দেন। আমরা আগের বার ভোরে টোটো করে মোহনা দেখতে গিয়েছিলাম। টোটো চালক বলেছিল যে জল বাড়লে টোটো চালিয়ে মোহনা পৌঁছানো সম্ভব হবে না । ভারি সুন্দর লেগেছিল, একে ভোর তায় শুধু দুজনায়। ফেরার পথের ভোরের জলছবি ক্যামেরা বন্দি করেছিলাম। এখানে তেমন টার দেখা মিলল না । আমরা এগিয়ে পড়লাম আপাত আবাসের দিকে ; ওদিক থেকে শ্যামের বাঁশি বাজতে শুরু করেছিল ‌‌.... তোমরা কতদূর ? দীঘা মোহনা শুনেই গার্জেনের গর্জনের আভাস পেলাম। চটজলদি হুঁস করে ফিরেও এলাম। সেদিন একটু পরেই ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যাব। ফিরে জলখাবার খেয়ে সব গোছগাছে লেগে পড়লাম। দেবাশ্রিতা আবার জলে চলি চলো বলে ধরে নিতে এসেছিল ... শরীর জোড়া তখন ক্লান্তি !!! সাথে পুরো ফ্রাই হ‌ওয়ার মতন রোদ !!! মাপ চেয়ে ঘরেই র‌ইলাম । ওরা জল ছপাছপ করে জলদি ফিরে এল কারণ আমাদের ফেরার সময় তখন আগত। এরপর সব লটবহর নিয়ে আমরা এগিয়ে পড়লাম; কিন্তু এ ক্ষণেও ওরা আমায় গাড়িতে নিল না ; কিন্তু হিল্লোল আনন্দে র সাথে গাড়িতে সাথে নিল। বেড়ানোর শেষে নতুন পুঁচকে বন্ধু কে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নতুন প্রাপ্তি কি বলো ??? 

@শুচিস্মিতাভদ্র

Friday, 4 July 2025

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৮

 বেড়াতে গিয়ে মজারু ৫৮

সাগর দা র আয় আয় ডাকে তো হাঁটা দিয়ে অনেক খানি পাড়ি দিয়ে তবেই তাকে ছুঁতে পারলাম। কিন্তু তিনি বেশ উত্তপ্ত। কখনো এত দেরি করে সাগরের কাছে আসিনি। উষ্ণতা বাড়িয়ে আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন । এর আগে গরমাগরম রোদের মাঝেও জলে নেমে ভারি আরাম পেয়েছি , এবার মনে হল যেন গা স‌ইয়ে নেওয়া কোন উষ্ণ প্রস্রবণে নেমেছি। এমনিতে পায়ের পাতা ডোবানো জলে যদিও আমি স্বচ্ছন্দ ; বাকি দের উৎপাতে প্রতিবার জলকে চল যেমন হয় , তেমন হয় দূরকে চল । এবার‌ও এক‌ই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও পিছনে বিকেলে দীঘার মন্দির দর্শন নামক হুড়ো চালু ছিল তাই রক্ষে !!!! 

বয়সের সাথে সাথে খানিক খানিক সাহস অর্জন করেছি ; কোলাঘাটের পুলে তার প্রমাণের ছবি জ্বল জ্বল করছে ; কাজেই সখাকে চেপে ধরে খাবি খেতে খেতে নোনা জল খেতে লাগলাম ভরপুর। তবে গরম জলে আরাম নেইকো। জলে জলীয় প্রাণীর বেশির ভাগ তখন হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরাতে মধ্যাহ্ন ভোজনের পরবর্তী ভাতঘুমের আবেশে আবিষ্ট। খানিক নোনতা গরম পানি তে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে বুঝলাম সাগরের ঢেউ জোড়া কাব্য তখন ভয়ানক গরম গদ্যের আকার প্রাপ্ত হয়েছে। আমি গুটি গুটি সাগর পাড়েও না , আবার জলেও না এমন অবস্থানে দেবাশ্রিতাকে নিয়ে জলীয় বালুকা বেলায় থাবা গেঁড়ে বসে পড়লাম। ঢেউ যেখানে আকার প্রাপ্ত হয়ে এগিয়ে ভাঙে তার খানিক দূরে যেখানে ঢেউ এর শক্তি নেহাৎ ই জোলো। এই বিশাল বপুকে নাড়াতে অক্ষম কিন্তু ভেজাতে দস্তুর মতন সক্ষম। তবে জামা কাপড় জুড়ে বস্তা বস্তা বালি জড়ো হল । সে সব নিয়ে হাজির হলাম হোটেলের অন্দরে। সাফ‌ সুতরো হয়ে এবারের গল্প জোড়া পৈটিক সংবাদ। বাঙালি বেড়াতে গেলে যাই খাবার খাক ; সারা দেশেই বাঙালি ঘরের খাবার খুঁজে মরে , আর ঘরের মানুষ হয়ে পরের খাবার নিয়ে রসনা তৃপ্ত করে। পরের খাবারে চীনা , মোঘলাই, দাক্ষিণাত্য, ইংলিশ সহ হরেক রকমের option এর ছড়াছড়ি । "রেখেছ বাঙালি করে " প্রবচণ বলে কি বা করার আছে । আমরাও ভয়ানক চিরন্তনী , পুরাতনী বাঙালি খাবার দিয়ে মন ও পেট ভরিয়ে ঘরমুখী হলাম। কর্তা মশাই মহা সাবধানী !!! ঘুমিয়ে পড়লে মন্দির দর্শন বিশ বাঁও জলে !!! তাই দেবাশ্রিতা সহ কর্তা মশাই ফতোয়া জারি করে ঘরে এলেন .... No ঘুম !!! খাওয়া আর ঘুমের জন্য কি বেড়াতে এসেছি ? একদমই না । তবে ; কিন্তু; পরন্তু সব ঝোলায় তুলে একটু গড়িয়ে বেরনোর জন্য প্রস্তুত হয়ে ৫.৩০ আমরা সবাই আণ্ডা বাচ্চা সহ বেরিয়ে পড়লাম। আসলে হৈচৈ পার্টি হলেও বয়স ব্যাটা যে বেড়েই চলেছে তাই মাঝে মাঝে সে কল কব্জা মারফত খবর দেয় বৈকি। তবে বেড়াতে গেলে মনটা এতো টা ই হাল্কা হয়ে যায় , ক্লান্তি টা ঝপ করে কাটিয়ে দিতে চাপ হয় না। বেরিয়ে আমরা তাজপুরের মেরিন ড্রাইভের পথ ধরতেই ক্লান্তিটা সমুদ্রে র ঢেউ এ চড়ে নাগাল ছাড়া হয়ে গেল। এমন প্রকৃতি র মাঝে আমার খুব গান পায় । তবে সে সব যেখানে প্রকাশ করা সহজ , তিনি আগাগোড়া মেয়ের বাবা হয়ে মেয়ে কে হামলে পড়ে সামলে ধরতে অন্য গাড়ি তে আসীন হয়েছেন। কি বেআক্কেলে বেরসিক হয়েছে বলার নয় !!!  আগে ভাগে বেরিয়ে পড়লে জনতা জনার্দন বলতো ... ভদো ( ভদ্র এর আদুরে ডাক বন্ধু মহলে ) কি রোমান্টিক !!! সে রাম‌ও নেই আর সেই ভদোও ঘুমন্ত। পুরো দস্তুর, আগাপাশতলা বাবা র উদয় হয়েছে । মহা বাবা , দুয়ারে বাবা , বেড়িয়ে বাবা .... বাবা রে বাবা । 

সাগর থেকে আসা নোনা হাওয়া খেতে খেতে তাজপুর পেরিয়ে শঙ্করপুর ধরে ফেলতে ফেলতেই মন বলল , গাড়ি থেকে নেমেই প্রথম তিনি বলবেন ... কেমন দুদিনে সমুদ্র সৈকত বরাবর যা যা ফেলা ছড়া করে আছে সব দেখিয়ে দিলাম । কেমন বুঝছ ?? তবে যে বলো অন্য কথা ??? কথার কারিগরি শুনে না হেঁসে পারিও না । আবার রাগ‌ও হয়। 

এই করতে করতে আঁধার নামা বিজলী বাতি জ্বলা পথে দীঘায় ঢুকে পড়লাম । পড়েই মনে হল ‌‌.... কি সর্বনাশ  !!! এ কি কলকাতায় দূর্গাপূজা তে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি ?

এই অধমের কথা কে আর কবে শুনেছে ? আমার বিদ্যে বুদ্ধি বলেছিল ; জগা দা র নতুন আবাসে জগাখিচুড়ী ভিড় না হয়ে যায় না। বাঙালি চিরকেলে হুজুগ প্রিয়। আমি কি তবে বাঙালি ন‌ইকো ?? আসলে আমি ভিড়ে ভয়ানক ভড়কে যাই তাই ভিড়ে ভিড়ি না এক্কেরে। ভেবেছিনু পরে কোনো একদিন যেয়ে দেখে নেবো ক্ষণ। কলকাতায় পূজোর ভিড়ে ভড়কে গেলেও উপায় নাস্তি। পূজোর সময় একা ছাড়া চাপ জনক । তাই দুজনেই লেগে পড়ি। তবে ছোটকালের এবেলা ওবেলা ঘুরু বেড়ু এখন ইতিহাস। ভোর ভোর মণ্ডপ চষে ক্ষ্যামা দিয়ে কারোর ; নয়কো নিজের ঘরেই ঢুকে পড়ি। 

ভিড় বলে ভিড় !!!! জয় জগন্নাথ !!! ওদিক থেকে তিনি ফোন মারফত নির্দেশ দান করার পর সে মতন গাড়ি ফিরতি পথ ধরে নেওয়া র আগে এক জায়গায় থেমে গেলাম। একদিকে দেবাশ্রিতা অন্য দিকে আমাদের বাহন চালকের তখন মন জোড়া দুঃখ। অভয় দানে হাজির তাদের দাদাভাই , রথের দিনে প্রথম কোর্টসিপ শুরু হয়েছিল আমাদের ; অগাদ বিশ্বাস কর্তা মশাই এর । অভয় দানে তেনার জুড়ি মেলা ভার .... চিন্তা কোরো না , কাল ভোরে সব দর্শন হবে। আর just ভাবো !!! কেমন আড়াই দিনে সব দেখিয়ে দিচ্ছি । এত দুঃখেও দেবাশ্রিতা আমার দিকে চাইল !!! এত বছর তবে কি করলাম ????

@শুচিস্মিতা ভদ্র 

Thursday, 3 July 2025

প্রতিবাদ

                                                                            প্রতিবাদ

                                                                      শুচিস্মিতা ভদ্র

"এখন ঘোর ভাঙেনি তোর যে, মেলেনি তোর আঁখি"- অনেক দিন পর গানটা FMএ শুনে তন্ময় হয়ে গেছিল লালিমা। বাবার বড়ই প্রিয় গান ছিল এটা।সকালে ছোট্ট লালিমাকে ঘুম থেকে জাগানোর পর আধো ঘুমন্ত , আধো জাগন্ত লালিমাকে প্রায় ই কোলে নিয়ে মজা করে ভরাট ও দরাজ গলায় গানটা গেয়ে উঠতেন শীর্ষেন্দু।বাবা আজ নেই, প্রায় বছর ঘুরতে চলল।সময় নদী যে কখন বয়ে গেল ? লালিমা টেরই পেল না।এতগুলো দিন যে কি ভাবে কেটে গেল বাবাকে ছাড়াই , ভাবলে লালিমা, বাবার আদরের লালি অবাক হয়ে যায় ! অথচ এটাই সত্য।দিন চলে যায়, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন স্মৃতির মাঝে থেকে যায়।তাঁকে ছোঁয়া যায় না, আর কাছে পাওয়া-ও যায় না।কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে যেন সন্তানের মধ্যেই নিজের ছাপ রেখে যায়।মা, লালিমাকে চিরকাল বাপসোহাগী বলতেন ।তিনি এখনও লালির কথায়, কাজে নিজের বড় প্রিয় মানুষটার প্রতিরূপ দেখতে পান।

গানটা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই কলিংবেলের যান্ত্রিক শব্দে লালিমার ঘোর সত্যিই ভেঙে যায়।দরজা খুলে দেখে রূপ কে নিয়ে তার বাবা প্রান্তর ফিরেছে।রূপ এখন সবে পাঁচ বছরে পা দিয়েছে।

রাতে রূপকে ঘুম পাড়িয়ে যখন লালিমা স্মার্ট ফোন হাতে নিল, তখনও প্রান্তর শুতে আসেনি। রাতে একটু খবরের কাগজে চোখ বোলায় সে।এ তার বহু বছরের অভ্যাস। ড্রইংরুমের সোফায় বসে খবরের কাগজের সব খুঁটিয়ে পড়াকে যোগ্য সঙ্গত করে, টেলিভিশনে চলতে থাকা কোন না কোন sports channel ।এ নিয়ে আগে লালিমার সাথে বচসা চলত।লালিমার বক্তব্য হলো, যে কোন একটা বিষয়ে মনোনিবেশ করো না কেন? কিন্তু এটাই যে তার ক্লান্তি মুক্তির একমাত্র উপায়, তা বোঝার পর লালিমা আর এ নিয়ে কিছু বলে না।

স্মার্ট ফোনের যুগে বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়।লালিমা, আজ অনেকক্ষণ ধরে তার বাবার প্রিয় গান গুলো খুঁজে বের করে online এ শোনার চেষ্টা করছিল।বিকেলে FM এ গানটা শোনার পর থেকে বাবাকে যেন খুব বেশি করে মনে পড়ছে।গানগুলো শুনতে শুনতে, কখন নিজের অজান্তেই চোখের জলে মাথার বালিশ ভিজে যাচ্ছিল খেয়াল ই , করেনি।হঠাৎ কপালে হালকা হাতের আলতো ছোঁয়ায় তাকিয়ে সে প্রান্তর কে দেখতে পায়।

"কি হয়েছে লালি ? বাবার কথা মনে পড়ছে ?"-প্র্রান্তরে প্রশ্নে লালিমা তাকে আঁকড়ে ধরে, সম্মতি জানায় মাথা নাড়িয়ে।

 রবিবার ছাড়া প্রতি সকালেই লালিমার ব্যস্ততা চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে। চা, জলখাবার, রূপকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা, প্রান্তর আর তার নিজের টিফিন তৈরি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা আর ছেলে ঝড় তুলে বেরিয়ে গেলে আধাঘন্টা একটু কাজের ছুটি মেলে।এই সময় সে একটু খবরের কাগজে চোখ বোলায়। এরপর রান্নার দিদি এসে গেলে তাকে সব বুঝিয়ে , নিজেকে ও বেরনোর জন্য প্রস্তুত হতে হয়।সে আজ বছর সাতেক একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা।

আজ খবরের কাগজের দু দুটো খবরে মনটা সকাল সকাল খারাপ হয়ে গেল।কাগজটা ভাঁজ করে সরিয়ে রাখল লালিমা। কিন্তু খারাপ খবরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও , আদৌ কি তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় ?

একটা ঘটনা, রাজস্থানের কোন এক বাজারে বোমা বিস্ফোরণে শতাধিক প্রাণহানি, জনা তিরিশ আহত, পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিস্ফোরণের কারন অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। বিস্ফোরণের কারন কোন জঙ্গি সংগঠন এখনও স্বীকার করেনি। দ্বিতীয় ঘটনা র স্থান, আমাদের ই শহর, কলকাতা।শিশু কন্যার ওপর পাশবিক অত্যাচার। এই সাতবছরের শিশুটি মানসিক ভারসাম্যহীন।

এ কোন যুগে আমরা বসবাস করছি ? হিংসা, ধর্ষণ, খুন ..... অপরাধ প্রবণতা দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। সকলেরই মনে নানা অসন্তোষ, তার পরিনতি ই কি অবক্ষয়মূখী করে তুলেছে সকলকে ? লালিমার মতো করে এমন কথা প্রতি নিয়ত আমাদের মনে তোলপাড় হয়, কিন্তু এর উত্তর কার কাছে ????

"লালিমা দি আজকের কাগজ পড়েছে ?"-রীমিকার প্রশ্নে, খাতা দেখা না থামিয়ে, লালিমা বলে-"হ্যাঁ রে, দুটো খবর ই দেখলাম সকালে, কাল হয়তো টেলিভিশনে দেখিয়েছে, আমার দেখা হয়নি।"

রীমিকা বলে-"এতো মানুষ মেরে কার কি লাভ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে বলো দেখি ? আর অন্য খবরটা তে যে victim তার কথা ভাবো, এরা সব মানুষ ????"

লালিমা মাথা নাড়ে, বলে-"কি সব যে হচ্ছে চারদিকে, ভালো লাগে না।তোর মেয়ে এবার IV এ উঠল না রে ?"রীমিকার সম্মতিতে লালিমা বলে -" সাবধানে রাখিস।"

"সে তো নজরে রাখি-ই , কিন্তু সর্ষের মধ্যেই তো ভূত লালিমা দি, তুমি নিশ্চিন্ত, তোমার তো ছেলে।"

"না রে ছোটছেলে রাও victim হয়, তবে বলতে পারিস বড়ো হয়ে গেলে অনেকটা নিশ্চিন্ত, আমাদের তো আজীবন সতর্কতার বর্ম পরে ঘুরতে হবে।এই আমরা কি ঘরে, বাইরে নানাবিধ অপ্রীতিকর ঘটনার থেকে রেহাই পেয়েছি বল ? আমাদের অনেকেরই তো বয়স নেহাত কম নয়।"

হঠাৎ ওদের আলোচনায় এসে যোগ দেন, অঙ্কের বয়োজ্যেষ্ঠ, পুরূষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নিবারণ দা, বলেন -" তোমাদের চিনি, জানি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা ও দোষী, সে যাই বলো। আজকাল মেয়েদের হাবভাব, পোশাক পরিচ্ছদ এসবের জন্য অনেকখানি দায়ী।" নিবারণদার কথা শেষ হতে না হতেই ভূগোল এর ঋতুপর্ণা চীৎকার করে ওঠে-" নিবারণদার দা, কে কিভাবে নিজেকে project করবে, সেটা তার personal ব্যাপার।তার মানেই কি সে commodity ?তার সাথে যা ইচ্ছা করার অধিকার জন্মে যায় ? আর কালকের ঘটনাতে কাকে দায়ী করবেন ? অসহায় একটা শিশু তা ও আবার মানসিক ভারসাম্যহীন - সে কি ভাবে দায়ী ?

                         হঠাৎ দেখা যায়, সাম্প্রতিক কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ও সেই ঘটনা গুলো কে কেন্দ্র করে যে সব হিংসাত্মক কার্যাবলি ঘটছে, এছাড়া ও সারা দেশের বর্তমান নানা হিংসাত্মক ঘটনা গুলো নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ দুটো দল তৈরি হয়ে teachers' room এ একটা জোরালো বাদানুবাদ শুরু হয়।আসলে সবে Annual Exam শেষ হয়েছে, তাই এখন ছাত্রছাত্রীদের ছুটি। টিচারদের ছুটি নেই, খাতা দেখা, result out করার নির্ধারিত দিনের আগের মধ্যে report card তৈরি এসব নিয়েই এখন হাল্কা ব্যস্ততা।

                     হঠাৎ হেডমিসট্রেস অনুভাদি ,দরজা ঠেলে teachers' roomএ ঢোকেন।ওনার কাছে এই তর্কবিতর্কের খবর পৌঁছে গেছে অফিসের পিয়ন নন্দের এর মাধ্যমে। নন্দ সব দিকেই আছে।এদিকের খবর ওদিক, ওদিকের খবর এদিক করার জন্য বেশ প্রসিদ্ধ।শিক্ষক, শিক্ষিকা রা যে কোন বিষয় আলোচনার আগে খুব সাবধানে কথা বলে, কিন্তু আজকের আলোচনায়, বিবদমান দুই গোষ্ঠীর কেউই খেয়াল করেনি ! যথারীতি এই আলোচনার খবর পাওয়ার কিছু পরেই স্বয়ং অনুভাদি মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন।

        "আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো ? খারাপ ঘটনা গুলো নিয়ে teacher's room এ ঝড় না তুলে, কিছু তো করার কথা ভাবতে পারেন !! আমাদের সবার যৌথ ভাবনায় ভালো কিছু হতে ও তো পারে। আমরা তো সকলেই ভবিষ্যতের নাগরিক গড়ার কারিগর।সেই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েই তো এই কর্ম বেছে নিয়েছি।হ্যাঁ অবশ্যই এ আমাদের রুজি রূটির মাধ্যম।কিন্তু আমরা এসবের প্রতিবাদ তো করতেই পারি, এমন মেজাজ না হারিয়ে।আর প্রতিবাদের ভাষার হিংসাত্মক হওয়ার কোন দরকার আছে কি ? আপনারা কি বলেন? "


লালিমা আর ঋতুপর্ণা সমস্বরে বলে ওঠে "কি ভাবে প্রতিবাদ করব দিদি ? What's app এ ছবি সরিয়ে, না মোমবাতি মিছিল করে ? লাভ হবে এভাবে? " অনুভাদি স্মিত হাসি ছড়িয়ে বললেন -" তন্ময় , তুমি তো ইতিহাসের ছাত্র।তুমি ই এর উত্তর দাও।ঘৃণ্য কাজের প্রতি সরব হওয়ার মাধ্যমটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সরব হওয়াটা।প্রতিবাদের ভাষা যুগে যুগে একই।প্রকাশ ভঙ্গি পৃথক।না হলে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কারাবাস হোতো না।সক্রিয় সংগ্রামে অংশ না নিয়ে ও অনেক কবি, লেখক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।এর নজির তো ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে।" 

তন্ময়, সম্মতি জানায় অনুভাদির কথায-"ঠিক বলেছেন দিদি, সারা বিশ্বের বিপ্লবের ইতিহাস তো তাই বলে।" অনুভাদি বলেন -" একদমই তাই। আর লালিমা আর ঋতুপর্ণা আপনাদের দুজনকেই বলছি what's app এ ছবি সরানো ও একটা প্রতিবাদ।আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সামনের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তো বর্তমানের এই সব হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাটক বা নৃত্য/গীতি আলেখ্য করতে পারি। এবছর এখনও পর্যন্ত এনিয়ে কোনো আলোচনা , সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।প্রতিবারের মত এবারও rest out হওয়ার পর ই হবে আলোচনা।এবছর এ ধরনের কিছু করা যায় কিনা দেখুন না !!! কি বিপাশা তুমি কি বলো ? আমাদের ছাত্রছাত্রীরা পারবে না ?

 বিপাশা স্কুলের cultural committee এর সদস্য, সে এগিয়ে আসে, " দিদি ঠিক বলেছেন, এটাই হোক এ বছর আমাদের স্কুলের তরফে ছোট্ট শুরু।এই মঞ্চ ই হয়ে উঠুক আমাদের প্রতিবাদের মঞ্চ। " খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ে বিপাশা।যার প্রকাশ ঘটে তার কথায়।অনুভাদি বিপাশাকে আরো উৎসাহিত করেন -" এই তো চাই বিপাশা। আমরা সবাই মিলে প্রতিবারের মত এবারও খুব সুন্দর একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব। আপনাদের আলোচনা আমাকে বিষয় নির্বাচন করতে সাহায্য করলো, কি বলেন ?"

                   লালিমা, বাড়ি ফিরে, রাতে খাবার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়ার পর প্রান্তরকে স্কুলের আলোচনার আদ্যোপান্ত শোনায়।প্রান্তর খুবই উৎসাহ দেয়।লালিমার গতকালের ভারাক্রান্ত মনটা যেন একটু উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, বলে-" জানো প্রান্তর, বাবাদের অফিসের 9/10 জনের একটা ছোট দল ছিল। বাবা বলতেন "অণু দল"।বাবা ই নাম দিয়েছিলেন " ভাষা"।একটা সময় "ভাষা" নানাধরনের পারিবারিক, সামাজিক, বিশ্বজনীন সমস্যা নিয়ে পথনাটিকা করত ।"

এবার প্রান্তরের অবাক হবার পালা-" তাই নাকি ? দারুন তো ! বলনি তো কখনো !!!" লালিমার দৃষ্টি অতীতের মাঝে হারিয়ে যায়, বলে-" আসলে সে সব আমার ছোট বেলার কথা, ওই সব নাটকের ছোটখাট মহিলা র চরিত্র যখন থাকত তখন "ভাষা"র কোন না কোন সদস্যের সহধর্মিণী বা বোন বা মেয়ে সমস্যার সমাধান করে দিত।মা ও এক দুবার অভিনয় করেছেন।"প্রান্তর কপট রাগ দেখায় -" আর কি কি লুকিয়ে রেখেছ বলো তো ঝুলিতে ??"

লালিমা একটু হাসে, প্রান্তরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে-" কিন্তু শেষ পর্যন্ত "ভাষা" বন্ধ হয়ে যায়। আসলে কয়েকজন বদলী হয়ে যান, আর প্রকাশ জেঠা হঠাৎ ই মারা যান। উনি রাস্তা য় নাটক করার অনুমতি পত্র জোগাড় করতেন, ওনার সাথে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিচয় ছিল।নাটকের script কিছুটা বাবা , বাকিটা লিখতেন রমেশ কাকু। সে সব বাদ দাও, আসলে পরবর্তী কালে কাজের চাপ বাড়ে, সাংসারিক না না দায়িত্ব বাড়ে সকলের ই। প্রাথমিক উত্তেজনা , উৎসাহে ভাটা পড়ে, সব মিলিয়ে "ভাষা" থেমে যায়।তবে সে সময় বাবা খুব upset হয়ে পড়েছিলেন।পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। মায়ের কাছে হয়তো এখনো "ভাষা"র পথনাটিকার ছবি, script কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এবার যেদিন যাব, বলব মাকে।"

"আচ্ছা, বাবা, ওই পথ নাটিকাতে গানের ব্যবহার করতেন ?"-প্রান্তরের প্রশ্নে লালিমা বলে -" হ্যাঁ, বাবার গানের প্রতি আকর্ষণ তো তুমি জানো ই, আর কি সুন্দর যে গাইতেন। নাটকের বিষয় অনুযায়ী গান নির্বাচন করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুল গীতি ই বাবার পছন্দের শীর্ষে থাকত সবসময়। অন্য গান ও যে নেওয়া হোতো না , এমন নয়।আসলে ছোটবেলার কথা অত মনে নেই, তবে বাবা বলতেন অনেক কিছু, আমি বড় হবার পর।" একটু থেমে লালিমা বলে-" আমার তো বাবার হাত ধরেই গান শেখা।গানকে ভালোবাসা।"-লালিমার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

"লালি, এতো সুন্দর তোমার গানের গলা ! বাবা চলে যাওয়ার পর তুমি কেন গান করা বন্ধ করে দিলে ? এটা ঠিক নয় লালি।আমি বলছি, আবার শুরু করো।"

"ঠিকই বলেছ।আজ অনুভাদির কথায় খুব উৎসাহ পেলাম। বাবা চলে যাওয়ার পর গান করতে বড়ো কষ্ট হয় গো, অনেক কথা মনে পড়ে যায়।"--লালিমার গলা বুজে আসে।

প্রান্তর, লালিমার হাত নিজের হাতের ভেতর নিয়ে অল্প চাপ দেয়, বলে-"বাবা যেটা তোমায় দুহাত উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তা অবহেলা কোরো না।তুমি এগিয়ে যাও লালি।আমরা সকলেই আছি তোমার সাথে।আর মনে রেখো প্রতিবাদ মানে ই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রক্তপাত নয়। শিল্পী মনের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হবে।তাই তো শিল্পী মন সবার থেকে স্বতন্ত্র।কিন্তু এভাবে ই সব অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে হবে।ফলের আশা করে ই প্রতিবাদ করে যেতে হবে।প্রত্যাশিত ফল না পেলে ও প্রতিবাদ থামালে চলবে না।"

"আর এভাবে এই প্রতিবাদের ভাষা সবার মাঝে ছড়িয়ে যাবে।রূপকে ও এই আদর্শে আমরা মানুষ করব। গুরুজনকে সন্মান করার সাথে সাথে মেয়েদের সন্মান করার শিক্ষা দেবো।সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করব অন্তত......" লালিমার কথার বলিষ্ঠ প্রকাশ ভঙ্গি প্রান্তরের দৃষ্টি এড়ায় না। সে ও লালিমাকে সব রকমের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয় মনে মনে।

@শুচিস্মিতাভদ্র







স্মৃতি টুকু থাক

                                                          স্মৃতিটুকু থাক

সমুদ্রের জলে ফসফরাস থাকে, তাই এত রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাড়ে জলরাশির আছড়ে পড়া এত দূর থেকেও রত্নাকর দেখছেন।একের পর এক ঢেউ আসছে, আবার আসছে, আবার আসছে........।অবিরাম এর কোনো শেষ নেই। এখন রাত প্রায় দুটো, রত্নাবলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কিন্তু রত্নাকরের আজ ঘুম আসবে না ।

কী অদ্ভুত নাম "রত্নাকর"।বাবা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ? এই প্রশ্ন করলে শুধু হাসতেন, কোনো উত্তর দিতেন না । স্কুলে, কলেজে , বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র বন্ধুরা নামকরণ করে করে দিয়েছিল।এমনকি কলেজের মানব স্যার ও দস্যু রত্নাকর বলে সম্বোধন করতেন। এক এক সময় খুব অভিমান হোতো বাবার ওপর। আর কী অন্য কোনো ভাল নাম ছিল না !!!! একদিন কাছে ডেকে মানব স্যার বলেছিলেন "নামে কিবা আসে যায় !!! যে রত্নাকর সেই তো মহা কবি বাল্মীকি, তা কী ভুলে গেছো ?" 

খুবই শান্ত শিষ্ট ছিলেন। রত্নাবলী র সাথে যখন বিয়ে হলো, তখন বাসরে শ্যালিকারা নামটি নিয়ে মজা করার সুযোগ ছাড়েনি মোটেই। 

যাইহোক এই বছর ফাল্গুন মাসে তাদের বিয়ের সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হল।সেই দিনে ও দুজনের কেউ ই জানতেন না যে ভবিষ্যৎ এ কী অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য।


"কাল রাতে ঘুমাওনি না গো ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে রত্নাকর একটু অবাক হন। "তুমি কি ভাবো, আমি কিছুই টের পাবো না ?" রত্নাবলীর প্রশ্নে, একটু অসহায় লাগে রত্নাকরের। চায়ের কাটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখেন। হোটেলের বারান্দা থেকে ভোরের সমুদ্রকে একবার দেখে নেন। বলেন-- "ঘুম আসছিলো না, আর আজই তো ফেরার ট্রেন, তাই ভালো করে রাতের নির্জন সমুদ্র কে দেখছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো ।তুমি রাগ করলে রত্না ?

রত্নাবলী হেসে ফেলে, আবার মায়া ও হয় । ভাবেন--এরপর কি হবে? এত সংবেদনশীল মানুষটার মনটাকে কে বুঝবে? কিন্তু না; এসব কোনো কথাই তিনি বলেন না।তাহলে যে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। এবারের ভ্রমণে কোনো মন খারাপের কথা বলা চলবে নাযে।এমন কথা তো এখানে আসার আগে দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তবু ও মনের উপরে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন দুজনেই। খুব স্বাভাবিক।আসলে আজ ই তো তাদের ঘরে ফেরার দিন। ট্রেন সন্ধ্যায় ।এই হয়তো তাদের একসাথে কাটানো শেষ ভালো কিছু মুহূর্ত।হয়তো ই বা ভাবছেন কেন ? এটা ই তো তাদের শেষ ভ্রমণ।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে, স্বামীর দিকে তাকান রত্নাবলী। সেখানেও কষ্টকে চাপা দেওয়ার কষ্টকর প্রয়াস দেখতে পান।কিন্তু এমনটা আজ কেন হচ্ছে কে জানে ? এখানে কি আসার পর থেকে গত চারদিন তারা দুজনে যা আনন্দে কাটালেন, তা মনের মণিকোঠায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মনের জোরে কিছুটা ঘোরাফেরা ও করেছেন গত কয়েকদিন।

বিগত মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করেই রত্নাবলী অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাঝে মাঝে মধ্যেই ভীষণ হাপিয়ে যাচ্ছিলেন।নিছক হার্টের সমস্যা ই ভেবেছিলেন।কিন্তু না না রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও কিছুই সঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না।ওনারা নিঃসন্তান।কাজেই সব রকম ছুটোছুটি করে রত্নাকর ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন।কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি।শেষে নানা রকম পরীক্ষা র শেষে ডাক্তার সন্দেহ করেন যে রত্নাবলীর শরীরে কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধি আশ্রয় নিয়েছে। যেদিন সেই রোগ সম্পর্কে ডাক্তার সহ ওনারা দুজনেই নিশ্চিত হন, সেদিন রাতে রত্নাকর খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। এক নিমেষে যেন বয়সটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।

রত্নাবলী কাছে এসে , রত্নাকরের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিলেন--"এসো আজ আমরা একে অপরকে একটা প্রতিশ্রুতি দিই।" অবাক চোখে রত্নাকর তাকিয়ে ছিলেন, রত্নাবলী আবার বলেছিলেন ---"তোমার এমন হেরে যাওয়া , অবসন্ন মুখ আমি দেখতে চাই না।তুমি তো কিছু লুকোওনি আমার কাছে , আমি তো সবটা জানি, কাজেই এই দিন গুলো একটু অন্য ভাবে কাটাই আমরা । চলো না গো , আমরা বিয়ের পর পর যে সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম , সেখানেই আবার যাই।"

"কিন্তু রত্না তোমার শারীরিক কষ্ট. ......" রত্নাকর কে থামিয়ে দিয়ে রত্নাবলী বলেছিল-"শারীরিক কষ্টের জন্য যা করণীয়, ওষুধ পথ্য সব চলুক তাতে আপত্তি করিনি তো ! কিন্তু মন ভরে একটু ঘুরে আসি আমরা দুজন।"

রত্নাকর আপত্তি করেননি।ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেই মতো সব বন্দোবস্ত করেই তারা চলে এসেছিলেন কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে।অসুস্থতা সম্বন্ধে কাউকে বিশেষ জানাননি।কি হবে ? অহেতুক মানুষজনকে বিব্রত করার ঘোর বিরোধী ওরা দুজনেই।

শুধু আসার আগে নিজেদের কাছেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন যে, এ কদিন কোনো দুঃখের ছোঁয়া যেন তাদের ধারে পাশে না থাকে। শারীরিক কষ্ট তো কিছু আছেই, থাকবে ও , কিন্তু তা যেন তাদের আনন্দে আঁচড় কাটতে না পারে ।

রত্নাকর , রত্নাবলী নামের দিক থেকে আশ্চর্য মিল।তাদের দুজনের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত এসেছে আর পাঁচ জনের মতো ই ।দুজনের অনেক মিল, অমিল জীবনে চলার পথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।এবার বোধহয় দ্বৈত জীবনের ছন্দপতনের সময় এসে গেছে।

ওনারা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের " বোঝাপড়া" কবিতার বিখ্যাত কটি লাইন মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।খুব সহজ নয় বটে, তবে অসম্ভব ও নয়---"মনে রে আজ কতো যে, ভালো মন্দ যাহা আসুক, সত্য রে লও সহজে।"

@শুচিস্মিতাভদ্র

তরুণ তুর্কি

                                                                       তরুণ তুর্কি 

                                                                   শুচিস্মিতা ভদ্র


পল্টন , ঘন্টাই , গুণগুণ, রুণি, পুটাস, পটাই , মাম্পা এমন সব অদ্ভুত নামীদের নিয়েই "তরুণ তুর্কি" যাত্রা শুরু করেছিল বছর তিনেক আগে । তবে ভাগ্যিস এ সব এদের ডাক্ নাম । তো যে কথা হচ্ছিল ..... "তরুণ তুর্কি" কি কোনো খেলার দল ? নাকি কোনো ক্লাব ? নাকি সমাজ সেবা মূলক সংস্থা ?? 

হযবরল যারা পড়েছ , তারা তো সকলেই কাক্কেশ্বর কে চেনা , তারা তো বুঝতেই পারছো যে এই প্রশ্নের উত্তরে কাক্কেশ্বর কি বলতে পারে ?? একদম ঠিক ধরেছ , উত্তরটা হতো .... " হয়নি হয়নি ফেলে ।" 

সত্যিই ডাহা ফেল ।" তরুণ তুর্কি" হলো গিয়ে ঘনঘটা দত্তরায় ওরফে ঘটাদার কোচিং সেন্টার। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনীর কয়েকটা বিষয়ের পঠনপাঠন হয় এখানে । এখনকার সব বোর্ডের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়েই গড়া এই তরুণ তুর্কি বাহিনী । তবে এক বিশেষ কারণ জন্য ছাত্র ছাত্রীর স্রোত বয়ে চলে না এখানে । 

কেন ???? আসলে এখানে পড়াশোনার সাথে সাথে আরো কিছু বিষয় প্রাধান্য পায় , বলা ভাল পড়াশোনার আগে সেই সব বিষয়ের অবস্থান। আর সেই কারণে ইদানিং কালের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় সামিল কোচিং সেন্টার গুলোর থেকে এই তরুণ তুর্কি অনেকটাই পিছিয়ে।তাতে অবশ্যি ঘটাদা আদেও বিচলিত নয় । তার এক কথা , আগে প্রকারের বাড়বৃদ্ধি হোক , যুব সমাজ প্রকৃত মানুষ হোক ..... বাকি সব ওর পিছন পিছন হয়েই যাবে । যদি ভালো মানুষই না হলো , তো গাদা গাদা নম্বর বগলদাবা করে , উচ্চপদের মোটা টাকার চাকরি বাগিয়ে কি হবে ?? 

কিন্তু এমন ভাবনায় গা ভাসালে যে হাতে হ্যারিকেন ধরতে হবেই ..... এমন ভাবনায় ভাবিত মা , বাবার সংখ্যাধিক্যের জন্যই ঘটাদার তরুণ তুর্কির সংখ্যা কমের দিকেই । তো ভি আচ্ছা । ঘনঘটার মতে উচ্চমার্গের ভাবনা সবার জন্য নয় । তাই যেমন চলছে চলুক। পড়াশোনা কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই হয় এখানে। ঘনঘটা বিজ্ঞানের ছাত্র। সে আর তার এক বন্ধু নির্বিঘ্ন মিলে বিজ্ঞানের দিকটা দেখে । স্ত্রী নীপা পড়ায় বাংলা ।ঘনঘটার এক খুড়তুতো বোন আছে , সে পড়ায় ইংরেজী। বাকি অন্যান্য বিষয় এখনো কিছু পড়ানো হয় না । খুব বেশী নয় ছাত্রছাত্রী , তাই অসুবিধা নেই। তবে এখানকার ছাত্রছাত্রী মানে ঘটাদার তরুণ তুর্কিদের যেটা অবশ্যই জানতে হয় , না জানলে এখানকার তুর্কি হওয়াও নাকচ হয়ে যাবে হয়তো বা ..... তা হলো প্রত্যেককে প্রত্যেকের ভালো , খারাপ, পছন্দ অপছন্দ সমান ভাবেই গ্রহণ করতে হবে , জানতে হবে । নিজের বিষয় কম জানলেও চলবে । ঘটাদা বলে ..... ' প্রত্যেকে আমরা পরের তরে বুঝলি রে ?? তোরা এখন একান্নবর্তী পরিবার মানে joint family এর ব্যপারটা জানিসই না। যে সময়টা এখানে থাকবে তখন অন্তত "আমি আমি" ভাবনাকে চাবি বন্ধ করে সবার জন্য ভাববি , না হলে এখানে আসবে না , বুঝলি !!!! '

পড়ার দিন ছাড়াও রবিবারের সকালের ঘরোয়া পরিসরে চলে "খোলা হাওয়া " নামের আড্ডা বৈঠক ।সেখানে পড়ার বাইরের কথা হয়। একমাত্র ঝাঁপ বন্ধ থাকে বিশেষ কোন কারণজন্য আর পরীক্ষার মরসুমে। ওই দিন ভাগযোগ করে গল্প, গান, কবিতা পাঠ , খাওয়া সব রকম চলতে থাকে । কখনো নীপা বৌদি চটজলদি কিছু না কিছু খাবার বানিয়ে ফেলে তুর্কিদের জন্য। তরুণদলও কখনো বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসে, কখনো একদমই খালি মুখে গল্প চলে আর মোড়ের বঙ্কিমদার দোকানের মুড়ি চানাচুর তো হাতের পাঁচ আছেই। 

নীপা বনগাঁ লাইনের হাবড়াতে একটা সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা আর ঘনঘটা আপাতত কোচিং নিয়েই ব্যাস্ত , বলা ভালো ব্যতিব্যাস্ত । বেশ কয়েকটা বেসরকারী চাকরিতে হাত পাকালেও , ওই প্রকারের উন্নয়নের চক্করে পড়েই সব চাকরিতে ফুলস্টপ পড়েছে। তাতে অবশ্যি ঘটাদা আদেও চিন্তিত নয়। কোচিং তরুণ তুর্কির তুর্কিদের আত্মিক উন্নয়ন বা প্রকারের বাড় বাড়ন্তের ভাবনা নিয়েই তার দিন কেটে যায় । পড়াশোনার উন্নয়ন নিয়ে বেশি ভাবিত নীপা আর ঘনঘটার বোন আহ্লাদিনী। ননদ বৌদি মিলে সেদিকে যা যা করণীয় তার যথাসাধ্য ব্যবস্থাপনা করে । ঘটাদাও থাকে সেসবের , তবে তার এক কথা -- ' আগে মানুষ হতে হবে মানুষের মতন , প্রকার শানাতে হবে। তারপর বাকি সব ..... ।'

নীপা বৌদি বলেন -- ' বুঝলাম , কিন্তু পড়াশোনা ছাড়া শুধুমাত্র প্রকার দিয়ে এযুগে কিছু হয়না । ' 

' তেমন তো একবারও বলিনি , তুমি অন্তত অন্যদের মতন , আমার ধ্যান ধারণার অপব্যাখ্যা করো না । ' -- রেগে জবাব দেয় ঘটাদা।

অধিকাংশ সময়ের মতনই এই তর্ক বিতর্কের সমাধানে আহ্লাদিনী হাল ধরে -- ' তোমরা দুজনেই ঠিক । কিন্তু দাদাসোনা, প্রকার যে উন্নত করবে , তার জন্য কি ওরা কিছু করছে ? মানে আমি বলতে চাইছি যে তুমি কি বোধদয়ের পাঠ জাতীয় কিছুর ক্লাস নাও ? যদিও আমি বেশি দিন এখানে যুক্ত হইনি , কিন্তু কিছু তো তেমন দেখিনি । তাহলে সে সব হবে কি করে ? বা আদেও ওমন উন্নতি কি ওদের কিছু হচ্ছে ? ' 

' তোরা সব বুদ্ধির জাহাজ , পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে বসে থাকিস !!!! ' ----মেজাজকে নিজের আয়ত্ত্বে আনার চেষ্টা করে আহ্লাদিনীর দাদাসোনা। 

' ক্লাসে এসব পড়াবো ?? বই নিয়ে বোঝাবো কি ভালো আর কি মন্দ ? আর বই এর ভারি ভারি কথা শুনে ওদের মনের প্রসার ঘটবে , প্রকারের উন্নয়ন হবে ???'--- বিরক্তি চাপা থাকে না ঘনঘটার উত্তরে।

ননদ বৌদি দুজনেই দৃষ্টি বিনিময় করে ....... ঘনঘটার দৃষ্টি এড়ায় না, মুখে হাসি খেলে যায় ‐--- ' আমি পড়ানোর মধ্যে গল্পের ছলে ওদের অনেক গম্ভীর বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করি । পাঠ্য বই তো জ্ঞানের বাণীতে ঠাসা । ওর বাইরে যদি একই ভাবে ওসব শোনাতে যাই , ওরা তো পালাবে । ভালো লাগবে না , মনে দেবে না , তাই সব বুঝতেও পারবে না । গল্পের ছলে , জীবনের থেকে, পারিপার্শ্বিক থেকে , বাড়ির থেকে , আমাদের থেকে সব দেখুক, বুঝুক ,তারপর শিখুক। সব যে ভালো শিখবে , তা নয় , কিন্তু নিজে বুঝে যেটা মনে করবে গ্রহণ করুক। আমাদের কাজ আমরা করি , তারপর দেখা যাবে। আমরা কোন পথ দেখলাম, সেটা অনেকটা matter করে। '

একটু থেমে দম নিয়ে নেয় ঘনঘটা , জল খেয়ে আবার শুরু করে --- ' আমাদের এই "তরুণ তুর্কি " এর ট্যাগ লাইন জানিসই, সকলকে সকলের সবটা জানতে হবেই। দোষ গুণ সব। আর শুধুমাত্র জানা নয় , মানতে হবে , মানাতে হবে । আমাদের কাছে সবাই সমান হবে। কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকা চলবে না । মেধা সবার সমান নয় , গ্রহণ ক্ষমতাও সমান নয়। যে যেমন বুঝবে , যতবার বলবে বুঝিয়ে দেবো । নম্বর যে যেমন পাবে , সেটা তার নিজের অর্জিত। আর রেজাল্ট বেরোনোর আগেই জমজমাট সেলিব্রেশন করব আমরা সবাই। কারণ ভালো নম্বর, খারাপ নম্বরের পক্ষপাতিত্বকে এড়ানো মুশকিল। কিন্তু আমাদের তরুণ তুর্কিরা যেন মুখ ভার না করে। '

নীপা বৌদি চোখ গোল করে বলে ----- ' দেখেছ তো !! তোমার দাদাসোনার প্ল্যান । এভাবে কোন কোচিং সেন্টার চলে ? লাটে উঠবে বলে দিলাম। ব্যবসা করতে আমিও বলছি না । কিন্তু কিছু তো মানবে !! সেদিন স্কুলের মুখার্জি দা বলছিলেন.....'কি হে তোমাদের তরুণ তুর্কি কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা ছাড়া অন্য বিষয়ে নাকি বেশি জোর দেওয়া হয় ? এটা সত্যিই নাকি ? ' 

                                                                            ***************


আহ্লাদিনী মাস দুয়েক এখানে পড়ানো শুরু করেছে । আসলে সে পাকাপাকি ভাবে কোনও চাকরিতে এখনো যোগ দেয়নি , এখন সে নানা ধরণের কম্পিটেটিভ পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে । দাদাসোনার অনুরোধে এখানে পড়ানো শুরু করেছে । পড়াতে ভালই লাগছে । বেশ কড়া মেজাজের আহ্লাদিনীর, নামের সাথে প্রকৃতিগত মিল একদমই নেই। ঘটাদার তুর্কিরা এরই মধ্যে একটা নামকরণও করে ফেলেছে । সেটা যদিও আহ্লাদিনী জানে না । তবে নীপাবৌদি আর ঘটাদা একদিন শুনে ফেলেছে ......... আহ্লাদিনীর অপভ্রংশ লাদিনী , সেখান থেকে কড়া মেজাজের জন্য লাদেন ম্যাম। ঈশ্ !!!! পারেও বটে । শুনে মুখ লুকিয়ে ঘনঘটা হেসেও ফেলেছিল। তবে তুর্কিদের সামনে মেকি গাম্ভীর্যে মুখ ঢেকে নিয়েছিল। ওরাও কিছু বুঝতে পারেনি।

' আচ্ছা বৌদি তুমি মাঝে মাঝেই কেন বলো এখানে সব লাটে উঠবে ? পড়াশোনা তো ভালোই হচ্ছে ।' ..... আহ্লাদিনীর প্রশ্নে নীপার মুখে কৌতুক খেলে যায় , বলে ..... ' শোনো এই যে শনিবার করে ওরা খোলা হাওয়া খায় , মানে ওই যে আড্ডার আসর বসায় , এমন কোনও কোচিং সেন্টারে কখনো দেখেছ বা শুনেছ ? সরস্বতী পুজো আর কোনও একটা , দুটো সেন্টারে একটা বিজয়া মিট , এই তো পালন হয়। এসবের জন্য তোমার দাদাসোনার তুর্কি বাহিনীর গার্জেনরা না আবার গর্জন করেন !!!! ' 

ঘটাদা ফুৎকারে নীপার কথা উড়িয়ে দেয় --- ' এমন গর্জন এখনো কানে আসেনি আর ছুটির দিনে অন্য রকম আড্ডা না দিয়ে , ওরা যে এখানে মিলিত ভাবে হৈচৈ করে , তাতে বরং ওনারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। কারণ এখনকার প্রজন্মের আড্ডার ধরনের বেশ বদল হয়েছে , অনেকক্ষেত্রে আবার সঙ্গীর রকম ফেরে তা স্বাস্থকর আড্ডাও নয়। আর by the way তুমিই তো খুব উৎসাহের হাওয়া দিয়ে , "খোলা হাওয়া" নাম দিলে । তবে এখন উল্টো গান ধরলে কেন ? ' 

নীপা মৃদু হাসে, কথোপকথন চলতে থাকে .... ' কিন্তু দাদাসোনা , ওদের নিজস্ব পরিসরে , আমাদের সব সময় থাকাটা তো সুস্থ নয়। " 

' থাকি না তো !!! আর যার যেমন সুবিধা , তেমনই আসে , কোনো জোরাজুরি নেই। নিজেরা মজা করে ,গল্প, গান চলতে থাকে , কখনো ওরাই ডাকে , কখনো অল্প যোগ দিয়ে , চলে আসি । ' 

আহ্লাদিনী আশ্বস্ত হয় কিছুটা । নীপা বৌদি সংশয় প্রকাশ করে -- ' কিন্তু এখনকার প্রজন্ম বড় বেশী আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর, ওরা কতটা তোমার ভাবনার কদর করবে , আমার সন্দেহ হয় ।'

' ওরা আমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা , কিন্তু সেটা শুধুমাত্র নেতিবাচক এটা আমার মনে হয় না । ওদের মধ্যে ভালোমন্দের বোধের থেকেও প্রতিযোগিতার দৌড়ে সামিল করিয়ে দেওয়ার ঝোঁকটাই আমাদের প্রজন্মের গুরুজনদের মধ্যে বেশি। ' .-- ঘটাদার গলায় হতাশা ঝরে পড়ে।

' প্রতিযোগিতা কবে ছিল না বলো দেখি ? '----- নীপার কথা ঘনঘটা হাত তুলে থামিয়ে দেয় ----- ' সুস্থ প্রতিযোগিতা এখন কোথায় নীপা ? একজনের ভালো নম্বর দেখে তার সতীর্থ হিংসা করছে , সেখানে আমরা বাঁধা না দিয়ে ইন্ধন জোগাতে ব্যস্ত। সুস্থ প্রতিযোগিতা তো ভালোও, আবার উপকারীও। আমার আর ইন্দ্র মধ্যেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা ছিল স্কুলে , তারপর কলেজেও , কিন্তু কোনো হিংসাত্মক ভাবনা সেখানে কাজ করতো না । কখনো নম্বরে ইন্দ্র এগিয়ে , আবার কখনো আমি । ' ----- স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে ঘনঘটা ।

ঘটাদার যুক্তি অকাট্য। তার মতে , তার ভাবনা অনুযায়ী অল্প কজনই যদি জীবনে পথ চলে , তাই চলুক না , সবাই যে সব গ্রহণ করবে এমন তো নয় !!!! 

                                                                  ****************

 " শীতের হাওয়ার লাগল নাচন " --------- বড় দিনের ছুটি পড়ে গেছে স্কুলে আর ঘটাদার " তরুণ তুর্কি কোচিং সেন্টার " - ও কদিনের জন্য ছুটি। ছুটির দিন গুলোর নিস্তব্ধ ঘটাদা , নীপা বৌদির ভালোই লাগে না । তবে শনিবারের "খোলা হাওয়া "-তে ওরা ইচ্ছে করলেই আসতে পারে , তবে এসময় ছুটির মেজাজে , পিকনিকের হল্লায় বেশিরভাগই কোন তুর্কির আগমন ঘটে না । ঘনঘটা কোন এক অজ্ঞাত কারণজন্য এদের নিয়ে অন্য কোথাও পিকনিকের আয়োজনে রাজি নন । আর কোচিং সেন্টারে আর আলাদা করে পিকনিক করার কথা কারো মাথায় ও আসেনি , কারণ ওদের সবার মুক্তির ঠিকানা , খোলা হাওয়া তো আছেই ।

এবার আহ্লাদিনীও কদিনের জন্য দুই বন্ধুর সাথে ছুটি কাটানোর জন্য শান্তিনিকেতন গেছে।

' চলো না , আমরা কদিন কোথাও ঘুরে আসি ।' ---- নীপার কথায় দাদা নড়েচড়ে বসে।

' গেলে হয় , কিন্তু আগাম ব্যবস্থা না করে তো এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। একটা ছুটি পেলেই তো সবাই দে ছুট......সব বুকিং আগে থেকেই Done । ' ঘনঘটা স্বগোতোক্তি করে।

' যা বলেছ !! তবে চলো একদিনের জন্য দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি , কতবার যেতে বলে !! ' ... নীপাবৌদি ইচ্ছা প্রকাশ করে।

হঠাৎ বাইরের গেটের শব্দে দুজনেই তাকিয়ে দেখে তরুণ তুর্কির কজন তুর্কি বাগানের গেট খুলে ঢুকছে , চোখে মুখে উদ্বেগ আবার উত্তেজনার মিশেলে অদ্ভুত অভিব্যক্তি । ঠিক ধরতে পারে না তারা , নীপা বৌদি উঠে আসে ।

' কি রে তোরা ? পল্টন তোর আজ বাড়িতে বড় দিনের অনুষ্ঠান আছে না ? ( পল্টন খ্রীষ্টান) আর রুণির তো আজই ধানবাদ যাওয়ার কথা !! আর বাকি তাদেরও তো কি সব হল্লাহাটির গল্প বলেছিলি । তো সে সব বাদ দিয়ে তোরা এখানে হাজির হয়েছিস যে !!! ' .... নীপা বৌদির প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই ঘটাদা চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে ..... ' আহ্ !! কি শুরু করলে ? এসেছে বেশ করেছে ।ওরা না আসলে আমার যে কিছু ভালো লাগে না , তা তো তোমার অজানা নেই। ওদের আসতে দাও আগে । পরে কথা হবে ।' 

ওরা ছয়জন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ী করে , ঘরের ভিতর ঢুকে একটু ইতস্তত করে শেষমেশ পল্টন বলে .... ' স্যার , একটা বিপদ ঘটে গেছে ' ----- ঘটাদা , বৌদি দুজনেই শঙ্কিত মুখে ওদের দিকে তাকায় ---- ' না মানে গুণগুণ তো পিসির বাড়ি গিয়েছিল , শান্তিনিকেতনে , ওখানেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, বাঁ হাতে প্লাস্টার করতে হয়েছে ।' 

' সেকি রে ? বেড়াতে গিয়ে কি বিপদে পড়ল !! আর কোথাও কোন চোট নেই তো ? তা তোরা কি দল বেঁধে ওখানে যাবি ? ' .... ঘটাদার প্রশ্নে , এবার মাম্পা উত্তর দেয় .... ' না স্যার, এতজন মিলে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয় । গুণগুণের পিসির বাড়ি যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই , আর এই ছুটির হিড়িকে কোন হোটেলে ঘর ফাঁকা পাবো না , আর সপ্তাহ খানেক পর ওরা গাড়ি ভাড়া করে ফিরেও আসবে , গুণগুণ বলছিল। তবে আমরা আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়েই এসেছিলাম। ' 

ইতস্তত করতে থাকা মাম্পাকে আশ্বস্ত করে নীপা বৌদি ---- ' এতো না ভেবে বলেই ফেলো । রাখার মতন হলে রাখব , না হলে রাখা যাবে না ..... এই তো ব্যাপার । এর বাইরে তো আর কিছু হবে না !! ' 

তুর্কিদের যে কোন ব্যাপারে ঘটাদা খুব সংবেদনশীল। নীপাকে থামিয়ে .... ' আহ্ !! আগে তো অনুরোধটা শুনি !!! বাকি কথা পরে হবে । বল্ তো কি বলছিস ? ' 

রুণি বলে ওঠে ... ' স্যার , আমরা সবাই যদি ছুটির কদিন রোজ কোচিং ক্লাসে বসে গল্প করে ভিডিও কলের মাধ্যমে গুণগুণের মন খারাপটা একটু কমাতে পারি , তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে ? Please please বৌদি , স্যার একটু দেখুন যদি হয় । ' 

রূণির আদুরে আবদারে পল্টন চোখ পাকায় , ভুন্টাই বলে .... ' দাঁড়া , স্যারকে কিছু বলতে দে , যদি কোন অসুবিধা না থাকে , তাহলে......নয়তো....

ঘটাদা নীপার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে, পল্টনের দিকে ফিরে বলে ------ ' বাঃ , দারুণ ভেবেছিস তো ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। কি বলো নীপা ? তবে তোদের তো সবারই কিছু না কিছু ফিক্সড প্রোগ্রাম ছিলো , তার কি হবে ? '

নীপা তার স্বামীকে খুব ভালোই চেনে , কাজেই সে বুঝতে পারে , তরুণ তুর্কিদের এমন একটা ভালো সিদ্ধান্তে তার আপনভোলা ছাত্রছাত্রী পাগল ঘনঘটা কি পরিমান খুশি হয়েছে !!! তুর্কিদের এমন প্রকারগত উন্নয়নের স্বপ্নই তো ঘনঘটা সব সময় দেখে।

' স্যার , বাড়ির সবার জন্য সেসব বজায় থাকছে , আর আমরা তো এখানেই সবচেয়ে বেশি মজা করব। রুণি ওর ঠাকুমার সাথে বাড়িতেই থাকছে , ধানবাদে যাবে না , আমাদের মধ্যে শুধু প্রলয় আর রেহান ওদের কলেজ পিকনিক ক্যান্সেল করতে রাজি হল না ।' ..... পল্টনের রাগ চাপা থাকে না ।

' পল্টন হাতের প্রতিটা আঙুল সমান হয় না । তবে প্রয়োজন সবগুলোরই। ওরা আজ একটু অন্যরকম ভাবে ভাবছে , হয়তো একদিন ওরা তোমাদের মতোই বন্ধুর জন্য ভাববে । রাগ করো না ।'.... নীপা বৌদি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করে। 

ঘটাদাও একই ভাবে বলে - ' ওসব নিয়ে ভাবিস না , তোদের লাদেন ম্যাম এখন শান্তিনিকেতনে , গুণগুণের পিসির বাড়ির ফোন নম্বর টা দিস , দেখি ওকে বলি , একবার যোগাযোগ করতে, পারলে দেখা করে আসবে না হয় ।' 

পল্টনদের দল তাদের স্যারের মুখে ম্যামের ওই তাদের দেওয়া নামের ব্যবহার দেখে কোনদিকে পালাবে ভেবে পায় না আর নীপা ও ঘনঘটা সমস্বরে হেসে ওঠেন । তুর্কি বাহিনীও মাথা চুলকে হেসে ফেলে ।


                                                                 *****************************


২/৩ দিন পর , রাতে খাওয়ার পরবর্তী পাঠ মিটিয়ে , নীপা ঘরে ঢুকে দেখল ঘনঘটা খাটে বসে বই পড়ছে । নীপাকে দেখে ঘনঘটা বইটা বন্ধ করে , নীপা মৃদু হেসে খাটে এসে ঘনঘটার উল্টোদিকে বসে।

' কি মশাই মন মেজাজ তো বেশ খুশি খুশি দেখছি '---- নীপার কথায় সম্মতি জানায় ঘটাদা -- ' হ্যাঁ , ছুটির কদিন বেশ ভালোই কাটলো । আসলে কি জানো !!! আমার তুর্কিরাই এ বাড়ির প্রাণ ভোমরা , বুঝলে ?? ' 

' সে আর বলতে ? তবে তুমি এবারে আরো খুশি হয়েছে ওদের এই সিদ্ধান্তে । ' --- নীপা বলে।

' একদম ঠিক বলেছ নীপা , দেখলে তো এ প্রজন্মকে অযথা দোষারোপ না করে , সঠিক দিকে ওদের চালনা করতে হবে আমাদেরই। যুগ বদলেছে, সবটা আগের মতন নেই। কিন্তু ভালোমন্দের বোধের সব কালেই এক।তার অদল বদল হয়নি। তবে সবাই আমার মত মানবে না , ঠিক আছে , অল্প কজনকে যদি শেখাতে পারি , তাই অনেক। ' 

' ঠিক বলেছ, তবে কি জানো ? তরুণ মন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুভূতি প্রবণ হয় , ছোট মনের পরিচয়বাহী হয়না সাধারণত। ব্যাতিক্রম সব সময়ই আছে । সে কথা থাক, কিন্তু জটিলতা বাড়ে বয়সের সাথে সাথেই। ' --- নীপা

' কথাটা মানছি নীপা , কিন্তু মূল ভাবনা যদি সঠিক হয় , আর তা যদি ছোট থেকেই , বিশেষ করে তরুণ মনে ঠিক মতো প্রথিত হয়ে যায় , তা রয়েই যায় । জটিলতা তাকে সাময়িক ভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে , দেয় ও, কিন্তু উপড়ে ফেলতে পারে না ।আমাদের সকলের মধ্যেই ভালো খারাপ দুইয়ের সহবস্থান আছে। কিন্তু কাকে মাথায় বসাবো , তার শিক্ষা গ্রহণ করতে করতেই আমরা বড় হই । এখানে পরিবেশ , পরিস্থিতির যেমন ভূমিকা আছে , তেমনই ভূমিকা আমাদের সকলের , যাদের ঘিরে ওরা বড় হচ্ছে । ' --- ঘনঘটা।


" তরুণ তুর্কি" এর তুর্কিরা এমন ভাবে প্রকারে বেড়ে উঠুক ---- ঘনঘটা দত্তরায়ের স্বপ্ন পূর্ণতা পাক। ব্যতিক্রম ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তরুণ ছাত্রদল নতুন যৌবনের দূত হয়ে হাল ধরে গড়ে তুলুক আদর্শ সমাজ । প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাত ধরে তারুণ্য হয়ে উঠুক অমর , চিরন্তন ও শাশ্বত মূর্তি ।।



                                                                    ¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤¤