বেড়াতে গিয়ে মজারু ৩৯
পরেরদিন সকালে সব গুছিয়ে , তা গাড়িতে সাজিয়ে শ্রীনগরের চারদিকের বাদ বাকি ঘুরে দেখার স্হান দেখতে চললাম সকলে মিলে , আমাদের যার যা বরাদ্দ সে জলখাবার গলধঃকরণ করে নিয়ে। চুপি চুপি বলি ছোট গিন্নিরা শ্রীনগরে এসেই ইংলিস ব্রেকফাস্টে ফিট করেছিল নিজেদের। শুরুর পরে পরেই চিড়েতে ভিড়লেও ব্রেক নিয়েছিল কিছু পরে । এদিকে আমরা এ যাত্রায় চিড়েতন কে সাথেই রেখেছিলাম। শুরুর দিন আর শেষ দিন বাদে চিড়ে তে চিড় ধরতে দিইনি ।
শ্রীনগরের সৌন্দর্যে আকুল ব্যাকুল ছিলেন মুঘল বাদশাকূলের অনেকেই। তাদের প্রতিষ্ঠিত বাগ বাগিচার মোটে একখান দেখা হয়েছিল শ্রীনগরে ঘোরার শুরুতে । বাকি গুলো না দেখলে কি আর আমাদের ঘোরাঘুরি শ্রী যুক্ত হয় ? লিস্টি মোতাবেক আমরা বাগ বাগিচাগামী হলাম । এবারেও খানিক পথ পেরিয়ে টিউলিপ বাগানের কাছেই আমাদের ছেড়ে ইমরাণ তার বাস নিয়ে জায়গা মতন সরে পড়ার পর , আমরা আটো ধরে পাহাড়ের চড়াই পথ ধরে ফেললাম।
শ্রীনগর পৌঁছনোর পর হোটেলের বারান্দা থেকে দৃশ্যমান এক পাহাড়ের মাথায় একখান কেল্লা দেখে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করার ইচ্ছে চাগিয়ে উঠলেও পরে ইচ্ছেটাতে তা দেওয়া যায়নি , কারণ ছানবিন করে জানা গেল ওটি মুঘলাই কেল্লা হলেও , এখনকার রাজা অর্থাৎ সরকারের আওতাধীন।
আপাতত কেল্লা ছেড়ে বাগানের পথ ধরে , বাগানের দোরগোড়ায় হাজির হলাম । শুনলাম এখানে খান দুয়েক মুঘল গার্ডেন দেখে আমরা অন্য আরেক মুঘল গার্ডেন এর দর্শন করব । সব শেষে ডাল লেকের পাশে অবস্থিত পবিত্র স্হান হজরতবাল মসজিদ দর্শন করে সেদিনের মতন জলচর হব অর্থাৎ স্বপ্নের সফরের আরেক স্বপ্ন সফল করতে হাউসবোটে আসীন হব। প্রথম ক্ষেপে আমরা হাজির হলাম পীর মহল নামধারী মুঘল গার্ডেনে যা লোক মুখে পরিচিত পরি মহল নামেই। কোথায় পীর আর কোথায় পরি এ সব আলোচনায় না গিয়ে আমরা সরাসরি বাগানে ঢুকেই পরি সাজতে লেগে পড়লাম ছুড়ি ও ধাড়ি সবাই। একে একে কাশ্মীর কি কলি ক্যামেরা বন্দী হতে লাগল । ছোটি, মোটি , নাটি সব রকম কলি সেদিন পরি মহলে ঘোরাঘুরি করলেও , কলকাতায় সব ফিরেছি কাশ্মীর সে কালি হয়ে ... জয় মা 🙏🏻। পরি মহলেও ধাপে ধাপে হাঁপ ধরার ব্যাপার ছিল । সে সব ধাপে ওঠার বায়না যে ধোপে টেকসই হলো না , এমন অপবাদ শত্তুরেও দিতে পারবে না । সব রকম ধাপ ঘুরে আমরা বাগান থেকে বেরিয়ে অটো চড়ে উতরাইতে আরেক বাগ চশমেসাহিতে হাজির হলাম রোদ চশমা লাগিয়ে .... তখন রোদের তেজ না হোক , বেশ খোলতাই হয়েছিল। তবে আমরা এখন কলকাতায় যে রোদের সাথে মোলাকাত করি তার কাছে এ নেহাতই শিশু। অটো থেকে নেমেই আমরা সকলে সফ্টি খেয়ে গরমে আরাম পেলাম । স্বপ্না কাকিমা চশমেসাহীর সিঁড়িতে আর ভিড়লেন না , কোমরের ব্যাথা তো ছিলই সাথে । ওখানেও বাগানের মাঝের ফুল , ফোয়ারা , রকমবেরকমের নাম না জানা গাছের শোভায় মুগ্ধ হলাম । সকলে এখানেও খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে দু ধাপ পেরিয়ে বাগানে ধপাস হলাম । সাদা ফুলে ছাওয়া গাছের সামনে , পাশে হেলে , দুলে একা , সকলে বেশ কতক ছবি তোলার পর মন খুশ হয়েছে কি না হয়েছে , হঠাৎই দেখি ক্যামেরা আর ছবি তুলছে না !!!! আনন্দ হঠাৎই ভুস করে ডুবে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেল। এক দিকে ছবির ছড়িয়ে থাকা বিষয় আর অন্য দিকে ক্যামেরার হরতালে মাথায় তখন করতাল বাজতে শুরু করেছে । এর মধ্যেই এই বাগিচার ফোয়ারার উৎস স্থলে ছবি তোলার হিড়িক তখন তুঙ্গে । দলে দলে ছবি তুলিয়ে লাইনে । আমরাও হাজির হলাম , মৌমাছির চাক বাঁচিয়ে ছবি জিন্দাবাদ হল মোবাইলের হাত ধরে । এদিকে মন তখন ক্যামেরা শোকে উথাল পাতাল !!! ছবি তোলা হয়েছে অগুন্তি ... সে গুলো কি গেল ? এই আতঙ্কে মন বিষন্ন। কারণ আমাদের মুম্বাই দর্শনের সময় এই গোলযোগে কত কেতাদুরস্তু ছবি মাঠে থুড়ি ক্যামেরাতেই শহীদ হয়েছিল ... বলার নয় । মেট্রো গলিতে ক্যামেরা বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েও সে সব উদ্ধার হয় নাই ।
সামনেই ভিন্ন প্রদেশের একজনকে পাকড়াও করে ভয়ানক হিন্দিতে সমস্যা ব্যক্ত করলাম ... তিনি খানিক ছানবিন করে যা বললেন ... বুঝলাম ... ক্যামেরা ছবির ভারে ভারাক্রান্ত। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই কেস । তবে তিনি কিছু অদরকারী ছবি বাতিল করার সুপরামর্শ দিলেন । অথবা বাগানের বাইরের দোকান থেকে আরেকখান মেমরি কার্ড কেনার আরেক রকম উপায় বাতলে দিলেন । এ সবে আমার কর্তামশাই দিলদরিয়া ... কিন্তুক ক্যামেরার দোকানের মালিককে খুব একটা কফিডেন্ট লাগল না এ ব্যাপারে । আর আমাদের কাছে কার্ড বিক্রির থেকে বাগানে আগত টুরিস্ট দের কাশ্মীর কি কলি বেশে র ছবির দ্রুত প্রিন্ট আউট বের করতেই তার ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে । অগত্যা আমরা, ক্যামেরা যেটা আমার কাছে বড়ই আদরের , তাকে পরের হাতে দেওয়ার বদলে নিজের ব্যাগে যত্ন করে ভরে ফেললাম । এরপরের পর্ব পেটপূজো সংক্রান্ত। সকলে সেদিন দক্ষিণী ধোসায় কাশ্মীরি মধ্যাহ্ন ভোজন সমাপন করলাম। এরপর গেলাম আরেক শাহী বাগ শালিমার বাগে। সেখানে সকলে নামলেন না । মেরা প্যায়ার শালিমার গানের কলি গুনগুন করতে করতে সেই বাগে আগুয়ান হলাম ... কিন্তু মেরা প্যায়ারে তখন মেরামতির কেরামতি দেখাচ্ছে কারিগরবৃন্দ। এখানে বাঁশ সেখানে দড়ির ফাঁস সব টপকে খানিক খানিক দেখা সাক্ষাত হল । এখানে ধাপের চাপ নেই । সমতল বাগানে নানা রকম ফুলের ছড়াছড়ি। ছবি তোলার পর আকাশ পানে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম কজনা ... কারণ তখন ঈশাণ কোণে মেঘ জমেছে , মনের মধ্যে গানের কলিও বদলে গেছে ..." মেঘ কালো আঁধার কালো .... " এবারে আমাদের টেম্পো ট্রাভেলার চলল ডাল লেকের পাশে অবস্থিত হজরতবল মসজিদ দর্শন করতে । আকাশের মুখ ভার তখন কেটেছে বটে , তবে দিনের শেষ হওয়ার রঙ লেগেছে তার চোখে মুখে। কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির পাশ কাটিয়ে আমরা মসজিদ চত্বরের সামনে নামলাম । ভিতরে নারী ও পুরুষের আলাদা আলাদা দিকে ভাগ করা অঞ্চল ঘুরে আমরা সকলে ডাল লেকের পাশে চলে এলাম। কনকনে ঠাণ্ডাতে হাল বেহাল হলেও আস্তে ধীরে সইয়ে নিতেই হল । ছবি তোলা বাকি ছিল তো ??? সবার ছবি তোলার জন্য এখানে খোদ কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির কজন ছাত্রীকেও পেয়ে গেলাম । ছোটগিন্নি চোস্ত হিন্দীতে ওদের সাথে নানা বিষয় বার্তালাপ করে ফেলল। জানা গেল ভূস্বর্গ ছেড়ে ওরা কোনদিন কোথাও যায়নি বেড়াতে। আসলে সুন্দরের মাঝে যাদের বাস , তারা সুন্দরের খোঁজে কেনই বা বেরবে ??
দেখাদেখির পর ফিরতি পথে ছোটখাটো কিছু খরিদারী মিটিয়ে আমরা দুই গিন্নি বাকিদের নিয়ে ডাল লেকের যে দিকে আমাদের হাউসবোটের অবস্থান , সেদিকে এগিয়ে চললাম। ঘাটের ধারে আমাদের পাহাড় প্রমাণ লাগেজ দেখে শিকারা চালকেরা চোখ কপালে তুলে বেশ ঘোট পাকালেও আমরা হাসি দিয়ে সব ঢাকা দিলাম । প্রথমে সামান তারপর টিমের তামাম সকলে দুলকি চালে দুখান শিকারা চড়ে ডাল লেকের জলে ভেসে পড়লাম। এত সুন্দর একখান লেক কেন যে ডাল হবে কে জানে ? নামের নিশ্চিত কোন না কোন সুন্দর ব্যাখ্যা আছে , যা আমার অজানা ।