Monday, 3 July 2023

বেড়াতে গিয়ে মজারু ৪০

পৃথিবী যে গোলাকার তার প্রমাণ কিছু না কিছু ভাবে মিলতেই থাকে। কন্যার বান্ধবীর মায়ের পরিচিত এক কাশ্মীরের বাসিন্দার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল ওখানে যাওয়ার বেশ কয়েক মাস আগে । পরে জানা গেল , আমাদের বেড়ানোকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারী সুমিত দা ( ট্রাভেল গাইড ) ওনার পরিচিত । আর আমাদের অজান্তেই আমরা নাজির ভাই এর হাউস বোট ও তার পাশের হাউসবোট বুক করেছি , সুমিত দা র মাধ্যমে । নাজির ভাই  , অনুত্তমার ( কন্যার বান্ধবীর মাতৃদেবী ) রেফারেন্সে আমাদের সাথে শ্রীনগর পৌঁছনোর পরের দিনেই ব্যক্তিগত ভাবে এসে হোটেলে দেখা করেন । আমরা ওখান থেকে ফেরার পরেও যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি এখনও।  

আমরা আমাদের লটবহর নিয়ে শিকারা চালকদের খানিক হাসির খোরাক সাপ্লাই করে দুখান শিকারা চেপে ডাক লেকের রাজকীয় হাউসবোটে আসীন হলাম । হাউসবোটে পৌঁছেই বিষন্নতার সুর বেজে উঠল কারণ একখান হাউসবোটে ৬ জনার বেশি থাকার উপায় নেইকো । তাই আমরা টিম ১১ দু ভাগে ভাগ হয়ে পাশাপাশি দু খান বোটে থাকার বন্দোবস্তে ন্যাস্ত হলাম। ছোট দুই বান্ধবীর হাই মাউ আর থামেই না , হেনকালে আমার মুশকিল আসান কর্তামশাই দুই সখীকে আস্বস্ত করল এই বলে যে আলাদা থাকলেও রাতে একসাথে গপ্পো করে খ্যাটন পর্ব মিটবে । দুই সহচরীর মুখের হাজার বাতির ঝিলিক আসতে না আসতেই বাতিল হল ওখানকার কর্মচারীদের হাউমাউ শুনে ... এবার তারা যা বললে তাতে নিজ্জস বুঝলাম যে ৬ এর বেশি মানুষের ওজন হাউসবোট সইতে পারে না । সংখ্যার বাড়াবাড়িতে জলের ওপরের বদলে ভিতরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা প্রবল । অতএব মুখের মেঘ নিয়ে দুই সখী দুই বোটের ঘরে প্রবেশ করল । 

রাজকীয় কাশ্মীরি কাঠের আসবাব , গালিচা সব কিছু নিয়ে কামাল করা অন্দরসজ্জা দেখে মনে আর মেজাজেও একখান রাজকীয় ব্যাপারেও আনাগোনা হতে লাগল । মেজাজে তা দিতে দিতেই দেখি ধুমায়িত গাঢ় দুধের চা হাজির সাথে কিছু মিষ্টি বিস্কুট। অনেক দিন পরে শরীর তখন নিজের দখলে ফেরত এসেছে ... ঘোরাঘুরির ২য় দিন থেকেই সে বেজায় ব্যাজার হয়ে পড়েছিল । আরাম করে চা পান করতে করতেই শুনলাম... ছোটগিন্নির সাথে আমরা কজনা স্হলে যাব ... শেষ মুহূর্তের ফাইনাল কেনাকিনির জন্য। আমার গেঁড়ি পত্রপাট পাশের হাউসবোটে সিঁধিয়ে গেল তার বান্ধবীর কাছে। ওদিকের বোট আর আমাদের বোটে যাওয়ার কমন পথ আছে একখান ...  জলের ওপরে ডেকের সাথে তা যুক্ত। 

অতএব আমরা ৫জন আবার জল পেরিয়ে স্থলে হাজির হলাম , হামলে পড়ে বাদ বাকি কেনা কাটা সামলে নিতে ।আমার কর্তামশাই ভয়ানক দরদাম করার পক্ষের লোক । সে দামাদামি শুরু করলে দোকানদারের করুণ মুখ দেখে সত্যিই আমার মায়া লাগে । আর বলতে নেই ওমন রাশভারী ওজনদার মানুষকে চট করে কেউ ঘাঁটায় না , ফুটপাতে তো বটেই খোদ সরকারী এম্পোরিয়ামেও সে তার দরদামের বাতজিৎ এ বাজিমাত করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিল এবার । কেনার পর্ব মিটিয়ে আমরা চললাম পেটে চালান করার মতন কিছু সান্ধ্যকালীন আহারের বন্দোবস্ত করতে । যদিও সন্ধ্যা তখন গড়িয়ে রাতের দিকে যেতে শুরু করেছে । সব যখন জোগাড় হল তখন আবার জল পেরিয়ে হাউসবোটে ফিরে এলাম। এতদিনের ঘোরাঘুরির ফলে সকলেই তখন বেশ ক্লান্ত ... 

জলে থুড়ি জলের ঘরে হাজির হয়ে দেখি রাতের খাবার রাজকীয় ডাইনিং টেবিলে সুসজ্জিত। সান্ধ্যকালীন আহারের জন্য যে সব খাবার  স্থল থেকে আনা হয়েছিল তাও ডিনারে যুক্ত করে তাদের মুক্তির পথ খুললাম । ছোটগিন্নিও ওদিকের খাবার ঘর সাজিয়ে ফেলল। আমরা যার যার হাউসবোটে রাতের খাবার খেতে বসে গেলাম । রাতের মেনুতে ভাত , তরকারি , রুটি , ডাল আর চিকেন হাজিরা দিচ্ছিল টেবিলে । সাথে ছিল সতেজ স্যালাড আর আমাদের আনা তন্দুরী চিকেন । 

 খেতে বসে ভাত আর ডালের অনবদ্য যুগলবন্দীতে মনে হল মাছে-ভাতে যেমন বাঙালির প্রমাণ মেলে , তেমন প্রমাণ ডালে ভাতে বাঙালিতেও মজুত।  যেখানেই যাই বাঙালি ডালে ডালে চলে , মানে খেতে গিয়ে ডাল খোঁজাখুঁজি করে ... বাঙলার বাইরে কালি ডাল / ডাল মাখানি আর ইয়লো ডাল বলে যা মেলে তা আর যাইহোক বাঙালির চিরাচরিত স্বাদের ডাল সে নয় । তবুও তা দিয়েই রসনাকে রসিয়ে নেয় তারা। কিন্তুক এই জলের ওপরের জলীয় ডাইনিংরুমে আমরা যেন এক যুগ পরে  ( যদিও মোটে এক সপ্তাহ) বাঙালি ডাল পেলাম এবং খেলাম । ডাল লেকের মহিমা নাকি মনের ভুল !!! বোঝা দুষ্কর।  পরেরদিন আমাদের ফেরার গল্প লেখার কথা । তার আগে আছে সব কিছু সুন্দর করে মাপে মাপে খাপে খাপে ভরে গুছোগুছির পাট । সেই মতন খাওয়ার পর আমাদের এক একজনের ব্যাগ পত্তরের ডালা খুলে মেলে ধরে হিসেব কষে কষে কাজ গুছিয়ে তুললাম তুলনামূলক মধ্য রাতে । রাত নিঝুম দাও না ঘুম ... বলার মতন সময় এগিয়ে এসেছে অনেক আগেই , আমার কন্যা তখন মোটাসোটা নরম গরম ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে ঘুমন্ত রাজকুমারী হয়ে নিদ্রামগ্ন। আমিও ঘুমের দেশের পথ ধরলাম । ধরার আগে একটু ফোনে মন দিলাম, এক খান গোটা সপ্তাহ শেষ করে ... সেদিনই প্রথম wifi এর সাথে যুক্ত হতে পেরেছি। আগে উপায় থাকলেও নিজে ছিলাম উপায়ের খোঁজাখুঁজি আর বোঝাবুঝির উর্ধ্বে। জলের ওপরে ঠাণ্ডার প্রকোপ কিছুটা বেশি হলেও তখন তা খানিক সয়ে গেছে । আর ওমন রাজকীয় পরিবেশে আমার কিন্তু বেশ মেজাজের সাথে ঘুম এসে পড়ল । এদিকে তিনি ভারী খুঁতখুঁতে, তাই নানা রকম খুঁতখুঁতানি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন । নিস্তব্ধ কনকনে ঠাণ্ডার রাতের বুক চিরে আসা অল্প শব্দও ভীষণ হয়ে তার ঘুমন্ত মোডকে জাগন্ত করে দিচ্ছিল । কাঠের মেঝেতে চলাচলের শব্দেও সে জেগে উঠছিল।  এক সময় ঘুম জাগরণের পালা মিটিয়ে ভোর হল । আরো কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে ডাল লেকের ভোর দেখলাম, যাকে কোন মতেই ডাল বলা যায় না। সকলে তখনও ঘুমের মাঝে , আমি ক্যামেরাসহ হাউসবোটের ডেকে আসীন হয়ে খানিক  মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করলাম, বাদবাকি থাকল মনে বন্দী হয়ে । এরপর যথা নিয়মে চা ও জলখাবারের পর্ব মিটিয়ে আমরা লেকের জলে ভেসে পড়লাম শিকারা রাইডে।  রকম বেরকম স্পটের লিস্টি নিয়ে আগেই দরদাম হয়ে গিয়েছিল । ঘন্টা দেড় দুই ঘুরে ফেরার কথা পাকাপোক্ত হয়ে ছিল আগেই।  দুলকি চালে শিকারা চড়ে বিনা কসরতে ভেসে চলতে তখন বেশ লাগছিল । কারণ সারা ঘোরাঘুরির শেষ পর্বে এসে শরীরের অন্দরমহলে তখন ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভুর সুর শোনা যেতে শুরু করেছে ।  একে একে পশরা সাজানো ভাসমান ও চলমান দোকানপত্র পাশে পাশে সাথে সাথে হাজিরা দিতে দিতে চলল । অবাক হবার কিছুই নেই শিকারাতে আসীন হয়ে দোকানপাটের ঢালাও আয়োজন আছে এই জলের মাঝেই।  এমনকি ওখানে কাশ্মীর কি কলি সাজার ও তার স্মৃতি টুকু থাক সম সাজনগোজনের ছবি তোলার বন্দোবস্তও ভেসে ভেসে হাজির হল । কিন্তুক কি ছবি , কি খাবি ( খাবার )  তখন পকেটের দিকে তাকিয়ে সবই মায়া ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না । দুলকি চালের গতিটা বেশ লাগছিল।  একে একে পেরিয়ে গেল ফ্লোটিং পোস্ট অফিস, ফ্লোটিং মার্কেট, ফ্লোটিং গার্ডেন, মীণা বাজার । এখানে কোন কোন হাউসবোট বিখ্যাত হয়েছে দূরদর্শনের ধারাবাহিক ( গুল গুলসন গুলফম) ও নানা চলচ্চিত্রের দাক্ষিণ্যে সে সবও দেখা সাক্ষাত হল । এরপর ফ্লোটিং মার্কেটের এক ড্রাই ফ্রুটের দোকানে নেমে পড়লাম ... ওর্ডারী কিছু কেনাকেনির জন্য। বিশাল দোকানে থরে থরে সাজানো অসংখ্য শুখা ফলের সম্ভার । শুধুমাত্র চোখে দেখা আর কেনা নয় ... সাথে ছিল চেখে দেখার সুযোগ । তবে ঘরের জন্য অল্প কিছু আর পরের জন্য আনতে দেওয়া শুকনো ফলের সাথে আমার রান্নাঘরের জন্য হিঙ আর কাশ্মীরের বিখ্যাত লাল লঙ্কা ( রঙের জন্য বিখ্যাত) কিনেছিলাম শুধুই চোখে দেখার বিনিময়ে। ওসব চেখে না দেখাই ভাল।  পরে সময় মতন চেখে দেখার জন্যই তো আনা ... তাই না ???😄 

এরপরে ছিল ঘরে ফেরার নতুনত্ব হীন পর্ব । আমরা দুলকি চালে ভেসে ভেসে হাউসবোটে ফিরে ফাইনাল প্যাকিং শেষ করে আবার স্থলের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়লাম। লটবহর নিয়ে ঘাটে ওঠার পর দেখা গেল দূরের হাইসবোটের ডেকে আমাদের আহেরীর সুন্দর গোলাপী রঙের ব্যাগপ্যাক খান একা একা বিষন্ন চেহারা নিয়ে এদিক পানে চেয়ে বসে আছে .... আবার বকাবকি আর ফোনাফুনির পাট চুকিয়ে সে তার মালকিনের জিম্মায় হাজির হল । আহেরীর মুখে হাসি ফুটল। খানিক অপেক্ষার পর ইমরাণের টেম্পো ট্রাভেলারে চড়ে  সব বোচকা সহ আমরা রওনা দিলাম ... প্রথমেই দুপুরের খাবারের পাট মেটানোর জন্য ডাল লেকের সামনের বুলেভার্ড রোডের ওপরে অবস্থিত এক হোটেলে সবাই নামলাম। পেট পূজোর পর এগিয়ে চললাম এয়ারপোর্টের পথে। ফেরার পথের খানা তল্লাশি গাল ভরা গল্প আগেই কানে এসেছিল পাড়াতুত নীলাঞ্জনাদির মারফত  .... এবারে তার খাস মহলে প্রবেশ করলাম। বাক্স প্যাটরা , আণ্ডা বাচ্চা সহ প্রত্যেকের আপাদমস্তক পাট পাট করে তল্লাশি এয়ারপোর্ট ঢোকার আগে পরে মিলিয়ে প্লেনে ওঠা ওবধি ক্ষেপে ক্ষেপে হতেই থাকল ৪/৫ বার , তখন আমরাও মনে মনে ক্ষেপে গেলেও কিন্তুক  চেপে আছি সে সব । এ সবের মাঝে স্ক্যানারে ধরা পড়ল আমার ব্যাগে নাকি নারকেল ???? কয় কি ?? সে আবার কি কথা ??? পরে শুনি পেপার পাল্পের তৈরি ছোট ছোট কানের দুল রাখার জুয়েলিরী বক্স ( যা টোকন স্বরূপই কেনা হয়েছিল ) নাকি ওমন ইম্প্রেশন দিয়ে মাত করেছে । অথচ একই স্ক্যানার আমার দিদি আর ছোটগিন্নির কৌটো ধরতে আপারগ। স্ক্যানারের কি মহিমা !!!! বোঝো কাণ্ড।  বেশ ইচ্ছে হলে ধরে আর ইচ্ছে হলে ছাড়ে 😊😊 

এ সব পেরিয়ে অনেক অপেক্ষার পর আকাশ পথ ধরে ফেললাম। মাঝপথে চণ্ডীগড়ে প্লেনে বসেই অপেক্ষার পালা মিটিয়ে আরো কিছু নেমে যাওয়া প্যাসেঞ্জারের সীট ভরে নিয়ে আমরা কলকাতার দিকে উড়তে শুরু করলাম । দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে গপ্প ও ঘুম সব ঝালিয়ে নিল । সময় মতন আমরা ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে এলাম । 

শরীরের অবসন্নতা সত্ত্বেও মনে অনেকখানি তরতাজা , টাটকা বাতাস নিয়ে ঘরে ফিরলাম । আজ পেরিয়ে গেছে প্রায় মাস তিনেক ... তাও মনে হয় ... এই তো সেদিন আমরা ভূস্বর্গের মাঝে ঘুরছিলাম আনন্দে ।

@শুচিস্মিতা ভদ্র